Ajker Patrika

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নেতা-কর্মীর ঢল, সমাবেশ থেকে যে বার্তা দিতে চায় জামায়াত

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ১৯ জুলাই ২০২৫, ১০: ৪৪
শনিবার সকালেই কানায় কানায় পূর্ণ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। ছবি: সংগৃহীত
শনিবার সকালেই কানায় কানায় পূর্ণ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আজ শনিবার (১৯ জুলাই) ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তাদের ইতিহাসের প্রথম জাতীয় সমাবেশ করছে। এই সমাবেশকে কেন্দ্র করে দলটির নেতা-কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং ঐতিহাসিক আয়োজনের প্রস্তুতি লক্ষ করা যাচ্ছে।

জামায়াতে ইসলামী এই সমাবেশকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি ‘টার্নিং পয়েন্ট’ এবং ‘ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার ঐতিহাসিক মহড়া’ হিসেবে দেখছে। সাত দফা দাবির মাধ্যমে দলটি দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে চাইছে। এই দাবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু দিক হলো:

নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা: জামায়াত চায়, আসন্ন নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলের জন্য সমান সুযোগ ও পরিবেশ নিশ্চিত করা হোক, যাতে কোনো দল বিশেষ সুবিধা না পায়। এটিকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত হিসেবে তারা দেখছে।

‘জুলাই গণহত্যার’ বিচার: যদিও ‘জুলাই গণহত্যার’ সুনির্দিষ্ট বিবরণ দেওয়া হয়নি, তবে এই দাবির মাধ্যমে দলটি একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিচার চেয়েছে, যা তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডার একটি সংবেদনশীল অংশ। এটি অতীতের কোনো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

প্রয়োজনীয় মৌলিক সংস্কার: দেশের শাসনব্যবস্থা, আইন এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মৌলিক সংস্কার আনার দাবি জানিয়েছে দলটি। এর মাধ্যমে তারা একটি জবাবদিহিমূলক এবং জনমুখী সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

সংখ্যানুপাতিক হারে (পিআর পদ্ধতি) সংসদ নির্বাচন: জামায়াত মনে করে, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি অনুযায়ী নির্বাচন হলে একটি ‘কোয়ালিটি পার্লামেন্ট’ গঠন করা সম্ভব হবে। তারা এই পদ্ধতির নির্বাচনকে বাংলাদেশের জন্য ‘সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত’ বলে দাবি করছে। তাদের যুক্তি হলো, এই পদ্ধতি ছোট দলগুলোকেও সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দেবে এবং ভোট আয়োজনের পেছনে রাষ্ট্রের অপচয় কমাবে।

জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন: জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিও জানানো হয়েছে। এর মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচনের একটি পূর্বাভাসও পাওয়া যাবে বলে তারা মনে করে।

দায়িত্ব পালনে বিভিন্ন সংস্থার ব্যর্থতা: জামায়াত সমাবেশ থেকে দেশের দায়িত্বরত বিভিন্ন সরকারি সংস্থার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার বিষয়টি তুলে ধরার কথা বলেছে। এটি সরকারের কার্যকারিতা এবং জবাবদিহি নিয়ে প্রশ্ন তোলার একটি কৌশল হতে পারে।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এই সমাবেশ সফল করতে জামায়াতে ইসলামী নজিরবিহীন প্রস্তুতি নিয়েছে। তাদের সাংগঠনিক সক্ষমতা এবং সদস্যদের প্রতিশ্রুতি নিয়ে অবশ্য কখনো প্রশ্ন ছিল না। আদর্শ ও রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে অনেক সমালোচনা থাকলেও বিশেষ করে একটি সুশৃঙ্খল রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াত বরাবরই প্রশংসিত হয়েছে।

দলটির নেতারা আশা করছেন, সারা দেশ থেকে প্রায় ১০ লাখ নেতা-কর্মী এই সমাবেশে অংশ নেবেন। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের ব্যবস্থাপনা একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ, যার জন্য তারা বিস্তারিত পরিকল্পনাও গ্রহণ করেছে।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাঁচ শতািধক অস্থায়ী টয়লেট স্থাপন করা হয়েছে, যা এত বড় জনসমাগমের জন্য অপরিহার্য। হাজারেরও বেশি পানির কল স্থাপন করা হয়েছে অজু ও পানীয় জলের জন্য, যা নেতা-কর্মীদের স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করবে। মঞ্চের দুপাশে দুটি বড় স্ক্রিন এবং সমাবেশের আশপাশের ৫০টিরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে এলইডি স্ক্রিন বসানো হয়েছে, যাতে দূর থেকেও সমাবেশের কার্যক্রম দেখা যায়। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় চার শতাধিক মাইক বসানো হয়েছে, যাতে সমাবেশের বক্তব্য বহুদূর পর্যন্ত শোনা যায়। অতিথি ও গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের বসার জন্য মঞ্চের সামনের দুপাশে ৬০০ চেয়ার রাখা হয়েছে।

প্রায় ৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবক আটটি ভিন্ন বিভাগের আওতায় দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের কাজ হলো জনসমাগম নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং আগত নেতা-কর্মীদের সহায়তা করা। এই বিশাল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী সমাবেশের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকার বাইরের জেলা থেকে আগত নেতা-কর্মীদের জন্য বিশেষ পরিবহনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করে ঢাকার বাইরের বাসগুলোর জন্য নির্দিষ্ট ’ড্রপিং পয়েন্ট’ নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে যানজট এড়ানো যায় এবং নেতা-কর্মীরা সহজে পৌঁছাতে পারেন। নেতা-কর্মীদের সুবিধার্থে চার জোড়া বিশেষ ট্রেন ভাড়া করা হয়েছে। রেলওয়েকে ভাড়া বাবদ প্রায় ৩২ লাখ টাকা অগ্রিম পরিশোধ করেছে তারা। এই ট্রেনগুলো রাজশাহী-ঢাকা-রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ-ঢাকা-সিরাজগঞ্জ এবং ময়মনসিংহ-ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে একবার করে চলাচল করবে। এটি দূর-দূরান্ত থেকে আসা নেতা-কর্মীদের জন্য একটি বড় সুবিধা।

মাঠের ভেতরে ও বাইরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিশ্চিত করতে একাধিক মনিটরিং সেল স্থাপন করা হয়েছে। এটি যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় সহায়তা করবে।

গত বৃহস্পতিবার রাত থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জামায়াতের নেতা-কর্মীরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসতে শুরু করেছেন। তাদের মধ্যে প্রবল উৎসাহ এবং একটি ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা লক্ষ করা যাচ্ছে। আজ শনিবার সকাল ৮টার মধ্যেই উদ্যান কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেছে।

আগত নেতা-কর্মীদের অনেকেই জামায়াতের লোগো সংবলিত টি-শার্ট পরেছেন এবং মাথায় দলীয় সাদা ফিতা বেঁধেছেন। কেউ কেউ দলীয় প্রতীক দাঁড়িপাল্লাও নিয়ে এসেছেন। অনেক নেতা-কর্মী রাতটি মাঠেই ত্রিপল বিছিয়ে শুয়ে-বসে কাটিয়েছেন। তাঁদের অনেকে স্লোগান দিতে দিতে সময় কাটাচ্ছেন এবং রাতে সেখানেই অবস্থান করার কথা জানিয়েছেন।

জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার সমাবেশের প্রস্তুতি পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের বিস্তারিত সময়সূচি জানিয়েছেন। শনিবার সকাল ১০টায় পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের মধ্য দিয়ে সমাবেশের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে। এরপর হামদ ও নাত পরিবেশন করা হবে। দুপুর ২টায় মূল অনুষ্ঠান শুরু হবে, যেখানে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা বক্তব্য রাখবেন এবং তাঁদের দাবিগুলো তুলে ধরবেন।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জামায়াতের এই সমাবেশ বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হিসেবে দেখছেন অনেকে। দীর্ঘ বিরতির পর একটি প্রধান রাজনৈতিক সমাবেশে দলটির উপস্থিতি নতুন করে আলোচনার জন্ম দেবে।

এই সমাবেশ জামায়াতের পুনরুত্থানের একটি প্রচেষ্টা এবং তাদের রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের একটি বড় মঞ্চ। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের জনভিত্তি এবং সাংগঠনিক সক্ষমতা দেখাতে চাইছে। সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব, জুলাই গণহত্যার বিচার এবং অন্যান্য সংস্কারের দাবিগুলো নিয়ে জামায়াত এই সমাবেশের মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছে। দলটি আশা করছে, এই সমাবেশ থেকে তাদের ৭ দফা দাবি জনগণের কাছে পৌঁছাবে এবং ব্যাপক জনমত তৈরি করতে সহায়ক হবে।

এই সমাবেশ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে জামায়াতের ভূমিকা এবং নির্বাচনী জোট-মহাজোটের সমীকরণ নিয়ে নতুন আলোচনার জন্ম দিতে পারে। যেমনটি সিলেট মহানগরী জামায়াতের আমির মুহাম্মদ ফখরুল ইসলাম বলেছেন, এই সমাবেশ ‘নতুন ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারের উত্থান বন্ধ’ করার একটি প্রয়াস এবং ‘দেশের রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট’ হবে।

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত