Ajker Patrika

কালোটাকা সাদা করার সুযোগ জুলাই অভ্যুত্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক: সিপিডি

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আজ মঙ্গলবার রাজধানীর গুলশানে অবস্থিত লেকশোর হোটেলে বাজেট নিয়ে পর্যালোচনা তুলে ধরে সিপিডি। ছবি: আজকের পত্রিকা
আজ মঙ্গলবার রাজধানীর গুলশানে অবস্থিত লেকশোর হোটেলে বাজেট নিয়ে পর্যালোচনা তুলে ধরে সিপিডি। ছবি: আজকের পত্রিকা

জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের অন্যতম দাবি ছিল বৈষম্যবিলোপ। অথচ সেই আন্দোলনের পর গঠিত সরকারের দেওয়া বাজেটে বিভিন্ন ক্ষেত্রে রয়ে গেছে বৈষম্যের ছাপ। প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট পর্যালোচনা করে এমন মতই দিয়েছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।

অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ গতকাল সোমবার বাজেট উপস্থাপন করেছেন। এর পরদিন আজ মঙ্গলবার রাজধানীর গুলশানে অবস্থিত লেকশোর হোটেলে বাজেট নিয়ে নিজেদের পর্যালোচনা তুলে ধরে সিপিডি।

প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে জমি ও ফ্ল্যাট কেনায় নির্দিষ্ট হারে কালোটাকা বৈধ করার সুযোগ অব্যাহত রাখা হয়েছে।

‘জাতীয় বাজেট ২০২৫-২৬: সিপিডির পর্যালোচনা’ শীর্ষক আয়োজনে নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘সিপিডি সব সময়ই বলে এসেছে—অপ্রদর্শিত অর্থ, অর্থাৎ কালোটাকা বৈধ করার সুযোগ পুরোপুরি বন্ধ করা উচিত। এটি নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য এবং সৎ করদাতাদের নিরুৎসাহিত করার শামিল। এ প্রস্তাবটি বাজেট থেকে প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি। এ প্রস্তাব বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা সৃষ্টি করে, যা বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে বাজেট ঘোষণার মূল অঙ্গীকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’

কালোটাকা সাদা করার বিষয়ে সিপিডির অবস্থান তুলে ধরে ফাহমিদা খাতুন আরও বলেন, এটা বৈষম্যবিরোধী জুলাই বিপ্লবের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই আন্দোলনের প্রতি সম্মান জানাতে হলে বাজেট থেকে এই বিতর্কিত প্রস্তাব প্রত্যাহার করা জরুরি।

উদাহরণ দিয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, আবাসন খাতের মূল্য অনেক বেশি। এর কারণ এই অপ্রদর্শিত অর্থ। এই অর্থ সেই খাতে সেটার দাম বাড়িয়ে দেয়। ফলে যাঁরা বৈধভাবে আয় করেন তাঁদের জন্য একটা অ্যাপার্টমেন্ট কেনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এতে সমাজে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। জুলাই আন্দোলন হয়েছিল বৈষম্যহীন সমাজের জন্য। বাজেটের প্রত্যয়টা বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করার, সেটার সঙ্গে এ প্রস্তাব চরমভাবে সাংঘর্ষিক।

করকাঠামো বিন্যাসের ক্ষেত্রেও বাজেটে বৈষম্য করা হয়েছে বলে মত দেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক। তিনি বলেন, ‘বাজেটে প্রবৃদ্ধির বদলে সামগ্রিক উন্নয়ন ও অবকাঠামোর বদলে মানুষের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার যে কথা বলা হয়েছে, কিছু কিছু উদ্যোগ তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে মনে করে সিপিডি। করকাঠামো বিন্যাস করতে গিয়ে ছয়টি শ্রেণি করা হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, নিম্নবিত্ত মানুষের করহার বেশি হবে; কিন্তু উচ্চবিত্তদের কম পড়বে। এটা বৈষম্যমূলক।’

সারা দেশে অঞ্চলভেদে যে ৫ হাজার টাকার করসীমা করা হয়েছে, এটিও বৈষম্যের মধ্যে পড়ে বলে জানান ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, রাজধানী ঢাকা এবং অন্যান্য জেলায় সেবার সমান সুযোগ থাকে না।

উন্নয়ন বাজেটের আকার নিয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, উন্নয়ন বাজেটের আকার এবার ছোট করা হয়েছে। তবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষিতে উন্নয়ন ব্যয় কমানো উদ্বেগজনক।

প্রস্তাবিত বাজেটে বেশ কিছু ইতিবাচক দিক থাকলেও সামগ্রিকভাবে চলমান অর্থনৈতিক সংকট আমলে নেওয়া হয়নি বলে মন্তব্য করেন ফাহমিদ খাতুন। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের সংকট মোকাবিলায় এসব সংকট আমলে নেওয়া দরকার ছিল। বিশেষ করে রাজস্ব-সংক্রান্ত বেশ কিছু উদ্যোগ বাজেটে ঘোষিত সমতামুখী ও টেকসই উন্নয়ন কাঠামোর ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

ফাহমিদা খাতুন আরও বলেন, বাজেটে পাচার করা অর্থ সম্পর্কে স্পষ্ট খতিয়ান উপস্থাপন করা হয়নি। একদিকে কালোটাকা বৈধ করার প্রস্তাব, অন্যদিকে অর্থ পাচার নিয়ে নীরবতা—সরকারের ঘোষিত নীতির সঙ্গে এর বৈপরীত্য রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

ভবিষ্যতে করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে ৩ লাখ থেকে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকায় উন্নীত করার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে সিপিডি। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য তহবিল গঠনের সিদ্ধান্তকেও সাধুবাদ জানায় সংস্থাটি।

অন্যদিকে শিল্পের ক্ষেত্রে কিছু ভালো উদ্যোগ লক্ষ্য করা গেছে বলে জানায় সিপিডি। তবে তারা মনে করে, ক্ষতি পোষাতে সাশ্রয়ী ঋণ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির তুলনামূলক সস্তা সরবরাহ থাকা দরকার।

প্রস্তাবিত বাজেটে যুক্তরাষ্ট্রকে আমদানি শুল্ক-করহার পর্যায়ক্রমে হ্রাস এবং দেশটির ১১০টি পণ্যের আমদানি শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হযেছে। পাশাপাশি ৬৫টি পণ্যের আমদানি শুল্ক হ্রাস,৯টি পণ্যের সম্পূরক শুল্ক সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার এবং ৪৪২টি পণ্যের সম্পূরক শুল্ক হ্রাস করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

এভাবে শুল্ক প্রত্যাহার করা হলে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নিয়ম অনুযায়ী তা অন্যান্য দেশকেও দিতে হবে বলে জানান সিপিডির নির্বাহী পরিচালক। তিনি বলেন, ‘তা করতে না পারলে বৈষম্য হবে। আবার সবাইকে সুযোগ দিলে বিশাল রাজস্ব হারাবে সরকার। এজন্য রাজস্ব আদায়ে দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। তাই ভালোভাবে বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’

অনুষ্ঠানে সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাজেটের মূল দর্শন হওয়া উচিত ছিল রাজস্বনীতির মাধ্যমে আয়বৈষম্য হ্রাস। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের আন্দোলনেও এটি প্রধান দাবি হিসেবে উঠে এসেছে। বাজেটে কর ও অন্যান্য নীতির মাধ্যমে বৈষম্য কমানোর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। ফলে নীতিগত দিক থেকে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত মেলে না।

অনুষ্ঠানে সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান, গবেষণা ফেলো মুনতাসীর কামাল, সৈয়দ ইউসুফ শাহাদাত প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত