Ajker Patrika

বড় পরিবার ভেঙে এখন বহু পরিবার

বড় পরিবার ভেঙে এখন বহু পরিবার

আমাদের ছেলেবেলায় বোদায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় পরিবার ছিল দত্ত পরিবার। এই দত্ত পরিবারের এক সদস্য আবার আমার বন্ধু। ফলে এই পরিবারের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা ও যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল সেই ছেলেবেলাতেই। 

দত্তবাড়ির অভিভাবক ছিলেন রাধিকা কিশোর দত্ত। ১০ পুত্র ও ৪ কন্যা সন্তানের পিতা ছিলেন তিনি। বিয়ে করেছিলেন দুটি। প্রথম পক্ষের ছয় পুত্র সন্তান। তাঁরা হলেন—হৃদয় কিশোর দত্ত (ডাক নাম ছিল ডালু), প্রফুল্ল কিশোর দত্ত, অনিল কিশোর দত্ত, সুকুমার দত্ত, শিবেন কিশোর দত্ত ও সনৎ কিশোর দত্ত। প্রথম স্ত্রীর অকাল মৃত্যুতে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এই ঘরে চার ছেলে ও চার মেয়ে। ছেলেদের নাম যথাক্রমে তারাপদ দত্ত (ডাক নাম মঙ্গল), বিজন বিহারী দত্ত (ডাক নাম বাবুল), শ্যামল কিশোর দত্ত ও অমল কিশোর দত্ত। মেয়েদের নাম অঞ্জলি, জ্যোৎস্না, মঞ্জু ও ইতি। ১৪ ছেলেমেয়ে নিয়ে বিরাট সংসার, বড় পরিবার। বাড়িটাও ছিল অনেক বড়। বিরাট ছিল বাড়ির চৌহদ্দি। 

দত্ত পরিবারের বিজন বিহারী আমার বন্ধু। একেবারে প্রথম শ্রেণি থেকেই বিজন আমার বন্ধু নয়। ও ছোট থাকতে ওর দাদার সঙ্গে রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমে চলে গিয়েছিল। তাই ওর শিক্ষাজীবন শুরু হয় আশ্রমে। পরে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় বোদা প্রাইমারি স্কুলে এসে ভর্তি হয় এবং বলা যায় একেবারে প্রথম দিন থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব পাকাপাকি হয়ে যায়। তার আগে অবশ্য সামান্য ভূমিকা আছে। চতুর্থ শ্রেণির পরীক্ষা দিয়ে বিজন ছুটি কাটাতে বোদা এসেছিল। কিন্তু ছুটি শেষে ও আর আশ্রমে ফিরে যেতে চায় না। জোর করে পাঠানোর চেষ্টা করা হলে বিজনের সে কি চিৎকার করে কান্না! টেনেহিঁচড়েও ওকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত নেওয়া যায়নি। আমাদের বাসা ছিল কাছাকাছি। আমার প্রয়াত বন্ধু ইউসুফ মন্টুর বাসায় আমরা তখন ভাড়া থাকতাম। ওই বাসার সামনে দিয়েই রাস্তা। বিজনকে যখন জোর করে বাসে ওঠানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন ওর কান্না শুনে আমরা আশপাশে যারা ওর সমবয়সী ছিলাম, তারা সঙ্গ নিলাম। আমাদের সঙ্গে ওর আগে থেকেই আলাপ-পরিচয় ছিল। আমাদের দেখে বিজনের কান্নার বেগ বেড়ে গিয়েছিল। ওকে জোর করে আশ্রমে না পাঠানোর জন্য আমরা খুদে বাহিনী জোর সুপারিশ করেছিলাম। বিজন বোদায় থেকে গেল। বিজনের আশ্রমে যাওয়ার কারণ ওর দাদা সুকুমার দত্ত। তিনি দশম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই সংসারত্যাগী হয়ে সন্ন্যাস জীবন বেছে নিয়েছিলেন। আমরা তাঁকে বলতাম সাধু দাদা। 

বিজনের বাবা, আমাদের জ্যাঠা মশাই, রাধিকা কিশোর দত্ত ছিলেন আপাদমস্তক একজন নির্বিরোধ ভালো মানুষ। তিনি কখনো কারও সঙ্গে কোনো ঝুটঝামেলায় জড়িয়েছেন বলে শোনা যায়নি। নিজের জায়গাজমির তদারকি ও সন্তানদের সময় দেওয়া ছাড়া তাঁকে আর কিছু করতে দেখেছি বলে মনে হয় না। তবে জায়গাজমি নিয়ে কেউ কোনো সমস্যায় পড়ে তাঁর কাছে এলে তিনি সৎ পরামর্শ দিতেন। জমিজমা-সংক্রান্ত বিষয়গুলো তিনি ভালো বুঝতেন। তিনি সেকালের ‘মাইনর’ পাস ছিলেন। তিনি এবং সিরাজউদ্দিন আহমেদ একসঙ্গে পড়াশোনা করেছেন। দুজনে ভালো বন্ধু ছিলেন। জমিজমার কাগজপত্র বিষয়ে দুজনেরই যথেষ্ট জ্ঞান ছিল। সিরাজ সরকার সাহেব ‘দেউনিয়াগিরি’ করতেন, রাধিকা বাবু দেউনিয়া হিসেবে ততটা খ্যাতি পাননি। দেউনিয়াগিরি হলো আসলে মাতব্বরি। 

আগের দিনের মানুষ কতগুলো মূল্যবোধ মেনে চলতেন। নিজের সন্তানকে যেমন স্নেহ করতেন, সন্তানের বন্ধুদেরও একই চোখে দেখতেন। বিজনের বাবা এবং মায়ের কাছে বিজন, আর আমি আলাদা ছিলাম না। বিজনের দাদাদের কাছেও আমি ছোট ভাই-ই ছিলাম। 

বিজনের বাবা রাধিকা জ্যেঠামশাই একজন পরোপকারী মানুষ ছিলেন। তিনি হাড় ভাঙার ভালো চিকিৎসা জানতেন। কারও হাত-পা ভেঙে বা মচকে গেলে তিনি তেল মালিশ করে ভালো করে তুলতেন। এক ধরনের ফিজিওথেরাপি। অনেকেই তাঁর ব্যবস্থাপনায় উপকার পেয়েছে। কিন্তু এই সেবাদানের বিনিময়ে তিনি কারও কাছে কোনো পয়সা নিতেন না। কেউ সেধে দিতে গেলেও রাগ করতেন। 

বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও তিনি ভেতরে-ভেতরে একটু রাগী মানুষই হয়তো ছিলেন। তবে সে রাগের প্রকাশ কখনো ঘটত না। তিনি বৈলাঅলা খড়ম পায়ে পরতেন। সে সময় বাড়িতে খড়ম পরারই নিয়ম ছিল। কেউ পরতেন ফিতাঅলা খড়ম। একটু বয়স্করা বৈলাঅলা খড়ম। তো, পুত্রসন্তানরা কখনো অবাধ্য হলে ওই খড়ম দিয়েই তাদের শায়েস্তা করতেন জ্যেঠামশাই। বিজনের পিঠেও দু-চার ঘা পড়েছে। 

আমরা পঞ্চম শ্রেণিতে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলাম। এখনকার মতো তখন তো আর কোচিং বাণিজ্য ছিল না। আমাদের একজন শিক্ষক ছিলেন শৈলেন কুমার মোদক। ভীষণ রাগী। একটু এদিক-ওদিক হলেই আর রক্ষে ছিল না। তাঁর হাতে মার খায়নি—এমন ছাত্র পাওয়া যাবে না। আমি ছিলাম ব্যতিক্রম। আমাকে পিটুনি দেওয়ার কোনো উপলক্ষ স্যার পাননি। একবার এক উপলক্ষ তিনি তৈরি করেছিলেন, প্রয়োগ করার সুযোগ আমি তাঁকে দিইনি। ছাত্র খুব একটা খারাপ ছিলাম না। শৈলেন স্যার মনে করলেন, তিনি একটু গাইড করলে বৃত্তি পাওয়া সহজ হবে। তিনি আমাকে আর বিজনকে প্রতি সন্ধ্যায় দত্তবাড়িতে গিয়ে পড়ানো শুরু করলেন, কোনো টাকাপয়সা না নিয়ে। শুধু রাতের খাবার খেতে হলো জ্যেঠিমার হাতে। জ্যেঠিমা তাদের বড় ঘরের মেঝেতে কী যত্নে যে পিঁড়ি পেতে বসতে দিয়ে আমাদের সুস্বাদু সব খাবার পরিবেশন করতেন! সব শেষে ঘন জ্বালের এক বাটি দুধ, যার ওপরে ভাসত পুরু সর। আমার আবার ছিল দুধ-ভাতে ভীষণ লোভ। আমি যতটা না পড়ার আগ্রহে ও বাড়ি যেতাম, তার চেয়ে বেশি যেতাম দুধের বাটির লোভে। 

লোভের কথায় আরেকটি বিষয় মনে পড়ল। একবার আমার খ্রিষ্টান হওয়ার ইচ্ছা হয়েছিল। আমার তখন ধারণা ছিল খ্রিষ্টান হলে বুঝি মিশনারিরা বিদেশ নিয়ে যাবে। বিদেশ যাওয়ার ইচ্ছা থেকেই খ্রিষ্টান হওয়ার আগ্রহ। দিনাজপুর মিশনে গিয়ে খ্রিষ্টান হওয়া যাবে বলে কারও কাছে হয়তো শুনেছিলাম। আমি বিজনকে পটালাম। ওকে পটানো সহজ কাজ ছিল না। ও আশ্রমে ছিল, দাদা ‘সাধু’। ও নিজেও একটু ‘ধার্মিক’ টাইপের ছিল (এখনো আছে। আমি ওকে সে জন্য গোসাই বলি)। তাই হিন্দুত্ব বাদ দিতে ও রাজি হচ্ছিল না। আবার আমাকে অখুশি করতেও চাচ্ছিল না। যা হোক, মূলত আমার চাপাচাপিতেই বিজন আমার সঙ্গে দিনাজপুর যেতে রাজি হলো। একদিন ভোরে আমরা বাড়িতে কাউকে কিছু না বলে খ্রিষ্টান হওয়ার জন্য পালালাম। তখন দিনাজপুর যেতেও অনেক সময় লাগত। আমরা দিনাজপুর পৌঁছে গেলাম খ্রিষ্টান মিশনে। একজন ফাদার এসে আমাদের সঙ্গে কথা বললেন। কিছু হয়তো খেতেও দিয়েছিলেন। জানতে চাইলেন আমাদের মিশনে যাওয়ার উদ্দেশ্য। আমি অকপটে বলি, খ্রিষ্টান হতে চাই। তিনি আমাদের গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া দুই কিশোরের নির্দোষ চোখমুখ দেখে ফাদার আর কতটুকু কি অনুমান করতে পারলেন, জানি না। বললেন, কেন তোমরা খ্রিষ্টান হতে চাও? 

আমি চটপট জবাব দিই, বিদেশ যাওয়ার জন্য। জবাব শুনে পাদ্রি বাবা খুশি হলেন বলে মনে হলো না। তিনি একটু গম্ভীর মুখে বললেন, বালক তোমার ভেতর লোভ ঢুকেছে। তুমি প্রভু যিশুর প্রতি ভালোবাসা থেকে খ্রিষ্টান হতে চাও না। বিদেশ যাওয়ার লোভে খ্রিষ্টান হতে চাও। 

যাক, আমার আর খ্রিষ্টান হওয়া হলো না। সে রাতটা দিনাজপুরে বিজনের দাদার বাসায় কাটিয়ে পরদিন বাড়ি ফিরে আসি। বিজনের দাদা-প্রফুল্ল কিশোর দত্ত পড়াশোনার জন্য দিনাজপুরে গিয়ে ওখানেই স্থায়ী হয়েছিলেন। খ্রিষ্টান হতে না গেলে তাঁর সঙ্গে হয়তো পরিচয়ও হতো না। প্রফুল্লদাও খুব ভালো মানুষ ছিলেন। ওই এক রাত থেকেই বুঝেছিলাম, তিনি কতটা সংবেদনশীল মনের অধিকারী ছিলেন। মনে আছে, গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেল কারও ডাকাডাকিতে। হারিকেনের মৃদু আলোতে দেখলাম, বৌদি দাদাকে ঠেলছেন আর বলছেন, ‘অ্যাই ওঠো না গো।’ দাদা ঘুম জড়ানো কণ্ঠেই জানতে চান, ‘কেন, কী হয়েছে?’ বৌদি বলেন, ‘তেষ্টা পেয়েছে। এক গ্লাস জল গড়িয়ে দাও।’ 

দাদা ধড়ফড় করে উঠলেন এবং কলসি থেকে গ্লাসে জল ঢেলে বৌদিকে দিলেন। তৃষ্ণা নিবারণ করে বৌদি আবার শুয়ে পড়লেন। স্ত্রীরাই শুধু স্বামীর সেবা করে না, স্বামীরাও স্ত্রী সেবা করে—প্রফুল্লদার কাছ থেকে সেই বালকবেলায় সেটা শিখেছিলাম। 

দত্তবাড়ির ১০ পুত্র সন্তানের মধ্যে বেঁচে আছেন পাঁচজন। পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন পাঁচজন। সবচেয়ে যে ছোট, সেই অমলের অকাল বিদায় সবাইকে অনেক কষ্ট দিয়েছে, ব্যথিত করেছে। অমন হাসিখুশি, প্রাণবন্ত ছেলেটা ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে জীবনযুদ্ধে পরাজিত হলো। বিএ পাস করে সোনালী ব্যাংকে চাকরি নিয়েছিল। ২৪-২৫ বছরের টগবগে যুবক, বন্ধুবৎসল, সদালাপী অমলকে বাঁচানোর চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু তা আর সম্ভব হয়নি। 

হৃদয়দা, প্রফুল্লদা, সনৎদা পরিণত বয়সেই চলে গেছেন। কিন্তু তারাপদদার বিদায়টাও কিছুটা অকালেই হয়েছে। বোনদের মধ্যে সবচেয়ে যে ছোট, সে-ই চলে গেছে সবার আগে। ওর নাম ছিল ইতি। নামটা রাখার পেছনেও বুঝি বিশেষ তাৎপর্য ছিল। ১৪ সন্তানের শেষ জন। তাই কি ইতি? বাবা-মা হয়তো আর সন্তান কামনা করেননি! ইতি আমাদের ছোট বোনের মতোই ছিল। ওর বিয়ে হলো বোদারই সুনীল কর্মকারের সঙ্গে। সুনীল আবার সম্পর্কে আমার মামা। বয়সে আমার ছোট। আমার ছোট কাকার নাম ছিল সুনীল সরকার। সে জন্য, নাকি অন্য কোনো কারণে ঠিক মনে নেই, আমার ছোট কাকিমা সুনীল কর্মকারের মাকে ‘মা’ ডাকতেন। এভাবে দুই পরিবারের মধ্য আত্মীয়তার সম্পর্ক হয়ে যায়। এভাবে ইতি আমার মামি। ওকে আমি মামি বললে রাগ করত। কারণ, আমি তো ছিলাম ওর দাদা। সুনীল এবং ইতি মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে ইহলোক ত্যাগ করে। 

বোনদের মধ্যে সবচেয়ে বড় অঞ্জলিদির বিয়ে হয়েছে কুড়িগ্রামে। তাঁর ছোট জ্যোৎস্নাদির দিনাজপুরে বিয়ে হলেও এখন তারা ভারতে চলে গেছেন। তার পরের বোন মঞ্জু সম্ভবত এখন বোদায়ই আছে। 

দত্তবাড়ির অন্তত চার সদস্য ভালো অভিনয় করতেন। একসময় বোদা ছিল সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে বেশ অগ্রসর। গান-বাজনা, অভিনয় ইত্যাদির প্রতি অনেকেরই অনুরাগ ছিল। প্রতিবছর এক বা একাধিক নাটক মঞ্চস্থ হতো। দত্তবাড়ির শিবেনদা, সনৎদা এবং তারাপদদা অভিনয় করে যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছিলেন। তাঁদের পিসতুতো দাদা দয়াল চন্দ্র ঘোষও ভালো অভিনয় করতেন। তিনি দত্তবাড়ির চৌহদ্দিতেই বসবাস করতেন। 

সে সময় পুরুষেরাই নারী চরিত্রে অভিনয় করতেন। সনৎদা এবং তারাপদদা নারী চরিত্রে অভিনয় করতেন। নায়িকা হিসেবে তারাপদদাকে মানাতোও ভালো। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো যে, নারী চরিত্রে অভিনয় করে বোদার আরও দুজন খুব জনপ্রিয় হয়েছিলেন। তাঁদের একজন বোদা বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও আওয়ামী লীগ নেতা রবিউল আলম সাবুলের বাবা আব্দুল চাচা এবং আরেকজন আমার পিসতুতো দাদা কার্তিক সরকার। এরা দুজনই প্রয়াত। 

নাটকের এই ধারাটা আমরাও অব্যাহত রেখেছিলাম। ক্লাস ফাইভ থেকে শুরু করে ক্লাস নাইন পর্যন্ত আমরা বন্ধুরাও প্রতিবছরই নাটক করতাম। ক্লাস এইটে উঠে তো আমাদের নাটকের ভূতে পেয়েছিল। সে বছর আমরা চারটি নাটক মঞ্চস্থ করেছিলাম। হুলুস্থুল কাণ্ড আর কি! অভিভাবক এবং শিক্ষকদের শাসানি ছাড়াও ছাত্র আন্দোলনে বেশি জড়িয়ে পড়ায় নাটক থেকে আমরা দূরে সরে আসি। 

আমরা অবশ্য নারী চরিত্র বর্জিত নাটকই করতাম। একটু কম নাটকীয়তা থাকলেও আমাদের আনন্দে কোনো ঘাটতি থাকত না। 

দত্তবাড়ির অনিল দত্ত, শিবেন দত্ত, বিজন এবং শ্যামল, যার যার মতো করে জীবন ও সংসার নিয়ে আছেন। সুকুমার দত্ত, অর্থাৎ স্বামী পরদেবানন্দজির কথা আগে বলেছি। তিনি এখন ঢাকায় শ্রীরামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমে আছেন। তিনি ‘তীর্থের পথে পথে’ নামে দুই খণ্ডের বড় দুটি বইও লিখেছেন। 

শিবেনদা একসময় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বেশ সক্রিয় ছিলেন। এখন সম্ভবত ‘ধর্মকর্ম’ নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকেন। 

বিজনের সুবাদে ও বাড়ির সবাইকে দাদা বললেও অনিল বাবুর বেলায় ব্যতিক্রম। তাঁকে কখনো দাদা বলেছি কি-না, মনে করতে পারছি না। আমার বাবার নাম অনিল। দুই অনিল ছিলেন আবার বন্ধুস্থানীয়। তাই আমি দত্তবাড়ির অনিল বাবুকে দাদা-কাকা কিছু না বলে ‘ভাবে সপ্তমী’ চালিয়ে দিতাম। দত্ত পরিবার এখন ভেঙে অনেক পরিবার হয়েছে। বাড়িগুলো প্রায় এক চৌহদ্দিতেই আছে। 

বিজনের সঙ্গে যোগাযোগটা এখনো অটুট আছে। আমাদের দুজনের আগ্রহেই এটা হয়েছে। 

লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

নির্বাচনের পথে দেশ

সম্পাদকীয়
নির্বাচনের পথে দেশ

অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলো। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের পথরেখা বেঁধে দিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তফসিল নিয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে। প্রতিটি দলই এখন নির্বাচনী প্রস্তুতির জন্য উঠেপড়ে লাগবে। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত নির্বাচন একটি সুস্থির সমাজব্যবস্থার দিকে দেশকে পরিচালিত করবে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

এরই মধ্যে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে গেছে। তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সদ্য পদত্যাগকারী দুই ছাত্র উপদেষ্টার পদত্যাগ কার্যকর হয়েছে। এই দুই উপদেষ্টার নির্বাচনে অংশ নেওয়া না-নেওয়া নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বিদেশি রাষ্ট্রদূতদেরও সক্রিয় দেখা গেছে নানাভাবে। বিভিন্ন দলের নেতাদের কাছে তাঁরা যাচ্ছেন, কথা বলছেন। এরই মধ্যে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে বেশ কিছু সংকট তৈরি হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কেন দেশে ফিরতে পারছেন না, তা নিয়ে জেগেছে প্রশ্ন। যে চাপের কথা তারেক রহমান নিজেই বলেছেন, সেই চাপ দেশের অভ্যন্তরের নাকি বিদেশি কোনো শক্তির তরফ থেকে—সে কথাও আলোচিত হয়েছে।

২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জোট সরকারের বিরুদ্ধে অর্থ লোপাট, দুর্নীতি, হাওয়া ভবনের মাধ্যমে প্যারালাল সরকার চালানোর অভিযোগসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। এদিকে ডাকসু নেতাদের কিছু কথা, কিছু কর্মকাণ্ড নিয়েও প্রশ্ন জেগেছে মানুষের মনে। তফসিল ঘোষণার দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীল দলের এক নেতাকে একজন ডাকসু নেতার নেতৃত্বে হেনস্তা করার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে এই ন্যক্কারজনক ঘটনা। সবচেয়ে শঙ্কার বিষয় হলো, দেশে-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের মূল নায়কদের নিয়ে কটাক্ষ করে কথা বলার প্রবণতা বেড়েছে। যাঁরা বলছেন, তাঁরা দেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যমকেও ব্যবহার করছেন। অজস্র মিথ্যার বেসাতি গড়ে তোলা হচ্ছে, অথচ তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারকে কোনো দৃষ্টান্তমূলক অবস্থান নিতে দেখা যায়নি।

আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনব্যবস্থা কলুষিত করা, দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, প্রতিষ্ঠান ভেঙে ফেলাসহ বহু অভিযোগ ছিল। যে রাজনৈতিক দলগুলো নির্যাতিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ আমলে, তারাই ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর যে রূপে আবির্ভূত হয়েছে, তা মোটেই জনগণের প্রত্যাশিত রূপ নয়। সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত বিভিন্ন দলের দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, পদ-বাণিজ্য, খুনোখুনির খবর ভেসে আসছে। যে ছাত্র নেতৃত্বের ওপর ভরসা রাখার কথা ভেবেছে তরুণ প্রজন্ম, সেই তরুণেরাও আজ দ্বিধান্বিত। এ রকম এক অস্থির সময়ে আসছে নির্বাচন। আশা থাকবে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, ব্যবসায়ীদের অবাধে কাজের সুযোগ, শিক্ষাঙ্গনে শৃঙ্খলা, রাজনৈতিক দলের চাঁদাবাজি বন্ধ, সাধারণ মানুষের জীবন ও কাজের নিরাপত্তাসহ কল্যাণকর কাজগুলো করবে নির্বাচিত সরকার। তবেই অস্থিরতা থেকে বের হওয়ার একটা উপায় খুঁজে পাওয়া যাবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

যে প্রশ্নগুলোর জবাব পেতে হবে

জাহীদ রেজা নূর
আমাদের দেশের কিছু আইন ব্যবসায়ী আমাদের বিজয় নিয়ে, বিজয়ের নায়কদের নিয়ে যেসব কথা বলে চলেছেন, তার তীব্র প্রতিবাদ হওয়া দরকার। ছবি: সংগৃহীত
আমাদের দেশের কিছু আইন ব্যবসায়ী আমাদের বিজয় নিয়ে, বিজয়ের নায়কদের নিয়ে যেসব কথা বলে চলেছেন, তার তীব্র প্রতিবাদ হওয়া দরকার। ছবি: সংগৃহীত

হঠাৎ করেই বিজয়ের মাসে দেখা গেল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তি করছে একদল মানুষ। এই প্রবণতাকে পাত্তা না দিলেও চলত, কিন্তু সেগুলো যদি জাতীয় প্রচারমাধ্যম থেকে প্রচারিত হয়, তখন সত্যিই একটু ভাবতে হয়। এর যে প্রতিবাদ হওয়া দরকার, সেটা অনুভব করতে হয়। আইন বিষয়ে পড়াশোনা করলে আইন ভালোভাবে শেখা হয় বটে, কিন্তু ব্যারিস্টার বা উকিল হলেই দেশের ইতিহাস ভালো জানবে—এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমাদের দেশের কিছু আইন ব্যবসায়ী আমাদের বিজয় নিয়ে, বিজয়ের নায়কদের নিয়ে যেসব কথা বলে চলেছেন, তার তীব্র প্রতিবাদ হওয়া দরকার। তাঁদের ব্যাপারে সরকারের অবস্থানও পরিষ্কার করা উচিত। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বশীল কারও কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে করা কটাক্ষের ব্যাপারে তেমন কোনো কড়া কথা আমি অন্তত বলতে শুনিনি।

যতদূর স্মরণ করতে পারি, ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানটি স্বাধীনতা বা বিজয় দিবসকে ছোট করার জন্য সংঘটিত হয়নি। একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের অঙ্গীকারে শামিল হয়েছিল দেশের আপামর মানুষ। এদের সবাই একই ভাবনা নিয়ে সামনের পথে এগোয়নি। সরকার পতন হলে কী হতে পারে কৌশল—এ রকম ভাবনাও কারও মাথায় ছিল বলে মনে হয় না। দেশের ছাত্র-জনতা এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল প্রাণের তাগিদে। যখন লাশ পড়ছিল একের পর এক, তখন রাজপথকেই বেছে নিয়েছিল তারা। কিন্তু এই প্রচণ্ড আলোড়নে সরকার পড়ে যাবে—এ রকম ভাবনা হয়তো তাদের ছিল না। ছিল না সে রকম কোনো প্রস্তুতি। তাই গণ-অভ্যুত্থানের বিজয় কিছু প্রগাঢ় নীতিকথার জন্ম দিলেও রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক কোনো দিশা দেয়নি। শুধু কি নীতিকথা? অশ্রাব্য উচ্চারণ করে লাইক-কমেন্টে ছেয়ে যাওয়া একদল নেতার সন্ধান আজকাল পাওয়া যাচ্ছে, যাঁরা টিনের চালে কাউয়ার পাশাপাশি আরও কত কিছু দেখছেন! বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করতে করতে চাঁদাবাজি করার পথে শামিল হচ্ছেন। আর এই ধরনের অরাজকতা চালানোর পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের গলায় জুতার মালা পরিয়ে প্রচার করছেন গণমাধ্যমে। তাঁরা ভাবছেন, স্বাধীনতার সব অর্জনকে কটাক্ষ করতে পারলে এ দেশের মানুষ একদিন ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’-এর সহযাত্রী হয়ে উঠবে আবারও।

কী হতে কী হয়ে গেল, এখন স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস নিয়ে কথা বলতে ভয় পায় মানুষ। একটি স্বাধীন দেশে স্বাধীনতা বা বিজয় শব্দগুলো কি নিষিদ্ধ হয়ে গেল নাকি? গত বছর শিল্পকলা একাডেমি যখন বিজয় উৎসব পালন করছিল, তখন ভয়ে ভয়ে তারা ‘বিজয় উৎসব’কে ‘ডিসেম্বর উৎসব’ লিখেছিল, সে কথা কি মনে আছে কারও? পরে প্রবল আপত্তির মুখে আবার তারা ‘বিজয় উৎসব’-এ ফিরে এসেছিল। স্বাধীনতা আর বিজয় শব্দ দুটি উচ্চারণ করার মতো বুকের পাটা নেই একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের—এটা যে কত বড় দুর্ভাবনার ব্যাপার, তা কি বলে বোঝানো যাবে?

১৯৭১ সালে যে ঘটনা ঘটেছিল এই ভূখণ্ডে, তার ছাপ পাওয়া যায় সারা বিশ্বে। সে সময়কার বিশ্বের দিকে তাকালে বোঝা যায়, কোন কোন ব্যাপার নিয়ে অস্থিরতা চলছিল। মনে করিয়ে দিই, রাশিয়া-চীনের দ্বন্দ্বের কারণে কমিউনিস্ট দুনিয়ার ভাঙন, পরাশক্তি হিসেবে মার্কিনদের বিজয়যাত্রা, সাম্রাজ্যবাদের বিকাশ, উপনিবেশগুলো ভেঙে নতুন নতুন স্বাধীন দেশ গঠন এবং তার কোনো কোনো দেশের বাম দিকে ঘেঁষা রাজনীতি, কিছু কিছু দেশে নব্য স্বৈরাচারের আবির্ভাব ইত্যাদি নানা প্যাঁচে পড়ে অস্থির হয়ে পড়েছিল বৈশ্বিক রাজনীতি। ভিয়েতনাম যুদ্ধ তখন আলোচনায় রয়েছে। এ রকমই একটা অবস্থায় ষাটের দশকের মধ্যভাগে ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করলেন ৬ দফা। সেই ৬ দফা নতুন কিছু ছিল না। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে কিংবা ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ইশতেহারেও এই আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টির দেখা মেলে। ১৯৬৬ সালের দিকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের চালানো শোষণ-বঞ্চনার বিষয়টি আমূল প্রকাশিত হয়ে পড়লে তা বাঙালির আবেগকে তাড়িত করেছিল। ফলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই ভূখণ্ডের মানুষ জানান দিয়েছিল, মাথায় হাত বোলানোর রাজনীতি আর চলবে না এখানে।

এত বড় বড় দল থাকতে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে কী করে আওয়ামী লীগ এত বড় বিজয় পেল, সে ইতিহাস নানাভাবে লেখা হয়েছে। এটাই ছিল বাংলার রায়। দেশের জনগণ সেই রায়ে ক্ষমতা দিয়েছিল ক্যারিশম্যাটিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে। সলিমুল্লাহ খানদের গুরু আহমদ ছফার বিখ্যাত উক্তিটি এখানে প্রযোজ্য। ছফা লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং শেখ মুজিবুর রহমান একটি যমজ শব্দ। একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটার অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। যারা এই সত্য অস্বীকার করবে, তাদের সঙ্গে কোনো রকমের বিতর্ক, বাদ-প্রতিবাদ করতেও আমরা রাজি হব না।’ ভুল শোনেননি, ছফা এ কথাই বলেছেন। এবং এখানেই তা শেষ করেননি। তিনি যোগ করেছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে শেখ মুজিবের নাম এমন অচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছে, যত পণ্ডিত হোন না কেন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের নিপুণতা এবং যুক্তির মারপ্যাঁচ দেখিয়ে কোনো ব্যক্তি একটা থেকে আর একটাকে পৃথক করতে পারবেন না।’

ছফাকে এসব কথা বলতে হলো কেন? তিনি তো তাঁর শিষ্যদের মতোই শেখ মুজিবকে অগ্রাহ্য করে অথবা জাতির ভিলেন বানিয়ে উপস্থাপন করতে পারতেন। কেন ছফা সেটা করেননি? আমার মনে হয়, ছফা ভেবে দেখেছেন, ইতিহাস নিয়ে মিথ্যে তথ্য দিলে ইতিহাসের কোনো না কোনো পর্যায়ে এসে তা ধরা পড়বেই। তখন আত্মপরিচয়েই টান পড়বে। শেখ মুজিব সম্পর্কে নানা ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য করলেও ছফা স্বাধীনতা ও শেখ মুজিবের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে নির্মোহ মতামত দিয়েছেন।

ইতিহাসবিমুখ পাকিস্তানপ্রেমী অর্বাচীনেরা এই স্বাধীন বাংলাদেশে বসে ইতিহাস বিকৃতি করে চলেছেন। এতে আমাদের তরুণসমাজ কতটা বিভ্রান্ত হবে, সে প্রশ্নের উত্তর এত দ্রুত পাওয়া যাবে না।

বিষয়টি বুঝতে চাইলে কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা করা দরকার। আমাদের সমাজে এই প্রতীকগুলো কীভাবে আছে, তা বুঝতে পারলেই স্বাধীনতা বা বিজয় আমাদের দেশে এখন কোন মর্যাদায় আছে, তা বোঝা যাবে। স্বাধীনতা বা দেশপ্রেমকে হুমকির মুখে ফেলতে হলে এমন কিছু কাজ করতে হয়, যাতে শুরুতেই ভয় আর আতঙ্ককে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। তারপর প্রতিষ্ঠিত সত্যগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। পতাকা, জাতীয় সংগীত নিয়ে বাজে কথা বলা—এভাবেই আস্তে আস্তে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র তাদের পায়ের নিচে মাটি খোঁজে।

পাঠক, আপনি মনে করুন একটি পরীক্ষা দিতে বসেছেন। আমি কিছু প্রশ্ন রেখে যাব, পাঠক এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে নিজেই এই পরীক্ষার প্রশ্নগুলোয় নম্বর দেবেন। তাঁরাই নির্ধারণ করবেন, কেমন আছে আজকের বাংলাদেশ।

প্রশ্নগুলো এমন: কেমন আছে দেশের বিচারব্যবস্থা? কেমন আছে নির্বাচন কমিশন? তারা কি স্বাধীনভাবে নিজেদের কাজ করে যাচ্ছে?

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কোন অবস্থায় আছে? সাংবাদিক-লেখক-গবেষকেরা কি নির্দ্বিধায় নির্বিঘ্নে কাজ করার মতো পরিবেশ পাচ্ছেন?

সমাজে কোনো বড় সংঘাত নেই তো? ঐক্যের কথা বলা হচ্ছে সব জায়গা থেকে। দেশের ডাকসাইটে স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সেই ঐক্য কি দেখা যাচ্ছে? বিভাজনের রাজনীতিকে কি সরিয়ে দেওয়া গেছে? সন্দেহ-অবিশ্বাসের রাজনীতি কি আছে, নাকি বিদায় নিয়েছে?

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সাধারণ জনগণ কি সন্তুষ্ট? মব বলুন আর চাপ প্রয়োগের রাজনীতি বলুন, সেগুলো কি জনমনে ভীতি ছড়াচ্ছে?

আপনি কি এমন কিছু লক্ষ করছেন, যেখানে সত্য ও মিথ্যাকে কাছাকাছি রেখে নাগরিকদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেওয়া হয়?

আপনি কি সামাজিক বন্ধন ভেঙে ফেলার প্রবণতা লক্ষ করেছেন? আউল-বাউলের দেশে গানবাজনা কি হুমকির মুখে পড়েছে? ‘তৌহিদি জনতা’ আদতে কাদের কোন লক্ষ্য বাস্তবায়ন করছে? সরকার কি এদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে? উত্তেজনা ছড়ায় যারা, তাদের পুলিশ ছেড়ে দিচ্ছে, আর যারা অত্যাচারিত হয়েছে, তাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে—এ রকম কিছু কি আপনার নজরে পড়েছে?

সমষ্টিগত শক্তি ভেঙে দেওয়ার জন্য কোনো বাঁশিওয়ালা কি বাঁশি বাজাচ্ছে? আপনি কি লক্ষ করেছেন শুধু ধর্মীয় সংখ্যালঘুই নয়, নানাভাবে যাঁরা সংখ্যালঘু, তাঁদের মারধর করে সংখ্যাগুরু অংশ আখের গুছিয়ে নিচ্ছে?

আপনি কি বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এমন কোনো অঙ্গীকার দেখতে পাচ্ছেন, যাতে তাদের ইশতেহার অনুযায়ী জনগণ একটি ‘সোনার বাংলা’য় বসবাস করবে?

প্রশ্নগুলোর উত্তর নিজে লিখুন। প্রতিটি প্রশ্নের জন্য ১০ নম্বর বরাদ্দ করুন। যোগফল মেলান, তারপর একটা সিদ্ধান্তে আসুন।

আপনি তখন বুঝতে পারবেন, গণ-অভ্যুত্থানকে কেউ কেউ স্বাধীনতাবিরোধিতার জায়গায় সুকৌশলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। যে তরুণেরা সেই অপচেষ্টা রুখে দিতে পারে, সে তরুণদের প্রতীক্ষায় আছি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

পুতিনের ভারত সফর: আঞ্চলিক ও বিশ্বরাজনীতিতে কী বার্তা দেয়

ড. মঞ্জুরে খোদা
রাশিয়া ঐতিহাসিকভাবে ভারতের প্রতিরক্ষা অংশীদার—পাকিস্তান যত আমেরিকার দিকে ঝুঁকেছে, ভারত তত কাছে পেয়েছে রাশিয়াকে।
রাশিয়া ঐতিহাসিকভাবে ভারতের প্রতিরক্ষা অংশীদার—পাকিস্তান যত আমেরিকার দিকে ঝুঁকেছে, ভারত তত কাছে পেয়েছে রাশিয়াকে।

গত সপ্তাহে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভারত সফর ও উভয় নেতার শীর্ষ বৈঠক অনেক কিছুরই ইঙ্গিত করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী পুতিনকে যেভাবে আলিঙ্গন করেছেন, স্বাগত জানিয়েছেন, একই গাড়িতে যাত্রা করেছেন, তা আলাস্কায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের সাক্ষাতের কথাই মনে করিয়ে দেয়। মোদি প্রেসিডেন্ট পুতিনকে সময়ের পরীক্ষিত বন্ধু, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আস্থার প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করেন। এই আস্থা ও হৃদ্যতা ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের গভীর মাত্রাকেই নির্দেশ করে। পুতিন তাঁর ক্ষমতা গ্রহণের ২৫ বছরে ১০ বার ভারত সফর করেছেন। তবে ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর এটিই ছিল তাঁর প্রথম ভারত সফর।

পুতিনের এই ভারত সফর নিছক কোনো রুটিন বিষয় ছিল না। ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের ধারাবাহিকতা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা প্রদান করে। তাঁদের সাক্ষাৎ ছিল বিশ্বরাজনীতির আগ্রহের বিষয়, কেননা ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর শুল্ক নিয়ে মোদির সঙ্গে যে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছিল ও বরফ গলছিল, তখনই পুতিন ভারত সফর করলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত-রাশিয়া এই বৈঠকে কে কী অর্জন করল, তার কয়েকটি দিক আলোচনা করা যাক।

প্রতিরক্ষা সহযোগিতা

পুতিনের এই সফরের মাধ্যমে ভারত তাদের প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়টি পুনরায় নিশ্চিত করল। রাশিয়া এখনো ভারতের প্রধান সমরাস্ত্রের সরবরাহকারী। যদিও ১৯৭০-৮০-এর দশকে ভারতের অস্ত্রের প্রায় ৮০ ভাগই রাশিয়া সরবরাহ করত। পুতিন এবারের সফরে ভারতকে এস ৫০০ আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা সিস্টেম হস্তান্তর, অতিরিক্ত সামরিক প্ল্যাটফর্ম, হেলিকপ্টার ও ইঞ্জিন কো-প্রোডাকশনসহ দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পগুলো নিয়ে আবারও তাদের প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করেছে। ‘প্রিভিলেজ কম্প্রিহেনসিভ স্ট্র্যাটেজিকস পার্টনারশিপ’ চুক্তির আওতায় রাশিয়ার সেনাবাহিনী ভারতের যেকোনো স্থল, বিমান ও নৌবন্দরকে তাদের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারবে। সামরিক প্রয়োজনে একে অন্যের ভূমিও ব্যবহার করতে পারবে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি সত্ত্বেও রাশিয়ার সঙ্গে এই প্রতিরক্ষা বোঝাপড়ার মাধ্যমে ভারত তাদের কৌশলগত নিজস্বতা নিশ্চিত করল।

জ্বালানি ও অর্থনৈতিক সুবিধা

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে ভারত রাশিয়া থেকে অনেক কম মূল্যে বিপুল তেল আমদানি করছে। এই সফরের মাধ্যমে ভারত তাদের জ্বালানিনিরাপত্তা, পরিশোধন সক্ষমতা, দীর্ঘমেয়াদি তেল-গ্যাস চুক্তিকে আরও শক্তিশালী করল। রাশিয়ার সস্তা অপরিশোধিত তেল ভারতের মুদ্রাস্ফীতি কমাতে, বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় ও সঞ্চয় করতে এবং পরিশোধন মুনাফা বাড়াতে সাহায্য করছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বে জ্বালানির বাজার অস্থিতিশীল হলে রাশিয়ার জ্বালানি শক্তি এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে ভবিষ্যতেও ভূমিকা রাখবে।

বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ

২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারত-রাশিয়ার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য প্রায় ৬৮ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। যদিও এই বাণিজ্য ভারসাম্যমূলক নয়। রাশিয়ায় ভারতীয় আমদানি প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার। তবে পুতিন-মোদি শীর্ষ সম্মেলনে উভয় দেশ ২০৩০ সালের মধ্যে এই বাণিজ্য ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এ ক্ষেত্রে বাণিজ্যপণ্যের তালিকা সম্প্রসারণ ঘটবে।

রাশিয়া ভারতীয় সরঞ্জাম, কাঁচামাল এবং খাদ্যপণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধিসহ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য প্রসারিত ও বৈচিত্র্যময় করার উপায়গুলো অনুসন্ধান করবে। অর্থনীতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং সাংস্কৃতিক সহযোগিতার ওপর ভারত-রাশিয়া আন্তসরকারি কমিশনও গঠিত হবে। মহাকাশ গবেষণা ও ভারত-রাশিয়ার যৌথ সামরিক যন্ত্রাংশ নির্মাণ এবং ভারত তা তৃতীয় কোনো দেশে নিজের উৎপাদিত পণ্য বলে বিক্রিও করার সুবিধা পাবে। ভারতে রুশ নকশায় দ্বিতীয় বৃহত্তম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনার কথা জানানো হয়।

ভূরাজনীতি ও কূটনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি

রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ভারতের জন্য চীন-রাশিয়া ব্লকের মধ্যে কিছুটা ভারসাম্য তৈরি করবে। ভবিষ্যতে চীন সীমান্ত সমস্যায় রাশিয়ার নিরপেক্ষতা বজায় রাখা ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মধ্য এশিয়া, আর্কটিক, নর্থ-সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডর—এইসব কৌশলগত এলাকায় সহযোগিতা বাড়ানো ভারতের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ রক্ষায় সহজ হবে।

বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় রাশিয়া চীনের ওপর ক্রমেই নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে এবং একে অন্যের বন্ধুত্ব ও আস্থার সম্পর্ক তারা নিজেরাই ঘোষণা করেছে। এই পরিস্থিতিতে রাশিয়া-ভারতের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রাখার মাধ্যমে চীনকেও জানিয়ে দেওয়া যে, রাশিয়া এখনো ভারতের গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার।

রুশ প্রেসিডেন্টের ভারত সফরের আগে ভারতের সাংবাদিকেরা পুতিনের মুখপাত্র দমিত্রি পেসকভকে প্রশ্ন করেছিলেন, ভারত ও চীনের মধ্যে যদি কোনো সংঘাত ও যুদ্ধ হয়, সে ক্ষেত্রে ভারত কি আশা করতে পারে যে রাশিয়া তাদের পাশে দাঁড়াবে? তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা আশা করি, ভারতের সঙ্গে চীনের যে বিরোধগুলো আছে, সেগুলো তারা মিটিয়ে ফেলবে। এ ক্ষেত্রে রাশিয়া একটি প্রস্তাবও দিয়েছিল হিমালয়ের ওপর দিয়ে সীমান্ত রেখা নিয়ে যে সমস্যা, সেটাকে তারা জিপিএস পদ্ধতি ব্যবহার করে সমাধান করতে পারে। সে ক্ষেত্রে রাশিয়া সহায়তা করতে পারে।’

পাকিস্তান রাশিয়া থেকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু সামরিক ও জ্বালানি সুবিধা নিতে চেয়েছিল, কিন্তু সেটা হয়ে ওঠেনি। পুতিনের ভারত সফর পরিষ্কার করে দিয়েছে যে দক্ষিণ এশিয়ায় রাশিয়ার মূল অংশীদার এখনো ভারতই। এটি ভারতের আঞ্চলিক নেতৃত্বের অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করবে।

ব্রিকস সম্প্রসারণের সময় ভারত-রাশিয়া সমন্বয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ব্রিকসের নেতৃত্বে জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্যপদের ভারতের আকাঙ্ক্ষাকে রাশিয়ার সমর্থন ও সহযোগিতার প্রতিশ্রুতির কথাও জানা গেছে। গ্লোবাল সাউথে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় ভারত দেখাতে চায় যে তার পশ্চিমা ও অ-পশ্চিমা উভয় ব্লকের ওপর প্রভাব আছে।

ভারতের যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কের সমীকরণ

যুক্তরাষ্ট্র ভারতের প্রধান নিরাপত্তা অংশীদার হলেও ভারত রাশিয়ার সঙ্গে এই সংযোগ ও সম্পর্কের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছে যে মিত্রতা মানেই নির্ভরতা নয়, নিজেদের স্বকীয়তাকে বিসর্জন দেওয়া নয়। ভারতের এই অবস্থান ওয়াশিংটনের কাছে স্পষ্ট

বার্তা দেয় যে ‘India will cooperate, but not at the cost of its autonomy.’ ভারত-রাশিয়ার এই কৌশলগত সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়া ও ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের সমীকরণে নতুন ভারসাম্য তৈরি করবে।

যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, জাপানসহ পশ্চিমা দেশগুলোর চাপ থাকা সত্ত্বেও ভারত রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে দেখিয়েছে যে ভারত কারও বা কোনো বলয়ে আবদ্ধ বা দায়বদ্ধ নয়। ভারতের এই স্বতন্ত্র অবস্থান বলে দেয়, জাতীয় স্বার্থ অনুযায়ী তারা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম এবং এটি তাদের একটি মূলনীতির দৃঢ় প্রকাশ।

সামগ্রিক মূল্যায়ন

পুতিনের ভারত সফর একটি ভূকৌশলগত বার্তা—ভারত তার বহুমুখী বৈদেশিক নীতি ও কৌশলগত স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এক প্রভাবশালী মধ্যম শক্তি হিসেবে অবস্থান করছে। পুতিনের এই সফরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা হচ্ছে, ভারত রাশিয়ার সঙ্গে জ্বালানি, প্রতিরক্ষা ও ভূরাজনীতিতে ঘনিষ্ঠ থাকবে, একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অংশীদারত্বও বজায় রাখবে। অর্থাৎ ভারত কারও পরনির্ভর নয়; বরং নিজস্ব স্বার্থের ভিত্তিতে ‘ভারসাম্যপূর্ণ ক্ষমতার রাজনীতি করবে। রাশিয়া এই সম্পর্ককে ব্যবহার করে পশ্চিমা, বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকার একচেটিয়া কূটনীতির বিকল্প হিসেবে ভারতকে দেখছে।

কয়েক মাস ধরে আমেরিকার পক্ষ থেকে ভারতকে রাশিয়ার তেল আমদানি ও রাশিয়া-ভারত সম্পর্কের চাপ তৈরি করেছে শুল্ক বৃদ্ধির অস্ত্রকে ব্যবহার করে। তা সত্ত্বেও ভারত তাকে গুরুত্ব না দিয়ে তাদের নিজস্ব নীতিতে অগ্রসর হয়েছে। রাশিয়া ঐতিহাসিকভাবে ভারতের প্রতিরক্ষা অংশীদার—পাকিস্তান যত আমেরিকার দিকে ঝুঁকেছে, ভারত তত কাছে পেয়েছে রাশিয়াকে। এ জন্যই দেশ দুটি সামরিক ও সামরিক প্রযুক্তিগত অংশীদারত্বের অন্যতম প্রধান বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেছে। পুতিনের সফরের আগে এক ব্রিফিংয়ে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, ভারতের সঙ্গে যা ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে, তার সবই ভাগ করে নেওয়া হবে। পুতিনও এই সফরের মাধ্যমে রাশিয়াকে একঘরে করার যে পশ্চিমা প্রচার ছিল, তার অনেকটা ভুল প্রমাণ করেছেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

কেন থমকে যাচ্ছে মেট্রোরেল

সম্পাদকীয়
কেন থমকে যাচ্ছে মেট্রোরেল

ঢাকা শহরের যানজটের সমস্যা থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি দিয়েছে মেট্রোরেল। তবে এটা চালুর প্রায় দেড় বছরে এই আধুনিক গণপরিবহনব্যবস্থা মাঝে মাঝে বন্ধ হয়েছে। সেটা একটা ভাবনার বিষয়। মূলত এই সময়ের মধ্যে অন্তত ১০ বার মেট্রোরেল চলাচলে বাধার সৃষ্টি হয়েছে, যার বেশির ভাগই জনগণের গাফিলতির কারণে হয়েছে।

এই দেড় বছরে মেট্রোরেল লাইনে কাপড়, ব্যাগ, ড্রোন, তার নিক্ষেপের কারণে ট্রেন চলাচল ব্যাহত হয়েছে। এখনই যদি এসব সমস্যা সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ না করা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে আরও বড় দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। একটা ভালো ব্যাপার যে, মেট্রোরেলের নিরাপত্তাব্যবস্থা এমন যে রেললাইনে সামান্যতম বাধা সৃষ্টি হলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ট্রেন থেমে যায়। এটি দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য ভালো দিক হলেও, মানবসৃষ্ট কারণে ঘন ঘন এই থমকে যাওয়া আধুনিক এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে কর্তৃপক্ষকে সেসব সমস্যা সমাধানের দিকে দৃষ্টি দেওয়া জরুরি।

জনগণ দ্বারা সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে করণীয় নিয়ে এখনই ভাবতে হবে কর্তৃপক্ষকে। তবে প্রযুক্তিগত সমস্যাও যে আছে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিছুদিন আগে ফার্মগেট এলাকায় বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে একজনের নিহত হওয়ার ঘটনাটি এই আধুনিক পরিবহনব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা তৈরি করেছে। বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার ঘটনায় ১১ ঘণ্টা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। যান্ত্রিক ত্রুটি হতেই পারে, তবে গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা সরঞ্জাম বারবার বিকল হওয়া বা খুলে পড়ার ঘটনাটি মেট্রোরেলের কারিগরি তদারকি ও রক্ষণাবেক্ষণ পদ্ধতি নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত নজরদারি ও রক্ষণাবেক্ষণে আরও গুরুত্ব দেওয়া আবশ্যক। এক সূত্র থেকে জানা যায়, এই নিহতের ঘটনা এবং অন্যান্য ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মেট্রোরেলে আগের তুলনায় ১০ শতাংশ যাত্রী কমে গেছে।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা মেট্রোরেল চলাচল স্বাভাবিক রাখতে কিছু কার্যকর পদক্ষেপের পরামর্শ দিয়েছেন। যেমন মেট্রোরেলের লাইনে বস্তু শনাক্ত করতে ‘অবজেক্ট ডিটেকশন সেন্সর’ ও ‘এআই-চালিত সিসিটিভি’ স্থাপন করা, ড্রোন পড়া প্রতিরোধে ‘ড্রোন ডিটেকশন রাডার’ ও ‘জিওফেন্সিং সিস্টেম’ ব্যবহার করার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া। এ ছাড়া বৈদ্যুতিক লাইনে সুরক্ষা নেট বসালে বাইরে থেকে তার বা বস্তু নিক্ষেপ ঠেকানো সম্ভব।

মেট্রোরেল দেশের সম্পদ। জনগণের মধ্যে সে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এর সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব। ডিএমটিসিএলকে প্রযুক্তিগত ত্রুটিগুলো দ্রুত সমাধান এবং রক্ষণাবেক্ষণে সর্বোচ্চ মান বজায় রাখতে হবে। একই সঙ্গে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে, যাতে মানুষ বুঝতে পারে তাদের সামান্য ভুল বা অসচেতনতা হাজার হাজার যাত্রীর ভোগান্তি এবং মারাত্মক দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। সচেতনতা ও প্রযুক্তিগত সুরক্ষা—এই দুইয়ের সমন্বয়েই কেবল মেট্রোরেলের মসৃণ ও নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করা সম্ভব। এই আধুনিক পরিষেবা যেন মাঝে মাঝে থমকে যাওয়ার দুর্নাম থেকে মুক্তি পায়, সেই প্রত্যাশা আমাদের।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত