Ajker Patrika

আজকের পত্রিকার অনুসন্ধান /বন খেল সরকার, চিংড়ি বারোভূতে

  • চকরিয়া সুন্দরবন ধ্বংস করে ৫৮৭ চিংড়িঘের
  • নীতিমালা ভেঙে সাবলিজ, নিয়ন্ত্রণ নেই মৎস্য বিভাগের
  • স্লুইসগেটে কর্মকর্তার বাণিজ্য: সিন্ডিকেটের চাঁদাবাজি, মাছ লুট
  • ঘেরজুড়ে ডাকাত-সন্ত্রাসীর দৌরাত্ম্য
সাইফুল মাসুম, চকরিয়া (কক্সবাজার) থেকে ফিরে
আপডেট : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৫: ১২
Thumbnail image
এই জায়গায় একসময় বনভূমি ছিল। সেখানে ছিল কেওড়া, বাইন, সুন্দরীর মতো শ্বাসমূলীয় গাছপালা। এ কারণেই এটি পরিচিত ছিল ‘চকরিয়া সুন্দরবন’ নামে। কিন্তু এখন বনের ছিটেফোঁটাও নেই। উজাড় হওয়া সেই বনভূমিতে এখন হয় চিংড়ির চাষ। সম্প্রতি কক্সবাজারের চকরিয়ায়। ছবি: আজকের পত্রিকা

‘আমার একটি নদী ছিল’র মতো হৃদয়স্পর্শী আরেকটি গান হতে পারে- ‘চকরিয়ায় একটি সুন্দরবন ছিল’। এই বনের আয়তন ছিল সাড়ে ৪৫ হাজার একর; আসল সুন্দরবনের প্রায় ৭ ভাগের এক ভাগ। এই বনেও ছিল কেওড়া, বাইন, সুন্দরীর মতো শ্বাসমূলীয় গাছপালা। বনে ঘুরে বেড়াতো হরিণ, বানর, বাঘ। নদী-খালের নোনাজলে ছিল মাছ, কাঁকড়া, কুমির। এই চকরিয়া সুন্দরবনও দেশের একটি বিশাল জনপদকে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচিয়ে দিত নিজের বুক পেতে। কিন্তু আজ আর কিছুই নেই।

কেন নেই? কীভাবে নেই? কারা ‘নেই’ করল সব? প্রশ্নগুলো মাথায় নিয়ে মাঠে নেমেই জানা যায়, মানুষের হাতেই ধ্বংসের সূত্রপাত এই সুন্দরবনের। আর ধ্বংসের ষোলোকলা পূর্ণ করে অন্য কেউ নয়, দেশের মানুষ ও সম্পদ দেখভালের দায়িত্ব নেওয়া সরকারগুলোই। নিজেদের সমর্থকগোষ্ঠী প্রভাবশালী লোকজনের কাছে ইজারা দিয়ে সেখানে চিংড়ি চাষের ব্যবস্থা করে উজাড় করা হয় আস্ত একটা সুন্দরবন। একটা দেশের সরকারের হাতে প্রকৃতি ধ্বংসের এমন ন্যক্কারজনক ঘটনার কথা আগেই জানা গেলেও গত তিন মাসের অনুসন্ধানে আমরা খুঁজে দেখেছি, এখন সেখানে কী চলছে! দেখা গেছে, একসময় যে মাটিতে দৃঢ় শ্বাসমূল-ঠেসমূলের ওপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ছিল ম্যানগ্রোভ গাছের গহিন বন; এখন সেখানে শুধুই নোনাপানির ঘের আর তার গভীরে ঘটে চলা অনিয়ম-দুর্নীতি আর দখল-রাহাজানির এক কালো অধ্যায়।

উপকূলের এই দ্বিতীয় প্রহরীখ্যাত কক্সবাজারের চকরিয়া সুন্দরবনে প্রথম সরকারি কোপ পড়ে ১৯৭৮ সালে। দেশে চিংড়ি চাষ প্রসারের কথা বলে রামপুর মৌজায় প্যারাবনের (এই অঞ্চলের ম্যানগ্রোভ বন) বেশির ভাগ জমি ইজারা দেয় তখনকার বিএনপি সরকার। পরে ১৯৮৬ সালে এরশাদ সরকার আবার সেই ইজারা বাতিল করে নতুন করে দুই দফায় মোট ৭ হাজার একর বনভূমি ইজারা দেয়। ইজারাদাররা যার যার অংশের বন উজাড় করে মাটি কেটে পাড় বেঁধে তৈরি করেন চিংড়ি ঘের। ২ থেকে ৫ ফুট গভীরতার সেই সব ঘের এখনো আছে; কিন্তু যে উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল, তা প্রায় ভেস্তে গেছে। ঘের ব্যবস্থাপনার জন্য নীতিমালা করা হলেও তা রয়ে গেছে কাগজেই। ইজারাদাররা কেউ চিংড়ি চাষ না করে নীতিমালা ভেঙে ঘেরগুলো অন্যদের কাছে সাবলিজ দিয়ে অর্থ আয় করছেন। ঘের ঘিরে গড়ে উঠেছে সন্ত্রাসী চক্র। সব আমলে ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে সন্ত্রাসীরা সেখানে ‘যা খুশি তাই’ করে চলেছে। আর সব অপকর্মের দোসর হয়ে ফায়দা লুটছে মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। অনুসন্ধানকালে চকরিয়া চিংড়ি ঘেরের ১৫ জন ইজারদার; সাবলিজ নেওয়া ৫০ জন চিংড়ি চাষি; মৎস্য অধিদপ্তরের ১০ জন কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ঘের সংশ্লিষ্ট অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা হয়েছে আজকের পত্রিকার এই প্রতিবেদকের।

নীতিমালার পাত্তা নেই

চকরিয়ার বদরখালী এলাকার বাসিন্দা জয়নাল আবেদীন খান বেসরকারি সংস্থা ‘উবিনীগ’-এর কক্সবাজার জেলার আঞ্চলিক সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করছেন। তিনি তাঁর শৈশবে ঘাস সংগ্রহকারীদের সঙ্গে একাধিকবার বনে ঢুকেছেন। তিনি বলেন, তখন এই চকরিয়া সুন্দরবন ঘিরে অনেক মানুষের জীবিকা নির্বাহ হতো। এখন তো বনের কোনো চিহ্নই নেই। তিনি জানান, উবিনীগ ১৯৯৩ সালে মহেশখালী চ্যানেল ও মাতামহুরী নদীর ৭ কিলোমিটার এলাকায় গাছ লাগিয়েছিল। সেগুলোরও বেশির ভাগ উজাড় করে ঘের করা হয়েছে।’

চকরিয়া বন বিভাগের তথ্য অনুসারে, স্বাধীনতার পর চকরিয়া সুন্দরবনের আয়তন ছিল ২১ হাজার একর। এর মধ্যে সংরক্ষিত বনভূমি ছিল ১৮ হাজার ৫০০ আর রক্ষিত বনভূমি (মালিকানায় জেলা প্রশাসন, ব্যবস্থাপনায় বন বিভাগ) ছিল ২ হাজার ৫০০ একর। পরে মৎস্য অধিদপ্তরসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরকে হস্তান্তর করা হয় প্রায় সাড়ে ১২ হাজার একর। সেই হিসাবে কাগজে অবশিষ্ট বনভূমি থাকার কথা সাড়ে ৮ হাজার একর। তবে চকরিয়া সুন্দরবনের রেঞ্জ কর্মকর্তা মেহারাজ উদ্দিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বাস্তবে এখানে আর কোনো বনভূমি নেই। সব জবরদখল ও উজাড় হয়ে গেছে। রেঞ্জ অফিস থাকলেও আমাদের কোনো কার্যক্রম নেই।’

মূলত মৎস্য অধিদপ্তরের কাছে হস্তান্তর করা বনভূমিতেই চিংড়ি চাষের পরিকল্পনা করা হয়। ১৯৭৮ সালে চকরিয়ার রামপুর মৌজায় চিংড়ি এস্টেটের কার্যক্রম শুরু হয়। ঘেরের ইজারা ও ব্যবস্থাপনা চলে দুটি আলাদা প্রকল্প ও অফিস আদেশের মাধ্যমে। পরে ঘের পরিচালনায় প্রথম নীতিমালা করা হয় ২০১১ সালে। ২০১৩ সালে সেটা সংস্কার করা হয়। নীতিমালায় বলা আছে, প্রকৃত চিংড়ি চাষিরাই শুধু ইজারা পাবেন। এ ক্ষেত্রে মৎস্য বিজ্ঞানে ডিপ্লোমাধারী, গ্র্যাজুয়েট বা প্রশিক্ষিত বেকার যুবক ও যুবতিরা অগ্রাধিকার পাবেন। ইজারাপ্রাপ্ত জমি কোনো অবস্থাতেই অন্য কারও কাছে বর্গা, সাবলিজ বা বন্ধক দেওয়া যাবে না।

কিন্তু ইজারাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের তালিকা যাচাই করে দেখা গেছে, অধিকাংশই চিংড়ি চাষের সঙ্গে জড়িত নন এবং তাঁরা ক্ষমতাধর রাজনীতিক ও আমলা বা তাদের আশীর্বাদপুষ্ট লোকজন। তাদের বড় অংশের ঠিকানা কক্সবাজারের বাইরে ঢাকাসহ অন্যান্য অঞ্চলে। নীতিমালায় সাবলিজ দিলে ইজারা বাতিলের কথা স্পষ্টভাবে বলা থাকলেও গত ৩৯ বছরে কাউকে নোটিশ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। অথচ অনুসন্ধানকালে একজন মূল ইজারাদারকেও ঘেরে চিংড়ি চাষ করতে দেখা যায়নি। তবে এ রকম দুই-চারজন আছেন বলে শোনা গেছে। হাতেগোনা এই ক’জন বাদে আর সবাই যার যার ঘের সাবলিজ দিয়ে দিয়েছেন। আর এসব ঘটছে মৎস্য অধিদপ্তরের নাকের ডগায়। অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে চিংড়ি চাষিদের হাতে কলমে প্রশিক্ষণ প্রদান, উন্নত পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা থাকলেও সরেজমিনে এ ধরনের কোনো কার্যক্রম চোখে পড়েনি। নীতিমালা বাস্তবায়নেও তাদের কোনো তৎপরতা নেই। অধিদপ্তরের প্রদর্শনী ঘেরে আগে অফিস থাকলেও এখন তা নেই।

ইজারা পেয়েছেন কারা

নথি ঘেঁটে দেখা যায়, ১৯৭৮ সালে জিয়া সরকারের নির্দেশে ৩৯ জন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে চিংড়ি চাষের জন্য চকরিয়া সুন্দরবনের প্রায় পাঁচ হাজার একর বনভূমি ইজারা দেয় মৎস্য অধিদপ্তর। তখন ১৭ জনকে দেড় শ’ ও ২২ জনকে এক শ’ একর করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। পরের বছর একই উদ্দেশ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আর্থিক সহযোগিতায় আরও দুই হাজার একর প্যারাবন ১১ একর করে ১১৯টি প্লটে ভাগে করে ১১৯ ব্যক্তিকে ইজারা দেওয়া হয়।

পরে ১৯৮৬ সালে এরশাদ সরকারের আমলে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (আইডিএ) প্রকল্পের আওতায় পাঁচ হাজার একরে আগের ৩৯ জনের ইজারা বাতিল করা হয় এবং ১০ একর করে ৪৬৭ প্লটে ভাগ করে ইজারা দেওয়া হয়। এর মধ্যে ৩২৫ ব্যক্তি ও ৪২টি প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন পায় ৪৫১টি প্লট। মামলা ও বিরোধের কারণে ১৬টি প্লটের ইজারা বাতিল অবস্থায় আছে। মৎস্য অধিদপ্তরের ৪৮ একরের প্রদর্শনী প্লটসহ ১০ একরের ঘের এলাকায় মোট ৪৬৮টি প্লট রয়েছে। প্রথম মেয়াদে ১০ বছর, দ্বিতীয় মেয়াদে ১৫ বছর আর তৃতীয় মেয়াদে ২০ বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হয়। ইজারায় প্রতি একরের জন্য বার্ষিক রাজস্ব ধরা হয় ২ হাজার টাকা করে। পাঁচ বছর পরপর ২ শতাংশ হারে রাজস্ব বৃদ্ধির কথাও বলা আছে নীতিমালায়।

তালিকা ঘেঁটে দেখা যায়, ১০ একরের ৪৮ নং প্লট ইজারা পেয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক ও কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি সিরাজুল মোস্তফা। ১০৯ নং প্লট ইজারা পেয়েছেন কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য ও বড়ইতলি ইউপি চেয়ারম্যান এটিএম জিয়াউদ্দিন চৌধুরীর স্ত্রী ইয়াছমিন চৌধুরী জলি। ২২০ নং প্লট পেয়েছেন কক্সবাজার জেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি প্রয়াত জালাল আহমেদ চৌধুরীর ছেলে এম রেজাউল করিম চৌধুরী। ৩৩৬ নং প্লট কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সালাহ উদ্দিন আহমদ; ৩৩৩-৩৩৫ তিনটি প্লট ডুলাহাজারা ইউপির দুইবারের চেয়ারম্যান ও চকরিয়া উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মো. মিজানুর রহমান চৌধুরী (খোকন মিয়া); ৩৩৯-৩৪১ তিনটি প্লট চিরিংগা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান এম সালাহ উদ্দিন; ৩২৭-৩২৯ প্লট তিনটি বিএনপি মাতামুহুরি সাংগঠনিক উপজেলা সভাপতি জামিল ইব্রাহিম চৌধুরী।

১১ একরের ৩৪ নং প্লট ইজারা পেয়েছেন সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক সংসদ সদস্য খোরশেদ আরা হক। ৪৩ নং প্লট চকরিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান জাহানারা পারভীন; ৬২ নং প্লট মহেশখালী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোছাইন ইব্রাহীম; ১১৮ নং প্লট ইজারা পেয়েছেন চকরিয়া-পেকুয়া আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির (জেপি-মঞ্জু) প্রেসিডিয়াম সদস্য এ এইচ সালাউদ্দিন মাহমুদ।

জানা গেছে, এফবিসিসিআই এর তালিকাভুক্ত ‘বাংলাদেশ ১০-১১ একর চিংড়ি প্রজেক্ট মালিক অ্যাসোসিয়েশন’ নামে চকরিয়া চিংড়ি ঘেরের ইজারাদারদের একটি সংগঠন রয়েছে। সংগঠনটির সভাপতির দায়িত্বে আছেন রাবেয়া আজিজ। তিনি ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত এম এ আজিজের স্ত্রী। ইজারা পাওয়া প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ মৎস্য ও পশুসম্পদ ফাউন্ডেশন। ১০ একর চিংড়ি এস্টেটের ৪৩৮-৪৬৭ নম্বরের ৩০টি প্লটে মোট ৩০০ একর ইজারা পেয়েছে এই ফাউন্ডেশন।

চুক্তি করে সাবলিজ

দফায় দফায় চকরিয়ায় গিয়ে যে ৫০ জন চিংড়ি চাষির সঙ্গে কথা হয়, তারা কেউ ইজারাদার নন। বছরে ঘেরপ্রতি দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত চুক্তিতে সাবলিজ নিয়ে তারা চিংড়ি চাষ করছেন। সাবলিজের ১৫টি চুক্তিপত্র সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। ১০০ ও ৫০ টাকার স্ট্যাম্পে বেশির ভাগ চুক্তিপত্রে লেখার ধরন একই। ১০ একর চিংড়ি ঘেরের ১০০ নম্বর প্লটের ইজারাদার বাঁশখালীর বাসিন্দা জাফর আহমদ। চকরিয়ার করাইয়াঘোনার বাসিন্দা জসিম উদ্দিনকে লিখিত চুক্তির মাধ্যমে প্লটটি তিনি সাবলিজ দিয়েছেন। এর জন্য বছরে এক লাখ ৪০ হাজার টাকা দেওয়ার চুক্তি হয়। দুই বছরের অগ্রিম টাকাও নেন জাফর। জানতে চাইলে জাফর আহমদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘টাকার প্রয়োজন হওয়ায় কয়েক বছরের সাবলিজ দিয়েছি।’

২১৭ ও ২১৮ নম্বর প্লটে ১০ বছর ধরে চিংড়ি চাষ করেন চকরিয়ার ছোঁয়াফাড়ি এলাকার বাসিন্দা আব্দুল মালেক (৪২)। তিনি জানান, প্লট দুটি মূলত তার মামা হেলাল সওদাগর ২০০৯ সাল সাবলিজ নিয়েছেন। ২০১৪ সালে মামার কাছ থেকে তিনি প্লট দুটো বর্গা নেন। আব্দুল মালেক জানান, প্রতি বছর সাবলিজের দুই লাখ করে চার লাখ টাকা তার মামা হেলালের মাধ্যমে মূল ইজারাদারদের কাছে পাঠিয়ে দেন। সাবলিজের দুই লাখ টাকা, চাঁদা, মাটিকাটা ও চিংড়ি চাষ বাবদ ১০ একরের একটি ঘেরে বছরে প্রায় ছয় লাখ টাকা খরচ হয়। মাছের উৎপাদন ভালো হলে খরচ বাদে পাঁচ লাখ টাকারও বেশি লাভ থাকে।

২১৭ নং প্লটের ইজারাদার দেওয়ান জহির আহমেদ ও ২১৮ নম্বর প্লটের ইজারাদার কুতুবদিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এটিএম নুরুল বশর চৌধুরী। দেওয়ান জহির আহমেদের বাড়ি হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে হলেও তিনি চকরিয়ার চিরিংগা ইউনিয়নের ঠিকানা দিয়েছেন। কারণ জানতে চাইলে বলেন, আগে চকরিয়ায় তিনি লবণের ব্যবসা করতেন। ১০ একর ঘেরের ৩ নম্বর প্লটের ইজারা পেয়েছেন ঢাকার শ্যামপুরের বাসিন্দা ও সোনালী ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বেগম রাশেদা আউয়াল। ১৯৮৬ সালে সরকারি ব্যাংকে চাকরি করা অবস্থায় তিনি চিংড়ির প্লট ইজারা পান। তাঁর ঘেরে চিংড়ি ও লবণ চাষ করেন বদরখালীর বাসিন্দা গিয়াসউদ্দিন। তিনি জানান, ছোঁয়াফাড়ির হাবিবুর রহমান থেকে বছরে চার লাখ ৬৫ হাজার টাকায় ঘের সাবলিজ নিয়েছেন। রাশেদা আউয়ালের সঙ্গে তাঁর কোনো যোগাযোগ নেই।

সাবলিজ দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে রাশেদা আউয়াল বলেন, ‘এ রকম অনেকেই করে।’ তাঁর প্লটে কে চিংড়ি চাষ করে প্রশ্ন করলে তিনি নাম বলতে পারেননি। চকরিয়া চিংড়ি ঘেরে ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত বিভিন্ন দায়িত্বে ছিলেন মৎস্য কর্মকর্তা খন্দকার হাবিবুর রহমান। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘সব ভুয়া লোকজনকে ইজারা দেওয়া হয়েছে। কেউ রাজনৈতিক প্রভাবে, কেউ টাকা পয়সা দিয়ে ইজারা পেয়েছেন। যে উদ্দেশ্যে চিংড়ির ঘের করা হয়েছে, তার কিছুই হয়নি। ইজারাদাররা সবাই সাবলিজ দিয়ে টাকা খাচ্ছে।’

ঘের দখলের পালা

চকরিয়া চিংড়ি ঘেরে দিনের চিত্র এক রকম, রাতের চিত্র আরেক রকম। ঘের দখল আর মাছ লুট নিয়মিত ঘটনা। একটি সশস্ত্র ডাকাত বাহিনীও গড়ে উঠেছে এখানে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতারা। তাই সরকার বদলের পর দখলের চিত্রও পাল্টে যায়। রেহাই পায়নি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিষ্ঠানের চিংড়ি ঘেরও। জানা গেছে, ২০২১ সালের ৫ জুলাই রাতে গ্রামীণের ঘের দখল করে নেয় আওয়ামী লীগের এমপি জাফর আলমের বাহিনী। ওই ঘটনায় মারধরের শিকার হওয়া ফাউন্ডেশন কর্মী কবির আহমেদ (৫২) আজকের পত্রিকাকে বলেন, সন্ত্রাসীরা তিনতলা ভবনের অনেক ক্ষয়ক্ষতি করেছে। ঘরভর্তি মালামাল ছিল, সব নিয়ে গেছে। দখলের পর ওই ঘর হয়ে ওঠে ডাকাতদের আস্তানা। তবে ৫ আগস্ট সরকার বদলের পর দখলমুক্ত হয় গ্রামীণের ঘেরগুলো।

তবে এখনো বেদখলে রয়েছে অনেক প্লট। ১০ একরের ২৪২ নং প্লটের ইজারাদার নারায়ণগঞ্জের দেওভোগের বাসিন্দা নাছরিন আক্তার জানান, করোনার পর থেকে জাফর আলমের সাঙ্গপাঙ্গরা তাঁর প্লট দখল করে রেখেছে। সেখানে তারা ঘরও তুলেছে। ২৩৬ নম্বর প্লট সাবলিজ নিয়ে চিংড়ির চাষ করেন শাহানবিল ইউনিয়নের কোরালখালীর বাসিন্দা নুরুল আলম। তিনি বলেন, প্রতি জোতে ডাকাতদের প্লটপ্রতি এক হাজার টাকা করে দিতে হয়। মাসে দুইবার টাকা না দিলে ওরা মাছ লুট করে নিয়ে যায়।

সম্প্রতি জাহাঙ্গীর নামে এক ডাকাত সরদার গ্রেপ্তার হয়েছে। চকরিয়া থানা-পুলিশের তালিকাভুক্ত ডাকাতের মধ্যে আরও আছে আব্দুস সালাম, নেজাম উদ্দিন, মো. ইব্রাহিম, আব্দুল জলিল, রুহুল আমিন, আব্দুল কাদের, রায়হান মিয়া, আব্দুর সবুর, পুতু মেম্বার, সোহেল অন্যতম। গত ১৫ বছর এই ডাকাতদের পৃষ্ঠপোষকতা করার অভিযোগ রয়েছে সাবেক সংসদ সদস্য জাফর আলমের বিরুদ্ধে। সরকার বদলের পর আত্মগোপনে থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে তার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু মুছা বলেন, কিছু নেতা ও জনপ্রতিনিধি জাফর আলমের নাম ব্যবহার করে নিজেরা ঘের দখল করেছে।’

৫ আগস্টের পর চকরিয়ার চিংড়ি ঘের নিয়ন্ত্রণে কয়েকজন বিএনপি নেতা জড়িয়ে পড়েছেন বলে জানা গেছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান চৌধুরী (খোকন মিয়া), বিএনপি মাতামুহুরি সাংগঠনিক উপজেলার সভাপতি জামিল ইব্রাহিম চৌধুরী, উপজেলা বিএনপির সদ্য সাবেক সদস্যসচিব ফখরুউদ্দিন ফরাজী, নজরুল ইসলাম (ব্যাঙ নজরুল), আলী আহমেদ। জানতে চাইলে ফখরুউদ্দিন ফরাজী আজকের পত্রিকাকে বলেন, বিগত সরকারের সময় সাধারণ মানুষের চিংড়ির প্লট বেদখল ছিল। এখন তা পুনরুদ্ধার করা হয়েছে।

স্লুইস গেটে সিন্ডিকেট

চকরিয়ার চিংড়ি এস্টেটে বয়ে যাওয়া নদী-খালে ২৭টি স্লুইচ গেট আছে। জোয়ার-ভাটার সময় এসব গেট দিয়ে চিংড়ি ঘেরে নোনা পানি যাওয়া-আসা করে। ২০-২৫টি ঘেরের জন্য একটি করে গেট। নীতিমালায় বলা আছে, ঘেরগুলোর ইজাদাররা কমিটি করে স্লুইচ গেটের ব্যবস্থাপনা ঠিক করবেন। কিন্তু ইজারাদাররা যেহেতু চিংড়ি চাষ থেকে দূরে, ঘেরগুলো তারা সাবলিজ দিয়ে রেখেছেন; তাই সেখানে কোনো বৈধ কমিটি তৈরি হয়নি। আর এই সুযোগে গেটগুলো কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এক শক্তিশালী সিন্ডিকেট। তারা বিভিন্ন অজুহাতে স্থানীয়দের স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে গার্ড পদে আবেদন করিয়ে মৎস্য অধিদপ্তর থেকে নিয়োগ আদায় করে। পরে তাদের মাধ্যমেই স্লুইস গেটগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চাঁদাবাজি, মাছ লুটের মতো অবৈধ কর্মকাণ্ডে মেতে ওঠে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই গার্ড নিয়োগে মোটা অঙ্কের ঘুষ লেনদেন হয়। এ রকম পাঁচটি কাগজ আজকের পত্রিকার কাছে এসেছে, যেখানে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে গার্ড নিয়োগের কথা লেখা আছে। কাগজগুলোতে স্বাক্ষর রয়েছে কক্সবাজার চিংড়ি চাষ সম্প্রসারণের আঞ্চলিক মৎস্য কর্মকর্তা তৌফিকুল ইসলামের। কাগজগুলো মৎস্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দেখালে তাঁরা জানান, এভাবে গার্ড নিয়োগের কোনো আইনি ভিত্তি নেই।

অনুসন্ধান বলছে, গার্ড নিয়োগের নামে আসলে অতি গুরুত্বপূর্ণ স্লুইচ গেটগুলোকে একধরনের ইজারা দিয়ে রেখেছেন মৎস্য কর্মকর্তারা। একেকটি স্লুইস গেটের ‘ইজারা মূল্য’ বছরে দুই থেকে ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত। যারা ইজারা নেন, তারা গেটে নিষিদ্ধ বিন্দিজাল বসিয়ে মাছ ধরেন। বদরখালী এলাকার এক বাসিন্দা জানান, তিনি চার লাখ টাকা দিয়ে এক বছরের জন্য স্লুইস গেট ইজারা পেয়েছেন। আরেক ‘ইজারাদার’ বজল কবির বলেন, আঞ্চলিক মৎস্য কর্মকর্তা তৌফিককে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা দিয়ে স্লুইচ গেট নিলেও তিনি এখনো দখলে যেতে পারেননি। এই মৎস্য কর্মকর্তা তৌফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে ইজারা বাতিল হওয়া কিছু প্লটে মৌখিক ইজারা দিয়ে টাকা কামাইয়ের অভিযোগও আছে। শাহানবিল ইউনিয়নের কোরালখালীর বাসিন্দা চিংড়ি চাষি জুনায়েদ ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ইজারা বাতিল হওয়া ১০ একর ঘেরের ৩১৮, ৩১৯ ও ৩২০ নম্বর প্লট মৌখিক ইজারা দিয়ে ২০২৩ সালে তার কাছ থেকে দুই লাখ টাকা নেন তৌফিক। ২০২৪ সালের জন্য আবার দুই লাখ টাকা নিলেও সরকার বদলের সুযোগে ওই তিনটি প্লট অন্য আরেক ব্যক্তিকে মৌখিক ইজারা দেন তৌফিক। জুনায়েদ বলেন, ‘তৌফিক সাহেব কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে হাঁটতে হাঁটতে আমার হাত থেকে টাকাটা নিয়েছেন। অনেক সময় তিনি টাকা সংগ্রহে ব্যবহার করেছেন চকরিয়ার আলমগীর ও মারুফ নামের দুই দালালকে।’

আটজন চিংড়ি চাষি গত ১৫ সেপ্টেম্বর তৌফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন। তবে মৎস্য অধিদপ্তর এখনো তদন্ত শুরু করেনি। জানতে চাইলে অভিযোগকারীদের একজন রায়হান কাইছার রিগান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘তৌফিক সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যোগসাজশ রেখে কৌশলে টাকা আদায় করেন। তার আর্থিক অবস্থা নিয়ে তদন্ত করলেই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে।’ এই অভিযুক্ত কর্মকর্তা তৌফিক তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে একই পদে রয়েছেন।

অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করলে আঞ্চলিক মৎস্য কর্মকর্তা তৌফিকুল ইসলাম বলেন, ‘অস্থায়ী গার্ড নিয়োগের আবেদনপত্রে প্রথমে কয়েকটিতে স্বাক্ষর করেছি। পরে আর কাউকে দিইনি। কিন্তু পরে অনেকে আমার স্বাক্ষর নকল করে নিয়োগের কাগজ বানিয়ে নিয়েছে।’

‘আপনার স্বাক্ষরিত গার্ড নিয়োগের কাগজগুলো; ঘের মৌখিক ইজারা দিয়ে টাকা নেওয়া এবং চিংড়ি চাষিদের কাছ থেকে মাছ আদায়ের মেসেজ আদান-প্রদানের স্ক্রিনশট আমাদের কাছে আছে’ জানালে তিনি ফোন কেটে দেন। পরে আবার হোয়াটসঅ্যাপে কল করে বলেন, ‘আগের এমপি জাফর আলম অনেক বিষয়ে রিকোয়েস্ট করত। চাকরি বাঁচাতে কিছু রিকোয়েস্ট রাখতে হতো। না রাখলে ওই এলাকায় যাওয়াও সমস্যা হতো।’ এরপর তৌফিক বলেন, ‘যদি কোনো কিছু করা লাগে, কক্সবাজার আইসেন আমি চেষ্টা করব। বদির রিসোর্ট আছে। আপনার ভালোই লাগবে। কাজ করতে গেলে অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি তো হয়ই।’

মৎস্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক (চিংড়ি) মো. আয়নাল হক বলেন, ‘দুর্নীতির কিছু তথ্য-প্রমাণ পাওয়ার পর তৌফিককে এমন কাজ করা থেকে বিরত থাকতে বলেছি।’ পদাধিকার বলে চিংড়ি ঘেরের স্লুইচ গেটসহ অবকাঠামো ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি চকরিয়ার ইউএনও। কিন্তু কমিটিতে দায়িত্বে থাকার বিষয়ে কিছুই জানেন না- দাবি করেছেন সদ্য সাবেক ইউএনও মো. ফখরুল ইসলাম।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ইজারাদাররা শর্তভঙ্গ করে সাবলিজ দেওয়ায় চিংড়ি ঘেরে সরকারের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হয়নি। ইজারা পুনর্মূল্যায়ন করে প্রকৃত চিংড়ি চাষি রেখে বাকিদের ইজারা বাতিল করা উচিত। যারা বিশ্বাসভঙ্গ করে সাবলিজ দিয়েছে, শাস্তির পাশাপাশি তাদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা উচিত। অনিয়মের সঙ্গে সরকারের যে কর্তাব্যক্তিরা জড়িত, তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।’ ভবিষ্যতে চিংড়ি ঘের যেন দুর্নীতির ক্ষেত্র হয়ে না ওঠে, তা আইনে যুক্ত করা যেতে পারে বলে এই আইনজ্ঞের মত। সার্বিক বিষয় অবগত করে জানতে চাইলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার ‘খোঁজ নেবেন’ বলে জানান। (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর দুর্নীতিবিষয়ক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ফেলোশিপ-২০২৪ এর আওতায় প্রতিবেদনটি করা হয়েছে।)

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত