জাহীদ রেজা নূর

সোভিয়েত ইউনিয়নে যখন গিয়েছিলাম, তখন প্রথম বর্ষে আমাদের শহরে পড়তে এল রাজন, সেটা ১৯৮৭ সাল। রোস্তভ নামে একটি শহরে প্রস্তুতিপর্বের পড়াশোনা শেষ করে ক্রাসনাদারে এসেছে। মেডিকেলে পড়বে। আমি সদ্য কুবান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্ব বিভাগে ক্লাস শুরু করেছি। আমাদের ভাষাতত্ত্ব বিভাগের সুবিধা ছিল, ক্যাম্পাসেই ক্লাস হতো। সারা শহর ছুটোছুটি করতে হতো না। রাজনদের ক্লাস হতো সারা শহরে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন ভবনে। ফলে ওদের কষ্টটা ছিল বেশি। ট্রাম, ট্রলিবাস, বাস ব্যবহার করে ক্লাস করত ওরা।
একটু অবসর পেলেই রাজন চলে আসত আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে। সেখানে অনেক রাত পর্যন্ত আমরা নানা ধরনের আলোচনা করতাম। সে আলোচনায় থাকত সমাজ বদলের কথা, খোঁজা হতো সাংস্কৃতিক মুক্তির উপায়। তখন আর আমাদের বয়স কত? কুড়ির এপাশ–ওপাশ। কিন্তু ভাবনাগুলো ছিল প্রখর ভালোবাসায় ঘেরা।
রাজনকে কখনোই আমার মনে হয়নি, ও হিন্দু, কিংবা আমাকেও কখনো মুসলমান ভেবে রাজন কথা বলেনি। এখন ভাবি, সে সময়টায় কী করে আমরা ধর্মীয় গণ্ডি অতিক্রম করে সম্পর্কগুলো গড়ে নিতাম? বলতেই হয়, আমাদের ক্রাসনাদার শহরে জহরদা, শ্যামলদা, বিবেকদা, প্রবীরদা, প্রশান্তদা, সমিত ছিল। কিন্তু এদের কাউকেই কখনো হিন্দু মনে করিনি। জহরদা পরপর দুবার আমাদের শহরের বাঙালি ছাত্র সংগঠনের সভাপতি ছিলেন। সমিত ছিল একবার।
তার মানে কি সে সময়টায় স্বাধীনতার অঙ্গীকারের একটা রেশ ছিল মানুষের মনে? আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে পুরো বাঙালি এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ–গোষ্ঠীর মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অংশ নিয়েছিল। তারই রেশ রয়ে গিয়েছিল? সেটাই কি এই বন্ধুতার কারণ?
দুই.
পরে ভেবে দেখেছি, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আবহ মানস গঠনে সাহায্য করেছে ঠিকই, কিন্তু তার চেয়ে বড় ছিল পারিবারিক শিক্ষা। সোভিয়েত ইউনিয়নে যে ছেলেমেয়েরা পড়তে যেত, তাদের বেশির ভাগই পারিবারিকভাবে ছিল অগ্রসর মানুষ। তাদের কাছে আন্তর্জাতিকতাবাদ, দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা কোনো কৃত্রিম বিষয় ছিল না। হয়তো সেটাই ছিল এই বন্ধনের একটা বড় কারণ। এখনো তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। এখনো মনে হয় না, তারা অনেক দূরের মানুষ।
এ বছর দুর্গা পূজায় রাজন চেয়েছিল বড় করে উৎসব করবে। কিন্তু পূজামণ্ডপে হামলা, প্রতিমা ভাঙচুর, মানুষ হত্যা ইত্যাদির কারণে ওর পূজার আনন্দ মাটি হয়ে গিয়েছিল।
বিজয়া দশমীর দিন তাই ওর বাড়িতে রাতে শুধু আমার পরিবারই ছিল আমন্ত্রিত। আর কেউ নয়। আমরা সহিংসতার আবহে নিজেদের মতো থাকতে চেষ্টা করেছি। ভাবতে চেষ্টা করেছি, সবকিছুর পরও একটা উজ্জ্বল আলো হয়তো দেখা যাবে। কিন্তু সে ভাবনা যে ধীরে ধীরে একেবারেই অবাস্তব হয়ে উঠছে, সেটা ভেবেও মনে কাঁটা দিয়েছে।
তিন.
বাঙালি হিন্দু–মুসলিম সম্পর্কের শুরুটা নিয়ে ভাবলে অনেক কিছু পরিষ্কার হবে। অন্ধতা যাদের গ্রাস করেছে, তাদের ভাবনায় আলো ফেলার জন্যই তা বলতে হবে।
বাঙালি মুসলমানের অধিকাংশই দেশজ মুসলমান, অর্থাৎ ধর্মান্তরিত মুসলমান। নবম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে সুফি দরবেশরাই বাংলায় এসেছিলেন ধর্মপ্রচারের জন্য। বখতিয়ার খিলজির বাংলা জয়ের অনেক আগে থেকেই ধর্মান্তরকরণ শুরু হয়ে গিয়েছিল। তার মানে, একহাতে কোরআন, অন্য হাতে কৃপাণ নিয়ে মুসলমানরা বলপূর্বক অন্য ধর্মের মানুষকে ধর্মান্তরিত করছিল, এটা আসরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের প্রচারের ফল। এ দেশের মানুষ ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হওয়ার একটা বড় কারণ ছিল ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার আকুতি। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিল সেন–বর্মণ ও দেব শাসকেরা। খেয়াল করলেই দেখা যাবে, বাংলার উত্তর ও পূর্ব অংশে বৌদ্ধদের সংখ্যা ছিল বেশি। পাল যুগে বৌদ্ধ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব থাকলেও কোনো বিশেষ ধর্মের প্রতি আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। পাল শাসনের সমাপ্তিতে যে সেন শাসন শুরু হলো, তা ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসন। অত্যাচারের মাত্রা ভয়াবহরকম হয়ে উঠেছিল। তখন বৌদ্ধরা দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করেছিল।
বাংলায় মুসলমান শাসন শুরু হওয়ার পর সুফিদের আগমন আরও বেড়ে গিয়েছিল। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের তুলনায় ইসলাম ছিল উদার। ইসলাম ধর্ম অন্তত তত্ত্বগতভাবে মানুষে মানুষে সমানাধিকার দেয়। তার ছোঁয়া লাগলে এই ধর্মের কারও জাত যায় না। কোরআন পড়তে তার কোনো বাধা নেই। ফলে নিম্নবর্ণের হিন্দুরাও সুফিদের আমন্ত্রণে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হচ্ছিল। কখনোই যে ধর্মান্তরিত করার জন্য মুসলমানেরা চাপ দেয়নি, সে কথা বলা যাবে না, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রবল শোষণে জর্জরিত হয়েই মানুষ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে।
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলা দরকার। সুফিদের সাধনায় বৌদ্ধধর্মের মাধ্যমে ভারতীয় যোগের প্রভাব পড়েছিল। তারও আগে ভারতে তান্ত্রিক ধর্মকর্মের ওপর বিশ্বাস ছিল। তান্ত্রিক গুরুরা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বলে মনে করা হতো। সুফি দরবেশদের সাধনাও অনেকটা তান্ত্রিক সাধনা বলে মনে করা হতো। সুফিরা ইসলামের শরিয়তি বিধান মেনে চলতেন না। ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিল না তাদের। ফলে খুব সহজেই সাধারণ মানুষ তাদের দিকে আকৃষ্ট হয়।
এ তো গেল নিম্নবিত্ত মানুষের ইসলাম গ্রহণের কথা। হিন্দু উচ্চবিত্ত মানুষের ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হওয়ার কারণগুলোর মধ্যে ছিল, মুসলমান হলে জিজিয়া কর দিতে হতো না, উচ্চ রাজপদ লাভ করার সুযোগ আসত। এ ছাড়াও আরেকটা অদ্ভুত কারণে ধর্ম পরিবর্তন করতেন তারা। হিন্দু ধর্মের ভয়াবহ ছুৎমার্গ, অর্থাৎ স্পর্শদোষ, খাদ্যদোষ, দৃষ্টিদোষ ইত্যাদির কারণে অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বীকেই সমাজে পতিত করে রাখা হতো। গোষ্ঠীসমেত তাদের সমাজচ্যুত করা হতো। তখন উপায়ন্তর না দেখে তারা ধর্ম পরিবর্তন করতেন।
বাংলার শাসনকর্তাদের অধিকাংশই ছিলেন বহিরাগত মুসলমান। তবে নবাবি আমলে যারা মোগল সাম্রাজ্যকে অগ্রাহ্য করে বাংলা শাসন করেছেন, তারা এই দেশের মানুষের মতোই দিনযাপন করতেন। তারা লুণ্ঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু মোগল শাসকেরা যাদের শাসন করতে পাঠাতেন, তারা চলে যাওয়ার সময় এ দেশের সম্পদও নিয়ে যেতেন।
এত কথা এখানে বলার উদ্দেশ্য হলো:
ক. বাংলার বৌদ্ধ ও হিন্দুরা ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন মূলত ব্রাহ্মণ্যবাদী শোষণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। অধিকাংশ ধর্মান্তর ঘটে সুফিবাদের প্রভাবে।
খ. সুফিবাদ শরিয়তি বিধান মেনে চলত না। সুফিবাদী ধারার ইসলাম এবং লোকজ সংস্কৃতির মিশ্রণেই গড়ে উঠেছিল এ দেশের ইসলাম।
গ. এ দেশে যারা মুসলিম হিসেবে বসবাস করছেন, তাদের প্রায় সবাই ধর্মান্তরিত মুসলমান। বৌদ্ধ ও হিন্দুদের থেকেই ধর্মান্তরিত হয়েছেন। তাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার এ দেশের মাটিতেই প্রথিত। আরবদেশের সংস্কৃতি থেকে তা বেড়ে ওঠেনি।
ঘ. খুব অল্পসংখ্যক বিদেশি শাসক এ দেশ শাসন করেছে। তাদের উত্তরাধিকার এত অধিক সংখ্যক নয়, যে নিজেদের আরব–বংশোদ্ভূত বলে দাবি করা যায়।
চার.
সম্প্রদায়–প্রশ্নে আমরা হেরে গেলাম কখন?
মনে করার কোনো কারণ নেই, এ দেশে হিন্দু–মুসলমান সম্পর্ক আগে সোনায় সোহাগা ছিল। জাত–পাতের প্রশ্নে হিন্দুবাড়ি ছিল (মূলত ব্রাহ্মণ) ভীষণরকম রক্ষণশীল। সেখানে মুসলমান ছেলেমেয়েদের খাওয়া–দাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কয়েকটি আত্মজীবনী পড়ে মনে হয়েছে, এ ব্যাপারে কট্টর মৌলবাদ হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ছিল। ইংরেজ আমলে হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি অংশের মধ্যে নতুন আলো এসে পড়ায় (যাকে অনেকেই বাংলার রেনেসাঁ নামে আখ্যায়িত করেন) অনেক ধরনের রক্ষণশীলতা থেকে তারা বেরিয়ে আসতে শুরু করেন। মূলত ইউরোপীয় মূল্যবোধের কারণে তারা অনেক বেশি উদারপন্থী হয়ে ওঠেন। কিন্তু অনগ্রসর গোটা ভারতের রক্ষণশীল মানসিকতা যেমন তার বিকাশের অন্তরায় ছিল, তেমনি দেশজ সংস্কৃতিকে একেবারে অগ্রাহ্য করা হয়েছিল বলে এই মূল্যবোধ খুব বেশি দূর এগিয়ে যেতে পারেনি। ফলে বাংলার রেনেসাঁ বেশ কিছু ভালো স্বপ্ন দেখিয়েছে বটে, কিন্তু স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মেলানো হয়নি বলে সারা দেশের মানুষকে উদ্বেলিত করতে পারেনি।
বাঙালি মুসলমান তার মুক্তির পথ খুঁজেছে আরও পরে। এবং তা ইংরেজদের হাত ধরেই। সে সব ইতিহাস এখানে না বলে শুধু এ কথা বলাই যথেষ্ট যে, মুক্তবুদ্ধির চর্চা করার সময় যে প্রসঙ্গটিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, তা হলো হাজার বছর ধরে আচরিত ধর্মবোধের সঙ্গে নতুন চিন্তাধারার সাংঘর্ষিক জায়গাগুলোকে আলোচনায় আনা। এবং প্রমাণ করে দেখিয়ে দেওয়া দরকার ছিল, কীভাবে মানুষকে মানবিক হতে হবে।
পাঁচ.
মুক্তবুদ্ধির চর্চাটা রয়ে গেল কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ মানুষের মধ্যে। এই ‘শিক্ষিত’ মানুষের বাইরে যে গোটা দেশটা ছিল, সেটা কিন্তু এই আলোয় উদ্ভাসিত হলো না। রাজনীতি থেকে একটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টা খানিক স্পষ্ট হবে। এ দেশে সর্বস্ব ত্যাগ করে যারা রাজনীতি করল, তাদের সিংহভাগই ছিলেন সাম্যবাদী। কিন্তু তাদের এই আত্মত্যাগ, সাম্যবাদী চেতনা কেন সাধারণ মানুষ গ্রহণ করল না? কমিউনিস্ট আন্দোলন মধ্যবিত্ত শ্রেণির আন্দোলন হিসেবেই বিকশিত হলো, নিম্নবিত্ত মানুষকে বাঁচানোর এই লড়াইয়ে নিম্নবিত্ত মানুষ কেন আকৃষ্ট হলো না? কেন মানুষ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্যেই খুঁজল মুক্তির পথ?
এখন মনে হয়, এর বড় কারণটিই হলো, দেশের সংস্কৃতির শিকড়ের ওপর দাঁড়িয়ে যখন দেশের লাঞ্ছনা, বঞ্চনার কথা বলেছে কোনো জাতীয়তাবাদী নেতা, তখন তা সহজেই বুঝতে পেরেছে মানুষ। কমিউনিস্ট কিংবা ইসলামি চিন্তাধারাকে অগ্রাহ্য করেই বাঙালি জাতীয়তাবাদে দীক্ষিত হয়েছে এই অঞ্চলের মানুষ। কমিউনিস্টরা বলেছে আন্তর্জাতিকতাবাদের কথা। নিজ দেশকে তারা সেই আন্তর্জাতিকতাবাদের অংশ বলে প্রচার করেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ থাকে তার নিজের অভাব, সমস্যা, সংকট নিয়ে। অন্য দেশের নির্যাতিত মানুষদের জন্য তার মর্মযাতনা থাকতে পারে, কিন্তু কোনোভাবেই তা নিজের কষ্ট, সংগ্রামের চেয়ে বড় নয়। ফলে, আন্তর্জাতিকতাবাদ এখানে বেড়ে উঠতে পারেনি। এবং এক সময় দেখা গেছে বিপ্লব প্রচারের জন্য সমাজতন্ত্রী টাকার আমদানি বন্ধ হয়ে যেতেই এই আন্দোলনে মরিচা ধরেছে।
অন্যদিকে, আরব–উদ্ভূত ধর্মীয় রাজনীতিও এই দেশের হালে পানি পায়নি একই কারণে। মানুষ নিজেকে দেশের অংশ বলে ভাবতে শুরু করেছে। আরবের খেজুর সংস্কৃতি দিয়ে এ দেশের ডাল–ভাতের চাহিদা মিটবে না, সেটা বুঝতে সময় নেয়নি আইয়ুবী স্বৈরশাসনের আমলে।
অথচ সেই আরব সংস্কৃতির রমরমায় বাঙালি তথা এই দেশের মানুষ আজ নতুন করে আবার আত্মপরিচয়ের সংকটে ভুগছে। সুফিবাদকে একেবারে অগ্রাহ্য করে কট্টর সালাফিবাদের দিকে রওনা দিল বাঙালি মুসলমান।
কেন এমন হলো?
ছয়.
সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ নয়। কয়েকটি প্রশ্ন নিয়ে এগোলে এই জেহাদি জোশের একটা প্যাটার্ন হয়তো বোঝা সম্ভব হবে।
যে কোনো জাতীয়তাবাদের মতো বাঙালি জাতীয়তাবাদও বাঙালির মনে অনেক স্বপ্নের জন্ম দিয়েছিল। বুঝিয়েছিল, অসাম্প্রদায়িকতাই মুক্তির পথ দেখাবে। সমাজের সকল ক্ষেত্রে নিজেদের দক্ষতা ও পরিশ্রম দিয়ে গড়ে তুলতে হবে দেশ। দক্ষতা ও পরিশ্রম দিয়ে দেশ গড়ার কাজটি যখনই হোঁচট খেয়েছে, তখন জাতীয়তাবাদও হোঁচট খেয়েছে। আর সেই শূন্যস্থান পূরণ করার দিকে এগিয়েছে ইসলামি জাতীয়তাবাদ। ইসলাম যদি সকল মুসলমানকে এক করতে পারত, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে মুসলমানদের একটাই দেশ থাকত, কিন্তু সেখানে এতগুলো আলাদা দেশ কেন?
বাঙালি জাতীয়তাবাদ যখন স্বপ্নগুলো পূরণ করতে পারল না, এবং বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর সুপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশকে মিনি পাকিস্তানে পরিণত করা হলো, তারপর থেকে আমাদের দেশের রাজনৈতিক–সামাজিক–সাংস্কৃতিক জীবনটা পর্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে, বেহুলার বাসরঘরে কী করে সাম্প্রদায়িকতার সাপ ঢুকে পড়ল।
সাত.
বাঙালি মুসলমান টেরও পেল না, কীভাবে তারা রাজনীতির শিকার হয়েছে। একই কথা বাঙালি হিন্দুর ক্ষেত্রেও বলা চলে। ১৯০৫ সালে বাঙালি হিন্দু যখন বঙ্গভঙ্গের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিল, তখন বাঙালি সত্তাই ছিল প্রধান পরিচয়। কিন্তু এরপর থেকেই ধীরে ধীরে বাঙালি হিন্দু প্রভাবিত হলো নিখিল ভারতীয় রাজনীতি দিয়ে, এবং কংগ্রেস নেতৃত্বেও গোঁড়াদের অবস্থান দৃঢ় হয়ে গেল। বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা তখন হয়ে গেল ভারতীয় জাতীয়তাবাদী। ফলে সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, শরৎ বসু, কিরণ শঙ্কর রায় যখন দেশভাগের সময় বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করছেন, তখন বাংলার হিন্দুরা তাদের ধর্মীয় পরিচয়টাকে জাতীয় পরিচয়ের চেয়ে বড় করে দেখেছিল। পূর্ব বাংলার মুসলিমরাও কিছুদিন অবিভক্ত বঙ্গের পক্ষে লড়াই করে একসময় খণ্ডিত বাংলাকে মেনে নিয়ে যত তাড়াতাড়ি পারে কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় চলে এসেছিল। সেই অস্থির সময়টি নিয়ে যে যার মতো ব্যাখ্যা দেয়, কিন্তু সে সময় জাতিগত পরিচয়ে বলীয়ান হতে না পারাই যে পরবর্তীকালে সাম্প্রদায়িকতার আগুনকে উসকে দিয়েছে, সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
আট.
তাই ভাবতে হবে—ধর্মচর্চার ভার কাদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে? এখন তো বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে মসজিদ অনেক বেশি যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জ্ঞানচর্চা মোটেই অনুপ্রেরণাদায়ক অবস্থানে নেই। শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের মধ্যেও চর্চাহীন, প্রজ্ঞাহীন মুফতে টাকা বানানোর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ফলে, নৈতিকভাবে দৃঢ় অবস্থান ধরে রেখে কোনো বিষয়ে কথা বলার মতো মানুষ ক্রমেই কমে যাচ্ছে। শুক্রবার দিন জুম্মার নামাজ আদায় করতে মসজিদে ভিড় করেন মানুষ। সে সময় মসজিদ এলাকায় যে আলোচনা হয়, যে খুতবা শুনে বাড়ি ফেরেন ধর্মভীরু মুসলমান, তাতে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর মতো বহু উপাদান থাকে। ধর্মের অপব্যাখ্যার বিরুদ্ধেও কেউ কথা বলতে সাহস পায় না। কারণ মসজিদ এলাকায় এই ধরনের ধর্মের লেবাসধারী মানুষেরই আধিক্য। এরা যুক্তি মানে না।
একজন মুসলমানের কাছে যেমন মসজিদ, একজন হিন্দুর কাছে তেমন মন্দির, খ্রিষ্টানের কাছে চার্চ, বৌদ্ধের কাছে প্যাগোডা ঠিক তেমন। যার যার ধর্ম তার তার। যিনি যে ধর্ম পালন করছেন, তিনি তার ধর্মের অনুশাসন মেনে চলবেন। কিন্তু ধর্মটাকে অর্ধশিক্ষিত মানুষের হাতে ছেড়ে দেওয়ার ফলেই এই গোল বেঁধেছে। প্রচলিত ধারণা মতে, উচ্চশিক্ষা লাভকারী মানুষই শিক্ষিত। কথাটা অসার। বহুযুগের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারায় মানুষ যে বিদ্যা করায়ত্ত করেছে, তার যে শক্তি আছে, তা অমূল্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ না নিয়েই সেই অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে কৃষক ফসল ফলায়। কোন জমিতে কতটুকু সার দিতে হবে, কোন সময়টা ফসল রোপণের জন্য উৎকৃষ্ট সময়, কখন ফসল কাটতে হবে এগুলো বছরের পর বছরের অভিজ্ঞতা থেকেই কৃষক করে যায়। বিজ্ঞান হয়তো সেই শিক্ষার সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে আরও কিছু কাজ করে, যা এই প্রক্রিয়াকে সহজ করে তোলে।
তাই তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের চেয়ে জীবনের শিক্ষালাভ করেছেন যিনি প্রকৃতি থেকে, তিনি নিশ্চয়ই পিছিয়ে পড়া মানুষ নন। গোল বাধে অর্ধশিক্ষিত মানুষ নিয়ে। এরা না বুঝে বা নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য নিজের মতো কোনো বিষয়ের ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে নেয়। যেহেতু তাদের কেউ চ্যালেঞ্জ করছে না, সেহেতু এরা কল্পিত ভাবনাকেই সত্য বলে চালিয়ে দিতে চায় এবং ধর্ম নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করার রীতি নেই বলে সবাই চুপ করে থাকে। সাধারণ মানুষ ভুলেই যায় যে, প্রশ্নটি ধর্ম নিয়ে নয়, ধর্মের অপব্যাখ্যা নিয়ে। ফলে ওয়াজ, মসজিদের ভুল বয়ানগুলোই ছড়িয়ে যায় সমাজে, সমাজ তার যৌক্তিক অবস্থান হারায় এবং ধীরে ধীরে অন্ধবিশ্বাসের দিকে অগ্রসর হয়।
এখন একটি বিষয় আলোচনায় আসা দরকার। দেশের একটা বড় অংশের শিক্ষাব্যবস্থায় দেশ নেই, দেশের মানুষ নেই, দেশের ইতিহাস নেই, ধর্মীয় পরিচয়টাই সেখানে তার একমাত্র পরিচয়—এ রকম একটা জেলখানা যারা বানিয়েছে, তাদের কাছ থেকে সুস্থ চিন্তা আশা করা যায় না। দেশের উৎপাদনের সঙ্গে এদের যোগাযোগের ব্যবস্থা কে করে দেবে। মসজিদ, মাদ্রাসা ছাড়া তো এদের চাকরির সুযোগ কম। তার মানে, ওই আবহ ছাড়া আর কোনো আবহের মধ্যেই তাদের যাওয়ার সুযোগ নেই। এ রকম জীবনে হতাশা আসাটা স্বাভাবিক। ঢলে তারা কীভাবে অন্যের দুঃখ, কষ্ট অনুভব করবে?
নয়.
ধর্ম, আরববিশ্ব, মুসলমান পরিচয় ইত্যাদি আসলে কোনো ব্যাপারই নয়। ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে নিজের অপরাধকে ঢেকে ফেলার এক অদ্ভুত খেলায় নিয়োজিত হয়েছে বাংলাদেশের ধর্ম ব্যবসায়ীরা। আর সেটাকেই ধর্মীয় বিধান বলে চালানোর চেষ্টা করছে।
দশ.
আমাদের স্কুলের নাম ছিল সিদ্ধেশ্বরী বালক উচ্চ বিদ্যালয়। আমার কাছের বন্ধুদের একজন ছিল জয়ন্ত কুমার ভৌমিক। গত শতাব্দীর সাত ও আটের দশকে স্কুলের নামটি হিন্দু নাম কিনা, জয়ন্ত হিন্দু হয়েও আমার কাছের বন্ধুদের একজন কেন, সে প্রশ্ন ওঠেনি কখনো। অমরজ্যোতি ক্লাবে খেলার সময় আমাদের ওয়ানডাউন ব্যাটসম্যান সৌমিত্র বা টুটুলকে কখনোই ধর্ম পরিচয় দিয়ে বিচার করিনি আমরা। আমার আর সৌমিত্রের জুটি একসঙ্গে অনেকটা সময় ক্রিজে কাটিয়েছি। তখন আমাদের একটাই পরিচয়, রান করে দলকে ভালো জায়গায় পৌঁছে দিতে হবে। এখন কেন ধর্ম পরিচয়টা বড় হয়ে উঠছে?
বড় হয়ে উঠছে এ কারণে যে, পরিবারে ধর্ম–সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেওয়া হয় না। ফেসবুকে স্ট্যাটাস কিংবা স্ট্যাটাসের মন্তব্যগুলো পড়লেই বুঝতে পারবেন, আমরা কোথায় আছি। নারী সম্পর্কে অধিকাংশ পুরুষের অবস্থানও টের পাবেন।
এগারো.
যারা এই অপঘাত থেকে বাঁচাতে পারত, তারা সময়মতো নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়ায়নি। অনেকেই ফেসবুকে, পত্রিকার লেখালেখিতে এই ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন, অথচ যে সংকটকালে মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হয়, সে কাজটি প্রতিবেশীরা করেননি। ধর্মীয় সহনশীলতা থাকলে তো স্থানীয় মুসলমানেরাই হিন্দু সম্প্রদায়ের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। কোথাও কোথাও যে সে রকম ঘটনা ঘটেনি, তা–ও নয়। কিন্তু মতলববাজরা তাদের স্বার্থসিদ্ধি করে নিয়েছিল আগেই।
আমাদের যে পোক্ত সমাজ ছিল, তার বন্ধন শিথিল হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ভারতের কথা টেনে আনার কোনো দরকার নেই। ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদ যদি বিজেপির মাধ্যমে প্রসারিত হয়, তাহলে সেটাও ভারতের জনজীবনের জন্য খুবই অস্বাস্থ্যকর অবস্থা। তার নিন্দা জানাব। কিন্তু আমাদের দেশের কিছু মুসলমানের অন্যায়কে জায়েজ করার জন্য ভারতের হিন্দুকে টেনে আনার কোনো অর্থ নেই। সেটাও মতলববাজির চূড়ান্ত।
বারো.
সমাজটা হারিয়ে গেছে। সমাজের বন্ধন শিথিল হয়েছে। ধর্মবিদ্বেষ বেড়েছে।
সমাজ হারিয়ে যাওয়ার পেছনে যে কারণগুলো আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো সাংস্কৃতিক বন্ধন ছিন্ন হওয়া। দেশের মানুষ সাংস্কৃতিক জীবনযাপনে অংশ নিচ্ছে কম। সংস্কৃতিই তো মানুষে মানুষে মিলন আনে। সিনেমা, নাটক, যাত্রার অভিনয় দেখে, সংলাপ শুনে মানুষের মনে বোধ জন্মায়, গানের সুরে সে বুঝতে পারে, হৃদয়ে ভালোবাসা, দেশপ্রেমের চাষবাস করার প্রয়োজনীয়তা। বৈশাখী মেলা, নবান্ন, পিঠা উৎসব ইত্যাদি পোক্ত করে সামাজিক বন্ধন।
সে সব মুছে গিয়ে মানুষ যান্ত্রিকতায় বিশ্বাসী হয়ে পড়ছে। ছুটছে টাকার পেছনে। আরা ছুটছে ধর্মান্ধতার পেছনে। তাই এই আলগা হয়ে যাওয়া বাঁধনকে পোক্ত করা খুব দরকার। কিন্তু তার আলামত পাচ্ছি না।
আর রাজনীতি? এ ধরনের নিন্দনীয় ঘটনা ঘটার সময় জনপ্রতিনিধিরা কোথায় থাকেন? তারা কেন মানুষকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন না? তাঁরা চাইলেই নিজ সংগঠনের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে এই সংকটের মোকাবিলা করতে পারেন।
পাশের বাড়ির মানুষটাও তো পাশে এসে দাঁড়াতে পারেন? কেন দাঁড়ান না?
ওই যে বললাম, আলগা হয়েছে বাঁধনের জোর। এটা রবীন্দ্রনাথের কথা। ‘রথের রশি’তে লিখেছিলেন তিনি। সেই বাঁধন পোক্ত হবে কিনা, তা নির্ভর করছে আমাদের কাণ্ডজ্ঞানের ওপর। সেটা আপাতত খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা।

সোভিয়েত ইউনিয়নে যখন গিয়েছিলাম, তখন প্রথম বর্ষে আমাদের শহরে পড়তে এল রাজন, সেটা ১৯৮৭ সাল। রোস্তভ নামে একটি শহরে প্রস্তুতিপর্বের পড়াশোনা শেষ করে ক্রাসনাদারে এসেছে। মেডিকেলে পড়বে। আমি সদ্য কুবান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্ব বিভাগে ক্লাস শুরু করেছি। আমাদের ভাষাতত্ত্ব বিভাগের সুবিধা ছিল, ক্যাম্পাসেই ক্লাস হতো। সারা শহর ছুটোছুটি করতে হতো না। রাজনদের ক্লাস হতো সারা শহরে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন ভবনে। ফলে ওদের কষ্টটা ছিল বেশি। ট্রাম, ট্রলিবাস, বাস ব্যবহার করে ক্লাস করত ওরা।
একটু অবসর পেলেই রাজন চলে আসত আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে। সেখানে অনেক রাত পর্যন্ত আমরা নানা ধরনের আলোচনা করতাম। সে আলোচনায় থাকত সমাজ বদলের কথা, খোঁজা হতো সাংস্কৃতিক মুক্তির উপায়। তখন আর আমাদের বয়স কত? কুড়ির এপাশ–ওপাশ। কিন্তু ভাবনাগুলো ছিল প্রখর ভালোবাসায় ঘেরা।
রাজনকে কখনোই আমার মনে হয়নি, ও হিন্দু, কিংবা আমাকেও কখনো মুসলমান ভেবে রাজন কথা বলেনি। এখন ভাবি, সে সময়টায় কী করে আমরা ধর্মীয় গণ্ডি অতিক্রম করে সম্পর্কগুলো গড়ে নিতাম? বলতেই হয়, আমাদের ক্রাসনাদার শহরে জহরদা, শ্যামলদা, বিবেকদা, প্রবীরদা, প্রশান্তদা, সমিত ছিল। কিন্তু এদের কাউকেই কখনো হিন্দু মনে করিনি। জহরদা পরপর দুবার আমাদের শহরের বাঙালি ছাত্র সংগঠনের সভাপতি ছিলেন। সমিত ছিল একবার।
তার মানে কি সে সময়টায় স্বাধীনতার অঙ্গীকারের একটা রেশ ছিল মানুষের মনে? আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে পুরো বাঙালি এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ–গোষ্ঠীর মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অংশ নিয়েছিল। তারই রেশ রয়ে গিয়েছিল? সেটাই কি এই বন্ধুতার কারণ?
দুই.
পরে ভেবে দেখেছি, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আবহ মানস গঠনে সাহায্য করেছে ঠিকই, কিন্তু তার চেয়ে বড় ছিল পারিবারিক শিক্ষা। সোভিয়েত ইউনিয়নে যে ছেলেমেয়েরা পড়তে যেত, তাদের বেশির ভাগই পারিবারিকভাবে ছিল অগ্রসর মানুষ। তাদের কাছে আন্তর্জাতিকতাবাদ, দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা কোনো কৃত্রিম বিষয় ছিল না। হয়তো সেটাই ছিল এই বন্ধনের একটা বড় কারণ। এখনো তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। এখনো মনে হয় না, তারা অনেক দূরের মানুষ।
এ বছর দুর্গা পূজায় রাজন চেয়েছিল বড় করে উৎসব করবে। কিন্তু পূজামণ্ডপে হামলা, প্রতিমা ভাঙচুর, মানুষ হত্যা ইত্যাদির কারণে ওর পূজার আনন্দ মাটি হয়ে গিয়েছিল।
বিজয়া দশমীর দিন তাই ওর বাড়িতে রাতে শুধু আমার পরিবারই ছিল আমন্ত্রিত। আর কেউ নয়। আমরা সহিংসতার আবহে নিজেদের মতো থাকতে চেষ্টা করেছি। ভাবতে চেষ্টা করেছি, সবকিছুর পরও একটা উজ্জ্বল আলো হয়তো দেখা যাবে। কিন্তু সে ভাবনা যে ধীরে ধীরে একেবারেই অবাস্তব হয়ে উঠছে, সেটা ভেবেও মনে কাঁটা দিয়েছে।
তিন.
বাঙালি হিন্দু–মুসলিম সম্পর্কের শুরুটা নিয়ে ভাবলে অনেক কিছু পরিষ্কার হবে। অন্ধতা যাদের গ্রাস করেছে, তাদের ভাবনায় আলো ফেলার জন্যই তা বলতে হবে।
বাঙালি মুসলমানের অধিকাংশই দেশজ মুসলমান, অর্থাৎ ধর্মান্তরিত মুসলমান। নবম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে সুফি দরবেশরাই বাংলায় এসেছিলেন ধর্মপ্রচারের জন্য। বখতিয়ার খিলজির বাংলা জয়ের অনেক আগে থেকেই ধর্মান্তরকরণ শুরু হয়ে গিয়েছিল। তার মানে, একহাতে কোরআন, অন্য হাতে কৃপাণ নিয়ে মুসলমানরা বলপূর্বক অন্য ধর্মের মানুষকে ধর্মান্তরিত করছিল, এটা আসরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের প্রচারের ফল। এ দেশের মানুষ ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হওয়ার একটা বড় কারণ ছিল ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার আকুতি। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিল সেন–বর্মণ ও দেব শাসকেরা। খেয়াল করলেই দেখা যাবে, বাংলার উত্তর ও পূর্ব অংশে বৌদ্ধদের সংখ্যা ছিল বেশি। পাল যুগে বৌদ্ধ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব থাকলেও কোনো বিশেষ ধর্মের প্রতি আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। পাল শাসনের সমাপ্তিতে যে সেন শাসন শুরু হলো, তা ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসন। অত্যাচারের মাত্রা ভয়াবহরকম হয়ে উঠেছিল। তখন বৌদ্ধরা দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করেছিল।
বাংলায় মুসলমান শাসন শুরু হওয়ার পর সুফিদের আগমন আরও বেড়ে গিয়েছিল। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের তুলনায় ইসলাম ছিল উদার। ইসলাম ধর্ম অন্তত তত্ত্বগতভাবে মানুষে মানুষে সমানাধিকার দেয়। তার ছোঁয়া লাগলে এই ধর্মের কারও জাত যায় না। কোরআন পড়তে তার কোনো বাধা নেই। ফলে নিম্নবর্ণের হিন্দুরাও সুফিদের আমন্ত্রণে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হচ্ছিল। কখনোই যে ধর্মান্তরিত করার জন্য মুসলমানেরা চাপ দেয়নি, সে কথা বলা যাবে না, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রবল শোষণে জর্জরিত হয়েই মানুষ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে।
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলা দরকার। সুফিদের সাধনায় বৌদ্ধধর্মের মাধ্যমে ভারতীয় যোগের প্রভাব পড়েছিল। তারও আগে ভারতে তান্ত্রিক ধর্মকর্মের ওপর বিশ্বাস ছিল। তান্ত্রিক গুরুরা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বলে মনে করা হতো। সুফি দরবেশদের সাধনাও অনেকটা তান্ত্রিক সাধনা বলে মনে করা হতো। সুফিরা ইসলামের শরিয়তি বিধান মেনে চলতেন না। ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিল না তাদের। ফলে খুব সহজেই সাধারণ মানুষ তাদের দিকে আকৃষ্ট হয়।
এ তো গেল নিম্নবিত্ত মানুষের ইসলাম গ্রহণের কথা। হিন্দু উচ্চবিত্ত মানুষের ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হওয়ার কারণগুলোর মধ্যে ছিল, মুসলমান হলে জিজিয়া কর দিতে হতো না, উচ্চ রাজপদ লাভ করার সুযোগ আসত। এ ছাড়াও আরেকটা অদ্ভুত কারণে ধর্ম পরিবর্তন করতেন তারা। হিন্দু ধর্মের ভয়াবহ ছুৎমার্গ, অর্থাৎ স্পর্শদোষ, খাদ্যদোষ, দৃষ্টিদোষ ইত্যাদির কারণে অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বীকেই সমাজে পতিত করে রাখা হতো। গোষ্ঠীসমেত তাদের সমাজচ্যুত করা হতো। তখন উপায়ন্তর না দেখে তারা ধর্ম পরিবর্তন করতেন।
বাংলার শাসনকর্তাদের অধিকাংশই ছিলেন বহিরাগত মুসলমান। তবে নবাবি আমলে যারা মোগল সাম্রাজ্যকে অগ্রাহ্য করে বাংলা শাসন করেছেন, তারা এই দেশের মানুষের মতোই দিনযাপন করতেন। তারা লুণ্ঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু মোগল শাসকেরা যাদের শাসন করতে পাঠাতেন, তারা চলে যাওয়ার সময় এ দেশের সম্পদও নিয়ে যেতেন।
এত কথা এখানে বলার উদ্দেশ্য হলো:
ক. বাংলার বৌদ্ধ ও হিন্দুরা ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন মূলত ব্রাহ্মণ্যবাদী শোষণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। অধিকাংশ ধর্মান্তর ঘটে সুফিবাদের প্রভাবে।
খ. সুফিবাদ শরিয়তি বিধান মেনে চলত না। সুফিবাদী ধারার ইসলাম এবং লোকজ সংস্কৃতির মিশ্রণেই গড়ে উঠেছিল এ দেশের ইসলাম।
গ. এ দেশে যারা মুসলিম হিসেবে বসবাস করছেন, তাদের প্রায় সবাই ধর্মান্তরিত মুসলমান। বৌদ্ধ ও হিন্দুদের থেকেই ধর্মান্তরিত হয়েছেন। তাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার এ দেশের মাটিতেই প্রথিত। আরবদেশের সংস্কৃতি থেকে তা বেড়ে ওঠেনি।
ঘ. খুব অল্পসংখ্যক বিদেশি শাসক এ দেশ শাসন করেছে। তাদের উত্তরাধিকার এত অধিক সংখ্যক নয়, যে নিজেদের আরব–বংশোদ্ভূত বলে দাবি করা যায়।
চার.
সম্প্রদায়–প্রশ্নে আমরা হেরে গেলাম কখন?
মনে করার কোনো কারণ নেই, এ দেশে হিন্দু–মুসলমান সম্পর্ক আগে সোনায় সোহাগা ছিল। জাত–পাতের প্রশ্নে হিন্দুবাড়ি ছিল (মূলত ব্রাহ্মণ) ভীষণরকম রক্ষণশীল। সেখানে মুসলমান ছেলেমেয়েদের খাওয়া–দাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কয়েকটি আত্মজীবনী পড়ে মনে হয়েছে, এ ব্যাপারে কট্টর মৌলবাদ হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ছিল। ইংরেজ আমলে হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি অংশের মধ্যে নতুন আলো এসে পড়ায় (যাকে অনেকেই বাংলার রেনেসাঁ নামে আখ্যায়িত করেন) অনেক ধরনের রক্ষণশীলতা থেকে তারা বেরিয়ে আসতে শুরু করেন। মূলত ইউরোপীয় মূল্যবোধের কারণে তারা অনেক বেশি উদারপন্থী হয়ে ওঠেন। কিন্তু অনগ্রসর গোটা ভারতের রক্ষণশীল মানসিকতা যেমন তার বিকাশের অন্তরায় ছিল, তেমনি দেশজ সংস্কৃতিকে একেবারে অগ্রাহ্য করা হয়েছিল বলে এই মূল্যবোধ খুব বেশি দূর এগিয়ে যেতে পারেনি। ফলে বাংলার রেনেসাঁ বেশ কিছু ভালো স্বপ্ন দেখিয়েছে বটে, কিন্তু স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মেলানো হয়নি বলে সারা দেশের মানুষকে উদ্বেলিত করতে পারেনি।
বাঙালি মুসলমান তার মুক্তির পথ খুঁজেছে আরও পরে। এবং তা ইংরেজদের হাত ধরেই। সে সব ইতিহাস এখানে না বলে শুধু এ কথা বলাই যথেষ্ট যে, মুক্তবুদ্ধির চর্চা করার সময় যে প্রসঙ্গটিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, তা হলো হাজার বছর ধরে আচরিত ধর্মবোধের সঙ্গে নতুন চিন্তাধারার সাংঘর্ষিক জায়গাগুলোকে আলোচনায় আনা। এবং প্রমাণ করে দেখিয়ে দেওয়া দরকার ছিল, কীভাবে মানুষকে মানবিক হতে হবে।
পাঁচ.
মুক্তবুদ্ধির চর্চাটা রয়ে গেল কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ মানুষের মধ্যে। এই ‘শিক্ষিত’ মানুষের বাইরে যে গোটা দেশটা ছিল, সেটা কিন্তু এই আলোয় উদ্ভাসিত হলো না। রাজনীতি থেকে একটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টা খানিক স্পষ্ট হবে। এ দেশে সর্বস্ব ত্যাগ করে যারা রাজনীতি করল, তাদের সিংহভাগই ছিলেন সাম্যবাদী। কিন্তু তাদের এই আত্মত্যাগ, সাম্যবাদী চেতনা কেন সাধারণ মানুষ গ্রহণ করল না? কমিউনিস্ট আন্দোলন মধ্যবিত্ত শ্রেণির আন্দোলন হিসেবেই বিকশিত হলো, নিম্নবিত্ত মানুষকে বাঁচানোর এই লড়াইয়ে নিম্নবিত্ত মানুষ কেন আকৃষ্ট হলো না? কেন মানুষ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্যেই খুঁজল মুক্তির পথ?
এখন মনে হয়, এর বড় কারণটিই হলো, দেশের সংস্কৃতির শিকড়ের ওপর দাঁড়িয়ে যখন দেশের লাঞ্ছনা, বঞ্চনার কথা বলেছে কোনো জাতীয়তাবাদী নেতা, তখন তা সহজেই বুঝতে পেরেছে মানুষ। কমিউনিস্ট কিংবা ইসলামি চিন্তাধারাকে অগ্রাহ্য করেই বাঙালি জাতীয়তাবাদে দীক্ষিত হয়েছে এই অঞ্চলের মানুষ। কমিউনিস্টরা বলেছে আন্তর্জাতিকতাবাদের কথা। নিজ দেশকে তারা সেই আন্তর্জাতিকতাবাদের অংশ বলে প্রচার করেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ থাকে তার নিজের অভাব, সমস্যা, সংকট নিয়ে। অন্য দেশের নির্যাতিত মানুষদের জন্য তার মর্মযাতনা থাকতে পারে, কিন্তু কোনোভাবেই তা নিজের কষ্ট, সংগ্রামের চেয়ে বড় নয়। ফলে, আন্তর্জাতিকতাবাদ এখানে বেড়ে উঠতে পারেনি। এবং এক সময় দেখা গেছে বিপ্লব প্রচারের জন্য সমাজতন্ত্রী টাকার আমদানি বন্ধ হয়ে যেতেই এই আন্দোলনে মরিচা ধরেছে।
অন্যদিকে, আরব–উদ্ভূত ধর্মীয় রাজনীতিও এই দেশের হালে পানি পায়নি একই কারণে। মানুষ নিজেকে দেশের অংশ বলে ভাবতে শুরু করেছে। আরবের খেজুর সংস্কৃতি দিয়ে এ দেশের ডাল–ভাতের চাহিদা মিটবে না, সেটা বুঝতে সময় নেয়নি আইয়ুবী স্বৈরশাসনের আমলে।
অথচ সেই আরব সংস্কৃতির রমরমায় বাঙালি তথা এই দেশের মানুষ আজ নতুন করে আবার আত্মপরিচয়ের সংকটে ভুগছে। সুফিবাদকে একেবারে অগ্রাহ্য করে কট্টর সালাফিবাদের দিকে রওনা দিল বাঙালি মুসলমান।
কেন এমন হলো?
ছয়.
সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ নয়। কয়েকটি প্রশ্ন নিয়ে এগোলে এই জেহাদি জোশের একটা প্যাটার্ন হয়তো বোঝা সম্ভব হবে।
যে কোনো জাতীয়তাবাদের মতো বাঙালি জাতীয়তাবাদও বাঙালির মনে অনেক স্বপ্নের জন্ম দিয়েছিল। বুঝিয়েছিল, অসাম্প্রদায়িকতাই মুক্তির পথ দেখাবে। সমাজের সকল ক্ষেত্রে নিজেদের দক্ষতা ও পরিশ্রম দিয়ে গড়ে তুলতে হবে দেশ। দক্ষতা ও পরিশ্রম দিয়ে দেশ গড়ার কাজটি যখনই হোঁচট খেয়েছে, তখন জাতীয়তাবাদও হোঁচট খেয়েছে। আর সেই শূন্যস্থান পূরণ করার দিকে এগিয়েছে ইসলামি জাতীয়তাবাদ। ইসলাম যদি সকল মুসলমানকে এক করতে পারত, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে মুসলমানদের একটাই দেশ থাকত, কিন্তু সেখানে এতগুলো আলাদা দেশ কেন?
বাঙালি জাতীয়তাবাদ যখন স্বপ্নগুলো পূরণ করতে পারল না, এবং বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর সুপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশকে মিনি পাকিস্তানে পরিণত করা হলো, তারপর থেকে আমাদের দেশের রাজনৈতিক–সামাজিক–সাংস্কৃতিক জীবনটা পর্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে, বেহুলার বাসরঘরে কী করে সাম্প্রদায়িকতার সাপ ঢুকে পড়ল।
সাত.
বাঙালি মুসলমান টেরও পেল না, কীভাবে তারা রাজনীতির শিকার হয়েছে। একই কথা বাঙালি হিন্দুর ক্ষেত্রেও বলা চলে। ১৯০৫ সালে বাঙালি হিন্দু যখন বঙ্গভঙ্গের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিল, তখন বাঙালি সত্তাই ছিল প্রধান পরিচয়। কিন্তু এরপর থেকেই ধীরে ধীরে বাঙালি হিন্দু প্রভাবিত হলো নিখিল ভারতীয় রাজনীতি দিয়ে, এবং কংগ্রেস নেতৃত্বেও গোঁড়াদের অবস্থান দৃঢ় হয়ে গেল। বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা তখন হয়ে গেল ভারতীয় জাতীয়তাবাদী। ফলে সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, শরৎ বসু, কিরণ শঙ্কর রায় যখন দেশভাগের সময় বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করছেন, তখন বাংলার হিন্দুরা তাদের ধর্মীয় পরিচয়টাকে জাতীয় পরিচয়ের চেয়ে বড় করে দেখেছিল। পূর্ব বাংলার মুসলিমরাও কিছুদিন অবিভক্ত বঙ্গের পক্ষে লড়াই করে একসময় খণ্ডিত বাংলাকে মেনে নিয়ে যত তাড়াতাড়ি পারে কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় চলে এসেছিল। সেই অস্থির সময়টি নিয়ে যে যার মতো ব্যাখ্যা দেয়, কিন্তু সে সময় জাতিগত পরিচয়ে বলীয়ান হতে না পারাই যে পরবর্তীকালে সাম্প্রদায়িকতার আগুনকে উসকে দিয়েছে, সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
আট.
তাই ভাবতে হবে—ধর্মচর্চার ভার কাদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে? এখন তো বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে মসজিদ অনেক বেশি যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জ্ঞানচর্চা মোটেই অনুপ্রেরণাদায়ক অবস্থানে নেই। শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের মধ্যেও চর্চাহীন, প্রজ্ঞাহীন মুফতে টাকা বানানোর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ফলে, নৈতিকভাবে দৃঢ় অবস্থান ধরে রেখে কোনো বিষয়ে কথা বলার মতো মানুষ ক্রমেই কমে যাচ্ছে। শুক্রবার দিন জুম্মার নামাজ আদায় করতে মসজিদে ভিড় করেন মানুষ। সে সময় মসজিদ এলাকায় যে আলোচনা হয়, যে খুতবা শুনে বাড়ি ফেরেন ধর্মভীরু মুসলমান, তাতে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর মতো বহু উপাদান থাকে। ধর্মের অপব্যাখ্যার বিরুদ্ধেও কেউ কথা বলতে সাহস পায় না। কারণ মসজিদ এলাকায় এই ধরনের ধর্মের লেবাসধারী মানুষেরই আধিক্য। এরা যুক্তি মানে না।
একজন মুসলমানের কাছে যেমন মসজিদ, একজন হিন্দুর কাছে তেমন মন্দির, খ্রিষ্টানের কাছে চার্চ, বৌদ্ধের কাছে প্যাগোডা ঠিক তেমন। যার যার ধর্ম তার তার। যিনি যে ধর্ম পালন করছেন, তিনি তার ধর্মের অনুশাসন মেনে চলবেন। কিন্তু ধর্মটাকে অর্ধশিক্ষিত মানুষের হাতে ছেড়ে দেওয়ার ফলেই এই গোল বেঁধেছে। প্রচলিত ধারণা মতে, উচ্চশিক্ষা লাভকারী মানুষই শিক্ষিত। কথাটা অসার। বহুযুগের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারায় মানুষ যে বিদ্যা করায়ত্ত করেছে, তার যে শক্তি আছে, তা অমূল্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ না নিয়েই সেই অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে কৃষক ফসল ফলায়। কোন জমিতে কতটুকু সার দিতে হবে, কোন সময়টা ফসল রোপণের জন্য উৎকৃষ্ট সময়, কখন ফসল কাটতে হবে এগুলো বছরের পর বছরের অভিজ্ঞতা থেকেই কৃষক করে যায়। বিজ্ঞান হয়তো সেই শিক্ষার সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে আরও কিছু কাজ করে, যা এই প্রক্রিয়াকে সহজ করে তোলে।
তাই তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের চেয়ে জীবনের শিক্ষালাভ করেছেন যিনি প্রকৃতি থেকে, তিনি নিশ্চয়ই পিছিয়ে পড়া মানুষ নন। গোল বাধে অর্ধশিক্ষিত মানুষ নিয়ে। এরা না বুঝে বা নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য নিজের মতো কোনো বিষয়ের ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে নেয়। যেহেতু তাদের কেউ চ্যালেঞ্জ করছে না, সেহেতু এরা কল্পিত ভাবনাকেই সত্য বলে চালিয়ে দিতে চায় এবং ধর্ম নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করার রীতি নেই বলে সবাই চুপ করে থাকে। সাধারণ মানুষ ভুলেই যায় যে, প্রশ্নটি ধর্ম নিয়ে নয়, ধর্মের অপব্যাখ্যা নিয়ে। ফলে ওয়াজ, মসজিদের ভুল বয়ানগুলোই ছড়িয়ে যায় সমাজে, সমাজ তার যৌক্তিক অবস্থান হারায় এবং ধীরে ধীরে অন্ধবিশ্বাসের দিকে অগ্রসর হয়।
এখন একটি বিষয় আলোচনায় আসা দরকার। দেশের একটা বড় অংশের শিক্ষাব্যবস্থায় দেশ নেই, দেশের মানুষ নেই, দেশের ইতিহাস নেই, ধর্মীয় পরিচয়টাই সেখানে তার একমাত্র পরিচয়—এ রকম একটা জেলখানা যারা বানিয়েছে, তাদের কাছ থেকে সুস্থ চিন্তা আশা করা যায় না। দেশের উৎপাদনের সঙ্গে এদের যোগাযোগের ব্যবস্থা কে করে দেবে। মসজিদ, মাদ্রাসা ছাড়া তো এদের চাকরির সুযোগ কম। তার মানে, ওই আবহ ছাড়া আর কোনো আবহের মধ্যেই তাদের যাওয়ার সুযোগ নেই। এ রকম জীবনে হতাশা আসাটা স্বাভাবিক। ঢলে তারা কীভাবে অন্যের দুঃখ, কষ্ট অনুভব করবে?
নয়.
ধর্ম, আরববিশ্ব, মুসলমান পরিচয় ইত্যাদি আসলে কোনো ব্যাপারই নয়। ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে নিজের অপরাধকে ঢেকে ফেলার এক অদ্ভুত খেলায় নিয়োজিত হয়েছে বাংলাদেশের ধর্ম ব্যবসায়ীরা। আর সেটাকেই ধর্মীয় বিধান বলে চালানোর চেষ্টা করছে।
দশ.
আমাদের স্কুলের নাম ছিল সিদ্ধেশ্বরী বালক উচ্চ বিদ্যালয়। আমার কাছের বন্ধুদের একজন ছিল জয়ন্ত কুমার ভৌমিক। গত শতাব্দীর সাত ও আটের দশকে স্কুলের নামটি হিন্দু নাম কিনা, জয়ন্ত হিন্দু হয়েও আমার কাছের বন্ধুদের একজন কেন, সে প্রশ্ন ওঠেনি কখনো। অমরজ্যোতি ক্লাবে খেলার সময় আমাদের ওয়ানডাউন ব্যাটসম্যান সৌমিত্র বা টুটুলকে কখনোই ধর্ম পরিচয় দিয়ে বিচার করিনি আমরা। আমার আর সৌমিত্রের জুটি একসঙ্গে অনেকটা সময় ক্রিজে কাটিয়েছি। তখন আমাদের একটাই পরিচয়, রান করে দলকে ভালো জায়গায় পৌঁছে দিতে হবে। এখন কেন ধর্ম পরিচয়টা বড় হয়ে উঠছে?
বড় হয়ে উঠছে এ কারণে যে, পরিবারে ধর্ম–সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেওয়া হয় না। ফেসবুকে স্ট্যাটাস কিংবা স্ট্যাটাসের মন্তব্যগুলো পড়লেই বুঝতে পারবেন, আমরা কোথায় আছি। নারী সম্পর্কে অধিকাংশ পুরুষের অবস্থানও টের পাবেন।
এগারো.
যারা এই অপঘাত থেকে বাঁচাতে পারত, তারা সময়মতো নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়ায়নি। অনেকেই ফেসবুকে, পত্রিকার লেখালেখিতে এই ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন, অথচ যে সংকটকালে মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হয়, সে কাজটি প্রতিবেশীরা করেননি। ধর্মীয় সহনশীলতা থাকলে তো স্থানীয় মুসলমানেরাই হিন্দু সম্প্রদায়ের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। কোথাও কোথাও যে সে রকম ঘটনা ঘটেনি, তা–ও নয়। কিন্তু মতলববাজরা তাদের স্বার্থসিদ্ধি করে নিয়েছিল আগেই।
আমাদের যে পোক্ত সমাজ ছিল, তার বন্ধন শিথিল হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ভারতের কথা টেনে আনার কোনো দরকার নেই। ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদ যদি বিজেপির মাধ্যমে প্রসারিত হয়, তাহলে সেটাও ভারতের জনজীবনের জন্য খুবই অস্বাস্থ্যকর অবস্থা। তার নিন্দা জানাব। কিন্তু আমাদের দেশের কিছু মুসলমানের অন্যায়কে জায়েজ করার জন্য ভারতের হিন্দুকে টেনে আনার কোনো অর্থ নেই। সেটাও মতলববাজির চূড়ান্ত।
বারো.
সমাজটা হারিয়ে গেছে। সমাজের বন্ধন শিথিল হয়েছে। ধর্মবিদ্বেষ বেড়েছে।
সমাজ হারিয়ে যাওয়ার পেছনে যে কারণগুলো আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো সাংস্কৃতিক বন্ধন ছিন্ন হওয়া। দেশের মানুষ সাংস্কৃতিক জীবনযাপনে অংশ নিচ্ছে কম। সংস্কৃতিই তো মানুষে মানুষে মিলন আনে। সিনেমা, নাটক, যাত্রার অভিনয় দেখে, সংলাপ শুনে মানুষের মনে বোধ জন্মায়, গানের সুরে সে বুঝতে পারে, হৃদয়ে ভালোবাসা, দেশপ্রেমের চাষবাস করার প্রয়োজনীয়তা। বৈশাখী মেলা, নবান্ন, পিঠা উৎসব ইত্যাদি পোক্ত করে সামাজিক বন্ধন।
সে সব মুছে গিয়ে মানুষ যান্ত্রিকতায় বিশ্বাসী হয়ে পড়ছে। ছুটছে টাকার পেছনে। আরা ছুটছে ধর্মান্ধতার পেছনে। তাই এই আলগা হয়ে যাওয়া বাঁধনকে পোক্ত করা খুব দরকার। কিন্তু তার আলামত পাচ্ছি না।
আর রাজনীতি? এ ধরনের নিন্দনীয় ঘটনা ঘটার সময় জনপ্রতিনিধিরা কোথায় থাকেন? তারা কেন মানুষকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন না? তাঁরা চাইলেই নিজ সংগঠনের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে এই সংকটের মোকাবিলা করতে পারেন।
পাশের বাড়ির মানুষটাও তো পাশে এসে দাঁড়াতে পারেন? কেন দাঁড়ান না?
ওই যে বললাম, আলগা হয়েছে বাঁধনের জোর। এটা রবীন্দ্রনাথের কথা। ‘রথের রশি’তে লিখেছিলেন তিনি। সেই বাঁধন পোক্ত হবে কিনা, তা নির্ভর করছে আমাদের কাণ্ডজ্ঞানের ওপর। সেটা আপাতত খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা।

ডা. মুশতাক হোসেন এরশাদবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা, ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য। তিনি কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছেন। পেশাজীবনে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ছিলেন।
১৩ ঘণ্টা আগে
কুড়িল বিশ্বরোডের ফুটওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে একটি খালের চমৎকার শোভা দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। ঢাকার বুকে এত সুন্দর একটা খাল! ধনুকের মতো বাঁক খেয়ে চলে গেছে দূরে, দুই পাড়ে হাঁটার রাস্তা। রাস্তা আর খালের পানির মাঝে সবুজ ঢাল সিঙ্গাপুর ডেইজির শায়িত লতায় আচ্ছাদিত।
১৩ ঘণ্টা আগে
পিরোজপুরের নেছারাবাদে যে ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য ইউএনও সাহেব ধন্যবাদ পেতেই পারেন। সেখানে একটি বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছিলেন তিনি সপরিবারে। কিন্তু যখন জানতে পারলেন, বিয়ের কনে প্রাপ্তবয়স্ক নয়, তখন তিনি না খেয়েই ফিরে আসেন। এবং তিনি ফিরে আসায় কাজিও বিয়ে পড়াননি। ফলে এই বাল্যবিবাহ হয়নি।
১৩ ঘণ্টা আগে
মিরপুরের শিয়ালবাড়ী এলাকায় একটি রাসায়নিক গুদামে আগুন লাগার পর যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল, সে কথা সবাই এখন জানেন। যাঁরা স্বজন হারিয়েছেন, তাঁরা জানেন এটা তাঁদের পরিবারের জন্য কত বড় ক্ষতি। নিহতদের পরিবার ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে কি না, তাদের জীবনে স্থিতি ফিরিয়ে আনতে কী করা দরকার...
১ দিন আগে
ডা. মুশতাক হোসেন এরশাদবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা, ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য। তিনি কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছেন। পেশাজীবনে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ছিলেন। সিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদ—এ চারটি বামপন্থী দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর না করার কারণ নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা।
মাসুদ রানা

আপনারা কেন জুলাই সনদে স্বাক্ষর না করার সিদ্ধান্ত নিলেন? আপনাদের মূল আপত্তিগুলো কী ছিল?
আমাদের প্রথম আপত্তি ছিল ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা ভিন্নমত সংযুক্ত না করা। যেসব বিষয়ে সবাই মিলে একমত হয়েছি বা মোটামুটি একমত হয়েছি, সেসব যুক্ত করা ছাড়া আমরা স্বাক্ষর করব না। যেহেতু ‘নোট অব ডিসেন্ট’সহ কিছু বিষয়ে আপত্তি ছিল, সেটা স্বাক্ষর করলে তো মেনে নেওয়া হতো। সেটা জাতীয় সংসদে হলে অন্য কথা ছিল বা কোনো রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে সেটা হতে পারে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বা সংখ্যালঘিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে সেটা মেনে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু ঐকমত্য কমিশন সে রকম কোনো ফোরাম না। এটা হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে ঐকমত্যে আসার জন্য একটা চেষ্টা, একটা উদ্যোগ।
জুলাই সনদ তৈরি করার সময় এর পটভূমি ধরে আমরা ইতিহাসকে সঠিকভাবে লেখার জন্য বারবার ইনপুট দিয়েছি। আমাদের দলসহ অন্য দলের নেতারা সেটা বলেছেন। কিন্তু সনদে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানকে পুরোপুরি গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। যদিও ছোট ছোট অনেক ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টা কীভাবে এল, সেটা তো থাকা দরকার এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তো থাকতে হবে। যদিও বিশাল আকারে ইতিহাস লেখার জায়গা এটা না। শেষে আসবে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের ঘটনা। এর মধ্যে মাঝখানের ঘটনাগুলো শুধু উল্লেখ করলেই চলত। সেটা তো করা হয়নি। যাঁরা খসড়াটি করেছেন, তাঁদের আমি অবশ্যই অযোগ্য বলব না। একেকজনের কথায় একেকটা বিষয় ঢুকে গেছে। কারও সঙ্গে তাঁরা বিতর্ক করেননি। ফলে আমাদের বক্তব্যগুলোকে বেমালুম বাদ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা মনে করেছেন, আমাদের বক্তব্য বাদ দিলে বুঝি কোনো সমস্যা হবে না। আবার কোনো কোনো দল যা-ই বলেছে, সেটাই তাঁরা রেখেছেন; যেখানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অসম্পূর্ণ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বক্তব্য একপেশে হয়েছে।
আবার অঙ্গীকারনামায় উল্লেখ করা হয়েছে, এই সনদ বাস্তবায়নের জন্য পরিপূর্ণভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকতে হবে। আমাদের কথা হলো, এই সনদ পরিপূর্ণ হলে সেখানে ‘নোট অব ডিসেন্ট’গুলো লিপিবদ্ধ থাকত। কিন্তু সেসব রাখা হয়নি। সনদের ভেতরে আবার তাঁরা লিখেছেন—যে দল সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে, ‘নোট অব ডিসেন্ট’ ছাড়া কাজ করতে পারবে। যারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না, তারাও তো কাজ করবে। তারা প্রয়োজনবোধে একমত না হলে সংসদ ত্যাগ করবে। নতুবা সংসদের বাইরে সভা-সমাবেশের মাধ্যমে জনগণের কাছে মতামত তুলে ধরবে। এসব তো ম্যান্ডেট পাওয়া না-পাওয়ার ওপর নির্ভর করে না।
এটা তো বিএনপির ভাষা। বিএনপি মনে করে, তারা ম্যান্ডেট নিয়ে আগামী সংসদে যাবে। সেটা ভালো কথা। কিন্তু আমরা ম্যান্ডেট পাব কি পাব না সেটা ভিন্ন কথা। আমরা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছি চুপ না থাকার জন্য। আমরা যেমনভাবে সংসদের ভেতরে কথা বলব, তেমনি সংসদের বাইরেও কথা বলব। আমরা আবার রাজপথে আন্দোলনও করব। সবকিছু মিলিয়ে আমরা কয়েকটি বামপন্থী দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর করিনি।
তবে আমরা সংবাদ সম্মেলন করে বলেছি, যেসব বিষয়ে আমরা সহমত জ্ঞাপন করেছি (সেটার রেকর্ড আছে) সেটা খুব ভালো কাজ হয়েছে। আমরা ঐকমত্য কমিশনকে ধন্যবাদ জানাই যে সাংবিধানিক প্রশ্ন, আইনের প্রশ্নসহ সংস্কার নিয়ে সব রাজনৈতিক দলের মতামত নিয়ে তারা একটা ঐতিহাসিক দলিল তৈরি করতে পেরেছে। এই দলিল থেকে বোঝা যাবে, কোন দলের কী দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু আমরা বলেছি, গায়ের জোরে সংবিধান বাতিল করার দাবি—এটা অসাংবিধানিক অপরাধ। আমরা মনে করি, সংবিধান বাতিল করার দাবি তোলা যাবে এবং নতুন সংবিধান করার দাবিও তোলা যাবে—সেটা রাষ্ট্রদ্রোহ হবে না। কিন্তু অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে যদি বাতিল করতে চায়, সেটা অবশ্যই রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ। তারা ৭ (ক) ধারার বাতিল করার প্রস্তাব করেছে। এটা নিয়ে আমরা আপত্তি করেছি। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টে উচ্চকক্ষে আমরা পিআর পদ্ধতির পক্ষে, কিন্তু দুই বাসদ ও সিপিবি উচ্চকক্ষে পিআরের পক্ষে না।
তবে আমরা যে কয়েকটি বাম দল এসব বিষয়ে একমত হয়েছি, আমরা আগামী দিনে সংসদের ভেতরে ও বাইরে এসব নিয়ে সংগ্রাম এবং রাজনৈতিকভাবে জনমত গঠনের কাজ করব। সেটা আমরা অঙ্গীকার করেছি।
এরপর আপনারা একটা স্মারকলিপি দিয়েছেন। এটা দেওয়ার কারণ কী?
আমরা কেন জুলাই সনদে স্বাক্ষর করলাম না, সেটা নিয়ে আমরা একটা সংবাদ সম্মেলন করেছি। সেই সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যটা আমাদের দুজন প্রতিনিধি হাতে হাতে ঐকমত্য কমিশনের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।
স্মারকলিপি দেওয়ার পর ঐকমত্য কমিশনের বক্তব্য কী?
তারা বলেছে, আপনারা অনেক কষ্ট করে, সময় নিয়ে বক্তব্য বা নোট দিয়েছেন, আপনারা এটার অংশীদার হন। আমরা বলেছি, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আর বিএনপির দৃষ্টিভঙ্গি এক নয়। জাতীয় সংসদে সিদ্ধান্ত হওয়ার আগে কেন আমরা আত্মসমর্পণ করব মৌলিক, দার্শনিক ও রাজনৈতিক প্রশ্নে? বিএনপি যেমন প্রত্যাশা করছে, তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে। তারাসহ তাদের মিত্ররা দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পাবে। তারা যেসব নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে, সেগুলোতে তারা পক্ষে নিতে পারে। কিন্তু সংসদে যাওয়ার আগেই আমাদের মেনে নিতে হবে, সংবিধান বাতিলের ১৪ ধারা রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ না, নারী ১০০ আসনে সরাসরি নির্বাচনের দরকার নেই, সংবিধানের ১৫০ (২) ধারা মতে শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ না থাকা—এ বিষয়গুলো এড়িয়ে গিয়ে তো আমরা সনদে স্বাক্ষর করে দাসখত দিতে পারি না। এই ফাঁদেও পা দিতে পারি না। আমরা স্পষ্ট করে বলেছি, এসব বিষয় যদি সংশোধন না করা হয়, তাহলে আমরা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করতে পারি না।
এনসিপি সনদের বাস্তবায়নের পদ্ধতির প্রশ্ন নিয়ে স্বাক্ষর করেনি। এটাকে আপনারা কীভাবে দেখেন?
তাদের তো সনদ নিয়ে কোনো দাবি নেই। তারা সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে চাপ সৃষ্টি করছে। আমাদের তো সনদের খসড়া নিয়েই আপত্তি। কিন্তু তাদের কোনো আপত্তি নেই। তারা শুধু বাস্তবায়ন পদ্ধতির বিতর্ক তুলে স্বাক্ষর করেনি।
আপনি নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা ছিলেন। সে সময়ে তিন জোটের রূপরেখাকে পরবর্তীকালে ক্ষমতাসীন কোনো দলই গুরুত্ব দেয়নি। এখন আপনি জুলাই সনদ নিয়ে কতটা আশাবাদী?
নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের তিন জোটের রূপরেখাকে নির্দিষ্ট করে সংবিধানের সঙ্গে আপগ্রেড করা হয়নি। সে সময় যে তিনটি জোট এই রূপরেখাতে স্বাক্ষর করেছিল, তারা কিন্তু পরবর্তী সময়ে তার অনেক কিছুই মানেনি। তারা সেখানকার রাজনৈতিক অঙ্গীকারও পালন করেনি। তা ছাড়া, এটার কোনো আইনি রূপও দেওয়া হয়নি। কথা ছিল তারা পরস্পরের প্রতি কোনো বৈরী আচরণ করবে না। সেই রাজনৈতিক অঙ্গীকারও পালন করেনি। পরস্পর পরস্পরকে ধ্বংস করার জন্য এক দল অন্য দলের প্রতি বিরূপ আচরণ করেছে। এগুলোকে কোনোভাবেই রাজনৈতিক আচরণ বা সাংবিধানিক আইন মেনে চলা বলা যায় না।
কিন্তু এবারের জুলাই সনদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এর ধারা ও উপধারা ধরে বিতর্ক করে কে পক্ষে আছে আর কে বিপক্ষে আছে, তা নিয়ে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। সে কারণে বলতে চাই, নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের তিন জোটের রূপরেখার সঙ্গে এবারের জুলাই সনদটা অনেক অগ্রসর দলিল বলতে হবে। কোনো দল যদি এর কোনো বক্তব্য সুনির্দিষ্টভাবে পালন করতে না চায়, তাহলে সব রাজনৈতিক দল তার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যাবে। জুলাই সনদ একেবারেই সুনির্দিষ্ট। কিন্তু নব্বইয়ের রূপরেখা এভাবে সুনির্দিষ্ট ছিল না। আবার সেই রূপরেখার মধ্যে কোনো গভীরতা ছিল না। তারপরেও যে কিছু হয়নি, সেটা বলা যাবে না। কারণ, নব্বইয়ের পরে সব দল কিন্তু সংসদীয় সরকার পদ্ধতির দিকে অগ্রসর হয়েছে। যদিও পরবর্তী সময়ে সেই সংসদীয় সরকার পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার পরেও নানা অঘটন ঘটেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতি আসলে কোন দিকে যাচ্ছে?
এখন দ্রুত দরকার একটা সংসদ নির্বাচন করা। যে নির্বাচিত সরকার জনগণের কাছে জবাবদিহি করবে। এখন কোনো জবাবদিহি করা যাচ্ছে না। আমরা যেভাবে গত স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে পেরেছি, এখন কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে তা করতে পারছি না। এখন কোনো বিষয়ে সরকারের কাছে অভিযোগ উত্থাপন করলে তারা বলে, কোনো কিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। আবার পুলিশও একই কথা বলছে।
রাজনৈতিক দলগুলো দেশটাকে ভাগাভাগি করার মতো করে কথা বলছে। এক দল আরেক দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে, আবার সবাই মিলে ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে। এখানে এখন একটা আজব পরিস্থিতি বিরাজ করছে। মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা দেওয়ার নিশ্চয়তা এ সরকার দিতে পারছে না। এ জন্য নির্বাচন করা দরকার। যদিও সুষ্ঠু নির্বাচন করা নিয়ে অনেকে শঙ্কা প্রকাশ করছেন। তারপরও নির্বাচনের মাধ্যমে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তখন আমরা একটা রাজনৈতিক ব্যাকরণের মধ্যে প্রবেশ করতে পারব।
নির্বাচিত সরকার ভালো কাজ করলে পক্ষে থাকব আর মন্দ কাজ করলে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করব। আগে থেকে বলা সম্ভব নয়, যারা দায়িত্বে থাকবে তারা কতটুকু পারছে বা পারছে না। তারা যদি জনগণের পক্ষে না থাকে, তাহলে প্রয়োজনে আগাম নির্বাচন দাবি করব।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ।
আপনারা কেন জুলাই সনদে স্বাক্ষর না করার সিদ্ধান্ত নিলেন? আপনাদের মূল আপত্তিগুলো কী ছিল?
আমাদের প্রথম আপত্তি ছিল ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা ভিন্নমত সংযুক্ত না করা। যেসব বিষয়ে সবাই মিলে একমত হয়েছি বা মোটামুটি একমত হয়েছি, সেসব যুক্ত করা ছাড়া আমরা স্বাক্ষর করব না। যেহেতু ‘নোট অব ডিসেন্ট’সহ কিছু বিষয়ে আপত্তি ছিল, সেটা স্বাক্ষর করলে তো মেনে নেওয়া হতো। সেটা জাতীয় সংসদে হলে অন্য কথা ছিল বা কোনো রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে সেটা হতে পারে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বা সংখ্যালঘিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে সেটা মেনে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু ঐকমত্য কমিশন সে রকম কোনো ফোরাম না। এটা হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে ঐকমত্যে আসার জন্য একটা চেষ্টা, একটা উদ্যোগ।
জুলাই সনদ তৈরি করার সময় এর পটভূমি ধরে আমরা ইতিহাসকে সঠিকভাবে লেখার জন্য বারবার ইনপুট দিয়েছি। আমাদের দলসহ অন্য দলের নেতারা সেটা বলেছেন। কিন্তু সনদে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানকে পুরোপুরি গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। যদিও ছোট ছোট অনেক ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টা কীভাবে এল, সেটা তো থাকা দরকার এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তো থাকতে হবে। যদিও বিশাল আকারে ইতিহাস লেখার জায়গা এটা না। শেষে আসবে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের ঘটনা। এর মধ্যে মাঝখানের ঘটনাগুলো শুধু উল্লেখ করলেই চলত। সেটা তো করা হয়নি। যাঁরা খসড়াটি করেছেন, তাঁদের আমি অবশ্যই অযোগ্য বলব না। একেকজনের কথায় একেকটা বিষয় ঢুকে গেছে। কারও সঙ্গে তাঁরা বিতর্ক করেননি। ফলে আমাদের বক্তব্যগুলোকে বেমালুম বাদ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা মনে করেছেন, আমাদের বক্তব্য বাদ দিলে বুঝি কোনো সমস্যা হবে না। আবার কোনো কোনো দল যা-ই বলেছে, সেটাই তাঁরা রেখেছেন; যেখানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অসম্পূর্ণ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বক্তব্য একপেশে হয়েছে।
আবার অঙ্গীকারনামায় উল্লেখ করা হয়েছে, এই সনদ বাস্তবায়নের জন্য পরিপূর্ণভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকতে হবে। আমাদের কথা হলো, এই সনদ পরিপূর্ণ হলে সেখানে ‘নোট অব ডিসেন্ট’গুলো লিপিবদ্ধ থাকত। কিন্তু সেসব রাখা হয়নি। সনদের ভেতরে আবার তাঁরা লিখেছেন—যে দল সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে, ‘নোট অব ডিসেন্ট’ ছাড়া কাজ করতে পারবে। যারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না, তারাও তো কাজ করবে। তারা প্রয়োজনবোধে একমত না হলে সংসদ ত্যাগ করবে। নতুবা সংসদের বাইরে সভা-সমাবেশের মাধ্যমে জনগণের কাছে মতামত তুলে ধরবে। এসব তো ম্যান্ডেট পাওয়া না-পাওয়ার ওপর নির্ভর করে না।
এটা তো বিএনপির ভাষা। বিএনপি মনে করে, তারা ম্যান্ডেট নিয়ে আগামী সংসদে যাবে। সেটা ভালো কথা। কিন্তু আমরা ম্যান্ডেট পাব কি পাব না সেটা ভিন্ন কথা। আমরা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছি চুপ না থাকার জন্য। আমরা যেমনভাবে সংসদের ভেতরে কথা বলব, তেমনি সংসদের বাইরেও কথা বলব। আমরা আবার রাজপথে আন্দোলনও করব। সবকিছু মিলিয়ে আমরা কয়েকটি বামপন্থী দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর করিনি।
তবে আমরা সংবাদ সম্মেলন করে বলেছি, যেসব বিষয়ে আমরা সহমত জ্ঞাপন করেছি (সেটার রেকর্ড আছে) সেটা খুব ভালো কাজ হয়েছে। আমরা ঐকমত্য কমিশনকে ধন্যবাদ জানাই যে সাংবিধানিক প্রশ্ন, আইনের প্রশ্নসহ সংস্কার নিয়ে সব রাজনৈতিক দলের মতামত নিয়ে তারা একটা ঐতিহাসিক দলিল তৈরি করতে পেরেছে। এই দলিল থেকে বোঝা যাবে, কোন দলের কী দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু আমরা বলেছি, গায়ের জোরে সংবিধান বাতিল করার দাবি—এটা অসাংবিধানিক অপরাধ। আমরা মনে করি, সংবিধান বাতিল করার দাবি তোলা যাবে এবং নতুন সংবিধান করার দাবিও তোলা যাবে—সেটা রাষ্ট্রদ্রোহ হবে না। কিন্তু অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে যদি বাতিল করতে চায়, সেটা অবশ্যই রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ। তারা ৭ (ক) ধারার বাতিল করার প্রস্তাব করেছে। এটা নিয়ে আমরা আপত্তি করেছি। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টে উচ্চকক্ষে আমরা পিআর পদ্ধতির পক্ষে, কিন্তু দুই বাসদ ও সিপিবি উচ্চকক্ষে পিআরের পক্ষে না।
তবে আমরা যে কয়েকটি বাম দল এসব বিষয়ে একমত হয়েছি, আমরা আগামী দিনে সংসদের ভেতরে ও বাইরে এসব নিয়ে সংগ্রাম এবং রাজনৈতিকভাবে জনমত গঠনের কাজ করব। সেটা আমরা অঙ্গীকার করেছি।
এরপর আপনারা একটা স্মারকলিপি দিয়েছেন। এটা দেওয়ার কারণ কী?
আমরা কেন জুলাই সনদে স্বাক্ষর করলাম না, সেটা নিয়ে আমরা একটা সংবাদ সম্মেলন করেছি। সেই সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যটা আমাদের দুজন প্রতিনিধি হাতে হাতে ঐকমত্য কমিশনের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।
স্মারকলিপি দেওয়ার পর ঐকমত্য কমিশনের বক্তব্য কী?
তারা বলেছে, আপনারা অনেক কষ্ট করে, সময় নিয়ে বক্তব্য বা নোট দিয়েছেন, আপনারা এটার অংশীদার হন। আমরা বলেছি, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আর বিএনপির দৃষ্টিভঙ্গি এক নয়। জাতীয় সংসদে সিদ্ধান্ত হওয়ার আগে কেন আমরা আত্মসমর্পণ করব মৌলিক, দার্শনিক ও রাজনৈতিক প্রশ্নে? বিএনপি যেমন প্রত্যাশা করছে, তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে। তারাসহ তাদের মিত্ররা দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পাবে। তারা যেসব নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে, সেগুলোতে তারা পক্ষে নিতে পারে। কিন্তু সংসদে যাওয়ার আগেই আমাদের মেনে নিতে হবে, সংবিধান বাতিলের ১৪ ধারা রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ না, নারী ১০০ আসনে সরাসরি নির্বাচনের দরকার নেই, সংবিধানের ১৫০ (২) ধারা মতে শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ না থাকা—এ বিষয়গুলো এড়িয়ে গিয়ে তো আমরা সনদে স্বাক্ষর করে দাসখত দিতে পারি না। এই ফাঁদেও পা দিতে পারি না। আমরা স্পষ্ট করে বলেছি, এসব বিষয় যদি সংশোধন না করা হয়, তাহলে আমরা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করতে পারি না।
এনসিপি সনদের বাস্তবায়নের পদ্ধতির প্রশ্ন নিয়ে স্বাক্ষর করেনি। এটাকে আপনারা কীভাবে দেখেন?
তাদের তো সনদ নিয়ে কোনো দাবি নেই। তারা সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে চাপ সৃষ্টি করছে। আমাদের তো সনদের খসড়া নিয়েই আপত্তি। কিন্তু তাদের কোনো আপত্তি নেই। তারা শুধু বাস্তবায়ন পদ্ধতির বিতর্ক তুলে স্বাক্ষর করেনি।
আপনি নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা ছিলেন। সে সময়ে তিন জোটের রূপরেখাকে পরবর্তীকালে ক্ষমতাসীন কোনো দলই গুরুত্ব দেয়নি। এখন আপনি জুলাই সনদ নিয়ে কতটা আশাবাদী?
নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের তিন জোটের রূপরেখাকে নির্দিষ্ট করে সংবিধানের সঙ্গে আপগ্রেড করা হয়নি। সে সময় যে তিনটি জোট এই রূপরেখাতে স্বাক্ষর করেছিল, তারা কিন্তু পরবর্তী সময়ে তার অনেক কিছুই মানেনি। তারা সেখানকার রাজনৈতিক অঙ্গীকারও পালন করেনি। তা ছাড়া, এটার কোনো আইনি রূপও দেওয়া হয়নি। কথা ছিল তারা পরস্পরের প্রতি কোনো বৈরী আচরণ করবে না। সেই রাজনৈতিক অঙ্গীকারও পালন করেনি। পরস্পর পরস্পরকে ধ্বংস করার জন্য এক দল অন্য দলের প্রতি বিরূপ আচরণ করেছে। এগুলোকে কোনোভাবেই রাজনৈতিক আচরণ বা সাংবিধানিক আইন মেনে চলা বলা যায় না।
কিন্তু এবারের জুলাই সনদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এর ধারা ও উপধারা ধরে বিতর্ক করে কে পক্ষে আছে আর কে বিপক্ষে আছে, তা নিয়ে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। সে কারণে বলতে চাই, নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের তিন জোটের রূপরেখার সঙ্গে এবারের জুলাই সনদটা অনেক অগ্রসর দলিল বলতে হবে। কোনো দল যদি এর কোনো বক্তব্য সুনির্দিষ্টভাবে পালন করতে না চায়, তাহলে সব রাজনৈতিক দল তার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যাবে। জুলাই সনদ একেবারেই সুনির্দিষ্ট। কিন্তু নব্বইয়ের রূপরেখা এভাবে সুনির্দিষ্ট ছিল না। আবার সেই রূপরেখার মধ্যে কোনো গভীরতা ছিল না। তারপরেও যে কিছু হয়নি, সেটা বলা যাবে না। কারণ, নব্বইয়ের পরে সব দল কিন্তু সংসদীয় সরকার পদ্ধতির দিকে অগ্রসর হয়েছে। যদিও পরবর্তী সময়ে সেই সংসদীয় সরকার পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার পরেও নানা অঘটন ঘটেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতি আসলে কোন দিকে যাচ্ছে?
এখন দ্রুত দরকার একটা সংসদ নির্বাচন করা। যে নির্বাচিত সরকার জনগণের কাছে জবাবদিহি করবে। এখন কোনো জবাবদিহি করা যাচ্ছে না। আমরা যেভাবে গত স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে পেরেছি, এখন কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে তা করতে পারছি না। এখন কোনো বিষয়ে সরকারের কাছে অভিযোগ উত্থাপন করলে তারা বলে, কোনো কিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। আবার পুলিশও একই কথা বলছে।
রাজনৈতিক দলগুলো দেশটাকে ভাগাভাগি করার মতো করে কথা বলছে। এক দল আরেক দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে, আবার সবাই মিলে ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে। এখানে এখন একটা আজব পরিস্থিতি বিরাজ করছে। মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা দেওয়ার নিশ্চয়তা এ সরকার দিতে পারছে না। এ জন্য নির্বাচন করা দরকার। যদিও সুষ্ঠু নির্বাচন করা নিয়ে অনেকে শঙ্কা প্রকাশ করছেন। তারপরও নির্বাচনের মাধ্যমে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তখন আমরা একটা রাজনৈতিক ব্যাকরণের মধ্যে প্রবেশ করতে পারব।
নির্বাচিত সরকার ভালো কাজ করলে পক্ষে থাকব আর মন্দ কাজ করলে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করব। আগে থেকে বলা সম্ভব নয়, যারা দায়িত্বে থাকবে তারা কতটুকু পারছে বা পারছে না। তারা যদি জনগণের পক্ষে না থাকে, তাহলে প্রয়োজনে আগাম নির্বাচন দাবি করব।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ।

মুক্তবুদ্ধির চর্চাটা রয়ে গেল কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ মানুষের মধ্যে। এই ‘শিক্ষিত’ মানুষের বাইরে যে গোটা দেশটা ছিল, সেটা কিন্তু এই আলোয় উদ্ভাসিত হলো না। রাজনীতি থেকে একটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টা খানিক স্পষ্ট হবে। এ দেশে সর্বস্ব ত্যাগ করে যারা রাজনীতি করল, তাদের সিংহভাগই ছিলেন সাম্যবাদী।
২২ অক্টোবর ২০২১
কুড়িল বিশ্বরোডের ফুটওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে একটি খালের চমৎকার শোভা দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। ঢাকার বুকে এত সুন্দর একটা খাল! ধনুকের মতো বাঁক খেয়ে চলে গেছে দূরে, দুই পাড়ে হাঁটার রাস্তা। রাস্তা আর খালের পানির মাঝে সবুজ ঢাল সিঙ্গাপুর ডেইজির শায়িত লতায় আচ্ছাদিত।
১৩ ঘণ্টা আগে
পিরোজপুরের নেছারাবাদে যে ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য ইউএনও সাহেব ধন্যবাদ পেতেই পারেন। সেখানে একটি বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছিলেন তিনি সপরিবারে। কিন্তু যখন জানতে পারলেন, বিয়ের কনে প্রাপ্তবয়স্ক নয়, তখন তিনি না খেয়েই ফিরে আসেন। এবং তিনি ফিরে আসায় কাজিও বিয়ে পড়াননি। ফলে এই বাল্যবিবাহ হয়নি।
১৩ ঘণ্টা আগে
মিরপুরের শিয়ালবাড়ী এলাকায় একটি রাসায়নিক গুদামে আগুন লাগার পর যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল, সে কথা সবাই এখন জানেন। যাঁরা স্বজন হারিয়েছেন, তাঁরা জানেন এটা তাঁদের পরিবারের জন্য কত বড় ক্ষতি। নিহতদের পরিবার ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে কি না, তাদের জীবনে স্থিতি ফিরিয়ে আনতে কী করা দরকার...
১ দিন আগেমৃত্যুঞ্জয় রায়

কুড়িল বিশ্বরোডের ফুটওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে একটি খালের চমৎকার শোভা দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। ঢাকার বুকে এত সুন্দর একটা খাল! ধনুকের মতো বাঁক খেয়ে চলে গেছে দূরে, দুই পাড়ে হাঁটার রাস্তা। রাস্তা আর খালের পানির মাঝে সবুজ ঢাল সিঙ্গাপুর ডেইজির শায়িত লতায় আচ্ছাদিত। আহা, কী পরিষ্কার সেই খালের জল, কোথাও একটা শুকনো পাতা পড়ে নেই জলের ওপর। খালের পাড়ে স্বর্ণচাঁপা, বকুল, কাঠবাদাম, চালতা, ছাতিম গাছগুলোর ছত্রবৎ পত্রাচ্ছাদন, গোড়া বাঁধানো নারকেলগাছের সারি। খালের জলে সাঁতরে বেড়াচ্ছে, লাফ দিচ্ছে মাছেরা। মাঝে মাঝে পাড়ে রয়েছে জলের ওপর বাড়ানো জেটির মতো রেলিংঘেরা পাকা চাতাল, যার ওপর দাঁড়িয়ে জলের কাছে যাওয়া যায়, খালের জলে বড়শি ফেলে মাছ ধরা যায়। ওপরে হেমন্তের ঝকঝকে নীল আকাশ, রোদের ঝিলিক। খালের পশ্চিম পাড়ে একটি অভিজাত এলাকার মনোরম ভবন। দেখে মনে হচ্ছে, এ যেন ঢাকা শহর নয়—নেদারল্যান্ডসের কোনো এক জায়গা।
নেদারল্যান্ডসের গিথুর্ন গ্রামের ছবি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা হয়তো জানেন, সেই গ্রামে গাড়ি চালানোর মতো কোনো রাস্তা নেই, আছে গ্রামজুড়ে চলাচলের জন্য চমৎকার খাল আর হাঁটার পথ। একটা গ্রামে কোনো গাড়ির রাস্তা নেই, খাল ও খালের ওপর আছে ১৭০টির বেশি সেতু। বৈদ্যুতিক নৌকায় করে সেই গ্রামের অধিবাসীরা এখান থেকে সেখানে যায়। আহা, গাড়ি ও জ্বালানির দূষণমুক্ত কী শান্ত মনোরম সে গ্রাম! খালের পাড় বাঁধানো, দুই পাড়ে থাকা অনুচ্চ ঘরবাড়ি, আঙিনার কোথাও কোনো খোলা মাটি নেই, পুরোটাই সবুজ কার্পেটের মতো ঘাসে ঢাকা, মাঝে মাঝে ফুলগাছের ঝোপ। যেন সে এক স্বপ্নের জায়গা, পৃথিবীর বুকেই স্বর্গের শোভা। ঢাকার এ জায়গাটি দেখেও সেই গিথুর্ন গ্রামের ছবিটা চোখে ভাসছিল। ধন্যবাদ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনকে—নিকুঞ্জ খালের এমন সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য।
আহা রে, ঢাকা শহরের সব খাল যদি এরূপ সুন্দর হতো! এ কথা ভাবতেই মনের মধ্যে ভেসে উঠল এর বিপরীত দৃশ্য। খাল দখল করতে করতে সেগুলো সংকুচিত হয়ে পড়েছে। যতটুকু অবশিষ্ট আছে, সেগুলোও হয়ে পড়েছে ময়লার ভাগাড়, কচুরিপানা ও ঝোপঝাড়ে ভরা মশককুলের অভয়ারণ্য। বিভিন্ন কলকারখানার বর্জ্য নির্গমনের নিকাশনালার মতো ব্যবহৃত হচ্ছে কোনো কোনো খাল। পচা দুর্গন্ধযুক্ত অস্বাস্থ্যকর সেই পরিবেশেই কেটে যাচ্ছে পথচারী ও এলাকাবাসীর দিনকাল। খালগুলো যেভাবে মরতে বসেছে, তাতে আগামী ১০ বছরও লাগবে না ঢাকা শহর খালশূন্য হতে। ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকা শহরে খালের সংখ্যা ৪৭টি। রিভার অ্যান্ড ডেল্টা সেন্টারের গবেষণা অনুযায়ী ৫৬টি। ড্যাপেও খালের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে ৪৩টি।
ধরা হয়, অতীতে ঢাকা শহরে ৪৭টি খাল সচল ছিল। শহরের চারপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদের সঙ্গে যুক্ত ছিল সেসব খাল। নৌকা ও নৌযান চলত সেসব খালে। পণ্য পরিবহন ও লোক চলাচলে সে সময় খালগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। একসময় শাহবাগ থেকে মগবাজার পর্যন্ত একটি খাল ছিল—পরীবাগ খাল। ঢাকা ওয়াসার মানচিত্রে তার অস্তিত্বের কথা জানা যায়। সেই খাল আর এখন নেই। এভাবে ধোলাই খাল, রায়েরবাজার, গোপীবাগ, নারিন্দা, সেগুনবাগিচা, কাঁঠালবাগান, ধানমন্ডি ইত্যাদি খালগুলোরও এখন আর অস্তিত্ব নেই। ধানমন্ডি লেকটাই একসময় ছিল খাল, হাতিরঝিলের খালে পিলখানা থেকে হাতির পালকে নিয়ে যাওয়া হতো গোসল করাতে। মোগল শাসকেরা ঢাকা শহরে বহুসংখ্যক খাল থাকায় ঢাকাকে রাজধানী করার চিন্তা করেছিল, খালগুলো তাদের চলাচল ও প্রতিরক্ষার জন্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ। শহরের জলাবদ্ধতা দূর ও পানি নিষ্কাশনের জন্যও ছিল সেগুলো সহায়ক। সেসব এখন ইতিহাস। এখন এক ঘণ্টা বৃষ্টি হলেই ঢাকা শহরের অনেক এলাকায় হাঁটুপানি জমে যায়।
ঢাকা শহরের সব খাল উদ্ধার করা প্রথম কাজ। উদ্ধারের পর সেসব খালের দুই পাড়ে ওয়াকওয়ে বা হাঁটার পথ তৈরি ও বাহারি গাছপালা লাগিয়ে সুশোভন করা দ্বিতীয় কাজ। তৃতীয় কাজ হলো খালগুলোতে নিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যাটারি, বিদ্যুৎ ও হস্তচালিত নৌযান চালনার উদ্যোগ নেওয়া। জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক কোনো নৌযান সেসব খালে চলাচলের অনুমতি না দেওয়া হবে খালের জলজ জীবগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা এবং দূষণ কমানোর গুরুত্বপূর্ণ উপায়। ওয়াকওয়ে যেন শুধু ওয়াক তথা হাঁটার জন্যই ব্যবহৃত হয়, সে রাস্তায় যেন কোনো গাড়ি বা মোটরসাইকেল না চলে। সবশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো খাল এবং তার চারপাশের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন ও দূষণমুক্ত রাখতে উত্তম ব্যবস্থাপনার চর্চা অব্যাহত রাখা। খাল ব্যবহারকারী থেকে শুরু করে সেখানকার সব অংশীজনের সক্রিয় অংশগ্রহণই এসব ব্যবস্থাপনাকে সুচারুরূপে বাস্তবায়নের মূল সূত্র, এর সঙ্গে থাকবে সঠিক পরিকল্পনা ও নির্দেশনা, উদ্বুদ্ধকরণ ও সচেতনার প্রচারণা। এ কাজে দরকার রাষ্ট্রীয় বা সরকারের সদিচ্ছা ও সিদ্ধান্ত, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও প্রকল্প গ্রহণ, রাজনৈতিক ঐকমত্য এবং জনগণের অংশগ্রহণ। অনেক তরুণ এখন স্বেচ্ছাসেবী হয়ে এরূপ কাজে অংশ নিতে আগ্রহী। তাদের উৎসাহিত করে নিরাপদভাবে কাজের সুযোগ করে দিতে হবে। সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত মালি ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা কাজ করবেন জবাবদিহির মধ্যে, স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে মিলেমিশে। শোভাবর্ধনের চারাগুলোর ব্যবস্থা করতে হবে সিটি করপোরেশনগুলোকেই। তবে এককভাবে শুধু দুই সিটি করপোরেশনের ওপর সম্পূর্ণ বিষয়টি চাপিয়ে দিলে হবে না। খালগুলোর দখলদারেরা অনেক শক্তিশালী, নিশ্চিত যে তাঁরা কেউই সেসব খালের দখল স্বেচ্ছায় ছাড়বেন না। দখলমুক্ত করার জন্য জোর প্রশাসনিক প্রচেষ্টা ও আইন প্রয়োগ করা দরকার।
প্রকৃতিতে প্রবহমান নদী আর খালগুলো হলো আমাদের দেহের শিরা-উপশিরার মতো। একটি ভূখণ্ডের জীবনরেখা বলা হয় এসব জলস্রোতকে। প্রবহমান এসব জলাশয় যেমন জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি মাটিসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্যও সহায়ক। ঢাকা শহরের প্রায় দুই কোটি মানুষের স্বাস্থ্যের কথা ভেবেও খালগুলোকে সচল করা দরকার। বর্তমানে ঢাকা শহরে ২৬টি খালের অস্তিত্ব চোখে দেখা গেলেও বাকি ২১টি খাল নেই। কোথায় কোথায় সেসব খাল ছিল, তা নিশ্চয় অতীতের মানচিত্রগুলোতে পাওয়া যাবে। সেগুলো আদৌ উদ্ধার বা দখলমুক্ত করা যাবে, তা দুরাশা। উদ্ধার করা গেলে সেগুলো খনন করে সচল ও শোভাময় করা উচিত। জার্মানির বার্লিন শহরে খালে করে ক্যানালক্রুজ করার সময় খালপাড়ের দুই পাশের বিভিন্ন স্থাপনা ও নাগরিক সৌন্দর্য, সেতু, রেস্তোরাঁ দেখতে দেখতে অভিভূত হতাম। ভাবতাম, জলের দেশ, নদীর দেশ, খালের দেশ বাংলাদেশ; অথচ সে দেশের শহরগুলোর খালে কেন এ রকম নৌ-পর্যটন করা যাবে না?
খালপাড় ভেঙে যাতে কোনো নগরবাসীর এক ফুট জমিও নষ্ট না হয়, সে জন্য ভেনিস, কোপেনহেগেন, প্যারিস ইত্যাদি শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া খাল ও নদীর দুই পাড় যেভাবে পাকা করে বাঁধাই করে রাখা হয়েছে, সেভাবে আমাদের প্রবহমান খালগুলোর পাড়ও বেঁধে দেওয়া যায়। নগরীর খালগুলো নিয়ে একটি চমৎকার পরিকল্পনার সুযোগ রয়েছে ড্যাপ বাস্তবায়নের কারণে। চলাচল, পরিবহন, জলাবদ্ধতা নিরসন, দূষণ হ্রাস, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, পর্যটন, সৌন্দর্যবর্ধন, স্থানীয় মানুষের আয়বর্ধন, পরিবেশ উন্নয়ন ইত্যাদির জন্য এ ধরনের পরিকল্পনা ও জরিপকাজ নিশ্চয় সহায়ক হবে। সবার মনে রাখা উচিত, প্রাকৃতিক প্রবাহকে রুদ্ধ করার অধিকার কারও নেই, তার ফল কখনো ভালো হয় না। এ নিয়ে কোনো খণ্ডিত পরিকল্পনা নয়, নিতে হবে সমন্বিত সামগ্রিক পরিকল্পনা। তাহলে আমরাও দেখতে পাব একটি মনোরম মহানগর, সুশোভিত খালসমৃদ্ধ একটি সুশোভন পরিবেশ। কুড়িল বিশ্বরোডের কাছে নিকুঞ্জ খালটি যদি এত সুন্দর করা যায়, সুন্দর রাখা যায়, তাহলে অন্যগুলো কেন এরূপ সুন্দর হবে না?
মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক
আরও খবর পড়ুন:

কুড়িল বিশ্বরোডের ফুটওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে একটি খালের চমৎকার শোভা দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। ঢাকার বুকে এত সুন্দর একটা খাল! ধনুকের মতো বাঁক খেয়ে চলে গেছে দূরে, দুই পাড়ে হাঁটার রাস্তা। রাস্তা আর খালের পানির মাঝে সবুজ ঢাল সিঙ্গাপুর ডেইজির শায়িত লতায় আচ্ছাদিত। আহা, কী পরিষ্কার সেই খালের জল, কোথাও একটা শুকনো পাতা পড়ে নেই জলের ওপর। খালের পাড়ে স্বর্ণচাঁপা, বকুল, কাঠবাদাম, চালতা, ছাতিম গাছগুলোর ছত্রবৎ পত্রাচ্ছাদন, গোড়া বাঁধানো নারকেলগাছের সারি। খালের জলে সাঁতরে বেড়াচ্ছে, লাফ দিচ্ছে মাছেরা। মাঝে মাঝে পাড়ে রয়েছে জলের ওপর বাড়ানো জেটির মতো রেলিংঘেরা পাকা চাতাল, যার ওপর দাঁড়িয়ে জলের কাছে যাওয়া যায়, খালের জলে বড়শি ফেলে মাছ ধরা যায়। ওপরে হেমন্তের ঝকঝকে নীল আকাশ, রোদের ঝিলিক। খালের পশ্চিম পাড়ে একটি অভিজাত এলাকার মনোরম ভবন। দেখে মনে হচ্ছে, এ যেন ঢাকা শহর নয়—নেদারল্যান্ডসের কোনো এক জায়গা।
নেদারল্যান্ডসের গিথুর্ন গ্রামের ছবি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা হয়তো জানেন, সেই গ্রামে গাড়ি চালানোর মতো কোনো রাস্তা নেই, আছে গ্রামজুড়ে চলাচলের জন্য চমৎকার খাল আর হাঁটার পথ। একটা গ্রামে কোনো গাড়ির রাস্তা নেই, খাল ও খালের ওপর আছে ১৭০টির বেশি সেতু। বৈদ্যুতিক নৌকায় করে সেই গ্রামের অধিবাসীরা এখান থেকে সেখানে যায়। আহা, গাড়ি ও জ্বালানির দূষণমুক্ত কী শান্ত মনোরম সে গ্রাম! খালের পাড় বাঁধানো, দুই পাড়ে থাকা অনুচ্চ ঘরবাড়ি, আঙিনার কোথাও কোনো খোলা মাটি নেই, পুরোটাই সবুজ কার্পেটের মতো ঘাসে ঢাকা, মাঝে মাঝে ফুলগাছের ঝোপ। যেন সে এক স্বপ্নের জায়গা, পৃথিবীর বুকেই স্বর্গের শোভা। ঢাকার এ জায়গাটি দেখেও সেই গিথুর্ন গ্রামের ছবিটা চোখে ভাসছিল। ধন্যবাদ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনকে—নিকুঞ্জ খালের এমন সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য।
আহা রে, ঢাকা শহরের সব খাল যদি এরূপ সুন্দর হতো! এ কথা ভাবতেই মনের মধ্যে ভেসে উঠল এর বিপরীত দৃশ্য। খাল দখল করতে করতে সেগুলো সংকুচিত হয়ে পড়েছে। যতটুকু অবশিষ্ট আছে, সেগুলোও হয়ে পড়েছে ময়লার ভাগাড়, কচুরিপানা ও ঝোপঝাড়ে ভরা মশককুলের অভয়ারণ্য। বিভিন্ন কলকারখানার বর্জ্য নির্গমনের নিকাশনালার মতো ব্যবহৃত হচ্ছে কোনো কোনো খাল। পচা দুর্গন্ধযুক্ত অস্বাস্থ্যকর সেই পরিবেশেই কেটে যাচ্ছে পথচারী ও এলাকাবাসীর দিনকাল। খালগুলো যেভাবে মরতে বসেছে, তাতে আগামী ১০ বছরও লাগবে না ঢাকা শহর খালশূন্য হতে। ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকা শহরে খালের সংখ্যা ৪৭টি। রিভার অ্যান্ড ডেল্টা সেন্টারের গবেষণা অনুযায়ী ৫৬টি। ড্যাপেও খালের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে ৪৩টি।
ধরা হয়, অতীতে ঢাকা শহরে ৪৭টি খাল সচল ছিল। শহরের চারপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদের সঙ্গে যুক্ত ছিল সেসব খাল। নৌকা ও নৌযান চলত সেসব খালে। পণ্য পরিবহন ও লোক চলাচলে সে সময় খালগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। একসময় শাহবাগ থেকে মগবাজার পর্যন্ত একটি খাল ছিল—পরীবাগ খাল। ঢাকা ওয়াসার মানচিত্রে তার অস্তিত্বের কথা জানা যায়। সেই খাল আর এখন নেই। এভাবে ধোলাই খাল, রায়েরবাজার, গোপীবাগ, নারিন্দা, সেগুনবাগিচা, কাঁঠালবাগান, ধানমন্ডি ইত্যাদি খালগুলোরও এখন আর অস্তিত্ব নেই। ধানমন্ডি লেকটাই একসময় ছিল খাল, হাতিরঝিলের খালে পিলখানা থেকে হাতির পালকে নিয়ে যাওয়া হতো গোসল করাতে। মোগল শাসকেরা ঢাকা শহরে বহুসংখ্যক খাল থাকায় ঢাকাকে রাজধানী করার চিন্তা করেছিল, খালগুলো তাদের চলাচল ও প্রতিরক্ষার জন্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ। শহরের জলাবদ্ধতা দূর ও পানি নিষ্কাশনের জন্যও ছিল সেগুলো সহায়ক। সেসব এখন ইতিহাস। এখন এক ঘণ্টা বৃষ্টি হলেই ঢাকা শহরের অনেক এলাকায় হাঁটুপানি জমে যায়।
ঢাকা শহরের সব খাল উদ্ধার করা প্রথম কাজ। উদ্ধারের পর সেসব খালের দুই পাড়ে ওয়াকওয়ে বা হাঁটার পথ তৈরি ও বাহারি গাছপালা লাগিয়ে সুশোভন করা দ্বিতীয় কাজ। তৃতীয় কাজ হলো খালগুলোতে নিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যাটারি, বিদ্যুৎ ও হস্তচালিত নৌযান চালনার উদ্যোগ নেওয়া। জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক কোনো নৌযান সেসব খালে চলাচলের অনুমতি না দেওয়া হবে খালের জলজ জীবগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা এবং দূষণ কমানোর গুরুত্বপূর্ণ উপায়। ওয়াকওয়ে যেন শুধু ওয়াক তথা হাঁটার জন্যই ব্যবহৃত হয়, সে রাস্তায় যেন কোনো গাড়ি বা মোটরসাইকেল না চলে। সবশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো খাল এবং তার চারপাশের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন ও দূষণমুক্ত রাখতে উত্তম ব্যবস্থাপনার চর্চা অব্যাহত রাখা। খাল ব্যবহারকারী থেকে শুরু করে সেখানকার সব অংশীজনের সক্রিয় অংশগ্রহণই এসব ব্যবস্থাপনাকে সুচারুরূপে বাস্তবায়নের মূল সূত্র, এর সঙ্গে থাকবে সঠিক পরিকল্পনা ও নির্দেশনা, উদ্বুদ্ধকরণ ও সচেতনার প্রচারণা। এ কাজে দরকার রাষ্ট্রীয় বা সরকারের সদিচ্ছা ও সিদ্ধান্ত, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও প্রকল্প গ্রহণ, রাজনৈতিক ঐকমত্য এবং জনগণের অংশগ্রহণ। অনেক তরুণ এখন স্বেচ্ছাসেবী হয়ে এরূপ কাজে অংশ নিতে আগ্রহী। তাদের উৎসাহিত করে নিরাপদভাবে কাজের সুযোগ করে দিতে হবে। সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত মালি ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা কাজ করবেন জবাবদিহির মধ্যে, স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে মিলেমিশে। শোভাবর্ধনের চারাগুলোর ব্যবস্থা করতে হবে সিটি করপোরেশনগুলোকেই। তবে এককভাবে শুধু দুই সিটি করপোরেশনের ওপর সম্পূর্ণ বিষয়টি চাপিয়ে দিলে হবে না। খালগুলোর দখলদারেরা অনেক শক্তিশালী, নিশ্চিত যে তাঁরা কেউই সেসব খালের দখল স্বেচ্ছায় ছাড়বেন না। দখলমুক্ত করার জন্য জোর প্রশাসনিক প্রচেষ্টা ও আইন প্রয়োগ করা দরকার।
প্রকৃতিতে প্রবহমান নদী আর খালগুলো হলো আমাদের দেহের শিরা-উপশিরার মতো। একটি ভূখণ্ডের জীবনরেখা বলা হয় এসব জলস্রোতকে। প্রবহমান এসব জলাশয় যেমন জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি মাটিসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্যও সহায়ক। ঢাকা শহরের প্রায় দুই কোটি মানুষের স্বাস্থ্যের কথা ভেবেও খালগুলোকে সচল করা দরকার। বর্তমানে ঢাকা শহরে ২৬টি খালের অস্তিত্ব চোখে দেখা গেলেও বাকি ২১টি খাল নেই। কোথায় কোথায় সেসব খাল ছিল, তা নিশ্চয় অতীতের মানচিত্রগুলোতে পাওয়া যাবে। সেগুলো আদৌ উদ্ধার বা দখলমুক্ত করা যাবে, তা দুরাশা। উদ্ধার করা গেলে সেগুলো খনন করে সচল ও শোভাময় করা উচিত। জার্মানির বার্লিন শহরে খালে করে ক্যানালক্রুজ করার সময় খালপাড়ের দুই পাশের বিভিন্ন স্থাপনা ও নাগরিক সৌন্দর্য, সেতু, রেস্তোরাঁ দেখতে দেখতে অভিভূত হতাম। ভাবতাম, জলের দেশ, নদীর দেশ, খালের দেশ বাংলাদেশ; অথচ সে দেশের শহরগুলোর খালে কেন এ রকম নৌ-পর্যটন করা যাবে না?
খালপাড় ভেঙে যাতে কোনো নগরবাসীর এক ফুট জমিও নষ্ট না হয়, সে জন্য ভেনিস, কোপেনহেগেন, প্যারিস ইত্যাদি শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া খাল ও নদীর দুই পাড় যেভাবে পাকা করে বাঁধাই করে রাখা হয়েছে, সেভাবে আমাদের প্রবহমান খালগুলোর পাড়ও বেঁধে দেওয়া যায়। নগরীর খালগুলো নিয়ে একটি চমৎকার পরিকল্পনার সুযোগ রয়েছে ড্যাপ বাস্তবায়নের কারণে। চলাচল, পরিবহন, জলাবদ্ধতা নিরসন, দূষণ হ্রাস, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, পর্যটন, সৌন্দর্যবর্ধন, স্থানীয় মানুষের আয়বর্ধন, পরিবেশ উন্নয়ন ইত্যাদির জন্য এ ধরনের পরিকল্পনা ও জরিপকাজ নিশ্চয় সহায়ক হবে। সবার মনে রাখা উচিত, প্রাকৃতিক প্রবাহকে রুদ্ধ করার অধিকার কারও নেই, তার ফল কখনো ভালো হয় না। এ নিয়ে কোনো খণ্ডিত পরিকল্পনা নয়, নিতে হবে সমন্বিত সামগ্রিক পরিকল্পনা। তাহলে আমরাও দেখতে পাব একটি মনোরম মহানগর, সুশোভিত খালসমৃদ্ধ একটি সুশোভন পরিবেশ। কুড়িল বিশ্বরোডের কাছে নিকুঞ্জ খালটি যদি এত সুন্দর করা যায়, সুন্দর রাখা যায়, তাহলে অন্যগুলো কেন এরূপ সুন্দর হবে না?
মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক
আরও খবর পড়ুন:

মুক্তবুদ্ধির চর্চাটা রয়ে গেল কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ মানুষের মধ্যে। এই ‘শিক্ষিত’ মানুষের বাইরে যে গোটা দেশটা ছিল, সেটা কিন্তু এই আলোয় উদ্ভাসিত হলো না। রাজনীতি থেকে একটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টা খানিক স্পষ্ট হবে। এ দেশে সর্বস্ব ত্যাগ করে যারা রাজনীতি করল, তাদের সিংহভাগই ছিলেন সাম্যবাদী।
২২ অক্টোবর ২০২১
ডা. মুশতাক হোসেন এরশাদবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা, ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য। তিনি কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছেন। পেশাজীবনে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ছিলেন।
১৩ ঘণ্টা আগে
পিরোজপুরের নেছারাবাদে যে ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য ইউএনও সাহেব ধন্যবাদ পেতেই পারেন। সেখানে একটি বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছিলেন তিনি সপরিবারে। কিন্তু যখন জানতে পারলেন, বিয়ের কনে প্রাপ্তবয়স্ক নয়, তখন তিনি না খেয়েই ফিরে আসেন। এবং তিনি ফিরে আসায় কাজিও বিয়ে পড়াননি। ফলে এই বাল্যবিবাহ হয়নি।
১৩ ঘণ্টা আগে
মিরপুরের শিয়ালবাড়ী এলাকায় একটি রাসায়নিক গুদামে আগুন লাগার পর যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল, সে কথা সবাই এখন জানেন। যাঁরা স্বজন হারিয়েছেন, তাঁরা জানেন এটা তাঁদের পরিবারের জন্য কত বড় ক্ষতি। নিহতদের পরিবার ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে কি না, তাদের জীবনে স্থিতি ফিরিয়ে আনতে কী করা দরকার...
১ দিন আগেসম্পাদকীয়

পিরোজপুরের নেছারাবাদে যে ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য ইউএনও সাহেব ধন্যবাদ পেতেই পারেন। সেখানে একটি বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছিলেন তিনি সপরিবারে। কিন্তু যখন জানতে পারলেন, বিয়ের কনে প্রাপ্তবয়স্ক নয়, তখন তিনি না খেয়েই ফিরে আসেন। এবং তিনি ফিরে আসায় কাজিও বিয়ে পড়াননি। ফলে এই বাল্যবিবাহ হয়নি।
বহু প্রচার করার পরও কোথাও কোথাও অপ্রাপ্তবয়স্ক নারী বা পুরুষের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে পরিবারের পক্ষ থেকে। কোথাও কোথাও সচেতনতা তৈরি হচ্ছে, কোথাও কোথাও তৈরি হচ্ছে না। অনেকে ভুলে যাচ্ছেন, কেন অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের বিয়ের পিঁড়িতে না বসানোই মঙ্গল।
বাল্যবিবাহের শিকার অল্প বয়সী মেয়েরা শারীরিক ও মানসিকভাবে বিয়ের জন্য প্রস্তুত থাকে না। এতে মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু, পুষ্টিহীনতা এবং প্রসবজনিত জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কম বয়সে সন্তানের মা হয়ে যাওয়ার কারণে তাদের পক্ষে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে এবং অনেক সময় তারা শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ঝরে পড়ে। সমাজের একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ নষ্ট হয়। আত্মনির্ভরশীল হতে না পারার কারণে সংসারে নানা ধরনের সংকটে তাদের পড়তে হয়। শিক্ষাবঞ্চিত ও অল্প বয়সে সংসার শুরু করা মেয়েরা সাধারণত আর্থিকভাবে নির্ভরশীল থাকে। এতে পরিবারে দারিদ্র্য দূর হয় না, বরং প্রজন্মের পর প্রজন্ম তা চলতে থাকে।
এতে যে নারীর অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, সেটাও বিবেচনায় আনা দরকার। বাল্যবিবাহের কারণে একটি মেয়ে নিজস্ব মতামত-সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এবং স্বাধীন জীবনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারে। সামাজিকভাবে সে হেয় হতে থাকে। সংসারে তার মতামতের কোনো মূল্য থাকে না। পুরুষশাসিত সমাজে এমনিতেই মেয়েরা থাকে কোণঠাসা হয়ে, বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েটি সে ক্ষেত্রে আরও ভঙ্গুর অবস্থায় থাকে। এ যেন তার ব্যাপারে সামাজিক নিপীড়নের জন্য একটি মুক্ত জায়গা হয়ে দেখা দেয়।
একজন মানুষ যেন মুক্ত, স্বাধীন চিন্তার অধিকারী হয়ে বেড়ে উঠতে পারে, সমাজে অর্থনৈতিক অবদান রাখার মতো করে নিজেকে তৈরি করে নিতে পারে, সেসব দিক বিবেচনা করা না হলে সংকটে পড়ে রাষ্ট্র।
পিরোজপুরের নেছারাবাদের ঘটনাটি আশার আলো জাগায়। যদিও ইউএনও বিয়ের অনুষ্ঠানে বাধা দেননি, তবু তিনি সেখানে অংশ না নিয়ে প্রতিবাদস্বরূপ চলে যাওয়ায় বিয়েটা হয়নি বলে একটি ভালো কাজ হয়েছে। যখন সমাজের একটি বড় অংশ অল্প বয়সে বিবাহ ও মাতৃত্বে জড়িয়ে পড়ে, তখন তারা কর্মক্ষম নাগরিক হিসেবে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে না। ফলে জাতির অগ্রগতিতেও বাধা সৃষ্টি হয়। অপ্রাপ্তবয়স্ক যে মেয়েটি অভিভাবকদের কারণে বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছিল, এখন হয়তোবা সে তা থেকে মুক্ত হবে। অভিভাবকেরাও সচেতন হয়ে এই শিশুকে শারীরিক, মানসিক, শিক্ষাগত ও সামাজিক সুরক্ষা দিতে পারেন। তাতে একটি সমৃদ্ধ ও সমানাধিকারের সমাজ গঠিত হওয়ার পথে তাঁরা অবদান রাখতে পারেন।
আরও খবর পড়ুন:

পিরোজপুরের নেছারাবাদে যে ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য ইউএনও সাহেব ধন্যবাদ পেতেই পারেন। সেখানে একটি বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছিলেন তিনি সপরিবারে। কিন্তু যখন জানতে পারলেন, বিয়ের কনে প্রাপ্তবয়স্ক নয়, তখন তিনি না খেয়েই ফিরে আসেন। এবং তিনি ফিরে আসায় কাজিও বিয়ে পড়াননি। ফলে এই বাল্যবিবাহ হয়নি।
বহু প্রচার করার পরও কোথাও কোথাও অপ্রাপ্তবয়স্ক নারী বা পুরুষের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে পরিবারের পক্ষ থেকে। কোথাও কোথাও সচেতনতা তৈরি হচ্ছে, কোথাও কোথাও তৈরি হচ্ছে না। অনেকে ভুলে যাচ্ছেন, কেন অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের বিয়ের পিঁড়িতে না বসানোই মঙ্গল।
বাল্যবিবাহের শিকার অল্প বয়সী মেয়েরা শারীরিক ও মানসিকভাবে বিয়ের জন্য প্রস্তুত থাকে না। এতে মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু, পুষ্টিহীনতা এবং প্রসবজনিত জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কম বয়সে সন্তানের মা হয়ে যাওয়ার কারণে তাদের পক্ষে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে এবং অনেক সময় তারা শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ঝরে পড়ে। সমাজের একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ নষ্ট হয়। আত্মনির্ভরশীল হতে না পারার কারণে সংসারে নানা ধরনের সংকটে তাদের পড়তে হয়। শিক্ষাবঞ্চিত ও অল্প বয়সে সংসার শুরু করা মেয়েরা সাধারণত আর্থিকভাবে নির্ভরশীল থাকে। এতে পরিবারে দারিদ্র্য দূর হয় না, বরং প্রজন্মের পর প্রজন্ম তা চলতে থাকে।
এতে যে নারীর অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, সেটাও বিবেচনায় আনা দরকার। বাল্যবিবাহের কারণে একটি মেয়ে নিজস্ব মতামত-সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এবং স্বাধীন জীবনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারে। সামাজিকভাবে সে হেয় হতে থাকে। সংসারে তার মতামতের কোনো মূল্য থাকে না। পুরুষশাসিত সমাজে এমনিতেই মেয়েরা থাকে কোণঠাসা হয়ে, বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েটি সে ক্ষেত্রে আরও ভঙ্গুর অবস্থায় থাকে। এ যেন তার ব্যাপারে সামাজিক নিপীড়নের জন্য একটি মুক্ত জায়গা হয়ে দেখা দেয়।
একজন মানুষ যেন মুক্ত, স্বাধীন চিন্তার অধিকারী হয়ে বেড়ে উঠতে পারে, সমাজে অর্থনৈতিক অবদান রাখার মতো করে নিজেকে তৈরি করে নিতে পারে, সেসব দিক বিবেচনা করা না হলে সংকটে পড়ে রাষ্ট্র।
পিরোজপুরের নেছারাবাদের ঘটনাটি আশার আলো জাগায়। যদিও ইউএনও বিয়ের অনুষ্ঠানে বাধা দেননি, তবু তিনি সেখানে অংশ না নিয়ে প্রতিবাদস্বরূপ চলে যাওয়ায় বিয়েটা হয়নি বলে একটি ভালো কাজ হয়েছে। যখন সমাজের একটি বড় অংশ অল্প বয়সে বিবাহ ও মাতৃত্বে জড়িয়ে পড়ে, তখন তারা কর্মক্ষম নাগরিক হিসেবে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে না। ফলে জাতির অগ্রগতিতেও বাধা সৃষ্টি হয়। অপ্রাপ্তবয়স্ক যে মেয়েটি অভিভাবকদের কারণে বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছিল, এখন হয়তোবা সে তা থেকে মুক্ত হবে। অভিভাবকেরাও সচেতন হয়ে এই শিশুকে শারীরিক, মানসিক, শিক্ষাগত ও সামাজিক সুরক্ষা দিতে পারেন। তাতে একটি সমৃদ্ধ ও সমানাধিকারের সমাজ গঠিত হওয়ার পথে তাঁরা অবদান রাখতে পারেন।
আরও খবর পড়ুন:

মুক্তবুদ্ধির চর্চাটা রয়ে গেল কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ মানুষের মধ্যে। এই ‘শিক্ষিত’ মানুষের বাইরে যে গোটা দেশটা ছিল, সেটা কিন্তু এই আলোয় উদ্ভাসিত হলো না। রাজনীতি থেকে একটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টা খানিক স্পষ্ট হবে। এ দেশে সর্বস্ব ত্যাগ করে যারা রাজনীতি করল, তাদের সিংহভাগই ছিলেন সাম্যবাদী।
২২ অক্টোবর ২০২১
ডা. মুশতাক হোসেন এরশাদবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা, ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য। তিনি কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছেন। পেশাজীবনে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ছিলেন।
১৩ ঘণ্টা আগে
কুড়িল বিশ্বরোডের ফুটওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে একটি খালের চমৎকার শোভা দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। ঢাকার বুকে এত সুন্দর একটা খাল! ধনুকের মতো বাঁক খেয়ে চলে গেছে দূরে, দুই পাড়ে হাঁটার রাস্তা। রাস্তা আর খালের পানির মাঝে সবুজ ঢাল সিঙ্গাপুর ডেইজির শায়িত লতায় আচ্ছাদিত।
১৩ ঘণ্টা আগে
মিরপুরের শিয়ালবাড়ী এলাকায় একটি রাসায়নিক গুদামে আগুন লাগার পর যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল, সে কথা সবাই এখন জানেন। যাঁরা স্বজন হারিয়েছেন, তাঁরা জানেন এটা তাঁদের পরিবারের জন্য কত বড় ক্ষতি। নিহতদের পরিবার ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে কি না, তাদের জীবনে স্থিতি ফিরিয়ে আনতে কী করা দরকার...
১ দিন আগেসম্পাদকীয়

মিরপুরের শিয়ালবাড়ী এলাকায় একটি রাসায়নিক গুদামে আগুন লাগার পর যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল, সে কথা সবাই এখন জানেন। যাঁরা স্বজন হারিয়েছেন, তাঁরা জানেন এটা তাঁদের পরিবারের জন্য কত বড় ক্ষতি। নিহতদের পরিবার ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে কি না, তাদের জীবনে স্থিতি ফিরিয়ে আনতে কী করা দরকার—তা নিয়ে সংশ্লিষ্টরা নিশ্চয়ই ভাববেন। এ রকম একটা অবস্থায় দুর্ঘটনা-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে খুব কম মানুষই মাথা ঘামায়। দুর্ঘটনা-পরবর্তী সময়টিতে স্থানীয় পরিবেশ ও পরিস্থিতি যে মোটেও অনুকূল থাকে না, সেটা বোঝা দরকার।
সম্প্রতি আমাদের প্রতিবেদক শিয়ালবাড়ীর ক্ষতিগ্রস্ত রাসায়নিক গুদামে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে তিনি দেখেছেন, এতগুলো দিন পার হওয়ার পরও বিষাক্ত রাসায়নিকের কারণে এখনো অসুস্থ হচ্ছে মানুষ। রাসায়নিকের ড্রাম থেকে নির্গত বিষাক্ত গ্যাস ও ধোঁয়া মানুষকে অসুস্থ করে দিচ্ছে। অসুস্থদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধরা রয়েছেন ঝুঁকির মধ্যে। প্রায়ই দেখা যায়, একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর দু-এক দিন সংবাদপত্রে রিপোর্ট হয়, তারপর একসময় সেটা ভুলে যায় মানুষ। কিন্তু যে মানুষেরা ভুক্তভোগী, তাদের প্রতিটি দিনই যে কাটছে ভয়ংকর রাসায়নিকের সঙ্গে লড়াই করে, সে খবর কয়জন রাখে?
চিকিৎসকেরা বলেছেন, অগ্নিকাণ্ডের কয়েক দিন পরও বিষাক্ত গ্যাস ও ধোঁয়ার ঘনত্ব বেশি থাকে। পরে ধীরে ধীরে তা কমে যায়। মাটিতে পড়ে থাকা রাসায়নিক দ্রব্যের অবশিষ্টাংশ ভুক্তভোগীর শরীরে ঢোকে। ঘন ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ার কারণে বাতাসে ভাসমান ক্ষুদ্র ধূলিকণা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে যায়। এই কারণে ভবিষ্যতেও তা বিপদ সৃষ্টি করতে পারে।
বিষাক্ত কণিকা বা গ্যাস মানবদেহে ঢোকে শ্বাসের মাধ্যমে, ত্বকের মাধ্যমে এবং খাদ্যের মাধ্যমে। এই গ্যাস অ্যাজমা, কাশি, গলাজ্বলা বা শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। চোখ আর ত্বকও তাতে আক্রান্ত হতে পারে। তৈরি হতে পারে মাথাব্যথা, বমি ও ক্লান্তির মতো ঘটনা। ভারী ধাতু দীর্ঘ মেয়াদে স্নায়ুতন্ত্র দুর্বল করে দেয়। তাতে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে।
শিয়ালবাড়ীর দুর্ঘটনাস্থলের অন্তত এক হাজার গজ পর্যন্ত এলাকায় বাতাসে এখনো পোড়া জিনিস ও গ্যাসের মতো কটু গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তাতে মনে হয়, এই এলাকার মানুষের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি এখনো রয়েছে সংকটের মুখে।
আমরা সবাই জানি, স্বাস্থ্য আমাদের মৌলিক অধিকারের একটি। কিন্তু দেশের মানুষ এ কথাও জানে, সেই মৌলিক অধিকার সব সময় সমুন্নত রাখা হয় না। রাসায়নিক গুদামে অগ্নিকাণ্ড ঘটলে কীভাবে তার মোকাবিলা করতে হবে, তার পূর্বপ্রস্তুতি কয়টি গুদামে আছে? এসব জায়গায় কি নিয়মিত ইন্সপেকশন হয়? শুধু গুদাম কেন, কারখানাগুলোয় কি সঠিক নিরাপত্তাব্যবস্থা রয়েছে? শ্রমিকেরা কি নিরাপদে তাঁদের কাজ করে যেতে পারেন?
এসব দুর্ঘটনায় মূলত সমাজের নিচুতলার মানুষেরা বিপদে পড়েন। তাঁদের পাশে যদি দাঁড়ানো না হয়, তাহলে বুঝতে হবে, শিল্প-ব্যবস্থাপনায় যে ঘাটতি আছে, তা নিরসনের কোনো চিন্তা কারও নেই।

মিরপুরের শিয়ালবাড়ী এলাকায় একটি রাসায়নিক গুদামে আগুন লাগার পর যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল, সে কথা সবাই এখন জানেন। যাঁরা স্বজন হারিয়েছেন, তাঁরা জানেন এটা তাঁদের পরিবারের জন্য কত বড় ক্ষতি। নিহতদের পরিবার ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে কি না, তাদের জীবনে স্থিতি ফিরিয়ে আনতে কী করা দরকার—তা নিয়ে সংশ্লিষ্টরা নিশ্চয়ই ভাববেন। এ রকম একটা অবস্থায় দুর্ঘটনা-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে খুব কম মানুষই মাথা ঘামায়। দুর্ঘটনা-পরবর্তী সময়টিতে স্থানীয় পরিবেশ ও পরিস্থিতি যে মোটেও অনুকূল থাকে না, সেটা বোঝা দরকার।
সম্প্রতি আমাদের প্রতিবেদক শিয়ালবাড়ীর ক্ষতিগ্রস্ত রাসায়নিক গুদামে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে তিনি দেখেছেন, এতগুলো দিন পার হওয়ার পরও বিষাক্ত রাসায়নিকের কারণে এখনো অসুস্থ হচ্ছে মানুষ। রাসায়নিকের ড্রাম থেকে নির্গত বিষাক্ত গ্যাস ও ধোঁয়া মানুষকে অসুস্থ করে দিচ্ছে। অসুস্থদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধরা রয়েছেন ঝুঁকির মধ্যে। প্রায়ই দেখা যায়, একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর দু-এক দিন সংবাদপত্রে রিপোর্ট হয়, তারপর একসময় সেটা ভুলে যায় মানুষ। কিন্তু যে মানুষেরা ভুক্তভোগী, তাদের প্রতিটি দিনই যে কাটছে ভয়ংকর রাসায়নিকের সঙ্গে লড়াই করে, সে খবর কয়জন রাখে?
চিকিৎসকেরা বলেছেন, অগ্নিকাণ্ডের কয়েক দিন পরও বিষাক্ত গ্যাস ও ধোঁয়ার ঘনত্ব বেশি থাকে। পরে ধীরে ধীরে তা কমে যায়। মাটিতে পড়ে থাকা রাসায়নিক দ্রব্যের অবশিষ্টাংশ ভুক্তভোগীর শরীরে ঢোকে। ঘন ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ার কারণে বাতাসে ভাসমান ক্ষুদ্র ধূলিকণা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে যায়। এই কারণে ভবিষ্যতেও তা বিপদ সৃষ্টি করতে পারে।
বিষাক্ত কণিকা বা গ্যাস মানবদেহে ঢোকে শ্বাসের মাধ্যমে, ত্বকের মাধ্যমে এবং খাদ্যের মাধ্যমে। এই গ্যাস অ্যাজমা, কাশি, গলাজ্বলা বা শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। চোখ আর ত্বকও তাতে আক্রান্ত হতে পারে। তৈরি হতে পারে মাথাব্যথা, বমি ও ক্লান্তির মতো ঘটনা। ভারী ধাতু দীর্ঘ মেয়াদে স্নায়ুতন্ত্র দুর্বল করে দেয়। তাতে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে।
শিয়ালবাড়ীর দুর্ঘটনাস্থলের অন্তত এক হাজার গজ পর্যন্ত এলাকায় বাতাসে এখনো পোড়া জিনিস ও গ্যাসের মতো কটু গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তাতে মনে হয়, এই এলাকার মানুষের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি এখনো রয়েছে সংকটের মুখে।
আমরা সবাই জানি, স্বাস্থ্য আমাদের মৌলিক অধিকারের একটি। কিন্তু দেশের মানুষ এ কথাও জানে, সেই মৌলিক অধিকার সব সময় সমুন্নত রাখা হয় না। রাসায়নিক গুদামে অগ্নিকাণ্ড ঘটলে কীভাবে তার মোকাবিলা করতে হবে, তার পূর্বপ্রস্তুতি কয়টি গুদামে আছে? এসব জায়গায় কি নিয়মিত ইন্সপেকশন হয়? শুধু গুদাম কেন, কারখানাগুলোয় কি সঠিক নিরাপত্তাব্যবস্থা রয়েছে? শ্রমিকেরা কি নিরাপদে তাঁদের কাজ করে যেতে পারেন?
এসব দুর্ঘটনায় মূলত সমাজের নিচুতলার মানুষেরা বিপদে পড়েন। তাঁদের পাশে যদি দাঁড়ানো না হয়, তাহলে বুঝতে হবে, শিল্প-ব্যবস্থাপনায় যে ঘাটতি আছে, তা নিরসনের কোনো চিন্তা কারও নেই।

মুক্তবুদ্ধির চর্চাটা রয়ে গেল কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ মানুষের মধ্যে। এই ‘শিক্ষিত’ মানুষের বাইরে যে গোটা দেশটা ছিল, সেটা কিন্তু এই আলোয় উদ্ভাসিত হলো না। রাজনীতি থেকে একটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টা খানিক স্পষ্ট হবে। এ দেশে সর্বস্ব ত্যাগ করে যারা রাজনীতি করল, তাদের সিংহভাগই ছিলেন সাম্যবাদী।
২২ অক্টোবর ২০২১
ডা. মুশতাক হোসেন এরশাদবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা, ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য। তিনি কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছেন। পেশাজীবনে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ছিলেন।
১৩ ঘণ্টা আগে
কুড়িল বিশ্বরোডের ফুটওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে একটি খালের চমৎকার শোভা দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। ঢাকার বুকে এত সুন্দর একটা খাল! ধনুকের মতো বাঁক খেয়ে চলে গেছে দূরে, দুই পাড়ে হাঁটার রাস্তা। রাস্তা আর খালের পানির মাঝে সবুজ ঢাল সিঙ্গাপুর ডেইজির শায়িত লতায় আচ্ছাদিত।
১৩ ঘণ্টা আগে
পিরোজপুরের নেছারাবাদে যে ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য ইউএনও সাহেব ধন্যবাদ পেতেই পারেন। সেখানে একটি বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছিলেন তিনি সপরিবারে। কিন্তু যখন জানতে পারলেন, বিয়ের কনে প্রাপ্তবয়স্ক নয়, তখন তিনি না খেয়েই ফিরে আসেন। এবং তিনি ফিরে আসায় কাজিও বিয়ে পড়াননি। ফলে এই বাল্যবিবাহ হয়নি।
১৩ ঘণ্টা আগে