মাসুমা হক প্রিয়াংকা
ধর্ষণের পর মাগুরার আট বছরের শিশুটির মৃত্যু আমাদের বিবেককে কতটুকু নাড়া দিল? তার ক্ষতবিক্ষত দেহ, শ্বাসরুদ্ধকর কান্না, মায়ের আর্তচিৎকার কি আমাদের চোখের ঠুলি খুলে দিতে পারল? এবারও কি আমরা চুপ করে থাকব, যেমন থাকি প্রতিবার? কয়েক দিনের জন্য ক্ষোভ দেখিয়ে আবার চুপ থাকা আমাদের স্বভাববৈশিষ্ট্য। এই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে অন্ধত্ব, তার কাছে শিশুটির কান্না হয়তো পরাজিতই হবে।
আমাদের চেনা সমাজ! যেখানে ধর্ষক বেঁচে থাকে, আর ভুক্তভোগীকে মরতে হয়! যেখানে নারী ধর্ষণের শিকার হলে প্রশ্ন ওঠে তার পোশাক নিয়ে, তার চলাফেরা নিয়ে, এমনকি তার পরিবার নিয়ে। অথচ ধর্ষকের পরিচয় কোনো দিন মুখ্য হয় না। সমাজ বরং তাকে রক্ষা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমরা একবারও ভাবি না, এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাই একের পর এক ধর্ষক তৈরি করছে। যেখানে নারীকে মানুষ নয়, বরং এক টুকরা মাংসপিণ্ড হিসেবে দেখা হয়। যেখানে এক শিশুর কান্নার চেয়ে বড় হয়ে ওঠে পরিবারের ‘সম্মান’ নামের মিথ্যে অহংকার!
আমাদের শিখিয়ে দেওয়া হয়, নারী ধর্ষণের শিকার হলে তার সম্মানহানি হয়, পুরুষের নয়। কী ভীষণ ভ্রান্ত এক চিন্তা! ধর্ষণের দায় ধর্ষকের, অথচ আমরা বোঝাতে চাই, লজ্জা ধর্ষণের শিকার মেয়েটি! আমরা চুপ করে থাকি, কারণ আমরা জানি, বিচার চাইতে গেলে আরও অপমান, লাঞ্ছনা ও বিড়ম্বনার শিকার হতে হবে। পুলিশের হয়রানি, আদালতে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হওয়া, আর বিচারহীনতার হতাশা—এত কিছুর ভেতর দিয়ে গিয়ে শেষমেশ বিচার পাওয়া তো দূরের কথা, নিজের বেঁচে থাকাটাই দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।
আমাদের বিচারব্যবস্থা কী করছে? ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত কয়জন ধর্ষকের এই সর্বোচ্চ শাস্তি হয়েছে? শাস্তি হয় না বলেই ধর্ষণের খবর আমরা অব্যাহতভাবে পত্রিকার পাতায় দেখতে পাই। যেন এই গল্পের শেষ নেই।
আমরা কি বুঝতে পারছি, কোথায় সমস্যা?
সমস্যা আমাদের পরিবারে, যেখানে শিশুদের শেখানো হয়, ‘এসব কথা বলা যায় না’। সমস্যাটা আমাদের স্কুলে, যেখানে যৌনশিক্ষা নিয়ে আলোচনা করাকে ‘অশ্লীলতা’ মনে করা হয়। সমস্যাটা আমাদের ধর্মীয় এবং সামাজিক রীতিতে, যেখানে পুরুষের বিকৃতি ঢেকে দেওয়া হয়, কিন্তু নারীর জীবনে অভিশাপ হয়ে থাকে সেই ঘটনা।
একটি শিশুর নিরাপত্তা তার নিজের পরিবার নিশ্চিত করতে পারে না—এর চেয়ে ভয়ংকর আর কী হতে পারে? বাবা-মায়েরা কি কখনো ভেবে দেখেছেন, তাঁদের সন্তানের সবচেয়ে বড় শত্রু বাইরের কেউ নয়, বরং সেই পরিচিত মুখ, যার কাছে আপনি চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস রাখেন। বিকৃত যৌন লালসার শিকার বেশির ভাগ শিশু কোনো অজানা অপরাধীর দ্বারা আক্রান্ত হয় না। এরা হয় কেউ মামা, কেউ চাচা, কেউ শিক্ষক, কেউ প্রতিবেশী। তবু আমরা ভাবি, এসব নিয়ে কথা বলা যায় না। কারণ এতে পরিবারের ‘সম্মান’ জড়িয়ে আছে!
কিন্তু পরিবার কিসের সম্মান বাঁচায়? ধর্ষককে রক্ষা করে? শিশুটির কান্না চেপে রেখে? তাহলে আমরা কি ধর্ষকদের জন্য নিরাপদ এক আশ্রয় তৈরি করছি না?
এই সমাজ বদলাতে হলে সবচেয়ে আগে দরকার বাবা-মায়ের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। সন্তানের সঙ্গে কথা বলুন। তাকে বোঝান, তার শরীর শুধু তারই, অন্য কারও অধিকার নেই সেটাতে হাত দেওয়ার। শরীরে গুড টাচ ও ব্যাট টাচের ধারণা শিশুদের দিতে হবে বাবা-মাকেই। শেখাতে হবে, যদি কখনো এমন কিছু ঘটে, তাহলে সেটা গোপন না করে বাবা-মাকে তৎক্ষণাৎ বলে দিতে হবে।
আমাদের সন্তানদের জানাতে হবে, ধর্ষকের পরিচয় একটাই—সে অপরাধী। আমাদের বলতে হবে, ধর্ষণ কোনো নারীর লজ্জা নয়, এটা ধর্ষকের ঘৃণ্য অপরাধ।
আমরা যত দিন পর্যন্ত এই সমাজকে শিশু ও নারীবান্ধব করে তুলতে না পারব, তত দিন আমাদের কণ্ঠরোধ করা ছোট ছোট নিষ্পাপ প্রাণের আর্তনাদ শুনতেই থাকতে হবে। আজ যদি না জাগি, তাহলে আগামীকাল আর্তনাদের সংখ্যা আরও বাড়বে। আমরা কি আরেকটা শিশুর মৃত্যু চাই? নাকি নিজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে সচেষ্ট হব?
লেখক: সমাজকর্মী ও গবেষক
ধর্ষণের পর মাগুরার আট বছরের শিশুটির মৃত্যু আমাদের বিবেককে কতটুকু নাড়া দিল? তার ক্ষতবিক্ষত দেহ, শ্বাসরুদ্ধকর কান্না, মায়ের আর্তচিৎকার কি আমাদের চোখের ঠুলি খুলে দিতে পারল? এবারও কি আমরা চুপ করে থাকব, যেমন থাকি প্রতিবার? কয়েক দিনের জন্য ক্ষোভ দেখিয়ে আবার চুপ থাকা আমাদের স্বভাববৈশিষ্ট্য। এই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে অন্ধত্ব, তার কাছে শিশুটির কান্না হয়তো পরাজিতই হবে।
আমাদের চেনা সমাজ! যেখানে ধর্ষক বেঁচে থাকে, আর ভুক্তভোগীকে মরতে হয়! যেখানে নারী ধর্ষণের শিকার হলে প্রশ্ন ওঠে তার পোশাক নিয়ে, তার চলাফেরা নিয়ে, এমনকি তার পরিবার নিয়ে। অথচ ধর্ষকের পরিচয় কোনো দিন মুখ্য হয় না। সমাজ বরং তাকে রক্ষা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমরা একবারও ভাবি না, এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাই একের পর এক ধর্ষক তৈরি করছে। যেখানে নারীকে মানুষ নয়, বরং এক টুকরা মাংসপিণ্ড হিসেবে দেখা হয়। যেখানে এক শিশুর কান্নার চেয়ে বড় হয়ে ওঠে পরিবারের ‘সম্মান’ নামের মিথ্যে অহংকার!
আমাদের শিখিয়ে দেওয়া হয়, নারী ধর্ষণের শিকার হলে তার সম্মানহানি হয়, পুরুষের নয়। কী ভীষণ ভ্রান্ত এক চিন্তা! ধর্ষণের দায় ধর্ষকের, অথচ আমরা বোঝাতে চাই, লজ্জা ধর্ষণের শিকার মেয়েটি! আমরা চুপ করে থাকি, কারণ আমরা জানি, বিচার চাইতে গেলে আরও অপমান, লাঞ্ছনা ও বিড়ম্বনার শিকার হতে হবে। পুলিশের হয়রানি, আদালতে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হওয়া, আর বিচারহীনতার হতাশা—এত কিছুর ভেতর দিয়ে গিয়ে শেষমেশ বিচার পাওয়া তো দূরের কথা, নিজের বেঁচে থাকাটাই দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।
আমাদের বিচারব্যবস্থা কী করছে? ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত কয়জন ধর্ষকের এই সর্বোচ্চ শাস্তি হয়েছে? শাস্তি হয় না বলেই ধর্ষণের খবর আমরা অব্যাহতভাবে পত্রিকার পাতায় দেখতে পাই। যেন এই গল্পের শেষ নেই।
আমরা কি বুঝতে পারছি, কোথায় সমস্যা?
সমস্যা আমাদের পরিবারে, যেখানে শিশুদের শেখানো হয়, ‘এসব কথা বলা যায় না’। সমস্যাটা আমাদের স্কুলে, যেখানে যৌনশিক্ষা নিয়ে আলোচনা করাকে ‘অশ্লীলতা’ মনে করা হয়। সমস্যাটা আমাদের ধর্মীয় এবং সামাজিক রীতিতে, যেখানে পুরুষের বিকৃতি ঢেকে দেওয়া হয়, কিন্তু নারীর জীবনে অভিশাপ হয়ে থাকে সেই ঘটনা।
একটি শিশুর নিরাপত্তা তার নিজের পরিবার নিশ্চিত করতে পারে না—এর চেয়ে ভয়ংকর আর কী হতে পারে? বাবা-মায়েরা কি কখনো ভেবে দেখেছেন, তাঁদের সন্তানের সবচেয়ে বড় শত্রু বাইরের কেউ নয়, বরং সেই পরিচিত মুখ, যার কাছে আপনি চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস রাখেন। বিকৃত যৌন লালসার শিকার বেশির ভাগ শিশু কোনো অজানা অপরাধীর দ্বারা আক্রান্ত হয় না। এরা হয় কেউ মামা, কেউ চাচা, কেউ শিক্ষক, কেউ প্রতিবেশী। তবু আমরা ভাবি, এসব নিয়ে কথা বলা যায় না। কারণ এতে পরিবারের ‘সম্মান’ জড়িয়ে আছে!
কিন্তু পরিবার কিসের সম্মান বাঁচায়? ধর্ষককে রক্ষা করে? শিশুটির কান্না চেপে রেখে? তাহলে আমরা কি ধর্ষকদের জন্য নিরাপদ এক আশ্রয় তৈরি করছি না?
এই সমাজ বদলাতে হলে সবচেয়ে আগে দরকার বাবা-মায়ের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। সন্তানের সঙ্গে কথা বলুন। তাকে বোঝান, তার শরীর শুধু তারই, অন্য কারও অধিকার নেই সেটাতে হাত দেওয়ার। শরীরে গুড টাচ ও ব্যাট টাচের ধারণা শিশুদের দিতে হবে বাবা-মাকেই। শেখাতে হবে, যদি কখনো এমন কিছু ঘটে, তাহলে সেটা গোপন না করে বাবা-মাকে তৎক্ষণাৎ বলে দিতে হবে।
আমাদের সন্তানদের জানাতে হবে, ধর্ষকের পরিচয় একটাই—সে অপরাধী। আমাদের বলতে হবে, ধর্ষণ কোনো নারীর লজ্জা নয়, এটা ধর্ষকের ঘৃণ্য অপরাধ।
আমরা যত দিন পর্যন্ত এই সমাজকে শিশু ও নারীবান্ধব করে তুলতে না পারব, তত দিন আমাদের কণ্ঠরোধ করা ছোট ছোট নিষ্পাপ প্রাণের আর্তনাদ শুনতেই থাকতে হবে। আজ যদি না জাগি, তাহলে আগামীকাল আর্তনাদের সংখ্যা আরও বাড়বে। আমরা কি আরেকটা শিশুর মৃত্যু চাই? নাকি নিজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে সচেষ্ট হব?
লেখক: সমাজকর্মী ও গবেষক
আমার এই লেখা যেদিন ছাপা হবে, সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা বৈঠকে বসেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
৫ ঘণ্টা আগেকয়েক দিন আগে সন্ধ্যায় মোহাম্মদপুর বাজারে গিয়েছি কিছু সবজি কেনার জন্য, তখন পেলাম তার ফোন।
৬ ঘণ্টা আগেএকটি দেশ তখনই প্রকৃত উন্নয়নের পথে এগোয়, যখন অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির সুফল সমাজের সব স্তরে সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু বাংলাদেশে যে প্রবৃদ্ধি বা অর্থনৈতিক পরিবর্তন ঘটছে, তার বাস্তব চিত্র ভিন্ন। আজকের পত্রিকায় ১৪ মার্চ প্রকাশিত খবর থেকে জানা যাচ্ছে, মাত্র তিন মাসে ব্যাংক হিসাবধারী কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে...
৬ ঘণ্টা আগেড. রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তাঁর গবেষণার বিষয় ঢাকা শহরের ‘হিজড়া’ সম্প্রদায়। লিঙ্গবৈচিত্র্যসহ সামাজিক নৃবিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে দেশে-বিদেশের গবেষণা পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
১ দিন আগে