Ajker Patrika

পিআর আদায় করে ছাড়বে জামায়াত, সমাবেশে ঘোষণা

তানিম আহমেদ ও সাখাওয়াত ফাহাদ, ঢাকা
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গতকাল জামায়াতে ইসলামীর জাতীয় সমাবেশে উপস্থিত নেতা-কর্মীদের একাংশ। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনসহ সাত দফা দাবিতে এর আয়োজন করা হয়। সমাবেশে ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, গণঅধিকার পরিষদ, এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা বক্তব্য দেন। ছবি: আজকের পত্রিকা
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গতকাল জামায়াতে ইসলামীর জাতীয় সমাবেশে উপস্থিত নেতা-কর্মীদের একাংশ। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনসহ সাত দফা দাবিতে এর আয়োজন করা হয়। সমাবেশে ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, গণঅধিকার পরিষদ, এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা বক্তব্য দেন। ছবি: আজকের পত্রিকা

সংসদের নিম্নকক্ষ, উচ্চকক্ষ ও সংরক্ষিত নারী আসন—সব ক্ষেত্রেই ভোটের সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতি চায় জামায়াতে ইসলামী। কিন্তু বিএনপিসহ কয়েকটি দলের অবস্থান এর বিপক্ষে। এই অবস্থায় পিআর পদ্ধতিতে ভোটের ঘোষণা দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জামায়াত। সেই দাবি মানা না হলে রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে তা আদায়ের ঘোষণা দিয়েছে দলটি।

রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গতকাল শনিবার জাতীয় সমাবেশ থেকে এই ঘোষণা দেন জামায়াতের নেতারা। সমাবেশে শেষ পর্যায়ে ভাষণ দিতে দাঁড়িয়ে দুই দফা পড়ে যান দলের আমির শফিকুর রহমান। পরে মঞ্চে বসেই সংক্ষেপে বক্তব্য শেষ করেন তিনি।

আমির শফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে বেলা ২টা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সমাবেশ শুরু হয়ে শেষ হয় বিকেল ৫টার কিছু সময় পরে। তবে শনিবার ভোর থেকে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে জামায়াতের নেতা-কর্মীরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জড়ো হতে থাকেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের অবস্থান উদ্যান ছাড়িয়ে আশপাশের সড়ক, রমনা পার্কে ছড়িয়ে পড়ে। সমাবেশের আশপাশের সড়কে বিশাল বিশাল স্ক্রিনের মাধ্যমে সরাসরি দেখানো হয় নেতাদের বক্তৃতা।

এর আগে সকাল থেকেই জামায়াতের নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত রাখতে মঞ্চ থেকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করা হয়। সমাবেশে পিআর পদ্ধতিতে ভোটের পক্ষের দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। যাতে জামায়াতের নেতারা ছাড়াও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিসের নেতারাসহ জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নিহতদের পরিবারের সদস্য, জুলাই যোদ্ধারা বক্তব্য দেন। তবে বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।

বিকেল সোয়া ৫টার দিকে বক্তব্য শুরু করেন জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান। কয়েক মিনিট কথা বলার পর কিছুটা অসুস্থ অনুভব করায় প্রথমে টুপি খুলে বক্তব্য দেন। এরপর কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে তিনি পড়ে যান। নেতা-কর্মীরা তাঁকে উঠিয়ে দিলে আবার বক্তব্য শুরু করেন তিনি। এ সময় তিনি আবার পড়ে যান। তখন দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, আমির গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ায় চিকিৎসকেরা পরামর্শ দিচ্ছেন তাঁর কথা বলা ঠিক হবে না। তবে আমির বসে থাকা অবস্থাতেই বক্তব্য শুরু করেন।

জাতীয় ঐক্যের নামে অহংকার, তুচ্ছতাচ্ছিল্য আর অরাজনৈতিক ভাষা ব্যবহারকারীদের প্রতি কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে শফিকুর রহমান বলেন, ‘আবু সাঈদরা যদি বুক পেতে না দিত, হয়তো আজকের বাংলাদেশ আমরা দেখতাম না। অনেকের জীবন হয়তো ফ্যাসিবাদীদের হাতে চলে যেত। আজকে যারা বিভিন্নভাবে দাবিদাওয়া তুলে ধরছেন, তখন তাঁরা কোথায় থাকতেন? সুতরাং অহংকার করে, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, কাউকে ছোট করে কথা না বলি। না হলে আমরা বুঝে নেব, স্বৈরাচারী বীজ তাদের মনে বাসা বেঁধেছে।’

জামায়াত সরকার গঠন করলে কোনো এমপি-মন্ত্রী ভবিষ্যতে সরকারি প্লট গ্রহণ করবেন না বলে ঘোষণা দেন শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, কোনো এমপি এবং কোনো মন্ত্রী ট্যাক্সবিহীন কোনো গাড়ি চড়বেন না। কোনো এমপি এবং কোনো মন্ত্রী তাঁর নিজের হাতে কোনো টাকা চালাচালি করবেন না। কোনো এমপি এবং কোনো মন্ত্রী যদি তাঁর নির্দিষ্ট কোনো কাজের জন্য বরাদ্দ পেয়ে থাকেন, কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের ১৮ কোটি মানুষের কাছে তাঁরা তার প্রতিবেদন তুলে ধরতে বাধ্য হবেন।

আমির বলেন, ‘চাঁদা আমরা নিব না, দুর্নীতি আমরা করব না। চাঁদা আমরা নিতে দেব না, দুর্নীতি আমরা সহ্য করব না।’

বক্তব্যে জামায়াতের নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আজব বাংলাদেশ, চাঁদা না দিলে জীবন শেষ। আমরা এমন একটি বাংলাদেশ গড়তে চাই, যেখানে আগামীর বাংলাদেশ, চাঁদা চাইলে জীবন শেষ। এ আইন চালু করতে হবে। তাহলে চাঁদা বন্ধ হয়ে যাবে।’

সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে কেন্দ্র দখল করা যাবে না বলে মন্তব্য করেন আরেক নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তিনি বলেন, টাকা দিয়ে ভোট কেনা যাবে না। এই পদ্ধতি হলে কারচুপি সম্ভব নয়, আর তাই অনেকে এটার বিরোধিতা করছে।

সংস্কার বিষয়ে তাহের বলেন, মিডিয়ার সামনে সবাই সংস্কার চান, কিন্তু মিটিংয়ে বসে অনেকে এমন ভান করেন যেন এসব সংস্কারের কোনো প্রয়োজনই নেই। তাহলে সমস্যা কোথায়? সংস্কার তো সবার কল্যাণেই। যারা সংস্কার চায় না, তাদের ভিন্ন মতলব আছে বলেই মনে হচ্ছে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপের কথা তুলে ধরে দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ বলেন, সেখানে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি দল পিআর পদ্ধতির পক্ষে মত দিয়েছে। অবিলম্বে সরকারকে সংবিধানে পিআর পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়ে আজাদ বলেন, ‘এ পদ্ধতি অনুসরণ করে নির্বাচনের ঘোষণা দিতে হবে। অন্যথায় রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে এ দাবি আদায় করে ছাড়ব।’

বক্তব্যে এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে উচ্চকক্ষ চাই না, এই বক্তব্য যারা দেয়, তারা জাতির সঙ্গে প্রতারণা করছে। বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনার বাইরে রেখে অন্তর্বর্তী সরকার এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।’

এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, ‘ফ্যাসিস্টবিরোধী আমাদের যে শক্তি, এদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। কিন্তু ঐক্যবদ্ধ থাকতে গিয়ে অন্ধভাবে কারও দালালি করা যাবে না। রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা থাকবে, কিন্তু তার সৌন্দর্য নষ্ট করা যাবে না। তবেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।’

বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন কার্যালয় স্থাপনের সমালোচনা করেন হেফাজতে ইসলামীর নায়েবে আমির মহিউদ্দিন রাব্বানী। তিনি বলেন, ‘মানবাধিকারের নামে কোরআন-সুন্নাহবিরোধী কর্মকাণ্ড বরদাশত করব না।’

নির্বাচনের আগে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর। তিনি বলেন, ‘মৌলিক সংস্কার নিশ্চিত না করে আপনারা (অন্তর্বর্তী সরকার) নির্বাচনের দিকে হাঁটবেন না। তাহলে সেটা আরেকটি প্রতারণামূলক নির্বাচনই হবে।’

সমাবেশে বক্তব্য দেন ছাত্রলীগের নির্মম নির্যাতনে নিহত বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ। তিনি বলেন, ‘৬ বছর হয়ে গেছে। ছেলে হত্যার বিচার এখনো পাইনি। আমি চাই, দ্রুত যেন আমার ছেলে হত্যার বিচার করা হয়।’

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে রংপুরে নিহত আবু সাঈদের ভাই রমজান আলী বলেন, ‘দীর্ঘ এক বছর পেরিয়ে গেলেও ভাইয়ের হত্যার বিচারও পাইনি। আমাদের শহীদ ভাইদের হত্যার বিচারের দরকার আছে কি নাই? আমি মনে করি, নির্বাচনের আগে এই শহীদ ভাইদের হত্যার বিচারের রায় প্রয়োজন।’

জুলাই আন্দোলনের যোদ্ধা তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসার শিক্ষার্থী জুনায়েদুর রহমান বলেন, ‘সংস্কারের নামে ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসন এখনো চালু রয়েছে। ফ্যাসিবাদের শিকড় যতই গভীরে থাকুক, তার মূলোৎপাটন না করা অব্দি আমাদের লড়াই চলমান থাকবে।’

হিন্দু মহাজোটের সভাপতি গোবিন্দ প্রামাণিক জামায়াতে ইসলামীকে শুধু একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে নয়, বরং একটি ‘ইউনিভার্সাল ইউনিভার্সিটি’ আখ্যা দেন।

সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের সদস্য এ টি এম আজহারুল ইসলাম, সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব ইউনুস আহমাদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমেদ আবদুল কাদের, নেজামে ইসলামের মহাসচিব মুসা বিন ইযহার প্রমুখ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ভারতের সঙ্গে আফগানিস্তান-শ্রীলঙ্কাও ঢাকায় এসিসির সভা বর্জন করল

মুক্তি পেয়ে আ.লীগ নেতার ভিডিও বার্তা, বেআইনি বলল বিএনপি

গাড়ি কেনার টাকা না দেওয়ায় স্ত্রীকে মারধর, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে মামলা

যুদ্ধবিমানের ২৫০ ইঞ্জিন কিনছে ভারত, ফ্রান্সের সঙ্গে ৬১ হাজার কোটি রুপির চুক্তি

সালাহউদ্দিনকে নিয়ে বিষোদ্‌গার: চকরিয়ায় এনসিপির পথসভার মঞ্চে বিএনপির হামলা-ভাঙচুর

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত