Ajker Patrika

ঢাবি শিক্ষার্থী শাকিল কি মব জাস্টিসের শিকার নয়, এ মৃত্যুর দায় কার

হুসাইন আহমদ
আপডেট : ১১ জুন ২০২৫, ০০: ০৭
শাকিল আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত
শাকিল আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত

আমি নাস্তিক নই, গ্রামের সবাই আমাকে নাস্তিক বলছে—এটাই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শেষ বর্ষের ছাত্র শাকিল আহমেদের আত্মঘাতী জীবনের শেষ স্বর। মায়ের সম্ভ্রম, বাবার সম্মান, নিজের মর্যাদা—সবকিছু বাঁচাতে গিয়ে এক তরুণ প্রাণ ঝরে গেল। প্রশ্ন ওঠে, এটা কি নিছক আত্মহত্যা, নাকি ‘সাংবাদিক না থাকা’ গ্রামে সংঘটিত এক পরিশীলিত মব জাস্টিস? উত্তর আমাদের জানা আছে, কিন্তু রাষ্ট্র নির্বিকার।

মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার দক্ষিণ জামশা গ্রামের এক প্রত্যন্ত বসতিতে ঘটেছিল ঘটনা। সাত-আট মাস আগে শাকিল একটি ফেসবুক পোস্টে মন্তব্য করেছিলেন, যা স্থানীয়রা হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে ‘কটূক্তিমূলক’ বলে দাবি করেছিল। মন্তব্যটি দ্রুত মুছে ফেলেন শাকিল। কিন্তু এই সমাজ ক্ষমা দেয় না, ভোলে না। শুধু তা-ই নয়, ভুলকে পুনর্জীবিত করতে সদা প্রস্তুত আছে সামাজিক মাধ্যম।

সুতরাং পুরোনো সেই মন্তব্যের স্ক্রিনশট আবার ভাইরাল করা হয় ২০২৫ সালের ৯ জুন রাতে, স্থানীয় কিছু ব্যক্তি তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে হত্যার হুমকি দেন, গালিগালাজ করেন, এমনকি বাড়িতে গিয়ে সালিসি বিচারের হুমকিও দেন। শাকিল বুঝতে পারেন, সামাজিক অপমান কেবল তাঁর নয়, তাঁর মা-বাবারও হবে। লাঞ্ছনার সেই বিভীষিকা কল্পনা করেই হয়তো শাকিল আর বেঁচে থাকতে চাননি, রাত ২টার দিকে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি।

আমরা মব জাস্টিস বলতে সাধারণত বুঝি গণপিটুনি বা একরকমের শারীরিক নির্যাতন। কিন্তু মব জাস্টিসের আধুনিক, নীরব ও ধ্বংসাত্মক রূপ হলো—সামাজিক অসহিষ্ণুতা ও সম্মানহানির ভয়। শাকিলের মৃত্যু ঠিক এমন এক পরিস্থিতির চূড়ান্ত রূপ, যেখানে গ্রামের লোকজন নিজেদের বিচারক বানিয়ে তাঁকে ‘কটূক্তিকারী, নাস্তিক, ধর্মবিরোধী’ বলে ঘোষণা করে দিল। সালিসি সভার নাম করে সামাজিকভাবে তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছিল।

শাকিলের ‘সুইসাইড নোট’ থেকে এটা স্পষ্ট যে তিন শাস্তির ভয়ে নয়, বরং মিথ্যা অপবাদে প্রিয়জনদের অসম্মানের আশঙ্কায় আত্মহননের পথ বেছে নেন। এই মৃত্যু ছিল পরিকল্পিত মানসিক চাপের ফল। তার মানে, শাকিল গণপিটুনির শিকার না হলেও ‘মনস্তাত্ত্বিক মব জাস্টিস’-এর শিকার হয়েছেন, যা বাস্তবিক অর্থেই বেশি নির্মম, বেশি ভয়ংকর।

এই ঘটনায় ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি যথাযথ সম্মান রেখে প্রশ্ন তুলতে হয়, একটি ফেসবুক কমেন্টের জন্য কীভাবে সমাজ শুধু শিক্ষার্থী বলে নয়, কোনো মানুষকে এই মাত্রায় অপদস্থ ও নিপীড়ন করতে পারে।

যদি কেউ সত্যিই ধর্মানুভূতিতে আঘাত করে থাকে, তবে দেশে বিদ্যমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, তথ্যপ্রযুক্তি আইন এবং ধর্ম অবমাননার আইনি ব্যবস্থা রয়েছে। এই আইনগুলো অনেক ক্ষেত্রে নিপীড়নমূলক ও স্বাধীন মতপ্রকাশের পথে বাধা। তবু বিদ্যমান আইনে একটা বিচারপ্রক্রিয়া তো থাকে। কেন মানুষ নিজেই আইন হাতে তুলে নিচ্ছে? কেন ধর্মের নামে লোকজন বিচারকের ভূমিকা নিচ্ছে?

কিন্তু এই প্রশ্নগুলো নতুন নয়। মতপ্রকাশের জন্য প্রকাশ্যে হুমকি দিয়ে অভিজিৎ রায়, নীলাদ্রী নীল, ফয়জুল হক রনি, ওয়াশিকুর বাবুকে হত্যা করা হয়েছে। এসব নাম একেকটি স্বাধীন মতপ্রকাশের রক্তাক্ত মূর্ত প্রতীক। কিন্তু শাকিলের ঘটনা অন্য রকম, তাকে ধারালো ধাতব অস্ত্রের আঘাতে মারা হয়নি, সামাজিক লাঞ্ছনাই এখানে বড় অস্ত্র। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টার পরও তাঁকে মরতে হলো।

কিন্তু এই মৃত্যুর দায় কার? প্রতিটি জীবন মূল্যবান এবং স্বজনদের কাছে প্রিয় ও প্রয়োজনীয়। শাকিল হয়তো বড় ভাস্কর হতো, সমাজ-রাষ্ট্রে অবদান রাখতেন। সেই সুযোগ তাঁকে দিল না এই সংকীর্ণ ও কূপমণ্ডূক সমাজ ও ব্যর্থ রাষ্ট্র। এখান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজের চরম ব্যর্থতা ফুটে উঠল।

প্রথম ব্যর্থতা, ফেসবুকে মন্তব্য ভাইরাল হওয়ামাত্রই প্রশাসন কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়নি। স্থানীয় পুলিশের ‘অপমৃত্যুর মামলা’ দায়েরই প্রমাণ করে যে তারা ঘটনাটিকে ‘ব্যক্তিগত দুর্বলতা’ বলে দায় সারতে চায়। দ্বিতীয় ব্যর্থতা, শাকিল ও তাঁর পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কেউ এগিয়ে আসেনি। সালিস বসানোর প্রস্তুতির খবর পর্যন্ত জানা গেছে, অথচ প্রশাসন ‘নীরব দর্শক’ হয়েই থাকল। তৃতীয় ব্যর্থতা, সমাজ ও শিক্ষাব্যবস্থা এমন এক মানসিক কাঠামো তৈরি করতে পারেনি, যেখানে একজন শিক্ষার্থী আত্মপক্ষ সমর্থনের সাহস পায়, অথবা যেকোনো প্রকার অপমানের বিরুদ্ধে সামাজিক নিরাপত্তা অনুভব করে।

এখন প্রশ্ন, মরার পরেও কি শাকিল বিচার পাবে, এই ঘটনার বিচার কি রাষ্ট্র করবে। যারা ফেসবুকে হুমকি দিয়েছে, যারা রাতে বাড়িতে এসে ভয়ভীতি দেখিয়েছে, তারা কি আইনের আওতায় আসবে? নাকি এটাও আরেকটি ফাইলচাপা ‘অপমৃত্যু মামলা’য় পরিণত হবে।

আমরা জানি, বাংলাদেশে ধর্মীয় অনুভূতির নামে বহু বিচারবহির্ভূত ঘটনাই ঘটে চলেছে, কিন্তু বিচারের ঘটনা বিরল। যদি শাকিলের মৃত্যুও সে তালিকায় যুক্ত হলে তরুণ প্রজন্মের ভরসার শেষ আলোটিও নিভে যাবে। শাকিল আহমেদের মৃত্যু আত্মহত্যা হিসেবে লিপিবদ্ধ হবে, হয়তো কেউ বলবেন, তিনি মানসিকভাবে দুর্বল ছিলেন, কেউ বলবে ‘ধর্ম অবমাননার অপরিণামদর্শিতার’ দায় তিনি নিতে পারেনি। কিন্তু ইতিহাস বলবে, শাকিল এক সামাজিক মৃত্যুদণ্ডের শিকার হয়েছিল, যার বিচারক ছিল তারই প্রতিবেশী এবং বিচার ছিল ভয়ার্ত সালিস ও ভয়ানক অপমান।

আমরা যদি এর বিরুদ্ধে না দাঁড়াই, তাহলে একদিন হয়তো নিজের সন্তানকেও বলার সুযোগ পাব না—‘ভয় নেই, তুমি যা বিশ্বাস করো তা বলো, সমাজ তোমার পাশে থাকবে। শাকিল আত্মহত্যা করেননি, তাঁকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়েছিল। আর সেটিই মব জাস্টিসের নতুন নাম—নীরব হত্যা।

লেখক:

সহকারী বার্তা সম্পাদক

আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ড. ইউনূসের গ্রামীণ মৎস্য ও পশুসম্পদ ফাউন্ডেশনের ঘেরে ডাকাতি, আহত ৪

পাচারের অর্থে দুবাইয়ে মেয়ের ৪৫ কোটি টাকার ফ্ল্যাট—অভিযোগ নিয়ে যা বললেন গভর্নর

সুধা সদন এখন কিশোর গ্যাং ও মাদকসেবীর আখড়া

যুক্তরাজ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের শতকোটি টাকার সম্পত্তি জব্দ

দোকান দখলে যুবদল-কৃষক দল নেতা, আ.লীগের দোসর আখ্যা দিয়ে ১৬ মামলা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত