Ajker Patrika
সাক্ষাৎকার

চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনাল একটা লাভজনক প্রতিষ্ঠান: অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ

চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনাল একটা লাভজনক প্রতিষ্ঠান: অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ

আনু মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক। তিনি ‘সর্বজনকথা’ পত্রিকার সম্পাদক। দীর্ঘদিন তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে ‘গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি’র কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করছেন। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়া হলে দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কী প্রভাব পড়তে পারে, এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা

মাসুদ রানা

চট্টগ্রাম বন্দর দেশের আমদানি-রপ্তানির ৯০ শতাংশের বেশি পরিচালনা করে এবং লোকসানও হয় না। তারপরও কেন এটা বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়া হচ্ছে?

সেটা আমাদেরও একটা প্রশ্ন। দেশের মধ্যে এ রকম কোনো প্রতিষ্ঠান নেই বা বন্দর কর্তৃপক্ষের যথেষ্ট লোকজন নেই—এ রকম যদি কোনো অসহায় পরিস্থিতি তৈরি হতো এবং যারা এটা পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত, তারা এটাকে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে—এ রকম পরিস্থিতি থাকলে তার একটা যুক্তি থাকত। কিংবা যদি নতুন প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি নেই এবং সেগুলো কেনার অর্থ নেই, এভাবে কথা বলে সরকার একটা যুক্তি সাজাতে পারত। কিন্তু এগুলোর কোনোটিরই ঠিক নেই। কারণ, চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনাল একটা লাভজনক প্রতিষ্ঠান। শুধু লাভজনক নয়, এখন যত খরচ হয়, তার আয় হয় দ্বিগুণ। মানে উদ্বৃত্ত বিপুল পরিমাণ অর্থ আছে। এরপর নতুন নতুন যন্ত্রপাতি কেনার জন্য কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে।

আগে যে বেসরকারি কোম্পানি এবং এখন নৌবাহিনী এটা খুব দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করছে। এ বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনালের অপারেটর হিসেবে এখন পর্যন্ত কার্যক্রম পরিচালনায় কোনো ধরনের সমস্যা দেখা যায়নি। বর্তমান সরকার যে উদ্যোগটা নিচ্ছে, তাতে বড় ধরনের একটা অসংগতির জায়গা তৈরি করছে। তারা বলছে, এই বন্দরের আরও দক্ষতা বাড়াতে হবে, সে জন্য আমরা মাশুল বাড়াচ্ছি। মাশুল বাড়াতে হয় আয় বাড়ানোর জন্য। কিন্তু বন্দরের তো উদ্বৃত্ত অর্থ আছে। এ মাশুল বাড়ানো হচ্ছে আসলে বিদেশি কোম্পানির স্বার্থে। যে বিদেশি কোম্পানি এটা পরিচালনার দায়িত্ব নেবে, তাদের উদ্দেশ্য হলো মুনাফা বৃদ্ধি করা। সেই মুনাফা যাতে অনেক বেশি করা যায়, সরকার অনেক আগে থেকে তাদের নির্দেশে এবং বিশ্বব্যাংকের সুপারিশে এর মাশুল বৃদ্ধি করেছে। এর পরিণাম কী হতে পারে, সেটা আমরা এর মাশুল বৃদ্ধি থেকে দেখতে পাচ্ছি।

চট্টগ্রাম বন্দর শুধু বাণিজ্যিক কেন্দ্র নয়, এটি দক্ষিণ এশিয়ার একটি কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দর। এর ব্যবস্থাপনায় বিদেশিরা সম্পৃক্ত হলে আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে কোনো প্রভাব ফেলতে পারে?

এটা খুব গুরুতর প্রশ্ন। বিদেশি কোম্পানি তো অনেক দেশেই কাজ করে। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর হলো পুরো দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। এখান দিয়ে দেশের ৯০ শতাংশ আমদানি-রপ্তানি হয়। মোংলা বন্দর সেভাবে কাজ করে না। চট্টগ্রাম বন্দরের অন্য অনেক টার্মিনাল চালুই করা যায়নি। একটা ছোট টার্মিনাল আছে, সেটা একটা সৌদি কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছে শেখ হাসিনা সরকার। সেটাও ঠিকভাবে কাজ করছে না। সেখানে নিউমুরিং টার্মিনাল বিদেশি কোম্পানিকে অযৌক্তিকভাবে দেওয়ার যে তাগিদ বর্তমান সরকারের মধ্যে দেখা যাচ্ছে, সেটা নিয়ে আমাদের বড় আশঙ্কার জায়গা তৈরি হয়েছে। বন্দরের সক্ষমতা বাড়ার কথাটা আসলে কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এটার একমাত্র কারণ কোনো গোষ্ঠীর কৌশলগত স্বার্থরক্ষা বা কোনো গোষ্ঠীর চাহিদা পূরণ। আবার এই সরকারের কারও কারও মধ্যে বাধ্য থাকার কারণ হতে পারে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ডিবি ওয়ার্ল্ডকে এ সরকার টেন্ডার ছাড়া দিতে চাইছে। শেখ হাসিনার সরকার এই কোম্পানিকে টেন্ডার ছাড়া দিতে চেয়েছিল। আরব আমিরাত হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পকেটের একটা রাষ্ট্র। এটি কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র নয়। পকেট রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও ডিবি ওয়ার্ল্ড কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বন্দর নিতে পারেনি। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে এটা নিয়ে বিরোধিতা হয়েছিল। এ কোম্পানি বিশ্বের যেখানে কাজ করতে গেছে, সেখানে নানা ধরনের সমস্যা তৈরি করেছে।

তারপরও ডিবি ওয়ার্ল্ডকে দিতেই হবে, তার জন্য প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরু করে বিভিন্ন উপদেষ্টার মধ্যে আগ্রহ দেখে আমার মধ্যে আশঙ্কা, অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি দেশকে ভৌগোলিক, সামরিক কৌশলগত নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ফেলতে পারে।

একটি গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দরের সম্পূর্ণ বা আংশিক নিয়ন্ত্রণ বিদেশি শক্তির হাতে যাওয়াটা কি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি তৈরি করবে না?

হ্যাঁ, অবশ্যই হুমকি তৈরি করবে। এখন বাংলাদেশের প্রধান বন্দর, যার সঙ্গে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা, কৌশলগত নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও সচলতা—সবকিছু নির্ভর করছে। সেই সমুদ্রবন্দর যখন বিদেশি কোম্পানিকে দরপত্র, যাচাই-বাছাই ছাড়া এবং জনসম্মতি ছাড়া দিয়ে দেওয়া হয়, সেটা তো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এই সরকার যে এটা দেওয়ার জন্য জোরজবরদস্তি করছে, তাতে আমার আশঙ্কা হচ্ছে, সরকারের সঙ্গে অন্য কোনো অ্যাজেন্ডা জড়িয়ে আছে।

বন্দর বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়া হলে এখনকার অনেক লোকের চাকরি চলে যেতে পারে। তখন কী হবে?

ডিবি ওয়ার্ল্ডের পুরোনো রেকর্ড হলো, বিশ্বের যেসব দেশে গেছে, সেখানে লোকবল ছাঁটাই করেছে। তাদের দিক থেকে সেটা যৌক্তিক। কারণ, তারা তো মুনাফা করতে চাইবে। মুনাফা করার জন্য দুটি জিনিস দরকার। একটা হলো, মুনাফার জন্য মাশুল বৃদ্ধি করা। আর অন্যটা হলো, লোক কমিয়ে ফেলা। ডিবি ওয়ার্ল্ড মুনাফা বৃদ্ধির জন্য খরচ কমাবে। এই খরচ কমানোর জন্য তারা যে কাজ করানোর জন্য ১০ জন লোকের দরকার, সেটা তারা ৫ জন দিয়ে করাতে চাইবে। আর বাকি ৫ জনকে ছাঁটাই করে ফেলবে। এ জন্য বলা যায়, ছাঁটাই অবশ্যম্ভাবী হবে।

মাশুল বৃদ্ধি করার কারণে আমদানি করা জিনিসের মূল্য বৃদ্ধি পাবে এবং রপ্তানি করার জিনিস পাঠানোর খরচও বাড়বে। তাতে রপ্তানিকারক ব্যবসায়ীদের সক্ষমতা এবং প্রতিযোগিতা করার ক্ষমতা কমে যাবে। আর আমদানির ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশের সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে। পুরো অর্থনীতির জন্য সেটা বিপর্যয় ডেকে আনবে। এগুলো কিন্তু বিদেশি কোম্পানির স্বার্থে করা হবে। সেটার কারণে আমাদের দেশের অর্থনীতি বিপদের মধ্যে পড়বে। তাতে বলা যায়, সরকার যে কারণে এটাকে বিদেশি কোম্পানিকে দিচ্ছে, তাতে দেশের পরিণতির কী হবে, তার একটা নমুনা হচ্ছে মাশুল বৃদ্ধি।

বিদেশি কোম্পানিনির্ভর, ঋণনির্ভর, আমদানিনির্ভর নানা চুক্তি করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ এখতিয়ার কি অন্তর্বর্তী সরকারের আছে?

এই এখতিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। কারণ, শিক্ষকসহ নানা পেশার মানুষেরা যখন তাঁদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করেন, তখন সরকারের উপদেষ্টারা বলেন যে আমরা তো অন্তর্বর্তী সরকার। আমরা তো এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারি না। সেসব হলো নির্বাচিত সরকারের কাজ। কিন্তু এই কথাটা তাঁদের স্মরণে থাকে না, যখন এ ধরনের চুক্তি তাঁরা করেন।

তারা অন্তর্বর্তী সরকার—তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো নির্বাচনের জন্য যতটুকু সংস্কার করা দরকার, সেটাই তাদের প্রধান কাজ। এ ছাড়া তাদের আর কোনো কিছু করার দরকার নেই। ৩০ বছর মেয়াদি একটা চুক্তি করতে চাইছে সরকার, কিন্তু তারা দায়িত্ব ছেড়ে দেবে কয়েক মাসের মধ্যে। ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তির প্রভাব এ দেশের মধ্যে যখন পড়বে, তখন সেটার জন্য জবাবদিহি কে করবে সে সময়? সে সময় তো এদের কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ, এদের মধ্যে বেশির ভাগই দেশে থাকবেন না। এরপরও এই সরকার এই সর্বনাশা চুক্তি করার চেষ্টা করছে। এর আগে স্টারলিংকের সঙ্গে চুক্তি করেছে। এই চুক্তি কেন করা হয়েছিল, তার কোনো যুক্তি পাওয়া যায় না। আবার তারা এলএনজি আমদানি করার চুক্তি করেছে। সেটাও যথাযথ প্রতিষ্ঠানকে না জানিয়ে।

এই সরকারের কিছু ব্যক্তির ভূমিকা দেখে মনে হয়, তাঁরা বিদেশি বড় বড় কোম্পানির লবিস্ট হিসেবে কাজ করছেন! এসব হলো একটা বড় দুশ্চিন্তার বিষয়। এই সরকারের এগুলো করার কোনো এখতিয়ার নেই। তাদের একমাত্র কাজ হচ্ছে, একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করে বিদায় নেওয়া।

চট্টগ্রাম বন্দর অব্যবস্থাপনা নিয়ে সমালোচনা আছে, সেটাকে আমরা কীভাবে ত্রুটিমুক্ত করতে পারি?

অব্যবস্থাপনা নিয়ে সমস্যা আছে। তবে সেটা অপারেটর বদল করে সমাধান করা যাবে না। প্রধান সমস্যার একটা হলো কাস্টমস। বিদেশি কোম্পানিকে অপারেটর হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু কাস্টমস, পরিবহনব্যবস্থা, কনটেইনার রাখার জায়গা যদি অপরিবর্তিত থাকে, তাহলে পরিস্থিতির তেমন কোনো পরিবর্তন হবে না।

মালামাল লোড-আনলোড করতে সময় যে বেশি লাগে, বন্দরের যে অদক্ষতার সমস্যা, সেটা কিন্তু যাবে না। সেই সমস্যা থেকেই যাবে। এখনকার দায়িত্বপ্রাপ্ত অপারেটর সফল ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে। সরকার যদি কাস্টমস, আমলাতন্ত্র, পরিবহন ও যোগাযোগ সমস্যা দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিত, তাহলে অনেক ভালো হতো। এতে জট কমত এবং সক্ষমতাও বাড়ত।

ভাটার সময় এখানে বড় জাহাজ আসতে পারে না, সেটার জন্য মালামাল নামাতে বেশি সময় লাগে, সেটার জন্য টেকনিক্যাল সমস্যা দূর করতে হবে। এটা তো অপারেটরের সমস্যা না।

সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

আজকের পত্রিকাকেও ধন্যবাদ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...