Ajker Patrika

ভোট ঘিরে বাংলাদেশে সহিংসতার শঙ্কা, সংলাপে যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের ভূমিকা জরুরি

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ০৪ জানুয়ারি ২০২৪, ১৪: ৪৭
ভোট ঘিরে বাংলাদেশে সহিংসতার শঙ্কা, সংলাপে যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের ভূমিকা জরুরি

আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার আবার ক্ষমতায় এলেও তা স্বল্পমেয়াদী হতে পারে। বিরোধীদের কর্মকাণ্ডসহ দলের ভেতরে-বাইরে সহিংসতার শঙ্কাসহ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ বাড়তে পারে। 

এই অচলাবস্থা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে দুই পক্ষকেই ছাড় দিয়ে সংলাপে বসতে হবে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি অংশীদার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সক্রিয় উদ্যোগ নেওয়া উচিত। বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ প্রতিরোধ ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজি) প্রতিবেদনে এসব পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। 

ব্রাসেলসভিত্তিক অলাভজনক স্বাধীন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান আইসিজি আজ বৃহস্পতিবার ‘বিয়ন্ড দ্য ইলেকশন: ব্রেকিং বাংলাদেশ’স পলিটিক্যাল ডেডলক’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বাংলাদেশে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে।

এতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ এখন এক সন্ধিক্ষণে উপনীত। নিখুঁত না হলেও একদা প্রাণবন্ত গণতান্ত্রিক এই দেশ ক্ষমতাসীন সরকারের বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প না থাকলেও শিগগিরই তৃতীয় নির্বাচনে যাচ্ছে। নিজের শর্ত অনুযায়ী শেখ হাসিনার নির্বাচন অনুষ্ঠানের সংকল্প ভোটের আগে ও পরে সহিংসতার ঝুঁকি বাড়াবে। অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক প্রতিকূল পরিস্থিতির পাশাপাশি দলটি যে অভ্যন্তরীণ বিরোধিতার সম্মুখীন হচ্ছে, সে কারণে আওয়ামী লীগের দিক থেকে সমঝোতা চাওয়ার যৌক্তিক কারণ আছে।’

আইসিজি বলেছে, ‘শেখ হাসিনার দল স্বল্পমেয়াদে ক্ষমতা ধরে রাখতে পারে এবং বিরোধী দলগুলোও নিজেদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে নিতে পারে। আর সম্ভাব্য সহিংস প্রতিক্রিয়াসহ আওয়ামী লীগের ওপর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ বাড়তে পারে। এই অচলাবস্থা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে বের করতে দুই পক্ষকে সংলাপে বসতে হবে। প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে সম্পর্ক পুনর্নির্মাণ এবং বাংলাদেশকে গণতন্ত্র শান্তি ও স্থিতিশীলতার পথে ফিরিয়ে আনতে আলোচনার জন্য উভয়পক্ষ থেকে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা প্রয়োজন। বিদেশি অংশীদারদের, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের উচিত দুপক্ষকে সেই পথে যেতে সক্রিয়ভাবে উৎসাহিত করা।’

বাংলাদেশে আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে বিরোধীদের সঙ্গে ছাড়াও ক্ষমতাসীন দলের ভেতরের নানা পক্ষের মধ্যে বড় ধরনের সহিংসতা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক এই প্রতিষ্ঠান। এই মুহূর্তে ভোটগ্রহণ স্থগিত সম্ভব না হলেও নির্বাচনের পরের বিপর্যয়ের কথা মাথা রেখে সরকারকে সংলাপের পথ খোলার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। 

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসা শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধীদের দমিয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রশাসনে পরিণত হয়েছে। জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হিসেবে পাওয়া উত্তরাধিকার ও শক্তিশালী দলীয় কাঠামোর কারণে তিনি ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে ব্যাপক সাফল্য গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর সরকার এক দশকেরও বেশি সময় ধরে শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, উন্নত স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থা ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্প গ্রহণ করেছে। 

কিন্তু যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকার আওয়ামী লীগের সংকল্পের কারণে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধীরে ধীরে অবক্ষয় করছে উল্লেখ করে আইসিজির প্রতিবেদনে বলা হয়, গত এক দশকে আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগ, নিরাপত্তা সংস্থা ও নির্বাচনী কর্তৃপক্ষসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ধরেছেন শেখ হাসিনা। এসব জায়গায় অনুগতদের বসিয়েছেন। তাঁর সরকার বিরোধী কর্মী, সুশীল সমাজের ব্যক্তিত্ব এবং সাংবাদিকদের ওপরও নিপীড়ন চালিয়ে আসছে। 

শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনামলের ক্ষেত্রে ২০১১ সালের সংবিধান সংশোধনীকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, এর ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পথ বন্ধ হয়। এ কারণে বিরোধী দল ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে এবং ২০১৮ সালের ভোটে অংশ নেওয়ার সময় কর্তৃপক্ষের হাতে ক্রমাগত দমন-পীড়নের সম্মুখীন হয়। এ নির্বাচনে ব্যালট বাক্স ভরার ব্যাপক অভিযোগের মধ্যে আওয়ামী লীগসহ ৯৬ শতাংশ আসনে জয়ী হয়। 

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০১৮ সালে নির্বাচনের পর থেকেই দেশে-বিদেশে অসন্তোষ বেড়েছে। অনেক বাংলাদেশির অভিযোগ, ১৫ বছর ধরে তারা বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি। এসব ঘটনা দুই পক্ষের মধ্যেকার বৈরিতা আরও তীব্র করেছে। বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপ নাকচ করে দিয়েছেন শেখ হাসিনা। এদিকে বিএনপি ও তার মিত্ররা অর্থনীতিকে ব্যাহত করতে এবং সরকারকে তাদের নির্বাচনী দাবিতে রাজি হতে বাধ্য করতে হরতাল ও অববোধের ডাক দিয়েছে। 

আইজিসি বলছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ লক্ষ্যে তারা বিরোধীদের দমনে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করছে। বিপরীতে ক্ষমতাসীন দলকে ‘বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন’ আয়োজনে বাধ্য করতে বদ্ধপরিকর বিএনপি। তেমনটা করা হলে জেতারও আশা করছে দলটি। 

আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে। কর্তৃত্ববাদ ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা নিয়ে ক্রমবর্ধমান জন অসন্তোষের মধ্যে বিরোধীদের অনেকটাই শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের ওপর সরকারের দমন-পীড়ন ও বিরোধী দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের গ্রেপ্তার উত্তেজনা বাড়িয়ে দিয়েছে, যা বিরোধীদের নির্বাচন বর্জনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। 

আইসিজির প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৯ সালে সরকার গঠন করা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ ও ২০১৮ সালে নিজ তত্ত্বাবধানে ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজন করে ক্ষমতা ধরে রাখতে বেপরোয়া কর্মকাণ্ড চালিয়েছেন। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকট, বৈদেশিক সম্পর্কের পালাবদল এবং নতুন করে উজ্জীবিত বিরোধী দল আওয়ামী লীগের জন্য আরেকটি একতরফা নির্বাচন করা কঠিন করে তুলেছে। 

ব্রাসেলসভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি বলছে, বিরোধীরা নির্বাচন বর্জন করায় ভোটার উপস্থিতি সম্ভবত কম হতে যাচ্ছে। ব্যালটে তেমন বিশ্বাসযোগ্য কোনো বিকল্প না থাকায় অসন্তুষ্ট বাংলাদেশিরা রাজপথে নামছে ফলে রাজনৈতিক সহিংসতার ঝুঁকিও বাড়ছে। এছাড়া আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষগুলোর মধ্যেও দাঙ্গা-হাঙ্গামা দেখা দিতে পারে।

এ অবস্থায় করণীয় হিসেবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির উচিত ভোটের পর উভয় পক্ষ থেকে ছাড় দিয়ে মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক উত্তেজনা কমানোর লক্ষ্যে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বিদেশি অংশীদারদের উচিত প্রধান দুই দলকে এই বিষয়ে উৎসাহিত করা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত