Ajker Patrika

কার্বন নিঃসরণ কমাতে বিশ্বে বাড়ছে সবুজ প্রযুক্তির ব্যবহার

মোস্তাফিজ মিঠু, ঢাকা
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

আমরা প্রায়ই উপলব্ধি করি, পৃথিবীর আবহাওয়া আর আগের মতো নেই। বাংলাদেশে শীত ও গ্রীষ্ম ছাড়া কোনো ঋতু আগের মতো আলাদা করা যায় না। এর মূল কারণ জলবায়ুর পরিবর্তন। ২০২৪ সালে বিশ্ব বেশি তাপমাত্রার রেকর্ড গড়েছে। দিন দিন আরও উষ্ণ হচ্ছে পৃথিবী। বিশ্বের অনেক দেশ এ নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে।

কেউ কেউ তাদের অর্থনীতিকে এমনভাবে গড়ে তুলছে, যাতে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা পায় এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাস করার উপযোগী পৃথিবী নিশ্চিত করা যায়। ডেনমার্ক, সুইডেন, ফিনল্যান্ড বা জাপানের মতো দেশগুলো পরিবেশবান্ধব শক্তি, পুনর্ব্যবহারযোগ্য সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণে বৈপ্লবিক ভূমিকা পালন করছে।

তবে আমেরিকা কিংবা ইউরোপ ছাড়িয়ে এমন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডা পর্যন্ত কার্বন নিঃসরণ কমাতে তেলে চালিত মোটরবাইক বিদ্যুৎ-চালিত করার পরিকল্পনা করেছে।

নবায়নযোগ্য শক্তিতে আস্থা ডেনমার্কের

১৯৭৩ সালে তেলের সংকট দেখা দেওয়ার পর ডেনমার্ক নবায়নযোগ্য শক্তির ওপর আস্থা রেখেছে। বর্তমানে দেশটি অফশোর উইন্ড টারবাইনের মাধ্যমে বেশির ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। ডেনমার্ক বিশ্বের প্রথম ‘এনার্জি আইল্যান্ড’ তৈরি করছে। সেখান থেকে ইউরোপের আরও বিভিন্ন দেশে গ্রিন এনার্জি সরবরাহ করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। এ ছাড়া কৃষি এবং মৎস্যনির্ভর সংস্কৃতি দেশটির নাগরিকদের প্রকৃতির সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য সাহায্য করেছে।

রিসাইক্লিংয়ে বিশ্বসেরা সুইডেন

সুইডেনে বর্জ্যের ৯৯ শতাংশ পুনর্ব্যবহার হয়। সুইডিশ সরকার পরিবেশদূষণ ঠেকাতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তিতে অংশ নিয়েছে। দেশটি জীববৈচিত্র্য রক্ষা, নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার এবং বিকল্প জ্বালানিতে পরিচালিত গণপরিবহন ব্যবস্থায়ও অগ্রগামী।

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় সবুজ নগরী গড়ছে জাপান

প্রযুক্তির দেশ বলা হয় জাপানকে। তাদের ‘স্মার্ট সিটি’ প্রকল্পে শহরগুলো এমনভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে, যেখানে বিদ্যুৎ, পানি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা—সবই স্বয়ংক্রিয় ও পরিবেশবান্ধব। জাপানিরা রিসাইক্লিংয়ে এতটাই পারদর্শী যে প্রতিটি বাড়িতে বর্জ্য ৮ ভাগ করা হয়, যাতে সহজে পুনর্ব্যবহার করা যায়।

ভারতে সূর্যের আলোয় পথচলা

বিশ্বের বৃহৎ জনসংখ্যার দেশ ভারতও পিছিয়ে নেই। ‘ইন্টারন্যাশনাল সোলার অ্যালায়েন্স’ গড়ে তুলে তারা সৌরশক্তিকে বিশ্বে ছড়িয়ে দিচ্ছে। দিল্লি থেকে রাজস্থানের মরুভূমি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে সৌর প্যানেল, যেখানে একসময় শুধু সূর্যের উত্তাপ ছিল। ভারত গ্রিন ইন্ডিয়া মিশনের আওতায় বনায়ন কর্মসূচি চালাচ্ছে। পাহাড়ে, সমতলে, শহরের আশপাশে রোপণ করা হচ্ছে লাখ লাখ গাছ। তাদের লক্ষ্য, পরিবেশ বাঁচানো এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ ভারত গড়া।

জৈব চাষে এগিয়ে অস্ট্রিয়া

অস্ট্রিয়ার গ্রামাঞ্চলে কৃষিকাজের চিত্র একটু আলাদা দেখা যাবে। সেখানে চাষাবাদে কৃত্রিম রাসায়নিকের বদলে প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জৈব পদ্ধতিতে ফসল ফলানো হয়। অস্ট্রিয়া এখন ইউরোপের শীর্ষ জৈব কৃষিনির্ভর দেশ। দেশটির প্রায় প্রতি চারটি খামারের মধ্যে একটি অরগানিক, যা পুরো ইউরোপে সবচেয়ে বেশি। এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে সরকারি সহায়তা, পরিবেশবান্ধব কৃষিনীতি এবং সচেতন ভোক্তাসমাজ। একই সঙ্গে কার্বন ট্যাক্স, সবুজ বিনিয়োগ ও পরিবেশবান্ধব কৃষিকে উৎসাহিত করার মতো পদক্ষেপ নিচ্ছে দেশটি।

দূষণের বিরুদ্ধে চীন

একসময় পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত দেশগুলোর একটি ছিল চীন। কিন্তু এখন দেশটি সেই পরিচয় বদলাতে উঠেপড়ে লেগেছে। শহরের আকাশ ঢেকে ফেলা ধোঁয়া সরাতে তারা কয়লাভিত্তিক শিল্প কমিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তি, সৌর ও বায়ুশক্তিতে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। বেইজিং, সাংহাইয়ের মতো শহরে ইলেকট্রিক বাস ও বাইক চালু হয়েছে হাজার হাজার, যা ধীরে ধীরে শহরের বায়ু বদলে দিচ্ছে।

প্রকৃতিপ্রেম ও পরিবেশ সচেতনতায় সুইজারল্যান্ড

সুইজারল্যান্ডের মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রায় ৬২ শতাংশ জলবিদ্যুৎ। এটি তাদের জলসম্পদের দক্ষ ব্যবহারের ফল। দেশটির নাগরিকেরা পরিবেশরক্ষায় অত্যন্ত সচেতন। ‘সুইসস্টেইনেবল’ নামের উদ্যোগের মাধ্যমে দেশটির পর্যটন খাতেও পরিবেশবান্ধব নীতিগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে। হোটেল ও ট্যুর অপারেটররা এসব কার্যক্রমে যুক্ত হলে সরকারিভাবে স্বীকৃতি ও প্রণোদনা দেওয়া হয়।

সূর্য ও লবণের শক্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে চিলি

দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলির আতাকামা মরুভূমিতে পড়া সূর্যের আলোয় বিশ্বের অন্যতম বড় সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প চালু হয়েছে। দেশটি লবণভিত্তিক ব্যাটারি প্রযুক্তিও ব্যবহার করছে, যাতে বিদ্যুৎ সংরক্ষণ সম্ভব হয়।

প্রযুক্তির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কার্বন। ফলে পৃথিবীর উষ্ণতাও বাড়ছে। এ থেকে মুক্তি পেতে প্রতিটি দেশেরই সচেতন হওয়া প্রয়োজন। ঢাকা বিশ্বের অন্যতম দূষিত শহর হওয়ার পরও বাংলাদেশ এমন উদ্যোগ থেকে পিছিয়ে আছে। অথচ বন সংরক্ষণ, নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ সচেতনতায় আরও এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। এই ক্ষেত্রে সরকার, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী এবং সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে ভবিষ্যতের জন্য একটি পরিবেশবান্ধব দেশ গড়তে।

সূত্র: এশিয়া নিউজ ও গ্লোবাল সিটিজেন সলিউশন

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত