Ajker Patrika

ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্ত: উচ্চকক্ষে পিআর, গোপন ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন

  • উচ্চকক্ষ হবে ১০০ আসনের। পিআর পদ্ধতিতে আপত্তি বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর।
  • পিএসসি, দুদক, সিএজি ও ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান সংবিধানে রাখা নিয়ে বিএনপির ভিন্নমত।
  • রাষ্ট্রের মূলনীতি ইস্যুতে সংলাপ বর্জন সিপিবি, বাসদ ও বাংলাদেশ জাসদের।
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক। ফাইল ছবি
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক। ফাইল ছবি

বিএনপিসহ কয়েকটি দলের আপত্তি সত্ত্বেও সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের (পিআর) ভিত্তিতে ১০০ সদস্যের উচ্চকক্ষসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তবে রাজনৈতিক ঐকমত্য হওয়ায় আইনসভার উভয় কক্ষের সদস্যদের গোপন ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এবং বাছাই কমিটির মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান নিয়োগের সিদ্ধান্ত দিয়েছে কমিশন। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের সংলাপের সর্বশেষ দিনে এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।

ঐকমত্য কমিশন রাষ্ট্রের চার গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিলেও বিএনপিসহ পাঁচটি দল এতে নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) দেবে বলে জানিয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) এবং ন্যায়পাল।

কমিশনের প্রস্তাব ছিল, উচ্চকক্ষের ১০০ সদস্য নির্বাচিত হবেন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতিক হারে। উচ্চকক্ষের প্রার্থী ঘোষণার ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ নারী রাখার কথাও বলা হয়েছে।

উচ্চকক্ষের ক্ষমতা সম্পর্কে প্রস্তাবে বলা হয়েছে, উচ্চকক্ষের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা থাকবে না। তবে অর্থ বিল ছাড়া অন্য সব বিল উভয় কক্ষে উপস্থাপন করা হবে। উচ্চকক্ষ কোনো বিল স্থায়ীভাবে আটকে রাখতে পারবে না। এক মাসের বেশি বিল আটকে রাখলে সেটিকে উচ্চকক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত বলে গণ্য করা হবে। নিম্নকক্ষ কর্তৃক প্রস্তাবিত বিলসমূহ পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করবে উচ্চকক্ষ এবং নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে তা অনুমোদন অথবা প্রত্যাখ্যান করতে হবে। যদি উচ্চকক্ষ কোনো বিল অনুমোদন করে, তবে উভয় কক্ষে পাস হওয়া বিল রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য পাঠানো হবে। সংবিধান সংশোধন-সংক্রান্ত যেকোনো বিল উচ্চকক্ষের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাস করতে হবে।

সংলাপে ১০০ সদস্যের উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সিংহভাগ দল একমত হলেও আলোচনায় জট লাগে এই কক্ষের সদস্যদের নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে। শেষ পর্যন্ত বিএনপি, লেবার পার্টি, এনডিএম, ১২ দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী জোটের প্রতিনিধিরা জানিয়ে দেন পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ চান না​ তাঁরা।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘পিআর পদ্ধতি হলে উচ্চকক্ষ চাই না।’ তিনি বিষয়টি জাতীয় সনদে উল্লেখ করার অনুরোধ করেন। তবে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা চাই উচ্চকক্ষ গঠিত হবে নিম্নকক্ষের আসনের সংখ্যানুপাতিক হারে। বর্তমান সংরক্ষিত নারী আসন যেভাবে হয় সেভাবে।’

এদিকে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় উচ্চকক্ষের প্রয়োজন নেই বলে জানিয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এবং আমজনতার দল। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) সংলাপে অংশ নেওয়া অন্য দলগুলো কমিশনের প্রস্তাবে একমত বলে জানিয়েছে।

স্পিকারের সভাপতিত্বে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, ডেপুটি স্পিকার (বিরোধী দল থেকে) এবং সংসদের তৃতীয় বৃহত্তম দলের একজন প্রতিনিধির সমন্বয়ে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগে বাছাই কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত দিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। বাছাই কমিটির কাছে সরকারি ও বিরোধী দল থেকে পাঁচজন করে ১০ জন এবং তৃতীয় বৃহত্তম দল দুজনের নাম প্রস্তাব করবে। তারা সর্বসম্মতিক্রমে বা ৪-১ ভোটে প্রধান উপদেষ্টার নাম রাষ্ট্রপতির কাছে প্রস্তাব করবে। এ কমিটি ব্যর্থ হলে আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের দুজন বিচারপতিকে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। তাঁরা র‍্যাকড চয়েজ পদ্ধতিতে ১২ জনের মধ্যে থেকে একজনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। তাতেও ব্যর্থ হলে ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিধান অনুসরণ করা হবে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি প্রধান উপদেষ্টা হতে পারবেন না।

