Ajker Patrika

বাহাস বিভেদ-সংঘাতে না গড়ালেই বাঁচোয়া

আজাদুর রহমান চন্দন
Thumbnail image
প্রতীকী ছবি

‘শক্তি-সামর্থ্য’ কম বলেই বোধ করি শুরু থেকেই উপেক্ষার শিকার বামপন্থী রাজনৈতিক দল-সংগঠন ও বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবীরা। দিনে দিনে নানা বিষয়ে তাদের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও অন্তর্বর্তী সরকারের মতভেদও প্রকাশ পায়। ইদানীং দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপির সঙ্গেও মতভেদ বাড়ছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব ও সরকারের। স্বাভাবিকভাবেই সংস্কারপ্রত্যাশী নাগরিকদের বিষয়টি উদ্বিগ্ন করে তোলে। দলাদলি আর বিভেদের কারণে বারবার আন্দোলনের সুফল হাতছাড়া হওয়ার অভিজ্ঞতা থাকায় সিঁদুরে মেঘেও অনেক ভয় তাদের।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের দাবি ওঠার পর বিএনপি এর বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ায় গত অক্টোবরেই দুই পক্ষের মধ্যে একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল। রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবি ওঠার পরপরই বিএনপির কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দলীয় অবস্থান তুলে ধরে জানিয়েছিলেন, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের মাধ্যমে দেশে কোনো সাংবিধানিক সংকট ও শূন্যতা তৈরি হলে তৃতীয় পক্ষ সুযোগ নিতে পারে বলে দলটির আশঙ্কা। অন্তর্বর্তী সরকারের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হলে সে-যাত্রায় সাধারণ মানুষ হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল। কিন্তু স্বস্তির সেই নিশ্বাস স্থায়ী হতে পারছে কি!

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান বা বিপ্লবের (কারও কারও ভাষায়) ঘোষণাপত্র প্রকাশ নিয়েও কিছুটা টানাপোড়েন দেখা দেয়। যেকোনো বিপ্লবের ঘোষণা হয় বিপ্লবের আগে কিংবা সফল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই। ৫ আগস্ট বা এর পরপর ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হলে সেটি নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকত না। কিন্তু পাঁচ মাস পরে এসে ‘বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ করার উদ্যোগ নেওয়ায় কেউ কেউ এটিকে জাতীয় নির্বাচন পেছানোর একধরনের প্রয়াস হিসেবে সন্দেহ করছেন। বিএনপির ভেতরে এমন বিশ্বাস গড়ে ওঠে যে, কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের উসকানি কিংবা ভরসায়ই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জমায়েত ডেকে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। গত ২৮ ডিসেম্বর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে একই ধরনের দুটি পোস্ট দিয়ে ৩১ ডিসেম্বর ‘বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ করার কথা জানানো হয়ছিল। কাছাকাছি সময়ে ফেসবুকে নিজের ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্টে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ লিখেছিলেন, ‘কমরেডস, নাউ অর নেভার’। পরদিন এক সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ জানিয়েছিলেন, ৩১ ডিসেম্বর বেলা তিনটায় ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ দেওয়া হবে। তিনি বলেন, ঘোষণাপত্রে ‘নাৎসিবাদী আওয়ামী লীগকে’ বাংলাদেশে অপ্রাসঙ্গিক ঘোষণা করা হবে এবং ‘মুজিববাদী সংবিধান কবরস্থ’ করা হবে। যদিও বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বিবিসি বাংলাকে বলেন, বাহাত্তরের সংবিধান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত শাসনতন্ত্র।

বিএনপি কয়েক মাস আগে থেকেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার তাগিদ দিয়ে আসছিল। সে নিয়েও কিছুটা অস্বস্তি দেখা যায় অন্তর্বর্তী সরকার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বের মধ্যে। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সম্প্রতি জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পরিকল্পনা প্রকাশ করার পর বিএনপি ও তার মিত্ররা এর সমালোচনায় মুখর হয়। গত মাসের শেষ দিকে এক মতবিনিময় সভায় স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, বেশির ভাগ মানুষ চান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই জাতীয় সংসদের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেবেন তাঁরা। স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনও বক্তাদের মতামতের পক্ষে সমর্থন দেয়। তখন থেকেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে আলোচনা চলে রাজনৈতিক অঙ্গনে। এরপর ৮ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের এক বক্তব্যের পর আলোচনাটি জোরালো হয়ে ওঠে। ওই দিন ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংকের (ইআইবি) ভাইস প্রেসিডেন্ট নিকোলা বিয়ার সাক্ষাৎ করতে এলে প্রধান উপদেষ্টা তাঁকে জানান, অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচনেরও প্রস্তুতি নিচ্ছে।

জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পরিকল্পনার তীব্র বিরোধিতা করে বিএনপি ও এর সমমনা বিভিন্ন দল। ওই দলগুলোর নেতারা বলেন, সরকার যদি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মতো বিষয় তুলে ধরে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা করে, তাহলে তাঁরা দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি দেবেন।

এদিকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন ইস্যুতে সরকারের পক্ষে অবস্থান জানান দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের উদ্যোগে গঠিত জাতীয় নাগরিক কমিটি। ১১ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর স্থানীয় সরকারকাঠামো ‘ভেঙে পড়ায়’ নাগরিকেরা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে তারা জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আয়োজন করার ওপর গুরুত্ব দেন। এখানে বলা দরকার, জাতীয় নাগরিক কমিটি বেশ কিছুদিন ধরে সারা দেশে সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তুলছে, যাকে নতুন রাজনৈতিক দল গড়ার প্রক্রিয়া হিসেবেই দেখা হচ্ছে। নতুন এই রাজনৈতিক দল আগামী মাসের মধ্য থেকে শেষ ভাগে আত্মপ্রকাশ করতে পারে বলে এরই মধ্যে সংবাদও বেরিয়েছে। এমনও বলা হচ্ছে, সংসদীয় আসন, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে বিএনপির দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের নতুন দলে টানার চেষ্টা করা হবে। এই রাজনৈতিক দল গড়ার প্রক্রিয়া নিয়ে এখন রীতিমতো বাহাস চলছে।

নির্বাচন প্রসঙ্গে বিএনপির সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের টানাপোড়েনের মাঝে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে বিএনপির ‘কথার টোন আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।’ তিনি ২৪ জানুয়ারি বিবিসি বাংলাকে বলেন, তিনি রাজনৈতিক দলে যোগ দিলে সরকার থেকে বেরিয়ে যাবেন।

এর দুই দিন আগেই বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য নিয়ে এমন আলোচনার সূত্রপাত। মির্জা ফখরুল বলেছিলেন, ‘বর্তমান সরকার নিরপেক্ষ থাকতে না পারলে নির্বাচন করতে নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন হবে।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ছাত্ররা রাজনৈতিক দল গঠন করলে সরকার থেকে ‘বেরিয়ে আসা উচিত’। অন্তর্বর্তী সরকারের দুই তরুণ উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহর প্রতিক্রিয়ার পরও পাল্টাপাল্টি প্রতিক্রিয়া অব্যাহত আছে।

কোনো বিপ্লব, গণ-অভ্যুত্থান বা গণ-আন্দোলনের পর বিজয়ী বিভিন্ন শক্তির মধ্যে ক্ষমতাকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব দেখা দেওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। যদিও গত জুলাই-আগস্টে যা ঘটেছে, তা বিপ্লব নাকি গণ-অভ্যুত্থান—সে নিয়ে বিতর্ক আছে শুরু থেকেই। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, শীর্ষ পর্যায়ের কোনো কোনো ব্যক্তির পক্ষ থেকে ঘটনাটিকে কখনো বিপ্লব, কখনো গণ-অভ্যুত্থান আখ্যা দেওয়া। সে প্রসঙ্গে আর নাই-বা

এগোলাম। গণ-অভ্যুত্থানে শামিল হওয়া নানা মত ও পথের ব্যক্তি-সংগঠনের মধ্যে ফুটে ওঠা বিভাজন এড়িয়ে গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে এগোতে পারাটাই দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলজনক। কিন্তু ‘জাতি’ শব্দটি লেখার সঙ্গে সঙ্গেই যে আরেকটি বিভাজনের কথা সামনে এসে গেল। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা যে কৃত্রিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্য পূর্ব বাংলার মুসলমানরাই বেশি প্রাণপাত করেছিলেন, বছর না পেরোতেই তারাই তো আবার ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন বাংলা ভাষার মর্যাদার প্রশ্নে। এরপর ভাষা-সংস্কৃতি আর গণতন্ত্রের ধারাবাহিক লড়াইয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়, সেটি তো জাতি-রাষ্ট্র ছাড়া অন্য কিছু ছিল না। সেই জাতি পরিচয়টিও যে এখন হুমকির মুখে। এ প্রসঙ্গও না হয় তোলা থাকল অন্য কোনো দিনের জন্য। এ ছাড়া কাগজের লেখা মুছে দিলেও বাঙালি তো আর অন্য কোনো জাতিতে রূপান্তরিত হবে না; পঁচাত্তর-পরবর্তী দীর্ঘ সময়েও হয়নি।

এটা সবারই জানা যে, শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে উদার ও মধ্যপন্থীরা ছাড়াও শরিক ছিল চরম ডান ও চরম বামপন্থীরা। পরস্পরবিরোধী পক্ষগুলো বিভেদ এড়িয়ে শান্তিপূর্ণ উপায়ে গণতন্ত্রে উত্তরণ ঘটাতে পারলেই কেবল জনমনে জেগে ওঠা ভয় দূর হবে। এ ক্ষেত্রে উদার গণতান্ত্রিক শক্তির সময়োপযোগী জোরালো ভূমিকা দরকার। সেই ভূমিকা তারা রাখতে পারবে কি না, সেটিই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত