ড. মইনুল ইসলাম
মনে পড়ছে ১৯৭১ সালের কথা। মহান মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ডিসেম্বরের যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরাজয় অবশ্যম্ভাবী বুঝতে পেরে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিকল্পিতভাবে বাসা কিংবা কর্মস্থল থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। এই কাজটি করেছিল জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের নিয়ে গঠিত ‘আলবদর বাহিনী’। চরম এই নৃশংসভাবে হত্যার বিষয়ে গত ৫৩ বছরেও জামায়াতে ইসলামী কিংবা ইসলামী ছাত্র সংঘের নব্য সংস্করণ ইসলামী ছাত্রশিবিরের জাতির কাছে ক্ষমা না চাওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। বর্তমানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লেবাস ধারণ করে যে ১৫২ জন সমন্বয়ক অন্তর্বর্তী সরকারের দণ্ডমুণ্ডের কর্তার ভূমিকা পালন করে চলেছে, তাদের মধ্যে নাকি ১০৮ জন ইসলামী ছাত্রশিবিরের ক্যাডার। তারা বাংলাদেশের ইতিহাসকে তাদের পছন্দমতো সাজাবার উদ্দেশ্যে নাকি ‘রিসেট বাটন’ টিপে দিয়েছে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের দিনগুলোর পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী হত্যার ব্যাপারে তাদের অবস্থান কী, সেটা জানার জন্যই কলামটি লিখছি।
১৯৭৬ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দলবিধি আদেশের ফায়দাভোগী হয়ে ‘পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী’ ‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ’ নাম ধারণ করে বাংলাদেশে রাজনীতি করার বৈধ অধিকার অর্জন করেছিল, কিন্তু তাদের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘকে তারা পুরোনো নামে পুনরুজ্জীবিত করেনি সম্ভবত এই বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ভার এড়িয়ে যাওয়ার চাণক্য-কৌশল অবলম্বনে। তাই জাতির কাছে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ভার স্বীকার করে জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবির ক্ষমা প্রার্থনা করার নৈতিক সাহস প্রদর্শন করবে কি না, সেটা আবারও জিজ্ঞাসা করতে চাই। জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান আমির ডা. শফিকুর রহমান কয়েকবারই বলেছেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামী কোনো ভুল করে থাকলে তার জন্য অবশ্যই ক্ষমা প্রার্থনা করবে। (তিনি অবশ্য ১৯৭১ সালে ছাত্রলীগ করতেন এবং ১৯৭২ সাল থেকে নাকি ছাত্রলীগের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র গ্রুপের সদস্য ছিলেন!) তাঁর কাছে সে জন্যই সরাসরি প্রশ্ন করছি, মুক্তিযুদ্ধের শেষ সপ্তাহে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের এই নৃশংস বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞকে তিনি কি মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে স্বীকার করেন না? যদি অপরাধ হিসেবে স্বীকার করেন তাহলে ক্ষমা চাননি কেন বা এখনো চাইছেন না কেন? এটা যদি ভুল অথবা অপরাধ না হয় তাহলে কোন কাজটা এর চেয়ে নৃশংসতর অপরাধ?
পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ডিসেম্বর মাসে যখন বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের অধীন সশস্ত্র বাহিনীর কাছে পাকিস্তানি ঘাতক হানাদার বাহিনীর পরাজয় অবধারিত হয়ে উঠেছিল, তখন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর পরিকল্পনা মোতাবেক স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার উদ্দেশ্যে তালিকা করে ঢাকাসহ সারা দেশে ২০০-এর বেশি বুদ্ধিজীবীকে পাকড়াও করে হত্যা করার নীলনকশা প্রণয়ন করে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘ। পরবর্তীকালে রাও ফরমান আলীর অফিস থেকে এই তালিকাটি উদ্ধার করা হয়েছিল। তালিকা ধরে ধরে বুদ্ধিজীবীদের তাঁদের বাসা কিংবা কর্মস্থল থেকে অস্ত্রের মুখে পাকড়াও করে মিরপুরের বাঙলা কলেজে, ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে বা রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে গুলি করে কিংবা বেয়নেট চালিয়ে হত্যা করার দায়িত্বটি অর্পিত হয়েছিল ইসলামী ছাত্র সংঘের ঘাতক ‘আলবদর’ বাহিনীর ওপর। এই আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠিত হয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ‘অক্সিলিয়ারি ফোর্স’ হিসেবে, জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ১৯৭১ সালের মে-জুন মাসে। অতএব শুধু বুদ্ধিজীবী হত্যা নয়, মুক্তিযুদ্ধের শেষ ছয় মাসে সারা দেশে আলবদর ও আলশামস বাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পথপ্রদর্শক, গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহকারী ও সহায়ক ঘাতক বাহিনীর ভূমিকা পালন করেছিল রাজাকার বাহিনীর মতো। বরং রাজাকারদের চেয়ে অনেক বেশি প্রশিক্ষিত, কার্যকর ও নিষ্ঠুর ঘাতক বাহিনী হিসেবে জনগণের কাছে বিভীষিকার প্রতীক হয়ে উঠেছিল আলবদর ও আলশামস। অতএব এটা মোটেও অস্বাভাবিক ছিল না যে জেনারেল রাও ফরমান আলী চতুরতার সঙ্গে বাছাই করে নিয়েছিল আলবদর বাহিনীর ঢাকা নগরীর দুর্ধর্ষ ক্যাডারদের বুদ্ধিজীবী নিধনের প্রধান ঘাতক বাহিনী হিসেবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার হলের (বর্তমান মাস্টারদা সূর্য সেন হল) বেশ কয়েকজন ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা-কর্মী পরবর্তী সময়ে এই ঘাতক বাহিনীর মূল কুশীলব হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে এবং এখনো বিদেশে পালিয়ে রয়েছে। আলবদর বাহিনী গঠিত হয়েছিল জামায়াতে ইসলামীর সরাসরি সিদ্ধান্তের মাধ্যমে। (অবাঙালি জনগোষ্ঠীর একটি অংশের আলবদরের ঘাতকদের সক্রিয় দোসরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।) এত দিনে প্রমাণিত হয়ে গেছে যে ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে অংশগ্রহণ করতেই হয়নি, এককভাবে আলবদর বাহিনীই ওই হত্যাযজ্ঞের নায়ক ছিল। তাই জামায়াতে ইসলামীকে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ভার স্বীকার করতেই হবে। তাদের অঙ্গসংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের নাম বদলে ১৯৭৬ সালে ইসলামী ছাত্রশিবির করে ফেলার মাধ্যমে জামায়াত যদি ভেবে থাকে তারা এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের রক্তের দাগ’ মুছে ফেলতে পারবে, তাহলে তারা চরম ভুল করবে।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বুদ্ধিজীবী হত্যা শুরু হলেও প্রধানত ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে রাও ফরমান আলীর তালিকা ধরে আলবদর বাহিনী কর্তৃক বুদ্ধিজীবী হত্যায় গতি সঞ্চারিত হয়েছিল। বাংলাদেশ সরকারের গেজেট অনুযায়ী ৫৬০ জন বুদ্ধিজীবী মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে শাহাদাত বরণ করেছেন। ডিসেম্বরে আলবদরের হাতে শহীদ অধ্যাপকদের মধ্যে মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, রাশিদুল হাসান, ফাইজুল মাহী, সিরাজুল হক খান, সন্তোষ ভট্টাচার্য এবং গিয়াসউদ্দিন আহমদ ছিলেন স্বনামধন্য। অন্যদের মধ্যে সাহিত্যিক ও সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সার, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, সাংবাদিক নিজামউদ্দিন, সাংবাদিক সেলিনা পারভীন, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলিম চৌধুরী এবং ডা. গোলাম মরতুজা আলবদরের হাতে নৃশংস হত্যার শিকার বুদ্ধিজীবীদের প্রথম সারির কয়েকজন। তাঁদের অনেকের অর্ধগলিত মৃতদেহ ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে ঢাকার বিভিন্ন বধ্যভূমিতে পাওয়া গিয়েছিল, আবার বেশ কয়েকজনের মৃতদেহ পাওয়াই যায়নি। (মিরপুরে বড় ভাই শহীদুল্লা কায়সারের সন্ধান করতে গিয়ে দেশের কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হানও চিরতরে হারিয়ে গিয়েছিলেন।) ওপরের তালিকা থেকে কি প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না যে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘ অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়ন করেছে স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশ যাতে এসব মেধাবী ও সমাজের নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের সমাজ গঠনে নিয়োজিত করতে না পারে সে জন্য? এটা কি ‘চরম জাতিদ্রোহী কর্মকাণ্ড’ নয়? জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘ কি ভেবেছিল বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করলে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়কে নস্যাৎ করা যাবে? ডিসেম্বর মাসে তারা পাকিস্তানের পরাজয় অবধারিত বুঝতে পেরেও এহেন জাতিদ্রোহিতায় কেন মগ্ন ছিল?
স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সংঘটিত ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে জামায়াত-শিবির সুচতুরভাবে নেতৃত্বের ভূমিকা হাইজ্যাক করতে পেরেছিল প্রধানত তাদের ‘সিভিল আর্মির’ সাংগঠনিক অবয়বের কারণে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের অধিকাংশই ছিল ছদ্মবেশে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ক্যাডার। তাদের বেশ কয়েকজন ছদ্মবেশে ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে অবস্থান গ্রহণ করতেও সমর্থ হয়েছিল। সারা দেশ থেকে জামায়াত-শিবির টেলিফোন করে নেতা-কর্মীদের ঢাকায় জড়ো করতে পেরেছিল ৫ আগস্ট। ৩ আগস্ট বাংলাদেশের সেনাপ্রধান ঘোষণা করেছিলেন যে সেনাসদস্যরা আন্দোলনকারী জনগণের ওপর গুলি চালাবে না। অতএব যৌক্তিকভাবেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা ‘চলো চলো ঢাকা চলো’ লংমার্চকে ৬ আগস্টের পরিবর্তে এক দিন এগিয়ে দিয়ে ৫ আগস্ট নির্ধারণ করে দিয়েছিল। সাধারণ জনগণের সিংহভাগ এবং হাসিনাবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীরা ২০১২ সাল থেকেই স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত করার জন্য ক্ষোভে ফুঁসছিল। ৫ আগস্ট দুপুর থেকে তারা যখন ঢাকার রাজপথগুলোকে মিছিলে মিছিলে সয়লাব করে দিয়েছিল, তখন জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরাও ওই মিছিলগুলোর জনসমুদ্রে শামিল হয়ে গিয়েছিল।
৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের চার মাস অতিবাহিত হওয়ার পর এখন পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে যে জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন এই সরকারের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু ‘রিসেট বাটন’ টেপার কথা বলে এই সরকারের কর্তাব্যক্তিরা যদি মনে করে থাকেন যে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধ, বিজয় দিবস ও বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবসকে ইতিহাস থেকে মুছে দিতে পারবেন, তাহলে
তাঁরা আহাম্মকের স্বর্গে বাস করছেন বলতেই হবে! আমরা কখনোই ভুলব না যে জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্র সংঘ/শিবির আজও তাদের এই ঘৃণ্য হত্যাযজ্ঞের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চায়নি।
ড. মইনুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
মনে পড়ছে ১৯৭১ সালের কথা। মহান মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ডিসেম্বরের যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরাজয় অবশ্যম্ভাবী বুঝতে পেরে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিকল্পিতভাবে বাসা কিংবা কর্মস্থল থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। এই কাজটি করেছিল জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের নিয়ে গঠিত ‘আলবদর বাহিনী’। চরম এই নৃশংসভাবে হত্যার বিষয়ে গত ৫৩ বছরেও জামায়াতে ইসলামী কিংবা ইসলামী ছাত্র সংঘের নব্য সংস্করণ ইসলামী ছাত্রশিবিরের জাতির কাছে ক্ষমা না চাওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। বর্তমানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লেবাস ধারণ করে যে ১৫২ জন সমন্বয়ক অন্তর্বর্তী সরকারের দণ্ডমুণ্ডের কর্তার ভূমিকা পালন করে চলেছে, তাদের মধ্যে নাকি ১০৮ জন ইসলামী ছাত্রশিবিরের ক্যাডার। তারা বাংলাদেশের ইতিহাসকে তাদের পছন্দমতো সাজাবার উদ্দেশ্যে নাকি ‘রিসেট বাটন’ টিপে দিয়েছে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের দিনগুলোর পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী হত্যার ব্যাপারে তাদের অবস্থান কী, সেটা জানার জন্যই কলামটি লিখছি।
১৯৭৬ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দলবিধি আদেশের ফায়দাভোগী হয়ে ‘পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী’ ‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ’ নাম ধারণ করে বাংলাদেশে রাজনীতি করার বৈধ অধিকার অর্জন করেছিল, কিন্তু তাদের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘকে তারা পুরোনো নামে পুনরুজ্জীবিত করেনি সম্ভবত এই বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ভার এড়িয়ে যাওয়ার চাণক্য-কৌশল অবলম্বনে। তাই জাতির কাছে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ভার স্বীকার করে জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবির ক্ষমা প্রার্থনা করার নৈতিক সাহস প্রদর্শন করবে কি না, সেটা আবারও জিজ্ঞাসা করতে চাই। জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান আমির ডা. শফিকুর রহমান কয়েকবারই বলেছেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামী কোনো ভুল করে থাকলে তার জন্য অবশ্যই ক্ষমা প্রার্থনা করবে। (তিনি অবশ্য ১৯৭১ সালে ছাত্রলীগ করতেন এবং ১৯৭২ সাল থেকে নাকি ছাত্রলীগের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র গ্রুপের সদস্য ছিলেন!) তাঁর কাছে সে জন্যই সরাসরি প্রশ্ন করছি, মুক্তিযুদ্ধের শেষ সপ্তাহে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের এই নৃশংস বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞকে তিনি কি মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে স্বীকার করেন না? যদি অপরাধ হিসেবে স্বীকার করেন তাহলে ক্ষমা চাননি কেন বা এখনো চাইছেন না কেন? এটা যদি ভুল অথবা অপরাধ না হয় তাহলে কোন কাজটা এর চেয়ে নৃশংসতর অপরাধ?
পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ডিসেম্বর মাসে যখন বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের অধীন সশস্ত্র বাহিনীর কাছে পাকিস্তানি ঘাতক হানাদার বাহিনীর পরাজয় অবধারিত হয়ে উঠেছিল, তখন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর পরিকল্পনা মোতাবেক স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার উদ্দেশ্যে তালিকা করে ঢাকাসহ সারা দেশে ২০০-এর বেশি বুদ্ধিজীবীকে পাকড়াও করে হত্যা করার নীলনকশা প্রণয়ন করে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘ। পরবর্তীকালে রাও ফরমান আলীর অফিস থেকে এই তালিকাটি উদ্ধার করা হয়েছিল। তালিকা ধরে ধরে বুদ্ধিজীবীদের তাঁদের বাসা কিংবা কর্মস্থল থেকে অস্ত্রের মুখে পাকড়াও করে মিরপুরের বাঙলা কলেজে, ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে বা রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে গুলি করে কিংবা বেয়নেট চালিয়ে হত্যা করার দায়িত্বটি অর্পিত হয়েছিল ইসলামী ছাত্র সংঘের ঘাতক ‘আলবদর’ বাহিনীর ওপর। এই আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠিত হয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ‘অক্সিলিয়ারি ফোর্স’ হিসেবে, জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ১৯৭১ সালের মে-জুন মাসে। অতএব শুধু বুদ্ধিজীবী হত্যা নয়, মুক্তিযুদ্ধের শেষ ছয় মাসে সারা দেশে আলবদর ও আলশামস বাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পথপ্রদর্শক, গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহকারী ও সহায়ক ঘাতক বাহিনীর ভূমিকা পালন করেছিল রাজাকার বাহিনীর মতো। বরং রাজাকারদের চেয়ে অনেক বেশি প্রশিক্ষিত, কার্যকর ও নিষ্ঠুর ঘাতক বাহিনী হিসেবে জনগণের কাছে বিভীষিকার প্রতীক হয়ে উঠেছিল আলবদর ও আলশামস। অতএব এটা মোটেও অস্বাভাবিক ছিল না যে জেনারেল রাও ফরমান আলী চতুরতার সঙ্গে বাছাই করে নিয়েছিল আলবদর বাহিনীর ঢাকা নগরীর দুর্ধর্ষ ক্যাডারদের বুদ্ধিজীবী নিধনের প্রধান ঘাতক বাহিনী হিসেবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার হলের (বর্তমান মাস্টারদা সূর্য সেন হল) বেশ কয়েকজন ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা-কর্মী পরবর্তী সময়ে এই ঘাতক বাহিনীর মূল কুশীলব হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে এবং এখনো বিদেশে পালিয়ে রয়েছে। আলবদর বাহিনী গঠিত হয়েছিল জামায়াতে ইসলামীর সরাসরি সিদ্ধান্তের মাধ্যমে। (অবাঙালি জনগোষ্ঠীর একটি অংশের আলবদরের ঘাতকদের সক্রিয় দোসরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।) এত দিনে প্রমাণিত হয়ে গেছে যে ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে অংশগ্রহণ করতেই হয়নি, এককভাবে আলবদর বাহিনীই ওই হত্যাযজ্ঞের নায়ক ছিল। তাই জামায়াতে ইসলামীকে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ভার স্বীকার করতেই হবে। তাদের অঙ্গসংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের নাম বদলে ১৯৭৬ সালে ইসলামী ছাত্রশিবির করে ফেলার মাধ্যমে জামায়াত যদি ভেবে থাকে তারা এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের রক্তের দাগ’ মুছে ফেলতে পারবে, তাহলে তারা চরম ভুল করবে।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বুদ্ধিজীবী হত্যা শুরু হলেও প্রধানত ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে রাও ফরমান আলীর তালিকা ধরে আলবদর বাহিনী কর্তৃক বুদ্ধিজীবী হত্যায় গতি সঞ্চারিত হয়েছিল। বাংলাদেশ সরকারের গেজেট অনুযায়ী ৫৬০ জন বুদ্ধিজীবী মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে শাহাদাত বরণ করেছেন। ডিসেম্বরে আলবদরের হাতে শহীদ অধ্যাপকদের মধ্যে মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, রাশিদুল হাসান, ফাইজুল মাহী, সিরাজুল হক খান, সন্তোষ ভট্টাচার্য এবং গিয়াসউদ্দিন আহমদ ছিলেন স্বনামধন্য। অন্যদের মধ্যে সাহিত্যিক ও সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সার, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, সাংবাদিক নিজামউদ্দিন, সাংবাদিক সেলিনা পারভীন, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলিম চৌধুরী এবং ডা. গোলাম মরতুজা আলবদরের হাতে নৃশংস হত্যার শিকার বুদ্ধিজীবীদের প্রথম সারির কয়েকজন। তাঁদের অনেকের অর্ধগলিত মৃতদেহ ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে ঢাকার বিভিন্ন বধ্যভূমিতে পাওয়া গিয়েছিল, আবার বেশ কয়েকজনের মৃতদেহ পাওয়াই যায়নি। (মিরপুরে বড় ভাই শহীদুল্লা কায়সারের সন্ধান করতে গিয়ে দেশের কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হানও চিরতরে হারিয়ে গিয়েছিলেন।) ওপরের তালিকা থেকে কি প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না যে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘ অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়ন করেছে স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশ যাতে এসব মেধাবী ও সমাজের নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের সমাজ গঠনে নিয়োজিত করতে না পারে সে জন্য? এটা কি ‘চরম জাতিদ্রোহী কর্মকাণ্ড’ নয়? জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘ কি ভেবেছিল বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করলে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়কে নস্যাৎ করা যাবে? ডিসেম্বর মাসে তারা পাকিস্তানের পরাজয় অবধারিত বুঝতে পেরেও এহেন জাতিদ্রোহিতায় কেন মগ্ন ছিল?
স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সংঘটিত ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে জামায়াত-শিবির সুচতুরভাবে নেতৃত্বের ভূমিকা হাইজ্যাক করতে পেরেছিল প্রধানত তাদের ‘সিভিল আর্মির’ সাংগঠনিক অবয়বের কারণে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের অধিকাংশই ছিল ছদ্মবেশে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ক্যাডার। তাদের বেশ কয়েকজন ছদ্মবেশে ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে অবস্থান গ্রহণ করতেও সমর্থ হয়েছিল। সারা দেশ থেকে জামায়াত-শিবির টেলিফোন করে নেতা-কর্মীদের ঢাকায় জড়ো করতে পেরেছিল ৫ আগস্ট। ৩ আগস্ট বাংলাদেশের সেনাপ্রধান ঘোষণা করেছিলেন যে সেনাসদস্যরা আন্দোলনকারী জনগণের ওপর গুলি চালাবে না। অতএব যৌক্তিকভাবেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা ‘চলো চলো ঢাকা চলো’ লংমার্চকে ৬ আগস্টের পরিবর্তে এক দিন এগিয়ে দিয়ে ৫ আগস্ট নির্ধারণ করে দিয়েছিল। সাধারণ জনগণের সিংহভাগ এবং হাসিনাবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীরা ২০১২ সাল থেকেই স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত করার জন্য ক্ষোভে ফুঁসছিল। ৫ আগস্ট দুপুর থেকে তারা যখন ঢাকার রাজপথগুলোকে মিছিলে মিছিলে সয়লাব করে দিয়েছিল, তখন জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরাও ওই মিছিলগুলোর জনসমুদ্রে শামিল হয়ে গিয়েছিল।
৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের চার মাস অতিবাহিত হওয়ার পর এখন পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে যে জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন এই সরকারের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু ‘রিসেট বাটন’ টেপার কথা বলে এই সরকারের কর্তাব্যক্তিরা যদি মনে করে থাকেন যে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধ, বিজয় দিবস ও বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবসকে ইতিহাস থেকে মুছে দিতে পারবেন, তাহলে
তাঁরা আহাম্মকের স্বর্গে বাস করছেন বলতেই হবে! আমরা কখনোই ভুলব না যে জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্র সংঘ/শিবির আজও তাদের এই ঘৃণ্য হত্যাযজ্ঞের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চায়নি।
ড. মইনুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
২০ বছর আগে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে অটিজম শব্দটির অস্তিত্ব প্রায় খুঁজে পাওয়া যেত না। অটিজম বিষয়ে মানুষের ধারণা সীমিত ছিল। ঠিক সেই সময়ে অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন পরিচালিত বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান ‘কানন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০৪ সালের ৪ এপ্রিল, বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটির একটি চারতলা ভাড়া বাড়িতে...
৮ ঘণ্টা আগেমাঝে মাঝে মনে হয় দেশটা বুঝি ট্রায়াল অ্যান্ড এররের ভিত্তিতে চলছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, এমনকি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়েও নানা ধরনের পরীক্ষামূলক তত্ত্ব দেখতে পাচ্ছি। প্রথমে নতুন কিছু একটা বলা হয় বা চালু করা হয়। তারপর দেখা হয়—কতটা বিতর্ক হয় সেটা নিয়ে।
১৩ ঘণ্টা আগেসম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ সেনাবাহিনীকে দেওয়া ও অস্থায়ী আবাসনসহ বিভিন্ন দাবিতে শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের ফলে কর্তৃপক্ষ আন্দোলনের দাবি মেনে নিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, কর্তৃপক্ষ দাবি মেনে নেওয়ার পরও প্রত্যাশিত দাবির বাস্তবায়ন না দেখে আবারও...
১৪ ঘণ্টা আগেআকৃষ্ট করেছিল, সে বাণী যেন কথার কথায় পরিণত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। ভালো একটি ভবিষ্যতের আশা ক্রমেই ধূসরতার দিকে যাচ্ছে। শীর্ষ সন্ত্রাসীরা রাজধানীর নিউ এলিফ্যান্ট রোড ও নিউমার্কেট এলাকার মধ্যে থাকা ৫৭টি মার্কেটের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। এই মার্কেটগুলো থেকে প্রতি মাসে সেবা খাত...
১৪ ঘণ্টা আগে