Ajker Patrika

চন্দবাড়ির গল্পও মন্দ নয়

আপডেট : ০৫ মে ২০২২, ১১: ০৬
চন্দবাড়ির গল্পও মন্দ নয়

দত্তবাড়ির পর বোদার চন্দবাড়ির কথা না লিখলে চলে না। দত্তবাড়ির মতো চন্দবাড়িতেও আছে আমার সহপাঠী ও বন্ধু। আবার দত্ত ও চন্দবাড়ির মধ্যেও আছে পারস্পরিক আত্মীয়তার সম্পর্ক। 

বোদার থানাপাড়া এখন অনেক বড়। অনেক বাড়িঘর। আর আমাদের ছোটবেলায় থানা, ওয়াপদা অফিস এবং একদিকে চন্দবাড়ি, অন্যদিকে হকিকুল ডাক্তার সাহেবের বাড়ি ছাড়া আর কোনো বাড়িঘর ছিল বলে মনে পড়ে না। 

উমেশ চন্দ্র চন্দ ও মন্মথ চন্দ দুই ভাই। উমেশ চন্দের দুই ছেলে সুধীর চন্দ্র চন্দ ও অধীর চন্দ্র চন্দ। উমেশ বাবুকে আমি দেখিনি। তবে মন্মথ বাবুকে দেখেছি। তাঁর বাড়ি অবশ্য থানাপাড়ায় ছিল না। তাঁর বাড়ি বাজার থেকে সিরাজ সরকার সাহেবের বাড়ি যেতে আগে পড়ত। হাতের বাঁয়ে। এখনো আছে সেই বাড়ি। মন্মথ চন্দের মেয়ে ছায়াদিকে বিয়ে করেন দত্তবাড়ির শিবেন দত্ত।

উমেশ চন্দের দুই ছেলের থানাপাড়ার বাসায় আমার ছিল অবাধ যাতায়াত। বড় ছেলে সুধীর চন্দের তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। শিবানী চন্দ, কল্যাণী চন্দ (সুনু), সুধাংশু চন্দ (স্বপন), নারায়ণী চন্দ (বেণু), হিমাংশু চন্দ (তপন/তপু) ও প্রবীর চন্দ (নয়ন)। শিবানী চন্দকে আমি দেখিনি। তিনি অবিভক্ত ভারতের জলপাইগুড়িতে মামাবাড়িতে একেবারে ছোট থেকেই বড় হয়েছেন। আর দেশে আসেননি। অন্য সবাই বোদায় ছিলেন বা আছেন। এর মধ্যে স্বপনদা অকালপ্রয়াত। সুনুদি, স্বপনদা ও বেণু আমার বড়। তবে বড় হলেও বেণু আর তপু আমার সহপাঠী। পরে সম্ভবত ক্লাস ফাইভ থেকে বেণু আমার ‘জুনিয়র’ হয়ে যায়। আর তপু হয়ে ওঠে আমার প্রিয় বন্ধুদের একজন। আমি, তপু ও দত্তবাড়ির বিজন—এই তিনজন ছিলাম (দেখা-সাক্ষাৎ কম হলেও এখনো আছি) ‘এক দেহ, এক প্রাণ’। কত কথাই না মনে পড়ছে। একটি ঘটনার কথা না বলে পারছি না। হাইস্কুলে পড়ার সময় আমরা কয়েকজন (এর মধ্যে বিজন, তপু আর আমি কমন) প্রতি বৃহস্পতিবার টিফিনের সময় স্কুল পালিয়ে ঠাকুরগাঁওয়ে যেতাম সিনেমা দেখার জন্য। শুক্রবার নতুন ছবি শুরু হতো, কাজেই বৃহস্পতিবার আমরা বিদায়ী ছবিটা দেখতাম। বলাকা টকিজ নামের সিনেমা হলটির মালিক ছিলেন মির্জা রুহুল আমিন (চখা মিয়া নামে সমধিক পরিচিত)। তিনি ছিলেন বর্তমান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বাবা এবং সাবেক সেনাপ্রধান ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমানের শ্বশুর।

স্কুল থেকে পালিয়ে আমরা একত্রিত হতাম সাতখামারে শামসুদ্দিন ডাক্তার সাহেবের ডিসপেনসারিতে। দুপুরবেলা ওটা ফাঁকা থাকত। আমার বাড়ি ছিল তার পাশেই। ওটা ছিল ঠাকুরগাঁওয়ে যাওয়ার সড়কের একেবারে লাগোয়া। বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে উঠলে কেউ দেখে ফেলতে পারে—এই আশঙ্কা থেকেই আমরা একটু এগিয়ে গিয়ে বাসে উঠতাম। প্রবাদ আছে, ‘যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে রাত হয়’। একদিন আমাদের শামসুদ্দিন ডাক্তার চাচার ডিসপেনসারিতে জটলারত অবস্থায় দেখতে পান ডা. ফয়জুল করিম, আমাদের মশিয়ারের (মশিয়ার রহমান, এখন পল্লি কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা) বাবা। আমরা যে স্কুল পালিয়ে ওখানে সমবেত হয়েছি, সেটা তিনি বুঝতে পারেন। তিনি সম্ভবত রোগী দেখে সাইকেলে চেপে ফিরছিলেন। তিনি নিজে আমাদের কিছু বললেন না। তবে বাজারে গিয়ে তপুর বাবা সুধীর কাকুকে বিষয়টি অবগত করেন। কাকু দ্রুত ছুটে আসেন এবং আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তপুকে পাকড়াও করে পায়ের কাবলি স্যান্ডেল দিয়ে বেদম পেটাতে থাকেন। তপু চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে মিনতি করে বলতে থাকে, ‘দোহাই বাবা, আর মেরো না।’ কাকু কোনো কথা শোনেন না। একপর্যায়ে পিটিয়ে ক্লান্ত হয়ে আমাদের সবাইকে শাসিয়ে তিনি চলে যান। আমরা ভাবলাম, অত পিটুনি খেয়ে তপু হয়তো আর সিনেমা দেখতে যাবে না। কিন্তু আমাদের অবাক করে তপু বলল, ‘মার তো খেয়েই ফেলেছি, তাহলে আর সিনেমা দেখা থেকে বঞ্চিত হব কেন?’

তপু ছিল আমাদের বন্ধুদের মধ্য সবচেয়ে ছোটখাটো। তাই ওকে নিয়ে কত ধরনের কাণ্ডই না আমরা করতাম। সেই তপু, হিমাংশু চন্দ এখন ঠাকুরগাঁওয়ে একটি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) প্রধান নির্বাহী। তপুও খুব সরল মনের সাদাসিধে মানুষ। জীবনে টাকা-পয়সা যেমন উপার্জন করেছে, তেমন খরচও করেছে। ওর বাবা, আমাদের সুধীর কাকুও ছিলেন অত্যন্ত দরাজ দিল মানুষ। আমি তাঁর কাছ থেকে যে স্নেহ-ভালোবাসা পেয়েছি, তা বলে শেষ করা যাবে না।

আমার বন্ধু তপুর বাবা, আমাদের সুধীর কাকু ছিলেন আমার দেখা ‘অসাধারণ’ মানুষদের একজন। দেখতে ছিলেন সুদর্শন। অমন উন্নত নাক, গৌর বর্ণ, মাথা উঁচু করে হাঁটাচলা করা; দেখলেই মনের মধ্যে একটি সমীহ ভাব চলে আসত। তাঁকে আমরা একধরনের ভয়মিশ্রিত সমীহই করতাম। একেবারে ছোটবেলায় এড়িয়ে চলতাম। আস্তে আস্তে যতই তাঁর নৈকট্য লাভ করেছি, ততই মনে হয়েছে তাঁর মনের ভেতরটা কত নরম। পরিণত বয়সেও তিনি ঝুনা নারকেল না হয়ে কচি ডাবের মতোই ছিলেন।

প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন একজন নামকরা ফুটবল খেলোয়াড়। জলপাইগুড়ি জেলায়ও তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। আমরা ছোটবেলায়ও তাঁকে বোদা হাইস্কুল মাঠে শৌখিন খেলোয়াড় হিসেবে খেলতে দেখেছি। সুধীর কাকু, ডা. ফয়জুল চাচারা মাঠে নামলে জমে উঠত খেলা। তরুণদের উৎসাহিত করার জন্যই সে সময় তাঁরা নিয়মিত মাঠে যেতেন।

তপুর মা, মানে আমাদের কাকি মারা যান সম্ভবত ১৯৫৭ সালে। আমি হয়তো তাঁকে দেখিওনি। শুনেছি নয়নের তখন মাত্র দেড় বছর বয়স। তপুর তিন-সাড়ে তিন। কাজেই মায়ের কোনো স্মৃতি ওদের মনে থাকার কথা নয়। ওরা প্রকৃতপক্ষে মাতৃস্নেহে বড় হয়েছে দিদিমার কাছে। দিদিমা সরজুবালা দেবী ছিলেন সুধীর কাকুর মাসিমা। তিনি বাল্যবিধবা। বিয়ের অল্প পরই স্বামীহারা হয়ে সুধীর কাকুর সংসারে স্থায়ী হয়েছিলেন। তপু ও নয়ন এই দিদিমার কোলেপিঠে মানুষ। তাই তিনি ছিলেন ওদের মা, দিদিমা নয়!

এই মহীয়সী নারীকে যাঁরা না দেখেছেন, তাঁরা তাঁর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কোনো ধারণা করতে পারবেন না। তিনিই কার্যত চন্দবাড়িতে অভিভাবক ছিলেন। তাঁর ছায়া-মায়ায় তপুরা ভাইবোন মানুষ হয়েছে। আরও একজন তপুদের মায়ের অভাব পূরণে বড় ভূমিকা রেখেছেন—তপুদের কাকিমা, অধীর কাকুর স্ত্রী। এই কাকিমার নাম রেখা রানী চন্দ। নিজের তিন মেয়ে ও দুই ছেলেসন্তানের সঙ্গে ভাশুরের সন্তানদেরও তিনি অকৃপণ স্নেহ-ভালোবাসা দিয়েছেন।

সুধীর কাকুর স্ত্রীবিয়োগের পর অনেকে তাঁকে আবার বিয়ে করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তখন এমন রেওয়াজ ছিল, কিন্তু প্রথম স্ত্রীর প্রতি গভীর ভালোবাসা তাঁকে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণে নিরুৎসাহিত করেছিল। একসময় আমি চন্দবাড়ির সদস্যের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। ওই বাড়ির হাঁড়িতে আমার জন্য দুমুঠো চাল যেন দেওয়াই থাকত। আমি গেলে দিদিমা, কাকিমা কেউ বিরক্ত না হয়ে খুশি হতেন। হাসিমুখেই আমাকে স্বাগত জানাতেন। দিদিমা আর নেই। প্রায় ৯০ বছর বয়সে তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। কাকিমা এখনো সক্রিয় আছেন, সেঞ্চুরি করার অপেক্ষায়।

তপুর কাকাতো বোন রেবা রানী চন্দ; ডাক নাম পুতুল। আমাদের ছোট। দেখতে অনেকটা পুতুলের মতোই ছিল। আমি একটু বড় হওয়ার পর, অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই মনে হয়, কেউ কেউ পুতুলের সঙ্গে আমার বিয়ের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করতেন বলে আমি শুনেছি। তবে বিষয়টি জোরালো হয়ে ওঠেনি।

তপুদের ভাইবোনেরা সবাই মুক্ত মনের অধিকারী। তপু আমার বন্ধু। ওর সঙ্গে মাখামাখি সম্পর্ক হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু ওর বড় ভাই স্বপনদা এবং ছোট ভাই নয়নের সঙ্গেও গোড়া থেকেই আমার সম্পর্ক অত্যন্ত প্রীতিময়। নয়ন এখন বোদার একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি। কলেজে অধ্যাপনা থেকে সম্প্রতি অবসর নিয়ে সংস্কৃতি-সাহিত্য-সমাজ নিয়ে কাজ করেন, লেখালেখি করেন। কবিতা ও গদ্যে সমান পারদর্শী।

এই পরিবারের সঙ্গে আমার অতি ঘনিষ্ঠতার আরেকটি বড় কারণ বোধ হয় এটাই যে, এরা সবাই কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক ছিলেন। পার্টির সদস্য না হয়েও এরা ছিলেন পার্টি অন্তপ্রাণ। এ রকম পরিবার বোদায় আরও দু-চারটি ছিল।

চন্দবাড়ির সুধীর চন্দের জন্ম ১৯১৭ সালের কোনো এক বুধবার। ওই বছর পৃথিবীতে প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল। অক্টোবর বিপ্লব বলে পরিচিত সেই বিপ্লবের অভিঘাত তখনই বোদায় গিয়ে পৌঁছানোর কথা নয়। তাই সুধীর চন্দের চেতনায় বিপ্লব আঘাত হানেনি। তবে একধরনের উদার মানবতাবাদী চেতনার বিকাশ তাঁর মধ্যে লক্ষ করা গেছে। তাঁর বাড়ির পরিবেশ যে কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন হয়েছিল, সেটা আগে উল্লেখ করেছি। একটি কাকতালীয় ব্যাপার হলো তাঁর জন্ম এবং মৃত্যু একই বারে। বুধবার। ২০০০ সালের এক বুধবার তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। প্রায় ৮৩ বছরের জীবন পেয়েছিলেন তিনি।

সুধীর চন্দ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাস করেছিলেন সম্ভবত ১৯৩৭ সালে। তাঁর সঙ্গে একই বছর প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন বোদা হাইস্কুলের শিক্ষক সেলিমের বাবা সিদ্দিক সাহেব। ম্যাট্রিক পাসের পর সুধীর চন্দ আর পড়াশোনা না করে চাকরিতে ঢোকেন। তিনি অবিভক্ত ভারতেই জুট করপোরেশনে প্রথম চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। বন বিভাগেও নাকি তাঁর চাকরি হয়েছিল। সাপ, মশা ইত্যাদির ভয়ে তিনি সেই চাকরিতে যোগ দেননি।

ব্রিটিশরা ভারত ভাগ করে পাকিস্তান ও ভারত দুই রাষ্ট্রের জন্ম দিয়ে ১৯৪৭ সালে বিদায় নেয়। সে সময় সুধীর চন্দ তৎকালীন পাকিস্তানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তখন তাঁর চাকরি ন্যস্ত হয় ডিসি কালেক্টরে তহসিল অফিসে, তহসিলদার হিসেবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় পর্যন্ত তিনি ওই চাকরি করেছেন। বোদা ছাড়াও দেবীগঞ্জ, পঞ্চগড় ও সেতাবগঞ্জে তিনি তহসিলদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। স্বাধীনতার পর তিনি লুথার্ন ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন নামের একটি সাহায্য সংস্থায় চাকরি নেন। পরে এই সংগঠন আরডিআরএস নামে রূপান্তরিত হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে এই সংস্থা অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছিল। তখন ঠাকুরগাঁও কলেজে পড়াশোনার পাশাপাশি বেশ কিছুদিন আরডিআরএসের কনস্ট্রাকশন বিভাগে কাজ করেছে আমার বন্ধু হিমাংশু চন্দ তপন বা তপু। বেশ কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিধ্বস্ত ভবন নতুন করে তৈরির কাজ তদারকির দায়িত্ব পালন করেছে তপু। সুধীর কাকু আরডিআরএসের চাকরি করেছেন ১৯৮০ সাল পর্যন্ত। ফলে তিনি স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ঠাকুরগাঁওয়েই বসবাস করেছেন। বাসা ভাড়া নিয়ে দুই ছেলেকে নিয়ে তিনি থাকতেন। তপু ও নয়ন ঠাকুরগাঁও কলেজে পড়ত। তপু ওই কলেজ থেকে বিএ পাস করেছে আর নয়ন এইচএসসি পাস করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। দর্শনশাস্ত্রে মাস্টার্স করে বোদায় ফিরে পাথরাজ কলেজে শিক্ষকতা শুরু করে। তপু বিয়েশাদি করে ঠাকুরগাঁওয়েই স্থায়ী হয়েছে।

তপুদের ঠাকুরগাঁওয়ের বাসায়ও নানা কারণে আমাকে বহুদিন রাত কাটাতে হয়েছে এবং পাত পাততে হয়েছে। তখন ঢাকায় আসার জন্য আমাকে হয় দিনাজপুর অথবা ঠাকুরগাঁও থেকে গাড়ি ধরতে হতো। পঞ্চগড় থেকে কোনো কোচ ডে কিংবা নাইট তখনো চালু হয়নি। ঢাকা থেকে বাড়ি যাওয়া এবং বাড়ি থেকে ঢাকায় আসার জন্য ঠাকুরগাঁওয়ে আমার রাত্রিকালীন অবস্থান হতো তপুদের বাসায়। রান্নাঘরে একসঙ্গে বসে আমরা চারজন রাতের খাবার খেতাম। সুধীর কাকু পরম মমতায় আমাকে পুত্রবৎ পাশে বসাতেন। আহা, কত প্রীতিময় ছিল সেই দিনগুলো!

আগেই বলেছি, কাকু ছিলেন একজন ভালো ফুটবল খেলোয়াড়। তিনি জলপাইগুড়ি টাউন ক্লাবের ক্যাপ্টেন ছিলেন। তিনি সাত-আটবার ইন্ডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (আইএফএ) শিল্ড কাপ খেলেছেন। ট্রফি জিতেছেন। হেড করে গোল করায় তিনি খুব পারদর্শী ছিলেন। তখন মাঝগ্রামের আবদুর রহমান সাহেবও ভালো ফুটবল খেলতেন। তাঁর কর্নার কিক মানেই ছিল অবধারিত গোল। সে জন্যই তখন বলা হতো সুধীর চন্দের হেড আর আব্দুর রহমানের কর্নার কিক ইকুয়াল টু গোল। তিনি রংপুর ও দিনাজপুরে গিয়েও খেলেছেন।

সুধীর কাকু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছেন। অস্ত্র হাতে সম্মুখ সমরে অংশ না নিলেও শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় নেওয়া মানুষদের নানা উপায়ে সাহায্য-সহযোগিতায় ছিলেন সদা তৎপর। যেসব রাজনৈতিক নেতাকর্মী ওপারে গিয়েছিলেন, তাঁদের জন্য বড় সহায় ছিলেন সুধীর কাকু। কিন্তু কিছু মানুষ যেমন যুদ্ধ শেষের পাওনা বুঝে নেওয়ার জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন, সুধীর কাকু ছিলেন সেখানে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।

চন্দবাড়ির স্বপনদা ছিলেন হাসিখুশি স্বভাবের, একটু যেন আপনভোলা মানুষ। সংসার করেছেন। কিন্তু প্রকৃত সংসারী বলতে যা বোঝায়, তিনি তা ছিলেন কি না, আমার সন্দেহ আছে। মাথার ওপর সুধীর কাকুর মতো বটবৃক্ষসম বাবা থাকলে অমনই বোধ হয় হওয়ার কথা।

স্বপনদা আমার বড়। বন্ধুর বড় ভাই। কিন্তু আমাদের মধ্যে একধরনের বন্ধুত্বের সম্পর্কই গড়ে উঠেছিল। তিনি আমার সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলতেন। রাজনীতি সচেতন ছিলেন। দেশ-দুনিয়া সম্পর্কে খোঁজখবর রাখতেন। নিয়মিত খবরের কাগজ পড়তেন।

১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আমাদের এলাকা থেকে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন কামু ভাই, অ্যাডভোকেট কামরুল হোসেন। মনে আছে, ওই নির্বাচনী প্রচারে আমি আর স্বপনদা একসঙ্গে অনেক জায়গায় গিয়েছি। বিভিন্ন গ্রাম বা ইউনিয়নে আমাদের উভয়ের পরিচিতদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ভোট প্রার্থনা করেছি। আমি সাইকেল চালাতে পারতাম না। স্বপনদা সাইকেল চালিয়ে আমাকে নিয়ে যেতেন। তখন গ্রামাঞ্চলে রাস্তাঘাট ভালো ছিল না। আলপথে অনেক কষ্ট করেই আমাদের যেতে হতো। হাসিমুখেই এই কষ্টকর কাজটি স্বপনদা করতেন। আমরা বুঝতে পারতাম, জনমত আমাদের অনুকূলে নয়। তার পরও কিসের আশায়, কিসের নেশায় যে দিনরাত গ্রাম থেকে গ্রামে, বাড়ি থেকে বাড়ি ছুটে বেড়াতাম!

আমি ঢাকায় আসার পর স্বপনদার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই যোগাযোগ কমে গিয়েছিল। তার পরও ছুটিছাঁটায় বোদায় গেলে স্বপনদা ছুটে আসতেন। কত জিজ্ঞাসা নিয়ে আমার কাছে সেসবের উত্তর জানতে চাইতেন। তাঁর সব কৌতূহল মেটানোর সাধ্য আমার ছিল না। এর মধ্যে একটি দুর্ঘটনায় স্বপনদা একটি পা হারান। তিনি ক্র্যাচে ভর দিয়ে এক পায়ে হাঁটতেন। শেষদিকে সম্ভবত ছাত্র পড়িয়ে উপার্জন করতেন। ২০০৩ সালে স্বপনদার মৃত্যু হয়। তিনি রেখে গেছেন দুই মেয়ে ও এক ছেলেসন্তান। বৌদি তাঁর দেবরদের সহযোগিতায় ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছেন। বড় মেয়ে চৈতালি চন্দ সোমার বর ঝাড়বাড়ি কলেজের অর্থনীতির সহকারী অধ্যাপক। ছোট মেয়ে বিপাশা চন্দ দোলন বরিশালে বিয়ে হলেও এখন সম্ভবত বোদাতেই আছে। ছেলে সৌমিত চন্দ জয়দ্বীপ কৃতী ছাত্র। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে ভারতের গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করে ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছে। জয়দ্বীপ জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিল, সভাপতি হয়েছিল। বাম রাজনীতিতে তাঁর আগ্রহ হয়তো এখনো বহাল আছে। গুজরাটে যাওয়ার আগে দৈনিক সমকালে কিছুদিন সাংবাদিকতা করেছে। লেখালেখির হাত ভালো। এর মধ্যেই গবেষণামূলক কিছু গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ লিখে সুনাম অর্জন করেছে।

আমার বন্ধু হিমাংশু তপুও একজন সফল মানুষ। ঠাকুরগাঁওয়ে ওর একটি এনজিও আছে। অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। ছাত্রাবস্থাতেই তপু উপার্জনমুখী হয়েছে। প্রথমে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি, তারপর ঠাকুরগাঁওয়ে একটি কসমেটিকসের দোকান এবং সব শেষে শার্প নামে এনজিও প্রতিষ্ঠা। নানা ধরনের সামাজিক কাজকর্মেও তপু সময় দেয়। ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়েও ছাত্রাবস্থায় তপুর ভেতরের এত প্রতিভা সম্পর্কে আমরা কিছু আন্দাজ করতে পারিনি। তপুর একমাত্র ছেলে বুদ্ধদেব চন্দ তমাল কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করে এসে এখন বগুড়ায় একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছে। তমাল বিয়ে করে এক সন্তানের জনকও হয়েছে। আমার বন্ধু তপু গর্বিত দাদু হিসেবে পরিতৃপ্তি নিয়ে সংসার করছে।

ভাইদের মধ্যে ছোট প্রবীর চন্দ নয়ন। মূলত সে-ই এখন চন্দবাড়ির অভিভাবক। বোদার একজন সচেতন ও সংস্কৃতি মনস্ক মানুষ। দর্শনশাস্ত্রে পড়াশোনা করেও সাহিত্যে তাঁর অনুরাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন থেকেই। নিয়মিত কবিতা এবং নানা বিষয়ে প্রবন্ধ লিখে থাকে। দুটি কবিতার বইও বের হয়েছে। দুটি প্রবন্ধের বই প্রকাশের অপেক্ষায়। তার স্ত্রীও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। ছেলে শুভ্র প্রতিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করে একটি অ্যাড ফার্মে চাকরি করছে। মেয়ে দেবলীনা দৈবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের ছাত্রী।

চন্দবাড়ির মেয়েদের কথা কিছু না বললেই নয়। সুধীর চন্দের বড় মেয়ে জলপাইগুড়িতে থেকেছেন বলে তাঁর সঙ্গে আমার কখনো দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দু-তিনবার তিনি বোদায় এসেছেন। আমি তখন বোদা ছেড়েছি। ফলে শিবানী চন্দ আমার অদেখা বড় দিদি। কল্যাণী; অর্থাৎ সুনুদিই হলেন আমাদের দেখা বড় দিদি। কী হাসিখুশি মানুষ সুনুদি! মানুষকে আপন করে নেওয়ার শক্তি যেমন তাঁর আছে, তেমনি আছে প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে এগিয়ে চলার প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস।

আমাদের ছোটবেলায় সুনুদির বিয়ে হয়। প্রেমের বিয়ে। মধু জামাইবাবুও খুব সুন্দর ছিলেন। সুনুদি তো অবশ্যই সুন্দরী। ভালোই চলছিল সব। সময় গড়িয়ে দুটি ফুটফুটে পুত্রসন্তানের জনক-জননী হন তাঁরা। তারপর যে কোথা থেকে কী হয়। জামাইবাবুকে আর বোদায় দেখা যায় না। তিনি সংসারত্যাগী হন। কী দুঃসহ মর্মজ্বালা বুকে চেপে সুনুদি তাঁর দুই ছেলে মিহির ও বিজনকে মানুষ করার কাজটি সম্পন্ন করেছেন, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কারও পক্ষে বোঝা কঠিন। বাবা এবং পরিবারের সহযোগিতা-সমর্থন তিনি পেয়েছেন। কিন্তু আমাদের কুচুটে সমাজের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করা যে কত কঠিন, সেটা না বললেও চলে। সুনুদি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। তাঁর ছোট ছেলে বিজন সরকারও একটি প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। বড় ছেলে মিহির সরকার একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করত বলে শুনেছিলাম।

চন্দবাড়ির আরেক মেয়ে বেণু ওরফে নারায়ণী চন্দ, আমার বন্ধু এবং মামি। আমার মায়ের কোনো ভাইবোন নেই। তিনি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। তবে মায়ের কয়েকজন পাতানো ভাই আছে, যারা আমার মামা। এ রকম একজন হলেন নারায়ণ চন্দ্র সাহা। ঢাকার বিক্রমপুরে বাড়ি। চাকরির সুবাদে বোদায় যান গত শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। তিনি কিছুদিন লজিং থাকতেন আমার পিসার বাসায়; অর্থাৎ কার্তিকদা-জ্যোতিষদাদের বাসায়। তখন অবশ্য পিসেমশাই শরৎ চন্দ্র সরকার জীবিত ছিলেন। যা হোক, ওই বাসায় লজিং থাকার সুবাদেই হয়তো আমার মায়ের ভাই হয়ে যান নারায়ণ সাহা। আমার মামা। এই মামাই বিয়ে করেন চন্দবাড়ির মেয়ে বেণুকে। বন্ধু হেয় গেল মামি। বিয়ের পর নতুন সংসার গোছানোর আগে কিছুদিন তাঁরা আমাদের বাড়িতেই ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই এই পরিবারের সঙ্গেও আমার অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। একসময় এমনও ছিল যে, ঢাকা থেকে বাড়ি গেলে রাতটা আমি নারায়ণ মামার বাসাতেই কাটাতাম। ততদিনে তাঁদের মেয়ে ও ছেলে বড় হয়ে উঠতে শুরু করেছে। একটি বিষয় লক্ষণীয়। মামার নাম নারায়ণ আর যাকে বিয়ে করলেন তাঁর নাম নারায়ণী। আমাকে আমার দু-এক বন্ধু তখন ঠাট্টা করে বলত, আমার স্ত্রীর নাম নাকি হবে হয় বিভা, না হয় রঞ্জনা! না, সেটা হয়নি।

বেণুও প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারি করেছে। ছেলে বাপ্পা ওরফে স্বরূপ সাহা এসএসসি পাস করে কলকাতায় চলে যায়। এমবিএ পাস করে বাপ্পা এখন বেঙ্গালুরুতে আছে বলে শুনেছি। বাপ্পা আমাকে মামা বলে ডাকে। কী অদ্ভুত সামাজিক সম্পর্কগুলো! বেণুর মেয়ে শম্পা কিছুদিন ঢাকায় ছিল। তারপর নাকি আমেরিকায় চলে গেছে। নারায়ণ মামার জীবনাবসান হয়েছে। মামি এখন অবসরজীবন যাপন করছেন।

নটে গাছটি মুড়োল, চন্দবাড়ির গল্প ফুরোল।

লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

সাক্ষাৎকার

এখন একটা আজব পরিস্থিতি বিরাজ করছে

ডা. মুশতাক হোসেন

ডা. মুশতাক হোসেন এরশাদবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা, ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য। তিনি কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছেন। পেশাজীবনে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ছিলেন। সিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদ—এ চারটি বামপন্থী দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর না করার কারণ নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা

মাসুদ রানা
আপডেট : ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৭: ৫৩

আপনারা কেন জুলাই সনদে স্বাক্ষর না করার সিদ্ধান্ত নিলেন? আপনাদের মূল আপত্তিগুলো কী ছিল?

আমাদের প্রথম আপত্তি ছিল ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা ভিন্নমত সংযুক্ত না করা। যেসব বিষয়ে সবাই মিলে একমত হয়েছি বা মোটামুটি একমত হয়েছি, সেসব যুক্ত করা ছাড়া আমরা স্বাক্ষর করব না। যেহেতু ‘নোট অব ডিসেন্ট’সহ কিছু বিষয়ে আপত্তি ছিল, সেটা স্বাক্ষর করলে তো মেনে নেওয়া হতো। সেটা জাতীয় সংসদে হলে অন্য কথা ছিল বা কোনো রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে সেটা হতে পারে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বা সংখ্যালঘিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে সেটা মেনে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু ঐকমত্য কমিশন সে রকম কোনো ফোরাম না। এটা হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে ঐকমত্যে আসার জন্য একটা চেষ্টা, একটা উদ্যোগ।

জুলাই সনদ তৈরি করার সময় এর পটভূমি ধরে আমরা ইতিহাসকে সঠিকভাবে লেখার জন্য বারবার ইনপুট দিয়েছি। আমাদের দলসহ অন্য দলের নেতারা সেটা বলেছেন। কিন্তু সনদে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানকে পুরোপুরি গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। যদিও ছোট ছোট অনেক ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টা কীভাবে এল, সেটা তো থাকা দরকার এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তো থাকতে হবে। যদিও বিশাল আকারে ইতিহাস লেখার জায়গা এটা না। শেষে আসবে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের ঘটনা। এর মধ্যে মাঝখানের ঘটনাগুলো শুধু উল্লেখ করলেই চলত। সেটা তো করা হয়নি। যাঁরা খসড়াটি করেছেন, তাঁদের আমি অবশ্যই অযোগ্য বলব না। একেকজনের কথায় একেকটা বিষয় ঢুকে গেছে। কারও সঙ্গে তাঁরা বিতর্ক করেননি। ফলে আমাদের বক্তব্যগুলোকে বেমালুম বাদ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা মনে করেছেন, আমাদের বক্তব্য বাদ দিলে বুঝি কোনো সমস্যা হবে না। আবার কোনো কোনো দল যা-ই বলেছে, সেটাই তাঁরা রেখেছেন; যেখানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অসম্পূর্ণ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বক্তব্য একপেশে হয়েছে।

আবার অঙ্গীকারনামায় উল্লেখ করা হয়েছে, এই সনদ বাস্তবায়নের জন্য পরিপূর্ণভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকতে হবে। আমাদের কথা হলো, এই সনদ পরিপূর্ণ হলে সেখানে ‘নোট অব ডিসেন্ট’গুলো লিপিবদ্ধ থাকত। কিন্তু সেসব রাখা হয়নি। সনদের ভেতরে আবার তাঁরা লিখেছেন—যে দল সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে, ‘নোট অব ডিসেন্ট’ ছাড়া কাজ করতে পারবে। যারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না, তারাও তো কাজ করবে। তারা প্রয়োজনবোধে একমত না হলে সংসদ ত্যাগ করবে। নতুবা সংসদের বাইরে সভা-সমাবেশের মাধ্যমে জনগণের কাছে মতামত তুলে ধরবে। এসব তো ম্যান্ডেট পাওয়া না-পাওয়ার ওপর নির্ভর করে না।

এটা তো বিএনপির ভাষা। বিএনপি মনে করে, তারা ম্যান্ডেট নিয়ে আগামী সংসদে যাবে। সেটা ভালো কথা। কিন্তু আমরা ম্যান্ডেট পাব কি পাব না সেটা ভিন্ন কথা। আমরা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছি চুপ না থাকার জন্য। আমরা যেমনভাবে সংসদের ভেতরে কথা বলব, তেমনি সংসদের বাইরেও কথা বলব। আমরা আবার রাজপথে আন্দোলনও করব। সবকিছু মিলিয়ে আমরা কয়েকটি বামপন্থী দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর করিনি।

তবে আমরা সংবাদ সম্মেলন করে বলেছি, যেসব বিষয়ে আমরা সহমত জ্ঞাপন করেছি (সেটার রেকর্ড আছে) সেটা খুব ভালো কাজ হয়েছে। আমরা ঐকমত্য কমিশনকে ধন্যবাদ জানাই যে সাংবিধানিক প্রশ্ন, আইনের প্রশ্নসহ সংস্কার নিয়ে সব রাজনৈতিক দলের মতামত নিয়ে তারা একটা ঐতিহাসিক দলিল তৈরি করতে পেরেছে। এই দলিল থেকে বোঝা যাবে, কোন দলের কী দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু আমরা বলেছি, গায়ের জোরে সংবিধান বাতিল করার দাবি—এটা অসাংবিধানিক অপরাধ। আমরা মনে করি, সংবিধান বাতিল করার দাবি তোলা যাবে এবং নতুন সংবিধান করার দাবিও তোলা যাবে—সেটা রাষ্ট্রদ্রোহ হবে না। কিন্তু অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে যদি বাতিল করতে চায়, সেটা অবশ্যই রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ। তারা ৭ (ক) ধারার বাতিল করার প্রস্তাব করেছে। এটা নিয়ে আমরা আপত্তি করেছি। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টে উচ্চকক্ষে আমরা পিআর পদ্ধতির পক্ষে, কিন্তু দুই বাসদ ও সিপিবি উচ্চকক্ষে পিআরের পক্ষে না।

তবে আমরা যে কয়েকটি বাম দল এসব বিষয়ে একমত হয়েছি, আমরা আগামী দিনে সংসদের ভেতরে ও বাইরে এসব নিয়ে সংগ্রাম এবং রাজনৈতিকভাবে জনমত গঠনের কাজ করব। সেটা আমরা অঙ্গীকার করেছি।

এরপর আপনারা একটা স্মারকলিপি দিয়েছেন। এটা দেওয়ার কারণ কী?

আমরা কেন জুলাই সনদে স্বাক্ষর করলাম না, সেটা নিয়ে আমরা একটা সংবাদ সম্মেলন করেছি। সেই সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যটা আমাদের দুজন প্রতিনিধি হাতে হাতে ঐকমত্য কমিশনের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।

স্মারকলিপি দেওয়ার পর ঐকমত্য কমিশনের বক্তব্য কী?

তারা বলেছে, আপনারা অনেক কষ্ট করে, সময় নিয়ে বক্তব্য বা নোট দিয়েছেন, আপনারা এটার অংশীদার হন। আমরা বলেছি, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আর বিএনপির দৃষ্টিভঙ্গি এক নয়। জাতীয় সংসদে সিদ্ধান্ত হওয়ার আগে কেন আমরা আত্মসমর্পণ করব মৌলিক, দার্শনিক ও রাজনৈতিক প্রশ্নে? বিএনপি যেমন প্রত্যাশা করছে, তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে। তারাসহ তাদের মিত্ররা দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পাবে। তারা যেসব নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে, সেগুলোতে তারা পক্ষে নিতে পারে। কিন্তু সংসদে যাওয়ার আগেই আমাদের মেনে নিতে হবে, সংবিধান বাতিলের ১৪ ধারা রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ না, নারী ১০০ আসনে সরাসরি নির্বাচনের দরকার নেই, সংবিধানের ১৫০ (২) ধারা মতে শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ না থাকা—এ বিষয়গুলো এড়িয়ে গিয়ে তো আমরা সনদে স্বাক্ষর করে দাসখত দিতে পারি না। এই ফাঁদেও পা দিতে পারি না। আমরা স্পষ্ট করে বলেছি, এসব বিষয় যদি সংশোধন না করা হয়, তাহলে আমরা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করতে পারি না।

এনসিপি সনদের বাস্তবায়নের পদ্ধতির প্রশ্ন নিয়ে স্বাক্ষর করেনি। এটাকে আপনারা কীভাবে দেখেন?

তাদের তো সনদ নিয়ে কোনো দাবি নেই। তারা সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে চাপ সৃষ্টি করছে। আমাদের তো সনদের খসড়া নিয়েই আপত্তি। কিন্তু তাদের কোনো আপত্তি নেই। তারা শুধু বাস্তবায়ন পদ্ধতির বিতর্ক তুলে স্বাক্ষর করেনি।

আপনি নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা ছিলেন। সে সময়ে তিন জোটের রূপরেখাকে পরবর্তীকালে ক্ষমতাসীন কোনো দলই গুরুত্ব দেয়নি। এখন আপনি জুলাই সনদ নিয়ে কতটা আশাবাদী?

নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের তিন জোটের রূপরেখাকে নির্দিষ্ট করে সংবিধানের সঙ্গে আপগ্রেড করা হয়নি। সে সময় যে তিনটি জোট এই রূপরেখাতে স্বাক্ষর করেছিল, তারা কিন্তু পরবর্তী সময়ে তার অনেক কিছুই মানেনি। তারা সেখানকার রাজনৈতিক অঙ্গীকারও পালন করেনি। তা ছাড়া, এটার কোনো আইনি রূপও দেওয়া হয়নি। কথা ছিল তারা পরস্পরের প্রতি কোনো বৈরী আচরণ করবে না। সেই রাজনৈতিক অঙ্গীকারও পালন করেনি। পরস্পর পরস্পরকে ধ্বংস করার জন্য এক দল অন্য দলের প্রতি বিরূপ আচরণ করেছে। এগুলোকে কোনোভাবেই রাজনৈতিক আচরণ বা সাংবিধানিক আইন মেনে চলা বলা যায় না।

কিন্তু এবারের জুলাই সনদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এর ধারা ও উপধারা ধরে বিতর্ক করে কে পক্ষে আছে আর কে বিপক্ষে আছে, তা নিয়ে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। সে কারণে বলতে চাই, নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের তিন জোটের রূপরেখার সঙ্গে এবারের জুলাই সনদটা অনেক অগ্রসর দলিল বলতে হবে। কোনো দল যদি এর কোনো বক্তব্য সুনির্দিষ্টভাবে পালন করতে না চায়, তাহলে সব রাজনৈতিক দল তার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যাবে। জুলাই সনদ একেবারেই সুনির্দিষ্ট। কিন্তু নব্বইয়ের রূপরেখা এভাবে সুনির্দিষ্ট ছিল না। আবার সেই রূপরেখার মধ্যে কোনো গভীরতা ছিল না। তারপরেও যে কিছু হয়নি, সেটা বলা যাবে না। কারণ, নব্বইয়ের পরে সব দল কিন্তু সংসদীয় সরকার পদ্ধতির দিকে অগ্রসর হয়েছে। যদিও পরবর্তী সময়ে সেই সংসদীয় সরকার পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার পরেও নানা অঘটন ঘটেছে।

বাংলাদেশের রাজনীতি আসলে কোন দিকে যাচ্ছে?

এখন দ্রুত দরকার একটা সংসদ নির্বাচন করা। যে নির্বাচিত সরকার জনগণের কাছে জবাবদিহি করবে। এখন কোনো জবাবদিহি করা যাচ্ছে না। আমরা যেভাবে গত স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে পেরেছি, এখন কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে তা করতে পারছি না। এখন কোনো বিষয়ে সরকারের কাছে অভিযোগ উত্থাপন করলে তারা বলে, কোনো কিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। আবার পুলিশও একই কথা বলছে।

রাজনৈতিক দলগুলো দেশটাকে ভাগাভাগি করার মতো করে কথা বলছে। এক দল আরেক দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে, আবার সবাই মিলে ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে। এখানে এখন একটা আজব পরিস্থিতি বিরাজ করছে। মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা দেওয়ার নিশ্চয়তা এ সরকার দিতে পারছে না। এ জন্য নির্বাচন করা দরকার। যদিও সুষ্ঠু নির্বাচন করা নিয়ে অনেকে শঙ্কা প্রকাশ করছেন। তারপরও নির্বাচনের মাধ্যমে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তখন আমরা একটা রাজনৈতিক ব্যাকরণের মধ্যে প্রবেশ করতে পারব।

নির্বাচিত সরকার ভালো কাজ করলে পক্ষে থাকব আর মন্দ কাজ করলে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করব। আগে থেকে বলা সম্ভব নয়, যারা দায়িত্বে থাকবে তারা কতটুকু পারছে বা পারছে না। তারা যদি জনগণের পক্ষে না থাকে, তাহলে প্রয়োজনে আগাম নির্বাচন দাবি করব।

সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

আপনাকেও ধন্যবাদ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ঢাকার অন্য খালগুলোও তো এমন সুন্দর হতে পারে

মৃত্যুঞ্জয় রায় 
আপডেট : ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ১৮: ০৮
কুড়িল বিশ্বরোডের কাছে সুশোভিত নিকুঞ্জ খাল। ছবি: লেখক
কুড়িল বিশ্বরোডের কাছে সুশোভিত নিকুঞ্জ খাল। ছবি: লেখক

কুড়িল বিশ্বরোডের ফুটওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে একটি খালের চমৎকার শোভা দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। ঢাকার বুকে এত সুন্দর একটা খাল! ধনুকের মতো বাঁক খেয়ে চলে গেছে দূরে, দুই পাড়ে হাঁটার রাস্তা। রাস্তা আর খালের পানির মাঝে সবুজ ঢাল সিঙ্গাপুর ডেইজির শায়িত লতায় আচ্ছাদিত। আহা, কী পরিষ্কার সেই খালের জল, কোথাও একটা শুকনো পাতা পড়ে নেই জলের ওপর। খালের পাড়ে স্বর্ণচাঁপা, বকুল, কাঠবাদাম, চালতা, ছাতিম গাছগুলোর ছত্রবৎ পত্রাচ্ছাদন, গোড়া বাঁধানো নারকেলগাছের সারি। খালের জলে সাঁতরে বেড়াচ্ছে, লাফ দিচ্ছে মাছেরা। মাঝে মাঝে পাড়ে রয়েছে জলের ওপর বাড়ানো জেটির মতো রেলিংঘেরা পাকা চাতাল, যার ওপর দাঁড়িয়ে জলের কাছে যাওয়া যায়, খালের জলে বড়শি ফেলে মাছ ধরা যায়। ওপরে হেমন্তের ঝকঝকে নীল আকাশ, রোদের ঝিলিক। খালের পশ্চিম পাড়ে একটি অভিজাত এলাকার মনোরম ভবন। দেখে মনে হচ্ছে, এ যেন ঢাকা শহর নয়—নেদারল্যান্ডসের কোনো এক জায়গা।

নেদারল্যান্ডসের গিথুর্ন গ্রামের ছবি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা হয়তো জানেন, সেই গ্রামে গাড়ি চালানোর মতো কোনো রাস্তা নেই, আছে গ্রামজুড়ে চলাচলের জন্য চমৎকার খাল আর হাঁটার পথ। একটা গ্রামে কোনো গাড়ির রাস্তা নেই, খাল ও খালের ওপর আছে ১৭০টির বেশি সেতু। বৈদ্যুতিক নৌকায় করে সেই গ্রামের অধিবাসীরা এখান থেকে সেখানে যায়। আহা, গাড়ি ও জ্বালানির দূষণমুক্ত কী শান্ত মনোরম সে গ্রাম! খালের পাড় বাঁধানো, দুই পাড়ে থাকা অনুচ্চ ঘরবাড়ি, আঙিনার কোথাও কোনো খোলা মাটি নেই, পুরোটাই সবুজ কার্পেটের মতো ঘাসে ঢাকা, মাঝে মাঝে ফুলগাছের ঝোপ। যেন সে এক স্বপ্নের জায়গা, পৃথিবীর বুকেই স্বর্গের শোভা। ঢাকার এ জায়গাটি দেখেও সেই গিথুর্ন গ্রামের ছবিটা চোখে ভাসছিল। ধন্যবাদ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনকে—নিকুঞ্জ খালের এমন সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য।

আহা রে, ঢাকা শহরের সব খাল যদি এরূপ সুন্দর হতো! এ কথা ভাবতেই মনের মধ্যে ভেসে উঠল এর বিপরীত দৃশ্য। খাল দখল করতে করতে সেগুলো সংকুচিত হয়ে পড়েছে। যতটুকু অবশিষ্ট আছে, সেগুলোও হয়ে পড়েছে ময়লার ভাগাড়, কচুরিপানা ও ঝোপঝাড়ে ভরা মশককুলের অভয়ারণ্য। বিভিন্ন কলকারখানার বর্জ্য নির্গমনের নিকাশনালার মতো ব্যবহৃত হচ্ছে কোনো কোনো খাল। পচা দুর্গন্ধযুক্ত অস্বাস্থ্যকর সেই পরিবেশেই কেটে যাচ্ছে পথচারী ও এলাকাবাসীর দিনকাল। খালগুলো যেভাবে মরতে বসেছে, তাতে আগামী ১০ বছরও লাগবে না ঢাকা শহর খালশূন্য হতে। ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকা শহরে খালের সংখ্যা ৪৭টি। রিভার অ্যান্ড ডেল্টা সেন্টারের গবেষণা অনুযায়ী ৫৬টি। ড্যাপেও খালের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে ৪৩টি।

ধরা হয়, অতীতে ঢাকা শহরে ৪৭টি খাল সচল ছিল। শহরের চারপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদের সঙ্গে যুক্ত ছিল সেসব খাল। নৌকা ও নৌযান চলত সেসব খালে। পণ্য পরিবহন ও লোক চলাচলে সে সময় খালগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। একসময় শাহবাগ থেকে মগবাজার পর্যন্ত একটি খাল ছিল—পরীবাগ খাল। ঢাকা ওয়াসার মানচিত্রে তার অস্তিত্বের কথা জানা যায়। সেই খাল আর এখন নেই। এভাবে ধোলাই খাল, রায়েরবাজার, গোপীবাগ, নারিন্দা, সেগুনবাগিচা, কাঁঠালবাগান, ধানমন্ডি ইত্যাদি খালগুলোরও এখন আর অস্তিত্ব নেই। ধানমন্ডি লেকটাই একসময় ছিল খাল, হাতিরঝিলের খালে পিলখানা থেকে হাতির পালকে নিয়ে যাওয়া হতো গোসল করাতে। মোগল শাসকেরা ঢাকা শহরে বহুসংখ্যক খাল থাকায় ঢাকাকে রাজধানী করার চিন্তা করেছিল, খালগুলো তাদের চলাচল ও প্রতিরক্ষার জন্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ। শহরের জলাবদ্ধতা দূর ও পানি নিষ্কাশনের জন্যও ছিল সেগুলো সহায়ক। সেসব এখন ইতিহাস। এখন এক ঘণ্টা বৃষ্টি হলেই ঢাকা শহরের অনেক এলাকায় হাঁটুপানি জমে যায়।

ঢাকা শহরের সব খাল উদ্ধার করা প্রথম কাজ। উদ্ধারের পর সেসব খালের দুই পাড়ে ওয়াকওয়ে বা হাঁটার পথ তৈরি ও বাহারি গাছপালা লাগিয়ে সুশোভন করা দ্বিতীয় কাজ। তৃতীয় কাজ হলো খালগুলোতে নিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যাটারি, বিদ্যুৎ ও হস্তচালিত নৌযান চালনার উদ্যোগ নেওয়া। জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক কোনো নৌযান সেসব খালে চলাচলের অনুমতি না দেওয়া হবে খালের জলজ জীবগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা এবং দূষণ কমানোর গুরুত্বপূর্ণ উপায়। ওয়াকওয়ে যেন শুধু ওয়াক তথা হাঁটার জন্যই ব্যবহৃত হয়, সে রাস্তায় যেন কোনো গাড়ি বা মোটরসাইকেল না চলে। সবশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো খাল এবং তার চারপাশের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন ও দূষণমুক্ত রাখতে উত্তম ব্যবস্থাপনার চর্চা অব্যাহত রাখা। খাল ব্যবহারকারী থেকে শুরু করে সেখানকার সব অংশীজনের সক্রিয় অংশগ্রহণই এসব ব্যবস্থাপনাকে সুচারুরূপে বাস্তবায়নের মূল সূত্র, এর সঙ্গে থাকবে সঠিক পরিকল্পনা ও নির্দেশনা, উদ্বুদ্ধকরণ ও সচেতনার প্রচারণা। এ কাজে দরকার রাষ্ট্রীয় বা সরকারের সদিচ্ছা ও সিদ্ধান্ত, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও প্রকল্প গ্রহণ, রাজনৈতিক ঐকমত্য এবং জনগণের অংশগ্রহণ। অনেক তরুণ এখন স্বেচ্ছাসেবী হয়ে এরূপ কাজে অংশ নিতে আগ্রহী। তাদের উৎসাহিত করে নিরাপদভাবে কাজের সুযোগ করে দিতে হবে। সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত মালি ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা কাজ করবেন জবাবদিহির মধ্যে, স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে মিলেমিশে। শোভাবর্ধনের চারাগুলোর ব্যবস্থা করতে হবে সিটি করপোরেশনগুলোকেই। তবে এককভাবে শুধু দুই সিটি করপোরেশনের ওপর সম্পূর্ণ বিষয়টি চাপিয়ে দিলে হবে না। খালগুলোর দখলদারেরা অনেক শক্তিশালী, নিশ্চিত যে তাঁরা কেউই সেসব খালের দখল স্বেচ্ছায় ছাড়বেন না। দখলমুক্ত করার জন্য জোর প্রশাসনিক প্রচেষ্টা ও আইন প্রয়োগ করা দরকার।

প্রকৃতিতে প্রবহমান নদী আর খালগুলো হলো আমাদের দেহের শিরা-উপশিরার মতো। একটি ভূখণ্ডের জীবনরেখা বলা হয় এসব জলস্রোতকে। প্রবহমান এসব জলাশয় যেমন জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি মাটিসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্যও সহায়ক। ঢাকা শহরের প্রায় দুই কোটি মানুষের স্বাস্থ্যের কথা ভেবেও খালগুলোকে সচল করা দরকার। বর্তমানে ঢাকা শহরে ২৬টি খালের অস্তিত্ব চোখে দেখা গেলেও বাকি ২১টি খাল নেই। কোথায় কোথায় সেসব খাল ছিল, তা নিশ্চয় অতীতের মানচিত্রগুলোতে পাওয়া যাবে। সেগুলো আদৌ উদ্ধার বা দখলমুক্ত করা যাবে, তা দুরাশা। উদ্ধার করা গেলে সেগুলো খনন করে সচল ও শোভাময় করা উচিত। জার্মানির বার্লিন শহরে খালে করে ক্যানালক্রুজ করার সময় খালপাড়ের দুই পাশের বিভিন্ন স্থাপনা ও নাগরিক সৌন্দর্য, সেতু, রেস্তোরাঁ দেখতে দেখতে অভিভূত হতাম। ভাবতাম, জলের দেশ, নদীর দেশ, খালের দেশ বাংলাদেশ; অথচ সে দেশের শহরগুলোর খালে কেন এ রকম নৌ-পর্যটন করা যাবে না?

খালপাড় ভেঙে যাতে কোনো নগরবাসীর এক ফুট জমিও নষ্ট না হয়, সে জন্য ভেনিস, কোপেনহেগেন, প্যারিস ইত্যাদি শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া খাল ও নদীর দুই পাড় যেভাবে পাকা করে বাঁধাই করে রাখা হয়েছে, সেভাবে আমাদের প্রবহমান খালগুলোর পাড়ও বেঁধে দেওয়া যায়। নগরীর খালগুলো নিয়ে একটি চমৎকার পরিকল্পনার সুযোগ রয়েছে ড্যাপ বাস্তবায়নের কারণে। চলাচল, পরিবহন, জলাবদ্ধতা নিরসন, দূষণ হ্রাস, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, পর্যটন, সৌন্দর্যবর্ধন, স্থানীয় মানুষের আয়বর্ধন, পরিবেশ উন্নয়ন ইত্যাদির জন্য এ ধরনের পরিকল্পনা ও জরিপকাজ নিশ্চয় সহায়ক হবে। সবার মনে রাখা উচিত, প্রাকৃতিক প্রবাহকে রুদ্ধ করার অধিকার কারও নেই, তার ফল কখনো ভালো হয় না। এ নিয়ে কোনো খণ্ডিত পরিকল্পনা নয়, নিতে হবে সমন্বিত সামগ্রিক পরিকল্পনা। তাহলে আমরাও দেখতে পাব একটি মনোরম মহানগর, সুশোভিত খালসমৃদ্ধ একটি সুশোভন পরিবেশ। কুড়িল বিশ্বরোডের কাছে নিকুঞ্জ খালটি যদি এত সুন্দর করা যায়, সুন্দর রাখা যায়, তাহলে অন্যগুলো কেন এরূপ সুন্দর হবে না?

মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইউএনও এবং বাল্যবিবাহ

সম্পাদকীয়
আপডেট : ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ১৮: ০১
ইউএনও এবং বাল্যবিবাহ

পিরোজপুরের নেছারাবাদে যে ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য ইউএনও সাহেব ধন্যবাদ পেতেই পারেন। সেখানে একটি বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছিলেন তিনি সপরিবারে। কিন্তু যখন জানতে পারলেন, বিয়ের কনে প্রাপ্তবয়স্ক নয়, তখন তিনি না খেয়েই ফিরে আসেন। এবং তিনি ফিরে আসায় কাজিও বিয়ে পড়াননি। ফলে এই বাল্যবিবাহ হয়নি।

বহু প্রচার করার পরও কোথাও কোথাও অপ্রাপ্তবয়স্ক নারী বা পুরুষের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে পরিবারের পক্ষ থেকে। কোথাও কোথাও সচেতনতা তৈরি হচ্ছে, কোথাও কোথাও তৈরি হচ্ছে না। অনেকে ভুলে যাচ্ছেন, কেন অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের বিয়ের পিঁড়িতে না বসানোই মঙ্গল।

বাল্যবিবাহের শিকার অল্প বয়সী মেয়েরা শারীরিক ও মানসিকভাবে বিয়ের জন্য প্রস্তুত থাকে না। এতে মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু, পুষ্টিহীনতা এবং প্রসবজনিত জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কম বয়সে সন্তানের মা হয়ে যাওয়ার কারণে তাদের পক্ষে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে এবং অনেক সময় তারা শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ঝরে পড়ে। সমাজের একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ নষ্ট হয়। আত্মনির্ভরশীল হতে না পারার কারণে সংসারে নানা ধরনের সংকটে তাদের পড়তে হয়। শিক্ষাবঞ্চিত ও অল্প বয়সে সংসার শুরু করা মেয়েরা সাধারণত আর্থিকভাবে নির্ভরশীল থাকে। এতে পরিবারে দারিদ্র্য দূর হয় না, বরং প্রজন্মের পর প্রজন্ম তা চলতে থাকে।

এতে যে নারীর অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, সেটাও বিবেচনায় আনা দরকার। বাল্যবিবাহের কারণে একটি মেয়ে নিজস্ব মতামত-সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এবং স্বাধীন জীবনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারে। সামাজিকভাবে সে হেয় হতে থাকে। সংসারে তার মতামতের কোনো মূল্য থাকে না। পুরুষশাসিত সমাজে এমনিতেই মেয়েরা থাকে কোণঠাসা হয়ে, বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েটি সে ক্ষেত্রে আরও ভঙ্গুর অবস্থায় থাকে। এ যেন তার ব্যাপারে সামাজিক নিপীড়নের জন্য একটি মুক্ত জায়গা হয়ে দেখা দেয়।

একজন মানুষ যেন মুক্ত, স্বাধীন চিন্তার অধিকারী হয়ে বেড়ে উঠতে পারে, সমাজে অর্থনৈতিক অবদান রাখার মতো করে নিজেকে তৈরি করে নিতে পারে, সেসব দিক বিবেচনা করা না হলে সংকটে পড়ে রাষ্ট্র।

পিরোজপুরের নেছারাবাদের ঘটনাটি আশার আলো জাগায়। যদিও ইউএনও বিয়ের অনুষ্ঠানে বাধা দেননি, তবু তিনি সেখানে অংশ না নিয়ে প্রতিবাদস্বরূপ চলে যাওয়ায় বিয়েটা হয়নি বলে একটি ভালো কাজ হয়েছে। যখন সমাজের একটি বড় অংশ অল্প বয়সে বিবাহ ও মাতৃত্বে জড়িয়ে পড়ে, তখন তারা কর্মক্ষম নাগরিক হিসেবে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে না। ফলে জাতির অগ্রগতিতেও বাধা সৃষ্টি হয়। অপ্রাপ্তবয়স্ক যে মেয়েটি অভিভাবকদের কারণে বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছিল, এখন হয়তোবা সে তা থেকে মুক্ত হবে। অভিভাবকেরাও সচেতন হয়ে এই শিশুকে শারীরিক, মানসিক, শিক্ষাগত ও সামাজিক সুরক্ষা দিতে পারেন। তাতে একটি সমৃদ্ধ ও সমানাধিকারের সমাজ গঠিত হওয়ার পথে তাঁরা অবদান রাখতে পারেন।

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

বিষাক্ত গ্যাস

সম্পাদকীয়
বিষাক্ত গ্যাস

মিরপুরের শিয়ালবাড়ী এলাকায় একটি রাসায়নিক গুদামে আগুন লাগার পর যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল, সে কথা সবাই এখন জানেন। যাঁরা স্বজন হারিয়েছেন, তাঁরা জানেন এটা তাঁদের পরিবারের জন্য কত বড় ক্ষতি। নিহতদের পরিবার ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে কি না, তাদের জীবনে স্থিতি ফিরিয়ে আনতে কী করা দরকার—তা নিয়ে সংশ্লিষ্টরা নিশ্চয়ই ভাববেন। এ রকম একটা অবস্থায় দুর্ঘটনা-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে খুব কম মানুষই মাথা ঘামায়। দুর্ঘটনা-পরবর্তী সময়টিতে স্থানীয় পরিবেশ ও পরিস্থিতি যে মোটেও অনুকূল থাকে না, সেটা বোঝা দরকার।

সম্প্রতি আমাদের প্রতিবেদক শিয়ালবাড়ীর ক্ষতিগ্রস্ত রাসায়নিক গুদামে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে তিনি দেখেছেন, এতগুলো দিন পার হওয়ার পরও বিষাক্ত রাসায়নিকের কারণে এখনো অসুস্থ হচ্ছে মানুষ। রাসায়নিকের ড্রাম থেকে নির্গত বিষাক্ত গ্যাস ও ধোঁয়া মানুষকে অসুস্থ করে দিচ্ছে। অসুস্থদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধরা রয়েছেন ঝুঁকির মধ্যে। প্রায়ই দেখা যায়, একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর দু-এক দিন সংবাদপত্রে রিপোর্ট হয়, তারপর একসময় সেটা ভুলে যায় মানুষ। কিন্তু যে মানুষেরা ভুক্তভোগী, তাদের প্রতিটি দিনই যে কাটছে ভয়ংকর রাসায়নিকের সঙ্গে লড়াই করে, সে খবর কয়জন রাখে?

চিকিৎসকেরা বলেছেন, অগ্নিকাণ্ডের কয়েক দিন পরও বিষাক্ত গ্যাস ও ধোঁয়ার ঘনত্ব বেশি থাকে। পরে ধীরে ধীরে তা কমে যায়। মাটিতে পড়ে থাকা রাসায়নিক দ্রব্যের অবশিষ্টাংশ ভুক্তভোগীর শরীরে ঢোকে। ঘন ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ার কারণে বাতাসে ভাসমান ক্ষুদ্র ধূলিকণা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে যায়। এই কারণে ভবিষ্যতেও তা বিপদ সৃষ্টি করতে পারে।

বিষাক্ত কণিকা বা গ্যাস মানবদেহে ঢোকে শ্বাসের মাধ্যমে, ত্বকের মাধ্যমে এবং খাদ্যের মাধ্যমে। এই গ্যাস অ্যাজমা, কাশি, গলাজ্বলা বা শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। চোখ আর ত্বকও তাতে আক্রান্ত হতে পারে। তৈরি হতে পারে মাথাব্যথা, বমি ও ক্লান্তির মতো ঘটনা। ভারী ধাতু দীর্ঘ মেয়াদে স্নায়ুতন্ত্র দুর্বল করে দেয়। তাতে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে।

শিয়ালবাড়ীর দুর্ঘটনাস্থলের অন্তত এক হাজার গজ পর্যন্ত এলাকায় বাতাসে এখনো পোড়া জিনিস ও গ্যাসের মতো কটু গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তাতে মনে হয়, এই এলাকার মানুষের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি এখনো রয়েছে সংকটের মুখে।

আমরা সবাই জানি, স্বাস্থ্য আমাদের মৌলিক অধিকারের একটি। কিন্তু দেশের মানুষ এ কথাও জানে, সেই মৌলিক অধিকার সব সময় সমুন্নত রাখা হয় না। রাসায়নিক গুদামে অগ্নিকাণ্ড ঘটলে কীভাবে তার মোকাবিলা করতে হবে, তার পূর্বপ্রস্তুতি কয়টি গুদামে আছে? এসব জায়গায় কি নিয়মিত ইন্সপেকশন হয়? শুধু গুদাম কেন, কারখানাগুলোয় কি সঠিক নিরাপত্তাব্যবস্থা রয়েছে? শ্রমিকেরা কি নিরাপদে তাঁদের কাজ করে যেতে পারেন?

এসব দুর্ঘটনায় মূলত সমাজের নিচুতলার মানুষেরা বিপদে পড়েন। তাঁদের পাশে যদি দাঁড়ানো না হয়, তাহলে বুঝতে হবে, শিল্প-ব্যবস্থাপনায় যে ঘাটতি আছে, তা নিরসনের কোনো চিন্তা কারও নেই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত