Ajker Patrika

গুম কমিশনের প্রতিবেদন

৫ আগস্টের পরও গুমকে অস্বীকার করা হচ্ছে

আমানুর রহমান রনি, ঢাকা 
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে গুমের ঘটনায় সত্য ও জবাবদিহির পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকারের অস্বীকারের সংস্কৃতি। আওয়ামী লীগ ধারাবাহিকভাবে গুমকে অস্বীকার করেছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পরিবর্তনের পরও এই অস্বীকারের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হচ্ছে; কারণ, অনেক অভিযুক্ত এখনো ক্ষমতার কেন্দ্রে। ফলে প্রমাণ নষ্ট, সাক্ষীর ভয়ভীতি, তদন্তে বাধা ও ভয়ভীতির পরিবেশ এখনো রয়েছে।

গুমসংক্রান্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে এসব অভিযোগ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত সরকারের ভয়ের সংস্কৃতি ভেঙে সত্য তুলে ধরতে কমিশনকে বিকল্প পদ্ধতি অনুসরণ ও অনুসন্ধান করতে হয়েছে। অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে ১ হাজার ৮০০ অভিযোগের মধ্যে ২৫৩ জনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে, গুম ছিল পদ্ধতিগত। তাঁদের গুম হওয়ার সময় সাধারণ ডায়েরি বা মামলার মাধ্যমে নিখোঁজ হওয়া নথিভুক্ত ছিল এবং ফিরে আসার সময় তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় মামলা হয়েছে; যার অর্থ তাঁরা রাষ্ট্রীয় হেফাজতে ছিলেন। তাঁদের অনেকেই নির্জন কারাগারে একে অপরকে দেখেছেন এবং তাঁদের অভিজ্ঞতা একই ধরনের, যদিও তাঁরা একে অপরকে চিনতেন না।

এ বিশ্লেষণ থেকে প্রতীয়মান হয়, শেখ হাসিনার শাসনামলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছত্রচ্ছায়ায় গুম পদ্ধতিগতভাবে সংঘটিত হয়েছে। উগ্রবাদের হুমকি ব্যবহার করে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা, বৈশ্বিক স্বীকৃতি আদায় এবং দমন-পীড়নের বৈধতা তৈরি করা হয়েছে। বিচারব্যবস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনীকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে এবং নির্যাতন ও গোপন বন্দিশালাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের হোলি আর্টিজান হামলাও রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। উগ্রবাদ কোনো একশ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। অথচ তৎকালীন সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করতেই উগ্রবাদের ছায়া ব্যবহার করেছে। গুম, মিথ্যা মামলা, বিচারবহির্ভূত হত্যা—এসবই আইন ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।

প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, গুমের শিকার ব্যক্তিরা বিভিন্ন বয়স, পেশা ও রাজনৈতিক পরিচয়ের হলেও তাঁদের অভিজ্ঞতা প্রায় এক। বেশির ভাগই তৎকালীন বিরোধী দলের কর্মী ছিলেন এবং নির্যাতনের সময় তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়েই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পৃক্তরাও গুম হয়েছেন অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে।

গুমের এই ভয়াবহ বাস্তবতা শুধু ভুক্তভোগীদের নয়, রাষ্ট্রের নিরাপত্তাব্যবস্থাকেও দুর্বল করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে দোষীদের উপস্থিতি গোয়েন্দা ঝুঁকিও তৈরি করেছে। গুম কোনো রাজনৈতিক পক্ষের একক সমস্যা নয়, এটা জাতীয় মানবাধিকার ও নিরাপত্তার ইস্যু।

ক্রুসিফাইড হওয়ার মতো বেঁধে রাখা আয়নাঘরে গুমের শিকার এক নারী কমিশনে দেওয়া তাঁর অভিযোগে নির্যাতনের কথা ব্যাখ্যা করেছেন। ওই নারী অভিযোগ করেন, অনেকটা ক্রুসিফাইড হওয়ার মতো করে তাঁর হাত দুই দিকে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখছে। তার ওড়নাও নিয়ে নিয়েছিল। তাঁর গায়ে কোনো ওড়না নিতে দেয়নি। জানালার দিকে মুখ করে তাঁকে রাখা হয়েছিল, পুরুষেরা এসে তাঁকে দেখে যেত। তারা বলাবলি করত, এমন পর্দাই করছে, এখন সব পর্দা ছুটে গেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকার সমাজের সর্বস্তরে একটি ভয়ের সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছিল। এখন সময় এসেছে এই ভীতির সংস্কৃতি নির্মূল করার।

গুম কমিশনের প্রধান দুই সুপারিশ কমিশন সরকারকে তাদের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে প্রধান দুটি সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে একটি হলো—অতীত সংশোধনমূলক এবং অপরটি ভবিষ্যতের করণীয় নির্ধারণ।

অতীতের ভুল সংশোধন: দ্রুত বিচারপ্রক্রিয়ায় গুম হওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিগত সরকারের দায়ের করা মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করা উচিত বলে মনে করে কমিশন। কমিশন প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, হাজার হাজার মিথ্যা মামলা হয়েছে। এসব মামলার নিষ্পত্তি হওয়া জরুরি। কারণ, প্রতিটি মামলা পরিচালনায় ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে সাত লাখ টাকা ব্যয় করতে হয়; যা তাদের পরিবারের বার্ষিক ব্যয়ের দ্বিগুণ।

কমিশন দাবি করেছে, সন্ত্রাসবিরোধী আইনে হওয়া মামলা এক বছরের মধ্যে বিচার শেষ করার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। তাই কমিশন প্রস্তাব করেছে, এক বছরের মধ্যে বিচার শেষ না করতে পারলে সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালকে বাধ্যতামূলকভাবে আদেশ দিতে হবে—মামলা বন্ধ ও অভিযুক্তকে অব্যাহতি দেওয়া হোক।

এ ছাড়া ট্রাইব্যুনালগুলোকে দ্রুত অতীতের মামলার বিচারপ্রক্রিয়া শেষ করা। বিচারকদের মধ্যে গুম ও নির্যাতনের বিষয়গুলো জানাতে হবে। তাঁদের সচেতন করতে হবে।

কমিশন তার প্রতিবেদন উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা কোনো প্রতিকার নয়, বরং এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি শাস্তিমূলক প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে। এমনকি পাতানো প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে যাবজ্জীবন অথবা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

ভবিষ্যতের জন্য করণীয়: সন্ত্রাসবাদ দমনে দেশি মডেল তৈরি করা কমিশনের সদস্যরা দেশের ঊর্ধ্বতন পুলিশ ও সেনা গোয়েন্দাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে কমিশন নিশ্চিত হয়েছে, বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদ দমনে প্রতিরোধ ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় যে মডেল অনুসরণ করে, তা সঠিক নয়। কোনো কোনো অভিজ্ঞ পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা এ নিয়ে নিজেরাও হতাশ। কারণ, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীনির্ভর ও নিরাপত্তাকেন্দ্রিক কৌশল সম্পূর্ণভাবে অনুসরণ করছে, যা মূলত বিদেশি তহবিল ও প্রশিক্ষণের প্রভাব দ্বারা চালিত—যেহেতু এই মডেলটি স্থানীয় বাস্তবে পরীক্ষিত নয়। তাঁরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, এই আন্তর্জাতিক তহবিলের জন্য বিদেশি মডেল অনুসরণ করতে হচ্ছে, যা বাংলাদেশের বাহিনীগুলোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও জনমতের প্রতি সম্পৃক্ততা কমিয়ে দিচ্ছে। এই মডেল বাংলাদেশে কার্যকর কি না, তা গভীরভাবে দেখা উচিত। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে নিজেদেরই একটি মডেল তৈরি করতে হবে। যেমন মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া করেছে। তারা তাদের বিভিন্ন সম্প্রদায়, কমিউনিটি, ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে একটি মডেল তৈরি করে সফল হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত