বিভুরঞ্জন সরকার
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে, তা দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য স্বাস্থ্যকর না ক্ষতিকর, সে প্রশ্ন অনেকের মনেই উঠছে। প্রশ্ন উঠছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার আন্তরিকতা ও সততা নিয়েও। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠকে বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল ডিসেম্বরেই নির্বাচন চেয়েছে। তবে ডিসেম্বরের পরেও যে নির্বাচন কেউ চায়নি, তা নয়। সবাই যদি কোনো বিষয়ে একমত হতে না পারে, তবে সেই বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের মত মেনে নেওয়াই যুক্তিসংগত। সেই হিসেবে ঈদের আগের দিন সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এপ্রিলের প্রথম দিকে যেকোনো দিন নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে ড. ইউনূস রাজনৈতিক জটিলতা নতুন করে বাড়িয়ে দিয়েছেন। দেশে এখন নির্বাচন হলে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি বিএনপির। সেই বিএনপি ডিসেম্বরেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রশ্নে অনড়। কেন বড় দলটি ডিসেম্বরেই নির্বাচন চায়—এর কারণও দলটির পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
শুধু বিএনপি নয়, আরও অনেক দল ডিসেম্বরে নির্বাচন চায়। ১২-দলীয় জোটের মতে, এপ্রিলে নির্বাচনের প্রস্তাব যেন একধরনের ‘এপ্রিল ফুল’। বিষয়টি যে ফালতু রসিকতা নয়, গুরুতর রাজনৈতিক প্রশ্ন—সেটা কারও না বোঝার কথা নয়। জনগণ যখন বছরের পর বছর একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের আশায় বুক বেঁধেছে, তখন ডিসেম্বরের পরিবর্তে এপ্রিলে নির্বাচন ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা প্রকৃতপক্ষে গণ-ইচ্ছাকে উপেক্ষা করারই নামান্তর। এমন সিদ্ধান্ত জনগণকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত রাখার একটি কৌশল হিসেবে কেউ মনে করলে তাকে দোষ দেওয়া যাবে না ।
ডিসেম্বর শুধু একটি মাস নয়, এটি বাঙালির আত্মত্যাগ, বিজয় ও গণ-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। ১৯৭১ সালের রক্তাক্ত বিজয় ডিসেম্বরেই অর্জিত হয়েছিল। এই মাসে নির্বাচন হলে জনগণের মনন ও চেতনাকে ঐক্যবদ্ধ করা সহজ হয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির জন্য এটি সুবিধাজনক, আর যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতপন্থীদের জন্য এটি অস্বস্তিকর। তাই তারা ডিসেম্বর এড়িয়ে যেতে চায়। নির্বাচনকে যদি সত্যিকারের প্রতিফলন করতে হয় জাতীয় চেতনার, তবে ডিসেম্বরের প্রতীকী শক্তিকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায় না।
এই প্রেক্ষাপটে ডিসেম্বরে নির্বাচন অনেকটাই প্রতীকী ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। একে কেন্দ্র করে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। তা ছাড়া শীতকাল রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য সুবিধাজনক। ভোটার উপস্থিতি বাড়ে, প্রশাসনিক যন্ত্রও কম সমস্যায় পড়ে।
লেখক আহমেদ মোস্তফা কামাল তাঁর সামাজিক মাধ্যমে যেমনটা ইঙ্গিত দিয়েছেন, ডিসেম্বর মাসে জামায়াতে ইসলামীর মতো মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিগুলো কোণঠাসা থাকে। বিজয়ের আবহে তারা জনগণের কাছে সহজে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা দাঁড় করাতে পারে না। পক্ষান্তরে রমজানের সময়, বিশেষত এপ্রিল মাসে, ধর্মীয় আবেগ ও ইসলামি সংগঠনের চেতনা অধিক সক্রিয় থাকে—যা নির্বাচনী রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে।
এই বাস্তবতায় রাজনৈতিক প্রশ্নটি তাই দাঁড়ায়—নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশন কি জনগণের সুবিধা বিবেচনায় নেবে, নাকি কোনো দলের বা ব্যক্তির সুবিধা?
সরকার ও নির্বাচন কমিশনের উচিত যুক্তিসম্মত ও বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা। কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠীর সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা করে নির্বাচনের সময় ঠিক করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এপ্রিলে যখন সারা দেশে উচ্চমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পরীক্ষার সময়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেন্দ্র নির্ধারণ অসম্ভব, তখন নির্বাচন আয়োজন শুধু অবাস্তব নয়, রাজনৈতিক প্ররোচনামূলকও। এ ছাড়া রমজান-পরবর্তী ক্লান্তি, বৈশাখের খরা, কালবৈশাখীর ভয়াল আশঙ্কা—সব মিলিয়ে নির্বাচন-বিরুদ্ধ পরিবেশের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। তাহলে প্রশ্ন জাগে, এই সময় নির্বাচন দিতে চাওয়ার পেছনে আসল উদ্দেশ্য কী?
ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখন প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যবস্থাপনা বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার পক্ষে মত দেন এবং বিরোধিতাকারীদের প্রতিহত করার ঘোষণা দেন, তখন দেশের স্বার্থ নিয়ে স্পষ্ট উদ্বেগের কারণ সৃষ্টি হয়। এমন বক্তব্য একজন দলনিরপেক্ষ উপদেষ্টার বলে মনে না হয়ে অনেকের কাছে স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতাকেন্দ্রিক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ বলে মনে হয়েছে। এতে প্রশ্ন উঠেছে, ড. ইউনূস কি সত্যি দেশের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছেন, নাকি অন্য কারও স্বার্থরক্ষায় কাজ করছেন। তাঁর ভূমিকায় সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ববোধের অভাব কি ফুটে উঠছে না?
১২-দলীয় জোট নেতাদের মতে, ডিসেম্বরে নির্বাচন আয়োজনের জন্য সেনাবাহিনীসহ রাষ্ট্রীয় সব মহলে ইতিবাচক ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। সেনাবাহিনী বারবার দেশের সংকটকালে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে এবং জাতিকে স্থিতিশীলতা দিয়েছে। জনগণের মধ্যে সেনাবাহিনীর প্রতি আস্থার কারণেই তারা আশা করছে, নির্বাচন নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ হবে। তাই অযৌক্তিক তারিখ চাপিয়ে দিয়ে সামরিক ও অসামরিক কর্তৃপক্ষের সম্পর্কেও অনাস্থা তৈরি করা হবে, যা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী।
বাংলাদেশের জনগণ এখন ভোটাধিকার ফিরে পেতে প্রস্তুত। গত ১৫ বছরের অবরুদ্ধ গণতন্ত্র, একতরফা নির্বাচন ও প্রশাসনিক প্রহসনের বিরুদ্ধে তাঁরা ঐক্যবদ্ধ। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান মানে শুধুই একটি সরকারের বিদায় নয়, এটি গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের ঘোষণাও। যে নির্বাচন জনগণের ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করবে না, সেটি নির্বাচন নয়, আরেকটি প্রহসনমাত্র।
রমজানের সময় নির্বাচন প্রচারণার আয়োজন একদিকে যেমন ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি অশ্রদ্ধা, অন্যদিকে বাস্তবতাকে অস্বীকার করা। খরা, ঝড়-বৃষ্টি, অগ্নিকাণ্ড—এসব নিয়ে এপ্রিলে প্রশাসন ও জনগণ এমনিতেই পর্যুদস্ত থাকে। তখন ভোট গ্রহণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও হয় বিপজ্জনক। অতএব এই বাস্তবতা মেনে ডিসেম্বরেই নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নেওয়া সবার জন্যই মঙ্গলজনক।
এপ্রিল নির্বাচন মানেই পরিবেশ, সময়, জনমত, রাজনৈতিক বাস্তবতা—সবকিছুর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া। পক্ষান্তরে ডিসেম্বর নির্বাচন মানেই জাতিগতভাবে সম্মিলিত একটি সময়কে ব্যবহার করে সত্যিকার গণতান্ত্রিক অভিষেকের পথে হাঁটা।
এই মুহূর্তে দরকার একটি মৌলিক ঐকমত্য, যেখানে নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল, সেনাবাহিনী ও দেশের সচেতন জনগণ মিলে একটি নির্দিষ্ট সময় ও কাঠামোর ওপর একমত হবে। সেই সময় ডিসেম্বর ছাড়া অন্য কিছু হলে তা কেবল গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবেই চিহ্নিত হবে।
ডিসেম্বরের নির্বাচন কেবল রাজনৈতিক দলগুলোর অভিপ্রায় নয়, এটি দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর দাবি। প্রফেসর ইউনূস বা অন্য কারও ইচ্ছা অনুযায়ী নয়, নির্বাচন হওয়া উচিত জাতীয় স্বার্থের নিরিখে। সংবিধান, পরিবেশ, সময় ও চেতনার আলোকে দেশের মানুষ নিজেরাই নির্ধারণ করবে কবে হবে নির্বাচন। এপ্রিলের প্রস্তাবনা যদি জনগণকে বিভ্রান্ত করে, তবে সেটিও আরেক রাজনৈতিক প্রতারণা।
গণতন্ত্রের মৌল ভিত্তি হলো জনগণের ভোটাধিকার। সেই ভোটাধিকার ফিরে পেতে দীর্ঘদিন আন্দোলন হয়েছে। বিরোধী দলগুলোর দাবি ছিল অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। সেই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে একটি সরকার বিদায় নিয়েছে। জনগণ চেয়েছে এমন একটি সরকার, যারা সব পক্ষকে নির্বাচনে অংশগ্রহণে নিশ্চিত করবে।
কিন্তু এখন যদি নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে আবারও সন্দেহ তৈরি হয়, তাহলে পুরো প্রক্রিয়াই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। যারা নতুন সরকারে এসেছে, তারা যদি একইভাবে সময়সূচিকে সুবিধাজনক করে, তাহলে জন-আস্থা কোথায় থাকবে?বাংলাদেশ অনেক রাজনৈতিক ভুল ও বিশ্বাসভঙ্গ দেখেছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে নির্বাচনের নামে যা হয়েছে, তাতে জনগণ আস্থা হারিয়েছে। এখন আর ভুলের কোনো সুযোগ নেই। সঠিক সময়, সঠিক প্রক্রিয়া, সঠিক নেতৃত্ব ও সর্বোপরি জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেই একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এসেছে। আজ যখন আরেকটি নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে, তখন আবার যদি সেই পুরোনো কৌশল, ধোঁয়াশা, অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত ফিরে আসে, তাহলে পুরো ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা ভেঙে পড়বে।
ভোটাধিকার ফিরে পেতে যাঁরা লড়েছেন, যাঁরা শহীদ হয়েছেন, যাঁরা নিপীড়িত হয়েছেন, তাঁদের প্রতি সম্মান জানিয়ে ডিসেম্বরে নির্বাচন না হলে এই জাতি হয়তো আরেকবার বুঝে যাবে— কারা তাঁদের জন্য, আর কারা বিশ্বব্যবস্থার অন্য কোনো প্রভুর নির্দেশে চলছে। ভুল থেকে শিক্ষা না নিয়ে ভুলকে আঁকড়ে থাকার জেদ কখনো শুভবুদ্ধির পরিচয় বহন করে না।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে, তা দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য স্বাস্থ্যকর না ক্ষতিকর, সে প্রশ্ন অনেকের মনেই উঠছে। প্রশ্ন উঠছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার আন্তরিকতা ও সততা নিয়েও। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠকে বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল ডিসেম্বরেই নির্বাচন চেয়েছে। তবে ডিসেম্বরের পরেও যে নির্বাচন কেউ চায়নি, তা নয়। সবাই যদি কোনো বিষয়ে একমত হতে না পারে, তবে সেই বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের মত মেনে নেওয়াই যুক্তিসংগত। সেই হিসেবে ঈদের আগের দিন সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এপ্রিলের প্রথম দিকে যেকোনো দিন নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে ড. ইউনূস রাজনৈতিক জটিলতা নতুন করে বাড়িয়ে দিয়েছেন। দেশে এখন নির্বাচন হলে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি বিএনপির। সেই বিএনপি ডিসেম্বরেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রশ্নে অনড়। কেন বড় দলটি ডিসেম্বরেই নির্বাচন চায়—এর কারণও দলটির পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
শুধু বিএনপি নয়, আরও অনেক দল ডিসেম্বরে নির্বাচন চায়। ১২-দলীয় জোটের মতে, এপ্রিলে নির্বাচনের প্রস্তাব যেন একধরনের ‘এপ্রিল ফুল’। বিষয়টি যে ফালতু রসিকতা নয়, গুরুতর রাজনৈতিক প্রশ্ন—সেটা কারও না বোঝার কথা নয়। জনগণ যখন বছরের পর বছর একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের আশায় বুক বেঁধেছে, তখন ডিসেম্বরের পরিবর্তে এপ্রিলে নির্বাচন ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা প্রকৃতপক্ষে গণ-ইচ্ছাকে উপেক্ষা করারই নামান্তর। এমন সিদ্ধান্ত জনগণকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত রাখার একটি কৌশল হিসেবে কেউ মনে করলে তাকে দোষ দেওয়া যাবে না ।
ডিসেম্বর শুধু একটি মাস নয়, এটি বাঙালির আত্মত্যাগ, বিজয় ও গণ-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। ১৯৭১ সালের রক্তাক্ত বিজয় ডিসেম্বরেই অর্জিত হয়েছিল। এই মাসে নির্বাচন হলে জনগণের মনন ও চেতনাকে ঐক্যবদ্ধ করা সহজ হয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির জন্য এটি সুবিধাজনক, আর যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতপন্থীদের জন্য এটি অস্বস্তিকর। তাই তারা ডিসেম্বর এড়িয়ে যেতে চায়। নির্বাচনকে যদি সত্যিকারের প্রতিফলন করতে হয় জাতীয় চেতনার, তবে ডিসেম্বরের প্রতীকী শক্তিকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায় না।
এই প্রেক্ষাপটে ডিসেম্বরে নির্বাচন অনেকটাই প্রতীকী ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। একে কেন্দ্র করে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। তা ছাড়া শীতকাল রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য সুবিধাজনক। ভোটার উপস্থিতি বাড়ে, প্রশাসনিক যন্ত্রও কম সমস্যায় পড়ে।
লেখক আহমেদ মোস্তফা কামাল তাঁর সামাজিক মাধ্যমে যেমনটা ইঙ্গিত দিয়েছেন, ডিসেম্বর মাসে জামায়াতে ইসলামীর মতো মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিগুলো কোণঠাসা থাকে। বিজয়ের আবহে তারা জনগণের কাছে সহজে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা দাঁড় করাতে পারে না। পক্ষান্তরে রমজানের সময়, বিশেষত এপ্রিল মাসে, ধর্মীয় আবেগ ও ইসলামি সংগঠনের চেতনা অধিক সক্রিয় থাকে—যা নির্বাচনী রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে।
এই বাস্তবতায় রাজনৈতিক প্রশ্নটি তাই দাঁড়ায়—নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশন কি জনগণের সুবিধা বিবেচনায় নেবে, নাকি কোনো দলের বা ব্যক্তির সুবিধা?
সরকার ও নির্বাচন কমিশনের উচিত যুক্তিসম্মত ও বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা। কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠীর সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা করে নির্বাচনের সময় ঠিক করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এপ্রিলে যখন সারা দেশে উচ্চমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পরীক্ষার সময়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেন্দ্র নির্ধারণ অসম্ভব, তখন নির্বাচন আয়োজন শুধু অবাস্তব নয়, রাজনৈতিক প্ররোচনামূলকও। এ ছাড়া রমজান-পরবর্তী ক্লান্তি, বৈশাখের খরা, কালবৈশাখীর ভয়াল আশঙ্কা—সব মিলিয়ে নির্বাচন-বিরুদ্ধ পরিবেশের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। তাহলে প্রশ্ন জাগে, এই সময় নির্বাচন দিতে চাওয়ার পেছনে আসল উদ্দেশ্য কী?
ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখন প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যবস্থাপনা বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার পক্ষে মত দেন এবং বিরোধিতাকারীদের প্রতিহত করার ঘোষণা দেন, তখন দেশের স্বার্থ নিয়ে স্পষ্ট উদ্বেগের কারণ সৃষ্টি হয়। এমন বক্তব্য একজন দলনিরপেক্ষ উপদেষ্টার বলে মনে না হয়ে অনেকের কাছে স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতাকেন্দ্রিক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ বলে মনে হয়েছে। এতে প্রশ্ন উঠেছে, ড. ইউনূস কি সত্যি দেশের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছেন, নাকি অন্য কারও স্বার্থরক্ষায় কাজ করছেন। তাঁর ভূমিকায় সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ববোধের অভাব কি ফুটে উঠছে না?
১২-দলীয় জোট নেতাদের মতে, ডিসেম্বরে নির্বাচন আয়োজনের জন্য সেনাবাহিনীসহ রাষ্ট্রীয় সব মহলে ইতিবাচক ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। সেনাবাহিনী বারবার দেশের সংকটকালে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে এবং জাতিকে স্থিতিশীলতা দিয়েছে। জনগণের মধ্যে সেনাবাহিনীর প্রতি আস্থার কারণেই তারা আশা করছে, নির্বাচন নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ হবে। তাই অযৌক্তিক তারিখ চাপিয়ে দিয়ে সামরিক ও অসামরিক কর্তৃপক্ষের সম্পর্কেও অনাস্থা তৈরি করা হবে, যা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী।
বাংলাদেশের জনগণ এখন ভোটাধিকার ফিরে পেতে প্রস্তুত। গত ১৫ বছরের অবরুদ্ধ গণতন্ত্র, একতরফা নির্বাচন ও প্রশাসনিক প্রহসনের বিরুদ্ধে তাঁরা ঐক্যবদ্ধ। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান মানে শুধুই একটি সরকারের বিদায় নয়, এটি গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের ঘোষণাও। যে নির্বাচন জনগণের ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করবে না, সেটি নির্বাচন নয়, আরেকটি প্রহসনমাত্র।
রমজানের সময় নির্বাচন প্রচারণার আয়োজন একদিকে যেমন ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি অশ্রদ্ধা, অন্যদিকে বাস্তবতাকে অস্বীকার করা। খরা, ঝড়-বৃষ্টি, অগ্নিকাণ্ড—এসব নিয়ে এপ্রিলে প্রশাসন ও জনগণ এমনিতেই পর্যুদস্ত থাকে। তখন ভোট গ্রহণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও হয় বিপজ্জনক। অতএব এই বাস্তবতা মেনে ডিসেম্বরেই নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নেওয়া সবার জন্যই মঙ্গলজনক।
এপ্রিল নির্বাচন মানেই পরিবেশ, সময়, জনমত, রাজনৈতিক বাস্তবতা—সবকিছুর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া। পক্ষান্তরে ডিসেম্বর নির্বাচন মানেই জাতিগতভাবে সম্মিলিত একটি সময়কে ব্যবহার করে সত্যিকার গণতান্ত্রিক অভিষেকের পথে হাঁটা।
এই মুহূর্তে দরকার একটি মৌলিক ঐকমত্য, যেখানে নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল, সেনাবাহিনী ও দেশের সচেতন জনগণ মিলে একটি নির্দিষ্ট সময় ও কাঠামোর ওপর একমত হবে। সেই সময় ডিসেম্বর ছাড়া অন্য কিছু হলে তা কেবল গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবেই চিহ্নিত হবে।
ডিসেম্বরের নির্বাচন কেবল রাজনৈতিক দলগুলোর অভিপ্রায় নয়, এটি দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর দাবি। প্রফেসর ইউনূস বা অন্য কারও ইচ্ছা অনুযায়ী নয়, নির্বাচন হওয়া উচিত জাতীয় স্বার্থের নিরিখে। সংবিধান, পরিবেশ, সময় ও চেতনার আলোকে দেশের মানুষ নিজেরাই নির্ধারণ করবে কবে হবে নির্বাচন। এপ্রিলের প্রস্তাবনা যদি জনগণকে বিভ্রান্ত করে, তবে সেটিও আরেক রাজনৈতিক প্রতারণা।
গণতন্ত্রের মৌল ভিত্তি হলো জনগণের ভোটাধিকার। সেই ভোটাধিকার ফিরে পেতে দীর্ঘদিন আন্দোলন হয়েছে। বিরোধী দলগুলোর দাবি ছিল অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। সেই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে একটি সরকার বিদায় নিয়েছে। জনগণ চেয়েছে এমন একটি সরকার, যারা সব পক্ষকে নির্বাচনে অংশগ্রহণে নিশ্চিত করবে।
কিন্তু এখন যদি নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে আবারও সন্দেহ তৈরি হয়, তাহলে পুরো প্রক্রিয়াই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। যারা নতুন সরকারে এসেছে, তারা যদি একইভাবে সময়সূচিকে সুবিধাজনক করে, তাহলে জন-আস্থা কোথায় থাকবে?বাংলাদেশ অনেক রাজনৈতিক ভুল ও বিশ্বাসভঙ্গ দেখেছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে নির্বাচনের নামে যা হয়েছে, তাতে জনগণ আস্থা হারিয়েছে। এখন আর ভুলের কোনো সুযোগ নেই। সঠিক সময়, সঠিক প্রক্রিয়া, সঠিক নেতৃত্ব ও সর্বোপরি জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেই একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এসেছে। আজ যখন আরেকটি নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে, তখন আবার যদি সেই পুরোনো কৌশল, ধোঁয়াশা, অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত ফিরে আসে, তাহলে পুরো ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা ভেঙে পড়বে।
ভোটাধিকার ফিরে পেতে যাঁরা লড়েছেন, যাঁরা শহীদ হয়েছেন, যাঁরা নিপীড়িত হয়েছেন, তাঁদের প্রতি সম্মান জানিয়ে ডিসেম্বরে নির্বাচন না হলে এই জাতি হয়তো আরেকবার বুঝে যাবে— কারা তাঁদের জন্য, আর কারা বিশ্বব্যবস্থার অন্য কোনো প্রভুর নির্দেশে চলছে। ভুল থেকে শিক্ষা না নিয়ে ভুলকে আঁকড়ে থাকার জেদ কখনো শুভবুদ্ধির পরিচয় বহন করে না।
৬ জুন সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আগামী জুলাই মাসেই সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি ‘জুলাই সনদ’ প্রস্তুত করে আমরা জাতির সামনে উপস্থাপন করতে পারব বলে আশা করছি।’
১ ঘণ্টা আগেদীর্ঘ ছুটির অবসান হতে চলেছে। দেশে বেশির ভাগ অফিস-আদালত (সরকারি বা বেসরকারি) এখনো খোলেনি, কিন্তু জীবনের প্রবাহ কোথাও বন্ধ হয়নি। বাইরে থেকে তালাবদ্ধ রাখা হলেও ভেতরে সবই চলছে। সরকারের প্রধান ব্যক্তির বিদেশ সফর বন্ধ হয়নি। রাজনৈতিক নেতাদের কর্মকাণ্ড এত দিনে নতুন নতুন দিকে মোড় নিচ্ছে।
৭ ঘণ্টা আগেএকজন শিক্ষকের জন্ম হয় কীভাবে? শুধু একটি নিয়োগপত্র কিংবা একটি প্রশিক্ষণ সনদ পেলেই কি তিনি শিক্ষক হয়ে ওঠেন? নাকি তার আগে-পরে থাকে একটি দীর্ঘ পথচলা, আত্মমর্যাদাবোধ ও দায়বদ্ধতার ধ্যান?
৮ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় একটি অতিপরিচিত শব্দ হলো ষড়যন্ত্র। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই এর শিকার হয়েছি। কখনো কখনো ষড়যন্ত্রে লিপ্তও হয়েছি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ষড়যন্ত্র কি আদৌ কোনো যন্ত্র? এ যন্ত্র কীভাবে কাজ করে? আমরা প্রায় সবাই জানি ষড়্ঋতু মানে ছয় ঋতু। কেননা, বলা হয়ে থাকে, ছয় ঋতুর দেশ বাংলাদেশ।
৮ ঘণ্টা আগে