প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের ক্ষেত্রে বাছাই কমিটিতে বিচারপতিদের অন্তর্ভুক্ত করা এবং র‍্যাকড চয়েজ পদ্ধতির বিরোধিতা করেছে বিএনপি।

এদিকে সরকারি কর্ম কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত দিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। বিএনপিসহ পাঁচটি দল ও ১২ দলীয় জোট বিষয়টিতে নোট অব ডিসেন্ট দেবে বলে জানিয়েছে।

আলোচনায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ নিয়োগের জন্য শক্ত আইন করার পক্ষে মত দেন। সংবিধানের নিয়োগ কমিটির বিধান যুক্ত করার বিরোধিতা করেন তিনি।

পরে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, এ বিষয়গুলোতে বিএনপি, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২ দলীয় জোট, এনডিএম ও আমজনতার দল নোট অব ডিসেন্ট দেবে। এদিকে নির্বাচন কমিশন নিয়োগের বিধান সংবিধানে যুক্ত করার বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে আগেই।

আইনসভার উভয় কক্ষের (জাতীয় সংসদ ও উচকক্ষ) সদস্যদের গোপন ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে।

সব রাজনৈতিক দল নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের সম্প্রসারণ, সংরক্ষণ ও বাস্তবায়নের সাংবিধানিক ও আইনগত ভিত্তি দিতে একমত হয়েছে বলে ঘোষণা দিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। তবে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার-সংক্রান্ত বিদ্যমান বিধানের বিস্তারিত আলোচনায় দলগুলো একমত হয়নি জানিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, এই সিদ্ধান্তকে প্রস্তাবনা হিসেবে পরবর্তী সংসদের জন্য সনদে যুক্ত করা হবে।

রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতির অংশে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি উল্লেখ থাকবে বলে সিদ্ধান্ত দেয় কমিশন। তবে নির্বাচনের পরে সংসদ চাইলে বিদ্যমান মূলনীতির স্থলে এগুলো যুক্ত করতে পারবে। আবার কেউ চাইলে বিদ্যমান মূলনীতির সঙ্গে যুক্ত করতে পারবে। তবে এ আলোচনা থেকে ওয়াকআউট করে সিপিবি, বাসদ ও বাংলাদেশ জাসদ।

কমিশন সিদ্ধান্ত দেয়, কারও পরামর্শ বা সুপারিশ ছাড়া রাষ্ট্রপতি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য; তথ্য কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য, প্রেস কাউন্সিল চেয়ারম্যান, আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ দিতে পারবেন। শেষ দুটোর বিষয়ে আপত্তি জানাবে বিএনপি, এলডিপি, লেবার পার্টি, এনডিএম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, ১২ দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট। গভর্নর নিয়োগের বিষয়ে আপত্তি নাগরিক ঐক্যের।

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রধান এবং মৌলিক দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর উল্লেখ করেছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেছেন, পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনবোধে এই বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার জন্য সুনির্দিষ্টভাবে বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে ঐকমত্য কমিশন সবাইকে নিয়ে প্রয়োজনে বসবে।

দ্বিতীয় ধাপের সংলাপে ২০টি বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। গতকাল রাতে সাড়ে নয়টার পরে দ্বিতীয় ধাপের সংলাপের সমাপ্তি টানেন আলী রীয়াজ।

সংলাপ শেষে দলগুলো জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের সঙ্গে ফটোসেশনে অংশ নেন। অনেক দলের নেতাদের কমিশনের সদস্যদের আলাদা আলাদা ছবি তুলতে দেখা যায়। নেতারা পারস্পরিক কথাবার্তা বলেন ও শুভকামনা ব্যক্ত করেন। অনেক নেতাকে কমিশনের সহযোগীদের সঙ্গেও কথা বলতে দেখা যায়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত