Ajker Patrika

প্লাস্টিক দূষণের হোক অবসান

মৃত্যুঞ্জয় রায় 
প্লাস্টিক দূষণ কমাতে বা শেষ করতে হলে পর্যায়ক্রমে প্লাস্টিকের উৎপাদন কমাতে হবে। ছবি: এএফপি
প্লাস্টিক দূষণ কমাতে বা শেষ করতে হলে পর্যায়ক্রমে প্লাস্টিকের উৎপাদন কমাতে হবে। ছবি: এএফপি

বিশ্বে পরিবেশদূষণকারী হিসেবে ১৫টি প্রধান দূষক চিহ্নিত করা হয়েছে। পয়লা নম্বরে আছে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার। বিশ্বব্যাপী পরিবেশদূষণে ৫ নম্বর দূষণকারী এখন প্লাস্টিক। দূষণের মাত্রা অনুযায়ী এই অবস্থান নির্ধারিত হয়েছে। বিগত পাঁচ দশকে প্লাস্টিকের ব্যবহার রাতারাতি বেড়ে এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে তা এখন আমাদের গোটা পৃথিবীর পরিবেশ ও জীবের টিকে থাকার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের রোজ লড়াই করতে হচ্ছে প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে। প্লাস্টিক প্রতিমুহূর্তে ক্ষতি করে চলেছে আমাদের জীবন, পরিবেশ ও পৃথিবীর। এ জন্য এ বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে প্লাস্টিক দূষণ নিরসনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে।

প্লাস্টিকের ব্যবহার সারা পৃথিবীতে দিন দিন বেড়ে চলেছে, যা আমাদের ত্রিমুখী সংকটকে বাড়িয়ে দিয়েছে। এ সংকটগুলো হলো জলবায়ুগত সংকট, প্রকৃতিগত সংকট ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি। বিশ্বে প্রায় ৫ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের জন্য দায়ী প্লাস্টিক। প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ১৪ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য সাগরে পড়ছে। এর ব্যবহার কমানোর যদি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া না হয় তাহলে ২০৪০ সালে ২৯ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য সাগরের পানিতে গিয়ে পড়বে। এতে জলজ জীবের বাস্তুতন্ত্র বদলে যাবে। আবার বিভিন্ন পয়োনালার মাধ্যমে ও প্লাস্টিক বর্জ্যসহ মাটি ভরাটের ফলে মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা মাটিতে জমা হচ্ছে। এতে মাটিতে থাকা জীবের বাস্তুতন্ত্র বদলে যাচ্ছে। এরূপ মাটিতে ফসল চাষের ফলে সেসব ফসল তথা খাদ্যের মাধ্যমে তা আবার আমাদের দেহে প্রবেশ করছে। বিভিন্ন প্যাকেটজাত খাদ্যদ্রব্য প্লাস্টিকের মোড়কে বিক্রি করায় সেসব খাদ্যও মাইক্রোপ্লাস্টিক দ্বারা দূষিত হচ্ছে। বৃষ্টি ও পাহাড়ের বরফেও প্লাস্টিক কণার অস্তিত্ব মিলেছে।

রোজ কানাডায় এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, একটি টি-ব্যাগ ব্যবহার করে এক কাপ চা পান করলে তার মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করে ১১ দশমিক ৬ বিলিয়ন মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা! এসব কণা দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে। এমনকি তা রক্তনালি ও মস্তিষ্কে পর্যন্ত এখন পৌঁছে গেছে। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে দেহের স্বাভাবিক জৈবনিক ও শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। প্লাস্টিক দূষণ এখন বিশ্বব্যাপী এক ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, এতে পরিবেশ ও সমাজের বার্ষিক আর্থিক ক্ষতি নিরূপিত হয়েছে ৩০০ থেকে ৬০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

উনিশ শতকেল ষাটের দশক থেকে পৃথিবীতে প্লাস্টিকের ব্যবহার শুরু হয়। কিন্তু প্লাস্টিক ব্যবহারের বিস্ফোরণটা আসলে ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, আমাদের একটি বেলাও প্লাস্টিক ছাড়া জীবন চলে না। যে ল্যাপটপে বসে এ লেখাটা লিখছি, সেটি না হলে তো এ লেখাটাই লিখতে পারতাম না। ব্যবহারের সময় ঘটে একধরনের দূষণ, ব্যবহার শেষে যখন সেগুলো বর্জ্যে পরিণত হয়, তখন সেখান থেকে শুরু হয় আরেক ধরনের দীর্ঘস্থায়ী দূষণ। পরিবেশে ব্যাপ্ত আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিকের এসব কণা খালি চোখে দেখা যায় না। অদৃশ্যভাবে এগুলো আমাদের পরিবেশ ও জীবজগতের অবিরামভাবে ক্ষতি করে চলেছে। বিশেষ করে জলজ জীবের ক্ষতি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।

জলজ জীবগুলো মানুষের অন্যতম প্রধান খাদ্য। তাই সেসব জীবের মাধ্যমে তা আমাদের দেহে ঢুকছে, ঢুকছে পানির মাধ্যমে এমনকি রান্নাঘরে এসে ঢুকছে লবণের মাধ্যমে। বাংলাদেশে সাগরের পানি থেকে প্রস্তুত প্রতি কেজি লবণে পাওয়া গেছে ২৬৭৬টি মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা। আর এক লিটার পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বোতলজাত মিনারেল ওয়াটারে পাওয়া গেছে ২৩ হাজার ৫৯৪টি মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা। পরিসংখ্যান বলছে, পৃথিবীতে কমপক্ষে ২৬৭ প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণী মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণে তীব্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে মাছ, কচ্ছপ, পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণী। গবেষকেরা হিসাব করে দেখেছেন, নানাভাবে নানা মাধ্যম থেকে একজন মানুষ বছরে ৩৯ হাজার থেকে ৫২ হাজার মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা গ্রহণ করছে।

মাইক্রোপ্লাস্টিক তথা প্লাস্টিকের অণুকণা এখন কোথায় নেই? পরিবেশের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে এখন মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা না আছে। মাইক্রোপ্লাস্টিক আছে বাতাসে, পানিতে, মাটিতে, খাবারে এমনকি পানীয় বোতলের ভেতরের পানিতেও। নদী থেকে সাগরেও ছড়িয়ে পড়েছে। আর্কটিক সাগরেও এর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। বর্জ্য শোধনাগারের ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টগুলোও এখন একে শোধন করতে পারছে না। মহামারি রোগের জীবাণুর মতো মাইক্রোপ্লাস্টিক এখন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ প্লাস্টিক আদৌ ব্যবহার না করেও এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। বাতাসে থাকা অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মাইক্রো ও ন্যানো প্লাস্টিক কণা শ্বাস গ্রহণের মাধ্যমে আমাদের দেহে ঢুকছে, খাবার পানির মাধ্যমেও ঢুকছে। দেহে প্রবেশের পর সেগুলো সরাসরি চলে যাচ্ছে যকৃৎ, প্লীহা, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, জননাঙ্গ, বৃক্ক এমনকি মস্তিষ্কেও। এসব কণা রক্তপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করছে। মানবস্বাস্থ্যের ওপর এর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়ছে।

গবেষকেরা দেখেছেন যে পঞ্চাশের দশকে বিশ্বে প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদনের বার্ষিক গড় পরিমাণ যেখানে ছিল ২ মিলিয়ন টন, সেখানে ২০১৫ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৪১৯ মিলিয়ন টন, ২০২০ সালে ছিল ৪৩৫ মিলিয়ন টন। ধারণা করা হচ্ছে, একে যদি থামানো না যায় তাহলে ২০৪০ সালে তা গিয়ে দাঁড়াবে ৬০০ মিলিয়ন টনে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের গবেষকেরা দেখেছেন যে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের প্রায় ৯১ শতাংশ পুনঃ চক্রায়ন বা রিসাইকেল করা হয় না। সেগুলো বর্জ্য আকারে আমাদের বিভিন্ন স্থানে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে, যা সেসব স্থানে জমছে। এসব প্লাস্টিক বর্জ্য স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নিঃশেষিত হতে প্রায় ৪০০ বছর সময় লাগে। তাই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এর দীর্ঘমেয়াদি কুফল আমাদের ভোগ করতে হচ্ছে।

বর্তমানে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ যেভাবে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে পরিবেশ থেকে তা নিষ্কাশন করা কঠিন। তাই প্লাস্টিক দূষণ কমানোর জন্য ভিন্ন কৌশল খুঁজতে হবে। প্রয়োজনে পচনশীল অনবায়নযোগ্য বায়োপ্লাস্টিক ব্যবহারের দিকে ঝুঁকতে হবে। আইনের দ্বারা প্লাস্টিক ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত, সীমিত বা বন্ধ করার পদক্ষেপ নিতে হবে। এ দেশে ইতিমধ্যে একবার-ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বোতল ও পাত্র ব্যবহার বন্ধের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বিশ্ব পরিবেশ দিবসে আয়োজকেরা এবার আলো ফেলেছে পাঁচটি ‘আর’ (R)-এর ওপর—রিফিউজ, রিডিউস, রিইউজ, রিসাইকেল এবং রিথিংক। অর্থাৎ প্লাস্টিক সামগ্রী ব্যবহার প্রথমে বর্জন করতে হবে। না পারলে তার ব্যবহার কমাতে হবে। তা সম্ভব না হলে তা পুনর্ব্যবহার করতে হবে। এরপর প্লাস্টিক বর্জ্য পুনঃচক্রায়ন করতে হবে। এসব কিছুর পর প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহারের ব্যাপারে বারবার ভাবতে হবে।

প্লাস্টিক দূষণ কমাতে বা শেষ করতে হলে প্রথমে পর্যায়ক্রমে প্লাস্টিকের উৎপাদন কমাতে হবে, একবার-ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকপাত্র একবারই ব্যবহার করতে হবে, সেগুলো বারবার ব্যবহার করা যাবে না, অযথা প্লাস্টিক বা পলিথিন দ্বারা সামগ্রী মোড়ক করা কমাতে হবে, প্লাস্টিক ব্যবহারের পর যে বর্জ্য বা আবর্জনা তৈরি হয়, তা এখানে-সেখানে না ফেলে একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে রিসাইকেল করতে হবে। যে বা যারা প্লাস্টিক উৎপাদন করছেন, তাঁদের উৎসাহিত বা প্রণোদিত করতে হবে যেন তাঁরাই প্লাস্টিকের ব্যবহারোত্তর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নাগরিক সচেতনতার পাশাপাশি সেসব নাগরিকের হাতে প্লাস্টিকের বিকল্প কোনো পরিবেশবান্ধব পণ্য তুলে দিতে হবে। এসব নিয়ে গবেষণাও বাড়াতে হবে।


মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত