Ajker Patrika

সামর্থ্যের মধ্যে প্রয়োজন মেটাতে ফারজানার উদ্যোগ

ফিয়াদ নওশাদ ইয়ামিন
ফারজানা আফরিন। ছবি: সংগৃহীত
ফারজানা আফরিন। ছবি: সংগৃহীত

সন্ধ্যার আলো ছড়ানোর পর থেকে শহরের ঘরগুলো পায় অন্য রূপ। কেউ টিভির নাটকে হারিয়ে যায়, কেউ বসে যায় আড্ডার চক্রে। কিন্তু একই শহরের এক নীরব ঘরে শুরু হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক সন্ধ্যা। ফারজানা আফরিন তখন নিজের অবসরের ভাঁজে লুকিয়ে থাকা অলসতা দূরে সরিয়ে নতুন পথ খুঁজে নেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে টুকটাক সঞ্চালনার ব্যস্ততা এবং গৃহিণী জীবনের দায়িত্ব সামলে তাঁর ভেতরের আরেক মানুষ সব সময় জেগে ছিল মানুষের জন্য কিছু করার ইচ্ছা নিয়ে। নিজের নামে কিছু গড়ে তোলার স্বপ্ন আর সমাজের বাস্তব চাহিদা বুঝে কাজ করার তাগিদ তাঁকে পর্যায়ক্রমে উদ্যমী করে তোলে।

যাত্রা শুরুর গল্প

একদম শুরুতে ফারজানা একটি মেলায় ঘরে তৈরি খাবারের দোকান দেন। কিন্তু তাঁর মন টানত দেশীয় পোশাকে। রঙিন কাপড়, ব্যাগ আর বিভিন্ন হস্তশিল্পের প্রতি নিজের ও ক্রেতাদের আগ্রহ তাঁকে নতুন করে ভাবতে সাহায্য করে। সেখান থেকে বিভিন্ন দেশীয় পণ্য সংগ্রহ করে মেলায় বিক্রি শুরু করেন তিনি। এদিকে সঞ্চালনা চলছিল নিজের ছন্দে। প্রতিটি অনুষ্ঠানেই নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন মানুষ, নতুন অনুপ্রেরণা। মেলা ও সঞ্চালনার কাজ করতে করতেই তিনি নিজের জীবনের একটি সিদ্ধান্ত নেন। নিজের এবং পরিবারের জন্য আফতাবনগরে ‘ফারজানা বুটিকস’ নামের একটি শোরুম খুলে ফেলেন।

শুরু হয় তাঁর জীবনের নতুন এক অধ্যায়। অনলাইন নয়, ভরসা অফলাইনেই ফারজানার কাজের ধরনটা একটু ভিন্ন। যে যুগে মানুষ আশ্রয় খুঁজছেন অনলাইনে, তখন ফারজানা ভাবছেন অফলাইনের কথা। অর্থাৎ এমন একটি জায়গা থেকে তিনি ব্যবসা শুরু করবেন, যেখানে মানুষ পণ্য দেখে-শুনে-বুঝে তারপর কিনতে পারবে। তিনি নিজের ব্যবসা বাড়াতে কখনোই অনলাইন ব্যবহার করেননি। ফেসবুকে খোলেননি পেজ। ফারজানা বলেন, ‘একজন উদ্যোক্তাকে অফলাইনে মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়, গ্রাহকদের চাহিদা বুঝতে হয়, সমস্যার সমাধান খুঁজে তাদের সাধ্যের মধ্যে পণ্য পৌঁছে দিতে হয়। এটাই ব্যবসা ও উদ্যোক্তার মধ্যে মূল পার্থক্য।’ সেই পার্থক্যই তাঁকে অন্য সবার থেকে আলাদা করে দিয়েছে।

পণ্যের বিক্রি বাড়াতে ফারজানা পেজ না খুলে ঘুরেছেন মেলায় মেলায়। সেখানে বসে শুনেছেন বিভিন্ন নারীর কথা। তাঁদের জীবনের গল্প আর ব্যবসার কথা। বুঝেছেন ক্রেতাদের চাহিদা। এরপর শোরুম করার কথা ভেবেছেন। যেখানে পণ্য থাকবে সব শ্রেণির মানুষের চাহিদা পূরণের জন্য। মেলায় অংশ নেওয়ায় তাঁর মধ্যে আত্মবিশ্বাস জেগেছে।

শোরুম নিয়ে ভিন্ন চিন্তা

ফারজানার শোরুমের মূল উদ্দেশ্য অন্যদের মতো নয়। তাঁর চোখে ব্যবসা মানে শুধু পণ্য বিক্রি নয়; মানুষের বাস্তব অবস্থা, সামর্থ্য ও প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা তাঁর অন্যতম উদ্দেশ্য। তিনি বলেন, ‘বড় করপোরেট শপে যাওয়ার সামর্থ্য যাদের আছে, তারা তো যেতেই পারবে। কিন্তু মহল্লার শ্রমজীবী মানুষ, গৃহকর্মী, দারোয়ান কিংবা সীমিত আয়ের গৃহিণী কি সেই দামে কিছু কিনতে পারে?’ এই প্রশ্ন থেকে তিনি নিজের শোরুমে রাখেন ১০০ টাকার হিজাব থেকে শুরু করে ৫ হাজার টাকার পোশাক। তাঁর কাছে লাভ নয়, মানুষ যেন খালি হাতে না ফেরে, সেটাই বড় বিষয়।

ফারজানা মনে করেন, ব্যবসা যদি ভয়ের দেয়াল টেনে রাখে, তবে সেটি মানুষের নয়, কেবল টাকার জন্য গড়ে ওঠা একটি ব্যবস্থা। তাঁর শোরুমে তাই দরজা খোলা থাকে সব ধরনের মানুষের জন্য; কেউ অপমানিত বোধ করে না, কেউ সংকোচে পড়ে না।

উদ্যোক্তা মেলা ও দেশীয় পণ্য

বিদেশি পণ্যের প্রতি ক্রেতাদের আগ্রহ থাকলেও ফারজানা বেশি গুরুত্ব দেন দেশীয় পণ্যের প্রতি। তিনি মনে করেন, দেশে অসংখ্য মানুষ কাজ করছে। সবাই দেশীয় পণ্য ব্যবহার করলে দেশের টাকা দেশেই থাকবে, শ্রমিকেরাও বাঁচবেন। এই চিন্তাধারা তাঁর ব্যবসাকে এক অন্য রকম মানবিক রূপ দিয়েছে।

উদ্যোক্তা মেলা তাঁর জীবনে বিশেষ জায়গা দখল করে আছে। সেখানেই তিনি প্রথম অনুধাবন করেছিলেন নারীদের সংগ্রাম, সাহস আর আত্মবিশ্বাস। অন্যদের পণ্য বিক্রি করতে দেখে তাঁর মনে প্রশ্ন জাগে, ‘আমি কি পারব?’ আর সেই প্রশ্ন থেকেই জন্ম নেয় তাঁর পথে হাঁটার সাহস। তিনি চান, নারী উদ্যোক্তারা যেন লাভের খাতার বাইরে এসে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেন। যেন খেটে খাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে সামর্থ্যবান—সবাই নিজেদের সামর্থ্যের মধ্যে যেন পছন্দের জিনিস কিনতে পারে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