Ajker Patrika

শ্রদ্ধাঞ্জলি

জিয়া নেই, বিএনপি আছে

মাসুদ রানা, সাংবাদিক
প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। ছবি: সংগৃহীত
প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হন কয়েকজন সেনাসদস্যের হাতে। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি ছিল একটি রাজনৈতিক দিক পরিবর্তনের মুহূর্ত। জিয়াউর রহমান কেবল একজন সেনানায়ক বা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, তিনি ছিলেন একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তিকে পুনর্গঠনের কারিগর, একটি নতুন রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠাতা এবং সামরিক ও বেসামরিক শাসনের মধ্যবর্তী এক রূপান্তরের ধারক। তাঁর মৃত্যুর ফলে শুধু রাষ্ট্রের নেতৃত্বেই নয়, বরং একটি সম্ভাব্য রাজনৈতিক ধারার বিকাশও থমকে যায়, যার ফলাফল আমরা আজকের রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রত্যক্ষ করি।

জিয়া রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন এমন এক সময়, যখন দেশ ছিল চরম রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বিশ্বাসঘাতকতা, সেনা বিদ্রোহ ও নেতৃত্বশূন্যতায় জর্জরিত ছিল রাষ্ট্রব্যবস্থা। এই প্রেক্ষাপটে জিয়া মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেন। তিনি ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ নামক ধারণা প্রতিষ্ঠা করে তা একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মতাদর্শে পরিণত করতে চান। তাঁর মতে এই জাতীয়তাবাদ ছিল একটি ধর্মনিরপেক্ষতাবিরোধী, কিন্তু উন্নয়নমুখী ও রাষ্ট্রকেন্দ্রিক চিন্তাধারা, যেখানে ‘ধর্মীয় মূল্যবোধ’ রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে।

তাঁর শাসনকাল দীর্ঘ হলে হয়তো বাংলাদেশের রাজনীতি আরেকভাবে পরিণতি লাভ করত। কারণ, তিনি যে ‘ডানপন্থী আধুনিকতা’ গড়ে তুলতে চাইছিলেন, তা একদিকে প্রশাসনিক দৃঢ়তা, অন্যদিকে আর্থিক উদারনীতি এবং গ্রামীণ উন্নয়ন ও বেসরকারীকরণে গুরুত্ব দিচ্ছিল। বলা যায়, জিয়ার মধ্যে ছিল একধরনের কনজারভেটিভ ডেভেলপমেন্টালিজম, যার ওপর ভিত্তি করে একটি মধ্যম আয়ের, নিয়ন্ত্রিত-উন্নয়নশীল দেশ গড়ে ওঠার পথ তৈরি হতে পারত।

জিয়া রাজনৈতিকভাবে বড় যে কাজটি করেন, তা হলো বিএনপি প্রতিষ্ঠা। ১৯৭৮ সালে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গঠন করেন, যেটি ছিল একদিকে বহুমাত্রিক স্বার্থের সমন্বয়, অন্যদিকে পুরোনো রাজনৈতিক শক্তির পুনর্জাগরণ। আওয়ামী লীগবিরোধী বিভিন্ন গোষ্ঠীকে একত্র করে, সেনা, আমলা, ব্যবসায়ী এবং মাদ্রাসাভিত্তিক শক্তিকে বিএনপির ছাতার নিচে নিয়ে এসে জিয়া এমন একটি রাজনৈতিক জোট গড়ে তোলেন, যার মূল ভিত্তি ছিল আওয়ামী লীগবিরোধিতা, ইসলামপ্রীতি ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রায়ন।

তবে এখানেই প্রশ্ন দেখা দেয়, জিয়া হত্যার পর তাঁর প্রতিষ্ঠিত দল কি সেই রাজনৈতিক দর্শন অব্যাহত রাখতে পেরেছে? ইতিহাস বলছে, আংশিকভাবে। বিএনপি ১৯৯১ সালে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস স্থাপন করে। সংসদীয় পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তন করে, যা নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক দিক। কিন্তু একই সঙ্গে দেখা যায়, দলটি ধীরে ধীরে একটি প্রতিক্রিয়াশীল, ক্ষমতাকেন্দ্রিক গোষ্ঠীতে পরিণত হয়, যেখানে আদর্শ নয়, বরং নেতৃত্বকেন্দ্রিকতা ও দলীয় সুবিধা মুখ্য হয়ে ওঠে।

জিয়া একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র এবং নিয়ন্ত্রিত উদারনীতি চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর উত্তরসূরিদের মধ্যে অনেকেই এই দৃষ্টিভঙ্গিকে চর্চা করেননি। বরং রাজনৈতিক সহনশীলতা কমে যায়, বিএনপির মধ্যে দলীয় বিভাজন, দুর্নীতির অভিযোগ এবং জোটনির্ভর রাজনীতি একটি দুর্বল কাঠামো তৈরি করে। ২০০১ সালের ক্ষমতা গ্রহণের পর বিএনপি নিজেই একটি দুর্নীতিগ্রস্ত ও সাংগঠনিকভাবে বিভ্রান্ত শক্তিতে পরিণত হয়। তৎকালীন সরকারের আমলে ‘হাওয়া ভবন রাজনীতি’, অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন এবং জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট বাঁধার ফলে বিএনপি জিয়ার প্রতিষ্ঠিত মূলধারা থেকে দূরে সরে যায়।

জিয়া ইসলামি মূল্যবোধকে ব্যবহার করলেও রাষ্ট্রকে ধর্মনির্ভর করে তোলেননি। বরং তিনি ধর্মকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে একটি সুসংগঠিত প্রশাসন ও উন্নয়নমুখী রাষ্ট্র গঠনের দিকেই নজর দিয়েছিলেন। তাঁর সময়ে ‘রাজাকারপ্রীতি’ কিংবা জঙ্গিবাদী শক্তির উত্থান ঘটেনি, বরং তিনি একটি মধ্য-ডানপন্থী কাঠামো গঠনের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বিএনপি পরবর্তীকালে ধর্মভিত্তিক জোটে যুক্ত হয়ে, এমনকি ২০০৫-০৬ সালের বোমা হামলা বা জেএমবির উত্থানের সময় নীরব থেকে এক বিপজ্জনক রাজনৈতিক সুর তৈরি করে দেয়, যার ফলে দলটি নৈতিকভাবে অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।

যদি প্রশ্ন করা হয়, জিয়া বেঁচে থাকলে কি বিএনপি এই রূপে পরিণত হতো? উত্তর সম্ভবত ‘না’। কারণ, একনায়কতান্ত্রিক প্রবণতাসম্পন্ন হলেও জিয়া ছিলেন কার্যকর রাষ্ট্র গঠনের প্রতি আন্তরিক। তাঁর মধ্যে রাজনৈতিক সংগঠন, প্রশাসনিক দক্ষতা ও আন্তর্জাতিক ভারসাম্য রক্ষা করার স্পষ্ট দক্ষতা ছিল। তিনি পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের পাশাপাশি মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রক্ষা করেছিলেন, কিন্তু কখনো চরমপন্থার পথে যাননি। এই ভারসাম্য আজকের বিশ্বে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

আরেকটি দিক বিবেচনা করা যেতে পারে। জিয়া বেঁচে থাকলে হয়তো ১৯৮২ সালে এরশাদের অভ্যুত্থান ঘটত না। কারণ, জিয়া ছিলেন সামরিক বাহিনীর প্রতি কঠোর নিয়ন্ত্রণমূলক

এক সংগঠক। তাঁর সময় সেনাবাহিনীতে অস্থিরতা চলছিল কিন্তু তিনি কঠোর হাতে অভ্যুত্থান দমনে সব সময়

তৎপর ছিলেন। এরশাদের উত্থান একটি দীর্ঘ সামরিক স্বৈরশাসনের

জন্ম দেয়, যা বিএনপি-আওয়ামী লীগ উভয় দলের মধ্যকার বৈরিতা ও রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা তৈরি করে। জিয়া থাকলে হয়তো এই ধারাটি রোধ করা যেত এবং রাজনৈতিক পরিপক্বতা তৈরি হতো দীর্ঘ মেয়াদে।

তবে এটাও সত্য, জিয়ার শাসনকালে বাক্‌স্বাধীনতা এবং বিরোধী রাজনীতির পরিসর সংকুচিত ছিল। তাঁর সময় সংবাদপত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ, রাজনৈতিক বন্দী এবং সেনা আদালতের প্রচলন ছিল। অতএব, তাঁর শাসন দীর্ঘমেয়াদি হলে রাজনৈতিক বিরোধিতার সুযোগ কতটা থাকত, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।

কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর বিএনপির রাজনীতি একপর্যায়ে এসে প্রায় ‘নেতৃত্বনির্ভর পরিবারতন্ত্রে’ পর্যবসিত হয়। জিয়ার পত্নী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দল পরিচালিত হতে থাকে এবং পরে তাঁর দুই পুত্রের মধ্যে রাজনৈতিক উত্তরাধিকার তৈরির উদ্যোগ লক্ষ করা যায়। তারেক রহমান এখন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, যিনি দেশের বাইরে অবস্থান করছেন দীর্ঘদিন ধরে। তাঁর রাজনৈতিক ভূমিকা ও কৌশল নিয়েও প্রশ্ন আছে। একদিকে তিনি চেষ্টা করছেন জিয়াউর রহমানের ভাষা ও কৌশলের ছায়া অনুসরণ করতে, কিন্তু বাস্তব রাজনীতির মাটিতে সেই দর্শন আজ আর জাগ্রত নয়।

সুতরাং বলা যায়, ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান যদি নিহত না হতেন, তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে হয়তো একটি ডানপন্থী উন্নয়নমুখী, রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আধুনিকতার পথ সুসংহত হতো। হয়তো বর্তমান রাজনৈতিক মেরুকরণ, প্রতিহিংসাপরায়ণতা এবং ধারাবাহিক অনিশ্চয়তা কিছুটা হলেও প্রশমিত হতো। আর বিএনপি যদি সত্যিই জিয়ার দর্শন অনুসরণ করত, তাহলে হয়তো দলটি আজ একটি সংগঠিত, আদর্শনির্ভর ও আধুনিক রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিতি পেতে পারত। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দলটি এখন জিয়ার আদর্শের নামমাত্র অনুসারী হলেও কার্যত সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে অনেকটাই যেন পথ খোঁজা পথিকের মতো এগিয়ে চলছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

নগদের ১৫০ কোটি টাকা বেহাতের অভিযোগ নিয়ে যা বললেন নাহিদের সাবেক পিএ আতিক

সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধই সেনাবাহিনীর চেতনার উৎস: সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার

আরাকান আর্মির হাতে মিয়ানমারের জেনারেল নিহত, চীনা টার্মিনালের কাছে চলছে লড়াই

বগুড়ায় ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার ৩ পুলিশ ও আনসার সদস্য কারাগারে

শেরপুরে ৮৫ বস্তা সরকারি চালসহ বিএনপি নেতা গ্রেপ্তার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত