অনলাইন ডেস্ক
গণ-অভ্যুত্থানের মুখে গত বছর ৫ আগস্ট ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে অনিয়ম, দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনে জর্জরিত আওয়ামী লীগের দেড় দশকের বেশি সময়ের শাসনের অবসান ঘটেছে। কিন্তু ততক্ষণে হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। নারী-শিশুসহ হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছে। গতকাল বুধবার প্রকাশিত জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) তথ্যানুসন্ধানী প্রতিবেদনে তার চিত্র উঠে এসেছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে রূপান্তরিত শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবি আদায়ে সেদিন সারা দেশ থেকে ঢাকায় আসার কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল আন্দোলনের সামনে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে ওই দিনের ঘটনা পরম্পরা বর্ণনা করা হয়েছে। সেই কর্মসূচি ঠেকাতে সরকার সেদিন কী কী করেছিল এবং সারা দিন যা যা ঘটেছিল, তার একটি বিবরণ উঠে এসেছে ওএইচসিএইচআরের প্রতিবেদনে।
কর্মসূচি ঠেকাতে পরিকল্পনার জন্য আগের দিন (৪ আগস্ট) তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দুই দফায় উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়। পুলিশের এক কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনার পতনের বিষয়ে পরদিন (৫ আগস্ট) সকাল থেকেই সেনাবাহিনী অবগত ছিল। কিন্তু পুলিশ জানত না বলে সরকারকে রক্ষা করতে তখনো সর্বাত্মকভাবে মাঠে ছিল।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫ আগস্ট ঢাকার কেন্দ্রস্থলে বড় প্রতিবাদ মিছিলের পরিকল্পনার কথা নেতাদের প্রকাশ্য ঘোষণা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য থেকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব জানতে পারেন। বিষয়টি নিয়ে ৪ আগস্ট সকালে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠক করেন। সেখানে সেনা, বিমান, নৌ, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই, পুলিশ ও পুলিশের বিশেষ শাখার প্রধানেরা ছিলেন। হাসিনা সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বৈঠকে অংশ নেন। তাঁরা ‘মার্চ অন ঢাকা’ প্রতিরোধের জন্য আবার কারফিউ জারি ও তা বলবৎ করার বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
বৈঠকের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষণা দেয়, কোনো বিরতি ছাড়াই অনির্দিষ্টকালের জন্য কঠোর কারফিউ চলবে। আন্দোলনকারীদের সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী একটি বিবৃতি দেন। ‘এই সন্ত্রাসীদের শক্ত হাতে দমন’ করতে তিনি দেশবাসীকে আহ্বান জানান।
৪ আগস্ট সন্ধ্যার পর গণভবনে আরেকটি বৈঠক করেন শেখ হাসিনা। সেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, র্যাব ও আনসার/ভিডিপির প্রধান, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার ও সেনাবাহিনীর কোয়ার্টারমাস্টার জেনারেল। বৈঠকে সেনাপ্রধান ও অন্যান্য নিরাপত্তা কর্মকর্তা ঢাকা রক্ষার বিষয়ে আবারও হাসিনাকে আশ্বস্ত করেছিলেন।
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করে বিক্ষোভকারীদের ঢাকার কেন্দ্রস্থলে প্রবেশে বাধা দিতে পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও বিজিবি মোতায়েন করার বিষয়ে বৈঠকে ঐক্যমত্য হয়েছিল। সেনাবাহিনী ও বিজিবি সাঁজোয়া যান ও সেনা মোতায়েন করে ঢাকার প্রবেশের পথগুলো অবরুদ্ধ করবে, বিক্ষোভকারীদের প্রবেশে বাধা দেবে। অন্যদিকে পুলিশ ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে নিয়ন্ত্রণ’ করবে।
শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাহিনী স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) তৎকালীন মহাপরিচালক ৫ আগস্ট প্রথম প্রহরে (রাত ১২টা ৫৫ মিনিট) বিজিবির মহাপরিচালককে পরপর দুটি হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা পাঠান। সেই বার্তাগুলোর হার্ড কপি পেয়েছে ওএইচসিএইচআর। এসবের তথ্য অনুসারে, প্রথমটি ছিল আন্দোলনের নেতাদের ফরোয়ার্ড করা সম্প্রচারিত বার্তা। এতে তাঁরা ঢাকায় প্রবেশের পথগুলো সম্পর্কে আন্দোলনকারী ছাত্র–জনতাকে জানিয়েছিলেন।
দ্বিতীয় বার্তাটি প্রতিরক্ষা নির্দেশনার রূপরেখার একটি ভিডিও রয়েছে বলে মনে হয়। এতে প্রতিরক্ষার প্রথম ও দ্বিতীয় লাইন, একটি তৃতীয় দূরপাল্লার ইউনিট, একটি ব্যাকআপ ইউনিট, একটি পশ্চাদ্ভাগের বাহিনীর কথা বলা হয়েছে। ৫ আগস্ট সকালে সেনাবাহিনী ও বিজিবির সদস্যরা মূলত দাঁড়িয়েছিলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, তাঁরা অর্পিত ভূমিকা পালন করেননি।
একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সাক্ষ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সেনা মোতায়েন করা হয়নি। আরেকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, বিজিবি প্রতি ঘণ্টায় বিভিন্ন প্রবেশপথ দিয়ে প্রায় ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার বিক্ষোভকারীকে ঢুকতে দিয়েছে, যা তাদের নিয়ন্ত্রণ করার কথা ছিল।
পরিস্থিতি নিয়ে এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ভিডিও ফুটেজে ৫০০ থেকে ৬০০ বিক্ষোভকারী সেনাবাহিনীর বাধা ছাড়াই উত্তরা থেকে ঢাকার কেন্দ্রস্থলের দিকে আসতে দেখে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, কিছু একটা গড়বড় হচ্ছে। চতুর্থ আরেকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে জানান, পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হচ্ছে না।
বিক্ষোভকারীদের শহরের কেন্দ্রস্থলে পৌঁছাতে বাধা দিতে তখনো পুলিশ অনেক জায়গায় গুলি চালাচ্ছিল। পুলিশের একজন কর্মকর্তার ভাষ্য, ‘সেদিন সকাল থেকেই সেনাবাহিনী জানত, শেখ হাসিনার পতন হয়ে গেছে। কিন্তু পুলিশ জানত না। তাই, পুলিশ তখনো সরকারকে রক্ষা করতে সর্বাত্মকভাবে মাঠে ছিল।’
বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের গুলি করার ঘটনা নথিভুক্ত করেছে ওএইচসিএইচআর। সবগুলোর ধরন ছিল একই। চানখাঁরপুলে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের কর্মকর্তারা ও অন্যান্য পুলিশ রাইফেল থেকে প্রাণঘাতী গুলি করেছে। তবে শাহবাগের দিকে অগ্রসর হতে চেষ্টা করা বিক্ষোভকারীদের থামাতে তাঁরা কম প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেছে। একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, পুলিশ যাকে দেখেছিল, তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছিল।
রামপুরা ব্রিজ পার হয়ে বাড্ডায় যাওয়ার চেষ্টাকালে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে ধাতব গুলি ও কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে পুলিশ। এতে শিক্ষার্থী বিক্ষোভকারীরা আহত হন। ওই এলাকায় সকালে গুলিতে আহত বেশ কয়েকজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
আজমপুরে পুলিশের গুলিতে আহত ১২ বছর বয়সী এক বালক বলেছে, পুলিশ ‘সব জায়গায় বৃষ্টির মতো গুলি চালাচ্ছিল।’ কীভাবে সে ওই স্থানে অন্তত এক ডজন মৃতদেহ দেখেছিল, সেই বর্ণনা করেছিল।
সাভারের আশুলিয়ায় পুলিশ বিক্ষোভকারীদের নিবৃত্ত ও আটক করতে প্রাথমিকভাবে তল্লাশিকেন্দ্র (চেকপোস্ট) বসিয়েছিল। যখন আরও বেশি বিক্ষোভকারী দেখা যায়, তখন অন্তত প্রথম দিকে পুলিশ কম প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেছিল। পরে প্রাণঘাতী গুলি ছোড়ে।
আহত বিক্ষোভকারীদের সাহায্য করতে গিয়ে গুলিতে আহত এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, আওয়ামী লীগের সমর্থকেরাও বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালান।
সাভার বাসস্ট্যান্ডের আশপাশে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালায়। এতে বিপুলসংখ্যক হতাহত হন। এক সাংবাদিক এলাকাটির বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তাঁরা তাঁকে বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাঁদের জোর করে মোতায়েন করেছেন। কিন্তু সেই সাধারণ পুলিশ সদস্যরা আরও হতাহতের ঘটনা ঘটাতে চাননি।
ওই এলাকায় গুলি চালানোর ঘটনার আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শীও একটি ছেলের মৃতদেহ দেখেছেন। ছেলেটি ৫ আগস্ট নিহত হয়েছিল। এই প্রত্যক্ষদর্শী ওএইচসিএইচআরকে বলেছেন, ৫ আগস্ট ছিল ‘আমাদের (বিক্ষোভকারীদের) জন্য সবচেয়ে আনন্দের দিন, কিন্তু ছেলেটির মায়ের জন্য সবচেয়ে দুঃখের দিন।’
৫ আগস্ট সকালে যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ ও আনসার সদস্যরা থানা ও এর কর্মকর্তাদের রক্ষায় বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি করার নির্দেশ পান। তাঁরা থানার ভেতর এবং আশপাশে অবস্থান নিয়ে বিপুলসংখ্যক বিক্ষোভকারীর ওপর প্রাণঘাতী রাইফেল ও শটগান দিয়ে গুলি চালায়। তাঁরা ঢাকা মার্চের জন্য জড়ো হয়েছিলেন।
ঘটনাস্থলে মোতায়েন থাকা কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, কিছু বিক্ষোভকারী পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট–পাটকেল নিক্ষেপ করেন। বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারী নিহত হন। বহুসংখ্যক আহত হয়। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন অটিস্টিক ছিলেন, তাঁর শরীরে দুটি গুলি লেগেছিল।
ওই এলাকায় মোতায়েন সেনা ইউনিটগুলো বিকেলের দিকে অল্প সময়ের জন্য পরিস্থিতি শান্ত করলেও পরে তারা সরে যায়। কিছুক্ষণ পরে থানার ফটকের বাইরে অবস্থানরত বিক্ষোভকারীদের ওপর একটি সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। তারপর রাইফেল ও শটগান দিয়ে গুলি চালায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ভিডিও প্রমাণসহ সাক্ষ্যে এই বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, বাঁচার উপায় খুঁজতে গিয়ে অথবা পালিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ কর্মকর্তারা ইচ্ছাকৃতভাবে বেশ কিছু নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীকে কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করেছেন। জনতাকে লক্ষ্য করে তাঁরা এলোপাতাড়ি গুলি চালাচ্ছিল।
৫ আগস্ট বিকেলে শেখ হাসিনার বিদায় উদ্যাপনের সময় কিছু পুলিশ জনতার ওপর প্রাণঘাতী গুলি ছুড়ে। হতাহত ব্যক্তিদের মধ্যে বেশ কয়েকটি শিশুও ছিল।
প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য ও চিকিৎসার নথির বরাতে বলা হয়, উত্তরায় মা–বাবার সঙ্গে ‘বিজয় মিছিলে’ আসা ৬ বছর বয়সী একটি ছেলেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়লে ভিডিও ও ছবিতে আনন্দের মুহূর্তগুলো দেখা যায়।
তবে সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলির শব্দে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। এর ফলে জনতা পালিয়ে যায়। শিশুটির ঊরুতে গুলি লেগেছিল। পরে আহত অবস্থায় হাসপাতালে সে মারা যায়। শিশুটিকে কে গুলি করেছে, তা দেখতে পাননি প্রত্যক্ষদর্শীরা। তবে একজন প্রত্যক্ষদর্শী বিশৃঙ্খল দৃশ্যের বর্ণনা দিয়েছেন। সেখানে নিরাপত্তা বাহিনী সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা থাকতে পারেন বলে ধারণা করা হয়।
কাছাকাছি একটি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন স্টেশন ছিল। কীভাবে পুলিশ কর্মকর্তারা বিক্ষোভ মিছিলের দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম দিকে অবস্থান নিয়েছিল, তা প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় উঠে এসেছে। প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিটি অন্যদের আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে যেতে দেখেন। এর মধ্যে মাথায় গুলিবিদ্ধ আরেকটি ছেলে ছিল।
প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষ্য ও চিকিৎসা-সংক্রান্ত তথ্য অনুযায়ী, উদ্যাপনকালে মিরপুরে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে ১২ বছর বয়সী একটি ছেলে নিহত হয়।
৫ আগস্ট বিকেলে গাজীপুরে ১৪ বছর বয়সী একটি ছেলেকে ইচ্ছাকৃতভাবে গুলিকরে পঙ্গু করা হয়। ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার বিক্ষোভকারীর মূলত একটি শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মিছিল করার সময় তার ডান হাতে গুলি করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, বিক্ষোভকারীরা নিরস্ত্র ছিলেন। তারা কোনো গুরুতর হুমকির কারণ ছিলেন না। নিরাপত্তা বাহিনী কোনো সতর্কতা ছাড়াই গুলি চালাতে শুরু করলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়। আনসার ফটকের কাছের রাস্তা অবরোধকারী জনতা আতঙ্কিত হয়ে পালিয়ে যান।
ফরেনসিক প্রমাণে দেখা যায়, খুব কাছ থেকে ছেলেটিকে শটগানের পেলেট আঘাত করে। পাথর ছোড়ার অভিযোগে তাকে শায়েস্তা করার লক্ষ্য ছিল বন্দুকধারীর। তিনি বলেছিল, ‘তোর এই হাত আর পাথর মারতে পারবে না।’ ছেলেটির ডান হাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৪০টির বেশি শটগানের পেলেট বিদ্ধ হয়। হাড় ও কোষের বেশ ক্ষতি হয়।
আরেকটি ঘটনা ঘটেছে গাজীপুরে। সেখানে পুলিশ কর্মকর্তারা একজন নিরস্ত্র রিকশাচালককে আটক করে তাঁকে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করেন। পুলিশ মরদেহটি টেনে নিয়ে যায়। তারা সেই মরদেহটি আর ফেরত দেয়নি। পরিবার তাদের প্রিয়জনকে দাফন করতে, শোক পালন করতে পারেনি।
ওই রিকশাচালককে গুলি করা পুলিশ কর্মকর্তাকে গত সেপ্টেম্বরে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ভুক্তভোগী ব্যক্তির পরিবারের এক সদস্য ওএইচসিএইচআর-এর কাছে আবেদন জানিয়ে বলেছেন, ‘আমি ন্যায়বিচার, স্বাধীন তদন্ত ও মরদেহ ফেরত চাই।’
এদিকে ৫ আগস্ট বিকেলে বিক্ষোভকারীরা আশুলিয়া থানাকে নিশানা করলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বিপুলসংখ্যক জনতা থানাটি ঘেরাও করে। পুলিশ বারবার পিছু হটার চেষ্টা করলেও তারা ইট–পাটকেল নিক্ষেপ করতে করতে অগ্রসর হতে থাকে। জবাবে পুলিশ প্রাণঘাতী গুলিভর্তি সামরিক রাইফেল ব্যবহার করে নির্বিচার গুলি চালায়।
পুলিশ যখন নিজেদের সরে যাওয়ার পথ পরিষ্কার করার চেষ্টা করেছিল, তখন এলোপাতাড়ি গুলি চলছিল। মারাত্মত সহিংস ব্যক্তিদের নিশানা না করে জনতাকে ভয় দেখানোর জন্য গুলি বেশি করে করা হচ্ছিল বলে মনে হয়। ফলে বিক্ষোভকারী ও পথচারীরা হতাহত হয়। ১৬ বছর বয়সী এক ছাত্রকে খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়, তার মেরুদণ্ডে গুরুতর আঘাত লেগেছিল, তাকে অবশ করে দেয়।
ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশে পুলিশ পরে গুলিবিদ্ধ মৃতদেহগুলো একটি ভ্যানে স্তূপ করে। তারা গাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। মনে হচ্ছিল, তারা কাজটি করেছে এই আশায় যে, মরদেহ পোড়ানোর বিষয়টি এই মিথ্যা ধারণা তৈরি করবে যে, এসব লোক আন্দোলনকারীদের হাতে নিহত হয়েছেন।
গণ-অভ্যুত্থানের মুখে গত বছর ৫ আগস্ট ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে অনিয়ম, দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনে জর্জরিত আওয়ামী লীগের দেড় দশকের বেশি সময়ের শাসনের অবসান ঘটেছে। কিন্তু ততক্ষণে হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। নারী-শিশুসহ হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছে। গতকাল বুধবার প্রকাশিত জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) তথ্যানুসন্ধানী প্রতিবেদনে তার চিত্র উঠে এসেছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে রূপান্তরিত শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবি আদায়ে সেদিন সারা দেশ থেকে ঢাকায় আসার কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল আন্দোলনের সামনে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে ওই দিনের ঘটনা পরম্পরা বর্ণনা করা হয়েছে। সেই কর্মসূচি ঠেকাতে সরকার সেদিন কী কী করেছিল এবং সারা দিন যা যা ঘটেছিল, তার একটি বিবরণ উঠে এসেছে ওএইচসিএইচআরের প্রতিবেদনে।
কর্মসূচি ঠেকাতে পরিকল্পনার জন্য আগের দিন (৪ আগস্ট) তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দুই দফায় উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়। পুলিশের এক কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনার পতনের বিষয়ে পরদিন (৫ আগস্ট) সকাল থেকেই সেনাবাহিনী অবগত ছিল। কিন্তু পুলিশ জানত না বলে সরকারকে রক্ষা করতে তখনো সর্বাত্মকভাবে মাঠে ছিল।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫ আগস্ট ঢাকার কেন্দ্রস্থলে বড় প্রতিবাদ মিছিলের পরিকল্পনার কথা নেতাদের প্রকাশ্য ঘোষণা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য থেকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব জানতে পারেন। বিষয়টি নিয়ে ৪ আগস্ট সকালে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠক করেন। সেখানে সেনা, বিমান, নৌ, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই, পুলিশ ও পুলিশের বিশেষ শাখার প্রধানেরা ছিলেন। হাসিনা সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বৈঠকে অংশ নেন। তাঁরা ‘মার্চ অন ঢাকা’ প্রতিরোধের জন্য আবার কারফিউ জারি ও তা বলবৎ করার বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
বৈঠকের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষণা দেয়, কোনো বিরতি ছাড়াই অনির্দিষ্টকালের জন্য কঠোর কারফিউ চলবে। আন্দোলনকারীদের সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী একটি বিবৃতি দেন। ‘এই সন্ত্রাসীদের শক্ত হাতে দমন’ করতে তিনি দেশবাসীকে আহ্বান জানান।
৪ আগস্ট সন্ধ্যার পর গণভবনে আরেকটি বৈঠক করেন শেখ হাসিনা। সেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, র্যাব ও আনসার/ভিডিপির প্রধান, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার ও সেনাবাহিনীর কোয়ার্টারমাস্টার জেনারেল। বৈঠকে সেনাপ্রধান ও অন্যান্য নিরাপত্তা কর্মকর্তা ঢাকা রক্ষার বিষয়ে আবারও হাসিনাকে আশ্বস্ত করেছিলেন।
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করে বিক্ষোভকারীদের ঢাকার কেন্দ্রস্থলে প্রবেশে বাধা দিতে পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও বিজিবি মোতায়েন করার বিষয়ে বৈঠকে ঐক্যমত্য হয়েছিল। সেনাবাহিনী ও বিজিবি সাঁজোয়া যান ও সেনা মোতায়েন করে ঢাকার প্রবেশের পথগুলো অবরুদ্ধ করবে, বিক্ষোভকারীদের প্রবেশে বাধা দেবে। অন্যদিকে পুলিশ ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে নিয়ন্ত্রণ’ করবে।
শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাহিনী স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) তৎকালীন মহাপরিচালক ৫ আগস্ট প্রথম প্রহরে (রাত ১২টা ৫৫ মিনিট) বিজিবির মহাপরিচালককে পরপর দুটি হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা পাঠান। সেই বার্তাগুলোর হার্ড কপি পেয়েছে ওএইচসিএইচআর। এসবের তথ্য অনুসারে, প্রথমটি ছিল আন্দোলনের নেতাদের ফরোয়ার্ড করা সম্প্রচারিত বার্তা। এতে তাঁরা ঢাকায় প্রবেশের পথগুলো সম্পর্কে আন্দোলনকারী ছাত্র–জনতাকে জানিয়েছিলেন।
দ্বিতীয় বার্তাটি প্রতিরক্ষা নির্দেশনার রূপরেখার একটি ভিডিও রয়েছে বলে মনে হয়। এতে প্রতিরক্ষার প্রথম ও দ্বিতীয় লাইন, একটি তৃতীয় দূরপাল্লার ইউনিট, একটি ব্যাকআপ ইউনিট, একটি পশ্চাদ্ভাগের বাহিনীর কথা বলা হয়েছে। ৫ আগস্ট সকালে সেনাবাহিনী ও বিজিবির সদস্যরা মূলত দাঁড়িয়েছিলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, তাঁরা অর্পিত ভূমিকা পালন করেননি।
একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সাক্ষ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সেনা মোতায়েন করা হয়নি। আরেকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, বিজিবি প্রতি ঘণ্টায় বিভিন্ন প্রবেশপথ দিয়ে প্রায় ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার বিক্ষোভকারীকে ঢুকতে দিয়েছে, যা তাদের নিয়ন্ত্রণ করার কথা ছিল।
পরিস্থিতি নিয়ে এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ভিডিও ফুটেজে ৫০০ থেকে ৬০০ বিক্ষোভকারী সেনাবাহিনীর বাধা ছাড়াই উত্তরা থেকে ঢাকার কেন্দ্রস্থলের দিকে আসতে দেখে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, কিছু একটা গড়বড় হচ্ছে। চতুর্থ আরেকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে জানান, পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হচ্ছে না।
বিক্ষোভকারীদের শহরের কেন্দ্রস্থলে পৌঁছাতে বাধা দিতে তখনো পুলিশ অনেক জায়গায় গুলি চালাচ্ছিল। পুলিশের একজন কর্মকর্তার ভাষ্য, ‘সেদিন সকাল থেকেই সেনাবাহিনী জানত, শেখ হাসিনার পতন হয়ে গেছে। কিন্তু পুলিশ জানত না। তাই, পুলিশ তখনো সরকারকে রক্ষা করতে সর্বাত্মকভাবে মাঠে ছিল।’
বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের গুলি করার ঘটনা নথিভুক্ত করেছে ওএইচসিএইচআর। সবগুলোর ধরন ছিল একই। চানখাঁরপুলে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের কর্মকর্তারা ও অন্যান্য পুলিশ রাইফেল থেকে প্রাণঘাতী গুলি করেছে। তবে শাহবাগের দিকে অগ্রসর হতে চেষ্টা করা বিক্ষোভকারীদের থামাতে তাঁরা কম প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেছে। একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, পুলিশ যাকে দেখেছিল, তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছিল।
রামপুরা ব্রিজ পার হয়ে বাড্ডায় যাওয়ার চেষ্টাকালে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে ধাতব গুলি ও কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে পুলিশ। এতে শিক্ষার্থী বিক্ষোভকারীরা আহত হন। ওই এলাকায় সকালে গুলিতে আহত বেশ কয়েকজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
আজমপুরে পুলিশের গুলিতে আহত ১২ বছর বয়সী এক বালক বলেছে, পুলিশ ‘সব জায়গায় বৃষ্টির মতো গুলি চালাচ্ছিল।’ কীভাবে সে ওই স্থানে অন্তত এক ডজন মৃতদেহ দেখেছিল, সেই বর্ণনা করেছিল।
সাভারের আশুলিয়ায় পুলিশ বিক্ষোভকারীদের নিবৃত্ত ও আটক করতে প্রাথমিকভাবে তল্লাশিকেন্দ্র (চেকপোস্ট) বসিয়েছিল। যখন আরও বেশি বিক্ষোভকারী দেখা যায়, তখন অন্তত প্রথম দিকে পুলিশ কম প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেছিল। পরে প্রাণঘাতী গুলি ছোড়ে।
আহত বিক্ষোভকারীদের সাহায্য করতে গিয়ে গুলিতে আহত এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, আওয়ামী লীগের সমর্থকেরাও বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালান।
সাভার বাসস্ট্যান্ডের আশপাশে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালায়। এতে বিপুলসংখ্যক হতাহত হন। এক সাংবাদিক এলাকাটির বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তাঁরা তাঁকে বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাঁদের জোর করে মোতায়েন করেছেন। কিন্তু সেই সাধারণ পুলিশ সদস্যরা আরও হতাহতের ঘটনা ঘটাতে চাননি।
ওই এলাকায় গুলি চালানোর ঘটনার আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শীও একটি ছেলের মৃতদেহ দেখেছেন। ছেলেটি ৫ আগস্ট নিহত হয়েছিল। এই প্রত্যক্ষদর্শী ওএইচসিএইচআরকে বলেছেন, ৫ আগস্ট ছিল ‘আমাদের (বিক্ষোভকারীদের) জন্য সবচেয়ে আনন্দের দিন, কিন্তু ছেলেটির মায়ের জন্য সবচেয়ে দুঃখের দিন।’
৫ আগস্ট সকালে যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ ও আনসার সদস্যরা থানা ও এর কর্মকর্তাদের রক্ষায় বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি করার নির্দেশ পান। তাঁরা থানার ভেতর এবং আশপাশে অবস্থান নিয়ে বিপুলসংখ্যক বিক্ষোভকারীর ওপর প্রাণঘাতী রাইফেল ও শটগান দিয়ে গুলি চালায়। তাঁরা ঢাকা মার্চের জন্য জড়ো হয়েছিলেন।
ঘটনাস্থলে মোতায়েন থাকা কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, কিছু বিক্ষোভকারী পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট–পাটকেল নিক্ষেপ করেন। বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারী নিহত হন। বহুসংখ্যক আহত হয়। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন অটিস্টিক ছিলেন, তাঁর শরীরে দুটি গুলি লেগেছিল।
ওই এলাকায় মোতায়েন সেনা ইউনিটগুলো বিকেলের দিকে অল্প সময়ের জন্য পরিস্থিতি শান্ত করলেও পরে তারা সরে যায়। কিছুক্ষণ পরে থানার ফটকের বাইরে অবস্থানরত বিক্ষোভকারীদের ওপর একটি সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। তারপর রাইফেল ও শটগান দিয়ে গুলি চালায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ভিডিও প্রমাণসহ সাক্ষ্যে এই বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, বাঁচার উপায় খুঁজতে গিয়ে অথবা পালিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ কর্মকর্তারা ইচ্ছাকৃতভাবে বেশ কিছু নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীকে কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করেছেন। জনতাকে লক্ষ্য করে তাঁরা এলোপাতাড়ি গুলি চালাচ্ছিল।
৫ আগস্ট বিকেলে শেখ হাসিনার বিদায় উদ্যাপনের সময় কিছু পুলিশ জনতার ওপর প্রাণঘাতী গুলি ছুড়ে। হতাহত ব্যক্তিদের মধ্যে বেশ কয়েকটি শিশুও ছিল।
প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য ও চিকিৎসার নথির বরাতে বলা হয়, উত্তরায় মা–বাবার সঙ্গে ‘বিজয় মিছিলে’ আসা ৬ বছর বয়সী একটি ছেলেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়লে ভিডিও ও ছবিতে আনন্দের মুহূর্তগুলো দেখা যায়।
তবে সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলির শব্দে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। এর ফলে জনতা পালিয়ে যায়। শিশুটির ঊরুতে গুলি লেগেছিল। পরে আহত অবস্থায় হাসপাতালে সে মারা যায়। শিশুটিকে কে গুলি করেছে, তা দেখতে পাননি প্রত্যক্ষদর্শীরা। তবে একজন প্রত্যক্ষদর্শী বিশৃঙ্খল দৃশ্যের বর্ণনা দিয়েছেন। সেখানে নিরাপত্তা বাহিনী সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা থাকতে পারেন বলে ধারণা করা হয়।
কাছাকাছি একটি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন স্টেশন ছিল। কীভাবে পুলিশ কর্মকর্তারা বিক্ষোভ মিছিলের দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম দিকে অবস্থান নিয়েছিল, তা প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় উঠে এসেছে। প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিটি অন্যদের আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে যেতে দেখেন। এর মধ্যে মাথায় গুলিবিদ্ধ আরেকটি ছেলে ছিল।
প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষ্য ও চিকিৎসা-সংক্রান্ত তথ্য অনুযায়ী, উদ্যাপনকালে মিরপুরে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে ১২ বছর বয়সী একটি ছেলে নিহত হয়।
৫ আগস্ট বিকেলে গাজীপুরে ১৪ বছর বয়সী একটি ছেলেকে ইচ্ছাকৃতভাবে গুলিকরে পঙ্গু করা হয়। ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার বিক্ষোভকারীর মূলত একটি শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মিছিল করার সময় তার ডান হাতে গুলি করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, বিক্ষোভকারীরা নিরস্ত্র ছিলেন। তারা কোনো গুরুতর হুমকির কারণ ছিলেন না। নিরাপত্তা বাহিনী কোনো সতর্কতা ছাড়াই গুলি চালাতে শুরু করলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়। আনসার ফটকের কাছের রাস্তা অবরোধকারী জনতা আতঙ্কিত হয়ে পালিয়ে যান।
ফরেনসিক প্রমাণে দেখা যায়, খুব কাছ থেকে ছেলেটিকে শটগানের পেলেট আঘাত করে। পাথর ছোড়ার অভিযোগে তাকে শায়েস্তা করার লক্ষ্য ছিল বন্দুকধারীর। তিনি বলেছিল, ‘তোর এই হাত আর পাথর মারতে পারবে না।’ ছেলেটির ডান হাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৪০টির বেশি শটগানের পেলেট বিদ্ধ হয়। হাড় ও কোষের বেশ ক্ষতি হয়।
আরেকটি ঘটনা ঘটেছে গাজীপুরে। সেখানে পুলিশ কর্মকর্তারা একজন নিরস্ত্র রিকশাচালককে আটক করে তাঁকে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করেন। পুলিশ মরদেহটি টেনে নিয়ে যায়। তারা সেই মরদেহটি আর ফেরত দেয়নি। পরিবার তাদের প্রিয়জনকে দাফন করতে, শোক পালন করতে পারেনি।
ওই রিকশাচালককে গুলি করা পুলিশ কর্মকর্তাকে গত সেপ্টেম্বরে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ভুক্তভোগী ব্যক্তির পরিবারের এক সদস্য ওএইচসিএইচআর-এর কাছে আবেদন জানিয়ে বলেছেন, ‘আমি ন্যায়বিচার, স্বাধীন তদন্ত ও মরদেহ ফেরত চাই।’
এদিকে ৫ আগস্ট বিকেলে বিক্ষোভকারীরা আশুলিয়া থানাকে নিশানা করলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বিপুলসংখ্যক জনতা থানাটি ঘেরাও করে। পুলিশ বারবার পিছু হটার চেষ্টা করলেও তারা ইট–পাটকেল নিক্ষেপ করতে করতে অগ্রসর হতে থাকে। জবাবে পুলিশ প্রাণঘাতী গুলিভর্তি সামরিক রাইফেল ব্যবহার করে নির্বিচার গুলি চালায়।
পুলিশ যখন নিজেদের সরে যাওয়ার পথ পরিষ্কার করার চেষ্টা করেছিল, তখন এলোপাতাড়ি গুলি চলছিল। মারাত্মত সহিংস ব্যক্তিদের নিশানা না করে জনতাকে ভয় দেখানোর জন্য গুলি বেশি করে করা হচ্ছিল বলে মনে হয়। ফলে বিক্ষোভকারী ও পথচারীরা হতাহত হয়। ১৬ বছর বয়সী এক ছাত্রকে খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়, তার মেরুদণ্ডে গুরুতর আঘাত লেগেছিল, তাকে অবশ করে দেয়।
ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশে পুলিশ পরে গুলিবিদ্ধ মৃতদেহগুলো একটি ভ্যানে স্তূপ করে। তারা গাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। মনে হচ্ছিল, তারা কাজটি করেছে এই আশায় যে, মরদেহ পোড়ানোর বিষয়টি এই মিথ্যা ধারণা তৈরি করবে যে, এসব লোক আন্দোলনকারীদের হাতে নিহত হয়েছেন।
সব ঠিকঠাক থাকলে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটতে যাচ্ছে সপ্তাহখানেকের মাথায়। এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে দলের গঠনতন্ত্র-ঘোষণাপত্র, সাংগঠনিক কাঠামো, কর্মসূচি-কৌশল ঠিক করা হচ্ছে। দলের নেতৃত্ব মোটামুটি ঠিক হয়ে গেছে।
২৩ মিনিট আগেজুলাই-আগস্টের হত্যা, নৃশংসতার জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের প্রতিবেদনকে প্রামাণ্য দলিল মনে করছেন অন্তর্বর্তী সরকারসংশ্লিষ্ট ও বিচারপ্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অনেকে।
৩৩ মিনিট আগেগণ-অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের ওপর জোর দিচ্ছে। এজন্য গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশন এরই মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তবে সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
৪৩ মিনিট আগেগুমকে পৃথিবীতে মানবতাবিরোধী সবচেয়ে বড় অপরাধ হিসেবে অভিহিত করেছেন গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা। তাঁরা বলেছেন, গুম করা হলে হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তির কোনো চিহ্ন থাকে না। পরিবারের কাছে কেবল তাঁর স্মৃতিটুকু থাকে। তাঁরা গুমের ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবি করেছেন।
১ ঘণ্টা আগে