Ajker Patrika
সাক্ষাৎকার

আতঙ্কিত না হয়ে দরকার বাস্তবতা উপলব্ধি করা: মারুফুর রহমান

ডা. মারুফুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

ডা. মারুফুর রহমান ২০১২ সালে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সেন্টার ফর মেডিকেল বায়োটেকনোলজিতে ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। করোনার প্রথম সময় থেকেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ কাজের পাশাপাশি, এই বিষয়ে ডাক্তারদের প্রশিক্ষণ ও জনসচেতনতা তৈরিতে লেখালেখি চালিয়ে গেছেন। বর্তমানে তিনি ডক্টরাল রিসার্চার হিসেবে ইউনিভার্সিটি অব শেফিল্ড, যুক্তরাজ্যে কর্মরত আছেন। করোনার নতুন আক্রমণ নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার বিভুরঞ্জন সরকার

আপডেট : ১৫ জুন ২০২৫, ১৫: ২০

আজকের পত্রিকা: সাম্প্রতিক সময়ে ‘করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট’ নিয়ে বেশ উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। আপনি কি আমাদের স্পষ্ট করে বলবেন নতুন ভ্যারিয়েন্টটি কী এবং এটি কতটা ভয়ানক?

মারুফুর রহমান: করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট আসা স্বাভাবিক ঘটনা যা ভাইরাসটির মিউটেশনের কারণে নিয়মিত হতে থাকে। বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সবশেষ তথ্য অনুযায়ী LF.7, XFG, XEC, JN.1, এবং N. B.1. 8.1 ভ্যারিয়েন্টগুলো ছড়াচ্ছে যা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, আইসিডিডিআর, বিও নিশ্চিত করেছে। WHO এই ভ্যারিয়েন্টগুলোকে ‘Variant Under Monitoring’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। স্বাস্থ্যঝুঁকি অনুসারে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এগুলোকে কম ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবেই চিহ্নিত করেছে। এখন পর্যন্ত এগুলোকে ‘ভয়াবহ’ বলা যাচ্ছে না, তবে স্বাস্থ্য খাতের সতর্ক দৃষ্টি জরুরি।

আজকের পত্রিকা: এর উপসর্গ কি আলাদা? আগের ভ্যারিয়েন্টগুলোর সঙ্গে এর পার্থক্য কী?

মারুফুর রহমান: ভ্যারিয়েন্ট পরিবর্তনের সঙ্গে উপসর্গের খুব বেশি পরিবর্তনের সরাসরি প্রমাণ পাওয়া যায়নি। উপসর্গগুলো আগের মতোই, যেমন বিভিন্ন মাত্রার জ্বর, শুকনা কাশি, গলা ব্যথা, শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা, দুর্বলতা, কিছু ক্ষেত্রে স্বাদ ও গন্ধের পরিবর্তন। তবে আগের মতোই ব্যক্তিভেদে লক্ষণ ভিন্নতা প্রকাশ পেতে পারে বিশেষ করে শিশু, গর্ভবতী নারী, বৃদ্ধ, ডায়াবেটিস বা হৃদরোগের মতো দীর্ঘমেয়াদি রোগাক্রান্ত ব্যক্তিবর্গে লক্ষণগুলো তীব্র হতে পারে। তবে এই ভ্যারিয়েন্টগুলোর সংক্রমণ তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে কম তীব্রতার ও ক্ষণস্থায়ী উপসর্গগুলো বেশি দেখা যেতে পারে যা অনেকে বুঝতেই পারেন না তাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন। এতে সমস্যা হয় দুইভাবে—একদিকে অসচেতনতা বাড়ে, অন্যদিকে সংক্রমণ ছড়ায় নীরবে।

আজকের পত্রিকা: এই ভ্যারিয়েন্ট কি আবার গণসংক্রমণের আশঙ্কা তৈরি করতে পারে?

মারুফুর রহমান: গণসংক্রমণ তো আমরা আক্ষরিক অর্থে পার করে এসেছি। তবে নতুন ভ্যারিয়েন্ট যদি বেশি সংক্রামক হয় এবং জনসাধারণ যদি উদাসীন থাকে—তাহলে এটা পুনরায় বড় ঢেউ তৈরি করতে পারে। তবে আশার কথা হলো, অধিকাংশ মানুষের শরীরে এখন কিছু না কিছু অনাক্রম্যতা (immunity) তৈরি হয়েছে, হয় টিকার মাধ্যমে, নয়তো পূর্ববর্তী সংক্রমণের ফলে। ফলে আগের মতো হাসপাতালে ভর্তির হার বা মৃত্যুহার এতটা বাড়ার আশঙ্কা কম।

আজকের পত্রিকা: অনেকেই বলছেন, নতুন ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ হার বেশি, কিন্তু মৃত্যুহার কম। এটা কতটা সত্য?

মারুফুর রহমান: এটা অনেকাংশে সত্য। বর্তমান পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, এই সময়ের সাবভ্যারিয়েন্টগুলোর সংক্রমণ খুব দ্রুত হয়, কিন্তু গুরুতর অসুস্থতা তুলনামূলকভাবে কম, অতীতের প্যান্ডেমিক বা প্রি-প্যান্ডেমিক সময়ের ভ্যারিয়েন্টগুলোর তুলনায়। তবে যাঁরা বয়স্ক, যাঁদের শরীরে নানা জটিলতা রয়েছে, তাঁদের জন্য এটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। অর্থাৎ মৃত্যুহার গড়পড়তা কম, কিন্তু কিছু শ্রেণির মানুষদের জন্য এখনো এটি প্রাণঘাতী হতে পারে।

আজকের পত্রিকা: ভ্যাকসিন কি এখনো কার্যকর? নাকি নতুন ভ্যারিয়েন্টে ভ্যাকসিনও দুর্বল হয়ে পড়েছে?

মারুফুর রহমান: ভ্যাকসিন শতভাগ সুরক্ষা দেয় না—এটা আমরা শুরু থেকেই জানি। তবে এটা গুরুতর অসুস্থতা ও মৃত্যু অনেকাংশে রোধ করতে পারে। নতুন ভ্যারিয়েন্টে দেখা গেছে, আগের ভ্যাকসিনগুলো কিছুটা কম কার্যকর হতে পারে সংক্রমণ ঠেকাতে, কিন্তু মৃত্যুর হার কম রাখার দিক থেকে এখনো কার্যকর। ভ্যাকসিনের ক্রস প্রটেকশনের কারণে নতুন ভ্যারিয়েন্টগুলোর বিরুদ্ধেও যথেষ্ট সুরক্ষা পাওয়া যাবে। mRNA-ভিত্তিক নতুন আপডেটেড ভ্যাকসিন ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে দেওয়া হচ্ছে, যা নতুন ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধেও কার্যকর বলে প্রাথমিক তথ্য বলছে।

আজকের পত্রিকা: বাংলাদেশে এখনো কি করোনা টেস্ট হচ্ছে? এবং এই নতুন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্তে কি আমাদের ল্যাব সক্ষম?

মারুফুর রহমান: এখন দেশে আগের মতো ব্যাপকভাবে টেস্ট হচ্ছে না। ২০২৩ সাল পর্যন্ত নিয়মিত জিনোম সিকোয়েন্সিং হয়েছে যা এখন আর নিয়মিত নয়। সার্ভিলেন্স প্রোগ্রামের আওতায় বিশেষ কিছু হাসপাতালে ও ইনস্টিটিউটে জিনোম সিকোয়েন্সিং এখনো চলছে, যেখানে নতুন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত করা সম্ভব। কিন্তু সত্যি কথা হলো, আমরা এখনো ‘সিস্টেমেটিক স্যাম্পলিং’ করছি না। জনস্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণের জন্য এটা অত্যন্ত জরুরি। কারণ আপনি যদি টেস্টই না করেন, তাহলে ধরবেন কীভাবে নতুন ভ্যারিয়েন্ট আসছে বা ছড়াচ্ছে?

আজকের পত্রিকা: যদি এটি আবার ছড়ায়, তাহলে আমাদের করণীয় কী হবে? পুরোনো লকডাউনব্যবস্থা কি আবার ফিরবে?

মারুফুর রহমান: লকডাউন এখন আর কার্যকর উপায় নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এখন আর লকডাউনের পক্ষে নয়। আমাদের করণীয় হলো—সচেতনতা, টার্গেটেড টেস্টিং, রিস্ক গ্রুপকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সুরক্ষা দেওয়া এবং দ্রুত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ। যদি হাসপাতালের চাপ বাড়ে, তখন কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় ‘রেস্ট্রিকটিভ মেজার’ নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সার্বিকভাবে জীবন থামিয়ে দেওয়ার যুগ আর নেই।

আজকের পত্রিকা: আপনি যদি তিনটি প্রধান সতর্কতা দিতে চান, তা কী হবে?

মারুফুর রহমান:. মুখে মাস্ক পরুন—বিশেষ করে জনসমাগমে।

২. হাত ধোয়ার অভ্যাস রাখুন—পুরোনো হলেও আজও প্রাসঙ্গিক।

৩. অসুস্থ বোধ করলে ঘরে থাকুন এবং প্রয়োজনে পরীক্ষা করুন।

আজকের পত্রিকা: শিশু ও গর্ভবতী নারীরা কি এই নতুন ভ্যারিয়েন্টে বেশি ঝুঁকিতে?

মারুফুর রহমান: শিশুর ক্ষেত্রে সংক্রমণ বেশি দেখা গেলেও গুরুতর অসুস্থতা তুলনামূলক কম। তবে যেসব শিশুর পূর্ববর্তী অসুস্থতা বা ইমিউন ঘাটতি রয়েছে—তাদের সতর্ক থাকতে হবে। গর্ভবতী নারীরা সব সময়ই সংক্রমণজনিত রোগে ঝুঁকিপূর্ণ; অতএব, তাদের টিকা নেওয়া এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি।

আজকের পত্রিকা: অনেকে বলছেন, করোনা এখন আর ভয় পাওয়ার কিছু নয়—এটা সাধারণ ফ্লুর মতো হয়ে গেছে। আপনি কি একমত?

মারুফুর রহমান: আংশিক একমত। ফ্লুর মতো একে সম্পূর্ণ সাধারণীকরণ বিপজ্জনক হতে পারে। কারণ করোনার দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া, যাকে আমরা লং কোভিড বলি, এখনো সম্পূর্ণ বোঝা যায়নি। তাছাড়া প্রতিবছর যদি নতুন ভ্যারিয়েন্ট আসে এবং তা অনেককে হাসপাতালে পাঠায়, তাহলে এটিকে সাধারণ জ্বর বলে উড়িয়ে দেওয়া উচিত নয়।

আজকের পত্রিকা: স্কুল-কলেজ, গণপরিবহন, অফিসে কি কোনো বাড়তি সতর্কতা নেওয়া উচিত এখন?

মারুফুর রহমান: অবশ্যই। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানকে তাদের নিজস্ব ‘রেসপন্স প্ল্যান’ তৈরি করা উচিত। অফিসে অসুস্থ কর্মীদের বিশ্রামের সুযোগ দেওয়া, গণপরিবহনে মাস্কের ব্যবহার উৎসাহিত করা এবং স্কুলে হাইজিন শিক্ষা চালু রাখা এখন সময়ের দাবি।

আজকের পত্রিকা: নতুন করে ভ্যাকসিন ক্যাম্পেইন চালু করা কি জরুরি?

মারুফুর রহমান: আমার মতে, হ্যাঁ। বিশেষ করে বয়স্ক, গর্ভবতী নারী, ডায়াবেটিস বা হৃদরোগে আক্রান্তদের জন্য বুস্টার ডোজ আবার চালু করা উচিত। অনেক দেশেই বার্ষিক কোভিড ভ্যাকসিন চালু হচ্ছে। আমরাও ধীরে ধীরে সেই মডেলের দিকে যেতে পারি।

আজকের পত্রিকা: আমরা কি আগের ভুল থেকে কিছু শিখেছি?

মারুফুর রহমান: আংশিক। আমরা দেখেছি, হুট করে ভয় বা গুজবে কান দিলে সিস্টেম ভেঙে পড়ে। আবার নির্লিপ্ত থাকলেও সমস্যা। তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়া, জনগণকে সময়মতো আপডেট দেওয়া এবং চিকিৎসকদের কথা গুরুত্ব দিয়ে শোনা—এই তিনটি শিক্ষা এখন আমাদের জরুরি।

আজকের পত্রিকা: আপনার মতে, বাংলাদেশের জন্য এখন সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ কী হতে পারে?

মারুফুর রহমান: ১. নতুন ভ্যারিয়েন্ট পর্যবেক্ষণে জিনোম সিকোয়েন্সিং বাড়ানো

২. ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে টিকা দেওয়া

৩. স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতির জন্য পুনরায় সক্রিয় করা

৪. সাধারণ মানুষকে ‘সতর্ক কিন্তু আতঙ্কহীন’ মনোভাব শেখানো

আজকের পত্রিকা: আপনি যদি একবাক্যে বলেন, আমরা আতঙ্কিত হব, নাকি সচেতন?

মারুফুর রহমান: ‘আতঙ্ক নয়, বিজ্ঞানভিত্তিক সচেতনতা—এটাই এখনকার করণীয়।’

করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট সম্পর্কে আতঙ্কিত না হয়ে আমাদের দরকার বাস্তবতা উপলব্ধি করা। ভ্যাকসিন, স্বাস্থ্যবিধি এবং তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই আমরা সামনে এগোতে পারি।

আজকের পত্রিকা: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

মারুফুর রহমান: আপনাকে এবং আপনার মাধ্যমে আজকের পত্রিকার পাঠকদেরও ধন্যবাদ। সচেতন হোন। বিপদমুক্ত থাকুন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত