Ajker Patrika

শেখ হাসিনার সরকার

ঋণ করে ঘি খাওয়ার ক্ল্যাসিক উদাহরণ

ড. মইনুল ইসলাম
Thumbnail image
হাসিনার নেওয়া নিকৃষ্ট প্রকল্পের একটি ঢাকা-মাওয়া-যশোর-পায়রা রেলপথ। ছবি: সংগৃহীত

শেখ হাসিনার পতিত স্বৈরাচারী সরকার সাড়ে ১৫ বছর ধরে এ দেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি প্রশংসনীয় গতিতে বাড়ার গল্প সাজিয়ে শাসন করেছে। মাথাপিছু জিডিপি প্রকৃতপক্ষে একটি মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ কনসেপ্ট। এটার সবচেয়ে মারাত্মক সীমাবদ্ধতা হলো, এটা একটা গড়, যেটা স্বল্পসংখ্যক ধনী এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক অবস্থানের দরিদ্র জনগণের আয়ের বণ্টনের ক্রমবর্ধমান বৈষম্যকে লুকিয়ে ফেলে।

এর মানে, একজন কোটিপতির আয়ের সঙ্গে একজন ফকিরের শূন্য আয়ের গড় করলেও ওই ফকিরের মাথাপিছু আয় ৫০ লাখ টাকা হয়ে যাবে। মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যদি দেশে আয়বণ্টনে বৈষম্যও বাড়তে থাকে, তাহলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুফল সমাজের কয়েক হাজার উচ্চবিত্ত জনগোষ্ঠীর কাছে পুঞ্জীভূত হওয়ার প্রবণতা ক্রমেই শক্তিশালী হতে থাকে। ফলে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ প্রবৃদ্ধির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়।

বাংলাদেশের গত সাড়ে ১৫ বছরের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল একচেটিয়াভাবে পুঞ্জীভূত হয়ে গেছে কয়েক হাজার কোটিপতির কাছে। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হলো বাংলাদেশের জনগণের আয়বৈষম্য-পরিমাপক জিনি সহগ, যা ১৯৭৩ সালে ছিল ০.৩৬, সেটা বিংশ শতাব্দীর আশির দশক থেকে বাড়তে বাড়তে ২০২২ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপে পর্বতপ্রমাণ ০.৪৯৯-এ পৌঁছে গিয়েছিল। কোনো দেশের জিনি সহগের মান ০.৫ হলে সে দেশকে ‘উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ’ বলা হয়। তাই ২০২৪ সালে বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে একটি ‘উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে’ পরিণত হয়েছে।

তাত্ত্বিকভাবে জিডিপি হলো: (ভোগ ব্যয়+বিনিয়োগ ব্যয়+সরকারি ব্যয়+রপ্তানি আয়= আমদানি ব্যয়)। আর মোট জিডিপিকে দেশের মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ দিলে পাওয়া যায় মাথাপিছু জিডিপি। মাথাপিছু জিডিপি বেশি দেখানোর জন্য হাসিনার সরকার একদিকে ‘ডেটা ডক্টরিং’ করে মোট জিডিপিকে বাড়িয়ে দেখাত, অন্যদিকে দেশের মোট জনসংখ্যাকে প্রকৃত জনসংখ্যার তুলনায় কমিয়ে দেখাত। সাবেক অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল যখন ২০১৪-১৮ মেয়াদে পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন, তখন থেকেই তিনি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে ‘ডেটা ডক্টরিং’-এর কেন্দ্র বানিয়ে ফেলেছিলেন। সত্য তথ্য পরিবেশনের পরিবর্তে ভুয়া তথ্য-উপাত্ত ম্যানুফেকচার করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছিল ব্যুরোকে। ‘ডেটা ডক্টরিং’য়ের সহায়তায় মোট জিডিপি বাড়িয়ে দেখানো এবং জনসংখ্যা কমিয়ে দেখানো পরিকল্পনা ব্যুরোর খাসলতে পরিণত হয়েছিল। উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে কাহিনি প্রচার করে হাসিনার সরকার দেশে-বিদেশে প্রশংসা কুড়িয়েছিল, তার সিংহভাগই ছিল ভুয়া ও ভিত্তিহীন।

বাংলাদেশে প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগ ব্যয় এক দশক ধরে জিডিপির অনুপাত হিসাবে ২৩-২৪ শতাংশে ঘুরপাক খাচ্ছে, কিন্তু সরকারি খাতে অজস্র ঋণ করে ঘি খাওয়ার মতো অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ ঋণের অর্থ ব্যয় করায় প্রতিবছর মোট জিডিপি বেড়ে গেছে। সরকারি রাজস্ব আহরণ এ দেশে কমতে কমতে জিডিপির শতাংশ হিসাবে ৮ শতাংশে নেমে যাওয়া সত্ত্বেও বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ ঋণের অর্থে প্রতিবছর সরকারি ব্যয় বাড়ানোয় জিডিপি দ্রুত বেড়ে গেছে। সরকারি ঋণ বাড়লে তা জিডিপিকে বাড়িয়ে দেয়, জিডিপি প্রবৃদ্ধির পথে কোনো বাধা হয় না। কারণ, ঋণের হিসাব জিডিপিতে থাকে না। হাসিনা তাঁর সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে তাঁর পরিবার, আত্মীয়স্বজন, দলীয় নেতা-কর্মী, কতিপয় অলিগার্ক-ব্যবসায়ী এবং পুঁজি-লুটেরাদের সঙ্গে নিয়ে সরকারি খাতের প্রকল্প থেকে যে কোটি কোটি টাকা লুণ্ঠনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন, তার ভয়াবহ কাহিনি তাঁর পতনের পর উদ্ঘাটিত হতে শুরু করেছে।

গত ৭ আগস্ট একটি জাতীয় দৈনিকে হেডলাইনের খবরে প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের মোট স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। অথচ ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার দিনে বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল মাত্র ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। এর মানে, এই দুই ঋণের স্থিতির অঙ্কের পার্থক্য দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ২০৬ কোটি টাকা। ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে হাসিনা এই সুবিশাল ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার ঋণের সাগরে দেশের জনগণকে নিমজ্জিত করেন। প্রতিবছর মাথাপিছু জিডিপির উচ্চ প্রবৃদ্ধি দেখিয়ে চলেছেন, যাকে এককথায় বলা চলে ‘নিকৃষ্টতম শুভংকরের ফাঁকি’ এবং জনগণের সঙ্গে ভয়ানক প্রতারণা। ফলে ২০২৪ সালের নভেম্বরে প্রতিজন বাংলাদেশির মাথার ওপর ১ লাখ টাকার বেশি ঋণ নিজেদের অজান্তেই চেপে বসেছে।

হাসিনার শাসনামলে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার অজুহাতে একের পর এক মেগা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পাশাপাশি সারা দেশে বেলাগামভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে শত শত উন্নয়ন প্রকল্প। প্রতিটি মেগা প্রকল্পে প্রকৃত ব্যয়ের তিন-চার গুণ বেশি ব্যয় দেখানোর মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে কোটি কোটি টাকা, যে জন্য এসব প্রকল্পের ব্যয় ‘বিশ্বের সর্বোচ্চ’ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

দেশের এমন একটি প্রকল্পের নাম করা যাবে না, যেটার খরচ প্রতিবেশী দেশ ভারতের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি ছাড়া কম নয়। গত সাড়ে ১৫ বছর ছিল দেশে দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের মহোৎসব-কাল। কয়েকটি নিকৃষ্ট প্রকল্পের উদাহরণ দেখুন: পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-মাওয়া-যশোর-পায়রা রেলপথ, চট্টগ্রাম-দোহাজারী- কক্সবাজার রেলপথ এবং ঢাকা-গাজীপুর বিআরটি প্রকল্প নিঃসন্দেহে নিকৃষ্ট প্রকল্প। এই প্রকল্পগুলোতে প্রকৃত ব্যয়ের তিন-চার গুণ বেশি অর্থ ব্যয়িত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের নিকৃষ্টতম ‘সাপ্লায়ারস ক্রেডিট প্রকল্প’ ১২ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান ঋণে নির্মীয়মাণ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। এটি আক্ষরিকভাবেই ‘সাদা হাতি প্রকল্প’।

প্রাক্কলিত নির্মাণ ব্যয় ১৩৫০ কোটি ডলারের মধ্যে ১২০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল রাশিয়া। অনেকেরই জানা নেই যে মাত্র ৬ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান ঋণে ভারতের তামিলনাড়ুর কুদান কুলামে ২০০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপিত হয়েছে কয়েক বছর আগে। অথচ আমাদের ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের জন্য ১২ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান ঋণ নিতে হয়েছে কেন? সম্প্রতি একটি মার্কিন সংবাদমাধ্যম ‘গ্লোবাল ডিফেন্স কর্প’ দাবি করেছে যে শেখ হাসিনা তাঁর পুত্র জয় এবং শেখ রেহানার কন্যা টিউলিপের মধ্যস্থতায় এবং একটি মালয়েশিয়ান ব্যাংকের সহায়তায় রূপপুর প্রকল্প থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার আত্মসাৎ করেছেন।

এই মেগা প্রজেক্টের মতো সব প্রকল্পেই পুঁজি-লুণ্ঠনের কেন্দ্রে ছিল হাসিনা-পুত্র জয়, রেহানা-কন্যা টিউলিপ ও রেহানা-পুত্র ববি, শেখ ফজলুল করিম সেলিম ও তাঁর পুত্র শেখ ফাহিম, শেখ হেলাল এবং তাঁর ভাই শেখ জুয়েল ও তাঁর পুত্র শেখ তন্ময়, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও তাঁর পুত্র সাদিক আবদুল্লাহ; শেখ তাপস, শেখ পরশ, লিটন চৌধুরী ও নিক্সন চৌধুরী এবং হাসিনার অন্যান্য আত্মীয়স্বজন।

সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের পুত্র সোহেল তাজ অভিযোগ করেছেন, ২০০৯ সালেই শেখ হাসিনা বলেছিলেন ‘বিএনপি অনেক টাকা কামিয়েছে। এখন আমাদেরকে দুহাতে টাকা বানাতে হবে।’ প্রতিমন্ত্রিত্ব গ্রহণের কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে প্রকৃতপক্ষে সরকারের সবকিছু পরিচালনা করছিল হাসিনার পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনরা, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা শুধুই শিখণ্ডী। চরমভাবে হতাশ হয়ে ২০০৯ সালের মে মাসেই সোহেল তাজ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন।

সম্প্রতি হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান রিমান্ডে স্বীকার করেছেন, এস আলম বিভিন্ন ব্যাংক থেকে যে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি লুট করেছেন, তার অর্ধেকটাই দিতে হয়েছে জয় ও টিউলিপকে! সালমান রহমান নিজেও তাঁর মালিকানাধীন বেক্সিমকোর মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ৩৬ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত দেননি। গত ২৪ সেপ্টেম্বর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে যে দেশের চলমান ৮২টি প্রকল্পে শেখ হাসিনার কোনো না কোনো আত্মীয়স্বজন জড়িত ছিলেন, যেগুলোর প্রকল্প-ব্যয় ৫১ হাজার কোটি টাকার বেশি।

২০২৩ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। হাসিনা সরকারের খামখেয়ালিভাবে গৃহীত নানা প্রকল্পে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের হিড়িক তিন বছরের মধ্যেই বিদেশি ঋণকে ১০০ বিলিয়ন ডলারে উল্লম্ফন করিয়েছে। নিউইয়র্ক-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির তথ্যমতে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে ১৪৯.২০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে গেছে। উপরন্তু স্বৈরাচারী হাসিনা ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণের সাগরে দেশের জনগণকে ডুবিয়ে দিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেন, যার ওপর দাঁড়িয়ে ছিল তাঁর উন্নয়নের গলাবাজি।

লেখক: সাবেক অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত