Ajker Patrika

নাশকতার আসামি সাবেক শিবির নেতার জন্য পুলিশ কমিশনারকে বাদশার ফোন

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী
আপডেট : ২৮ জুলাই ২০২৪, ০৮: ২২
নাশকতার আসামি সাবেক শিবির নেতার জন্য পুলিশ কমিশনারকে বাদশার ফোন

রাজশাহীতে নাশকতার মামলায় গ্রেপ্তার ইসলামী ছাত্র শিবিরের সাবেক এক নেতাকে সহায়তার জন্য পুলিশ কমিশনারকে ফোন করেছেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা। রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) কমিশনারকে তিনি অন্তত ছয়বার ফোন করলেও আসামিকে ছাড়েনি। তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

কারাগারে পাঠানো আসামির নাম নুরুজ্জামান খান (৫৫) নগরীর সাহেববাজার এলাকার মসজিদ মিশন একাডেমির (স্কুল অ্যান্ড কলেজ) অধ্যক্ষ। ১৯৮২ সালে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেশির ভাগই দলীয় নেতা-কর্মী। এই প্রতিষ্ঠানের অন্তত ১২ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে নাশকতার মামলা আছে। এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা মাঝেমধ্যেই গ্রেপ্তার হন।

পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, নুরুজ্জামান খান ছাত্রজীবনে শিবিরের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ছিলেন। পরে জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করেন। এখন তিনি জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে নগরীর হড়গ্রাম মুন্সিপাড়া মহল্লার নিজ বাড়ি থেকে নুরুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করে কাশিয়াডাঙ্গা থানা-পুলিশ। এরপর বুধবার (২৪ জুলাই) তাঁকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।

গত বছরের ১৭ নভেম্বর কাশিয়াডাঙ্গা থানায় পুলিশের দায়ের করা একটি নাশকতার মামলায় নুরুজ্জামানকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। মামলার বাদী উপপরিদর্শক (এসআই) শাহ আলী মিয়া এজাহারে উল্লেখ করেন, ২০২৩ সালের ১৬ নভেম্বর বিএনপি ও জামায়াতের অবরোধ কর্মসূচি ছিল। এ জন্য বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীরা সেদিন রাতে নগরীর সায়েরগাছা এলাকায় রাস্তায় অবস্থান নিয়ে মানুষের চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছিলেন। খবর পেয়ে ফোর্স নিয়ে তিনি সেখানে যান। বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীরা ওই এলাকায় ফায়ার সার্ভিসের অফিস লক্ষ্য করে দুটি ককটেল ছুড়ে মারে। একটি ককটেল বিস্ফোরিত হয়ে অফিসের জানালার কাচ ভেঙে যায়। অপর একটি অবিস্ফোরিত ককটেল উদ্ধার করা হয়। অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করা হয়।

এই মামলায় অধ্যক্ষ নুরুজ্জামান খানকে গ্রেপ্তারের পর তাঁকে ছাড়ানোর জন্য দৌড়াদৌড়ি শুরু করেন মসজিদ মিশন একাডেমির গভর্নিং বডির সভাপতি সরিফুল ইসলাম বাবু। তিনি নগরীর ১২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য। নুরুজ্জামানকে ছাড়াতে তিনি ছুটে যান রাজশাহী-২ (সদর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা ও রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান আসাদের কাছে। এরপর ফজলে হোসেন বাদশা নগর পুলিশের কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদারকে অন্তত ছয়বার ফোন করেন। বুধবার বেলা ৩টায় পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য তিনি সরিফুল ইসলাম বাবুকে সময় নিয়ে দেন। ফজলে হোসেন বাদশা বিষয়টি স্বীকার করেছেন।

অথচ সংসদ সদস্য থাকাকালে ২০২০ সালের ১১ আগস্ট ফজলে হোসেন বাদশা সংবাদ সম্মেলন করে মসজিদ মিশন একাডেমির নানা অনিয়মের তথ্য তুলে ধরেছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি রাজশাহী মহানগরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বলে দীর্ঘদিন স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ও জঙ্গিবাদীরা একে কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। এই প্রতিষ্ঠানের কিছু শিক্ষক জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যুক্ত এবং তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারবিরোধী জঙ্গি তৎপরতার কারণে বিভিন্ন ফৌজদারি মামলাও রয়েছে। প্রতিষ্ঠানের ১১ কোটি টাকা লুটপাট করে সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে ব্যয় করা হয়েছে।

এই প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষকে ছাড়াতে ফোন করার বিষয়ে জানতে চাইলে ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, ‘অধ্যক্ষ কোন মতাদর্শের মানুষ তা প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির সভাপতি সরিফুল ইসলাম বাবু ভালো বলতে পারবেন। আমি পুলিশ কমিশনারকে বলেছিলাম, বিষয়গুলো যেন তাঁর কাছ থেকে শোনা হয়। এ জন্য আমি বাবুকে পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাতের একটি সময় নিয়ে দিয়েছিলাম।’ 

বাদশা দাবি করেন, সম্প্রতি নগরীর একটি মাদ্রাসার অধ্যক্ষকে আটকের পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কেন তাঁকে ছাড়া হয়েছে সে প্রশ্ন তুলে বাদশা বলেন, মসজিদ মিশন একাডেমির অধ্যক্ষ নুরুজ্জামান খান জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি করেন কি না তা তিনি জানেন না।

কাউন্সিলর সরিফুল ইসলাম বাবু আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানের অন্তত ১২ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে আগে থেকেই নাশকতার মামলা আছে। অধ্যক্ষ নুরুজ্জামানের বিরুদ্ধে মামলা ছিল না। একটা পুরোনো মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এ জন্য আমি বাদশা ভাই (ফজলে হোসেন বাদশা) ও আসাদ ভাইয়ের (আসাদুজ্জামান আসাদ) কাছে গিয়েছিলাম। বাদশা ভাই পুলিশ কমিশনারকে ফোন করে দেখা করার জন্য আমাকে সময় নিয়ে দিয়েছিলেন। আসাদ ভাই ফোন করতে চেয়েছিলেন। ৩টার সময় আমার সঙ্গে আসাদ ভাইয়েরও পুলিশ কমিশনারের কাছে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ঢাকা যাওয়ার শিডিউল থাকায় তিনি যেতে পারেননি।’

সরিফুল ইসলাম বাবু আরও বলেন, ‘দেখা করলে পুলিশ কমিশনার আমাকে জানিয়েছেন যে অধ্যক্ষ নুরুজ্জামান খানের ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেন আছে। কিন্তু আমি তাঁর দুটি ব্যাংক হিসাব দেখে এমন কিছু পাইনি। প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হিসেবে আমি তাঁকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেছিলাম। কারণ, তিনি নানাভাবে আমাদেরকে সহযোগিতা করে থাকেন।’

জামায়াত নেতার জন্য পুলিশ কমিশনারকে ফোন করার বিষয়ে জানতে চাইলে সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, ‘আমার কাছে কয়েকজন এসেছিলেন যেন ফোন করে তাঁকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করি। কিন্তু আমি ফোন করিনি। ফোন করেছি এই প্রমাণ কেউ দিতে পারবে না।’

কাশিয়াডাঙ্গা থানা থেকে নুরুজ্জামানকে আদালতে পাঠানোর সময় পুলিশ প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘প্রাথমিক তদন্তে এই আসামি মামলার ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে।’ 

আরএমপি কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদার বলেন, ‘নুরুজ্জামান খান জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে তথ্য পাওয়া গেছে। আরও তদন্ত চলছে। মামলায় থাকা অভিযোগ এখন বিচারাধীন বিষয়। এ বিষয়ে এখন আর কোনো মন্তব্য করব না।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত