Ajker Patrika

আইএফএমের ঋণ: শর্ত কঠোর হচ্ছে

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ০৩ নভেম্বর ২০২২, ০০: ০৭
আইএফএমের ঋণ: শর্ত কঠোর হচ্ছে

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ পাওয়া নিয়ে আলোচনা যতই গড়াচ্ছে, ততই তাদের শর্ত কঠোর হচ্ছে। দেশের খেলাপি ঋণ আর রিজার্ভ গণনার ব্যাপারে দিন দিন কঠোর অবস্থান নিচ্ছে ঋণদাতা এ সংস্থাটি। গতকাল বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকে আইএমএফের সফররত প্রতিনিধিরা ঋণের দর-কষাকষিতে কোনো নমনীয়তা দেখাননি। বরং কেন বাংলাদেশে ঋণখেলাপি বাড়ছে বা তা কমানো যাচ্ছে না কেন, খেলাপি কমাতে কতটা কঠোর হতে পারছে ব্যাংকগুলো, ঋণ-আমানতের সুদের হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হলে কী প্রভাব পড়বে–এসব ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্পষ্ট বক্তব্য জানতে চেয়েছেন তাঁরা।

একই সঙ্গে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গণনার ধরন কী রকম, তা আরও স্পষ্ট করা যায় কীভাবে—এসব ব্যাপারেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্পষ্ট বক্তব্য জানতে চেয়েছেন আইএমএফের কর্মকর্তারা। পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে ভর্তুকি নিয়ে কঠোর মনোভাব দেখিয়েছেন তাঁরা। কারণ, এসব দর-কষাকষির পরই প্রস্তাবিত সাড়ে ৪ বিলিয়ন বা ৪৫০ কোটি ডলার ঋণের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে সংস্থাটি।

গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে বৈঠকে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের আইএমএফ মিশনপ্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধিদলের সদস্যরা মিশনের হালনাগাদ তথ্য অবহিতকরণ সময় উল্লিখিত শর্ত বাস্তবায়নে জোর তাগিদ দেন। এ সময় গভর্নরের পক্ষ থেকে বিষয়গুলো পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের আশ্বাস দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন সূত্র থেকে এ বিষয়ে জানা গেছে।

শর্তের ব্যাপারে আইএমএফের কঠোর মনোভাব নিয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আইএমএফের শর্ত খুব একটা কঠিন নয়। এগুলো চাইলে সরকার বাস্তবায়ন করতে পারে। এতে একটা সমস্যা হলো, হঠাৎ করে খেলাপি বেড়ে যাবে। আবার রিজার্ভ কম দেখাবে। এতে তো কোনো সমস্যা নেই। বরং বাস্তবায়ন করলে অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক হবে। এখন সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে সবকিছু।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে। গত জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অবলোপন করা প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। পাশাপাশি অর্থঋণ আদালতে বিভিন্ন ব্যাংকের ১ লাখ ৫৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা আটকা রয়েছে। আর খাতসংশ্লিষ্টদের দাবি, ঋণ পুনঃ তফসিলের আড়ালে বিপুল পরিমাণ অর্থ আটকা রয়েছে। এসবের জন্য দায়ী ঋণ ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, যা দেশের ব্যাংকিং খাতে মারাত্মক সমস্যা। এ বিষয়গুলোই শক্তভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে আইএমএফ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র আরও জানায়, গত কয়েক দিন অনুষ্ঠিত বৈঠকের বিভিন্ন নথি থেকে প্রাপ্ত বিষয় সম্পর্কে আইএমএফের কর্মকর্তারা গভর্নরকে অবহিত করেন এবং প্রয়োজনীয় সংস্কারের তাগিদ দেন। এসব বিষয়ের মধ্যে অন্যতম হলো রিজার্ভ হিসাবে আন্তর্জাতিক এ সংস্থাটি বিপিএম–৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) পদ্ধতি অনুসরণ, ঋণঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় সংস্কার, মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণ হ্রাস, ঋণে সুদ হারের সীমা বাতিল, ফরেন এক্সচেঞ্জ রেট, ব্যাংক পরিচালনা পরিষদ গঠনে চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের তদবির, অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ মঞ্জুর, বিভিন্ন ব্যাংকের অনিয়মের বিরুদ্ধে গৃহীত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টর সাপোর্ট প্রজেক্ট বাস্তবায়ন, ব্যাংক সুপারভিশন, ব্যাংক কোম্পানি আইন, ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন আইনসহ কয়েকটি আইনের সংস্কার এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে ভর্তুকি বাতিল।

গভর্নরের সঙ্গে আইএমএফের কর্মকর্তাদের বৈঠক প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক জি এম আবুল কালাম আজাদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, এ বিষয়ে তাঁর পক্ষে মন্তব্য করা সম্ভব নয়।

তবে একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে আজকের পত্রিকাকে বলেন, আইএমএফের শর্ত দেশের আর্থিক খাতের জন্য ভালো। এগুলো করতে পারলে ব্যাংকিং খাতের সমস্যা দূর হতো। আর রিজার্ভ গণনার বিষয়ে তো হারানোর কিছু নেই। শুধু গণনার পার্থক্য। এখন সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর নির্ভর করছে এসব বাস্তবায়নের বিষয়।

জানা গেছে, বর্তমানে ডলারের ভিন্ন ভিন্ন দর রয়েছে। গত মঙ্গলবার থেকে ব্যাংকগুলো জোটবদ্ধ হয়ে প্রবাসী আয়ে প্রতি ডলারের দাম ৫০ পয়সা কমিয়ে সর্বোচ্চ দাম দিচ্ছে ১০৭ টাকা। আর রপ্তানিকারকদের দেওয়া হয় ব্যাংকভেদে ১০৪ থেকে ১০৫ টাকা। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করছে ৯৭ টাকা। আইএমএফ ডলারের দাম বাজারের ওপরে ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে। এই নিয়ে নিয়মিত পরামর্শ দিচ্ছে সংস্থাটি।

বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ব্যাংকগুলো এত দিন এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে ডলার কেনায় ১০৭ টাকা ৫০ পয়সা দর দিয়ে আসছিল। নতুন করে তা ১০৭ টাকা করা হয়েছে।

এদিকে সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের ভর্তুকি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও সংস্কার চেয়েছে আইএমএফ। আর চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে মোট ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ রেখেছে সরকার। ভর্তুকির বেশির ভাগই জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের জন্য রাখা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত