Ajker Patrika

পাকিস্তানের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ

মালিহা লোধি
পাকিস্তানকে একটি বহুমাত্রিক পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। ছবি: এএফপি
পাকিস্তানকে একটি বহুমাত্রিক পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। ছবি: এএফপি

চার দিনব্যাপী পাকিস্তান-ভারত সামরিক সংঘাতে পাকিস্তান শুধু নিজেকে সফলভাবে রক্ষা করতেই সক্ষম হয়নি, বরং পেহেলগামে সন্ত্রাসী ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সামরিক সমাধান চাপিয়ে দেওয়ার ভারতের উদ্দেশ্যকেও ব্যর্থ করে দিয়েছে। পারমাণবিক যুদ্ধের সীমার নিচে প্রচলিত যুদ্ধের পরিসর বাড়ানোর ভারতীয় অপচেষ্টা সফল হয়নি। পাকিস্তান পাল্টা আক্রমণের মাধ্যমে প্রচলিত প্রতিরোধক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে এবং ভারতের এই বেপরোয়া সামরিক অভিযানের খরচ অনেক বাড়িয়ে তুলেছে।

এই সাফল্য স্বাভাবিকভাবেই দেশে উদ্‌যাপিত হয়েছে এবং জাতীয় আত্মবিশ্বাস পুনর্জাগরণে সহায়তা করেছে। তবে এখন বিজয়ের উচ্ছ্বাস থেকে বেরিয়ে আসা এবং পরবর্তী চ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার দিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। কারণ ভারতের নরেন্দ্র মোদির সরকারের বিবেচনাহীন সংঘর্ষমূলক অবস্থান এবং চলমান উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি বজায় রাখা থেকে বোঝা যায়, নতুন সংকট আসবেই। দীর্ঘ সময় ধরে বিজয়ের আত্মতৃপ্তিতে ভোগার ঝুঁকি হলো, এতে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ও ঢিলেমি তৈরি হতে পারে, যখন সামনে হয়তো আরও বড় কোনো চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। প্রকৃতপক্ষে এই মুহূর্তটি গভীর চিন্তা, সুপরিকল্পনা ও কঠোর পরিশ্রমের কথাই বলে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সংকট শেষ হওয়ার পর থেকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাঁর বাগ্‌যুদ্ধ আরও জোরদার করেছেন এবং পাকিস্তানবিরোধী উন্মাদনাকে উসকে দিচ্ছেন। একের পর এক ভাষণে তিনি দাবি করেছেন যে ভারতের সামরিক পদক্ষেপের মাধ্যমে একটি ‘নতুন স্বাভাবিকতা’ (নিউ নরমাল) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতে যেকোনো সন্ত্রাসী হামলাকে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল ধরা হবে এবং এই ‘নতুন’ নীতির আওতায় সামরিকভাবে জবাব দেওয়া হবে। তিনি পাকিস্তানের প্রতি হুমকির কেন্দ্রে সিন্ধু পানিচুক্তিকেও নিয়ে গেছেন। মোদি বারবার বলেছেন, পাকিস্তান ‘ভারতের নদী’ থেকে এক ফোঁটাও পানি পাবে না এবং তিনি পাকিস্তানকে ‘গরমটা বোঝাবেন’ বলে শপথ করেছেন। চুক্তিটি খারাপভাবে সম্পাদিত হয়েছে বলে দাবি করে তিনি পরিষ্কার করে দিয়েছেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে পানি ব্যবহার করতে তিনি বদ্ধপরিকর।

এ ধরনের উসকানিমূলক বক্তব্যের একটি অংশ দেশের অভ্যন্তরীণ জনগণের উদ্দেশে দেওয়া হচ্ছে এবং এটি ভারতের সামরিক অভিযানের অপ্রত্যাশিত ও বিব্রতকর ফলাফলের ক্ষতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টারই অংশ। এমন আগ্রাসী বক্তব্যের একটি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও আছে, এটি মোদিকে তাঁর মুসলিমবিরোধী ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল করতে সাহায্য করছে। তবে তাঁর এই হুমকিগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। বিশেষ করে মোদি ইতিমধ্যেই পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ানোর এক উদগ্র বাসনা দেখিয়েছেন। সব দিক বিবেচনায়, ভারত পাকিস্তানের ওপর চাপ অব্যাহত রাখবে। যেমন, পূর্বসতর্কতামূলক যুদ্ধের হুমকি দেবে এবং পানিসম্পদকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবে।

অতএব, পাকিস্তানকে একটি বহুমাত্রিক পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে, যার অর্থ হলো প্রতিরক্ষা, অর্থনীতি, কূটনীতি এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে সক্রিয় উদ্যোগ নেওয়া। সামরিক প্রস্তুতির ক্ষেত্রে, প্রথম জরুরি হবে প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় যে ঘাটতিগুলো সাম্প্রতিক সংকটে প্রকাশ পেয়েছে তা চিহ্নিত করা এবং ভবিষ্যতের বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জে সম্ভাব্য দুর্বলতার দিকগুলো নির্ধারণ করা। এটি এই বোঝায় যে সরঞ্জামাদি উন্নত করা দরকার–বিশেষ করে বিমানবাহিনী, ক্ষেপণাস্ত্র ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচালিত ইলেকট্রনিক যুদ্ধ ও বিমান প্রতিরক্ষা সক্ষমতার দিকে নজর দিতে হবে। কারণ সাম্প্রতিক যুদ্ধেই দেখা গেছে ভারত ব্যাপকভাবে মনুষ্যবিহীন বিমানের ব্যবহার করেছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। ইসলামাবাদ চীন থেকে জে-৩৫ এ, পঞ্চম প্রজন্মের স্টিলথ যুদ্ধবিমান সংগ্রহের বিষয়েও আগ্রহী।

তবে প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়টি অবশ্যই একটি স্পষ্ট প্রতিরক্ষা কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে এবং তা এমনভাবে পরিকল্পনা করা উচিত, যাতে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ সক্ষমতা ও অগ্রাধিকারে দক্ষতার সঙ্গে সম্পদ বরাদ্দ করা যায়।

একটি শক্তিশালী ও টেকসই প্রতিরক্ষাব্যবস্থার জন্য অর্থনীতি মজবুত করাটা একান্ত অপরিহার্য। বাস্তবিক অর্থে, ভারতকে ঘিরে তৈরি হওয়া চ্যালেঞ্জকে সরকার এমন একটি সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে, যাতে শুধু আইএমএফ-নির্ধারিত সাময়িক সমন্বয়মূলক পদক্ষেপেই সীমাবদ্ধ না থেকে, সাহসী ও ব্যাপক অর্থনৈতিক সংস্কার গ্রহণ করা যায়। কারণ জাতীয় নিরাপত্তা এমনটাই দাবি করে।

এই সংস্কারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হওয়া উচিত কর-ভিত্তি (ট্যাক্স বেজ) প্রসারিত করা, ভর্তুকি কমানো এবং রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বেসরকারীকরণ দ্রুততর করা। দেশীয় সম্পদ আহরণকে অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে। কারণ বহির্বিশ্ব থেকে ধার নেওয়ার নীতি ইতিমধ্যে পাকিস্তানকে অসহনীয় ঋণের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

ভারতের পক্ষ থেকে অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে পাকিস্তানকে দুর্বল করার যে কৌশল থাকতে পারে, তার সর্বোত্তম জবাব হতে পারে এমন অর্থনৈতিক সংস্কার, যা দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে এবং আত্মনির্ভরতার পথে নিয়ে যাবে। ভারতের চ্যালেঞ্জ তাই একটি সম্ভাবনার জানালা, যেটি আর সাবধানী, পুরোনো ধাঁচের অর্থনৈতিক কৌশলের কারণে নষ্ট করা যাবে না।

ভারতের তরফ থেকে সিন্ধু পানিচুক্তি বাতিল বা স্থগিতের হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া সতর্কভাবে মূল্যায়ন ও নির্ধারণ করা উচিত। কারণ এটি নিঃসন্দেহে পাকিস্তানের নিরাপত্তার ও অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। এ প্রসঙ্গে সমস্ত আইনি বিকল্প খতিয়ে দেখা জরুরি এবং একবার যেই পথ নির্ধারণ করা হবে, সেটির প্রতি যথাযথ কূটনৈতিক সমর্থন গড়ে তুলে দৃঢ়তার সঙ্গে অনুসরণ করতে হবে।

এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের পক্ষে যেটি কাজ করতে পারে তা হলো, আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের চুক্তি স্থগিতের সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থনের চেয়ে বরং অসন্তোষই বেশি দেখা গেছে। এমনকি, যুক্তরাষ্ট্রও ব্যক্তিগত যোগাযোগে নয়াদিল্লিকে সিন্ধু পানিচুক্তি মেনে চলার এবং তা বজায় রাখার পরামর্শ দিয়েছে।

এটিও এমন একটি সময়, যখন কূটনীতি শুধু কথায় নয়, বাস্তব কর্মপন্থায়ও দেশের প্রথম প্রতিরক্ষা স্তর হওয়া উচিত। পাকিস্তানকে টিকে থাকতে হলে এই যুদ্ধ কেবল সামরিক নয়, বরং কূটনৈতিক ময়দানেই লড়তে হবে। আমাদের কূটনৈতিক কৌশল হওয়া উচিত কেবল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করে নয়, বরং সুদূরপ্রসারী কৌশলের ওপর। শুধু কয়েকটি পশ্চিমা দেশের রাজধানীতে একটি প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে কূটনীতিকে কার্যকর করা সম্ভব নয়। পররাষ্ট্রনীতি হওয়া উচিত কৌশলগত লক্ষ্য পূরণের মাধ্যম, তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার নয়।

আসলে, এটি উপযুক্ত সময় একটি বিস্তৃত পররাষ্ট্রনীতির পর্যালোচনা করার, যাতে করে একটি সুসংগঠিত কৌশলগত পরিকল্পনা তৈরি করা যায়। এই পর্যালোচনা আরও জরুরি হয়ে উঠেছে, কারণ জেনারেল পারভেজ মোশাররফের সময় থেকে আজ পর্যন্ত কোনো পূর্ণাঙ্গ পররাষ্ট্রনীতির মূল্যায়ন হয়নি। যদিও এই সময়ের মধ্যে বিশ্বরাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এবং ভূরাজনৈতিক পালাবদল ঘটেছে।

একটি পররাষ্ট্রনীতি পর্যালোচনা পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নীতিকে অভিযোজিত করতে, নতুন সুযোগ কাজে লাগাতে এবং ভারতের চ্যালেঞ্জের পরিপ্রেক্ষিতে অগ্রাধিকারগুলো পুনর্নির্ধারণে সহায়ক হবে। এটি বিদ্যমান নীতিগুলোর কার্যকারিতা মূল্যায়ন করতে, উন্নতির ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করতে এবং নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য নীতি পুনর্গঠন করতেও সাহায্য করবে।

এই পর্যালোচনাটি বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়। কারণ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি মূলত বিভিন্ন আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ঘটনার প্রতি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়েছে, যা কোনো সুসংগঠিত ও সুপরিকল্পিত কৌশলের অংশ ছিল না। একটি পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা বিদেশে পাকিস্তানের কূটনৈতিক মিশনগুলোকে নীতিগত প্রস্তাব দেওয়ার সুযোগ এনে দেবে।

যেহেতু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পররাষ্ট্রনীতিতে সামরিক বাহিনী প্রধান ভূমিকা পালন করেছে, তাই এই পর্যালোচনা বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রধান প্রধান ইস্যুতে অর্থবহ সংলাপের সুযোগ সৃষ্টি করবে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত করবে এবং সমন্বয় ও তথ্য আদান-প্রদানের মান বাড়াবে।

ভারতের স্থায়ী ও বহুমাত্রিক হুমকির মুখে পাকিস্তানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যা করতে হবে, তার সম্পূর্ণ তালিকা এটি নয়; তবে সবচেয়ে জরুরি পদক্ষেপগুলো যা নিতে হবে, তা এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। এর ওপরও জাতীয় ঐক্য বজায় রাখা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।

(পাকিস্তানের ডন পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাটি ইংরেজি থেকে অনূদিত)

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পশ্চিমবঙ্গে আটক দুই আওয়ামী লীগ নেতা ও পুলিশ কর্মকর্তা, পরে মুক্তি

সভা শেষে সরকারি গাড়িতেই গরু নিয়ে গেলেন ইউএনও

যশোরে বিএনপি ও যুবদল নেতার বাড়িতে কাফনের কাপড়, দা, চিরকুট পাঠিয়ে হুমকি

১২ দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা

নিউজিল্যান্ডের সংসদে হাকা, দুনিয়া কাঁপানো সেই সাংসদেরা বরখাস্ত

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত