বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্তির পরও কর্মহীন থাকলে তা তরুণদের মধ্যে একটা হতাশার সৃষ্টি করে। সে কর্মহীনতার সময়কাল দীর্ঘায়িত হলে তা উপর্যুক্ত হতাশাকে আরও গভীর করে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে সে হতাশার আর্থিক ও মানসিক মাত্রিকতা রয়েছে; কিন্তু সামষ্টিক পর্যায়ে সে হতাশার সামাজিক ও রাজনৈতিক মাত্রিকতা রয়েছে। তারুণ্যের হতাশা শুধু নেতিবাচক নয়; কাঙ্ক্ষিতও নয় মোটে।
সেলিম জাহান

সংবাদটি অনেকটা নীরবেই এসেছে সংবাদপত্রে—দৃষ্টিও কাড়েনি তা বড় একটা। হয়তো সেটি তেমন কোনো উত্তেজক বিষয় নয় বলে; কিংবা তা সরব কোনো সংকট না হওয়ার কারণে। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে, সংবাদটি একটি অশনিসংকেত বয়ে আনে। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সনদপ্রাপ্ত প্রায় ৯ লাখ তরুণ কর্মহীন। ২০১৩ সালে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্ত কর্মহীন তরুণের সংখ্যা ছিল ২ লাখ। সুতরাং গত ১২ বছরে সংখ্যাটি চার গুণের বেশি বেড়েছে। দেশে কর্মহীন লোকের সংখ্যা যদি ২৭ লাখ হয়, তাহলে তার এক-তৃতীয়াংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্ত। এ চিত্রটি স্বাভাবিকভাবেই কতগুলো প্রশ্নের জন্ম দেয়। যেমন দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা যদি তরুণদের কর্মনিয়োজন নিশ্চিত না করতে পারে, তাহলে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কি ব্যর্থ, সেটা কি তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলেছে? এই বিপুল কর্মহীন তারুণ্য কি সম্পদের, সুযোগের অপচয় নয়? কিংবা এমন একটি চালচিত্র নিয়ে বাংলাদেশ কি করে একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বে প্রতিযোগিতা করবে?
এসব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য তারুণ্যের কর্মহীনতার সামষ্টিক এ চিত্রটিকে একটু বিভাজিতভাবে দেখা যাক। এক. উপাত্ত বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্ত কর্মহীন তরুণদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৬ লাখ, নারীদের সংখ্যা ৩ লাখ। এর দুটো কারণ থাকতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ পেয়েও মেয়েরা কম সংখ্যায় শ্রমবাজারে আসে। ফলে তাঁরা যে কর্মহীনতায় কম সংখ্যক, সেটা সেই বাস্তবতার প্রতিফলন হতে পারে। কিংবা সত্যি সত্যিই কমসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্ত তরুণী কর্মহীন। দুই. নানা স্তরের শিক্ষাপ্রাপ্ত কর্মহীন তরুণদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্ত তরুণদের হার সবচেয়ে বেশি। মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার যেখানে ৩ শতাংশ, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্ত তরুণদের মধ্যে সে হার হচ্ছে ১৪ শতাংশ—চার গুণের বেশি। তিন. বাংলাদেশে প্রায় ৮৬ লাখ তরুণ শিক্ষায়, কাজে বা প্রশিক্ষণে রত নয়—এর মধ্যে ২৮ লাখ পুরুষ এবং ৫৮ লাখ নারী।
এ প্রেক্ষাপটকে পেছনে রেখে উত্থাপিত প্রশ্নগুলোকে বিশ্লেষণ করা যাক। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার পরিশীলিত সূক্ষ্ম উদ্দেশ্যগুলোকে আপাতত পাশে রেখে যদি ধরে নেই, বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্তির একটি অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে একটি ভালো কর্মে নিয়োজন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ৯ লাখ তরুণের জন্য সে লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে না। সেই সঙ্গে দেখা যাচ্ছে, যাঁদের কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, যাঁদের প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষা আছে, তাঁরা কর্মে নিয়োজিত হচ্ছেন; কিন্তু উচ্চশিক্ষিতরা কাজ খুঁজে পাচ্ছেন না। অনেকে এটাকে একটা ধাঁধা বলে অভিহিত করেছেন, আবার অনেকে কাজের ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষার প্রাসঙ্গিকতার বিষয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার, প্রাথমিক শিক্ষা বা মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত শ্রমিকেরা যে কর্মবাজারে কাজ করেন, সেখানে দক্ষতা-চাহিদা সাধারণ, যা দিয়ে সাধারণ কাজ সম্পন্ন করা যায়। সে বাজারে উচ্চমানের বিশেষায়িত দক্ষতার প্রয়োজন নেই। সুতরাং সে বাজারে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাবিহীন, প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত মানুষেরাও কাজ খুঁজে পান। সেখানে শ্রমবাজারের দক্ষতা চাহিদার সঙ্গে শ্রমবাজারের জোগানের দক্ষতার একটা সম্পৃক্ততা আছে।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্ত জনসম্পদের যে শ্রমবাজার, সেখানে কর্মনিয়োজনের জন্য যে জ্ঞান ও দক্ষতা প্রত্যাশিত, তার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্ত তরুণেরা যে জ্ঞান ও দক্ষতা নিয়ে বেরিয়ে আসেন, তার মধ্যে যথেষ্ট ফারাক থাকে। আমাদের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মাধ্যক্ষেরা প্রায়ই অভিযোগ করেন, তাঁদের যে ধরনের পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতার প্রয়োজন, দেশের উচ্চশিক্ষা খাত তা সরবরাহ করতে পারে না। ফলে আমাদের উচ্চশিক্ষিত তরুণদের কর্মনিয়োজন বিঘ্নিত হয়।
সে সঙ্গে কোন বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সনদ পাওয়া গেছে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সনদপ্রাপ্ত স্নাতকদের ২৩ শতাংশই বেকার অথচ ইংরেজিতে স্নাতকদের মধ্যে বেকারত্বের হার ০.১৭ শতাংশ। মনে রাখা দরকার, বর্তমান বিশ্বের কর্মজগৎ, কর্মবিষয় ও কর্মধারা দ্রুত বদলাচ্ছে। এর একটি কারণ অবশ্যই তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব, কিন্তু এর অন্যতম কারণ হচ্ছে উৎপাদন ও সেবা খাতের কাঠামোগত পরিবর্তন। ফলে নতুন নতুন পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতার চাহিদা সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের উচ্চ শিক্ষাব্যবস্থা এবং আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাকাঠামো সে জ্ঞান ও দক্ষতা সৃষ্টি করতে পারছে না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্ত কর্মহীন বেকারের সংখ্যা বাড়ছে এবং সেই সঙ্গে কর্মনিয়োজনের ক্ষেত্রে বর্তমান উচ্চশিক্ষার প্রাসঙ্গিকতা বিষয়ে প্রশ্ন উঠছে।
উচ্চশিক্ষা এবং কর্মনিয়োজনের মধ্যকার বিচ্ছিন্নতার অন্যান্য মাত্রিকতা রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে ৩ লাখ স্নাতককে কর্মনিয়োজনে আত্মস্থ করতে পারে। অথচ বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষাকাঠামো শুধু ২০২২ সালেই প্রায় ৭ লাখ স্নাতকের জন্ম দিয়েছে। জোগান যেখানে চাহিদার দ্বিগুণের চেয়ে বেশি, সেখানে উচ্চ কর্মহীনতা ঘটতে বাধ্য। এই বিশাল জোগানের অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অভাবনীয় বিস্তার।
বাংলাদেশে বর্তমানে ৫৬টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, তিন বছর আগে যেটা ছিল ৫৩। গত তিন বছরে আরও ১৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে বর্তমানে আমাদের দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১৬টি। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বড় অংশই সনদ প্রদান করে; কিন্তু প্রার্থিত দক্ষতা সৃষ্টি করে না। যেমন বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ২০২২ সালে দেশের ৭ লাখ স্নাতকের ৬১ শতাংশের জন্ম দিয়েছে। অন্যদিকে কর্মবিহীন স্নাতকদের ১৬ শতাংশ ওই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েরই স্নাতক।
বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকদের উচ্চ কর্মহীনতার একটি সামষ্টিক পরিপ্রেক্ষিতও রয়েছে। সে পরিপ্রেক্ষিতের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কর্মবিহীন প্রবৃদ্ধি। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি ঘটেছে; কিন্তু তা কর্মনিয়োজন সৃষ্টি করেনি। সরকারি মনোযোগের পুরোটাই ছিল প্রবৃদ্ধির দিকে, কর্মসৃষ্টির দিকে নয়। বর্তমান সময়ে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে গেছে, কমে গেছে কর্মনিয়োজনের সুযোগ। বাংলাদেশের খাতগুলোতেও জাতীয় আয় ও কর্মনিয়োজনের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা রয়েছে। দেশের কৃষি খাত জাতীয় আয়ের মাত্র ১১ শতাংশ অবদান রাখে; কিন্তু ৪৫ শতাংশ মানুষকে কর্মনিয়োজিত করে, তবে সেখানে ছদ্ম বেকারত্ব এবং অপরিপূর্ণ কর্মনিয়োজন রয়েছে। শিল্প খাত জাতীয় আয়ে ৩৭ শতাংশ অবদান রাখে; কিন্তু কর্মনিয়োজনে তার ভাগ মাত্র ১৭ শতাংশ। যদিও সেবা খাত জাতীয় আয়ে ৫১ শতাংশ অবদান রাখে, কর্মনিয়োজনে তার অংশ ৩৮ শতাংশ।
বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্ত তরুণদের মধ্যে উচ্চ বেকারত্বের আরও একটি কারণ রয়েছে। আনুষ্ঠানিক শিক্ষাবিহীন, প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা তাঁদের কর্মনিয়োজনের ক্ষেত্রে অত বেশি যাচাই-বাছাই করেন না। যা লভ্য, সেটাই তাঁরা নিয়ে নেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্ত তরুণেরা কর্মগ্রহণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে নানা বিষয় বিবেচনা করেন, যার মধ্যে কাজসংশ্লিষ্ট সামাজিক মর্যাদাও রয়েছে। সব রকমের লভ্য কাজকে তাঁরা বিবেচ্য মনে করেন না। এবং তাঁদের যাচাই-বাছাইও বেশ কঠিন। ফলে তাঁদের কর্মগ্রহণ সিদ্ধান্ত অত বেশি নমনীয় হয় না।
এই বিস্তৃত চালচিত্রের দুটো মাত্রিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্তির পরও কর্মহীন থাকলে তা তরুণদের মধ্যে একটা হতাশার সৃষ্টি করে। সে কর্মহীনতার সময়কাল দীর্ঘায়িত হলে তা উপর্যুক্ত হতাশাকে আরও গভীর করে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে সে হতাশার আর্থিক ও মানসিক মাত্রিকতা রয়েছে; কিন্তু সামষ্টিক পর্যায়ে সে হতাশার সামাজিক ও রাজনৈতিক মাত্রিকতা রয়েছে। তারুণ্যের হতাশা শুধু নেতিবাচক নয়; কাঙ্ক্ষিতও নয় মোটে।
সেই সঙ্গে যে দেশে ৯ লাখ উচ্চশিক্ষিত তরুণ কর্মহীন ও যেখানে ৮৬ লাখ তরুণ শিক্ষা, কর্মনিয়োজন ও প্রশিক্ষণের বাইরে আছে, সেটা সম্পদের একটি বিরাট অপচয়। অথচ অর্থনৈতিক গতিময়তা এবং সমাজ পরিবর্তনে তারুণ্য একটি বড় সম্পদ। তরুণদের প্রাণশক্তি, ঝুঁকি নেওয়ার সক্ষমতা, সৃষ্টিশীলতা ও সৃজনশীলতা, সাহস ও মনোবল অপ্রথাগত চিন্তা করার ক্ষমতার সুচারু ব্যবহার না হলে সেটা দুর্লভ এক সম্পদের অভাবনীয় অপচয়।
বিশ্ব বদলাচ্ছে দ্রুত। সে পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের তরুণদের প্রতিযোগিতা করতে হবে একটি গতিময় বিশ্বের মধ্যে। সে জন্য তারুণ্যের শক্তির অপচয় রোধ করে, তাঁদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে, তাঁদের কাজে লাগিয়ে আমাদের দ্রুত প্রস্তুত হতে হবে। কারণ, হাতে আমাদের সময় খুব একটা বেশি নেই।
লেখক: অর্থনীতিবিদ

সংবাদটি অনেকটা নীরবেই এসেছে সংবাদপত্রে—দৃষ্টিও কাড়েনি তা বড় একটা। হয়তো সেটি তেমন কোনো উত্তেজক বিষয় নয় বলে; কিংবা তা সরব কোনো সংকট না হওয়ার কারণে। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে, সংবাদটি একটি অশনিসংকেত বয়ে আনে। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সনদপ্রাপ্ত প্রায় ৯ লাখ তরুণ কর্মহীন। ২০১৩ সালে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্ত কর্মহীন তরুণের সংখ্যা ছিল ২ লাখ। সুতরাং গত ১২ বছরে সংখ্যাটি চার গুণের বেশি বেড়েছে। দেশে কর্মহীন লোকের সংখ্যা যদি ২৭ লাখ হয়, তাহলে তার এক-তৃতীয়াংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্ত। এ চিত্রটি স্বাভাবিকভাবেই কতগুলো প্রশ্নের জন্ম দেয়। যেমন দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা যদি তরুণদের কর্মনিয়োজন নিশ্চিত না করতে পারে, তাহলে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কি ব্যর্থ, সেটা কি তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলেছে? এই বিপুল কর্মহীন তারুণ্য কি সম্পদের, সুযোগের অপচয় নয়? কিংবা এমন একটি চালচিত্র নিয়ে বাংলাদেশ কি করে একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বে প্রতিযোগিতা করবে?
এসব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য তারুণ্যের কর্মহীনতার সামষ্টিক এ চিত্রটিকে একটু বিভাজিতভাবে দেখা যাক। এক. উপাত্ত বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্ত কর্মহীন তরুণদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৬ লাখ, নারীদের সংখ্যা ৩ লাখ। এর দুটো কারণ থাকতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ পেয়েও মেয়েরা কম সংখ্যায় শ্রমবাজারে আসে। ফলে তাঁরা যে কর্মহীনতায় কম সংখ্যক, সেটা সেই বাস্তবতার প্রতিফলন হতে পারে। কিংবা সত্যি সত্যিই কমসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্ত তরুণী কর্মহীন। দুই. নানা স্তরের শিক্ষাপ্রাপ্ত কর্মহীন তরুণদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্ত তরুণদের হার সবচেয়ে বেশি। মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার যেখানে ৩ শতাংশ, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্ত তরুণদের মধ্যে সে হার হচ্ছে ১৪ শতাংশ—চার গুণের বেশি। তিন. বাংলাদেশে প্রায় ৮৬ লাখ তরুণ শিক্ষায়, কাজে বা প্রশিক্ষণে রত নয়—এর মধ্যে ২৮ লাখ পুরুষ এবং ৫৮ লাখ নারী।
এ প্রেক্ষাপটকে পেছনে রেখে উত্থাপিত প্রশ্নগুলোকে বিশ্লেষণ করা যাক। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার পরিশীলিত সূক্ষ্ম উদ্দেশ্যগুলোকে আপাতত পাশে রেখে যদি ধরে নেই, বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্তির একটি অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে একটি ভালো কর্মে নিয়োজন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ৯ লাখ তরুণের জন্য সে লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে না। সেই সঙ্গে দেখা যাচ্ছে, যাঁদের কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, যাঁদের প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষা আছে, তাঁরা কর্মে নিয়োজিত হচ্ছেন; কিন্তু উচ্চশিক্ষিতরা কাজ খুঁজে পাচ্ছেন না। অনেকে এটাকে একটা ধাঁধা বলে অভিহিত করেছেন, আবার অনেকে কাজের ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষার প্রাসঙ্গিকতার বিষয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার, প্রাথমিক শিক্ষা বা মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত শ্রমিকেরা যে কর্মবাজারে কাজ করেন, সেখানে দক্ষতা-চাহিদা সাধারণ, যা দিয়ে সাধারণ কাজ সম্পন্ন করা যায়। সে বাজারে উচ্চমানের বিশেষায়িত দক্ষতার প্রয়োজন নেই। সুতরাং সে বাজারে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাবিহীন, প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত মানুষেরাও কাজ খুঁজে পান। সেখানে শ্রমবাজারের দক্ষতা চাহিদার সঙ্গে শ্রমবাজারের জোগানের দক্ষতার একটা সম্পৃক্ততা আছে।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্ত জনসম্পদের যে শ্রমবাজার, সেখানে কর্মনিয়োজনের জন্য যে জ্ঞান ও দক্ষতা প্রত্যাশিত, তার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্ত তরুণেরা যে জ্ঞান ও দক্ষতা নিয়ে বেরিয়ে আসেন, তার মধ্যে যথেষ্ট ফারাক থাকে। আমাদের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মাধ্যক্ষেরা প্রায়ই অভিযোগ করেন, তাঁদের যে ধরনের পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতার প্রয়োজন, দেশের উচ্চশিক্ষা খাত তা সরবরাহ করতে পারে না। ফলে আমাদের উচ্চশিক্ষিত তরুণদের কর্মনিয়োজন বিঘ্নিত হয়।
সে সঙ্গে কোন বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সনদ পাওয়া গেছে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সনদপ্রাপ্ত স্নাতকদের ২৩ শতাংশই বেকার অথচ ইংরেজিতে স্নাতকদের মধ্যে বেকারত্বের হার ০.১৭ শতাংশ। মনে রাখা দরকার, বর্তমান বিশ্বের কর্মজগৎ, কর্মবিষয় ও কর্মধারা দ্রুত বদলাচ্ছে। এর একটি কারণ অবশ্যই তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব, কিন্তু এর অন্যতম কারণ হচ্ছে উৎপাদন ও সেবা খাতের কাঠামোগত পরিবর্তন। ফলে নতুন নতুন পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতার চাহিদা সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের উচ্চ শিক্ষাব্যবস্থা এবং আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাকাঠামো সে জ্ঞান ও দক্ষতা সৃষ্টি করতে পারছে না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্ত কর্মহীন বেকারের সংখ্যা বাড়ছে এবং সেই সঙ্গে কর্মনিয়োজনের ক্ষেত্রে বর্তমান উচ্চশিক্ষার প্রাসঙ্গিকতা বিষয়ে প্রশ্ন উঠছে।
উচ্চশিক্ষা এবং কর্মনিয়োজনের মধ্যকার বিচ্ছিন্নতার অন্যান্য মাত্রিকতা রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে ৩ লাখ স্নাতককে কর্মনিয়োজনে আত্মস্থ করতে পারে। অথচ বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষাকাঠামো শুধু ২০২২ সালেই প্রায় ৭ লাখ স্নাতকের জন্ম দিয়েছে। জোগান যেখানে চাহিদার দ্বিগুণের চেয়ে বেশি, সেখানে উচ্চ কর্মহীনতা ঘটতে বাধ্য। এই বিশাল জোগানের অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অভাবনীয় বিস্তার।
বাংলাদেশে বর্তমানে ৫৬টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, তিন বছর আগে যেটা ছিল ৫৩। গত তিন বছরে আরও ১৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে বর্তমানে আমাদের দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১৬টি। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বড় অংশই সনদ প্রদান করে; কিন্তু প্রার্থিত দক্ষতা সৃষ্টি করে না। যেমন বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ২০২২ সালে দেশের ৭ লাখ স্নাতকের ৬১ শতাংশের জন্ম দিয়েছে। অন্যদিকে কর্মবিহীন স্নাতকদের ১৬ শতাংশ ওই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েরই স্নাতক।
বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকদের উচ্চ কর্মহীনতার একটি সামষ্টিক পরিপ্রেক্ষিতও রয়েছে। সে পরিপ্রেক্ষিতের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কর্মবিহীন প্রবৃদ্ধি। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি ঘটেছে; কিন্তু তা কর্মনিয়োজন সৃষ্টি করেনি। সরকারি মনোযোগের পুরোটাই ছিল প্রবৃদ্ধির দিকে, কর্মসৃষ্টির দিকে নয়। বর্তমান সময়ে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে গেছে, কমে গেছে কর্মনিয়োজনের সুযোগ। বাংলাদেশের খাতগুলোতেও জাতীয় আয় ও কর্মনিয়োজনের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা রয়েছে। দেশের কৃষি খাত জাতীয় আয়ের মাত্র ১১ শতাংশ অবদান রাখে; কিন্তু ৪৫ শতাংশ মানুষকে কর্মনিয়োজিত করে, তবে সেখানে ছদ্ম বেকারত্ব এবং অপরিপূর্ণ কর্মনিয়োজন রয়েছে। শিল্প খাত জাতীয় আয়ে ৩৭ শতাংশ অবদান রাখে; কিন্তু কর্মনিয়োজনে তার ভাগ মাত্র ১৭ শতাংশ। যদিও সেবা খাত জাতীয় আয়ে ৫১ শতাংশ অবদান রাখে, কর্মনিয়োজনে তার অংশ ৩৮ শতাংশ।
বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্ত তরুণদের মধ্যে উচ্চ বেকারত্বের আরও একটি কারণ রয়েছে। আনুষ্ঠানিক শিক্ষাবিহীন, প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা তাঁদের কর্মনিয়োজনের ক্ষেত্রে অত বেশি যাচাই-বাছাই করেন না। যা লভ্য, সেটাই তাঁরা নিয়ে নেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্ত তরুণেরা কর্মগ্রহণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে নানা বিষয় বিবেচনা করেন, যার মধ্যে কাজসংশ্লিষ্ট সামাজিক মর্যাদাও রয়েছে। সব রকমের লভ্য কাজকে তাঁরা বিবেচ্য মনে করেন না। এবং তাঁদের যাচাই-বাছাইও বেশ কঠিন। ফলে তাঁদের কর্মগ্রহণ সিদ্ধান্ত অত বেশি নমনীয় হয় না।
এই বিস্তৃত চালচিত্রের দুটো মাত্রিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্তির পরও কর্মহীন থাকলে তা তরুণদের মধ্যে একটা হতাশার সৃষ্টি করে। সে কর্মহীনতার সময়কাল দীর্ঘায়িত হলে তা উপর্যুক্ত হতাশাকে আরও গভীর করে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে সে হতাশার আর্থিক ও মানসিক মাত্রিকতা রয়েছে; কিন্তু সামষ্টিক পর্যায়ে সে হতাশার সামাজিক ও রাজনৈতিক মাত্রিকতা রয়েছে। তারুণ্যের হতাশা শুধু নেতিবাচক নয়; কাঙ্ক্ষিতও নয় মোটে।
সেই সঙ্গে যে দেশে ৯ লাখ উচ্চশিক্ষিত তরুণ কর্মহীন ও যেখানে ৮৬ লাখ তরুণ শিক্ষা, কর্মনিয়োজন ও প্রশিক্ষণের বাইরে আছে, সেটা সম্পদের একটি বিরাট অপচয়। অথচ অর্থনৈতিক গতিময়তা এবং সমাজ পরিবর্তনে তারুণ্য একটি বড় সম্পদ। তরুণদের প্রাণশক্তি, ঝুঁকি নেওয়ার সক্ষমতা, সৃষ্টিশীলতা ও সৃজনশীলতা, সাহস ও মনোবল অপ্রথাগত চিন্তা করার ক্ষমতার সুচারু ব্যবহার না হলে সেটা দুর্লভ এক সম্পদের অভাবনীয় অপচয়।
বিশ্ব বদলাচ্ছে দ্রুত। সে পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের তরুণদের প্রতিযোগিতা করতে হবে একটি গতিময় বিশ্বের মধ্যে। সে জন্য তারুণ্যের শক্তির অপচয় রোধ করে, তাঁদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে, তাঁদের কাজে লাগিয়ে আমাদের দ্রুত প্রস্তুত হতে হবে। কারণ, হাতে আমাদের সময় খুব একটা বেশি নেই।
লেখক: অর্থনীতিবিদ
বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্তির পরও কর্মহীন থাকলে তা তরুণদের মধ্যে একটা হতাশার সৃষ্টি করে। সে কর্মহীনতার সময়কাল দীর্ঘায়িত হলে তা উপর্যুক্ত হতাশাকে আরও গভীর করে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে সে হতাশার আর্থিক ও মানসিক মাত্রিকতা রয়েছে; কিন্তু সামষ্টিক পর্যায়ে সে হতাশার সামাজিক ও রাজনৈতিক মাত্রিকতা রয়েছে। তারুণ্যের হতাশা শুধু নেতিবাচক নয়; কাঙ্ক্ষিতও নয় মোটে।
সেলিম জাহান

সংবাদটি অনেকটা নীরবেই এসেছে সংবাদপত্রে—দৃষ্টিও কাড়েনি তা বড় একটা। হয়তো সেটি তেমন কোনো উত্তেজক বিষয় নয় বলে; কিংবা তা সরব কোনো সংকট না হওয়ার কারণে। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে, সংবাদটি একটি অশনিসংকেত বয়ে আনে। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সনদপ্রাপ্ত প্রায় ৯ লাখ তরুণ কর্মহীন। ২০১৩ সালে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্ত কর্মহীন তরুণের সংখ্যা ছিল ২ লাখ। সুতরাং গত ১২ বছরে সংখ্যাটি চার গুণের বেশি বেড়েছে। দেশে কর্মহীন লোকের সংখ্যা যদি ২৭ লাখ হয়, তাহলে তার এক-তৃতীয়াংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্ত। এ চিত্রটি স্বাভাবিকভাবেই কতগুলো প্রশ্নের জন্ম দেয়। যেমন দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা যদি তরুণদের কর্মনিয়োজন নিশ্চিত না করতে পারে, তাহলে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কি ব্যর্থ, সেটা কি তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলেছে? এই বিপুল কর্মহীন তারুণ্য কি সম্পদের, সুযোগের অপচয় নয়? কিংবা এমন একটি চালচিত্র নিয়ে বাংলাদেশ কি করে একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বে প্রতিযোগিতা করবে?
এসব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য তারুণ্যের কর্মহীনতার সামষ্টিক এ চিত্রটিকে একটু বিভাজিতভাবে দেখা যাক। এক. উপাত্ত বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্ত কর্মহীন তরুণদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৬ লাখ, নারীদের সংখ্যা ৩ লাখ। এর দুটো কারণ থাকতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ পেয়েও মেয়েরা কম সংখ্যায় শ্রমবাজারে আসে। ফলে তাঁরা যে কর্মহীনতায় কম সংখ্যক, সেটা সেই বাস্তবতার প্রতিফলন হতে পারে। কিংবা সত্যি সত্যিই কমসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্ত তরুণী কর্মহীন। দুই. নানা স্তরের শিক্ষাপ্রাপ্ত কর্মহীন তরুণদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্ত তরুণদের হার সবচেয়ে বেশি। মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার যেখানে ৩ শতাংশ, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্ত তরুণদের মধ্যে সে হার হচ্ছে ১৪ শতাংশ—চার গুণের বেশি। তিন. বাংলাদেশে প্রায় ৮৬ লাখ তরুণ শিক্ষায়, কাজে বা প্রশিক্ষণে রত নয়—এর মধ্যে ২৮ লাখ পুরুষ এবং ৫৮ লাখ নারী।
এ প্রেক্ষাপটকে পেছনে রেখে উত্থাপিত প্রশ্নগুলোকে বিশ্লেষণ করা যাক। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার পরিশীলিত সূক্ষ্ম উদ্দেশ্যগুলোকে আপাতত পাশে রেখে যদি ধরে নেই, বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্তির একটি অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে একটি ভালো কর্মে নিয়োজন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ৯ লাখ তরুণের জন্য সে লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে না। সেই সঙ্গে দেখা যাচ্ছে, যাঁদের কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, যাঁদের প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষা আছে, তাঁরা কর্মে নিয়োজিত হচ্ছেন; কিন্তু উচ্চশিক্ষিতরা কাজ খুঁজে পাচ্ছেন না। অনেকে এটাকে একটা ধাঁধা বলে অভিহিত করেছেন, আবার অনেকে কাজের ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষার প্রাসঙ্গিকতার বিষয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার, প্রাথমিক শিক্ষা বা মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত শ্রমিকেরা যে কর্মবাজারে কাজ করেন, সেখানে দক্ষতা-চাহিদা সাধারণ, যা দিয়ে সাধারণ কাজ সম্পন্ন করা যায়। সে বাজারে উচ্চমানের বিশেষায়িত দক্ষতার প্রয়োজন নেই। সুতরাং সে বাজারে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাবিহীন, প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত মানুষেরাও কাজ খুঁজে পান। সেখানে শ্রমবাজারের দক্ষতা চাহিদার সঙ্গে শ্রমবাজারের জোগানের দক্ষতার একটা সম্পৃক্ততা আছে।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্ত জনসম্পদের যে শ্রমবাজার, সেখানে কর্মনিয়োজনের জন্য যে জ্ঞান ও দক্ষতা প্রত্যাশিত, তার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্ত তরুণেরা যে জ্ঞান ও দক্ষতা নিয়ে বেরিয়ে আসেন, তার মধ্যে যথেষ্ট ফারাক থাকে। আমাদের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মাধ্যক্ষেরা প্রায়ই অভিযোগ করেন, তাঁদের যে ধরনের পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতার প্রয়োজন, দেশের উচ্চশিক্ষা খাত তা সরবরাহ করতে পারে না। ফলে আমাদের উচ্চশিক্ষিত তরুণদের কর্মনিয়োজন বিঘ্নিত হয়।
সে সঙ্গে কোন বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সনদ পাওয়া গেছে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সনদপ্রাপ্ত স্নাতকদের ২৩ শতাংশই বেকার অথচ ইংরেজিতে স্নাতকদের মধ্যে বেকারত্বের হার ০.১৭ শতাংশ। মনে রাখা দরকার, বর্তমান বিশ্বের কর্মজগৎ, কর্মবিষয় ও কর্মধারা দ্রুত বদলাচ্ছে। এর একটি কারণ অবশ্যই তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব, কিন্তু এর অন্যতম কারণ হচ্ছে উৎপাদন ও সেবা খাতের কাঠামোগত পরিবর্তন। ফলে নতুন নতুন পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতার চাহিদা সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের উচ্চ শিক্ষাব্যবস্থা এবং আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাকাঠামো সে জ্ঞান ও দক্ষতা সৃষ্টি করতে পারছে না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্ত কর্মহীন বেকারের সংখ্যা বাড়ছে এবং সেই সঙ্গে কর্মনিয়োজনের ক্ষেত্রে বর্তমান উচ্চশিক্ষার প্রাসঙ্গিকতা বিষয়ে প্রশ্ন উঠছে।
উচ্চশিক্ষা এবং কর্মনিয়োজনের মধ্যকার বিচ্ছিন্নতার অন্যান্য মাত্রিকতা রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে ৩ লাখ স্নাতককে কর্মনিয়োজনে আত্মস্থ করতে পারে। অথচ বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষাকাঠামো শুধু ২০২২ সালেই প্রায় ৭ লাখ স্নাতকের জন্ম দিয়েছে। জোগান যেখানে চাহিদার দ্বিগুণের চেয়ে বেশি, সেখানে উচ্চ কর্মহীনতা ঘটতে বাধ্য। এই বিশাল জোগানের অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অভাবনীয় বিস্তার।
বাংলাদেশে বর্তমানে ৫৬টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, তিন বছর আগে যেটা ছিল ৫৩। গত তিন বছরে আরও ১৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে বর্তমানে আমাদের দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১৬টি। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বড় অংশই সনদ প্রদান করে; কিন্তু প্রার্থিত দক্ষতা সৃষ্টি করে না। যেমন বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ২০২২ সালে দেশের ৭ লাখ স্নাতকের ৬১ শতাংশের জন্ম দিয়েছে। অন্যদিকে কর্মবিহীন স্নাতকদের ১৬ শতাংশ ওই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েরই স্নাতক।
বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকদের উচ্চ কর্মহীনতার একটি সামষ্টিক পরিপ্রেক্ষিতও রয়েছে। সে পরিপ্রেক্ষিতের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কর্মবিহীন প্রবৃদ্ধি। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি ঘটেছে; কিন্তু তা কর্মনিয়োজন সৃষ্টি করেনি। সরকারি মনোযোগের পুরোটাই ছিল প্রবৃদ্ধির দিকে, কর্মসৃষ্টির দিকে নয়। বর্তমান সময়ে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে গেছে, কমে গেছে কর্মনিয়োজনের সুযোগ। বাংলাদেশের খাতগুলোতেও জাতীয় আয় ও কর্মনিয়োজনের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা রয়েছে। দেশের কৃষি খাত জাতীয় আয়ের মাত্র ১১ শতাংশ অবদান রাখে; কিন্তু ৪৫ শতাংশ মানুষকে কর্মনিয়োজিত করে, তবে সেখানে ছদ্ম বেকারত্ব এবং অপরিপূর্ণ কর্মনিয়োজন রয়েছে। শিল্প খাত জাতীয় আয়ে ৩৭ শতাংশ অবদান রাখে; কিন্তু কর্মনিয়োজনে তার ভাগ মাত্র ১৭ শতাংশ। যদিও সেবা খাত জাতীয় আয়ে ৫১ শতাংশ অবদান রাখে, কর্মনিয়োজনে তার অংশ ৩৮ শতাংশ।
বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্ত তরুণদের মধ্যে উচ্চ বেকারত্বের আরও একটি কারণ রয়েছে। আনুষ্ঠানিক শিক্ষাবিহীন, প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা তাঁদের কর্মনিয়োজনের ক্ষেত্রে অত বেশি যাচাই-বাছাই করেন না। যা লভ্য, সেটাই তাঁরা নিয়ে নেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্ত তরুণেরা কর্মগ্রহণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে নানা বিষয় বিবেচনা করেন, যার মধ্যে কাজসংশ্লিষ্ট সামাজিক মর্যাদাও রয়েছে। সব রকমের লভ্য কাজকে তাঁরা বিবেচ্য মনে করেন না। এবং তাঁদের যাচাই-বাছাইও বেশ কঠিন। ফলে তাঁদের কর্মগ্রহণ সিদ্ধান্ত অত বেশি নমনীয় হয় না।
এই বিস্তৃত চালচিত্রের দুটো মাত্রিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্তির পরও কর্মহীন থাকলে তা তরুণদের মধ্যে একটা হতাশার সৃষ্টি করে। সে কর্মহীনতার সময়কাল দীর্ঘায়িত হলে তা উপর্যুক্ত হতাশাকে আরও গভীর করে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে সে হতাশার আর্থিক ও মানসিক মাত্রিকতা রয়েছে; কিন্তু সামষ্টিক পর্যায়ে সে হতাশার সামাজিক ও রাজনৈতিক মাত্রিকতা রয়েছে। তারুণ্যের হতাশা শুধু নেতিবাচক নয়; কাঙ্ক্ষিতও নয় মোটে।
সেই সঙ্গে যে দেশে ৯ লাখ উচ্চশিক্ষিত তরুণ কর্মহীন ও যেখানে ৮৬ লাখ তরুণ শিক্ষা, কর্মনিয়োজন ও প্রশিক্ষণের বাইরে আছে, সেটা সম্পদের একটি বিরাট অপচয়। অথচ অর্থনৈতিক গতিময়তা এবং সমাজ পরিবর্তনে তারুণ্য একটি বড় সম্পদ। তরুণদের প্রাণশক্তি, ঝুঁকি নেওয়ার সক্ষমতা, সৃষ্টিশীলতা ও সৃজনশীলতা, সাহস ও মনোবল অপ্রথাগত চিন্তা করার ক্ষমতার সুচারু ব্যবহার না হলে সেটা দুর্লভ এক সম্পদের অভাবনীয় অপচয়।
বিশ্ব বদলাচ্ছে দ্রুত। সে পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের তরুণদের প্রতিযোগিতা করতে হবে একটি গতিময় বিশ্বের মধ্যে। সে জন্য তারুণ্যের শক্তির অপচয় রোধ করে, তাঁদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে, তাঁদের কাজে লাগিয়ে আমাদের দ্রুত প্রস্তুত হতে হবে। কারণ, হাতে আমাদের সময় খুব একটা বেশি নেই।
লেখক: অর্থনীতিবিদ

সংবাদটি অনেকটা নীরবেই এসেছে সংবাদপত্রে—দৃষ্টিও কাড়েনি তা বড় একটা। হয়তো সেটি তেমন কোনো উত্তেজক বিষয় নয় বলে; কিংবা তা সরব কোনো সংকট না হওয়ার কারণে। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে, সংবাদটি একটি অশনিসংকেত বয়ে আনে। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সনদপ্রাপ্ত প্রায় ৯ লাখ তরুণ কর্মহীন। ২০১৩ সালে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্ত কর্মহীন তরুণের সংখ্যা ছিল ২ লাখ। সুতরাং গত ১২ বছরে সংখ্যাটি চার গুণের বেশি বেড়েছে। দেশে কর্মহীন লোকের সংখ্যা যদি ২৭ লাখ হয়, তাহলে তার এক-তৃতীয়াংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্ত। এ চিত্রটি স্বাভাবিকভাবেই কতগুলো প্রশ্নের জন্ম দেয়। যেমন দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা যদি তরুণদের কর্মনিয়োজন নিশ্চিত না করতে পারে, তাহলে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কি ব্যর্থ, সেটা কি তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলেছে? এই বিপুল কর্মহীন তারুণ্য কি সম্পদের, সুযোগের অপচয় নয়? কিংবা এমন একটি চালচিত্র নিয়ে বাংলাদেশ কি করে একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বে প্রতিযোগিতা করবে?
এসব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য তারুণ্যের কর্মহীনতার সামষ্টিক এ চিত্রটিকে একটু বিভাজিতভাবে দেখা যাক। এক. উপাত্ত বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্ত কর্মহীন তরুণদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৬ লাখ, নারীদের সংখ্যা ৩ লাখ। এর দুটো কারণ থাকতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ পেয়েও মেয়েরা কম সংখ্যায় শ্রমবাজারে আসে। ফলে তাঁরা যে কর্মহীনতায় কম সংখ্যক, সেটা সেই বাস্তবতার প্রতিফলন হতে পারে। কিংবা সত্যি সত্যিই কমসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্ত তরুণী কর্মহীন। দুই. নানা স্তরের শিক্ষাপ্রাপ্ত কর্মহীন তরুণদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্ত তরুণদের হার সবচেয়ে বেশি। মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার যেখানে ৩ শতাংশ, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্ত তরুণদের মধ্যে সে হার হচ্ছে ১৪ শতাংশ—চার গুণের বেশি। তিন. বাংলাদেশে প্রায় ৮৬ লাখ তরুণ শিক্ষায়, কাজে বা প্রশিক্ষণে রত নয়—এর মধ্যে ২৮ লাখ পুরুষ এবং ৫৮ লাখ নারী।
এ প্রেক্ষাপটকে পেছনে রেখে উত্থাপিত প্রশ্নগুলোকে বিশ্লেষণ করা যাক। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার পরিশীলিত সূক্ষ্ম উদ্দেশ্যগুলোকে আপাতত পাশে রেখে যদি ধরে নেই, বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্তির একটি অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে একটি ভালো কর্মে নিয়োজন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ৯ লাখ তরুণের জন্য সে লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে না। সেই সঙ্গে দেখা যাচ্ছে, যাঁদের কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, যাঁদের প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষা আছে, তাঁরা কর্মে নিয়োজিত হচ্ছেন; কিন্তু উচ্চশিক্ষিতরা কাজ খুঁজে পাচ্ছেন না। অনেকে এটাকে একটা ধাঁধা বলে অভিহিত করেছেন, আবার অনেকে কাজের ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষার প্রাসঙ্গিকতার বিষয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার, প্রাথমিক শিক্ষা বা মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত শ্রমিকেরা যে কর্মবাজারে কাজ করেন, সেখানে দক্ষতা-চাহিদা সাধারণ, যা দিয়ে সাধারণ কাজ সম্পন্ন করা যায়। সে বাজারে উচ্চমানের বিশেষায়িত দক্ষতার প্রয়োজন নেই। সুতরাং সে বাজারে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাবিহীন, প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত মানুষেরাও কাজ খুঁজে পান। সেখানে শ্রমবাজারের দক্ষতা চাহিদার সঙ্গে শ্রমবাজারের জোগানের দক্ষতার একটা সম্পৃক্ততা আছে।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্ত জনসম্পদের যে শ্রমবাজার, সেখানে কর্মনিয়োজনের জন্য যে জ্ঞান ও দক্ষতা প্রত্যাশিত, তার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্ত তরুণেরা যে জ্ঞান ও দক্ষতা নিয়ে বেরিয়ে আসেন, তার মধ্যে যথেষ্ট ফারাক থাকে। আমাদের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মাধ্যক্ষেরা প্রায়ই অভিযোগ করেন, তাঁদের যে ধরনের পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতার প্রয়োজন, দেশের উচ্চশিক্ষা খাত তা সরবরাহ করতে পারে না। ফলে আমাদের উচ্চশিক্ষিত তরুণদের কর্মনিয়োজন বিঘ্নিত হয়।
সে সঙ্গে কোন বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সনদ পাওয়া গেছে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সনদপ্রাপ্ত স্নাতকদের ২৩ শতাংশই বেকার অথচ ইংরেজিতে স্নাতকদের মধ্যে বেকারত্বের হার ০.১৭ শতাংশ। মনে রাখা দরকার, বর্তমান বিশ্বের কর্মজগৎ, কর্মবিষয় ও কর্মধারা দ্রুত বদলাচ্ছে। এর একটি কারণ অবশ্যই তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব, কিন্তু এর অন্যতম কারণ হচ্ছে উৎপাদন ও সেবা খাতের কাঠামোগত পরিবর্তন। ফলে নতুন নতুন পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতার চাহিদা সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের উচ্চ শিক্ষাব্যবস্থা এবং আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাকাঠামো সে জ্ঞান ও দক্ষতা সৃষ্টি করতে পারছে না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্ত কর্মহীন বেকারের সংখ্যা বাড়ছে এবং সেই সঙ্গে কর্মনিয়োজনের ক্ষেত্রে বর্তমান উচ্চশিক্ষার প্রাসঙ্গিকতা বিষয়ে প্রশ্ন উঠছে।
উচ্চশিক্ষা এবং কর্মনিয়োজনের মধ্যকার বিচ্ছিন্নতার অন্যান্য মাত্রিকতা রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে ৩ লাখ স্নাতককে কর্মনিয়োজনে আত্মস্থ করতে পারে। অথচ বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষাকাঠামো শুধু ২০২২ সালেই প্রায় ৭ লাখ স্নাতকের জন্ম দিয়েছে। জোগান যেখানে চাহিদার দ্বিগুণের চেয়ে বেশি, সেখানে উচ্চ কর্মহীনতা ঘটতে বাধ্য। এই বিশাল জোগানের অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অভাবনীয় বিস্তার।
বাংলাদেশে বর্তমানে ৫৬টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, তিন বছর আগে যেটা ছিল ৫৩। গত তিন বছরে আরও ১৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে বর্তমানে আমাদের দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১৬টি। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বড় অংশই সনদ প্রদান করে; কিন্তু প্রার্থিত দক্ষতা সৃষ্টি করে না। যেমন বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ২০২২ সালে দেশের ৭ লাখ স্নাতকের ৬১ শতাংশের জন্ম দিয়েছে। অন্যদিকে কর্মবিহীন স্নাতকদের ১৬ শতাংশ ওই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েরই স্নাতক।
বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকদের উচ্চ কর্মহীনতার একটি সামষ্টিক পরিপ্রেক্ষিতও রয়েছে। সে পরিপ্রেক্ষিতের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কর্মবিহীন প্রবৃদ্ধি। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি ঘটেছে; কিন্তু তা কর্মনিয়োজন সৃষ্টি করেনি। সরকারি মনোযোগের পুরোটাই ছিল প্রবৃদ্ধির দিকে, কর্মসৃষ্টির দিকে নয়। বর্তমান সময়ে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে গেছে, কমে গেছে কর্মনিয়োজনের সুযোগ। বাংলাদেশের খাতগুলোতেও জাতীয় আয় ও কর্মনিয়োজনের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা রয়েছে। দেশের কৃষি খাত জাতীয় আয়ের মাত্র ১১ শতাংশ অবদান রাখে; কিন্তু ৪৫ শতাংশ মানুষকে কর্মনিয়োজিত করে, তবে সেখানে ছদ্ম বেকারত্ব এবং অপরিপূর্ণ কর্মনিয়োজন রয়েছে। শিল্প খাত জাতীয় আয়ে ৩৭ শতাংশ অবদান রাখে; কিন্তু কর্মনিয়োজনে তার ভাগ মাত্র ১৭ শতাংশ। যদিও সেবা খাত জাতীয় আয়ে ৫১ শতাংশ অবদান রাখে, কর্মনিয়োজনে তার অংশ ৩৮ শতাংশ।
বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্ত তরুণদের মধ্যে উচ্চ বেকারত্বের আরও একটি কারণ রয়েছে। আনুষ্ঠানিক শিক্ষাবিহীন, প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা তাঁদের কর্মনিয়োজনের ক্ষেত্রে অত বেশি যাচাই-বাছাই করেন না। যা লভ্য, সেটাই তাঁরা নিয়ে নেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্ত তরুণেরা কর্মগ্রহণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে নানা বিষয় বিবেচনা করেন, যার মধ্যে কাজসংশ্লিষ্ট সামাজিক মর্যাদাও রয়েছে। সব রকমের লভ্য কাজকে তাঁরা বিবেচ্য মনে করেন না। এবং তাঁদের যাচাই-বাছাইও বেশ কঠিন। ফলে তাঁদের কর্মগ্রহণ সিদ্ধান্ত অত বেশি নমনীয় হয় না।
এই বিস্তৃত চালচিত্রের দুটো মাত্রিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্তির পরও কর্মহীন থাকলে তা তরুণদের মধ্যে একটা হতাশার সৃষ্টি করে। সে কর্মহীনতার সময়কাল দীর্ঘায়িত হলে তা উপর্যুক্ত হতাশাকে আরও গভীর করে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে সে হতাশার আর্থিক ও মানসিক মাত্রিকতা রয়েছে; কিন্তু সামষ্টিক পর্যায়ে সে হতাশার সামাজিক ও রাজনৈতিক মাত্রিকতা রয়েছে। তারুণ্যের হতাশা শুধু নেতিবাচক নয়; কাঙ্ক্ষিতও নয় মোটে।
সেই সঙ্গে যে দেশে ৯ লাখ উচ্চশিক্ষিত তরুণ কর্মহীন ও যেখানে ৮৬ লাখ তরুণ শিক্ষা, কর্মনিয়োজন ও প্রশিক্ষণের বাইরে আছে, সেটা সম্পদের একটি বিরাট অপচয়। অথচ অর্থনৈতিক গতিময়তা এবং সমাজ পরিবর্তনে তারুণ্য একটি বড় সম্পদ। তরুণদের প্রাণশক্তি, ঝুঁকি নেওয়ার সক্ষমতা, সৃষ্টিশীলতা ও সৃজনশীলতা, সাহস ও মনোবল অপ্রথাগত চিন্তা করার ক্ষমতার সুচারু ব্যবহার না হলে সেটা দুর্লভ এক সম্পদের অভাবনীয় অপচয়।
বিশ্ব বদলাচ্ছে দ্রুত। সে পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের তরুণদের প্রতিযোগিতা করতে হবে একটি গতিময় বিশ্বের মধ্যে। সে জন্য তারুণ্যের শক্তির অপচয় রোধ করে, তাঁদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে, তাঁদের কাজে লাগিয়ে আমাদের দ্রুত প্রস্তুত হতে হবে। কারণ, হাতে আমাদের সময় খুব একটা বেশি নেই।
লেখক: অর্থনীতিবিদ

সম্প্রতি ঢাকার একটি বাংলা দৈনিক পত্রিকা আয়োজিত অর্থনৈতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বক্তা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের প্রত্যেকেই দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছেন, আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে তাঁরা সরকার গঠন করলে দেশের অর্থনীতিই হবে তাঁদের কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। এ দেশের নাগরিকদে
৮ ঘণ্টা আগে
শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে আলবদর ঘাতকেরা ঘর থেকে তুলে নিয়ে যায় ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর, মধ্যরাতে। ডিসেম্বরে পাকিস্তানি হানাদার ও আলবদররা যে বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ শুরু করেছিল, সিরাজুদ্দীন ছিলেন তার প্রথম শিকার। এরপর তিনি আর ফেরেননি, মরদেহও পাওয়া যায়নি। তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন কলমসৈনিককে
৮ ঘণ্টা আগে
বিশ্বব্যাপী ১০ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। ২০২৫ সালের এ দিবসের প্রতিপাদ্য হলো, ‘আওয়ার এভরিডে অ্যাসেনশিয়ালস’; অর্থাৎ, ‘আমাদের প্রতিদিনের অত্যাবশ্যকীয়তা’ কথাটি শুনতে সহজ মনে হলেও এর গভীরে লুকিয়ে আছে মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারগুলোর কথা। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে আজ
৮ ঘণ্টা আগে
মোহাম্মদপুরে ৮ ডিসেম্বর সোমবার সকালে খুন হলেন মা ও মেয়ে। দীর্ঘদিন শাহজাহান রোডের আমেনাস ড্রিম নামের যে বাড়িতে তাঁরা বসবাস করছিলেন, সেই বাড়িতেই গৃহকর্মীর উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে নিহত হলেন তাঁরা। ১৪ তলা ভবনের বিভিন্ন সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ধারণা করা হচ্ছে, বোরকা পরে এই গৃহকর্মী ঢুকেছিলেন ফ্ল্যাটে, মা
৮ ঘণ্টা আগেসেলিম জাহান

সম্প্রতি ঢাকার একটি বাংলা দৈনিক পত্রিকা আয়োজিত অর্থনৈতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বক্তা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের প্রত্যেকেই দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছেন, আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে তাঁরা সরকার গঠন করলে দেশের অর্থনীতিই হবে তাঁদের কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। এ দেশের নাগরিকদের জন্য নিঃসন্দেহে এটি সুসংবাদ। কারণ, দেশের সাধারণ মানুষের কাছেও অর্থনীতিই হচ্ছে ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু। মূল্যস্ফীতি থেকে কর্মহীনতা, সুযোগের অসমতা, উৎপাদন-উপকরণে প্রবেশাধিকারের প্রতিবন্ধকতা, মৌলিক সামাজিক সেবার উন্নত মান, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ইত্যাদি হলো আমাদের অর্থনীতির মূল সমস্যা। সম্মেলনে রাজনৈতিক নেতারা এসব বিষয়কেই গুরুত্ব দিয়েছেন। কারণ, বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশের জনালোচনায় রাজনৈতিক বিষয়গুলোই একচেটিয়া প্রাধান্য পেয়ে আসছিল।
শুরুতে তিনটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষিত হওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, অর্থনীতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, এই অঙ্গীকার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সেই অঙ্গীকারে কোন কোন বিষয় অগ্রাধিকার পাবে, সেটাও চিহ্নিত হওয়া প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের উপর্যুক্ত অঙ্গীকার এবং চিহ্নিত অগ্রাধিকারগুলোকে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারের কেন্দ্রবিন্দুতে প্রতিস্থাপন করতে হবে। তৃতীয়ত, ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই ক্ষমতাসীন দলটিকে বাংলাদেশের জন্য মধ্যমেয়াদি একটি অর্থনৈতিক রূপরেখা প্রণয়ন করতে হবে। সুনির্দিষ্ট সময়রেখায় সম্পন্ন এই রূপরেখা দেশের জনগণকে দেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা সম্পর্কে ধারণা দেবে। সেই সময়রেখা ধরে প্রতিবছর বিশ্বাসযোগ্য উপাত্তের মাধ্যমে রূপরেখাটির লক্ষ্য অর্জনের অগ্রগতির একটি বস্তুনিষ্ঠ পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করা হবে। এতে করে অর্থনৈতিক দিক থেকে জনগণের কাছে সরকারের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা যাবে।
এই রূপরেখার পরিপ্রেক্ষিতে একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ অর্থনীতির বর্তমান বাস্তবতা এবং অর্থনীতির ভবিষ্যতের জন্য এ রূপরেখায় কোন কোন বিষয়, সমস্যা এবং অন্তরায়গুলো বিবেচনায় আনা জরুরি। আমার মতে, তিন ধরনের সমস্যা যেমন প্রবহমান, ঘনীভূত এবং আসন্ন সমস্যাকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার।
বাংলাদেশের প্রবহমান সমস্যাগুলোর শীর্ষে রয়েছে দারিদ্র্য ও অসমতা। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিকট অতীতে দারিদ্র্য দূরীকরণে বাংলাদেশের অর্জনের অনেকটাই সাম্প্রতিক সময়ে খোয়া গেছে। ২০১০ থেকে ২০২২ সাল—এই ১২ বছরে বাংলাদেশ তার জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩ কোটি ৪৯ লাখ মানুষকে দারিদ্র্যসীমার ওপরে নিয়ে আসতে পেরেছিল। কিন্তু গত তিন বছরে বাংলাদেশে দারিদ্র্যহার আবার ১৮ শতাংশ থেকে ২১ শতাংশে উঠে গেছে। আজকে দেশের ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। গত তিন বছরে ৩০ লাখ লোক দারিদ্র্যের ফাঁদের মধ্যে পড়েছে। আরও ৬ কোটি ২০ লাখ লোক দারিদ্র্য ফাঁদে পড়ার হুমকিতে আছে। আমাদের অর্থনীতির অন্যতম বাস্তবতা হচ্ছে অসমতা ও বৈষম্য। যেমন দেশের উচ্চতম ২০ শতাংশ পরিবারে অনূর্ধ্ব ৫ বছরের শিশুমৃত্যুর হার যেখানে হাজারে ২০, সেখানে নিম্নতম ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সেই হার হচ্ছে হাজারে ২০ শতাংশ। সাম্প্রতিক সময়ে যদিও গ্রামে আয় অসমতায় স্থিতিশীল রয়েছে। তবে দেশের শহরাঞ্চলে তা বেড়ে গেছে।
দ্বিতীয় প্রবহমান সমস্যাটা হচ্ছে, স্বাস্থ্য, শিক্ষাক্ষেত্রে সামাজিক সেবার নিম্নমান। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাত পরিমাণগত দিক থেকে সম্প্রসারিত হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু সেসব অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সেবার মানে কোনো গুণগত উন্নতি কিংবা পরিবর্তন হয়নি। শিক্ষাক্ষেত্রে জ্ঞান কিংবা দক্ষতা অর্জন নয়, বরং সনদপ্রাপ্তিই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাস্থ্য খাতের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ কিন্তু উচ্চ মানসম্পন্ন সেবা প্রদান নয়। দুটি খাতেই উচ্চ মানসম্পন্ন সেবাগুলো সংরক্ষিত থাকে ধনিক শ্রেণির জন্য এবং এই জাতীয় বৈষম্যই বাংলাদেশের সমাজে অসমতা ত্বরান্বিত করার ব্যাপারে একটা চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে।
তৃতীয় প্রবহমান সমস্যাটা হচ্ছে, সঞ্চয়, বিনিয়োগ এবং সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে শ্লথগতি। প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে সঞ্চয়ের হার অত্যন্ত কম। অতীতে বাংলাদেশ যথেষ্ট পরিমাণে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারেনি। ভিয়েতনামের দিকে তাকালেই এ ব্যাপারে আমাদের ঘাটতি বোঝা যায়। বাংলাদেশে কর-জাতীয় আয়ের অনুপাত মাত্র ৮ থেকে ৯ শতাংশ, যেখানে নেপালে তা ১৯ শতাংশ এবং ভারতে ১২ শতাংশ। বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবেই রপ্তানি করের মতো অপ্রত্যক্ষ করের ওপর নির্ভর করেছে এবং সেই নির্ভরতা এখনো প্রত্যক্ষ করের দিকে যায়নি।
বাংলাদেশের ঘনীভূত সমস্যাগুলোর তালিকা বেশ দীর্ঘ। কর্মবিহীন প্রবৃদ্ধি, বিপুল বেকারত্ব, খেলাপি ঋণ, উল্লেখযোগ্য মানব-বঞ্চনা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গেড়ে বসেছে। ২০১৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশের শিল্প খাতে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও, দেশের অর্থনীতিতে প্রায় ১১ লাখ লোক কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এই সময়কালে পোশাকশিল্পের রপ্তানি তিন গুণ বেড়েছে, কিন্তু সেখানে কর্মসংস্থান স্থবিরই থেকে গেছে। সরকারি ভাষ্যমতে, দেশে বর্তমানে বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১৩ শতাংশ। তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার দেশের সার্বিক বেকারত্বের হারের দ্বিগুণ। বর্তমানে কর্মবিহীন প্রবৃদ্ধি এবং বেকারত্ব বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সমস্যা হিসেবে ঘনীভূত হচ্ছে।
দেশের আর্থিক খাত একটি গভীর সংকটের মধ্যে আছে। বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা বর্তমানে ৬ লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকা। বিদেশে অবৈধভাবে পাচার করা সুবিশাল অর্থের কিছুই উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা এখনো ফিরে আসেনি। দারিদ্র্য-বহির্ভূত মানব-বঞ্চনা আরও তীব্রতর হচ্ছে। প্রায় ১১ কোটি মানুষের জন্য নিরাপদ সুপেয় পানির সুবিধা নেই। অনূর্ধ্ব পাঁচ বছরের শিশুদের মধ্যে ৪১ শতাংশের জন্মনিবন্ধন হয়নি এবং ৫৯ শতাংশ শিশুর জন্মসনদ নেই। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ৫৭ শতাংশ শিশু দশম শ্রেণি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। গত ৬ বছরে শিশুশ্রম বেড়ে গেছে ২০১৯ সালের ৬ শতাংশ থেকে ২০২৫ সালের ৯ শতাংশ পর্যন্ত। বর্তমানে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার ৫৬ শতাংশ; যার মানে, ১৮ বছর অনূর্ধ্ব প্রতি দুজন বালিকার মধ্যে একজনকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের সংকটও ঘনীভূত হচ্ছে, যার নেতিবাচক প্রভাব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মানব উন্নয়নের ওপরে পড়বে। বাংলাদেশে নারীর প্রতি বৈষম্য এবং সহিংসতা শুধু অভাবনীয় একটি বাস্তবতাই নয়, বরং ঘনীভূত একটি সংকট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
বাংলাদেশ অর্থনীতির আসন্ন সমস্যাগুলো দেশের ভেতর এবং দেশের বাইরে থেকে উদ্ভূত। বহু বছরের ক্রমাগত হ্রাস এবং স্থবিরতার পরে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে নারীর প্রজনন হার বেড়ে গেছে। দেশের জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি এবং নগরায়ণের ওপরে এই বৃদ্ধির প্রভাব পড়বে। এই বৃদ্ধি বাংলাদেশ অর্থনীতিতে একটি বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। যেমন ইতিমধ্যে ৩ কোটি ৬৬ লাখ মানুষ নিয়ে ঢাকা নগরী জনসংখ্যার নিরিখে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। রাজধানী ঢাকা তার ধারণক্ষমতার প্রান্তসীমায় পৌঁছে গেছে। বায়ুদূষণ, পয়োনিষ্কাশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মতো সামাজিক সেবাকাঠামো ক্রমান্বয়ে ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে। মুক্ত মাঠ, পুকুর, জলাশয় হারিয়ে গিয়ে ঢাকা আজ একটি ইট-পাথরের নগরীতে পরিণত হয়েছে। এসবই জনজীবনে আসন্ন এক সংকটের সৃষ্টি করবে। বৈশ্বিক অঙ্গনে স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উত্তরণ এবং যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা আমদানি শুল্ক আরোপের ফলে আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে নানা সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, সেসব আসন্ন সংকটের জন্য বাংলাদেশের প্রস্তুতি কতখানি এবং সেই বিপৎসংকুল পথযাত্রায় বিজ্ঞতা এবং সুচিন্তিত পরিকল্পনা নিয়ে সেই বিপদ মোকাবিলা করে সব সংকট উতরে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারবে কি না।
বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচিত সরকারকে এই সংকটগুলো তার চিন্তার মধ্যে রাখতে হবে এবং এগুলোকে তার ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক রূপরেখার মধ্যে সন্নিবেশ করতে হবে। বস্তুনিষ্ঠ ও প্রাজ্ঞ নীতিমালা এবং প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন দিয়ে সরকার যদি সঠিক পথে এগিয়ে যায়, তাহলে বাংলাদেশ একটি অর্থনৈতিক পথযাত্রা গড়ে তুলতে পারবে, যেখানে সমতা এবং বৈষম্যহীন একটি অর্থনৈতিক গণতন্ত্র নিশ্চিত করে দেশের সব মানুষের সুকল্যাণ নিশ্চিত করা যাবে। যদি সে ব্যাপারে নবনির্বাচিত সরকার ব্যর্থ হয়, তাহলে সেটা হবে একটা বিশাল হৃত সুযোগ, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে বহুবার ঘটেছে।

সম্প্রতি ঢাকার একটি বাংলা দৈনিক পত্রিকা আয়োজিত অর্থনৈতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বক্তা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের প্রত্যেকেই দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছেন, আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে তাঁরা সরকার গঠন করলে দেশের অর্থনীতিই হবে তাঁদের কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। এ দেশের নাগরিকদের জন্য নিঃসন্দেহে এটি সুসংবাদ। কারণ, দেশের সাধারণ মানুষের কাছেও অর্থনীতিই হচ্ছে ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু। মূল্যস্ফীতি থেকে কর্মহীনতা, সুযোগের অসমতা, উৎপাদন-উপকরণে প্রবেশাধিকারের প্রতিবন্ধকতা, মৌলিক সামাজিক সেবার উন্নত মান, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ইত্যাদি হলো আমাদের অর্থনীতির মূল সমস্যা। সম্মেলনে রাজনৈতিক নেতারা এসব বিষয়কেই গুরুত্ব দিয়েছেন। কারণ, বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশের জনালোচনায় রাজনৈতিক বিষয়গুলোই একচেটিয়া প্রাধান্য পেয়ে আসছিল।
শুরুতে তিনটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষিত হওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, অর্থনীতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, এই অঙ্গীকার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সেই অঙ্গীকারে কোন কোন বিষয় অগ্রাধিকার পাবে, সেটাও চিহ্নিত হওয়া প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের উপর্যুক্ত অঙ্গীকার এবং চিহ্নিত অগ্রাধিকারগুলোকে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারের কেন্দ্রবিন্দুতে প্রতিস্থাপন করতে হবে। তৃতীয়ত, ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই ক্ষমতাসীন দলটিকে বাংলাদেশের জন্য মধ্যমেয়াদি একটি অর্থনৈতিক রূপরেখা প্রণয়ন করতে হবে। সুনির্দিষ্ট সময়রেখায় সম্পন্ন এই রূপরেখা দেশের জনগণকে দেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা সম্পর্কে ধারণা দেবে। সেই সময়রেখা ধরে প্রতিবছর বিশ্বাসযোগ্য উপাত্তের মাধ্যমে রূপরেখাটির লক্ষ্য অর্জনের অগ্রগতির একটি বস্তুনিষ্ঠ পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করা হবে। এতে করে অর্থনৈতিক দিক থেকে জনগণের কাছে সরকারের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা যাবে।
এই রূপরেখার পরিপ্রেক্ষিতে একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ অর্থনীতির বর্তমান বাস্তবতা এবং অর্থনীতির ভবিষ্যতের জন্য এ রূপরেখায় কোন কোন বিষয়, সমস্যা এবং অন্তরায়গুলো বিবেচনায় আনা জরুরি। আমার মতে, তিন ধরনের সমস্যা যেমন প্রবহমান, ঘনীভূত এবং আসন্ন সমস্যাকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার।
বাংলাদেশের প্রবহমান সমস্যাগুলোর শীর্ষে রয়েছে দারিদ্র্য ও অসমতা। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিকট অতীতে দারিদ্র্য দূরীকরণে বাংলাদেশের অর্জনের অনেকটাই সাম্প্রতিক সময়ে খোয়া গেছে। ২০১০ থেকে ২০২২ সাল—এই ১২ বছরে বাংলাদেশ তার জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩ কোটি ৪৯ লাখ মানুষকে দারিদ্র্যসীমার ওপরে নিয়ে আসতে পেরেছিল। কিন্তু গত তিন বছরে বাংলাদেশে দারিদ্র্যহার আবার ১৮ শতাংশ থেকে ২১ শতাংশে উঠে গেছে। আজকে দেশের ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। গত তিন বছরে ৩০ লাখ লোক দারিদ্র্যের ফাঁদের মধ্যে পড়েছে। আরও ৬ কোটি ২০ লাখ লোক দারিদ্র্য ফাঁদে পড়ার হুমকিতে আছে। আমাদের অর্থনীতির অন্যতম বাস্তবতা হচ্ছে অসমতা ও বৈষম্য। যেমন দেশের উচ্চতম ২০ শতাংশ পরিবারে অনূর্ধ্ব ৫ বছরের শিশুমৃত্যুর হার যেখানে হাজারে ২০, সেখানে নিম্নতম ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সেই হার হচ্ছে হাজারে ২০ শতাংশ। সাম্প্রতিক সময়ে যদিও গ্রামে আয় অসমতায় স্থিতিশীল রয়েছে। তবে দেশের শহরাঞ্চলে তা বেড়ে গেছে।
দ্বিতীয় প্রবহমান সমস্যাটা হচ্ছে, স্বাস্থ্য, শিক্ষাক্ষেত্রে সামাজিক সেবার নিম্নমান। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাত পরিমাণগত দিক থেকে সম্প্রসারিত হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু সেসব অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সেবার মানে কোনো গুণগত উন্নতি কিংবা পরিবর্তন হয়নি। শিক্ষাক্ষেত্রে জ্ঞান কিংবা দক্ষতা অর্জন নয়, বরং সনদপ্রাপ্তিই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাস্থ্য খাতের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ কিন্তু উচ্চ মানসম্পন্ন সেবা প্রদান নয়। দুটি খাতেই উচ্চ মানসম্পন্ন সেবাগুলো সংরক্ষিত থাকে ধনিক শ্রেণির জন্য এবং এই জাতীয় বৈষম্যই বাংলাদেশের সমাজে অসমতা ত্বরান্বিত করার ব্যাপারে একটা চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে।
তৃতীয় প্রবহমান সমস্যাটা হচ্ছে, সঞ্চয়, বিনিয়োগ এবং সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে শ্লথগতি। প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে সঞ্চয়ের হার অত্যন্ত কম। অতীতে বাংলাদেশ যথেষ্ট পরিমাণে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারেনি। ভিয়েতনামের দিকে তাকালেই এ ব্যাপারে আমাদের ঘাটতি বোঝা যায়। বাংলাদেশে কর-জাতীয় আয়ের অনুপাত মাত্র ৮ থেকে ৯ শতাংশ, যেখানে নেপালে তা ১৯ শতাংশ এবং ভারতে ১২ শতাংশ। বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবেই রপ্তানি করের মতো অপ্রত্যক্ষ করের ওপর নির্ভর করেছে এবং সেই নির্ভরতা এখনো প্রত্যক্ষ করের দিকে যায়নি।
বাংলাদেশের ঘনীভূত সমস্যাগুলোর তালিকা বেশ দীর্ঘ। কর্মবিহীন প্রবৃদ্ধি, বিপুল বেকারত্ব, খেলাপি ঋণ, উল্লেখযোগ্য মানব-বঞ্চনা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গেড়ে বসেছে। ২০১৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশের শিল্প খাতে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও, দেশের অর্থনীতিতে প্রায় ১১ লাখ লোক কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এই সময়কালে পোশাকশিল্পের রপ্তানি তিন গুণ বেড়েছে, কিন্তু সেখানে কর্মসংস্থান স্থবিরই থেকে গেছে। সরকারি ভাষ্যমতে, দেশে বর্তমানে বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১৩ শতাংশ। তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার দেশের সার্বিক বেকারত্বের হারের দ্বিগুণ। বর্তমানে কর্মবিহীন প্রবৃদ্ধি এবং বেকারত্ব বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সমস্যা হিসেবে ঘনীভূত হচ্ছে।
দেশের আর্থিক খাত একটি গভীর সংকটের মধ্যে আছে। বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা বর্তমানে ৬ লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকা। বিদেশে অবৈধভাবে পাচার করা সুবিশাল অর্থের কিছুই উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা এখনো ফিরে আসেনি। দারিদ্র্য-বহির্ভূত মানব-বঞ্চনা আরও তীব্রতর হচ্ছে। প্রায় ১১ কোটি মানুষের জন্য নিরাপদ সুপেয় পানির সুবিধা নেই। অনূর্ধ্ব পাঁচ বছরের শিশুদের মধ্যে ৪১ শতাংশের জন্মনিবন্ধন হয়নি এবং ৫৯ শতাংশ শিশুর জন্মসনদ নেই। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ৫৭ শতাংশ শিশু দশম শ্রেণি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। গত ৬ বছরে শিশুশ্রম বেড়ে গেছে ২০১৯ সালের ৬ শতাংশ থেকে ২০২৫ সালের ৯ শতাংশ পর্যন্ত। বর্তমানে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার ৫৬ শতাংশ; যার মানে, ১৮ বছর অনূর্ধ্ব প্রতি দুজন বালিকার মধ্যে একজনকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের সংকটও ঘনীভূত হচ্ছে, যার নেতিবাচক প্রভাব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মানব উন্নয়নের ওপরে পড়বে। বাংলাদেশে নারীর প্রতি বৈষম্য এবং সহিংসতা শুধু অভাবনীয় একটি বাস্তবতাই নয়, বরং ঘনীভূত একটি সংকট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
বাংলাদেশ অর্থনীতির আসন্ন সমস্যাগুলো দেশের ভেতর এবং দেশের বাইরে থেকে উদ্ভূত। বহু বছরের ক্রমাগত হ্রাস এবং স্থবিরতার পরে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে নারীর প্রজনন হার বেড়ে গেছে। দেশের জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি এবং নগরায়ণের ওপরে এই বৃদ্ধির প্রভাব পড়বে। এই বৃদ্ধি বাংলাদেশ অর্থনীতিতে একটি বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। যেমন ইতিমধ্যে ৩ কোটি ৬৬ লাখ মানুষ নিয়ে ঢাকা নগরী জনসংখ্যার নিরিখে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। রাজধানী ঢাকা তার ধারণক্ষমতার প্রান্তসীমায় পৌঁছে গেছে। বায়ুদূষণ, পয়োনিষ্কাশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মতো সামাজিক সেবাকাঠামো ক্রমান্বয়ে ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে। মুক্ত মাঠ, পুকুর, জলাশয় হারিয়ে গিয়ে ঢাকা আজ একটি ইট-পাথরের নগরীতে পরিণত হয়েছে। এসবই জনজীবনে আসন্ন এক সংকটের সৃষ্টি করবে। বৈশ্বিক অঙ্গনে স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উত্তরণ এবং যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা আমদানি শুল্ক আরোপের ফলে আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে নানা সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, সেসব আসন্ন সংকটের জন্য বাংলাদেশের প্রস্তুতি কতখানি এবং সেই বিপৎসংকুল পথযাত্রায় বিজ্ঞতা এবং সুচিন্তিত পরিকল্পনা নিয়ে সেই বিপদ মোকাবিলা করে সব সংকট উতরে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারবে কি না।
বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচিত সরকারকে এই সংকটগুলো তার চিন্তার মধ্যে রাখতে হবে এবং এগুলোকে তার ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক রূপরেখার মধ্যে সন্নিবেশ করতে হবে। বস্তুনিষ্ঠ ও প্রাজ্ঞ নীতিমালা এবং প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন দিয়ে সরকার যদি সঠিক পথে এগিয়ে যায়, তাহলে বাংলাদেশ একটি অর্থনৈতিক পথযাত্রা গড়ে তুলতে পারবে, যেখানে সমতা এবং বৈষম্যহীন একটি অর্থনৈতিক গণতন্ত্র নিশ্চিত করে দেশের সব মানুষের সুকল্যাণ নিশ্চিত করা যাবে। যদি সে ব্যাপারে নবনির্বাচিত সরকার ব্যর্থ হয়, তাহলে সেটা হবে একটা বিশাল হৃত সুযোগ, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে বহুবার ঘটেছে।

সংবাদটি অনেকটা নীরবেই এসেছে সংবাদপত্রে—দৃষ্টিও কাড়েনি তা বড় একটা। হয়তো সেটি তেমন কোনো উত্তেজক বিষয় নয় বলে; কিংবা তা সরব কোনো সংকট না হওয়ার কারণে। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে, সংবাদটি একটি অশনিসংকেত বয়ে আনে। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সনদপ্রাপ্ত প্রায় ৯ লাখ তরুণ কর্মহীন...
০১ অক্টোবর ২০২৫
শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে আলবদর ঘাতকেরা ঘর থেকে তুলে নিয়ে যায় ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর, মধ্যরাতে। ডিসেম্বরে পাকিস্তানি হানাদার ও আলবদররা যে বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ শুরু করেছিল, সিরাজুদ্দীন ছিলেন তার প্রথম শিকার। এরপর তিনি আর ফেরেননি, মরদেহও পাওয়া যায়নি। তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন কলমসৈনিককে
৮ ঘণ্টা আগে
বিশ্বব্যাপী ১০ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। ২০২৫ সালের এ দিবসের প্রতিপাদ্য হলো, ‘আওয়ার এভরিডে অ্যাসেনশিয়ালস’; অর্থাৎ, ‘আমাদের প্রতিদিনের অত্যাবশ্যকীয়তা’ কথাটি শুনতে সহজ মনে হলেও এর গভীরে লুকিয়ে আছে মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারগুলোর কথা। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে আজ
৮ ঘণ্টা আগে
মোহাম্মদপুরে ৮ ডিসেম্বর সোমবার সকালে খুন হলেন মা ও মেয়ে। দীর্ঘদিন শাহজাহান রোডের আমেনাস ড্রিম নামের যে বাড়িতে তাঁরা বসবাস করছিলেন, সেই বাড়িতেই গৃহকর্মীর উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে নিহত হলেন তাঁরা। ১৪ তলা ভবনের বিভিন্ন সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ধারণা করা হচ্ছে, বোরকা পরে এই গৃহকর্মী ঢুকেছিলেন ফ্ল্যাটে, মা
৮ ঘণ্টা আগেরাহাত মিনহাজ

শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে আলবদর ঘাতকেরা ঘর থেকে তুলে নিয়ে যায় ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর, মধ্যরাতে। ডিসেম্বরে পাকিস্তানি হানাদার ও আলবদররা যে বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ শুরু করেছিল, সিরাজুদ্দীন ছিলেন তার প্রথম শিকার। এরপর তিনি আর ফেরেননি, মরদেহও পাওয়া যায়নি। তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন কলমসৈনিককে আলবদর ঘাতকেরা যে প্রাণে বাঁচিয়ে রাখেনি, তা অনেক আগেই নিশ্চিত হওয়া গেছে। কিন্তু এরপরও হয়তো এই সাংবাদিক পরিবারের সদস্যরা বছরের পর বছর অকল্পনীয়, অবিশ্বাস্য স্বপ্নে সিরাজুদ্দীন হোসেনের প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষা করেছেন। বাড়ির দরজা খুলে রেখেছেন, প্রার্থনা করেছেন, হয়তো মানত করেছেন, সদকা দিয়েছেন, পীর-ফকিরের মাজারে মাথা ঠুকেছেন। আশা—কোনো এক অবিশ্বাস্য বাস্তবতায় সিরাজুদ্দীন ঘরে ফিরবেন। কিন্তু নাহ্, তিনি ফেরেননি!
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে দৈনিক ইত্তেফাক অফিসে ছিলেন সিরাজুদ্দীন হোসেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, কোনো অবস্থাতেই সংবাদপত্র অফিসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হামলা করবে না। এটা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। সিরাজুদ্দীনের ধারণা ভুল ছিল। অপারেশন সার্চলাইট শুরুর পর ইত্তেফাক ভবনে পাকিস্তানিরা দুই দফা গুলিবর্ষণ করে। এতে শহীদ হন সংবাদপত্রটির ক্যানটিন ব্যবস্থাপকের ভাতিজা। এ ছাড়া ২৬ মার্চ সকালে গানপাউডার ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। সে সময় কোনোমতে প্রাণ নিয়ে অফিস ত্যাগ করেন সিরাজুদ্দীনসহ অন্যরা। এরপর ২১ মে ১৯৭১ থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কড়া নজরদারিতে সংবাদপত্রটি আবারও প্রকাশিত হয়। সেনা অধীনে সংবাদপত্র প্রকাশে আগ্রহী ছিলেন না সিরাজুদ্দীন হোসেন। যদিও তিনি বাধ্য হন।
দীর্ঘদিন ধরে দৈনিক ইত্তেফাকের প্রাণভোমরা ছিলেন সিরাজুদ্দীন। ১৯৬৯ সালের ১ জুন আকস্মিকভাবে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মৃত্যুর পর সংবাদপত্রটির সবকিছু ছিলেন সিরাজুদ্দীন। তাই ১৯৭১ সালের ২১ মে থেকে নতুন করে প্রকাশের সময়ও সংবাদপত্রটির সবকিছুর দায়িত্বে ছিলেন এই সাংবাদিক। এ সময় বলবৎ ছিল ইয়াহিয়া খানের ৭৭ নম্বর সামরিক বিধি। ছিল কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের সেন্সরশিপ হাউস এবং সেনাবাহিনীর ইন্টার সার্ভিস পাবলিক রিলেশন বিভাগের প্রধান মেজর সিদ্দিক সালিক।
তবে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও প্রজ্ঞা ও দেশপ্রেমে অভূতপূর্ব সাংবাদিকতা করেছেন সিরাজুদ্দীন হোসেন। এ সময় পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু ইংরেজি ও উর্দু সংবাদপত্রে কিছু সংকটের কথা প্রকাশিত হতো। বাঙালি জাতির মনোবল বাড়াতে এবং যুদ্ধ যে চলছে, সে বিষয়টি তুলে ধরতে সিরাজুদ্দীন এই সংবাদগুলো অনুবাদ করে ইত্তেফাকে প্রকাশ করতেন। লিখেছেন রাজনৈতিক ভাষ্য ও সম্পাদকীয়। যেগুলোর মধ্য দিয়ে কৌশলে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের সলতেটি জ্বালিয়ে রেখেছিলেন এই সাংবাদিক; যা আধুনিক সংঘাতসংক্রান্ত সাংবাদিকতার বিশেষ পাঠ হতে পারে।
দৈনিক ইত্তেফাকের পাতায় সিরাজুদ্দীনের লেখা ‘এত দিনে’ শিরোনামের সম্পাদকীয়টি ছাপা হয়েছিল ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে। যে কালরাতে ঘাতকেরা তাঁকে ছিনিয়ে নিয়েছিল পরিবারের কাছ থেকে। ‘এত দিনে’ শিরোনামের সেই লেখায় ছিল বাংলাদেশ ঘিরে আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা বিশ্লেষণ। ক্ষমতাধর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকার বুকে যে ঘৃণ্য হামলা শুরু করেছিল, তাতে হায়েনাদের প্রধান সম্বল ছিল আমেরিকান এম-২৪ ট্যাংক। শুধু তা-ই নয়, বাঙালি জাতির ন্যায়সংগত মুক্তিসংগ্রামকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করে নিশ্চুপ ছিল। গণহত্যার প্রশ্নেও টুঁ শব্দ করেনি নিক্সন-কিসিঞ্জারের প্রশাসন। কিন্তু ৩ ডিসেম্বরের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের পরিবর্তন হয়। পাকিস্তানের পরাজয় যখন সন্নিকটে, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেকটা সরব হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রের এই দ্বৈত নীতি নিয়েই ছিল ‘এত দিনে’।
এই সম্পাদকীয়তে সিরাজুদ্দীন হোসেন লিখেছেন, ‘বিপন্ন মানবতার স্বার্থে যে সমস্যার আশু সমাধান যখন অপরিহার্য ছিল, তখনো বৃহৎ শক্তিসমূহকে ‘ঘরোয়া ব্যাপার’, ‘অভ্যন্তরীণ ব্যাপার’ ইত্যাদি বাগ্বিতণ্ডায় ধূম্রজাল তুলিয়া সমস্যার মানবিক দিকটি চাপা দিয়া পরিস্থিতিকে আরো ঘোরালো, আরো জটিল করিয়া তুলিতেই দেখা গিয়াছে। অথচ পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত সমস্যা কী, প্রকৃত পরিস্থিতিই বা কী, তাহা যে তাহাদের অজানা ছিল তাহাও নয়।’ একেবারে যথাযথ বিশ্লেষণ। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের পতন ঠেকানো। যা করতেই উঠেপড়ে লেগেছিল পাকিস্তানের মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন।
সম্পাদকীয়টিতে পরের দিকে সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন তুলে ধরেছেন বাঙালির চাওয়া ও স্বপ্নের কথা। তিনি লিখেছেন, ‘বিন্দুমাত্র বুদ্ধি যাহার ঘটে আছে, তাহার পক্ষে জনগণের স্বার্থ ও জনগণের মানসিক অবস্থা আমলে না আনিয়া কোনো অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা অথবা কোনো রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের কথা চিন্তা করাও সম্ভব নয়।’ ১৯৭১ সালে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির আকাঙ্ক্ষা ছিল স্বাধীনতা। যদিও সেই বিষয়টি পাশ কাটিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ভিন্ন পথে হাঁটছিল। দেশ দুটির অবস্থান ছিল গণতন্ত্রকামী সাড়ে সাত কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষার বিপরীত।
সম্পাদকীয়টির শেষ দিকে সিরাজুদ্দীন হোসেন লিখেছেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের সংকটের প্রশ্নেও বিশ্বের রাষ্ট্রীয় কর্ণধাররা সে মানসিকতার ঊর্ধ্বে উঠিতে পারিয়াছেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের গতকল্যকার বক্তব্যে অন্তত তাহার কোনই পরিচয় নাই। আর নাই বলিয়াই ঘটনা চলিয়াছে আপন নিয়মে।’ গতকালের বলতে এখানে ৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে নিরাপত্তা পরিষদে মার্কিন প্রতিনিধি জর্জ বুশ সিনিয়রের আহ্বানকে বুঝিয়েছেন সিরাজুদ্দীন হোসেন। এ সময় যেকোনো অবস্থায় একটা যুদ্ধ বিরতিতে পৌঁছাতে মরিয়া ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি। কিন্তু যে আহ্বান বা প্রচেষ্টা ছিল সম্পূর্ণ বাস্তবতাবিবর্জিত।
এই সম্পাদকীয়তেও একজন দক্ষ সাংবাদিকের মুনশিয়ানা দেখিয়েছিলেন সিরাজুদ্দীন হোসেন। তিনি যে একজন ‘রাজনৈতিক সাংবাদিক’ ছিলেন, ‘এত দিনে’ সম্পাদকীয়টিতে তারই প্রতিফলন ছিল।

শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে আলবদর ঘাতকেরা ঘর থেকে তুলে নিয়ে যায় ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর, মধ্যরাতে। ডিসেম্বরে পাকিস্তানি হানাদার ও আলবদররা যে বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ শুরু করেছিল, সিরাজুদ্দীন ছিলেন তার প্রথম শিকার। এরপর তিনি আর ফেরেননি, মরদেহও পাওয়া যায়নি। তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন কলমসৈনিককে আলবদর ঘাতকেরা যে প্রাণে বাঁচিয়ে রাখেনি, তা অনেক আগেই নিশ্চিত হওয়া গেছে। কিন্তু এরপরও হয়তো এই সাংবাদিক পরিবারের সদস্যরা বছরের পর বছর অকল্পনীয়, অবিশ্বাস্য স্বপ্নে সিরাজুদ্দীন হোসেনের প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষা করেছেন। বাড়ির দরজা খুলে রেখেছেন, প্রার্থনা করেছেন, হয়তো মানত করেছেন, সদকা দিয়েছেন, পীর-ফকিরের মাজারে মাথা ঠুকেছেন। আশা—কোনো এক অবিশ্বাস্য বাস্তবতায় সিরাজুদ্দীন ঘরে ফিরবেন। কিন্তু নাহ্, তিনি ফেরেননি!
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে দৈনিক ইত্তেফাক অফিসে ছিলেন সিরাজুদ্দীন হোসেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, কোনো অবস্থাতেই সংবাদপত্র অফিসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হামলা করবে না। এটা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। সিরাজুদ্দীনের ধারণা ভুল ছিল। অপারেশন সার্চলাইট শুরুর পর ইত্তেফাক ভবনে পাকিস্তানিরা দুই দফা গুলিবর্ষণ করে। এতে শহীদ হন সংবাদপত্রটির ক্যানটিন ব্যবস্থাপকের ভাতিজা। এ ছাড়া ২৬ মার্চ সকালে গানপাউডার ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। সে সময় কোনোমতে প্রাণ নিয়ে অফিস ত্যাগ করেন সিরাজুদ্দীনসহ অন্যরা। এরপর ২১ মে ১৯৭১ থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কড়া নজরদারিতে সংবাদপত্রটি আবারও প্রকাশিত হয়। সেনা অধীনে সংবাদপত্র প্রকাশে আগ্রহী ছিলেন না সিরাজুদ্দীন হোসেন। যদিও তিনি বাধ্য হন।
দীর্ঘদিন ধরে দৈনিক ইত্তেফাকের প্রাণভোমরা ছিলেন সিরাজুদ্দীন। ১৯৬৯ সালের ১ জুন আকস্মিকভাবে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মৃত্যুর পর সংবাদপত্রটির সবকিছু ছিলেন সিরাজুদ্দীন। তাই ১৯৭১ সালের ২১ মে থেকে নতুন করে প্রকাশের সময়ও সংবাদপত্রটির সবকিছুর দায়িত্বে ছিলেন এই সাংবাদিক। এ সময় বলবৎ ছিল ইয়াহিয়া খানের ৭৭ নম্বর সামরিক বিধি। ছিল কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের সেন্সরশিপ হাউস এবং সেনাবাহিনীর ইন্টার সার্ভিস পাবলিক রিলেশন বিভাগের প্রধান মেজর সিদ্দিক সালিক।
তবে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও প্রজ্ঞা ও দেশপ্রেমে অভূতপূর্ব সাংবাদিকতা করেছেন সিরাজুদ্দীন হোসেন। এ সময় পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু ইংরেজি ও উর্দু সংবাদপত্রে কিছু সংকটের কথা প্রকাশিত হতো। বাঙালি জাতির মনোবল বাড়াতে এবং যুদ্ধ যে চলছে, সে বিষয়টি তুলে ধরতে সিরাজুদ্দীন এই সংবাদগুলো অনুবাদ করে ইত্তেফাকে প্রকাশ করতেন। লিখেছেন রাজনৈতিক ভাষ্য ও সম্পাদকীয়। যেগুলোর মধ্য দিয়ে কৌশলে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের সলতেটি জ্বালিয়ে রেখেছিলেন এই সাংবাদিক; যা আধুনিক সংঘাতসংক্রান্ত সাংবাদিকতার বিশেষ পাঠ হতে পারে।
দৈনিক ইত্তেফাকের পাতায় সিরাজুদ্দীনের লেখা ‘এত দিনে’ শিরোনামের সম্পাদকীয়টি ছাপা হয়েছিল ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে। যে কালরাতে ঘাতকেরা তাঁকে ছিনিয়ে নিয়েছিল পরিবারের কাছ থেকে। ‘এত দিনে’ শিরোনামের সেই লেখায় ছিল বাংলাদেশ ঘিরে আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা বিশ্লেষণ। ক্ষমতাধর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকার বুকে যে ঘৃণ্য হামলা শুরু করেছিল, তাতে হায়েনাদের প্রধান সম্বল ছিল আমেরিকান এম-২৪ ট্যাংক। শুধু তা-ই নয়, বাঙালি জাতির ন্যায়সংগত মুক্তিসংগ্রামকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করে নিশ্চুপ ছিল। গণহত্যার প্রশ্নেও টুঁ শব্দ করেনি নিক্সন-কিসিঞ্জারের প্রশাসন। কিন্তু ৩ ডিসেম্বরের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের পরিবর্তন হয়। পাকিস্তানের পরাজয় যখন সন্নিকটে, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেকটা সরব হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রের এই দ্বৈত নীতি নিয়েই ছিল ‘এত দিনে’।
এই সম্পাদকীয়তে সিরাজুদ্দীন হোসেন লিখেছেন, ‘বিপন্ন মানবতার স্বার্থে যে সমস্যার আশু সমাধান যখন অপরিহার্য ছিল, তখনো বৃহৎ শক্তিসমূহকে ‘ঘরোয়া ব্যাপার’, ‘অভ্যন্তরীণ ব্যাপার’ ইত্যাদি বাগ্বিতণ্ডায় ধূম্রজাল তুলিয়া সমস্যার মানবিক দিকটি চাপা দিয়া পরিস্থিতিকে আরো ঘোরালো, আরো জটিল করিয়া তুলিতেই দেখা গিয়াছে। অথচ পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত সমস্যা কী, প্রকৃত পরিস্থিতিই বা কী, তাহা যে তাহাদের অজানা ছিল তাহাও নয়।’ একেবারে যথাযথ বিশ্লেষণ। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের পতন ঠেকানো। যা করতেই উঠেপড়ে লেগেছিল পাকিস্তানের মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন।
সম্পাদকীয়টিতে পরের দিকে সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন তুলে ধরেছেন বাঙালির চাওয়া ও স্বপ্নের কথা। তিনি লিখেছেন, ‘বিন্দুমাত্র বুদ্ধি যাহার ঘটে আছে, তাহার পক্ষে জনগণের স্বার্থ ও জনগণের মানসিক অবস্থা আমলে না আনিয়া কোনো অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা অথবা কোনো রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের কথা চিন্তা করাও সম্ভব নয়।’ ১৯৭১ সালে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির আকাঙ্ক্ষা ছিল স্বাধীনতা। যদিও সেই বিষয়টি পাশ কাটিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ভিন্ন পথে হাঁটছিল। দেশ দুটির অবস্থান ছিল গণতন্ত্রকামী সাড়ে সাত কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষার বিপরীত।
সম্পাদকীয়টির শেষ দিকে সিরাজুদ্দীন হোসেন লিখেছেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের সংকটের প্রশ্নেও বিশ্বের রাষ্ট্রীয় কর্ণধাররা সে মানসিকতার ঊর্ধ্বে উঠিতে পারিয়াছেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের গতকল্যকার বক্তব্যে অন্তত তাহার কোনই পরিচয় নাই। আর নাই বলিয়াই ঘটনা চলিয়াছে আপন নিয়মে।’ গতকালের বলতে এখানে ৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে নিরাপত্তা পরিষদে মার্কিন প্রতিনিধি জর্জ বুশ সিনিয়রের আহ্বানকে বুঝিয়েছেন সিরাজুদ্দীন হোসেন। এ সময় যেকোনো অবস্থায় একটা যুদ্ধ বিরতিতে পৌঁছাতে মরিয়া ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি। কিন্তু যে আহ্বান বা প্রচেষ্টা ছিল সম্পূর্ণ বাস্তবতাবিবর্জিত।
এই সম্পাদকীয়তেও একজন দক্ষ সাংবাদিকের মুনশিয়ানা দেখিয়েছিলেন সিরাজুদ্দীন হোসেন। তিনি যে একজন ‘রাজনৈতিক সাংবাদিক’ ছিলেন, ‘এত দিনে’ সম্পাদকীয়টিতে তারই প্রতিফলন ছিল।

সংবাদটি অনেকটা নীরবেই এসেছে সংবাদপত্রে—দৃষ্টিও কাড়েনি তা বড় একটা। হয়তো সেটি তেমন কোনো উত্তেজক বিষয় নয় বলে; কিংবা তা সরব কোনো সংকট না হওয়ার কারণে। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে, সংবাদটি একটি অশনিসংকেত বয়ে আনে। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সনদপ্রাপ্ত প্রায় ৯ লাখ তরুণ কর্মহীন...
০১ অক্টোবর ২০২৫
সম্প্রতি ঢাকার একটি বাংলা দৈনিক পত্রিকা আয়োজিত অর্থনৈতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বক্তা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের প্রত্যেকেই দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছেন, আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে তাঁরা সরকার গঠন করলে দেশের অর্থনীতিই হবে তাঁদের কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। এ দেশের নাগরিকদে
৮ ঘণ্টা আগে
বিশ্বব্যাপী ১০ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। ২০২৫ সালের এ দিবসের প্রতিপাদ্য হলো, ‘আওয়ার এভরিডে অ্যাসেনশিয়ালস’; অর্থাৎ, ‘আমাদের প্রতিদিনের অত্যাবশ্যকীয়তা’ কথাটি শুনতে সহজ মনে হলেও এর গভীরে লুকিয়ে আছে মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারগুলোর কথা। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে আজ
৮ ঘণ্টা আগে
মোহাম্মদপুরে ৮ ডিসেম্বর সোমবার সকালে খুন হলেন মা ও মেয়ে। দীর্ঘদিন শাহজাহান রোডের আমেনাস ড্রিম নামের যে বাড়িতে তাঁরা বসবাস করছিলেন, সেই বাড়িতেই গৃহকর্মীর উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে নিহত হলেন তাঁরা। ১৪ তলা ভবনের বিভিন্ন সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ধারণা করা হচ্ছে, বোরকা পরে এই গৃহকর্মী ঢুকেছিলেন ফ্ল্যাটে, মা
৮ ঘণ্টা আগেআন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস
হাসান আলী

বিশ্বব্যাপী ১০ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। ২০২৫ সালের এ দিবসের প্রতিপাদ্য হলো, ‘আওয়ার এভরিডে অ্যাসেনশিয়ালস’; অর্থাৎ, ‘আমাদের প্রতিদিনের অত্যাবশ্যকীয়তা’ কথাটি শুনতে সহজ মনে হলেও এর গভীরে লুকিয়ে আছে মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারগুলোর কথা। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে আজ আমাদের দেশের অবহেলিত প্রবীণদের বঞ্চনা এবং তাঁদের অধিকার পাওয়া নিয়ে আলোচনা করব।
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় দুই কোটি প্রবীণ মানুষ বসবাস করছেন। এই সংখ্যা কেবল একটি পরিসংখ্যান
নয়, এটি দুই কোটি জীবনের গল্প, ত্যাগের ইতিহাস, সংগ্রামের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার বিশাল ভান্ডার। অথচ দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, এই দুই কোটি প্রবীণের একটি বড় অংশ আজও মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে অনেকে অনিশ্চয়তা, অবহেলা ও একাকিত্বের বোঝা তাঁরা বয়ে বেড়াচ্ছেন।
‘আমাদের প্রতিদিনের অত্যাবশ্যকীয়তা’ বলতে প্রথমে বুঝি, ভাত, কাপড়, বাসস্থান ও চিকিৎসা। কিন্তু বাস্তবে কতজন প্রবীণ নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার পান? কতজন প্রবীণ নিয়মিত চিকিৎসাসেবা পান? অনেক বৃদ্ধ বাবা-মা শেষ বয়সে হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকেন সন্তানের অবহেলায়, অর্থের অভাবে কিংবা ভুল সিদ্ধান্তের কারণে। চিকিৎসার অভাবে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকা—এ কি মানুষের মৌলিক অধিকার হতে পারে?
প্রবীণের অধিকার শুধু খাদ্য বা চিকিৎসায় সীমাবদ্ধ নয়, সম্মান পাওয়াও একটি মৌলিক মানবাধিকারের মধ্যে পড়ে। কিন্তু আজ অনেক ঘরে প্রবীণেরা হয়ে উঠছেন ‘বোঝা’। সংসারের যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় সন্তানেরা তাঁদের মতামতের মূল্য দেন না। ছোট ছোট বিষয়েও উপেক্ষা করা হয় তাঁদের মতামত। অথচ একসময় এই মানুষেরা হাজারো প্রতিকূলতার মধ্যেও সংসারের তাকত বোঝা বহন করেছেন।
‘আমাদের প্রতিদিনের অত্যাবশ্যকীয়তা’—বাক্যটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো নিরাপত্তা ও মানসিক শান্তি। কিন্তু কত প্রবীণ আজ ভয় নিয়ে দিন কাটান—এই বুঝি বাড়ি তাঁকে থেকে বের করে দেওয়া হলো, এই বুঝি জমিজমা হাতছাড়া হয়ে গেল, এই বুঝি সন্তান মুখ ফিরিয়ে নিল! এই ভয়, এই অনিশ্চয়তা কোনো মানুষের জীবনের শেষ অধ্যায়ের জন্য কখনোই কাম্য হতে পারে না।
গ্রাম হোক কিংবা শহর—চিত্র খুব একটা আলাদা নয়। কোথাও প্রবীণ মা-বাবা সারা দিন একাকিত্বে দিন কাটান, কোথাও বৃদ্ধ বাবার চিকিৎসার টাকা নিয়ে ভাই-বোনের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ, মামলা-মোকদ্দমা পর্যন্ত গড়ায়। অথচ এই মানুষগুলোর নিঃস্বার্থ শ্রম, ভালোবাসা ও ত্যাগের ওপরেই গড়ে উঠেছে আজকের পরিবার ও সমাজের ভিত্তি।
মানবাধিকার দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানবাধিকার মানে শুধু আন্তর্জাতিক চুক্তি নয়, এটি ঘরের ভেতরের আচরণও। প্রবীণকে সময় দেওয়া, তাঁর কথা মন দিয়ে শোনা, অসুস্থ হলে পাশে দাঁড়ানো, একাকিত্বে তাঁকে সঙ্গ দেওয়া—এসবই মানবাধিকারের জীবন্ত প্রকাশ।
রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের কথাও এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রবীণ ভাতা, বিনা মূল্যে কিংবা স্বল্প মূল্যে চিকিৎসাসেবা, নিরাপদ আশ্রয়, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা—এসব নিশ্চিত করাই রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অনেক প্রবীণ এসব সুযোগ সম্পর্কে জানেন না, আবার অনেকে পেতে গিয়ে হয়রানি ও দুর্ভোগের শিকার হন। শুধু আইন থাকলেই হবে না, তার সঠিক বাস্তবায়ন জরুরি।
যেভাবে আমরা নিজেদের দৈনন্দিন প্রয়োজন ছাড়া একমুহূর্তও চলতে পারি না, তেমনি প্রবীণদের দৈনন্দিন চাহিদাগুলো উপেক্ষা করে কোনো সভ্য সমাজ টিকে থাকতে পারে না। প্রবীণেরা শুধু আমাদের অতীতের মানুষ নন,
তাঁরা আমাদের বর্তমানের অভিভাবক এবং ভবিষ্যতের জন্য এক জীবন্ত শিক্ষালয়।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস তখনই পালন করা সার্থক হবে, যখন আমরা আমাদের বাবা-মাকে ‘বোঝা’ নয়, ‘বটবৃক্ষ’ হিসেবে দেখব। প্রবীণের খাদ্য, চিকিৎসা, নিরাপত্তা ও সম্মানকে দয়া নয়; অধিকার হিসেবে মান্য করব এবং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রবীণবান্ধব মনোভাব গড়ে তুলতে পারব। কারণ, যে সমাজ তার প্রবীণদের সম্মান করতে জানে না, সে সমাজ কখনোই প্রকৃত অর্থে মানবিক হতে পারে না। মানবাধিকারের আলো তখনই সম্পূর্ণ হয়, যখন সেই আলো দুই কোটি প্রবীণের চোখেও নিরাপদ আশার আলো হয়ে জ্বলে উঠবে।

বিশ্বব্যাপী ১০ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। ২০২৫ সালের এ দিবসের প্রতিপাদ্য হলো, ‘আওয়ার এভরিডে অ্যাসেনশিয়ালস’; অর্থাৎ, ‘আমাদের প্রতিদিনের অত্যাবশ্যকীয়তা’ কথাটি শুনতে সহজ মনে হলেও এর গভীরে লুকিয়ে আছে মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারগুলোর কথা। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে আজ আমাদের দেশের অবহেলিত প্রবীণদের বঞ্চনা এবং তাঁদের অধিকার পাওয়া নিয়ে আলোচনা করব।
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় দুই কোটি প্রবীণ মানুষ বসবাস করছেন। এই সংখ্যা কেবল একটি পরিসংখ্যান
নয়, এটি দুই কোটি জীবনের গল্প, ত্যাগের ইতিহাস, সংগ্রামের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার বিশাল ভান্ডার। অথচ দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, এই দুই কোটি প্রবীণের একটি বড় অংশ আজও মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে অনেকে অনিশ্চয়তা, অবহেলা ও একাকিত্বের বোঝা তাঁরা বয়ে বেড়াচ্ছেন।
‘আমাদের প্রতিদিনের অত্যাবশ্যকীয়তা’ বলতে প্রথমে বুঝি, ভাত, কাপড়, বাসস্থান ও চিকিৎসা। কিন্তু বাস্তবে কতজন প্রবীণ নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার পান? কতজন প্রবীণ নিয়মিত চিকিৎসাসেবা পান? অনেক বৃদ্ধ বাবা-মা শেষ বয়সে হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকেন সন্তানের অবহেলায়, অর্থের অভাবে কিংবা ভুল সিদ্ধান্তের কারণে। চিকিৎসার অভাবে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকা—এ কি মানুষের মৌলিক অধিকার হতে পারে?
প্রবীণের অধিকার শুধু খাদ্য বা চিকিৎসায় সীমাবদ্ধ নয়, সম্মান পাওয়াও একটি মৌলিক মানবাধিকারের মধ্যে পড়ে। কিন্তু আজ অনেক ঘরে প্রবীণেরা হয়ে উঠছেন ‘বোঝা’। সংসারের যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় সন্তানেরা তাঁদের মতামতের মূল্য দেন না। ছোট ছোট বিষয়েও উপেক্ষা করা হয় তাঁদের মতামত। অথচ একসময় এই মানুষেরা হাজারো প্রতিকূলতার মধ্যেও সংসারের তাকত বোঝা বহন করেছেন।
‘আমাদের প্রতিদিনের অত্যাবশ্যকীয়তা’—বাক্যটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো নিরাপত্তা ও মানসিক শান্তি। কিন্তু কত প্রবীণ আজ ভয় নিয়ে দিন কাটান—এই বুঝি বাড়ি তাঁকে থেকে বের করে দেওয়া হলো, এই বুঝি জমিজমা হাতছাড়া হয়ে গেল, এই বুঝি সন্তান মুখ ফিরিয়ে নিল! এই ভয়, এই অনিশ্চয়তা কোনো মানুষের জীবনের শেষ অধ্যায়ের জন্য কখনোই কাম্য হতে পারে না।
গ্রাম হোক কিংবা শহর—চিত্র খুব একটা আলাদা নয়। কোথাও প্রবীণ মা-বাবা সারা দিন একাকিত্বে দিন কাটান, কোথাও বৃদ্ধ বাবার চিকিৎসার টাকা নিয়ে ভাই-বোনের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ, মামলা-মোকদ্দমা পর্যন্ত গড়ায়। অথচ এই মানুষগুলোর নিঃস্বার্থ শ্রম, ভালোবাসা ও ত্যাগের ওপরেই গড়ে উঠেছে আজকের পরিবার ও সমাজের ভিত্তি।
মানবাধিকার দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানবাধিকার মানে শুধু আন্তর্জাতিক চুক্তি নয়, এটি ঘরের ভেতরের আচরণও। প্রবীণকে সময় দেওয়া, তাঁর কথা মন দিয়ে শোনা, অসুস্থ হলে পাশে দাঁড়ানো, একাকিত্বে তাঁকে সঙ্গ দেওয়া—এসবই মানবাধিকারের জীবন্ত প্রকাশ।
রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের কথাও এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রবীণ ভাতা, বিনা মূল্যে কিংবা স্বল্প মূল্যে চিকিৎসাসেবা, নিরাপদ আশ্রয়, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা—এসব নিশ্চিত করাই রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অনেক প্রবীণ এসব সুযোগ সম্পর্কে জানেন না, আবার অনেকে পেতে গিয়ে হয়রানি ও দুর্ভোগের শিকার হন। শুধু আইন থাকলেই হবে না, তার সঠিক বাস্তবায়ন জরুরি।
যেভাবে আমরা নিজেদের দৈনন্দিন প্রয়োজন ছাড়া একমুহূর্তও চলতে পারি না, তেমনি প্রবীণদের দৈনন্দিন চাহিদাগুলো উপেক্ষা করে কোনো সভ্য সমাজ টিকে থাকতে পারে না। প্রবীণেরা শুধু আমাদের অতীতের মানুষ নন,
তাঁরা আমাদের বর্তমানের অভিভাবক এবং ভবিষ্যতের জন্য এক জীবন্ত শিক্ষালয়।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস তখনই পালন করা সার্থক হবে, যখন আমরা আমাদের বাবা-মাকে ‘বোঝা’ নয়, ‘বটবৃক্ষ’ হিসেবে দেখব। প্রবীণের খাদ্য, চিকিৎসা, নিরাপত্তা ও সম্মানকে দয়া নয়; অধিকার হিসেবে মান্য করব এবং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রবীণবান্ধব মনোভাব গড়ে তুলতে পারব। কারণ, যে সমাজ তার প্রবীণদের সম্মান করতে জানে না, সে সমাজ কখনোই প্রকৃত অর্থে মানবিক হতে পারে না। মানবাধিকারের আলো তখনই সম্পূর্ণ হয়, যখন সেই আলো দুই কোটি প্রবীণের চোখেও নিরাপদ আশার আলো হয়ে জ্বলে উঠবে।

সংবাদটি অনেকটা নীরবেই এসেছে সংবাদপত্রে—দৃষ্টিও কাড়েনি তা বড় একটা। হয়তো সেটি তেমন কোনো উত্তেজক বিষয় নয় বলে; কিংবা তা সরব কোনো সংকট না হওয়ার কারণে। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে, সংবাদটি একটি অশনিসংকেত বয়ে আনে। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সনদপ্রাপ্ত প্রায় ৯ লাখ তরুণ কর্মহীন...
০১ অক্টোবর ২০২৫
সম্প্রতি ঢাকার একটি বাংলা দৈনিক পত্রিকা আয়োজিত অর্থনৈতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বক্তা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের প্রত্যেকেই দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছেন, আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে তাঁরা সরকার গঠন করলে দেশের অর্থনীতিই হবে তাঁদের কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। এ দেশের নাগরিকদে
৮ ঘণ্টা আগে
শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে আলবদর ঘাতকেরা ঘর থেকে তুলে নিয়ে যায় ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর, মধ্যরাতে। ডিসেম্বরে পাকিস্তানি হানাদার ও আলবদররা যে বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ শুরু করেছিল, সিরাজুদ্দীন ছিলেন তার প্রথম শিকার। এরপর তিনি আর ফেরেননি, মরদেহও পাওয়া যায়নি। তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন কলমসৈনিককে
৮ ঘণ্টা আগে
মোহাম্মদপুরে ৮ ডিসেম্বর সোমবার সকালে খুন হলেন মা ও মেয়ে। দীর্ঘদিন শাহজাহান রোডের আমেনাস ড্রিম নামের যে বাড়িতে তাঁরা বসবাস করছিলেন, সেই বাড়িতেই গৃহকর্মীর উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে নিহত হলেন তাঁরা। ১৪ তলা ভবনের বিভিন্ন সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ধারণা করা হচ্ছে, বোরকা পরে এই গৃহকর্মী ঢুকেছিলেন ফ্ল্যাটে, মা
৮ ঘণ্টা আগেসম্পাদকীয়

মোহাম্মদপুরে ৮ ডিসেম্বর সোমবার সকালে খুন হলেন মা ও মেয়ে। দীর্ঘদিন শাহজাহান রোডের আমেনাস ড্রিম নামের যে বাড়িতে তাঁরা বসবাস করছিলেন, সেই বাড়িতেই গৃহকর্মীর উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে নিহত হলেন তাঁরা। ১৪ তলা ভবনের বিভিন্ন সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ধারণা করা হচ্ছে, বোরকা পরে এই গৃহকর্মী ঢুকেছিলেন ফ্ল্যাটে, মা ও মেয়েকে খুন করে স্কুলের পোশাক পরে তিনি বেরিয়ে গেছেন। এর পর থেকে তাঁর কোনো হদিস নেই। এ ছাড়া আর কেউ এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল কি না, পুলিশ তা নিয়ে তদন্ত করছে।
নিজ বাড়িতে মানুষ নিরাপদ নয়। বিভিন্ন এলাকায় অপরাধ বাড়ছে। প্রতিকারের জন্য কারও কাছে গেলে কতটা উপকার পাওয়া যাবে, তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে সংশয় আছে। মানুষ তার করের টাকা যেসব কারণে দিয়ে থাকে, তার একটি তো নিরাপত্তা। সরকার এমন কোনো বার্তা দিতে পারছে না, যার ওপর নির্ভর করে মানুষ নিশ্চিন্তে জীবন যাপন করতে পারে। নিজের বাড়িতেই মানুষ নিরাপদ নয়—আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা সরকারের এ এক বড় ব্যর্থতা।
মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডের এই জোড়া খুনের ঘটনা কয়েকটি বিষয়ে ভাবতে বাধ্য করে। এই ঘটনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে বাড়ির দারোয়ান এবং গৃহকর্মীরাও হয়ে উঠতে পারেন সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সদস্য। আমাদের দেশে যাচাই-বাছাই না করে কাজে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাই কোনো অপরাধী কৌশলে কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ পেয়ে গেলে তার পক্ষে সহজে অপরাধ ঘটানো সম্ভব হয়। লোক নিয়োগ করার সময় তাই খুবই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। সন্দেহ থেকে নয়, দায়িত্বের জায়গা থেকে এই যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা প্রয়োজন। কাউকে নিয়োগ করার সময় তার পরিচয়পত্র দেখা এবং তার কপি সংরক্ষণ করা অবশ্যকর্তব্য হিসেবে বিবেচনায় নিতে হবে। আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত না হলেও নিয়োগের আগে পরিচিত কারও কাছ থেকে রেফারেন্স নেওয়ার চল থাকা দরকার। কর্মীর বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানার পাশাপাশি এখন যেখানে তার বসবাস, সেই বাড়ির মালিক ও ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে তার ব্যাপারে তথ্য নেওয়া জরুরি। বাড়িতে যাঁরা দারোয়ানের কাজ করেন, তাঁদের অনেকের চোখের সামনে সিসিটিভি থাকলেও তাঁরা সব সময় সেদিকে দৃষ্টি রাখেন না। একটানা মোবাইলের দিকে চোখ রাখার প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। গৃহকর্মী কাজ শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর কাছে মূল্যবান কোনো সামগ্রী থাকলে গৃহকর্তা সেটা আগেই দারোয়ান বা নিরাপত্তাকর্মীকে জানিয়ে রাখবেন, এ রকম রীতি থাকা দরকার। গৃহকর্তার কাছ থেকে সে রকম তথ্য না পেয়ে থাকলে নিরাপত্তাকর্মীরা মূল্যবান দ্রব্য নিয়ে কাউকে বেরিয়ে যেতে দেবেন না।
বাড়িতে কে কখন ঢুকল, তা নিয়ে আগমন, প্রস্থান রেজিস্টার রাখা দরকার। প্রয়োজনে নিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থে প্রতিবেশী ও পুলিশের সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করা জরুরি। নিছক অল্পকিছু অর্থ বা অলংকারের লোভে খুন করার এই মানসিকতা যে বিকারের জন্ম দেয়, তার প্রতিকার সন্ধানে নিবিষ্ট হওয়া জরুরি।

মোহাম্মদপুরে ৮ ডিসেম্বর সোমবার সকালে খুন হলেন মা ও মেয়ে। দীর্ঘদিন শাহজাহান রোডের আমেনাস ড্রিম নামের যে বাড়িতে তাঁরা বসবাস করছিলেন, সেই বাড়িতেই গৃহকর্মীর উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে নিহত হলেন তাঁরা। ১৪ তলা ভবনের বিভিন্ন সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ধারণা করা হচ্ছে, বোরকা পরে এই গৃহকর্মী ঢুকেছিলেন ফ্ল্যাটে, মা ও মেয়েকে খুন করে স্কুলের পোশাক পরে তিনি বেরিয়ে গেছেন। এর পর থেকে তাঁর কোনো হদিস নেই। এ ছাড়া আর কেউ এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল কি না, পুলিশ তা নিয়ে তদন্ত করছে।
নিজ বাড়িতে মানুষ নিরাপদ নয়। বিভিন্ন এলাকায় অপরাধ বাড়ছে। প্রতিকারের জন্য কারও কাছে গেলে কতটা উপকার পাওয়া যাবে, তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে সংশয় আছে। মানুষ তার করের টাকা যেসব কারণে দিয়ে থাকে, তার একটি তো নিরাপত্তা। সরকার এমন কোনো বার্তা দিতে পারছে না, যার ওপর নির্ভর করে মানুষ নিশ্চিন্তে জীবন যাপন করতে পারে। নিজের বাড়িতেই মানুষ নিরাপদ নয়—আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা সরকারের এ এক বড় ব্যর্থতা।
মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডের এই জোড়া খুনের ঘটনা কয়েকটি বিষয়ে ভাবতে বাধ্য করে। এই ঘটনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে বাড়ির দারোয়ান এবং গৃহকর্মীরাও হয়ে উঠতে পারেন সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সদস্য। আমাদের দেশে যাচাই-বাছাই না করে কাজে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাই কোনো অপরাধী কৌশলে কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ পেয়ে গেলে তার পক্ষে সহজে অপরাধ ঘটানো সম্ভব হয়। লোক নিয়োগ করার সময় তাই খুবই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। সন্দেহ থেকে নয়, দায়িত্বের জায়গা থেকে এই যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা প্রয়োজন। কাউকে নিয়োগ করার সময় তার পরিচয়পত্র দেখা এবং তার কপি সংরক্ষণ করা অবশ্যকর্তব্য হিসেবে বিবেচনায় নিতে হবে। আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত না হলেও নিয়োগের আগে পরিচিত কারও কাছ থেকে রেফারেন্স নেওয়ার চল থাকা দরকার। কর্মীর বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানার পাশাপাশি এখন যেখানে তার বসবাস, সেই বাড়ির মালিক ও ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে তার ব্যাপারে তথ্য নেওয়া জরুরি। বাড়িতে যাঁরা দারোয়ানের কাজ করেন, তাঁদের অনেকের চোখের সামনে সিসিটিভি থাকলেও তাঁরা সব সময় সেদিকে দৃষ্টি রাখেন না। একটানা মোবাইলের দিকে চোখ রাখার প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। গৃহকর্মী কাজ শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর কাছে মূল্যবান কোনো সামগ্রী থাকলে গৃহকর্তা সেটা আগেই দারোয়ান বা নিরাপত্তাকর্মীকে জানিয়ে রাখবেন, এ রকম রীতি থাকা দরকার। গৃহকর্তার কাছ থেকে সে রকম তথ্য না পেয়ে থাকলে নিরাপত্তাকর্মীরা মূল্যবান দ্রব্য নিয়ে কাউকে বেরিয়ে যেতে দেবেন না।
বাড়িতে কে কখন ঢুকল, তা নিয়ে আগমন, প্রস্থান রেজিস্টার রাখা দরকার। প্রয়োজনে নিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থে প্রতিবেশী ও পুলিশের সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করা জরুরি। নিছক অল্পকিছু অর্থ বা অলংকারের লোভে খুন করার এই মানসিকতা যে বিকারের জন্ম দেয়, তার প্রতিকার সন্ধানে নিবিষ্ট হওয়া জরুরি।

সংবাদটি অনেকটা নীরবেই এসেছে সংবাদপত্রে—দৃষ্টিও কাড়েনি তা বড় একটা। হয়তো সেটি তেমন কোনো উত্তেজক বিষয় নয় বলে; কিংবা তা সরব কোনো সংকট না হওয়ার কারণে। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে, সংবাদটি একটি অশনিসংকেত বয়ে আনে। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সনদপ্রাপ্ত প্রায় ৯ লাখ তরুণ কর্মহীন...
০১ অক্টোবর ২০২৫
সম্প্রতি ঢাকার একটি বাংলা দৈনিক পত্রিকা আয়োজিত অর্থনৈতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বক্তা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের প্রত্যেকেই দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছেন, আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে তাঁরা সরকার গঠন করলে দেশের অর্থনীতিই হবে তাঁদের কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। এ দেশের নাগরিকদে
৮ ঘণ্টা আগে
শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে আলবদর ঘাতকেরা ঘর থেকে তুলে নিয়ে যায় ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর, মধ্যরাতে। ডিসেম্বরে পাকিস্তানি হানাদার ও আলবদররা যে বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ শুরু করেছিল, সিরাজুদ্দীন ছিলেন তার প্রথম শিকার। এরপর তিনি আর ফেরেননি, মরদেহও পাওয়া যায়নি। তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন কলমসৈনিককে
৮ ঘণ্টা আগে
বিশ্বব্যাপী ১০ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। ২০২৫ সালের এ দিবসের প্রতিপাদ্য হলো, ‘আওয়ার এভরিডে অ্যাসেনশিয়ালস’; অর্থাৎ, ‘আমাদের প্রতিদিনের অত্যাবশ্যকীয়তা’ কথাটি শুনতে সহজ মনে হলেও এর গভীরে লুকিয়ে আছে মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারগুলোর কথা। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে আজ
৮ ঘণ্টা আগে