Ajker Patrika

কেমন হওয়া উচিত ‘জুলাই সনদ’

লন্ডনের চ্যাথাম হাউসে রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সে বক্তব্য দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক পেজ
লন্ডনের চ্যাথাম হাউসে রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সে বক্তব্য দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক পেজ

৬ জুন সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আগামী জুলাই মাসেই সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি ‘জুলাই সনদ’ প্রস্তুত করে আমরা জাতির সামনে উপস্থাপন করতে পারব বলে আশা করছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব ও অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা একটি ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ দেওয়ার কথা জানিয়েছিল। তারা আমাকেও সেখানে আমন্ত্রণ জানায়। আমি বলেছিলাম, দেশের সব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিসহ অন্যদের সঙ্গে নিয়ে সকলে মিলে এ ঘোষণাপত্র দেওয়া ভালো হবে। সেই প্রেক্ষিতেই আমরা ‘জুলাই সনদ’-এর প্রস্তুতি নিচ্ছি।’

তাঁর ভাষ্যমতে, এই ‘জুলাই সনদ’ একটি প্রতিশ্রুতি, যেখানে জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র নির্মাণের লক্ষ্যে সংস্কার কমিশনের দেওয়া প্রস্তাবগুলোর মধ্য থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, তার তালিকা থাকবে। এই সনদে স্বাক্ষর করে রাজনৈতিক দলগুলো জাতির কাছে সেসব বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করবে।

১১ জুন লন্ডনে এক আলোচনাতেও প্রধান উপদেষ্টা আগামী জুলাই মাসে সব রাজনৈতিক দলের মতৈক্যের ভিত্তিতে ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন।

‘জুলাই সনদ’-কে ঘিরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ে এক ধরনের উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা হলে রাজনীতিতে কী গুণগত পরিবর্তন আসবে তা এখনো স্পষ্ট নয়, যেমন স্পষ্ট নয় ‘জুলাই ঘোষণায়’ আসলে কী থাকবে?

অনেক বছর ধরেই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলীয় দ্বন্দ্ব, অবিশ্বাস, সহিংসতা ও একতরফা ক্ষমতার অপব্যবহার রাজনীতিকে এমন এক জায়গায় নিয়ে গেছে, যেখানে কোনো পক্ষই আর অপর পক্ষকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে স্বীকার করতে চায় না— বরং শত্রু হিসেবে দেখে। এমন প্রেক্ষাপটে ‘জুলাই সনদ’ যদি সত্যিই গঠনমূলক রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে আসে, তবে সেটি হতে পারে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা।

এ সনদের প্রধান উদ্দেশ্য, অনানুষ্ঠানিক সূত্রে জানা যাচ্ছে, একটি গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথ তৈরি করা, রাজনৈতিক সহাবস্থান ও সহনশীলতার নতুন নীতি নির্ধারণ এবং শাসনব্যবস্থায় এমন কাঠামোগত সংস্কার আনা, যা ভবিষ্যতে ক্ষমতার অপব্যবহার বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দলীয় নিয়ন্ত্রণকে সীমিত করবে। এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে জমে ওঠা জনগণের অসন্তোষ, তরুণ সমাজের গণতন্ত্রমুখিতা, বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা পুনরুদ্ধারের দাবি এবং একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরির আকাঙ্ক্ষা।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি জাতীয় উপদেষ্টা পর্ষদ এই সম্ভাব্য রূপরেখা তৈরি করছে, যাতে প্রধান দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়।

যদি এই সনদ একটি কার্যকর ঘোষণাপত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তাতে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় আমূল সংস্কার আনার সম্ভাবনা থাকবে। স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন, নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন, ভোটের দিন সেনা মোতায়েন, ব্যালট পদ্ধতির মাধ্যমে ভোটগ্রহণ এবং রাজনৈতিক দলের আচরণবিধি নির্ধারণ— এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।

এর বাইরে, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পারস্পরিক সহাবস্থান নিশ্চিত করতে বিরোধী দলকে দমন বা কোণঠাসা করার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা যেতে পারে। একই সঙ্গে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, সামাজিক আন্দোলনের অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতিও এই সনদের অংশ হতে পারে।

‘জুলাই সনদ’-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হতে পারে শাসনব্যবস্থার কাঠামোগত পরিবর্তন। বিশেষজ্ঞদের মধ্যে কেউ কেউ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল মডেল বা ফ্রান্সের মিশ্র শাসনব্যবস্থার মতো একটি নতুন কাঠামো প্রস্তাব করছেন, যেখানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ভারসাম্যপূর্ণভাবে ভাগ করা হবে। এতে করে একক দলের শাসনের জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বণ্টিত হবে এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

একই সঙ্গে বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে বিচারপতি নিয়োগ পদ্ধতিতে সংস্কার, দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পুনর্গঠন এই সনদের অংশ হতে পারে। এতে করে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দলীয় প্রভাব থেকে মুক্ত থাকা ও পেশাগতভাবে চলার পরিবেশ সৃষ্টি হবে।

আকা

এ রকম একটি রূপরেখা কেবল রাজনৈতিক নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকেও বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হতে পারে। কারণ, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আসে না, শিল্প ও বাণিজ্য খাত দুর্বল থাকে, কর্মসংস্থান হ্রাস পায় এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় না।

এই সনদ যদি টেকসই শান্তির রূপরেখা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক নীতিতে বহুদলীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি রাষ্ট্রীয় নীতিমালা তৈরি হতে পারে, যা সরকারের পরিবর্তন হলেও দীর্ঘমেয়াদে দেশের অগ্রগতি নিশ্চিত করবে।

তবে বাস্তবতা জটিল। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর অতীত রেকর্ড বলছে, তারা অনেক সময় চুক্তি বা সমঝোতায় স্বাক্ষর করলেও বাস্তবায়নে আন্তরিকতা দেখায় না। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও ক্ষমতা-আকাঙ্ক্ষা তাদের চুক্তিভঙ্গ করতে বাধ্য করে।

কাজেই এই সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জনগণের চাপ, নাগরিক সমাজের সক্রিয়তা ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। বিশেষত, ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূ-রাজনৈতিক আগ্রহ এই প্রক্রিয়াকে সাহায্যও করতে পারে, আবার বাধাগ্রস্তও করতে পারে।

সবশেষে বলা যায়, ‘জুলাই সনদ’ একটি কাগজে লেখা ঘোষণা হলে তার কোনো অর্থ থাকবে না। বরং তা হতে হবে রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার দলিল।

জনগণ, নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক দল এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে এটি বাস্তবায়নে আন্তরিক ও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। তবেই এই সনদ বাংলাদেশের রাজনীতিকে সংঘাত, অনাস্থা ও কর্তৃত্ববাদী দুষ্টচক্র থেকে বের করে আনতে পারে।

নইলে এটি পরিণত হবে আরেকটি উচ্চাশার কুয়াশায়।

এখন প্রশ্ন একটাই— আমরা কি সত্যিই পরিবর্তন চাই? নাকি শুধু প্রতিপক্ষকে ঠকিয়ে আবার সেই পুরোনো পথে হাঁটব?

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত