Ajker Patrika

শান্তিতে নোবেলজয়ী মারিয়া মাচাদো

গণতন্ত্রের অগ্রদূত নাকি হন্তারক

আব্দুর রহমান 
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

লাতিন আমেরিকার দেশ ভেনেজুয়েলার বিরোধীদলীয় নেতা মারিয়া কোরিনা মাচাদো চলতি বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। নোবেল কমিটি তাঁকে নোবেল দেওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে, ‘ভেনেজুয়েলার জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিরলস প্রচেষ্টা এবং একনায়কতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে ন্যায়সংগত ও শান্তিপূর্ণ পরিবর্তনের লড়াইয়ের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন।’

কিন্তু যে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের কারণে তিনি নোবেল পেলেন, তাতে আসলে তাঁর অবদান কতটা, তা নিয়েই উঠেছে প্রশ্ন। ২০০২ সালে ভেনেজুয়েলার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুগো শাভেজ দেশটির সম্পদ এবং ভূমি সংস্কার করে নতুন আইন জারি করেছিলেন। সেই আইন দেশটির কৃষক ও শ্রমিকশ্রেণিকে সুবিধা দিয়েছিল। সেই সময়ে শাভেজ নতুন পেট্রোলিয়াম আইন করেন। ফলে দেশটিতে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য তেল-গ্যাস উত্তোলন কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ, শাভেজের নতুন আইন অনুসারে এক্সন মবিল বা শেভরনের মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ১৬ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত রয়্যালটি দিতে হতো দেশটির সরকারকে। শুধু তা-ই নয়, শাভেজের নতুন আইন অনুসারে যেকোনো তেল বা গ্যাসক্ষেত্রের বেলায় বিদেশি বিনিয়োগে সরকারের অংশীদারত্ব থাকত ন্যূনতম ৫১ শতাংশ।

পশ্চিমা দৃষ্টিতে হুগো শাভেজ খুব একটা গণতান্ত্রিক না হলেও তাঁর করা এসব সংস্কার দেশটির সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিয়েছিল। কিন্তু ২০০১ সালে ৫৬ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার এক বছর পর, ২০০২ সালে ভেনেজুয়েলায় একটি অভ্যুত্থান হয়। তাতে ক্ষমতাচ্যুত হন শাভেজ। নেতৃত্বে আসেন ব্যবসায়ী নেতা পেদ্রো কারমোনা। তিনি এসেই একটি ডিক্রি জারি করেন, যা ‘কারমোনা ডিক্রি’ নামে পরিচিত। সেই ডিক্রিতে স্বাক্ষরকারীদের অন্যতম ছিলেন মারিয়া মাচাদো। এই ডিক্রির ফলে দেশটিতে ১৯৯৯ সালে গৃহীত নতুন সংবিধান, দেশটির সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং শাভেজের করা যাবতীয় সংস্কার বাতিল হয়ে যায়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের হারানো সুযোগ ফিরে পায়।

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এবং তৎকালীন বুশ প্রশাসন এই অভ্যুত্থানের বিষয়ে অবগত ছিল। কেবল তা-ই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের ফেরি করা প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল এনডাওমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি ভেনেজুয়েলায় যারা হুগো শাভেজবিরোধী আন্দোলনে জড়িত ছিল, তাদের অর্থায়ন করত বলে জানা গেছে সিআইএর নথি থেকে। যাহোক, সেই অভ্যুত্থান খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। মাত্র ৪৭ ঘণ্টার মধ্যেই শাভেজ তাঁর হারানো ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেন।

এরপরও যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্নভাবে মাচাদো ও হুগো শাভেজবিরোধী শিবিরকে অর্থ এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে গেছে বলে অভিযোগ আছে। কেবল তা-ই নয়, লাতিন আমেরিকার বেশির ভাগ দেশের মতো ভেনেজুয়েলাও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে এবং ইসরায়েলি দখলদারির বিরুদ্ধে ছিল। ২০০৮-০৯ সালে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের পর শাভেজ দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। কিন্তু মাচাদো দিনের পর দিন খোলামেলাভাবে ইসরায়েলের পক্ষ নিয়েছেন।

কিছুদিন আগে মাচাদো ইসরায়েলি এক চ্যানেলকে বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি এবং বলি, আমাদের সরকার ইসরায়েলে অবস্থিত দূতাবাসটি জেরুজালেমে স্থানান্তর করবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, একদিন ভেনেজুয়েলা ও ইসরায়েলের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠবে। সেটি হবে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতি আমাদের সমর্থনের অংশ।’ এখানেই শেষ নয়, মাচাদো ইসরায়েলের কট্টর মুসলিমবিদ্বেষী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দল লিকুদ পার্টির কট্টর সমর্থকও।

গত সেপ্টেম্বরে মারিয়া কোরিনা মাচাদো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্যারিবীয় অঞ্চলে ভেনেজুয়েলার সামরিক উপস্থিতি বাড়ানোর উদ্যোগের জোরালো সমর্থক হয়ে ওঠেন। তিনি ওই সময় দাবি করেন, ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরো

পুরো অঞ্চলের জন্য বড় ধরনের ‘নিরাপত্তা হুমকি।’ মার্কিন সংবাদমাধ্যম ফক্স নিউজকে মাচাদো বলেন, ‘এটা জীবন-মরণের প্রশ্ন। ভেনেজুয়েলাবাসীর জীবন শুধু নয়, আমেরিকানদের জীবনও রক্ষা করা দরকার। কারণ, মাদুরো মাদক-সন্ত্রাসবাদের এক সহযোগী কাঠামোর প্রধান।’

ফলে নোবেল কমিটি যখন গাজায় ফিলিস্তিনিদের জীবনের অধিকার অস্বীকার করা এবং নিজ দেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্রে শামিল থাকা ব্যক্তিকে ‘চ্যাম্পিয়ন অব ডেমোক্রেসি’ আখ্যা দিয়ে পুরস্কারে ভূষিত করে,

তখন প্রশ্ন জাগতেই পারে, নোবেল আসলে কাদের দেওয়া হচ্ছে!

লেখক: সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত