Ajker Patrika

জীবনের জাদুবাস্তবতা

রুশা চৌধুরী
রুশা চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত
রুশা চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

এই জীবনে মানুষ হয়ে জন্মানো আর মানুষ হয়ে ওঠা—এই দুইয়ের মাঝে যে সংযোগ, তাকে যদি ‘ম্যাজিক রিয়্যালিজম’ বলি? কথাটির সহজ কোনো মানে কি করা যায়? জীবনের শুরুতে কিংবা বেড়ে উঠতে উঠতে কতটুকুইবা বুঝতে পারা যায়? বোঝাটুকুর জন্যই যে মনের বৃদ্ধি দরকার!

যদি বলি মানুষ বাড়ে সময়ে তবে তার মন বাড়বে কিসে? কেমন করে বড় হবে মন? জন্মের অর্থই শরীর বাড়বে আর বুড়ো হবে মানুষ। এইসব কিছুর সূত্রও পৃথিবীর তাবৎ এনাটমি আর ফিজিওলজি বইতে লিখেও ফেলেছে মানুষ নিজেই। তবে মনকে কীভাবে বাড়ানো যায়, কেমন করে তাকে প্রসারিত করা যায়, তার তেমন কোনো স্পেশালাইজড ফর্মুলার কথা শেখা হলো কই?

মন বড় করবার, হৃদয় দিয়ে দেখবার, যুক্তি বা বুদ্ধির বাইরে খুব গভীর কিছু একটা বিষয়কে জীবনে ধারণ করবার কোনো একক মন্ত্র আসলে আছে কি? আমার কাছে মাঝেমধ্যে এই মন্ত্রটা শেখার শুরু সেই মায়ের কোলে বসে ‘আয় আয় চাঁদ মামা’ বা ‘মেরি হ্যাড এ লিটল ল্যাম্ব’ শোনার সময় থেকেই। কিছু ভালোমতো না বুঝেই ছোটবেলার ঘুমপাড়ানি গান-গল্প, ছড়া, রূপকথার বইগুলো মনের ভেতরে ধরে ফেলে মানুষ। আর তাই বুদ্ধু ভুতুম, ঠাকুরমার ঝুলি, নন্টে ফন্টে, সুকুমার, টোনাটুনির দলেরা মনের ভেতরে থেকে যায়। তারপর সময়ের সঙ্গে সেসবের সঙ্গে যোগ দেয় সেকালের লালন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, কাফকা, হেমিংওয়ে থেকে হালের রাওলিং ছুঁয়ে সালমান রুশদিরা।

জীবনের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে, অকারণে হাসতে, সব মানুষকে ভালো না বাসলেও তাদের ‘মানুষ’ ভাবতে, মা-বাবার কথা মান্য করতে, মায়ের মনে মন আর বাবার হাতে হাত রাখা, ঠিক সময়ে বই নিয়ে বসা, বন্ধু নামের মাহাত্ম্য বোঝা...এ রকম কাজগুলো এরাই করিয়ে নেয় আমাদের দিয়ে।

ছড়া, কবিতা, গান, গল্প, বইয়ের পাতার মানুষের সঙ্গে সামনে থাকা মানুষগুলোর জীবনও কিন্তু আমাদের ‘মন’ আর ‘মনন’ তৈরি করতে থাকে। এরাই জীবনের মাঝে থেকে উধাও হয়ে যাওয়া সময়কেও বিশাল থেকে ছোট বানিয়ে দিতে পারে! সারিয়ে তুলতে পারে হৃদয়ের সব ক্ষত আর সংকীর্ণতাকে।

‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ থেকে গড়িয়ে সেই জল ‘মিডনাইট সামার ড্রিমে’ গিয়ে কেমন করে মিশে যায়? এই এত রকম ‘কেমন করে’র উত্তর খুঁজতে গেলে কি উত্তর খুঁজে পায় জীবন? যারা খুঁজে নিতে পারে তারা এর সুবাসটুকুও ধরে রাখতে পারে। জীবন তাদের কাছে সহজ হয়, মানুষকে তারা জাতি, ধর্ম, বর্ণ দিয়ে না শুধু, তাদের ‘মানুষ’ পরিচয়টুকু দিয়েই গ্রহণ করতে পারে।

‘পাওয়ার’ কথাই নয় শুধু, ‘না পাওয়ার’ মাঝেও যে ‘পাওয়া’ থাকে, তাকে তারা ‘প্রাপ্তি’ বলতে পারে। রবিঠাকুর এটাই তো বলেছিলেন ‘রাতের সব তারাই থাকে দিনের আলোর গভীরে’ কথাটির মধ্য দিয়ে।

আমাদের জীবনভর সঙ্গে থাকা ‘স্মৃতিকাতরতাই’ জীবনের সঞ্চয় হয়ে শুরু থেকে মাঝবয়স ছুঁয়ে অপার বিস্ময় আর জীবনের সবচেয়ে আরাম হয়ে থাকে। মন যদি সহজ হয় তবে খুলে যায় অনেক বন্ধ দরজা, হিংসার বদলে বেরিয়ে আসে রাংতামোড়া ভালোবাসা। জীবনচর্চা যদি সৎ হয় তবে সবার সেই গোপন ঘরের বাসিন্দারা সুখ নিয়ে না এলেও সেই দুঃখ বা ব্যথাকে সহজ করে নেওয়ার সূত্রটা খোঁজা যায়। এক অনন্ত খোঁজ!

এতসব জটিল কথার মানে যদি সহজ করে বলা যায় তবে তা লেখা থাকুক সেই ‘আবোল তাবোল’-এর পাতায়। কে আমার থেকে এগিয়ে গেল, তার হিসাব বাদ দিয়ে যে এগিয়ে গেছে তার হাতটা ধরতে চেষ্টা করি! একবার পেছনে তাকিয়ে সেখানে যে আছে তার হাতটাও ধরি। যদি জীবনে একবারও লালনের সুর শুনে থাকি তবে তার বাণীটাকেও মনের মাঝে রাখি—

‘মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই মূল হারাবি মানুষ ভজলে সোনার মানুষ পাবি...’

পাওয়াই যদি জীবনের মন্ত্র হয়, তবে তার মূল সুর হোক ‘মানুষ’! আর এটাই এ জীবনের ‘ম্যাজিক রিয়্যালিজম’।

‘এমন মানব জনম আর কি হবে মন যা করো তরায় করো এই ভবে।’

মানবিকতার ম্যাজিক দিয়ে তাই মনটাকে স্বচ্ছ করতে শিখি আর এই স্বচ্ছতাই বেঁচে থাকার মূল রসদ বা রিয়্যালিটি। সবাই মিলেমিশে সব মানুষকে তার প্রাপ্য সম্মানটুকু দিয়ে নিজের জীবনটাও সুন্দর করে রাখাই এ জীবনের ‘ম্যাজিক রিয়্যালিটি’ হতে পারে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত