Ajker Patrika

‘দেশে প্রযুক্তি খাতে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো উদ্যোক্তার অভাব’

২০১৮ সালে ‘হুয়াওয়ে সিডস ফর দ্য ফিউচার’ প্রতিযোগিতায় জাতীয় পর্যায়ের বিজয়ী হন আজমাইন ইয়াক্কীন সৃজন। চীনে আয়োজিত প্রতিযোগিতাটির আঞ্চলিক পর্যায়েও তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। বর্তমানে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিএসই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। এ ছাড়া প্রযুক্তির উদ্ভাবন নিয়ে নিয়মিত কাজ করছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মোস্তাফিজ মিঠু

মোস্তাফিজ মিঠু, ঢাকা
আজমাইন ইয়াক্কীন সৃজন
আজমাইন ইয়াক্কীন সৃজন

২০১৮ সালে আপনি হুয়াওয়ে সিডস ফর দ্য ফিউচার প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছিলেন। এই প্রতিযোগিতা আপনার ক্যারিয়ারে কীভাবে ভূমিকা রেখেছে?

আমি প্রায়ই বলি, হুয়াওয়ে আমাকে শিক্ষকতা পেশার জন্য তৈরি করেছে। ২০১৮ সালে এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার আগে কিংবা আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে চীনে যাওয়ার আগে আমার শিক্ষক হওয়ার কোনো ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু এরপর হুয়াওয়ের হেডকোয়ার্টার্স ও হুয়াওয়ে ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার সুযোগ পেলাম। সেখানকার ল্যাবে ফোর-জি ও ফাইভ-জির মতো আধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে দেখি। তখন মনে হলো, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন নিয়ে আমিও এ ধরনের গবেষণা করতে পারি। তখন বুঝলাম, শিক্ষকতা আমাকে নিজের ইচ্ছেমতো গবেষণার সুযোগ দেবে। আমি গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার ৮ দিন পর বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিতে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম। এরপর ২০২১ সালে রুয়েটে নিয়োগ পাই। আসলে সিডস ফর দ্য ফিউচারে না গেলে হয়তো আমার সম্ভাবনা ও আগ্রহের জায়গাটা ঠিকমতো বুঝতে পারতাম না।

শিক্ষাজীবনে একাডেমির বাইরে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় শিক্ষার্থীদের অংশ নেওয়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনি মনে করেন?

শিক্ষাজীবন বলতে সাধারণত গতানুগতিক পড়াশোনা বোঝায়। এর বাইরেও যে একটা জগৎ আছে, এই জিনিসটা জানার জন্য বা বোঝার জন্য সব থেকে কার্যকরী পদক্ষেপ হতে পারে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া। সব থেকে বড় একটা বিষয় হলো, প্রেজেন্টেশন স্কিল বা কমিউনিকেশন স্কিল। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এই দক্ষতা থাকে না বললেই চলে। যাঁরা নিজেদের চেষ্টায় বিভিন্ন প্রতিযোগিতা বা ক্লাবের মাধ্যমে এটা শিখছেন, তাঁরা হয়তো লাভবান হচ্ছেন, কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীদের এটা নেই। এর মূল কারণ হচ্ছে, আমাদের গতানুগতিক ধারার সিলেবাসে এ ধরনের স্কিলগুলো শেখানোর ব্যবস্থা নেই। এ ছাড়া আরও কিছু স্কিল আছে, যেগুলো এ ধরনের প্রতিযোগিতাগুলোর মাধ্যমে আসলে ভালোভাবে রপ্ত করা যায়। যেমন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ও টাইম ম্যানেজমেন্ট।

শিক্ষকতার পাশাপাশি আপনি প্রযুক্তি নিয়ে অন্য কোনো কাজ করছেন কি?

শিক্ষকতার পাশাপাশি প্রযুক্তি নিয়েও আমি সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছি। আমি বিশ্বাস করি, জ্ঞান কখনোই সীমাবদ্ধ নয়। এটা শুধু শিক্ষার্থীদের জন্য নয়, সবার জন্যই উন্মুক্ত থাকা উচিত। এই বিশ্বাস থেকেই আমি প্রতিষ্ঠা করেছি ‘ইয়াং লারনার্স রিসার্চ ল্যাব’, যেখানে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে ১৫-১৬ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পেশাজীবীরাও গবেষণার হাতেখড়ি নিচ্ছেন।

আমি নিজেও গবেষণায় অত্যন্ত মনোযোগী। এখন পর্যন্ত তিনটি সরকারি প্রকল্প সফলভাবে সম্পন্ন করেছি এবং একটি চলমান আছে, যার কাজ প্রায় শেষের পথে। পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও কাজ করেছি। প্রতিযোগিতামূলক পরিসরে নিয়মিত আমি যুক্ত আছি। হুয়াওয়ে আইসিটি কমপিটিশনে গত বছর আমার শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক ফাইনালে অংশ নেয় এবং দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে। এ বছর আমিও টিচিং কনটেস্টে অংশ নিই এবং বিশ্বপর্যায়ে গ্র্যান্ড প্রাইজ জয় করি। বর্তমানে এআই এবং মেশিন লার্নিং নিয়ে কাজ করছি। হুয়াওয়ের মাইন্ডস্পোর মডেলের ভিত্তিতে একটি ‘মেশিন লার্নিং অ্যান্ড ডিপ লার্নিং’ কোর্স ডিজাইন করেছি।

চীন থেকে দেশে ফিরে এসে বুঝতে পারি, আমরা প্রযুক্তি শিক্ষা থেকে কতটা পিছিয়ে রয়েছি। তবে আমাদের সম্ভাবনা রয়েছে বিশাল! আমার মনে হয়েছিল, উন্নত দেশেই শুধু নয়, বাংলাদেশেও প্রযুক্তি বিষয় নিয়ে কাজ করার সম্ভাবনা অসীম।

‘সিডস ফর দ্য ফিউচার’ প্রতিযোগিতায় আপনার অভিজ্ঞতা কী?

২০১৮ সালে আমি ১৫ দিনের জন্য চীন সফরে গিয়েছিলাম এই প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে। প্রথম ৫ দিন আমরা ছিলাম বেইজিংয়ে, পরবর্তী ১০ দিন কাটে শেনজেনে। প্রতিটি দিন ছিল অভিজ্ঞতায় ভরপুর, মনে রাখার মতো, শেখার মতো, অনুভব করার মতো। এই প্রোগ্রামের সবচেয়ে বড় অর্জন আমার মনে হয়েছে বন্ধুত্ব। আমরা মোট দশজন বাংলাদেশ থেকে গিয়েছিলাম। এখনো সবাই সংযুক্ত, কথা বলি, দেখা করি। বেইজিংয়ে প্রথম দিনেই আমরা বাংলাদেশি অ্যাম্বাসেডরের সঙ্গে দেখা করি। এরপর হুয়াওয়ের হেডকোয়ার্টার্সে কালচারাল প্রোগ্রামে আমি একটি ওপেনিং স্পিচ দিই। চায়নিজ কালচারের সঙ্গে পরিচিত হই। এই ভাষাগত-সাংস্কৃতিক সংযোগ খুবই মূল্যবান। চীন থেকে দেশে ফিরে এসে বুঝতে পারি, আমরা প্রযুক্তি শিক্ষা থেকে কতটা পিছিয়ে রয়েছি। অথচ আমাদের সম্ভাবনা রয়েছে বিশাল! আমার মনে হয়েছিল, উন্নত দেশেই শুধু নয়, বাংলাদেশেও প্রযুক্তি বিষয় নিয়ে কাজ করার সম্ভাবনা অসীম। সেই দায়বোধ থেকেই আমি শিক্ষকতায় এসেছি।

আমাদের দেশে তরুণদের জন্য প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করার কতটা সুযোগ তৈরি হয়েছে এবং সমস্যাটা কোথায়?

বর্তমানে বাংলাদেশের তরুণদের জন্য প্রযুক্তিনির্ভর ক্যারিয়ার গঠনের সুযোগ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ২০১৮ সালের তুলনায় আজ অনেক প্রতিষ্ঠান মেশিন লার্নিং, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও গবেষণাভিত্তিক কাজের জন্য তরুণদের নিয়োগ দিচ্ছে। এখন শুধু প্রতিযোগিতামূলক প্রোগ্রামিং নয়, বরং প্রার্থীর গিটহাব প্রোফাইলে এআই সম্পর্কিত কোড আছে কি না, সেটাও গুরুত্ব পাচ্ছে। পাশাপাশি দেশে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চলমান বিভিন্ন প্রকল্পেও তরুণদের যুক্ত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

তবে বড় সমস্যা, দেশে প্রযুক্তি খাতে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো উদ্যোক্তার অভাব। অধিকাংশ সফটওয়্যার প্রকল্পেই আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা আউটসোর্সে অংশ নিয়ে কাজ করছেন, পুরো সমাধান তৈরির নেতৃত্বে নয়। আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো আধুনিক রিসার্চ ল্যাবের অভাব। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়েই সেই পর্যায়ের ল্যাব নেই, যেখানে শিক্ষার্থীরা সত্যিকার অর্থে উদ্ভাবন করতে পারে। চীনের শেনজেন পলিটেকনিক ইউনিভার্সিটিতে সফরের অভিজ্ঞতা আমার চিন্তাকে আরও গভীর করেছে। সেখানে দেখেছি, কীভাবে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবেই ৫.৫জি কোর চিপ থেকে

শুরু করে বিভিন্ন প্রযুক্তি ডিজাইন ও উৎপাদনে যুক্ত। তবে আশার কথা হচ্ছে, হুয়াওয়ের মতো কিছু প্রতিষ্ঠান এখন বাংলাদেশের প্রযুক্তি শিক্ষায় বিনিয়োগ করছে। এমন উদ্যোগগুলো যদি আরও সম্প্রসারিত হয়, তাহলে গবেষণার পরিবেশ তৈরি হবে এবং প্রকৃত উদ্ভাবন দেশ থেকেই উঠে আসবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

শেখ হাসিনা যাঁকে ঢাকায় ‘হত্যা করলেন’, তিনি ময়মনসিংহে জীবিত!

চরফ্যাশন থেকে গেটিসবার্গ কলেজ

জীবিত ভাইকে জুলাই আন্দোলনে নিহত দেখিয়ে মামলায় সাক্ষীও দুই ভাই, নেপথ্যে যা জানা গেল

নগদে স্ত্রীর চাকরি, স্বার্থের সংঘাতে জড়ালেন নাহিদের সাবেক পিএ আতিক মুর্শেদ

যুক্তরাষ্ট্রে সি চিন পিংয়ের মেয়েকে বহিষ্কারের দাবি, হঠাৎ কেন এই বিতর্ক

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত