Ajker Patrika

স্মার্ট বাংলাদেশে স্মার্ট পুলিশিং

আক্তার হোসেন
আপডেট : ০৩ জুলাই ২০২৪, ১৬: ২২
স্মার্ট বাংলাদেশে স্মার্ট পুলিশিং

বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সুদৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, ২০৪১ সালের মধ্যে দেশ ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরিত হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা আগামী ’৪১ সালে বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলব। আর সেই বাংলাদেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে চলে যাব।’

উন্নয়নের মহাসড়কে চলমান বাংলাদেশের লক্ষ্য এখন স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ। ডিজিটাল বাংলাদেশের হাত ধরে উন্নয়নের ধারা বজায় রেখে দেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের কর্মপরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে। অর্থাৎ, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুফল কাজে লাগিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হয়ে উঠবে একটি উন্নত, সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ। তবে এ যাত্রায় অনেক সম্ভাবনার পাশাপাশি কিছু চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হবে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বাড়াতে হবে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা। একই সঙ্গে সার্বিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অন্তর্ভুক্তিমূলক টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। 

৩ জানুয়ারি পুলিশ সপ্তাহ ২০২৩ উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশ সদস্যদের প্রতি বেশ কিছু মূল্যবান ও উপদেশমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে একটি দক্ষ ও বিশ্বমানের “স্মার্ট পুলিশ” গড়ে তোলা।’ সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, ২০৪১ সালে বাংলাদেশ হবে উন্নত বাংলাদেশ এবং সেটি হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণা জনসাধারণ্যে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। স্মার্ট বাংলাদেশে নাগরিকসেবা থেকে শুরু করে সব আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ডে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। 

আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হলো প্রশাসন। আর প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসংগঠন হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলতে প্রধানত পুলিশ সার্ভিসকেই বোঝানো হয়। পুলিশের ওপর জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ও স্বাভাবিক জীবনযাপন অনেকটাই নির্ভরশীল। উন্নত বিশ্বে পুলিশ জনগণের সার্বক্ষণিক সেবায় নিয়োজিত থাকে। যেকোনো সমস্যায় জনগণ পুলিশের সাহায্য কামনা করে। পুলিশ সদস্যদের কাজই হলো জনগণের যেকোনো সমস্যায় সব ধরনের সহযোগিতা করা। অসহায়, বিপন্ন ও বিপদগ্রস্ত মানুষের প্রতি আন্তরিকভাবে সহযোগিতা ও মানবিকতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া। পাশাপাশি জনগণের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জনে নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়া। মোটকথা, পুলিশ সদস্যরা পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় জনগণের মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার ও আইনের শাসনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। 

 উন্নত বিশ্বে সাধারণত ধরা হয়ে থাকে যে সমাজের ৯০ শতাংশ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেশের প্রচলিত আইন মেনে চলবে, বাকি ১০ শতাংশ মানুষ আইনের বরখেলাপ করবে অথবা বিপথগামী হবে। পুলিশ তাদের নিয়ন্ত্রণ করবে অথবা আইনের আওতায় আনবে। অন্যভাবে বললে বলা যায়, পুলিশ এই ১০ শতাংশ মানুষের কাছ থেকে সমাজের ৯০ শতাংশ শান্তিকামী মানুষকে রক্ষা করবে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে ৯০ শতাংশ মানুষ কি আইন মেনে চলে বা চলার মতো পরিবেশ আছে? তবে এ কথা ঠিক, অল্প কিছু মানুষের নিয়মবহির্ভূত কাজের প্রভাব সমাজে অনেক বেশি পড়ে। পুলিশের কাজ মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। সুতরাং কেউ যদি অন্যায়ভাবে আটক হন, তার প্রভাবও বেশি থাকে। সামান্যতম বিচ্যুতিও মানুষকে প্রভাবান্বিত করতে পারে। পুলিশকে আইনত মানুষের স্বাধীনতা খর্ব করার অধিকার দেওয়া আছে, তবে তা সম্পূর্ণ ন্যায়সংগতভাবে হতে হবে। 

পুলিশের কাজ হচ্ছে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা দেওয়া। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে সতর্ক আছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হবে, সেটা নিয়ে পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিনিয়ত কাউন্সেলিং করা হচ্ছে। প্রতিদিন দায়িত্ব বণ্টনের আগে কর্মকর্তারা পুলিশ সার্ভিসের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রেখে কাজ করার বিষয়ে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। থানা থেকে শুরু করে পুলিশ লাইনস, পুলিশ ক্যাম্প, বিভাগ—সবখানেই কাউন্সেলিং করা হয়। কাউন্সেলিংকালে পুলিশ সদস্যদের কোথাও তল্লাশি চালাতে হলে কী নিয়ম মানতে হবে, কী ধরনের আচরণ করতে হবে, তা বুঝিয়ে বলা হয়। সাধারণ মানুষকে যেন সম্মান দেওয়া হয়, তাদের প্রতি যেন ভদ্র আচরণ করা হয়। 

 স্মার্ট পুলিশিং হলো তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর একটি আধুনিক পুলিশিং ব্যবস্থা, যেখানে জ্ঞানবিজ্ঞান ব্যবহৃত হয় অত্যধিক। স্মার্ট পুলিশিংয়ে অপরাধমূলক কার্যক্রমের উপাদানগুলো ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও গবেষণা করা হয়, যা অফিসারদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধির সহায়ক। তা ছাড়া নতুন নতুন উদ্ভাবনী প্রযুক্তিকে উৎসাহিত করা হয় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ ও প্রতিকারের জন্য। অর্থাৎ, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে দ্রুত সময়ে নির্ধারিত, বাস্তবিক ও কাঙ্ক্ষিত পুলিশিং সেবা প্রদানই হলো স্মার্ট পুলিশিং।

মানুষের ব্যক্তিগত থেকে রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ধাপে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যাপক প্রয়োগ ইতিমধ্যে লক্ষণীয় প্রভাব ফেলেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো প্রেডিক্টিভ পুলিশিং, যা স্মার্ট পুলিশিং বাস্তবায়নে এমন এক ব্যবস্থাকে বোঝায়; যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের মাধ্যমে অপরাধ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে একটি স্বয়ংক্রিয়, দ্রুতগতিসম্পন্ন ও তুলনামূলক নির্ভুল ব্যবস্থাপনা। অপরাধ ও অপরাধীকে শনাক্ত করার মাধ্যমে অপরাধ প্রতিরোধ, বিশ্লেষণ ও প্রতিকারে কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। যেমন—সিসি ক্যামেরা, সেন্সর ডিভাইস, পূর্বে তৈরিকৃত ডেটাবেইসের তথ্য বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম। আইন প্রয়োগের ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এ আই) সংযোজন একটি বৈপ্লবিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা জননিরাপত্তায় ফোর্স মোবিলাইজেশন, রিসোর্স অ্যালোকেশন, স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় অগ্রিম তথ্য প্রদান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। 

ডিজিটাল যোগাযোগমাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানুষ ঘরে বসে তাদের কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি সেবা উল্লেখ না করলেই নয়। আমরা সবাই জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর সুবিধাভোগী। বিপদাপদ, অগ্নিকাণ্ড, দুর্ঘটনা বা যেকোনো জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত সেবার জন্য ৯৯৯-এ কল করে থাকি। এটা পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস এবং স্বাস্থ্য সমন্বয়ে একটি সেবা। সেবাটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর উদ্বোধন করেন। এটি তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত বা উদ্ভাবন। আরেকটি সেবা অনলাইন পুলিশ ক্লিয়ারেন্স। বাংলাদেশের কোনো নাগরিকের প্রবাসে চাকরি বা অভিবাসন প্রক্রিয়ায় এই ক্লিয়ারেন্স প্রয়োজন হয়। সেবাটি চালু হয় ২০১৭ সালে। এ ধরনের আরও বহুবিদ অনলাইন সেবা রয়েছে। ডিজিটাল হওয়ার কারণে সেবা দ্রুত মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে। এতে সময় ও খরচ দুই-ই কম লাগছে।

 একটি তথ্য ও তথ্যভিত্তিক বা তথ্যনির্ভর সমাধান পদ্ধতি, যাকে কম্পিউটারের ভাষায় বলা হয় Algorithm। উদাহরণস্বরূপ, জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯। যেকোনো জরুরি পরিস্থিতিতে নাগরিকদের সেবা প্রদান করার জন্যই সেবাটি প্রবর্তন করা হয়। বর্তমানে ৯৯৯ ডিজিটাল পদ্ধতিতে কাজ করছে। কেউ ৯৯৯-এ কল করলে কল সেন্টারে একজন অপারেটর (Call Taker) কলটি গ্রহণ করে এবং কলারের চাহিদামতো কল সংশ্লিষ্ট স্থানীয় ইউনিট, অর্থাৎ থানায় ডেসপাচ করে অথবা কনফারেন্সিংয়ের জন্য থানাকে সংযুক্ত করে দেয়। এই ব্যবস্থায় কলারের লোকেশনও জানা যায় (GPS Location)। অতঃপর থানা থেকে সেবাপ্রত্যাশীকে সাড়া প্রদান করা হচ্ছে। সাড়া প্রদানের সময় (Response Time) আরও সংক্ষিপ্ত ও দ্রুত করার লক্ষ্যে পুলিশের মোবাইল পেট্রল গাড়িগুলোতে মোবাইল ডেটা টার্মিনাল (এমডিটি) বসানোর কার্যক্রমও সরকারের সক্রিয় বিবেচনাধীন রয়েছে। ফলে ৯৯৯ কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার থেকে থানায় ডেসপাচের পরিবর্তে সরাসরি ঘটনাস্থল বা সেবাপ্রত্যাশীর নিকটবর্তী কোনো এমডিটিতে কল ডেসপাচ করলে খুব দ্রুত সাড়া প্রদান করা সম্ভব হবে।

স্মার্ট ৯৯৯, যা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ তথা স্মার্ট গভর্নমেন্টেরই’ অংশ, তা আসলে কী রকম হবে? ডিজিটাল ৯৯৯ যখন স্মার্ট ৯৯৯ হবে, তখন কোনো অগ্নিকাণ্ড, দুর্ঘটনা বা অপরাধ, যেমন—হাউস ট্রেসপাসিং, যৌন হয়রানি ইত্যাদিসহ যেকোনো জরুরি প্রয়োজনে মানুষকে আর কল করতে হবে না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসমৃদ্ধ (AI) যেকোনো IOT (Internet of Things)-এর আশপাশে কোনো ঘটনা, দুর্ঘটনা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় সেবার জন্য সংকেত বা কোনো অ্যালার্ম স্মার্ট ৯৯৯ কমান্ড সেন্টারে পাঠাতে পারবে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কোথাও সাপ্তাহিক ছুটি উদ্‌যাপন করতে গিয়েছেন বা আমরা যা সচরাচর করি—ঈদ, পূজার বড় ছুটি পেলে পরিবারের সবাই মিলে গ্রামের বাড়িতে যাই। তখন বাসায় কেউ থাকে না। সে ক্ষেত্রে আপনার বাসায় যদি IOT নামক ডিভাইসটি থাকে আর তার যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থাকে, তবে আপনার অনুপস্থিতিতে যে কেউ আপনার বাসা-বাড়িতে ঢুকলে বা বাসায় কোনো দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ড ঘটলে স্মার্ট ৯৯৯ কমান্ড সেন্টারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কল বা অ্যালার্ম বা সিগন্যাল চলে আসবে। শুধু তাই নয়, স্মার্ট ৯৯৯ অবশ্যই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসমৃদ্ধ কলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে শনাক্ত করে অগ্নিকাণ্ড হলে নিকটবর্তী ফায়ার সার্ভিসকে অথবা কোনো অপরাধসংক্রান্ত হলে নিকটবর্তী ইউনিটকে কল, সংকেত, সিগন্যাল পাঠাবে। সাড়া বা সেবা প্রদান অথবা সাড়া প্রদানকারী ঘটনাস্থলে না পৌঁছানো পর্যন্ত স্বয়ংক্রিয়ভাবে কলটি লাইভ থাকবে।

 আমরা এমন একটি দ্রুত পরিবর্তনশীল সময় পার করছি, যেখানে বিশ্ব প্রতিটি মুহূর্তে প্রযুক্তিগত উন্নতির পাশাপাশি নিত্যনতুন জটিল সমস্যার সাক্ষী হচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে বিশ্বের নানা প্রান্তে ঘটে যাওয়া প্রযুক্তিগত বিপ্লব পরিবর্তন করে দিচ্ছে আমাদের ধারণা, প্রস্তুতি ও কাজের ধরনকে। কালের পরিক্রমায় আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) যুগে প্রবেশ করেছি। 

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, যানবাহনের অতিরিক্ত গতি এবং বেপরোয়া গাড়ি চলাচলের কারণে দুর্ঘটনা হয় ৮০ শতাংশেরও বেশি। এ দুর্ঘটনার হার কমিয়ে আনার জন্য AI সংবলিত Automated Software Application ক্যামেরা এবং স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। মহাসড়কে ইতিমধ্যে সংঘটিত দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থান স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হবে। তদনুসারে স্মার্ট ক্যামেরা সড়ক-মহাসড়কে প্রকাশ্য-গোপনে বসানো যেতে পারে। এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংবলিত ক্যামেরা গতিসীমার অতিরিক্ত গতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে শনাক্ত করতে পারবে এবং সংশ্লিষ্ট গাড়ি এবং গাড়ির মালিকের তথ্যভান্ডার (Big Data) বিশ্লেষণ করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্ণয় করতে পারবে। তদুপরি আইন অনুসারে এ অপরাধের জন্য নির্ধারিত জরিমানা সরাসরি অভিযুক্ত গাড়ির মালিকের যোগাযোগের ঠিকানা, মোবাইল ফোন নম্বর বা ই-মেইলে পাঠিয়ে দিতে পারবে। পেমেন্ট সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত এটা মুলতবি দেখাবে। তা ছাড়া, ট্রাফিক সিগন্যাল যদি Automated করা যায়, তখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যানজট শনাক্ত করে তদনুসারে ট্রাফিক সিগন্যাল স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত হবে। ফলে একটি নির্দিষ্ট স্থানে বা ট্রাফিক সিগন্যালে যানবাহনের জট অনেকাংশে কমে যাবে। কারণ পুরো ট্রাফিক-ব্যবস্থা তখন ডিজিটাল ও স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত হবে। 

পুলিশিং ব্যবস্থাপনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের বড় সুবিধা হলো প্রেডিক্টিভ অ্যানালাইসিস। সুবিস্তর তথ্যভান্ডারের স্বয়ংক্রিয় পর্যালোচনার মাধ্যমে এআই অ্যালগোরিদম এমন কিছু ঘটনা ও অপরাধের লক্ষণ শনাক্ত করতে সক্ষম, যা মানুষের পর্যালোচনাশক্তি দ্বারা অসম্ভব। এই পূর্ব শনাক্তকরণ সক্ষমতা পুলিশ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে কোনো অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আগেই অপরাধ দমনে সাহায্য করবে। এই ক্ষেত্রে এআই অপরাধীর আচরণ বিশ্লেষণ করে অপরাধপ্রবণ অঞ্চল, অপরাধের ধরন ও মাত্রা অনুযায়ী রিসোর্স মোবিলাইজেশন ও প্রো-অ্যাকটিভ সিদ্ধান্ত গ্রহণে ক্রিমিনাল ট্র্যাক ডেটা, মানুষের আচরণ বিশ্লেষণ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের তথ্য ব্যবহার করে থাকে। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে সমাজের ৩০-৪০ শতাংশ অপরাধ কমানো সম্ভব। একই সঙ্গে জরুরি সময়ে সেবাপ্রত্যাশীর ডাকে সাড়া দেওয়ার সময় ২৫-৩০ শতাংশ কমিয়ে আনে। 

 কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন মুখমণ্ডল শনাক্তকরণ (ফেইস রিকগনিশন) প্রযুক্তি সন্দেহভাজন অপরাধীকে চিহ্নিত ও তার গতিবিধি লক্ষ করতে সক্ষম। একই সঙ্গে এই প্রযুক্তি নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধান, আত্মগোপনে থাকা অপরাধীকে খুঁজে বের করা এবং জনসমাগমে মানুষের নিরাপত্তায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের নিউ অর্লিপ্স শহরের পুলিশ অপরাধী, গাড়ি ও স্থান শনাক্ত করতে এআই প্রযুক্তির ব্যবহার করে। রাশিয়া ও চায়নাতেও এই প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত।
 
স্মার্ট বাংলাদেশের পাশাপাশি স্মার্ট সিটির বিষয়টিও এখন বহুল আলোচিত হয়ে উঠেছে। স্মার্ট সিটি নাগরিকদের দ্রুত সেবা প্রদান যেমন নিশ্চিত করবে, তেমনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহায়তা করবে। স্মার্ট সিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংবলিত স্মার্ট পুলিশিং অপরাধী শনাক্ত-চিহ্নিতকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। অপরাধের ঘটনাস্থল ও অপরাধী দ্রুত শনাক্ত করা যাবে। পৃথিবীর উন্নত দেশের শহরগুলোতে সিসিটিভি বসিয়ে নিরাপত্তাবলয় তৈরি করা হয়। সন্দিগ্ধ বা কোনো অপরাধী অথবা অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তিকে ইন্টেলিজেন্ট ক্যামেরার সাহায্যে সহজেই শনাক্ত করতে পারে। আর এর পেছনে কাজ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং অটোমেটেড সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন। ২৪/৭ মনিটরিংয়ের ফলে অপরাধীদের নির্বিঘ্ন চলাচল অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব এবং অপরাধ সংঘটনের মাত্রা কমে যায়। এই নিরবচ্ছিন্ন মনিটরিং ব্যবস্থায় একটা প্রতিরোধমূলক প্রভাব থাকে। অপরাধী যখন জানে যে অপরাধ করে পার পাবে না, তখন এমনিতেই অপরাধের হার কমে যায়। 

নিরাপদ ও উন্নত শহর বাস্তবায়নে স্মার্ট পুলিশিংয়ের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থাকে স্বয়ংক্রিয়, গতিশীল, নির্ভুল, নিরাপদ ও জনবান্ধব করার লক্ষ্যে বিশ্ব্যব্যাপী নানান পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হচ্ছে। দি এআই গ্লোবাল সার্ভিল্যান্সের (এআইজিএস) ২০১৯-এর তথ্যমতে ৫৬টি দেশ ইতিমধ্যে নিরাপদ শহর গড়ার লক্ষ্যে বিভিন্নভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার শুরু করেছে। এআই প্রযুক্তির সাহায্যে শহরের রাস্তায় চলমান সব গাড়ির তথ্য সংগ্রহ, ট্রাফিক ফ্লো সিমুলেশন, যানজটের পরিমাণ ও রুট ট্র্যাকিং পর্যালোচনার মাধ্যমে একটি স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা সম্ভব, যার ফলে জনসাধারণের যানজটের ভোগান্তি হ্রাস এবং সময় ও অর্থের সাশ্রয় হবে। একই সঙ্গে বেপরোয়াভাবে গাড়ি চলাচল, ফিটনেসবিহীন গাড়ি শনাক্তকরণ, যত্রতত্র পার্কিং, খেয়ালখুশিমতো রাস্তা পারাপারসহ সব অসংলগ্ন ও আইনবহির্ভূত কার্যক্রম রোধ করা সম্ভব হবে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে শহরের বাস্তবিক তথ্যের ওপর একটি সুবৃহৎ ডেটা সেট তৈরি করার মাধ্যমে ভবিষ্যমুখী সিদ্ধান্ত গ্রহণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করবে। প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভার্চুয়াল কার্যক্রম ও নির্ভরতা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। যেহেতু সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকি খুবই সংবেদনশীল তুলনামূলক নতুন, তাই এই অপরাধ দমনে, প্রতিকারে ও জনসচেতনতায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খুবই কার্যকর ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। এআই প্রযুক্তি খুব দ্রুত অসংগতি শনাক্ত করতে এবং ত্বরিত নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করে সম্ভাব্য ক্ষতি প্রতিহত করতে সক্ষম। এই প্রো-অ্যাকটিভ ব্যবস্থাপনা দেশের ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহের তথ্য সুরক্ষিত রাখতে স্বয়ংক্রিয় পাহারাদার হিসেবে কাজ করে। সাইবার সিকিউরিটিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার স্মার্ট পুলিশিং বাস্তবায়নে কাজের ব্যাপকতা ও উপযোগিতায় একে অপরের পরিপূরক। 

অধিকন্তু, স্মার্ট পুলিশিং বাস্তবায়নে কাজের ব্যাপকতা ও প্রয়োজনীয়তার নিরিখে সুষ্ঠু মানবসম্পদ ও সম্পদ বরাদ্দ (রিসোর্স অ্যালোকেশন) একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ক্ষেত্রে পেট্রল রুটস অপটিমাইজেশন, লজিস্টিকস ব্যবস্থাপনা ও মাঠ প্রশাসন ব্যবস্থাপনায় এআই অ্য্যালগোরিদম ডেটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে ভবিষ্যমুখী সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। এটি শুধু সেবা প্রদানে গতিশীলতাই আনে না, বরং একই সঙ্গে সেবার মানোন্নয়ন ও জবাবদিহি সুনিশ্চিত করে। ২০১৫ সালের দিকে ৮১ শতাংশ ব্রাজিলিয়ান কোনো না কোনোভাবে হত্যার শিকার হওয়ার আশঙ্কা করতেন। পরবর্তী সময়ে রিও ডি জেনেরিওর পুলিশ হত্যার ঘটনা ও হুমকি পর্যালোচনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নেয় এবং উক্ত অপরাধের মাত্রা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়। 

আমাদের দেশের বিদ্যমান পুলিশিং ব্যবস্থাপনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ বিশ্বের সব জনবহুল দেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় এক অনন্য উদাহরণ স্থাপন করবে। স্বয়ংক্রিয় ও দ্রুত শনাক্তকরণ, সাড়াদান ও প্রতিকারের এই সক্ষমতা সামাজিকভাবে অপরাধ দমন ও বিস্তার রোধে সাহায্য করবে। একই সঙ্গে ডেটা ড্রিভেন পর্যালোচনার মাধ্যমে এআই প্রদত্ত ভবিষ্যমুখী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের মাধ্যমে সামাজিকভাবে অপরাধপ্রবণতা কমে আসবে, যা একটি সুষ্ঠু, সুন্দর ও নিরাপদ সমাজব্যবস্থার দিকে আমাদের নিয়ে যাবে। 

বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশ শতভাগ না হলেও বহুলাংশেই ডিজিটাল ও আধুনিক হয়ে উঠেছে। দেশের থানাগুলোকে সংযুক্ত করা হয়েছে সর্বাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ও ডেটাবেইসের আওতায়। অপরাধ তদন্ত, ময়নাতদন্ত, অপরাধী শনাক্তকরণেও ব্যবহৃত হচ্ছে ডিএনএ-ফরেনসিক বিশ্লেষণসহ আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। স্বল্প সময়ে অপরাধীরা ধরাও পড়ছে। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনের জন্যই পুলিশ বাহিনী। সেই প্রেক্ষাপটে দেশের পুলিশ বাহিনী সর্বদাই আইনের রক্ষকের ভূমিকায় জনবান্ধব হিসেবে অবতীর্ণ হচ্ছে। 

মোটকথা, অপরাধ করে পার পাবে না কেউ পুলিশের হাত থেকে, তা সে যে ধরনের অপরাধই হোক না কেন। তবে এসবের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের জন্য থাকতে হবে তথ্যপ্রযুক্তির সর্বাধিক ব্যবহার, পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা, সিসি ক্যামেরা, দক্ষ জনবল, স্ট্রাইকিং ফোর্স, অত্যাধুনিক যানবাহন, ট্যাকটিক্যাল বেল্ট, আনুষঙ্গিক সরঞ্জামসহ অত্যাধুনিক হেলিকপ্টার—এ সবই যুক্ত করতে হবে পুলিশ বাহিনীতে। 

স্মার্ট বাংলাদেশে স্মার্ট পুলিশিং হবে একটি অনিবার্য বাস্তবতা। উৎপাদন, প্রস্তুতকরণ, বিপণন থেকে শুরু করে সেবা প্রদান—সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলবে কম্পিউটারাইজড পদ্ধতি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে। পরিবর্তিত এই প্রেক্ষাপটে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষা, অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণে স্মার্ট পুলিশিং হবে একমাত্র নিয়ামক। এই বাস্তবতা সামনে রেখে একটি আধুনিক, দক্ষ, প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট পুলিশ গঠনে বাংলাদেশ পুলিশ এগিয়ে যাচ্ছে। নিয়োগ থেকে শুরু করে প্রশিক্ষণ, পদায়ন ও পদোন্নতিতে গুণগত পরিবর্তন আনা হয়েছে। দক্ষতা বৃদ্ধি এবং বিষয়ভিত্তিক দক্ষতার ওপরও বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। তদুপরি আধুনিক প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং বাহিনীর সদস্যদের অধিকতর প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে। স্মার্ট বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় স্মার্ট পুলিশ ও স্মার্ট পুলিশিং ব্যবস্থাপনা প্রস্তুতি গ্রহণের এখনই সময়। আমরা সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরিত হবে। আর সেই সঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশও হবে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর একটি আধুনিক স্মার্ট পুলিশ। 

লেখক: পুলিশ সুপার, হবিগঞ্জ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ওসমান হাদিকে হত্যাচেষ্টায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের মালিক আটক

রাজধানীতে অপরাধ: ১৪ ভাগ করে মিরপুর নিয়ন্ত্রণ করছে চার শীর্ষ সন্ত্রাসী

হাদিকে হত্যাচেষ্টা: সন্দেহভাজন ফয়সালের ব্যাংক হিসাব জব্দ

আজকের রাশিফল: প্রাক্তন ফোন করবে ও পুরোনো পাওনা টাকার কথা স্মরণ হবে, তবে পরিণতি একই

বকশীগঞ্জের ‘বটগাছ’খ্যাত বিএনপি নেতা আব্দুর রউফ তালুকদারের ইসলামী আন্দোলনে যোগদান

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

বুদ্ধিজীবী দিবস যেন ভুলে না যাই

শহীদ বুদ্বিজীবী হত্যাকারীদের বিচারভিন্ন কোনো পথ নেই—শুধু ন্যায্যতার কারণে নয়, শুধু মানবিকতার কারণেও নয়, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মার শান্তির জন্য, শহীদ-সন্তানদের অন্তরের বিচারের দাবি মেটানোর জন্য, জাতি হিসেবে আমাদের দায়মুক্তির জন্য।

সেলিম জাহান 
আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০: ৫৭
বুদ্ধিজীবী দিবস যেন ভুলে না যাই

আজ ১৪ ডিসেম্বর—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৫৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের—শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের, গুণী শিল্পীদের, খ্যাতনামা সাংবাদিকদের, প্রথিতযশা কবি-লেখকদের। এঁদের হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকেরা আর তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল তাদের দোসর সহযোগীরা। পরে জানা গেছে, ১৯৭১-এর ডিসেম্বরের কোনো এক সময়ে ঢাকা সেনানিবাসে গোপন বৈঠক বসেছিল প্রাদেশিক সরকারের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে আলবদর-আলশামস বাহিনীর কেন্দ্রীয় অধিনায়কদের। রাও ফরমান আলীর হাতে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা—এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের বিশেষ বিশেষ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নামের তালিকা, যেটি তিনি নিজে তৈরি করেছিলেন আট মাস আগে, একাত্তরের এপ্রিল মাসে। কী ভয়ংকর মানুষ ছিলেন রাও ফরমান আলী! কতখানি ভেবে রেখেছিলেন তিনি—কেমন করে বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করবে! জানতেন তিনি, বাঙালি জাতির বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করলে এ জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া যাবে। ভাবা যায়, এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই তিনি তালিকাটি তৈরি করেছিলেন বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা হিসেবে, যার বাস্তবায়নের দায়িত্ব তিনি তুলে দিয়েছিলেন আলবদর ও আলশামসের অধিনায়কদের হাতে।

পরবর্তী সময়ে রাও ফরমান আলীর ডায়েরি থেকে সেই তালিকা উদ্ধার করা হয়েছিল। মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যকার অনন্যসাধারণ একরাশ নাম সেখানে। ঠান্ডা মাথায় নীলনকশা তৈরি করা হয়েছিল। খুঁটিনাটি কিছুই ফরমান আলীর চিন্তা এড়ায়নি। তাই কোন শিক্ষক কোন বিভাগের, সেটাই শুধু তিনি লিখে রাখেননি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় তাঁদের বাড়ির ঠিকানাও লিখে রেখেছিলেন। জনান্তিকে শুনেছি যে রাও ফরমান আলীর কন্যা শাহীন ফরমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল, পড়ত মনোবিজ্ঞান বিভাগে। আমাদেরই সহপাঠী ছিল সে। কন্যার শিক্ষকদের হত্যা করতে রাও ফরমান আলী ছিলেন সম্পূর্ণ নির্বিকার। আজ এটাও ইতিহাসের অংশ যে এ তালিকার বাইরে এবং সে দিনেরও আগে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছিল। শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে তুলে নেওয়া হয়েছিল ১০ ডিসেম্বরে। রক্তক্ষরা সেসব কাহিনি লিপিবদ্ধ হয়েছে, যা আমাদের ইতিহাসের অংশ। নীলনকশা থেকে দেখা যায়, সে তালিকায় নাম ছিল প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক আহসানুল হক, অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়া, অধ্যাপক সাদ’উদ্দীনের মতো শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের। ভাগ্যক্রমে তাঁরা বেঁচে গেছেন।

তারপরের সব ঘটনা এখন ইতিহাস। যে শয়তানেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তুলে নিয়েছিল, তাদের অনেকেই এই বরেণ্য শিক্ষকদের শিক্ষার্থী ছিল। বিজয়ের একেবারে অন্তিম সীমায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে যারা এঁদের তুলে নিয়ে এসেছিল, তারা কিন্তু ভিনদেশি সৈনিক নয়, এ দেশেরই মানুষ। তাদের হাত কাঁপেনি এই সোনার মানুষদের চোখ বেঁধে দিতে, ঠোঁট কাঁপেনি সেই মিথ্যা আশ্বাস দিতে, ‘আবার ফিরিয়ে দিয়ে যাব’, বুক কাঁপেনি এই নরম মনের মানুষদের আঘাত করতে। না, তাঁরা ফেরেননি, সে দিনও না, কোনো দিনও না আজতক। বধ্যভূমিই হয়েছে তাঁদের শেষ শয‍্যা।

পারিবারিক সূত্রে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর অপহরণের কথা আমি শুনেছি। এবং এ-ও শুনেছি যে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পরে রাও ফরমান আলীর সঙ্গে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর পরিবারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল। অসম্ভব আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি আর ফেরেননি। সে ভয়াবহ দিনের কথা নানাভাবে শুনেছি। সেন্ট্রাল রোডে পৈতৃক নিবাস ‘দারুল আফিয়াতে’ দুপুরবেলা স্নান সেরে চুল আঁচড়াচ্ছিলেন তিনি। তাঁর মা টেবিলে ভাত বেড়ে রেখেছিলেন। তখনই তাঁকে তুলে নেওয়া হয়। যে তুলে নিতে এসেছিল, সে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীরই ছাত্র। শুনেছি, বাড়ির লোক আপত্তি করলে সেই লোকটি জবাব দিয়েছিল, ‘এই কিছুক্ষণের মধ্যেই স্যারকে নিয়ে আসব।’ না, আর তিনি ফিরে আসেননি। বেড়ে রাখা ভাত সন্তান খেতে পারেনি বলে মুনীর চৌধুরীর মা আজীবন একটি দুঃখ হৃদয়ে বয়ে বেড়িয়েছেন। শহীদ মুনীর চৌধুরী ১২ ডিসেম্বরের দিকে তাঁর অগ্রজ প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে ফোন করেছিলেন। ফোন ছেড়ে দেওয়ার আগে তাঁর শেষ কথা ছিল, ‘স্বাধীনতা তো আমাদের দোরগোড়ায় এসে গেল, তাই না?’ তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী অব্যর্থ ছিল, কিন্তু তিনি সে স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি।

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আমার তিন দল মানুষের কথা বড় মনে হয়। যাঁদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তাঁদের কথা—বড় বেদনার সঙ্গে। সেই সব শহীদের সন্তানদের, যাঁদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে, তাঁদের কথা—বড় মমতার সঙ্গে এবং সেইসব হন্তারকের কথা—তীব্র ঘৃণার সঙ্গে, যারা এমন পাশবিক কাজ করে আজও বহাল তবিয়তে আছে। আমার প্রায়ই মনে হয়, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমি নির্মমভাবে বঞ্চিত হয়ে পড়েছি। ভাবতেই পারি না যে আমার প্রাণপ্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হিরণ্ময় কিছু মানুষকে আর কোনো দিন দেখতে পাব না, বহু প্রিয় লেখকের নতুন লেখা আর পড়তে পারব না, অনেক সংগীতশিল্পীর কণ্ঠ আর সামনাসামনি শুনতে পারব না। আমরা অনেকেই এইসব স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষদের ঠিক চিনতে পারিনি, পাকিস্তানিরা কিন্তু ঠিকই পেরেছিল। বাংলাদেশের সৃষ্টশীলতা আর সৃজনশীলতার ভিত্তি গুঁড়িয়ে দিতে, আমাদের দেশের শিক্ষা ও শিল্প-সাহিত্যকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যই তারা বেছে নিয়েছিল এই অনন্যসাধারণ মানুষদের। মানুষ চিনতে ওরা ভুল করেনি।

অনেকেই জিজ্ঞেস করেন, লাখ লাখ নিহত মানুষের মধ্যে কেন বারবার শুধু শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কথা উঠে আসে। আমার মনে হয়, এর উত্তর দুটো—একটি প্রত্যক্ষ আর অন্যটি পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ কারণটি হচ্ছে, এ মানুষগুলো আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির জগতের অনন্য কিছু মানুষ ছিলেন; যাঁদের স্বপ্নদৃষ্টি, দিক্-দর্শন, চিন্তাভাবনা, শিক্ষা ও পরামর্শ আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে প্রতিনিয়ত। তাই আমাদের হৃদয়ে তাঁদের জন্য বিশেষ স্থান আছে। পরোক্ষ কারণটি হচ্ছে, আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরা বহু শহীদের স্মৃতি একসঙ্গে হৃদয়ে ধারণ করতে পারে না। তখন আমরা প্রতীক খুঁজে নিই। ১৪ ডিসেম্বরের শহীদ বুদ্ধিজীবীরা আমাদের সেই প্রতীক। এই প্রতীকের মাঝখান দিয়েই আমরা পৌঁছে যাই অন্য সব জানা-অজানা শহীদদের কাছে।

একাত্তর-উত্তর সময়ে শিক্ষক হিসেবে আমার সুবর্ণ সুযোগ ঘটেছিল উপর্যুক্ত শহীদদের অনেকেরই সন্তানদের সঙ্গে—বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে যাদের শিক্ষার্থী হিসেবে পাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে, তাদের মধ্যে আমার হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান আছে ১৯৭১-এর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানদের জন্য। আশির দশকে এদের অনেককেই আমার শ্রেণিকক্ষে আমি পেয়েছি। এ দশকের মাঝামাঝি সময়ে অর্থনীতি বিভাগে পড়াতে গিয়ে দেখি যে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী হিসেবে বসে আছে শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর পুত্রদ্বয় তানভীর হায়দার চৌধুরী (শোভন) ও প্রয়াত সুমন হায়দার চৌধুরী (সুমন), শহীদ চিকিৎসক মোহাম্মদ মর্তুজার কন্যা দ্যুতি অরণি (মিতি), শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের পুত্র তৌহীদ রেজা নূর (তৌহীদ)। এ আমার পরম প্রাপ্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শততম বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে আমি যখন ১৯৭১-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শিক্ষকদের ও শহীদ চিকিৎসক মোহাম্মদ মর্তুজার স্মৃতিচারণা করছিলাম, তখন শোভন, সুমন, মিতি ও তৌহীদের চেহারাটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। ওরা হয়তো জানেও না, আশির দশকে শ্রেণিকক্ষে ঢুকে ওদের দিকে তাকালে আমার মনটা হু হু করে উঠত। বহুবার এমন হয়েছে যে আমি ওদের মুখের দিকে তাকাতে পারিনি। কোনো দিন হয়তো বলা হয়নি, আজ ওদের এই কথাটুকুই শুধু বলে যাই—আর কিছু নয়।

শিক্ষার্থী হিসেবে নয়, কিন্তু অন্যভাবেও কাছে পেয়েছি অন্য শহীদ-সন্তানদের। বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয়তার বৃহত্তর অঙ্গনে কাছাকাছি এসেছি শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর সন্তানত্রয়ের সঙ্গে—আহমেদ মুনীর (ভাষণ), প্রয়াত আশফাক মুনীর (মিশুক) ও আসিফ মুনীরকে (তন্ময়)। স্বল্পকালের জন্য মিশুক আমার সহকর্মীও ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অবয়ব পত্রের (ফেসবুক) মাধ্যমে পরিচিত হয়েছি মাহমুদার সঙ্গে (শহীদ অধ্যাপক সিরাজুল হক খানের সন্তান)। জেনেছি মাহমুদকে—শহীদ অধ্যাপক রাশীদুল হাসানের পুত্র সে। সেই সঙ্গে এটাও মনে হয়েছে, সেদিনের যে শিশু, কিশোর-কিশোরীরা পশুশক্তির কাছে তাদের বাবাকে হারিয়েছে, তারা আজ পরিণত বয়সের মানুষ। তাদের মনের পিতৃ হারানোর বেদনা আমরা কেউ বুঝব না। কারণ, সব দুঃখই তো মানুষের ব্যক্তিগত, সব বেদনাই তো তার নিজস্ব। কিন্তু এটা তো বুঝি যে তাদের পিতার হন্তারকদের ‘বিচারের দাবি তাদের মনে নিভৃতে কাঁদে’ অহর্নিশ।

শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের বিচারভিন্ন কোনো পথ নেই—শুধু ন্যায্যতার কারণে নয়, শুধু মানবিকতার কারণেও নয়, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মার শান্তির জন্য, শহীদ-সন্তানদের অন্তরের বিচারের দাবি মেটানোর জন্য, জাতি হিসেবে আমাদের দায়মুক্তির জন্য। সে দায় রাষ্ট্রের, সমাজের ও ব্যক্তি মানুষের। সে দায়ভাগে আমরা সবাই সমান অংশীদার। জাতি হিসেবে আমরা যেন সে দায় ভুলে না যাই। সে আমাদেরই দায় এবং তার মোচনেই আমাদের মুক্তি।

লেখক: অর্থনীতিবিদ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ওসমান হাদিকে হত্যাচেষ্টায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের মালিক আটক

রাজধানীতে অপরাধ: ১৪ ভাগ করে মিরপুর নিয়ন্ত্রণ করছে চার শীর্ষ সন্ত্রাসী

হাদিকে হত্যাচেষ্টা: সন্দেহভাজন ফয়সালের ব্যাংক হিসাব জব্দ

আজকের রাশিফল: প্রাক্তন ফোন করবে ও পুরোনো পাওনা টাকার কথা স্মরণ হবে, তবে পরিণতি একই

বকশীগঞ্জের ‘বটগাছ’খ্যাত বিএনপি নেতা আব্দুর রউফ তালুকদারের ইসলামী আন্দোলনে যোগদান

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

উড়োজাহাজগুলোও পরিবেশের ক্ষতি করছে

মৃত্যুঞ্জয় রায় 
আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭: ৪৩
পৃথিবীতে প্রধান ১০টি কার্বন নিঃসরণকারীর মধ্যে উড়োজাহাজশিল্প একটি। ছবি: পিক্সাবে
পৃথিবীতে প্রধান ১০টি কার্বন নিঃসরণকারীর মধ্যে উড়োজাহাজশিল্প একটি। ছবি: পিক্সাবে

৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কাতার এয়ারওয়েজের একটি উড়োজাহাজে চড়ে গেলাম ঢাকা থেকে কাতারের দোহা। এরপর আমেরিকান এয়ারলাইনসের একটি বিশাল এয়ারক্রাফটে ৩৮ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে দোহা থেকে উড়াল দিয়েছি যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার উদ্দেশে। লম্বা পথ, ১৪ ঘণ্টা ৫০ মিনিটের একটানা চলা। সেখান থেকে আবার আরেকটি উড়োজাহাজ ধরে শেষ গন্তব্যে পৌঁছানো। যুগপৎ আনন্দ ও বিরক্তিকর সে ভ্রমণ অভিজ্ঞতার মধ্যেই মাথায় মাঝে মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে একটি কথা—এত লম্বা পথে প্রায় ৪০০ মানুষ আর তাদের ব্যাগেজ নিয়ে এই মহাযানকে উড়ান দিয়ে ঘণ্টায় প্রায় সাড়ে ৫০০ মাইল বেগে ছুটে চলতে কী পরিমাণ শক্তি ব্যয় করতে হচ্ছে! আর সে শক্তির জন্য কী পরিমাণ জ্বালানি বয়ে নিতে হচ্ছে, তা পোড়াতেও হচ্ছে।

সব সময় তো আমরা পৃথিবীর বুকে চলা লাখ লাখ গাড়িকে দুষছি জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর অন্যতম প্রধান খলনায়ক হিসেবে, উড়োজাহাজগুলোর কথা কি আমরা কখনো সেভাবে ভাবি? উড়োজাহাজগুলো কি সত্যিই পরিবেশ দূষণ করছে? সরল জবাব হলো, হ্যাঁ, করছে। জলবায়ু পরিবর্তনে উড়োজাহাজগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে বায়ুমণ্ডলে নন-কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসসহ অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করছে। উড়োজাহাজগুলো পরিবেশের জন্য অবশ্যই ক্ষতিকর ভূমিকা রাখছে। কী পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানি সেসব যান পুড়িয়ে কতটুকু কার্বন নিঃসরণ করছে, তাতে জলবায়ু পরিবর্তনে তার প্রভাব পড়ছে কতটুকু—এসব প্রশ্নও মাথার মধ্যে বারবার ঘুরপাক খেতে লাগল। জানা গেল, উড়োজাহাজগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। বিশ্বব্যাপী মোট কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নির্গমনে প্রায় আড়াই শতাংশ অবদান রয়েছে উড়োজাহাজ চলাচলে, যা মোট জলবায়ু প্রভাব হিসাবে ৪ শতাংশ নিরূপিত হয়েছে।

এখন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বদৌলতে মুহূর্তেই সেসব উত্তর পাওয়া যায়। এমনকি কোন ফ্লাইট এখন আকাশের কোথায় অবস্থান করছে, গন্তব্যে পৌঁছাতে কতটুকু সময় লাগবে, তা-ও মানচিত্রে দেখা যায়। কয়েক দিন আগে এ রকম একটি ফ্লাইট নম্বর দিয়ে একটি অ্যাপসের সাহায্যে অনুসন্ধান করতেই ফ্লাইট চলাচলের যে ছবিটি মোবাইল ফোনের পর্দায় ভেসে উঠল, তা দেখে মনে হলো বিশাল আকাশে আসলে খালি জায়গা কোথায়? সব তো দখল করে ফেলেছে নিত্য চলাচল করা উড়োজাহাজগুলো। জানা গেল, রোজ মানে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় পৃথিবীর আকাশে প্রায় এক লাখ ফ্লাইট ওঠা-নামা করে। রোজ ১৫ থেকে ২০ হাজার উড়োজাহাজ এসব ফ্লাইট পরিচালনা করে, যার মধ্যে রয়েছে যাত্রী ও মালামাল বহন, সামরিক ও ব্যক্তিগত উড়োজাহাজও। যাত্রীবাহী উড়োজাহাজের সংখ্যাই যে সবচেয়ে বেশি, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রতিদিন সারা বিশ্বে প্রায় ১৩ লাখ যাত্রী উড়োজাহাজে চলাচল করে। উড়োজাহাজের এই পরিষেবা দিতে বছরে ৮৫০০ লাখ টনের বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন ঘটছে, ২০৫০ সালে যা আরও অনেক বাড়বে। পৃথিবীতে প্রধান ১০টি কার্বন নিঃসরণকারীর মধ্যে উড়োজাহাজশিল্প একটি।

ভূপৃষ্ঠ থেকে অতি উচ্চতায় থাকায় সেখানকার বায়ুমণ্ডল ভূপৃষ্ঠের চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন বৈশিষ্ট্য বহন করে, সেখানকার বায়ুমণ্ডল ঠান্ডা। উড়োজাহাজে চড়ে তার বাইরের তাপমাত্রা কত, তা-ও মনিটরে দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দেখছি, এয়ারক্রাফটের বাইরে বাতাসের তাপমাত্রা মাইনাস ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরূপ ঠান্ডায় উড়োজাহাজের ইঞ্জিন থেকে যেসব রাসায়নিক দ্রব্য ও গ্যাস নির্গত হচ্ছে, সেগুলো ঘন মেঘের মতো জমে যাচ্ছে। পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে গভীর আকাশে মাঝে মাঝে উড়োজাহাজ চলে যাওয়ার পর আমরা যেসব ঘন সাদা মেঘের মতো সরল রেখা বা দীর্ঘ দাগ দেখি, এগুলো হলো তাই। ইংরেজিতে এগুলোকে বলে কন্ট্রেইল।

ভূপৃষ্ঠ থেকে অতি উচ্চতায় থাকার কারণে সেসব উড়োজাহাজ থেকে যেসব রাসায়নিক দ্রব্য নির্গত হয়, তা এককভাবে কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়ে বরং বেশি দূষণ ও বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঘটায়। বিশেষ করে নাইট্রাস অক্সাইড। উড়োজাহাজ থেকে ছড়িয়ে পড়া এসব জমাটবদ্ধ বাষ্পের রেখাগুলো তাপ আটকে রাখতে পারে। এ সম্পর্কে আমাদের আগে যেসব ধারণা ছিল, বাস্তবে এখন গবেষণা করে তার চেয়ে বেশি প্রভাব দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া উড়োজাহাজ থেকে নির্গত অন্যান্য বায়ুদূষণের মধ্যে রয়েছে জলীয় বাষ্প, স্যুট এবং সালফেটজাতীয় অ্যারোসল। এগুলোও বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে ও ঘন মেঘ গঠন করে। এর কারণে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে যেখানে ওজোনস্তর রয়েছে সেখানেও এর ক্ষতিকর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া আরও বেশ কিছু বিষয় যা এসব উড়োজাহাজ চলাচলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, সেগুলোও পরিবেশদূষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

হাসির কথা হলো, আমরা গবেষণা করে যত বেশি আধুনিক উড়োজাহাজ তৈরি করছি, সেগুলো প্রাচীন উড়োজাহাজের চেয়ে বরং বেশি দূষণ ঘটাচ্ছে। এগুলো যত বেশি উচ্চতা দিয়ে উড়ছে, তত বেশি দীর্ঘস্থায়ী কন্ট্রেইল বা জমাটবদ্ধ ঘন মেঘের রেখা তৈরি করছে, যা তাপ বাড়াচ্ছে। প্রাকৃতিক মেঘের মতোই এসব কন্ট্রেইল বায়ুমণ্ডলে অতিরিক্ত তাপ ধরে রাখে এবং জেট জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে সৃষ্ট কার্বনের চেয়ে জলবায়ু পরিবর্তনে বেশি অবদান রাখে। এ নিয়ে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে এক গবেষণাকাজও করা হয়েছে। সে গবেষণা দলের প্রধান গবেষক ও গবেষণাপত্রের লেখক ড. এডওয়ার্ড গ্রিসপেয়ার্ডট বলেছেন, অনেকে বোঝেন না যে কন্ট্রেইল ও জেট ফুয়েলের কার্বন নির্গমন জলবায়ুকে দ্বিগুণভাবে উষ্ণ করছে।

জেট প্লেনগুলো ওড়ে ৪০ হাজার ফুটের ওপর দিয়ে, আধুনিক প্লেনগুলো ওড়ে ৩৮ থেকে ৪০ হাজার ফুটের মধ্যে এবং প্রাচীন প্লেনগুলো ওড়ে ৩১ থেকে ৩৮ হাজার ফুটের মধ্যে। উঁচুতে থাকা প্লেনগুলো বেশি কন্ট্রেইল তৈরি করে, নিচুতে থাকাগুলো করে কম। সে গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে কন্ট্রেইল পরিবেশের জন্য উড়োজাহাজের কার্বন নির্গমনের চেয়ে দ্বিগুণ ক্ষতিকর, যার কারণে উড়োজাহাজ চলাচলের মোট জলবাযু প্রভাবের প্রায় ৬০ শতাংশ ঘটে। গবেষকেরা দেখিয়েছেন যে, বোয়িং ৭৮৭-৯ ড্রিম লাইনারের মতো আধুনিক উড়োজাহাজের কন্ট্রেইল পুরোনো মডেলের চেয়ে বেশি তৈরি হয়। এই গবেষণায় গবেষকেরা নাসার জিওইএস-আর উপগ্রহ থেকে নেওয়া স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করেছেন, যা উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া উড়োজাহাজগুলোর ৬৪ হাজারের বেশি কন্ট্রেইল ট্র্যাক করতে সাহায্য করেছে।

এ দৃশ্যের বাইরেও রয়েছে আরও এক দৃশ্য। রোজ প্রায় ১৩ লাখ যাত্রীর খাবার থেকে কী পরিমাণ বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে, সেটি কি আমরা কখনো ভেবে দেখেছি? উড়োজাহাজভিত্তিক অন-বোর্ড পরিষেবা, টার্মিনাল ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো নির্মাণ, উড়োজাহাজ শিল্পজনিত বর্জ্য ইত্যাদি কারণেও পরিবেশদূষণ বাড়ছে। এ থেকে দ্রুত নিষ্কৃতি পাওয়ার সহজ কোনো রাস্তা আছে বলে মনে হয় না। কার্বনমুক্ত উড়োজাহাজ চালনা এখনো এক স্বপ্নের ব্যাপার। কেননা, গাড়ির মতো আমরা ইলেকট্রিক উড়োজাহাজ আবিষ্কার করতে পারিনি, সেখানে সৌরশক্তি ব্যবহারের সুযোগও তৈরি হয়নি। কেননা, উড়োজাহাজ চালাতে যে বিপুল পরিমাণ শক্তি লাগে সেটি কখনো ব্যাটারি দিয়ে সম্ভব নয়। উড়োজাহাজের বিকল্প জ্বালানি হিসেবে কেউ কেউ হাইড্রোজেন ব্যবহারের কথা ভাবছেন। কিন্তু জ্বালানি হিসেবে হাইড্রোজেন ব্যবহারের ঝুঁকি আছে অনেক বেশি। এতে দাহ্যতার কারণে হাইড্রোজেন ব্যবহারের ফলে উড়োজাহাজে অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকি রয়েছে। উড়োজাহাজ চালনার জন্য টেকসই জ্বালানি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এগুলো অনেক বেশি ব্যয়বহুল এবং উৎপাদনের জন্য ব্যাপক জমি ও পানিসম্পদের দরকার হয়। এ মুহূর্তে পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষাও দরকার। কাজেই সে লাইনেও যাওয়া ঠিক হবে না।

আশঙ্কার কথা হলো, দিন দিন অন্যান্য পরিবহন খাতের তুলনায় প্রয়োজনেই উড়োজাহাজের চলাচল দ্রুত হারে বাড়ছে। যদি তা কমানো বা নিয়ন্ত্রণের কোনো সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনে বা বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে তার প্রভাবও বাড়বে। গবেষকদের মতে, এখনই ভাবার সময় এসেছে উড়োজাহাজের পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবন, উড়ানে আরও বেশি দক্ষ ও সাশ্রয়ী ব্যবস্থাপনা গ্রহণ, বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার এবং বিমান চলাচলকারী সংস্থাগুলোর কাছ থেকে পরিবেশদূষণের ক্ষতিপূরণ আদায় করে তা পরিবেশ উন্নয়নের কাজে ব্যয় করা।

মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও পরিবেশবিষয়ক লেখক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ওসমান হাদিকে হত্যাচেষ্টায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের মালিক আটক

রাজধানীতে অপরাধ: ১৪ ভাগ করে মিরপুর নিয়ন্ত্রণ করছে চার শীর্ষ সন্ত্রাসী

হাদিকে হত্যাচেষ্টা: সন্দেহভাজন ফয়সালের ব্যাংক হিসাব জব্দ

আজকের রাশিফল: প্রাক্তন ফোন করবে ও পুরোনো পাওনা টাকার কথা স্মরণ হবে, তবে পরিণতি একই

বকশীগঞ্জের ‘বটগাছ’খ্যাত বিএনপি নেতা আব্দুর রউফ তালুকদারের ইসলামী আন্দোলনে যোগদান

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

গুলিবিদ্ধ হাদি ও নির্বাচন

সম্পাদকীয়
আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২: ৫৫
গুলিবিদ্ধ হাদি ও নির্বাচন

এই সম্পাদকীয়টি যখন লেখা হচ্ছে, তখনো ইনকিলাব মঞ্চের নেতা শরিফ ওসমান হাদি সংকটাপন্ন শারীরিক অবস্থায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর ফাঁকে রিকশায় করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাওয়ার সময় তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় মোটরসাইকেলে বসা দুর্বৃত্ত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ-সংক্রান্ত সিসি ক্যামেরা ফুটেজ সবাই দেখেছেন। কে এই আততায়ী, তা নিয়ে পুলিশি তদন্ত চলছে। কেউ কেউ বলছেন, মোটরসাইকেলে থাকা দুই দুর্বৃত্ত ওসমান হাদির সঙ্গে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশও নিয়েছিল।

তফসিল ঘোষণার পরদিন এ রকম এক সহিংসতার ঘটনা ঘটায় অনেকেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছেন। যে উৎসবের নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার, সে নির্বাচনের পথে যাত্রার সময়টা এ রকম ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে উঠল কেন, সে প্রশ্ন উঠেছে। ওসমান হাদির মতো একজন সুপরিচিত নেতার জীবনের নিরাপত্তা নেই, এটা মেনে নেওয়া কঠিন। আমরা এই হত্যাচেষ্টার তীব্র নিন্দা জানাই।

টার্গেট কিলিং নিয়ে কেউ কেউ কথা বলছেন। একজন নেতা বলেছেন, অন্তত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী ৫০ জন নেতা টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হতে পারেন। এ ধরনের তথ্য দেওয়া হলে তার উৎস ও প্রমাণও হাজির করা উচিত। যদি কেউ সে রকম ষড়যন্ত্র করে থাকে, তবে তার মুখোশ উন্মোচন করাও জরুরি।

একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা কঠিন কাজ। কিন্তু সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজগুলো করা হলে এবং যে যার জায়গায় দাঁড়িয়ে দক্ষতার সঙ্গে কাজগুলো পরিচালনা করলে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কি সত্যিই একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করার অনুকূল হয়ে উঠতে পেরেছে—এই প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করে তাদের নৈতিক মনোবল যে জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছে, তাতে তাদের কাছ থেকে সত্যিই কি দক্ষ সেবা পাওয়া সম্ভব? মনোবলহীন একটি বাহিনী কতটা সাহসী পদক্ষেপ রাখতে পারে?

কিছুদিন আগে চট্টগ্রামে বিএনপির একজন সম্ভাব্য প্রার্থীর ওপরও গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। ওসমান হাদির ওপর গুলিবর্ষণের পর বিষয়টিকে আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে হচ্ছে না। নির্বাচনী ময়দানকে বিশৃঙ্খল করে তোলার জন্য শক্তিশালী কোনো মহল কি এসব কাজে মদদ দিচ্ছে? কারা এসব ঘটাচ্ছে, তা নিয়ে নিবিড় তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। কোনো গায়েবি হত্যাকারীর গল্প তৈরি করে সত্যিকারের খুনিদের আড়াল করার চেষ্টা হলে এই সহিংসতা আরও বাড়বে। সত্যিকারের অপরাধীরা ধরা পড়লেই কেবল তাদের লক্ষ্য, তাদের পেছনে কারা সক্রিয় ইত্যাদি বেরিয়ে আসবে। আর সেই তথ্য যাচাই-বাছাই করে কীভাবে এদের বিরুদ্ধে লড়াই করা যায়, সে কৌশল নিয়ে ভাবতে পারবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নির্বাচনী প্রচারণার সময় প্রার্থীকে ঘিরে তাঁর সমর্থকদেরও একটা নিরাপত্তাবলয় সৃষ্টি করতে হবে। যেকোনো ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে বলিষ্ঠভাবে—এ ছাড়া নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটবে না।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ওসমান হাদিকে হত্যাচেষ্টায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের মালিক আটক

রাজধানীতে অপরাধ: ১৪ ভাগ করে মিরপুর নিয়ন্ত্রণ করছে চার শীর্ষ সন্ত্রাসী

হাদিকে হত্যাচেষ্টা: সন্দেহভাজন ফয়সালের ব্যাংক হিসাব জব্দ

আজকের রাশিফল: প্রাক্তন ফোন করবে ও পুরোনো পাওনা টাকার কথা স্মরণ হবে, তবে পরিণতি একই

বকশীগঞ্জের ‘বটগাছ’খ্যাত বিএনপি নেতা আব্দুর রউফ তালুকদারের ইসলামী আন্দোলনে যোগদান

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

নির্বাচনের পথে দেশ

সম্পাদকীয়
নির্বাচনের পথে দেশ

অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলো। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের পথরেখা বেঁধে দিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তফসিল নিয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে। প্রতিটি দলই এখন নির্বাচনী প্রস্তুতির জন্য উঠেপড়ে লাগবে। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত নির্বাচন একটি সুস্থির সমাজব্যবস্থার দিকে দেশকে পরিচালিত করবে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

এরই মধ্যে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে গেছে। তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সদ্য পদত্যাগকারী দুই ছাত্র উপদেষ্টার পদত্যাগ কার্যকর হয়েছে। এই দুই উপদেষ্টার নির্বাচনে অংশ নেওয়া না-নেওয়া নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বিদেশি রাষ্ট্রদূতদেরও সক্রিয় দেখা গেছে নানাভাবে। বিভিন্ন দলের নেতাদের কাছে তাঁরা যাচ্ছেন, কথা বলছেন। এরই মধ্যে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে বেশ কিছু সংকট তৈরি হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কেন দেশে ফিরতে পারছেন না, তা নিয়ে জেগেছে প্রশ্ন। যে চাপের কথা তারেক রহমান নিজেই বলেছেন, সেই চাপ দেশের অভ্যন্তরের নাকি বিদেশি কোনো শক্তির তরফ থেকে—সে কথাও আলোচিত হয়েছে।

২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জোট সরকারের বিরুদ্ধে অর্থ লোপাট, দুর্নীতি, হাওয়া ভবনের মাধ্যমে প্যারালাল সরকার চালানোর অভিযোগসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। এদিকে ডাকসু নেতাদের কিছু কথা, কিছু কর্মকাণ্ড নিয়েও প্রশ্ন জেগেছে মানুষের মনে। তফসিল ঘোষণার দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীল দলের এক নেতাকে একজন ডাকসু নেতার নেতৃত্বে হেনস্তা করার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে এই ন্যক্কারজনক ঘটনা। সবচেয়ে শঙ্কার বিষয় হলো, দেশে-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের মূল নায়কদের নিয়ে কটাক্ষ করে কথা বলার প্রবণতা বেড়েছে। যাঁরা বলছেন, তাঁরা দেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যমকেও ব্যবহার করছেন। অজস্র মিথ্যার বেসাতি গড়ে তোলা হচ্ছে, অথচ তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারকে কোনো দৃষ্টান্তমূলক অবস্থান নিতে দেখা যায়নি।

আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনব্যবস্থা কলুষিত করা, দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, প্রতিষ্ঠান ভেঙে ফেলাসহ বহু অভিযোগ ছিল। যে রাজনৈতিক দলগুলো নির্যাতিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ আমলে, তারাই ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর যে রূপে আবির্ভূত হয়েছে, তা মোটেই জনগণের প্রত্যাশিত রূপ নয়। সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত বিভিন্ন দলের দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, পদ-বাণিজ্য, খুনোখুনির খবর ভেসে আসছে। যে ছাত্র নেতৃত্বের ওপর ভরসা রাখার কথা ভেবেছে তরুণ প্রজন্ম, সেই তরুণেরাও আজ দ্বিধান্বিত। এ রকম এক অস্থির সময়ে আসছে নির্বাচন। আশা থাকবে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, ব্যবসায়ীদের অবাধে কাজের সুযোগ, শিক্ষাঙ্গনে শৃঙ্খলা, রাজনৈতিক দলের চাঁদাবাজি বন্ধ, সাধারণ মানুষের জীবন ও কাজের নিরাপত্তাসহ কল্যাণকর কাজগুলো করবে নির্বাচিত সরকার। তবেই অস্থিরতা থেকে বের হওয়ার একটা উপায় খুঁজে পাওয়া যাবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ওসমান হাদিকে হত্যাচেষ্টায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের মালিক আটক

রাজধানীতে অপরাধ: ১৪ ভাগ করে মিরপুর নিয়ন্ত্রণ করছে চার শীর্ষ সন্ত্রাসী

হাদিকে হত্যাচেষ্টা: সন্দেহভাজন ফয়সালের ব্যাংক হিসাব জব্দ

আজকের রাশিফল: প্রাক্তন ফোন করবে ও পুরোনো পাওনা টাকার কথা স্মরণ হবে, তবে পরিণতি একই

বকশীগঞ্জের ‘বটগাছ’খ্যাত বিএনপি নেতা আব্দুর রউফ তালুকদারের ইসলামী আন্দোলনে যোগদান

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত