Ajker Patrika
সাক্ষাৎকার

তারুণ্যের ধর্মচ্যুত তরুণ আমাদের কাম্য নয়

মোজাম্মেল হোসেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে পড়াশোনা করা মোজাম্মেল হোসেন, ঘনিষ্ঠ মহলে যিনি মঞ্জু নামেই বেশি পরিচিত, ছাত্রাবস্থায় ১৯৬৯ সালে সাপ্তাহিক ‘যুগবাণী’ ও ১৯৭০ সালে সাপ্তাহিক ‘একতা’য় প্রতিবেদক হিসেবে পেশাজীবন শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘মুক্তিযুদ্ধ’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ছিলেন। দৈনিক ‘ভোরের কাগজ’ ও ‘প্রথম আলো’র বার্তা বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। দৈনিক ‘সমকাল’সহ একাধিক পত্রিকায় সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোজাম্মেল হোসেনের সঙ্গে সমসাময়িক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার বিভুরঞ্জন সরকার

আপডেট : ২৯ জুন ২০২৫, ১৩: ৫২

আপনি দীর্ঘকাল ধরে দেশের রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করছেন। আজকের অবস্থানে দাঁড়িয়ে আপনি দেশের রাজনীতিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

রাজনৈতিকভাবে দেশ একটি ঘোরতর জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সাংবিধানিক ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি দেশে থাকলেও, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ভালো হলেও নিয়মনীতি অগ্রাহ্য করে, নির্বাচনে নগ্ন কারচুপি করে আওয়ামী লীগ দীর্ঘ সময় একচ্ছত্রভাবে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করে অনেক সংকট তৈরি করেছিল। প্রাতিষ্ঠানিক ভাঙন, রাষ্ট্রযন্ত্র দলীয়করণ, খোলাখুলি ব্যাপক দুর্নীতি, রাজনৈতিক দলের দুর্বৃত্তায়ন, সমান সুযোগের অভাবে নাগরিকদের মধ্যে বঞ্চনাবোধ—এগুলোই হচ্ছে সংকটের রূপ। ছাত্র-তরুণেরা ভীষণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং গত বছর জুলাই-আগস্টে ত্বরিত ফুঁসে ওঠা রাজপথের রক্তাক্ত আন্দোলনে সরকারের পতন ঘটে যায়। কিন্তু এর পরই জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী নিয়মশৃঙ্খলা এনে একটি ভালো নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসনের পথে যাত্রা সম্পর্কে শঙ্কা তৈরি হতে থাকে, কেননা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শের বিরুদ্ধের শক্তিগুলো, বিশেষত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাধান্য প্রকাশ পায় এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-ঐতিহ্য, স্মারক আক্রান্ত হতে থাকে। গণতন্ত্রকে সফল করার জন্য, সাম্প্রতিক সময়ের মতো কোনো স্বৈরতান্ত্রিক শাসন যাতে আর না ফিরে আসে, সে জন্য অভিজ্ঞতা থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকাঠামোয় কিছু সংস্কার দরকার, তা সবাই মানে। কিন্তু সে অছিলায় সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তনসহ রাষ্ট্রের চরিত্র বদলে ফেলার একটি লক্ষণীয় চেষ্টা একধরনের নতুন দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করছে। এটা জটিলতা। এই পটভূমিতে দেশে অসহিষ্ণুতা, হিংস্রতা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা যা দেখা যাচ্ছে, তা উদ্বেগের কারণ। এসবের নিরসন ঘটিয়ে সমাজে শান্তি আনা, জাতীয় ঐক্য-সংহতি দৃঢ় করা বড় চ্যালেঞ্জ।

আওয়ামী লীগ তো এখন কার্যত দৃশ্যপট থেকে অপসারিত। বিএনপি কি শূন্যস্থান পূরণ করতে বা বিকল্প শক্তি হয়ে উঠতে পারবে? জাতীয় পার্টি?

এই প্রশ্নে আমি কিছুটা কঠোর হব। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি জনগণের প্রয়োজনে জনগণের মধ্য থেকে উঠে আসা দল নয়। সামরিক শাসকদের সৃষ্ট দল, যা তাঁরা ক্ষমতায় বসে বানিয়েছেন এবং পরিকৌশলী নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের মাধ্যমে জিতিয়ে এনেছেন। তবে সময়ের সঙ্গে রাজনীতি করে বিএনপি পোড় খেয়েছে, জনগণের কাতারে এসেছে। একাধিকবার দেশ পরিচালনা করেছে। প্রতিষ্ঠাতা সামরিক নেতা জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরে ভোটে জিতেই ক্ষমতায় এসেছে। ২০০৬ সাল থেকে ১৯ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকেও দলটি বড় আকারেই রয়েছে। কখনো কখনো ভুল সিদ্ধান্ত ও ভুল কৌশল এবং সাংগঠনিক দুর্বলতার জন্য আশানুরূপ ফল পায়নি। ২০১৪ থেকে আমি একাধিকবার বলেছি, বিএনপির উচিত ছিল আওয়ামী লীগ সৃষ্ট প্রতিকূলতার মধ্যেও সরকারের পতন ঘটাতে না চেয়ে, বয়কট না করে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ভোট শুদ্ধ করার জন্য লড়াই করা। তাতে সার্বিকভাবেও দেশের রাজনীতির উপকার হতো। ছাত্রদের আন্দোলনসহ আরও নানা কারণে হাসিনা সরকারের পতন ঘটায় এখন রাজনীতির মাঠ বিএনপির জন্যই অনুকূলে। তবে নিকট অতীতে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের অংশীদার বিএনপিও। এখনো চাঁদাবাজি, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রভৃতি পরিহারসহ দলের পরিশীলন ছাড়া বিএনপি জনগণের স্বার্থে ভূমিকা পালন করতে পারবে না। দলে তুলনামূলকভাবে চিন্তাশীল নেতৃত্বের দরকার ও তুলনামূলক বিশুদ্ধ রাজনীতির পথে হাঁটতে হবে দলটিকে।

জাতীয় পার্টি, এর প্রতিষ্ঠাতা সামরিক নেতা এরশাদের সময়ই কেবল ক্ষমতায় ছিল। পরে মূলত একটি ‘প্রক্সি পার্টি’তে রূপান্তরিত হয়। ক্ষমতার রাজনীতিতে এরা কখনো সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় না। বরং একটি ‘বিকল্প নয়, বিকল্পের অংশীদার’ হিসেবেই তারা বেশি কাজ করে। বর্তমান রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির ভূমিকা সীমিতই থাকবে।

সব সময়ই তো বলা হয় তরুণেরাই পরিবর্তন আনে। তরুণেরাই ভরসা। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পরে রাজনীতিতে তরুণদের ভূমিকা কেমন দেখছেন?

নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি তো তরুণদের দল। এনসিপি জন্ম নেওয়ার আগেই জুলাই আবহে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে আমি বলেছিলাম, তরুণদের একটি রাজনৈতিক দলকে আমরা স্বাগত জানাতে পারি। এঁরা বয়সে তরুণ ও মানসিকতায় আধুনিক হবেন। নীতি, কর্মসূচি, জ্ঞান ও ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্ব দেবেন; স্লোগান, বুলি কপচানো ও নেতা বন্দনায় নয়। যুক্তি দিয়ে কথা বলবেন সাধারণ স্বরগ্রামে, অহেতুক গলার রগ ফুলিয়ে বক্তৃতা করবেন না। গণতন্ত্রের রীতিনীতি মেনে চলবেন এবং পার্লামেন্টে বিরোধী দলের আসনে বসে রাজনীতি করাকে মর্যাদাপূর্ণ ভাববেন।

এমন তরুণদের দল আমরা পাচ্ছি কি না বা এনসিপি তেমন দল হচ্ছে কি না, তা পাঠকেরা প্রতিদিনই তাদের দেখে যাচাই করতে পারেন। গলা ফুলিয়ে, হিংসা ছড়িয়ে বক্তৃতা করা, অজ্ঞাত উৎসের হিসাববহির্ভূত অর্থ ব্যয়, চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠা, গাড়ির বহর নিয়ে শক্তির মহড়া ইত্যাদি না হলে বুঝব রাজনীতিতে পরিবর্তন আসছে।

আমাদের তরুণেরা রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। ‘আই হেইট পলিটিকস’ শোনা যেত। কারণ, বছরের পর বছর তারা আদর্শহীন, সুবিধাবাদী, সংঘাতপূর্ণ, দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি দেখেছে। অন্যদিকে সামাজিক মাধ্যমে তারা দুনিয়া দেখে, সেখানে তাদের রাজনৈতিক উপস্থিতি পাওয়া যায়, তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে, প্রশ্ন তোলে। তরুণেরা এখন ‘নিউ পলিটিকস’ চায়, যেখানে নেতৃত্ব হবে বিশ্বাসযোগ্য, চিন্তাশীল এবং বাস্তবমুখী। কিন্তু আমি বিস্মিত যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা, জাতীয় নাগরিক পার্টিতে সমবেত তরুণেরা শিক্ষিত, প্রতিভাবান, স্মার্ট কিন্তু কেউ কেউ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়, এমনকি ধর্মভিত্তিক রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত ও জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে তাদের নৈকট্য দেখা যায়। তখন ভাবি, তরুণ মানেই তো ভালো, অগ্রসর চিন্তার মানুষ, প্রগতিশীল ও ন্যায়যোদ্ধা নয়। এগুলো হচ্ছে তারুণ্যের ধর্ম। কিন্তু সব তরুণের মধ্যে তারুণ্য নেই। চোর-গুন্ডা-বদমাশ ও সন্ত্রাসীরা কি বয়সে তরুণ নয়? নজরুল যাদের আহ্বান করেন ‘চল চল চল...অরুণপ্রাতের তরুণদল’ বলে এবং রবীন্দ্রনাথ যাদের বলেন ‘ওরে আমার সবুজ, ওরে আমার কাঁচা, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা’। তারা শুধু বয়সে তরুণ নয়, ধর্মে-মর্মে তরুণ। তাই তরুণ ও তারুণ্যে পার্থক্য আছে। তারুণ্যের ধর্মচ্যুত তরুণ আমাদের কাম্য নয়। তাই আমাদের দেশ ও সমাজের ব্যাপক সাধারণ তরুণদের মধ্যে এনসিপির আবেদন কতটুকু হবে, তা ওই দলের ভূমিকা ও কাজের ওপর নির্ভর করবে।

আপনি কি মনে করেন বাংলাদেশে আশু গণতান্ত্রিক উত্তরণ সম্ভব?

নিশ্চয়ই সম্ভব, কারণ জনগণ দৃঢ়ভাবে এটা চায়। তবে কয়েকটি কঠিন চ্যালেঞ্জও আছে। মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলকে ঘিরে আমেরিকার মতো পরাশক্তির কোনো একটি ভূ-রাজনৈতিক পরিকল্পনা আছে বলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জল্পনা আছে, যদিও সংগত কারণে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। এখানে কোনো অস্থিতিশীলতা ঘটলে আমাদের নির্বাচন ব্যাহত হতে পারে। আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধের মধ্যে আমাদের নির্বাচন হওয়ার কথা। তবে এখনো এটা নিশ্চিত নয়।

মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্র একটি সংস্কৃতি, শুধু নিয়ম নয়। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কারের একটি ব্যাপক পরিকল্পনা প্রয়োজন, যে বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য লাগবে। প্রথম ধাপেই আমাদের নির্বাচনকে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। বিগত সরকারের বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজের বিচার অবশ্যই হতে হবে। তবে সরকার ও প্রশাসনের দায়ী ব্যক্তিবর্গ ছাড়া বর্তমানে সরকারের আদেশে কার্যক্রম নিষিদ্ধ রাখা আওয়ামী লীগের বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী-সমর্থককে সংগঠিত হওয়ার ও মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার দিয়ে গণতন্ত্রের যাত্রাকে অংশগ্রহণমূলক করা ভালো। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনও এই অধিকারগুলোর কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।

এবার দু-একটি আন্তর্জাতিক বিষয়। চলমান বিশ্ব পরিস্থিতি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা জোটের ভূমিকাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

পশ্চিমা জোট বলতে যদি আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা স্পষ্টত ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোকে বোঝাই, তাহলে এই দেশগুলো হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী দেশ। সারা দুনিয়ায় আধিপত্য তাদের কাম্য। আমরা তাত্ত্বিকভাবে বলি যে সাম্রাজ্যবাদের খাদ্য হচ্ছে যুদ্ধ। যুদ্ধ ছাড়া তারা বাঁচতে পারে না। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেও সারাক্ষণ কোথাও না কোথাও যুদ্ধ লেগেই আছে। চার বছর ধরে রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ চলার মধ্যেই এই মাসে ইরানে ইসরায়েল ও আমেরিকা আক্রমণ চালিয়ে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধ ঘটাল। ইসরায়েল প্রায় দুই বছর ধরে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় অকল্পনীয় নিষ্ঠুরতায় অব্যাহত গণহত্যা চালাচ্ছে। প্রায় ৬০ হাজার মানুষকে হত্যা করার পর এখন তাদের দুর্ভিক্ষে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিচ্ছে। এইসব ঘটনায় এখন জাতিসংঘ কার্যত নিষ্ক্রিয় বা সভায় বসলেও কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে না। ফিলিস্তিন ও ইরানে যা দেখা গেল, আমেরিকা ও ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে চলেছে। সর্বশেষ এই সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চাপে প্রতিটি ন্যাটো দেশ অস্ত্র খাতে ব্যয় ৫ শতাংশ বাড়াতে সম্মত হয়েছে। এককথায় বৃহৎ শক্তিগুলোর স্বার্থে বিশ্বকে যুদ্ধে তাতিয়ে রাখাই হচ্ছে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ পুরোটাই স্নায়ুযুদ্ধের কাল হলেও সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ব্লক ও পশ্চিমা ব্লকের শক্তির ভারসাম্য ছোট দেশগুলোকে একটা ভরসায় রেখেছিল। সে সময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জেতার পেছনে সোভিয়েতের ভূমিকা একটি বড় উপাদান ছিল। সোভিয়েতের আহ্বানে তখন বিশ্বে পূর্ণাঙ্গ পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের আলোচনা হয়েছিল। এখন বড় শক্তিগুলো নিরস্ত্রীকরণ নয়, পারমাণবিক অস্ত্রের একচেটিয়া অধিকার হাতে রাখতে চায়।

পরাশক্তিব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পরে আমেরিকা ভেবেছিল বিশ্ব এককেন্দ্রিক হবে। কিন্তু তা হলো না। বরং আমেরিকা একটু দুর্বল হওয়ার পাশাপাশি চীন, রাশিয়া, ভারত, ইরান প্রভৃতি শক্তিধর রাষ্ট্র আছে। দুই মহাশক্তির পরিবর্তে পৃথিবী শক্তিকেন্দ্রিক। এ রকম

অবস্থায় বাংলাদেশের মতো ছোট দেশের জন্য সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জ দুটোই আছে। সুযোগ এই কারণে যে, একপেশে অবস্থানের পরিবর্তে কৌশলী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করে আমরা স্বার্থসংশ্লিষ্ট সুবিধা আদায় করতে পারি। চ্যালেঞ্জ এই কারণে যে, বড়দের দ্বন্দ্বে আমরা পড়ে যেতে পারি একপেশে সিদ্ধান্তে। ভারসাম্য রক্ষা করে চলাই আমাদের স্বার্থানুকূল।

আপনার দৃষ্টিতে ইরান-ইসরায়েলের যুদ্ধের মূলে কী? এটি ধর্মীয়, রাজনৈতিক, না কৌশলগত সংঘাত? আমেরিকা কেন জড়াল?

খুব ভালো প্রশ্ন। কিন্তু উত্তরটা এককথায় দেওয়া যায় না। এই সংঘাত ধর্মীয়ও বটে, কৌশলগতও বটে এবং আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তার নিয়েও বটে।

দুটি রাষ্ট্রই ধর্মভিত্তিক। ইহুদি রাষ্ট্রটির শাসকদের মধ্যে জায়নবাদীরা আছে। জায়নবাদ হচ্ছে ইহুদি-শ্রেষ্ঠত্বের দাবিতে ফ্যাসিবাদী ভাবধারা। তবে সব ইহুদি জায়নবাদী নয়। তাদের মধ্যে উদার আধুনিক মানুষ অনেক আছে। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যুদ্ধে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করতে সব সময় ধর্মগ্রন্থ ‘তোরাহ’ ব্যবহার করেন। যেমন ১২ জুন ইরান আক্রমণের নাম ‘জাগ্রত সিংহ অপারেশন’ ওল্ড টেস্টামেন্টভিত্তিক কাহিনি থেকে। তিনি আক্রমণের আগে জেরুজালেমে ওয়েস্ট ওয়ালে গিয়ে প্রার্থনা করেন। ওদিকে জাব্বাজোব্বা পরা আয়াতুল্লাহ শাসকেরা ইরানকে মধ্যপ্রাচ্যে শিয়াপন্থী অভিভাবক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এরা এমন ধর্মান্ধ যে ২০২২ সালে মাহশা আমিনি নামে এক তরুণীর হিজাব সরে গিয়ে চুল বেরিয়ে পড়ায় নীতি-পুলিশ তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বন্দী অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হলে প্রতিবাদকারী শতাধিক কিশোরী-তরুণীকে মিছিলে গুলি করে মারা হয়। যুদ্ধে ধর্মীয় উপাদান ব্যবহার করা হলেও এটি মূলত ক্ষমতা ও আঞ্চলিক আধিপত্যের লড়াই। ইসরায়েল হচ্ছে একটি আঞ্চলিক পরাশক্তি, যাকে পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়ে থাকে। ইরান বড় আকারে পারমাণবিক গবেষণা করে, কিন্তু পারমাণবিক বোমা বানাতে চায়, তা স্বীকার না করে শান্তিপূর্ণ উন্নয়নের কাজে ব্যবহারের কথা বলে। আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থাকে পরিদর্শনের অনুমতি দেয়। আলোচনায়ও বসেছে। এর আগের মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একতরফা আলোচনা ভেঙে দিয়েছিলেন। ইসরায়েল এবার ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা ফেলে, কয়েকজন সেনাপতি ও পরমাণুবিজ্ঞানীকে গুপ্তহত্যা করে। ইরান কার্যকরভাবে ইসরায়েলে পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করতে পারলে ইসরায়েলের ইজ্জত বাঁচাতে যুক্তরাষ্ট্র শঠতাপূর্ণভাবে বি-টু যুদ্ধবিমান দিয়ে ইরানে বড় হামলা করে। তার পরই ট্রাম্প যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন। তিন রাষ্ট্রের দুই পক্ষের ১২ দিনের যুদ্ধ। সন্দেহ করা হয় যে ২০০৩ সালে জনবিধ্বংসী অস্ত্র আছে বলে মিথ্যা অজুহাতে ইরাক আক্রমণ করে সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাত ও ফাঁসি দেওয়ার মতো ঘটনা ইরানে ঘটানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র ফন্দি আঁটতে পারে।

এবার কে জিতল?

(হেসে) তিন পক্ষই। যুদ্ধ শেষ হওয়ার দিন ২৪ জুনেই আন্তর্জাতিক মিডিয়া জানায়, যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তারা ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র বানানো অনেক পিছিয়ে দিতে পেরেছে। ইসরায়েল বলেছে, তারা ইরানকে দুর্বল করে দিয়েছে। অবশ্য ইসরায়েলের আরেকটি লক্ষ্য খামেনি সরকারের পতন ঘটেনি—সে সম্পর্কে নীরব। আর ইরান বলেছে, তারা উপযুক্ত জবাব দিয়েছে। সর্বশেষ ২৬ জুন টিভিতে সম্প্রচারিত ভিডিও বার্তায় আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি কাতারে মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতকে ‘সজোরে চপেটাঘাত’ উল্লেখ করে বলেন, ‘ইসরায়েল ধসে পড়েছে।’

বলাই যায়, ইসরায়েলি ‘সিংহ’ গর্জন মোতাবেক শিকার ধরতে পারেনি। ইউরোপে কিছুটা কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতায় পড়েছে। তবে নেতানিয়াহুর ক্ষমতার আয়ু কিছু বাড়তে পারে। ইরান ধারণার চেয়ে বেশি সক্ষমতা দেখিয়েছে এবং খামেনির সরকার পড়ে যাওয়ার বিপরীতে জনমতের দিক থেকে কিছুটা সংহত হয়েছে। বিশ্বের মুসলমানদের সমর্থন পেয়েছে। তারা বাংলাদেশকে ধন্যবাদও জানিয়েছে। আর আমেরিকা কিছুটা দুর্বল ইরানকে আলোচনার টেবিলে বসাবে। তিন পক্ষই বড় যুদ্ধ চায়নি, সেখানেও জিতেছে।

এই ১২ দিনের উপসংহারহীন অসমাপ্ত যুদ্ধের আরেকটি দিক হলো চীন ও রাশিয়ার কৌশলগত উত্থান। চীন চায় মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আধিপত্যে ফাটল ধরুক। তারা ইরানকে কিছুটা উসকানি বা কৌশলগত সহায়তা দিয়েছে বলে ধারণা। রাশিয়াও মধ্যপ্রাচ্যে বন্ধুত্ব বাড়াতে সক্রিয়।

ইরানে বড় আক্রমণ দেখে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছিল।

তেমন আশঙ্কা দূরবর্তী বলেই মনে হয়। তবে স্থানিক যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি হতে পারে বা বলতে পারেন ‘প্রক্সিতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’ সম্ভব। দুটি বৈশ্বিক মেরু তৈরি হয়েছে: একদিকে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল-ন্যাটো ব্লক, অন্যদিকে চীন-রাশিয়া-ইরান-হিজবুল্লাহ-হামাস।

এই দুই মেরুর মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষ না হলেও তারা পরোক্ষে যুদ্ধ করছে ইউক্রেন, সিরিয়া, ইয়েমেন, গাজা প্রভৃতি যুদ্ধক্ষেত্রে। এখন তো যুদ্ধ শুধু অস্ত্রের না, তথ্যেরও। মিডিয়া, সামাজিক মাধ্যম, কূটনৈতিক মঞ্চ—সবই যুদ্ধে জড়িয়ে। থেমে নেই।

বাংলাদেশের অবস্থান কী হওয়া উচিত? আমাদের কি নিরপেক্ষ থাকা উচিত, নাকি অবস্থান নিতে হবে?

দৃঢ় অবস্থান, আমরা যুদ্ধ চাই না। সাংবিধানিকভাবে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়। তবে অবশ্যই ন্যায়-অন্যায় ও মানবাধিকারের প্রশ্নে গাজা যুদ্ধে ও ইরান আক্রমণে ইসরায়েলের তীব্র নিন্দা করেছি আমরা। ইসরায়েলকে আমরা রাষ্ট্র হিসেবে এখনো স্বীকৃতি দিইনি। আমাদের জনগণের একটি মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ আছে।

তবে রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। ইরানের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ও জ্বালানি সহযোগিতা আছে। আমরা আন্তর্জাতিক শান্তির পক্ষে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে অবশ্যই আপসহীন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

সাক্ষাৎকার

এখন একটা আজব পরিস্থিতি বিরাজ করছে

ডা. মুশতাক হোসেন

ডা. মুশতাক হোসেন এরশাদবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা, ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য। তিনি কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছেন। পেশাজীবনে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ছিলেন। সিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদ—এ চারটি বামপন্থী দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর না করার কারণ নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা

মাসুদ রানা
আপডেট : ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৭: ৫৩

আপনারা কেন জুলাই সনদে স্বাক্ষর না করার সিদ্ধান্ত নিলেন? আপনাদের মূল আপত্তিগুলো কী ছিল?

আমাদের প্রথম আপত্তি ছিল ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা ভিন্নমত সংযুক্ত না করা। যেসব বিষয়ে সবাই মিলে একমত হয়েছি বা মোটামুটি একমত হয়েছি, সেসব যুক্ত করা ছাড়া আমরা স্বাক্ষর করব না। যেহেতু ‘নোট অব ডিসেন্ট’সহ কিছু বিষয়ে আপত্তি ছিল, সেটা স্বাক্ষর করলে তো মেনে নেওয়া হতো। সেটা জাতীয় সংসদে হলে অন্য কথা ছিল বা কোনো রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে সেটা হতে পারে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বা সংখ্যালঘিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে সেটা মেনে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু ঐকমত্য কমিশন সে রকম কোনো ফোরাম না। এটা হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে ঐকমত্যে আসার জন্য একটা চেষ্টা, একটা উদ্যোগ।

জুলাই সনদ তৈরি করার সময় এর পটভূমি ধরে আমরা ইতিহাসকে সঠিকভাবে লেখার জন্য বারবার ইনপুট দিয়েছি। আমাদের দলসহ অন্য দলের নেতারা সেটা বলেছেন। কিন্তু সনদে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানকে পুরোপুরি গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। যদিও ছোট ছোট অনেক ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টা কীভাবে এল, সেটা তো থাকা দরকার এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তো থাকতে হবে। যদিও বিশাল আকারে ইতিহাস লেখার জায়গা এটা না। শেষে আসবে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের ঘটনা। এর মধ্যে মাঝখানের ঘটনাগুলো শুধু উল্লেখ করলেই চলত। সেটা তো করা হয়নি। যাঁরা খসড়াটি করেছেন, তাঁদের আমি অবশ্যই অযোগ্য বলব না। একেকজনের কথায় একেকটা বিষয় ঢুকে গেছে। কারও সঙ্গে তাঁরা বিতর্ক করেননি। ফলে আমাদের বক্তব্যগুলোকে বেমালুম বাদ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা মনে করেছেন, আমাদের বক্তব্য বাদ দিলে বুঝি কোনো সমস্যা হবে না। আবার কোনো কোনো দল যা-ই বলেছে, সেটাই তাঁরা রেখেছেন; যেখানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অসম্পূর্ণ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বক্তব্য একপেশে হয়েছে।

আবার অঙ্গীকারনামায় উল্লেখ করা হয়েছে, এই সনদ বাস্তবায়নের জন্য পরিপূর্ণভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকতে হবে। আমাদের কথা হলো, এই সনদ পরিপূর্ণ হলে সেখানে ‘নোট অব ডিসেন্ট’গুলো লিপিবদ্ধ থাকত। কিন্তু সেসব রাখা হয়নি। সনদের ভেতরে আবার তাঁরা লিখেছেন—যে দল সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে, ‘নোট অব ডিসেন্ট’ ছাড়া কাজ করতে পারবে। যারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না, তারাও তো কাজ করবে। তারা প্রয়োজনবোধে একমত না হলে সংসদ ত্যাগ করবে। নতুবা সংসদের বাইরে সভা-সমাবেশের মাধ্যমে জনগণের কাছে মতামত তুলে ধরবে। এসব তো ম্যান্ডেট পাওয়া না-পাওয়ার ওপর নির্ভর করে না।

এটা তো বিএনপির ভাষা। বিএনপি মনে করে, তারা ম্যান্ডেট নিয়ে আগামী সংসদে যাবে। সেটা ভালো কথা। কিন্তু আমরা ম্যান্ডেট পাব কি পাব না সেটা ভিন্ন কথা। আমরা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছি চুপ না থাকার জন্য। আমরা যেমনভাবে সংসদের ভেতরে কথা বলব, তেমনি সংসদের বাইরেও কথা বলব। আমরা আবার রাজপথে আন্দোলনও করব। সবকিছু মিলিয়ে আমরা কয়েকটি বামপন্থী দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর করিনি।

তবে আমরা সংবাদ সম্মেলন করে বলেছি, যেসব বিষয়ে আমরা সহমত জ্ঞাপন করেছি (সেটার রেকর্ড আছে) সেটা খুব ভালো কাজ হয়েছে। আমরা ঐকমত্য কমিশনকে ধন্যবাদ জানাই যে সাংবিধানিক প্রশ্ন, আইনের প্রশ্নসহ সংস্কার নিয়ে সব রাজনৈতিক দলের মতামত নিয়ে তারা একটা ঐতিহাসিক দলিল তৈরি করতে পেরেছে। এই দলিল থেকে বোঝা যাবে, কোন দলের কী দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু আমরা বলেছি, গায়ের জোরে সংবিধান বাতিল করার দাবি—এটা অসাংবিধানিক অপরাধ। আমরা মনে করি, সংবিধান বাতিল করার দাবি তোলা যাবে এবং নতুন সংবিধান করার দাবিও তোলা যাবে—সেটা রাষ্ট্রদ্রোহ হবে না। কিন্তু অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে যদি বাতিল করতে চায়, সেটা অবশ্যই রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ। তারা ৭ (ক) ধারার বাতিল করার প্রস্তাব করেছে। এটা নিয়ে আমরা আপত্তি করেছি। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টে উচ্চকক্ষে আমরা পিআর পদ্ধতির পক্ষে, কিন্তু দুই বাসদ ও সিপিবি উচ্চকক্ষে পিআরের পক্ষে না।

তবে আমরা যে কয়েকটি বাম দল এসব বিষয়ে একমত হয়েছি, আমরা আগামী দিনে সংসদের ভেতরে ও বাইরে এসব নিয়ে সংগ্রাম এবং রাজনৈতিকভাবে জনমত গঠনের কাজ করব। সেটা আমরা অঙ্গীকার করেছি।

এরপর আপনারা একটা স্মারকলিপি দিয়েছেন। এটা দেওয়ার কারণ কী?

আমরা কেন জুলাই সনদে স্বাক্ষর করলাম না, সেটা নিয়ে আমরা একটা সংবাদ সম্মেলন করেছি। সেই সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যটা আমাদের দুজন প্রতিনিধি হাতে হাতে ঐকমত্য কমিশনের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।

স্মারকলিপি দেওয়ার পর ঐকমত্য কমিশনের বক্তব্য কী?

তারা বলেছে, আপনারা অনেক কষ্ট করে, সময় নিয়ে বক্তব্য বা নোট দিয়েছেন, আপনারা এটার অংশীদার হন। আমরা বলেছি, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আর বিএনপির দৃষ্টিভঙ্গি এক নয়। জাতীয় সংসদে সিদ্ধান্ত হওয়ার আগে কেন আমরা আত্মসমর্পণ করব মৌলিক, দার্শনিক ও রাজনৈতিক প্রশ্নে? বিএনপি যেমন প্রত্যাশা করছে, তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে। তারাসহ তাদের মিত্ররা দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পাবে। তারা যেসব নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে, সেগুলোতে তারা পক্ষে নিতে পারে। কিন্তু সংসদে যাওয়ার আগেই আমাদের মেনে নিতে হবে, সংবিধান বাতিলের ১৪ ধারা রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ না, নারী ১০০ আসনে সরাসরি নির্বাচনের দরকার নেই, সংবিধানের ১৫০ (২) ধারা মতে শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ না থাকা—এ বিষয়গুলো এড়িয়ে গিয়ে তো আমরা সনদে স্বাক্ষর করে দাসখত দিতে পারি না। এই ফাঁদেও পা দিতে পারি না। আমরা স্পষ্ট করে বলেছি, এসব বিষয় যদি সংশোধন না করা হয়, তাহলে আমরা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করতে পারি না।

এনসিপি সনদের বাস্তবায়নের পদ্ধতির প্রশ্ন নিয়ে স্বাক্ষর করেনি। এটাকে আপনারা কীভাবে দেখেন?

তাদের তো সনদ নিয়ে কোনো দাবি নেই। তারা সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে চাপ সৃষ্টি করছে। আমাদের তো সনদের খসড়া নিয়েই আপত্তি। কিন্তু তাদের কোনো আপত্তি নেই। তারা শুধু বাস্তবায়ন পদ্ধতির বিতর্ক তুলে স্বাক্ষর করেনি।

আপনি নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা ছিলেন। সে সময়ে তিন জোটের রূপরেখাকে পরবর্তীকালে ক্ষমতাসীন কোনো দলই গুরুত্ব দেয়নি। এখন আপনি জুলাই সনদ নিয়ে কতটা আশাবাদী?

নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের তিন জোটের রূপরেখাকে নির্দিষ্ট করে সংবিধানের সঙ্গে আপগ্রেড করা হয়নি। সে সময় যে তিনটি জোট এই রূপরেখাতে স্বাক্ষর করেছিল, তারা কিন্তু পরবর্তী সময়ে তার অনেক কিছুই মানেনি। তারা সেখানকার রাজনৈতিক অঙ্গীকারও পালন করেনি। তা ছাড়া, এটার কোনো আইনি রূপও দেওয়া হয়নি। কথা ছিল তারা পরস্পরের প্রতি কোনো বৈরী আচরণ করবে না। সেই রাজনৈতিক অঙ্গীকারও পালন করেনি। পরস্পর পরস্পরকে ধ্বংস করার জন্য এক দল অন্য দলের প্রতি বিরূপ আচরণ করেছে। এগুলোকে কোনোভাবেই রাজনৈতিক আচরণ বা সাংবিধানিক আইন মেনে চলা বলা যায় না।

কিন্তু এবারের জুলাই সনদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এর ধারা ও উপধারা ধরে বিতর্ক করে কে পক্ষে আছে আর কে বিপক্ষে আছে, তা নিয়ে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। সে কারণে বলতে চাই, নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের তিন জোটের রূপরেখার সঙ্গে এবারের জুলাই সনদটা অনেক অগ্রসর দলিল বলতে হবে। কোনো দল যদি এর কোনো বক্তব্য সুনির্দিষ্টভাবে পালন করতে না চায়, তাহলে সব রাজনৈতিক দল তার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যাবে। জুলাই সনদ একেবারেই সুনির্দিষ্ট। কিন্তু নব্বইয়ের রূপরেখা এভাবে সুনির্দিষ্ট ছিল না। আবার সেই রূপরেখার মধ্যে কোনো গভীরতা ছিল না। তারপরেও যে কিছু হয়নি, সেটা বলা যাবে না। কারণ, নব্বইয়ের পরে সব দল কিন্তু সংসদীয় সরকার পদ্ধতির দিকে অগ্রসর হয়েছে। যদিও পরবর্তী সময়ে সেই সংসদীয় সরকার পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার পরেও নানা অঘটন ঘটেছে।

বাংলাদেশের রাজনীতি আসলে কোন দিকে যাচ্ছে?

এখন দ্রুত দরকার একটা সংসদ নির্বাচন করা। যে নির্বাচিত সরকার জনগণের কাছে জবাবদিহি করবে। এখন কোনো জবাবদিহি করা যাচ্ছে না। আমরা যেভাবে গত স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে পেরেছি, এখন কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে তা করতে পারছি না। এখন কোনো বিষয়ে সরকারের কাছে অভিযোগ উত্থাপন করলে তারা বলে, কোনো কিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। আবার পুলিশও একই কথা বলছে।

রাজনৈতিক দলগুলো দেশটাকে ভাগাভাগি করার মতো করে কথা বলছে। এক দল আরেক দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে, আবার সবাই মিলে ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে। এখানে এখন একটা আজব পরিস্থিতি বিরাজ করছে। মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা দেওয়ার নিশ্চয়তা এ সরকার দিতে পারছে না। এ জন্য নির্বাচন করা দরকার। যদিও সুষ্ঠু নির্বাচন করা নিয়ে অনেকে শঙ্কা প্রকাশ করছেন। তারপরও নির্বাচনের মাধ্যমে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তখন আমরা একটা রাজনৈতিক ব্যাকরণের মধ্যে প্রবেশ করতে পারব।

নির্বাচিত সরকার ভালো কাজ করলে পক্ষে থাকব আর মন্দ কাজ করলে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করব। আগে থেকে বলা সম্ভব নয়, যারা দায়িত্বে থাকবে তারা কতটুকু পারছে বা পারছে না। তারা যদি জনগণের পক্ষে না থাকে, তাহলে প্রয়োজনে আগাম নির্বাচন দাবি করব।

সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

আপনাকেও ধন্যবাদ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ঢাকার অন্য খালগুলোও তো এমন সুন্দর হতে পারে

মৃত্যুঞ্জয় রায় 
আপডেট : ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ১১: ৩৫
কুড়িল বিশ্বরোডের কাছে সুশোভিত নিকুঞ্জ খাল। ছবি: লেখক
কুড়িল বিশ্বরোডের কাছে সুশোভিত নিকুঞ্জ খাল। ছবি: লেখক

কুড়িল বিশ্বরোডের ফুটওভার ব্রিজে দাঁড়িয়ে একটি খালের চমৎকার শোভা দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। ঢাকার বুকে এত সুন্দর একটা খাল! ধনুকের মতো বাঁক খেয়ে চলে গেছে দূরে, দুই পাড়ে হাঁটার রাস্তা। রাস্তা আর খালের পানির মাঝে সবুজ ঢাল সিঙ্গাপুর ডেইজির শায়িত লতায় আচ্ছাদিত। আহা, কী পরিষ্কার সে খালের জল, কোথাও একটা শুকনো পাতা পড়ে নেই জলের ওপর। খালের পাড়ে স্বর্ণচাঁপা, বকুল, কাঠবাদাম, চালতা, ছাতিম গাছগুলোর ছত্রবৎ পত্রাচ্ছাদন, গোড়া বাঁধানো নারকেলগাছের সারি। খালের জলে সাঁতরে বেড়াচ্ছে, লাফ দিচ্ছে মাছেরা। মাঝে মাঝে পাড়ে রয়েছে জলের ওপর বাড়ানো জেটির মতো রেলিংঘেরা পাকা চাতাল, যার ওপর দাঁড়িয়ে জলের কাছে যাওয়া যায়, খালের জলে বড়শি ফেলে মাছ ধরা যায়। ওপরে হেমন্তের ঝকঝকে নীল আকাশ, রোদের ঝিলিক। খালের পশ্চিম পাড়ে একটি অভিজাত এলাকার মনোরম ভবন। দেখে মনে হচ্ছে, এ যেন ঢাকা শহর না—নেদারল্যান্ডসের কোনো এক জায়গা।

নেদারল্যান্ডসের গিথুর্ন গ্রামের ছবি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা হয়তো জানেন যে, সে গ্রামটিতে গাড়ি চালানোর মতো কোনো রাস্তা নেই, আছে গ্রামজুড়ে চলাচলের জন্য চমৎকার খাল আর হাঁটার পথ। একটা গ্রামে কোনো গাড়ির রাস্তা নেই, খাল ও খালের ওপর আছে ১৭০টির বেশি সেতু। বৈদ্যুতিক নৌকায় করে সে গ্রামের অধিবাসীরা এখান থেকে সেখানে যান। আহা, গাড়ি ও জ্বালানির দূষণমুক্ত কী শান্ত মনোরম সে গ্রাম! খালের পাড় বাঁধানো, দুই পাড়ে থাকা অনুচ্চ ঘরবাড়ি, আঙিনার কোথাও কোনো খোলা মাটি নেই, পুরোটাই সবুজ কার্পেটের মতো ঘাসে ঢাকা, মাঝে মাঝে ফুলগাছের ঝোপ। যেন সে এক স্বপ্নের জায়গা, পৃথিবীর বুকেই স্বর্গের শোভা। ঢাকার এ জায়গাটি দেখেও সেই গিথুর্ন গ্রামের ছবিটা চোখে ভাসছিল। ধন্যবাদ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনকে নিকুঞ্জ খালের এমন সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য।

আহা রে, ঢাকা শহরের সব খাল যদি এরূপ সুন্দর হতো! এ কথা ভাবতেই মনের মধ্যে ভেসে উঠল এর বিপরীত দৃশ্য। খাল দখল করতে করতে সেগুলো সংকুচিত হয়ে পড়েছে। যতটুকু অবশিষ্ট আছে, সেগুলোও হয়ে পড়েছে ময়লার ভাগাড়, কচুরিপানা ও ঝোপঝাড়ে ভরা মশককুলের অভয়ারণ্য। বিভিন্ন কলকারখানার বর্জ্য নির্গমনের নিকাশনালার মতো ব্যবহৃত হচ্ছে কোনো কোনো খাল। পচা দুর্গন্ধযুক্ত অস্বাস্থ্যকর সেই পরিবেশেই কেটে যাচ্ছে পথচারী ও এলাকাবাসীর দিনকাল। খালগুলো যেভাবে মরতে বসেছে, তাতে আগামী ১০ বছরও লাগবে না ঢাকা শহর খালশূন্য হতে। ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকা শহরে খালের সংখ্যা ৪৭টি। রিভার অ্যান্ড ডেল্টা সেন্টারের গবেষণা অনুযায়ী ৫৬টি। ড্যাপেও খালের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে ৪৩টি।

ধরা হয়, অতীতে ঢাকা শহরে ৪৭টি খাল সচল ছিল। শহরের চারপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদের সঙ্গে যুক্ত ছিল সেসব খাল। নৌকা ও নৌযান চলত সেসব খালে। পণ্য পরিবহন ও লোক চলাচলে সে সময় খালগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। একসময় শাহবাগ থেকে মগবাজার পর্যন্ত একটি খাল ছিল, যার নাম ছিল পরীবাগ খাল। ঢাকা ওয়াসার মানচিত্রে তার অস্তিত্বের কথা জানা যায়। সেই খাল আর এখন নেই। এভাবে ধোলাইখাল, রায়েরবাজার, গোপীবাগ, নারিন্দা, সেগুনবাগিচা, কাঁঠালবাগান, ধানমন্ডি ইত্যাদি খালগুলোরও এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই। ধানমন্ডি লেকটাই একসময় ছিল খাল, হাতিরঝিলের খালে পিলখানা থেকে হাতির পালকে নিয়ে যাওয়া হতো গোসল করাতে। মোগল শাসকেরা ঢাকা শহরে বহুসংখ্যক খাল থাকায় ঢাকাকে রাজধানী করার চিন্তা করেছিল, খালগুলো তাদের চলাচল ও প্রতিরক্ষার জন্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ। শহরের জলাবদ্ধতা দূর ও পানি নিষ্কাশনের জন্যও ছিল সেগুলো সহায়ক। সেসব এখন ইতিহাস। এখন এক ঘণ্টা বৃষ্টি হলেই ঢাকা শহরের অনেক এলাকায় হাঁটুপানি জমে যায়।

ঢাকা শহরের সব খাল উদ্ধার করা প্রথম কাজ। উদ্ধারের পর সেসব খালের দুই পাড়ে ওয়াকওয়ে বা হাঁটার পথ তৈরি ও বাহারি গাছপালা লাগিয়ে সুশোভন করা দ্বিতীয় কাজ। তৃতীয় কাজ হলো খালগুলোতে নিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যাটারি, বিদ্যুৎ ও হস্তচালিত নৌযান চালনার উদ্যোগ নেওয়া। জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক কোনো নৌযান সেসব খালে চলাচলের অনুমতি না দেওয়া হবে খালের জলজ জীবগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা ও দূষণ কমানোর গুরুত্বপূর্ণ উপায়। ওয়াকওয়ে যেন শুধু ওয়াক তথা হাঁটার জন্যই ব্যবহৃত হয়, সে রাস্তায় যেন কোনো গাড়ি বা মোটরসাইকেল না চলে। সবশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো খাল ও তার চারপাশের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন ও দূষণমুক্ত রাখতে উত্তম ব্যবস্থাপনার চর্চা অব্যাহত রাখা। খাল ব্যবহারকারী থেকে শুরু করে সেখানকার সব অংশীজনের সক্রিয় অংশগ্রহণই এসব ব্যবস্থাপনাকে সুচারুরূপে বাস্তবায়নের মূল সূত্র, এর সঙ্গে থাকবে সঠিক পরিকল্পনা ও নির্দেশনা, উদ্বুদ্ধকরণ ও সচেতনার প্রচারণা। এ কাজে দরকার রাষ্ট্রীয় বা সরকারের সদিচ্ছা ও সিদ্ধান্ত, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও প্রকল্প গ্রহণ, রাজনৈতিক ঐকমত্য এবং জনগণের অংশগ্রহণ। অনেক তরুণ এখন স্বেচ্ছাসেবী হয়ে এরূপ কাজে অংশ নিতে আগ্রহী। তাদের উৎসাহিত করে নিরাপদভাবে কাজের সুযোগ করে দিতে হবে। সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত মালি ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা কাজ করবেন জবাবদিহির মধ্যে, স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে মিলেমিশে। শোভাবর্ধনের চারাগুলোর ব্যবস্থা করতে হবে সিটি করপোরেশনগুলোকেই। তবে এককভাবে শুধু দুই সিটি করপোরেশনের ওপর সম্পূর্ণ বিষয়টি চাপিয়ে দিলে হবে না। খালগুলোর দখলদারেরা অনেক শক্তিশালী, নিশ্চিত যে তাঁরা কেউই সেসব খালের দখল স্বেচ্ছায় ছাড়বেন না। দখলমুক্ত করার জন্য জোর প্রশাসনিক প্রচেষ্টা ও আইন প্রয়োগ করা দরকার।

প্রকৃতিতে প্রবহমান নদী আর খালগুলো হলো আমাদের দেহের শিরা-উপশিরার মতো। একটি ভূখণ্ডের জীবনরেখা বলা হয় এসব জলস্রোতকে। প্রবহমান এসব জলাশয় যেমন জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি মাটিসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্যও সহায়ক। ঢাকা শহরের প্রায় দুই কোটি মানুষের স্বাস্থ্যের কথা ভেবেও খালগুলোকে সচল করা দরকার। বর্তমানে ঢাকা শহরে ২৬টি খালের অস্তিত্ব চোখে দেখা গেলেও বাকি ২১টি খাল নেই। কোথায় কোথায় সেসব খাল ছিল, তা নিশ্চয়ই অতীতের মানচিত্রগুলোতে পাওয়া যাবে। সেগুলো আদৌ উদ্ধার বা দখলমুক্ত করা যাবে তা দুরাশা। উদ্ধার করা গেলে সেগুলো খনন করে সচল ও শোভাময় করা উচিত। জার্মানির বার্লিন শহরে খালে করে ক্যানালক্রুজ করার সময় খালপাড়ের দুই পাশের বিভিন্ন স্থাপনা ও নাগরিক সৌন্দর্য, সেতু, রেস্তোরাঁ দেখতে দেখতে অভিভূত হতাম। ভাবতাম, জলের দেশ, নদীর দেশ, খালের দেশ বাংলাদেশ; অথচ সে দেশের শহরগুলোর খালে কেন এ রকম নৌ-পর্যটন করা যাবে না?

খালপাড় ভেঙে যাতে কোনো নগরবাসীর এক ফুট জমিও নষ্ট না হয় সে জন্য ভেনিস, কোপেনহেগেন, প্যারিস ইত্যাদি শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া খাল ও নদীর দুই পাড় যেভাবে পাকা করে বাঁধাই করে রাখা হয়েছে, সেভাবে আমাদের প্রবহমান খালগুলোর পাড়ও বেঁধে দেওয়া যায়। নগরীর খালগুলো নিয়ে একটি চমৎকার পরিকল্পনার সুযোগ রয়েছে ড্যাপ বাস্তবায়নের কারণে। চলাচল, পরিবহন, জলাবদ্ধতা নিরসন, দূষণ হ্রাস, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, পর্যটন, সৌন্দর্যবর্ধন, স্থানীয় মানুষের আয়বর্ধন, পরিবেশ উন্নয়ন ইত্যাদির জন্য এ ধরনের পরিকল্পনা ও জরিপকাজ নিশ্চয়ই সহায়ক হবে। সবারই মনে রাখা উচিত, প্রাকৃতিক প্রবাহকে রুদ্ধ করার অধিকার কারও নেই, তার ফল কখনো ভালো হয় না। এ নিয়ে কোনো খণ্ডিত পরিকল্পনা নয়, নিতে হবে সমন্বিত সামগ্রিক পরিকল্পনা। তাহলে আমরাও দেখতে পাব একটি মনোরম মহানগর, সুশোভিত খালসমৃদ্ধ একটি সুশোভন পরিবেশ। কুড়িল বিশ্বরোডের কাছে নিকুঞ্জ খালটি যদি এত সুন্দর করা যায়, সুন্দর রাখা যায়, তাহলে অন্যগুলো কেন এরূপ সুন্দর হবে না?

মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ইউএনও ও বাল্যবিবাহ

সম্পাদকীয়
ইউএনও ও বাল্যবিবাহ

পিরোজপুরের নেছারাবাদে যে ঘটনাটি ঘটেছে, তার জন্য ইউএনও সাহেব ধন্যবাদ পেতেই পারেন। সেখানে একটি বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছিলেন তিনি সপরিবারে। কিন্তু যখন জানতে পারলেন, বিয়ের কনে প্রাপ্তবয়স্কা নয়, তখন তিনি না খেয়েই ফিরে আসেন। এবং তিনি ফিরে আসায় কাজিও বিয়ে পড়াননি। ফলে এই বাল্যবিবাহটি হয়নি।

বহু প্রচার করার পরও কোথাও কোথাও অপ্রাপ্তবয়স্ক নারী বা পুরুষের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে পরিবারের পক্ষ থেকে। কোথাও কোথাও সচেতনতা তৈরি হচ্ছে, কোথাও কোথাও তৈরি হচ্ছে না। অনেকেই ভুলে যাচ্ছেন, কেন অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের বিয়ের পিঁড়িতে না বসানোই মঙ্গল।

বাল্যবিবাহের শিকার অল্প বয়সী মেয়েরা শারীরিক ও মানসিকভাবে বিয়ের জন্য প্রস্তুত থাকে না। এতে মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু, পুষ্টিহীনতা এবং প্রসবজনিত জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কম বয়সে সন্তানের মা হয়ে যাওয়ার কারণে তাদের পক্ষে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে এবং অনেক সময় তারা শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ঝরে পড়ে। সমাজের একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ নষ্ট হয়। আত্মনির্ভরশীল হতে না পারার কারণে সংসারে নানাবিধ সংকটের মধ্যে তাদের পড়তে হয়। শিক্ষাবঞ্চিত ও অল্প বয়সে সংসার শুরু করা মেয়েরা সাধারণত আর্থিকভাবে নির্ভরশীল থাকে। এতে পরিবারে দারিদ্র্য দূর হয় না, বরং প্রজন্মের পর প্রজন্ম সেই দারিদ্র্য চলতে থাকে।

এতে যে নারীর অধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে, সেটাও বিবেচনায় আনা দরকার। বাল্যবিবাহের কারণে একটি মেয়ে নিজস্ব মতামত-সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এবং স্বাধীন জীবনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারে। সামাজিকভাবেই সে হেয় হতে থাকে। সংসারে তার মতামতের কোনো মূল্য থাকে না। পুরুষশাসিত সমাজে এমনিতেই মেয়েরা থাকে কোণঠাসা হয়ে, বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েটি সে ক্ষেত্রে আরও ভঙ্গুর অবস্থায় থাকে। এ যেন তার ব্যাপারে সামাজিক নিপীড়নের জন্য একটি মুক্ত জায়গা হয়ে দেখা দেয়।

একজন মানুষ যেন মুক্ত, স্বাধীন চিন্তার অধিকারী হয়ে বেড়ে উঠতে পারে, সমাজে অর্থনৈতিক অবদান রাখার মতো করে নিজেকে তৈরি করে নিতে পারে, সেসব দিক বিবেচনা করা না হলে সংকটে পড়ে রাষ্ট্র।

পিরোজপুরের নেছারাবাদের ঘটনাটি আশার আলো জাগায়। যদিও ইউএনও বিয়ের অনুষ্ঠানে বাধা দেননি, তবু তিনি সেখানে অংশ না নিয়ে প্রতিবাদস্বরূপ চলে যাওয়ায় বিয়েটা হয়নি বলে একটি ভালো কাজ হয়েছে। যখন সমাজের একটি বড় অংশ অল্প বয়সে বিবাহ ও মাতৃত্বে জড়িয়ে পড়ে, তখন তারা কর্মক্ষম নাগরিক হিসেবে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে না। ফলে জাতির অগ্রগতিতেও বাধা সৃষ্টি হয়। অপ্রাপ্তবয়স্ক যে মেয়েটি অভিভাবকদের কারণে বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছিল, এখন হয়তোবা সে তা থেকে মুক্ত হতে পারে। অভিভাবকেরাও সচেতন হয়ে এই শিশুটিকে শারীরিক, মানসিক, শিক্ষাগত ও সামাজিক সুরক্ষা দিতে পারেন। তাতে একটি সমৃদ্ধ ও সমানাধিকারের সমাজ গঠিত হওয়ার পথে তাঁরা অবদান রাখতে পারেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

বিষাক্ত গ্যাস

সম্পাদকীয়
বিষাক্ত গ্যাস

মিরপুরের শিয়ালবাড়ী এলাকায় একটি রাসায়নিক গুদামে আগুন লাগার পর যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল, সে কথা সবাই এখন জানেন। যাঁরা স্বজন হারিয়েছেন, তাঁরা জানেন এটা তাঁদের পরিবারের জন্য কত বড় ক্ষতি। নিহতদের পরিবার ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে কি না, তাদের জীবনে স্থিতি ফিরিয়ে আনতে কী করা দরকার—তা নিয়ে সংশ্লিষ্টরা নিশ্চয়ই ভাববেন। এ রকম একটা অবস্থায় দুর্ঘটনা-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে খুব কম মানুষই মাথা ঘামায়। দুর্ঘটনা-পরবর্তী সময়টিতে স্থানীয় পরিবেশ ও পরিস্থিতি যে মোটেও অনুকূল থাকে না, সেটা বোঝা দরকার।

সম্প্রতি আমাদের প্রতিবেদক শিয়ালবাড়ীর ক্ষতিগ্রস্ত রাসায়নিক গুদামে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে তিনি দেখেছেন, এতগুলো দিন পার হওয়ার পরও বিষাক্ত রাসায়নিকের কারণে এখনো অসুস্থ হচ্ছে মানুষ। রাসায়নিকের ড্রাম থেকে নির্গত বিষাক্ত গ্যাস ও ধোঁয়া মানুষকে অসুস্থ করে দিচ্ছে। অসুস্থদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধরা রয়েছেন ঝুঁকির মধ্যে। প্রায়ই দেখা যায়, একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর দু-এক দিন সংবাদপত্রে রিপোর্ট হয়, তারপর একসময় সেটা ভুলে যায় মানুষ। কিন্তু যে মানুষেরা ভুক্তভোগী, তাদের প্রতিটি দিনই যে কাটছে ভয়ংকর রাসায়নিকের সঙ্গে লড়াই করে, সে খবর কয়জন রাখে?

চিকিৎসকেরা বলেছেন, অগ্নিকাণ্ডের কয়েক দিন পরও বিষাক্ত গ্যাস ও ধোঁয়ার ঘনত্ব বেশি থাকে। পরে ধীরে ধীরে তা কমে যায়। মাটিতে পড়ে থাকা রাসায়নিক দ্রব্যের অবশিষ্টাংশ ভুক্তভোগীর শরীরে ঢোকে। ঘন ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ার কারণে বাতাসে ভাসমান ক্ষুদ্র ধূলিকণা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে যায়। এই কারণে ভবিষ্যতেও তা বিপদ সৃষ্টি করতে পারে।

বিষাক্ত কণিকা বা গ্যাস মানবদেহে ঢোকে শ্বাসের মাধ্যমে, ত্বকের মাধ্যমে এবং খাদ্যের মাধ্যমে। এই গ্যাস অ্যাজমা, কাশি, গলাজ্বলা বা শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। চোখ আর ত্বকও তাতে আক্রান্ত হতে পারে। তৈরি হতে পারে মাথাব্যথা, বমি ও ক্লান্তির মতো ঘটনা। ভারী ধাতু দীর্ঘ মেয়াদে স্নায়ুতন্ত্র দুর্বল করে দেয়। তাতে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে।

শিয়ালবাড়ীর দুর্ঘটনাস্থলের অন্তত এক হাজার গজ পর্যন্ত এলাকায় বাতাসে এখনো পোড়া জিনিস ও গ্যাসের মতো কটু গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তাতে মনে হয়, এই এলাকার মানুষের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি এখনো রয়েছে সংকটের মুখে।

আমরা সবাই জানি, স্বাস্থ্য আমাদের মৌলিক অধিকারের একটি। কিন্তু দেশের মানুষ এ কথাও জানে, সেই মৌলিক অধিকার সব সময় সমুন্নত রাখা হয় না। রাসায়নিক গুদামে অগ্নিকাণ্ড ঘটলে কীভাবে তার মোকাবিলা করতে হবে, তার পূর্বপ্রস্তুতি কয়টি গুদামে আছে? এসব জায়গায় কি নিয়মিত ইন্সপেকশন হয়? শুধু গুদাম কেন, কারখানাগুলোয় কি সঠিক নিরাপত্তাব্যবস্থা রয়েছে? শ্রমিকেরা কি নিরাপদে তাঁদের কাজ করে যেতে পারেন?

এসব দুর্ঘটনায় মূলত সমাজের নিচুতলার মানুষেরা বিপদে পড়েন। তাঁদের পাশে যদি দাঁড়ানো না হয়, তাহলে বুঝতে হবে, শিল্প-ব্যবস্থাপনায় যে ঘাটতি আছে, তা নিরসনের কোনো চিন্তা কারও নেই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত