Ajker Patrika

সংস্কৃতির আচার, অনাচার

মযহারুল ইসলাম বাবলা 
Thumbnail image
কোনো মানুষই সংস্কৃতিবিহীন নয়। জাতীয়তা এবং শ্রেণির ভিন্নতায় সংস্কৃতির রকমফের নিশ্চয় রয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

১৯৮৮ সালে কলকাতার নাট্যদল নান্দীকারের নাট্য-উৎসবের আমন্ত্রণে ঢাকা থিয়েটারের প্রতিনিধিরূপে কলকাতায় গিয়েছিলাম। ‘কেরামত মঙ্গল’ নাটকটি উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছিল রবীন্দ্রসদনে। রবীন্দ্রসদনে উপচে পড়া দর্শকের উপস্থিতিতে নাটকের প্রদর্শনীর শেষে দর্শক প্রতিক্রিয়ায় হতাশ হয়েছিলাম। দর্শকদের অভিযোগ ছিল নাটকের সংলাপ তাঁদের বিন্দুমাত্র বোধগম্য হয়নি। এ নিয়ে নান্দীকার প্রধান রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত শ্লেষে বলেছিলেন, ‘হিন্দি শুনতে শুনতে কলকাতার বাঙালিদের কান নষ্ট হয়ে গেছে। আর হিন্দি বলতে বলতে বাংলা ভাষাও ভুলতে বসেছে। সেখানে পূর্ব বাংলার গ্রামীণ বাংলা ভাষার “কেরামত মঙ্গল” নাটকের সংলাপ তাঁদের বোঝার উপায় কোথায়?’ বাংলা শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির পীঠস্থান কলকাতার বাঙালিদের বাস্তব অবস্থা দেখে সেদিন আমরাও কম হতাশ-বিস্মিত হইনি। এখন তো বিষয়টি আরও চরম আকার ধারণ করেছে। কলকাতার উচ্চবিত্তদের পাশাপাশি মধ্যবিত্তরা পর্যন্ত বাংলা ভাষা ত্যাগ করে হিন্দি-ইংরেজি ভাষার শিক্ষাক্রমে সন্তানদের ঢালাওভাবে ঠেলে দিয়েছে। সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠার মোহে তারা মাতৃভাষা বাংলা ছেড়ে হিন্দি-ইংরেজির পিছু নিয়েছে।

প্রায় ৩০ বছর আগে শারদীয় দুর্গা পূজায় কলকাতায় গিয়েছিলাম। কলকাতার বাইরে মফস্বল ও জেলাগুলোর পূজা দেখতে চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, বর্ধমান, চুঁচুড়াসহ অনেক স্থানে গিয়েছিলাম। দেখেছি বারোয়ারি পূজামণ্ডপের মাইকগুলোতে হেমন্ত, সতীনাথ, মান্না দে, কিশোর কুমার, জগন্ময় মিত্র, তালাত মাহমুদ, সলিল চৌধুরী, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র, দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র, সাগর সেন, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, ভূপেন হাজারিকাসহ বাংলা গানের বরেণ্য শিল্পীদের গান দিন-রাত বেজে চলেছে। অথচ মাত্র কবছর আগে ওই স্থানগুলোতে দুর্গা পূজায় গিয়ে দেখেছি সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। বারোয়ারি পূজামণ্ডপে গান বাজছে সত্য, তবে একটিও বাংলা গান নয়। সমস্তই হিন্দি ছায়াছবির ধুমধাড়াক্কা হিন্দি গান। গানের কথার চেয়ে বাদ্য-বাজনার আধিক্যে গানের কথা বোঝার উপায় নেই। যুগের ব্যবধানে পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের পাল্টে গেছে সাংস্কৃতিক মান ও রুচি। ক্রমেই এখন সেটা ভয়ানক পর্যায়ে।

বরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় জীবদ্দশায় বলেছিলেন, ‘বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির লালন-পালন পশ্চিম বাংলাকেন্দ্রিক থাকবে না। সেটা বাংলাদেশকেন্দ্রিক হয়ে যাবে।’ তাঁর বলা কথা এখন বাস্তবে পরিণত। হিন্দির বহুমাত্রিক আগ্রাসনে কেবল পশ্চিম বাংলা আক্রান্ত নয়, আক্রান্ত ভারতের অপরাপর প্রদেশগুলোও। দক্ষিণ ভারত ব্যতীত সারা ভারতে হিন্দির আগ্রাসনে প্রদেশসমূহের ভাষা-সংস্কৃতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। দুঃখজনক হচ্ছে, বাংলাদেশেও হিন্দি সংস্কৃতির প্রভাব ক্রমেই বিস্তার লাভ করেছে। স্যাটেলাইট টেলিভিশনের কল্যাণে হিন্দি ছবি-সিরিয়ালে আক্রান্ত বাংলাদেশের দর্শক। আমাদের কিশোর বয়সীরা পর্যন্ত ইতিমধ্যে হিন্দি ভাষা রপ্ত করে ফেলেছে। হিন্দি ভারতের সরকারি ভাষা। সে বিবেচনায় পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের ওপর হিন্দির প্রভাব থাকাটা অসংগত নয়। তারা ইচ্ছা করলেই দক্ষিণের মতো হিন্দিকে এখন আর পরিত্যাগ করতে পারবে না। তারা বাঙালি জাতীয়তা পরিত্যাগ করে বহুপূর্বে ভারতীয় জাতীয়তায় নিজেদের সঁপে দিয়েছে। কিন্তু হিন্দি ভাষা তো আমাদের সুযোগ-প্রতিষ্ঠা কোনোটি দিতে পারবে না। তাহলে আমরা কেন হিন্দির আগ্রাসনের কাছে আত্মসমর্পণ করে চলেছি? হিন্দি সিরিয়ালে আকৃষ্ট দর্শকেরা পরনিন্দা, পরচর্চা, হিংসা-বিদ্বেষ, কুটিলতা, শঠতার কুশিক্ষায় পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনকে কলুষিত করার দীক্ষা নিচ্ছে। আমরাও ব্যাধিমুক্ত কোথায়? একদিকে হিন্দি ভাষা-সংস্কৃতির আগ্রাসন, অপর দিকে উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তা ও সংস্কৃতির প্রভাব আমাদের জাতীয় জীবনকে শঙ্কার মুখে ফেলেছে। এর থেকে মুক্ত হতে না পারলে আমাদেরও কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হবে।

কোনো মানুষই সংস্কৃতিবিহীন নয়। জাতীয়তা এবং শ্রেণির ভিন্নতায় সংস্কৃতির রকমফের নিশ্চয় রয়েছে। তারপরও স্ব স্ব শ্রেণিগত অবস্থানের ভিত্তিতে সংস্কৃতির বলয়ের মধ্যেই প্রতিটি মানুষের অবস্থান বিরাজ করে। সংস্কৃতি স্থির অনড় নয়। সংস্কৃতির যুগ, কাল এবং অর্থনৈতিক কারণে বিবর্তিত হয়। তাই মানুষের আদিম সংস্কৃতি সভ্যতার রূপান্তরের মধ্য দিয়ে পরিবর্তিত হয়ে এসেছে, ভৌগোলিকভাবে সব দেশে ও সমাজে। প্রতিটি জাতি নিজ নিজ ভূখণ্ডের সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করেই গঠিত হয়েছে। ভাষাও যেমন বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়, তেমনি সংস্কৃতিও। তাই সংস্কৃতি নির্দিষ্ট গণ্ডিতে কখনো সীমাবদ্ধ নয়। সংস্কৃতি বিকাশমান। প্রতিনিয়তই সংস্কৃতির রূপ-পরিবর্তন হয়ে থাকে। তাই সংস্কৃতির আদি বা অন্ত বলে বাস্তবে কিছু নেই। এমনকি সংস্কৃতি শ্রেণি-নিরপেক্ষও নয়।

আমাদের ভূখণ্ডে অতীতে সেলাই করা জামার প্রচলন ছিল না। নারীরা শাড়ির মতো লম্বা কাপড় জড়িয়ে পরত। পুরুষেরা ধুতি এবং গায়ে চাদর। সেলাই বস্ত্রের সূত্রপাত হয়েছে বহু পরে এবং ভিন্ন দেশের বস্ত্র সেলাইয়ের অনুকরণে। সভ্যতা নিজ ভূখণ্ড থেকে গজিয়ে ওঠে না। সভ্যতার বাহন মানুষ এবং অভিবাসী প্রক্রিয়ায় সভ্যতা ছড়িয়ে পড়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশ, মহাদেশে। আমাদের খাদ্য-সংস্কৃতিও একই প্রক্রিয়ায় পরিবর্তিত হয়ে আজকের অবস্থানে পৌঁছেছে বটে, তবে নিত্যই পরিবর্তিত হচ্ছে। খাদ্য, পোশাক, রুচির এই ক্রম-পরিবর্তন ধারা সব জাতির ক্ষেত্রেই ঘটে।

আমার শৈশব-কৈশোরে চট্টগ্রামে দেখেছি আবাল, বৃদ্ধবনিতাদের পোশাক বার্মিজদের আদলে। কোমর থেকে কয়েক ভাঁজ দিয়ে রং-বেরঙের কাপড় পেঁচিয়ে পরত। ওটাকে বলত থামি। ব্লাউজ পরত। ব্লাউজকে বলত কুর্তা এবং ওড়না গায়ে জড়িয়ে রাখত, সেটাকে বলত বড়কয়ড় [বড় কাপড়]। তিন ভাগে বিভক্ত পোশাক পরত প্রায় সব নারীই। তবে অগ্রসর শ্রেণি অর্থাৎ শিক্ষা ও অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল শ্রেণির মুষ্টিমেয় নারীদের কেবল শাড়ি পরতে দেখেছি। চট্টগ্রামের স্থানীয় নারীদের পোশাক ব্যবহারে শ্রেণি বিভাজন ওই পোশাকের ভিন্নতার মধ্যে প্রকাশ পেত।

পরিবর্তনের ধারা কিন্তু সর্বস্তরে তাৎক্ষণিক ঘটে না। সমাজের সুবিধাভোগীদের বেলায় দ্রুত ঘটলেও, প্রান্তিকে ঘটে না। এর প্রধানত কারণ অর্থনৈতিক। শহরে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত মানুষের সাধ্য আর সামষ্টিক সাধারণের সাধ্য এক নয়। তাই আমরা শহুরে জীবনে সংস্কৃতির পরিবর্তন যেমন দ্রুত দেখে থাকি, প্রান্তিকে সেটা দেখা যায় না। যোগাযোগব্যবস্থার অভূতপূর্ব পরিবর্তনে এখন এক দেশের সংস্কৃতি অপর দেশে সহজে পৌঁছে যায়। অভিবাসীদের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। এবং সেটা তাৎক্ষণিকভাবেই। সমাজ, সভ্যতার রূপান্তর অনিবার্যরূপে সংস্কৃতিরও রূপান্তর। প্রান্তিকজনেরা তাদের অর্থনৈতিক কারণে সংস্কৃতির রূপান্তরিত ধারার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে না বা সেটা গ্রহণ করতে পারে না। তাই সমাজের সুবিধভোগী এবং বঞ্চিত মানুষের সংস্কৃতির ভিন্নতা মোটা দাগে দৃশ্যমান। সেটা সমাজের দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে যায়।

সমাজের অগ্র-পশ্চাৎ যে দুটি ধারা বিদ্যমান সেটা শ্রেণিগত কারণেই। একই দেশ ও সমাজে সংস্কৃতির ভিন্নতার পেছনে শ্রেণির ভূমিকা অনিস্বীকার্য। শ্রেণিগত কারণে এখনো প্রান্তিকে সকালে পান্তাভাত খাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। সেটা আদি সংস্কৃতিকে ভালোবেসে নয়, অর্থনৈতিক কারণে। আমাদের দেশে শহর এবং গ্রামের সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে চরম বৈষম্যপূর্ণ অসংগতি রয়েছে। নাগরিক জীবনের সুযোগ আর প্রান্তিকের সুবিধাবঞ্চিত সামষ্টিক জীবনের বৈপরীত্য স্থূলভাবে ধরা পড়ে। এ যেন ভিন্ন ভিন্ন ভূখণ্ডের আদল। তাই গ্রাম ও শহরের বৈষম্য, সুযোগ-সুবিধার বৈপরীত্যের অবসান জরুরি। তেমনি জরুরি শ্রেণিবৈষম্যের অবসানে অভিন্ন সংস্কৃতির বলয় গড়ে তোলা। স্বীকার করতে হবে, বিদ্যমান ব্যবস্থাধীনে সেটা সম্ভব নয়। তাই ব্যবস্থার পরিবর্তন অপরিহার্য। ব্যবস্থার পরিবর্তন আলাদিনের বাতির স্পর্শে ঘটবে না। সে জন্য সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে। কাজটি নিশ্চয় রাজনৈতিক। পাশাপাশি সাংস্কৃতিকও বটে। সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি বিদ্যমান ব্যবস্থার পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলেই মান্য করি।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত