Ajker Patrika

গা ছমছমে পুতুলরাজ্য

ইশতিয়াক হাসান
আপডেট : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১১: ১৬
গা ছমছমে পুতুলরাজ্য

মেক্সিকো সিটির দক্ষিণে জচিমিলিকো প্রণালি ধরে নৌকায় চেপে আপনি পৌঁছে যাবেন লা আইলা দ্য লস মুনেক্স বা পুতুলের দ্বীপে। এমন নাম না পাওয়ার কোনো কারণও নেই। দ্বীপে নামার সঙ্গে সঙ্গে পর্যটকদের স্বাগত জানায় হাজারো পুতুল। কোনোটা বড়, কোনটা ছোট। কোনোটা দেখতে অদ্ভুত, কোনোটা আবার রীতিমতো বীভৎস। সবকিছু মিলিয়ে দ্বীপে প্রবেশ করার পর যদি গা ছমছম করতে থাকে, দোষ দেওয়া যাবে না আপনাকে।

দ্বীপে মানুষের স্থায়ী আবাস নেই। নেই বিদ্যুৎ কিংবা কলের পানির ব্যবস্থা। পাকা দালান তৈরি নিষেধ, কিছু দোকানপাট আছে, সেগুলো কাঠের তৈরি। আর স্থাপনাগুলোর ভেতরে কেবলই পুতুল আর পুতুল। কোনোটা দেয়ালে সাঁটানো, কোনোটা ঝোলানো। ঘরের ছাদ, গাছ এমনকি তীরে ভেড়ানো নৌকায়ও ঝুলতে দেখবেন পুতুলদের।

এই দ্বীপ পুতুলময় হওয়ার শুরু ১৯৫০ সালের দিকে। স্থানীয়দের মুখে মুখে প্রচলিত গল্প অনুযায়ী, ওই সময় একটি মেয়েশিশু এখানকার তেশুইলা হ্রদের পানিতে পড়ে যায়। ডন জুলিয়ান সান্টানা নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা শিশুটিকে বাঁচাতে ঝাঁপ দিলেও লাভ হয়নি। তারপর থেকেই মেয়েটির আত্মার প্রতি সম্মান জানিয়ে পুতুল সংগ্রহ শুরু করেন সান্টানা। অবশ্য সান্টানার অনেক আত্মীয়স্বজনের ধারণা, আসলে এমন কোনো মেয়ে ছিলই না, গোটা বিষয়টি ছিল তাঁর কল্পনা।

দ্বীপে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই দেখা পাবেন পুতুলদের।দ্বীপ ভ্রমণে টেক্সাস থেকে আসা জোসে পেরেজ নামের এক পর্যটক জানালেন, রাতে বেশ ভূতুড়ে লাগে দ্বীপটিকে। ‘আপাতদৃষ্টিতে খুব শান্ত একটি জায়গা মনে হয় একে। তবে রাতে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি হয় এখানে, মনে হয় সবগুলো পুতুল আপনার দিকেই তাকিয়ে আছে।’ বলেন তিনি।

পুতুলদ্বীপেই থাকেন ট্যুর গাইড জোসে গ্যাব্রিয়েল গনজালেজ ফ্রাংকো। জানান, নিজের বালক বয়স থেকেই ডন জুলিয়ান সান্টানাকে চিনতেন। তিনি বলেন, ‘সন্টানা মেয়েটিকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ব্যর্থ হন।’

তবে ওই দুর্ঘটনার কথা কোনো সরকারি নথিতে নেই। যেখানে মেয়েটি মারা গেছে, সেখানে সন্টানা একটি সাদা ক্রুশ পুঁতে রাখেন বলে জানা গেছে। ক্রুশ বসানোর পর দ্বীপে অদ্ভুত কিছু ঘটনা ঘটছে বলে দাবি করেন সান্টানা। তিনি নানা ধরনের ছায়া দেখার পাশাপাশি কান্না আর চিৎকার শুনতে পান। ওই চিৎকারে থাকত দুঃখের রেশ।

কোনো কোনো পুতুলের চেহারা এমন যে ভয় পেয়ে যান পর্যটকেরা।‘এখানে অস্বাভাবিক কোনো শক্তি আছে। সেটা অনুভব করতে পারবেন আপনি। তাই পুতুলের দ্বীপটি পৃথিবীর সবচেয়ে ভীতিকর জায়গাগুলোর একটি।’ বলেন ফ্রাংকো।

দ্বীপের তত্ত্বাবধায়ক ও সান্টানার ভাতিজা জেভিয়ের রোমেরো সান্তাও দাবি করেন, এখনো অস্বাভাবিক কান্না আর চিৎকারের শব্দ পাওয়া যায়। ‘রাতে জায়গাটিতে যখন ঘুরে বেড়াই, কখনো পরের দিনের পর্যটকের অপেক্ষায় থাকা কোনো সঙ্গীকে নিয়ে কম বয়স্ক কারও কান্না কিংবা গোঙানির শব্দ পাই।’

অনেকেরই ধারণা, অশুভ আত্মাদের থেকে বাঁচার জন্য সান্টানা গোটা দ্বীপময় ঝুলিয়ে দেন বিভিন্ন ধরনের পুতুল। তাঁর বিশ্বাস ছিল এমন—ভাঙা, বিকৃত সব পুতুল হ্রদে ডোবা মেয়েটি ও অন্য আত্মাদের দূরে সরিয়ে রাখে।

কাঠের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা পুতুল।‘ওই ঘটনার পর অনেক বছর বেঁচে ছিলেন ডন জুলিয়ান সান্টানা। এ সময় বন্ধুদের থেকে, আবর্জনার স্তূপসহ নানা জায়গা থেকে পুতুল সংগ্রহ করেন। এগুলোর বেশির ভাগই কদাকার, পুরোনো, ছেঁড়াফাঁড়া, পোড়া পুতুল।’ বলেন ফ্রাংকো। 

আশ্চর্য ঘটনা, এই পুতুলগুলো ঠিক করার কোনো চেষ্টা করতেন না সান্টানা। এমনকি পরিষ্কারও করতেন না। হাত-পা ছাড়া, চোখ নেই এমন অবস্থায়, অর্থাৎ যেভাবে পেয়েছেন সেভাবেই পুতুলগুলোকে ঝুলিয়ে দিতেন। এমনকি যে পুতুলগুলোর অবস্থা ভালো ছিল, রোদ-ঝড়-বৃষ্টিতে এগুলোর চেহারাও বিকৃত হয়ে পড়তে লাগল। নিজের কেবিনটাও পুতুলে ভরে ফেললেন সান্টানা। কিছু মানুষের কাছে দ্বীপটা ভয়ানক চেহারার পুতুলের একটি বিকৃত রাজ্য। অন্যরা আবার পুতুলের আশ্চর্য এই রাজ্যে আসতে লাগল এর অদ্ভুত বাসিন্দাদের দেখতে। তাঁদের স্বাগত জানাতেন সন্টানা। সামান্য অর্থ নিয়ে ঘুরে দেখাতেন তাঁর পুতুলরাজ্য।

গাছে গাছে ঝুলছে পুতুল। তো ওই যে শুরু হলো, এখন দ্বীপে আছে চার হাজারের বেশি পুতুল। কোনো পুতুলেরই নাম দেওয়া হয় না, একটি বাদে। ওটার নাম অগাস্তিনিতা। নীল রঙের পোশাক পরনে, গায়ে শোভা পাচ্ছে নানান পাথর। বলা হয়, এটি ছিল সন্টানার সবচে প্রিয় পুতুল। স্থানীয়দের ধারণা, নানা ধরনের অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল পুতুলটির। যারা তার ওপর আস্থা রাখত, তাদের উপকার করত সে। তাঁর সংগ্রহর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুতুল ছিল আগাস্তিনিতা। এটার সঙ্গে সময় কাটাতেন, কথা বলতেন, একেই নিজের রক্ষাকারী ভাবতেন। বলা হতো, আগাস্তিনা রাতে চলাফেরাও করতে পারত। আর তাই এখানে প্লেট রাখা হয়েছে আগাস্তিনাকে উপহার দেওয়ার জন্য। বলেন ফ্রাংকো।

এই দ্বীপের এবং এর  ভূতুড়ে পুতুলদের খবর পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে সময় লাগল না। বিশেষ করে রোমাঞ্চপ্রেমী আর সাহসীরা দ্বীপে আসতে শুরু করলেন এখানকার ভীতিকর বাসিন্দাদের দেখতে।
‘এখানে অন্য ধরনের কোনো শক্তির উপস্থিতি টের পাবেন। এটা ভালোও লাগবে আপনার। এটা অন্য ধরনের এক অভিজ্ঞতা।’ বলেন কলম্বিয়া থেকে আসা আইনজীবী নাতালিয়া পিঞ্জন।

পুতুলদ্বীপের ভয়াল পুতুলগুলোর মধ্যে কয়েকটি।২০০১ সালের এপ্রিলে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয় ডন জুলিয়ান সান্টানার। কোনো কোনো সূত্রের দাবি, ছোট্ট সেই মেয়েটি যেখানে মারা গিয়েছিল, সেখানেই তাঁর মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়।

মেক্সিকো সিটি থেকে ১৭ কিলোমিটার দক্ষিণে জচিমিলিকো প্রণালির ধারে এর অবস্থান। প্রণালি ধরে যাওয়ার পথে দেখা মিলবে নানা জাতের পাখি আর জলজ সাপের। অনেকের ধারণা, দ্বীপ ঘিরে যেসব অদ্ভুত আর অস্বাভাবিক ঘটনার কথা বলেন গাইডরা, সেগুলোর বাস্তব ভিত্তি নেই। তবে পর্যটকদের দ্বীপের প্রতি আগ্রহে এই ধারণা বিন্দুমাত্র ভাটা ফেলতে পারেনি। বিশেষ করে অদ্ভুত সব বিষয়ে যাঁদের আগ্রহ, তাঁদের ভ্রমণের প্রিয় জায়গা এটি। জচিমিলিকোর আশ্চর্য বাসিন্দাদের সঙ্গে দেখা করার সময় পর্যটকেরা নিয়ে আসতে পারেন নিজেদের পুতুল। দ্বীপটি এখন এতটাই জনপ্রিয় যে প্রণালির দুই পাশে দ্বীপটির অনেক রেপ্লিকা তৈরি করে রাখা হয়েছে।

সূত্র. এবিসি নিউজ, এটলাস অবসকিউরা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগদানের ঘোষণা কিশোরগঞ্জের আইনজীবীর, ফেসবুকে ঝড়

‘বিএনপি করি, শেখ হাসিনার আদর্শে বিশ্বাসী’: সেই ইউপি সদস্য গ্রেপ্তার

অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি-পদোন্নতির ক্ষমতা পাচ্ছেন সুপ্রিম কোর্ট

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর রাশিয়ার তেল কেনা স্থগিত করল চীন

পলাতক আসামিরা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না, আরপিও সংশোধন অনুমোদন

এলাকার খবর
Loading...