Ajker Patrika

অদৃশ্য আলো দিয়ে স্টারলিংকের চেয়ে ১০০ গুণ গতির ইন্টারনেট দেবে গুগল

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ১৬ জুন ২০২৫, ১৪: ৫৪
আঙুলের নখের আকারের এই চিপে সফটওয়্যারের মাধ্যমে ডিজিটাল তথ্যকে আলোক রশ্মিতে রূপান্তর করা হয়। ছবি: গুগল এক্স
আঙুলের নখের আকারের এই চিপে সফটওয়্যারের মাধ্যমে ডিজিটাল তথ্যকে আলোক রশ্মিতে রূপান্তর করা হয়। ছবি: গুগল এক্স

বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ এখনো ইন্টারনেট থেকে বঞ্চিত। আবার এমন বহু এলাকা আছে, যেখানে ফাইবার অপটিক্যাল কেব্‌ল পৌঁছানো ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। এই সমস্যার সমাধান নিয়ে এসেছে গুগলের গবেষণা ও উদ্ভাবনী ল্যাব গুগল এক্স। তারা তৈরি করেছে একটি আঙুলের নখের সমান চিপ—‘টারা’, যা কোনো কেব্‌ল ছাড়াই আলো ব্যবহার করে উচ্চগতির ইন্টারনেট পৌঁছে দিতে সক্ষম।

টারা প্রকল্পের নেতৃত্বে আছেন মহেশ কৃষ্ণস্বামী। তিনি আগে গুগলের ‘লুন’ প্রকল্পে কাজ করেছেন। আলফাবেটের উদ্ভাবনী গবেষণাগার এক্স, যা ‘মুনশট ফ্যাক্টরি’ নামেও পরিচিত, সেখানে জন্ম হয়েছিল লুন প্রকল্পের। এটি ছিল গুগলের একটি উচ্চাভিলাষী উদ্যোগ। লুন প্রকল্পে পরিকল্পনা ছিল হাই-আল্টিচিউড বেলুনের মাধ্যমে বিশ্বের দুর্গম অঞ্চলে ইন্টারনেট পৌঁছে দেওয়ার। তবে ২০২১ সালে গুগল প্রকল্পটি বন্ধ করে দেয়।

তবে লুন প্রকল্পের মূল চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি ছিল—বেলুনগুলোর মধ্যে ডেটা স্থানান্তর এবং সেখান থেকেই কৃষ্ণস্বামীর ভাবনায় আসে ‘আলো দিয়ে ডেটা পাঠানোর ধারণা’। তিনি গড়ে তোলেন একটি নতুন দল, যারা ফাইবার ছাড়াই আলো-নির্ভর উচ্চগতির সংযোগ প্রযুক্তি নিয়ে কাজ শুরু করেন। সেই গবেষণা থেকেই জন্ম নেয় ‘টারা’।

আঙুলের নখের আকারের এই চিপে সফটওয়্যারের মাধ্যমে ডিজিটাল তথ্যকে আলোক রশ্মিতে রূপান্তর করা হয়। এরপর চিপের সফটওয়্যার নিয়ন্ত্রিত আলোক উৎস থেকে ডেটার তথ্য সমৃদ্ধ আলোক রশ্মি ছুড়ে দেওয়া হয়। এভাবে ডেটা ট্রান্সফার করা হয়। গবেষণাগারে গবেষকেরা এ রকম দুটি টারা চিপ ব্যবহার করে প্রায় কয়েক কিলোমিটার দূরে ডেটা ট্রান্সফার করেছেন। গতি ছিল সেকেন্ডে ১০ গিগাবাইট।

টারা চিপ প্রকল্পের ব্যবস্থাপক মহেশ কৃষ্ণস্বামীর বলেন, এই প্রথমবার সিলিকন ফোটোনিক্স চিপ ব্যবহার করে উচ্চগতিতে এত দূর ডেটা পাঠানো সম্ভব হয়েছে।

এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো—এমন সব অঞ্চলে উচ্চগতির ইন্টারনেট পৌঁছে দেওয়া, যেখানে ফাইবার অপটিক কেব্‌ল বিছানো অত্যন্ত কঠিন, ব্যয়সাপেক্ষ কিংবা প্রায় অসম্ভব। যেমন—পাহাড়ি এলাকা, ঘন বনভূমি বা দুর্গম দ্বীপাঞ্চল। সাধারণত ফাইবার কেব্‌ল মাটির গভীরে বসাতে হয়, যা অনেক সময় ও অর্থের প্রয়োজন পড়ে। এই সীমাবদ্ধতা দূর করতেই টারা নিয়ে এসেছে আলো-নির্ভর একটি বিকল্প প্রযুক্তি, যা কেব্‌ল ছাড়াই দ্রুত, নির্ভরযোগ্য সংযোগ নিশ্চিত করতে পারে।

টারা প্রযুক্তির আরেকটি বড় সুবিধা হলো—এটি এমন আলো তরঙ্গদৈর্ঘ্য ব্যবহার করে যা ৫জি বা অন্যান্য রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ডের সঙ্গে মিলে যায় না। ফলে ব্যান্ডউইথের প্রতিযোগিতা বা সংকট থাকে না।

বর্তমানে পৃথিবীর ইন্টারনেটের মূল অবকাঠামো তৈরি হয় ফাইবার অপটিক কেব্‌লের সাহায্যে। সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে এই কেব্‌লের সাহায্যে এক দেশ আরেক দেশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।

ফাইবার অপটিকসের মাধ্যমে ইন্টারনেট পরিচালনার বড় সমস্যা হলো—এর রক্ষণাবেক্ষণ বেশ খরচ ও পরিশ্রম সাধ্য কাজ। তাই বিজ্ঞানীরা অনেক দিন ধরেই তারহীন বিকল্প ইন্টারনেটের তৈরির চেষ্টা করে আসছেন। ইতিমধ্যে ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স পরিচালিত স্টারলিংক প্রকল্পের তারহীন ইন্টারনেট সেবা চালু হয়েছে। পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে হাজার হাজার কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্যে ইন্টারনেট সেবা প্রদান করছে প্রতিষ্ঠানটি।

তারহীন ইন্টারনেট প্রযুক্তি নিয়ে বহুদিন ধরে কাজ করেছে গুগলও। টারা চিপ এ প্রচেষ্টার নতুনতম সংযোজন। গুগল এক্সের গবেষকেরা মনে করছেন, টারা চিপের মাধ্যমে এমন সব অঞ্চলে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছানো যাবে, যেখানে ফাইবার অপটিকসের ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপন করা কঠিন। টারা চিপের মাধ্যমে ব্যবহৃত ইন্টারনেটে গ্রাহকেরা ব্রডব্যান্ড অর্থাৎ ফাইবার অপটিকস কেব্‌লের মতোই গতি পাবেন।

টারা প্রকল্পের পরবর্তী ধাপ হচ্ছে বহু চিপের সমন্বয়ে একটি ‘মেশ নেটওয়ার্ক’ গঠন করা, যেখানে প্রতিটি টারা ডিভাইস একে অপরের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান করতে পারবে। এতে সহজে, দ্রুত ও বড় পরিসরে ইন্টারনেট সরবরাহ করা যাবে—বিশেষত দুর্বল, পিছিয়ে থাকা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায়।

কৃষ্ণস্বামী জানায় ফাইবার অপটিক কেব্‌ল মূলত প্লাস্টিক বা কাচের তৈরি অতি সূক্ষ্ম তার, যা আলোর মাধ্যমে তথ্য পাঠায়। তবে এগুলো বসাতে সময় লাগে বহুদিন, এমনকি মাস বা বছরও। তবে টারা চিপ ব্যবহার করে সংযোগ তৈরি করা যায় ‘কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই’।

এই চিপ হলো আগে তৈরি করা ‘টারা লাইটব্রিজ’ ডিভাইসের এর ক্ষুদ্র সংস্করণ। লাইটব্রিজ ছিল ট্রাফিক লাইটের মতো আকারের একটি যন্ত্র, যাতে ছিল আয়না, সেন্সর, অপটিকস এবং স্মার্ট সফটওয়্যার। দুটি লাইটব্রিজ একে অপরকে ধরতে পারলে ২০ গিগাবাইট পার সেকেন্ড গতিতে ২০ কিলোমিটার (১২.৪ মাইল) দূরত্বে তথ্য পাঠাতে পারত।

ইতিমধ্যে ১২ দেশে এই প্রযুক্তির বাস্তব প্রয়োগে সফল হয়েছে। উল্লেখযোগ্য একটি উদাহরণ কঙ্গোর দুই শহর—ব্রাজাভিলে ও কিনশাসা। নদীর দুই পাড়ে থাকা এই শহরগুলোর মধ্যে আগে ইন্টারনেট খরচে বিশাল ফারাক ছিল। টারা লাইটব্রিজ বসানোর পর প্রায় একই মূল্যে উচ্চগতির সংযোগ পাওয়া যাচ্ছে।

এ ছাড়া ২০২৪ সালের কোচেলা মিউজিক ফেস্টিভ্যালে এবং গুগলের নিজস্ব বে ভি ক্যাম্পাসে এই প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছে, যেখানে ফাইবার কেব্‌ল পৌঁছানো কঠিন ছিল।

মহেশ কৃষ্ণস্বামী জানিয়েছেন, ২০২৬ সালে গুগল এক্সের পরবর্তী পণ্যে এই চিপ ব্যবহৃত হবে। তবে সে পণ্যের নাম এখনো প্রকাশ করা হয়নি। এরই মধ্যে তারা গবেষক এবং উদ্ভাবকদের তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে, যেন এই প্রযুক্তির আরও নতুন ব্যবহার খুঁজে বের করা যায়।

তথ্যসূত্র: ওয়্যারড ও লাইভ সায়েন্স

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত