আজকের পত্রিকা ডেস্ক
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা নতুন করে আলোচনায় এসেছে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের ভিত্তিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে ঐকমত্য ও ভিন্নমত তৈরি হয়েছে, তা ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রব্যবস্থার গতিপথ নিয়ে নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। মূল প্রস্তাব ছিল প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা কমানো। কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানো। কিন্তু যে পরিমাণ ঐকমত্য হয়েছে, তাতে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কতটা কমবে এবং সংস্কারের মূল উদ্দেশ্য কতটা সফল হবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
বাংলাদেশের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর পদটি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং দেশের শাসনব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর হাতেই নির্বাহী ক্ষমতার প্রায় সবটুকু কেন্দ্রীভূত থাকে। সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ পর্যালোচনা করলে এই একচ্ছত্র ক্ষমতার চিত্রটি স্পষ্ট হয়।
সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা
বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চম অধ্যায়ে সরকারের নির্বাহী বিভাগ সম্পর্কে বিস্তারিত বলা আছে। এখানে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও দায়িত্বের মূল ভিত্তিগুলো আলোচনা করা হলো:
নির্বাহী ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু (অনুচ্ছেদ ৫৮): সংবিধান অনুযায়ী, প্রজাতন্ত্রের সব নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত। রাষ্ট্রপতি এই ক্ষমতা প্রয়োগ করেন প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে। এর ফলে, যদিও রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের প্রধান, কিন্তু কার্যত তিনি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া কোনো কাজ করতে পারেন না। একমাত্র প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মেনে চলতে হয়।
মন্ত্রিসভার প্রধান (অনুচ্ছেদ ৫৮(২)): প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার প্রধান। তিনি মন্ত্রীদের নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দেন। মূলত, প্রধানমন্ত্রী যাকে চান, তিনিই মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। মন্ত্রিসভার সব বৈঠক ও সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে নেওয়া হয়।
আইন প্রণয়নে প্রভাব (অনুচ্ছেদ ৬৫): প্রধানমন্ত্রী যেহেতু সংসদ নেতা এবং তাঁর দল সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল, তাই সংসদীয় আইন প্রণয়নে তাঁর প্রভাব অপরিসীম। সরকারি বিলগুলো প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বেই উত্থাপিত ও পাস হয়।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ (অনুচ্ছেদ ৪৮(৩)): অ্যাটর্নি জেনারেল, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার, সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান এবং সদস্যসহ গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদগুলোতে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেন, কিন্তু এই নিয়োগের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক। ফলে, এসব পদে কারা আসবেন, তা কার্যত প্রধানমন্ত্রীই নির্ধারণ করেন।
প্রতিরক্ষা বাহিনীর ওপর কর্তৃত্ব (অনুচ্ছেদ ৬১): বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হলেন রাষ্ট্রপতি। তবে, সংবিধান অনুযায়ী, এই ক্ষমতা আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। বাস্তবে, প্রধানমন্ত্রীই প্রতিরক্ষা বাহিনীর ওপর চূড়ান্ত কর্তৃত্ব বজায় রাখেন।
সংবিধান সংশোধনে ভূমিকা: সংবিধান সংশোধনের জন্য সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতাসীন দলের প্রধান, তাই তার নেতৃত্বেই সংবিধান সংশোধন সম্ভব হয়।
অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞ মনে করেন, বাংলাদেশের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর হাতে এত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। এর ফলে সংসদ, বিচার বিভাগ এবং অন্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই ভারসাম্যহীনতার কারণে প্রায়ই সরকার এবং প্রধানমন্ত্রীর একক সিদ্ধান্তই রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়।
এই একচ্ছত্র ক্ষমতা থেকে বেরিয়ে এসে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে সংবিধান সংস্কারের দাবি উঠেছে। তবে সংবিধানে এখন পর্যন্ত যে বিধানগুলো আছে, তাতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের সরকারপ্রধানদের তুলনায় অনেক বেশি ক্ষমতা উপভোগ করেন।
প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতার লাগাম টানার চেষ্টা: যতটুকু ঐকমত্য
ঐকমত্য কমিশন এবং বিভিন্ন দলের মধ্যে আলোচনার পর কিছু বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকার মেয়াদ নির্দিষ্ট করে দেওয়া। সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, একজন ব্যক্তি জীবনে সর্বোচ্চ দুই মেয়াদে বা মোট দশ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন। এটি ভবিষ্যতে কোনো একক ব্যক্তির দীর্ঘস্থায়ী ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রবণতা রোধে সহায়ক হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
এ ছাড়া, নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের ক্ষেত্রে একটি নতুন পদ্ধতির প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকারি দল, বিরোধী দল এবং বিচার বিভাগের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত একটি বাছাই কমিটি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এবং অন্য কমিশনারদের নাম সুপারিশ করবে। তবে এই বাছাই কমিটি সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হলে পরবর্তী প্রক্রিয়া কী হবে তা নিয়ে ঐকমত্য হয়নি। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব হলো, এরপর দুজন বিচারপতি এই বাছাই কমিটিতে যুক্ত হবেন। এরপর সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের ভিত্তিতে বাছাই চূড়ান্ত করা হবে। তাঁরাও সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হলে র্যাঙ্কড চয়েস ভোটিং পদ্ধতি অনুসরণের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিএনপি এর বিরোধিতা করে এই পরিস্থিতিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সংসদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে।
রাষ্ট্রপতির হাতে সরাসরি কিছু সাংবিধানিক পদে নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন, প্রেস কাউন্সিল এবং আইন কমিশন অন্তর্ভুক্ত। জরুরি অবস্থা জারির ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রীর একক সিদ্ধান্তের বদলে মন্ত্রিসভার অনুমোদন বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এই পদক্ষেপগুলো আপাতদৃষ্টিতে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সামান্য হলেও হ্রাস করবে।
ভিন্নমতের দেয়াল: যেসব প্রস্তাব আটকে আছে
তবে, মূল প্রস্তাবগুলোর অনেকগুলোতেই বিএনপিসহ কয়েকটি দলের ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা ভিন্নমত রয়েছে, যা সংস্কারের সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা কমাতে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের প্রস্তাব করেছিল, যা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগের দায়িত্ব পালন করবে। কিন্তু বিএনপি এবং অন্যান্য দলের আপত্তির কারণে সেই প্রস্তাব বাদ দিয়ে কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়, যেখানেও তাদের আপত্তি ছিল। বিএনপি মনে করে, এ ধরনের কমিটি নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা দুর্বল করে দেবে।
সবচেয়ে বড় ভিন্নমত দেখা গেছে প্রধানমন্ত্রীর একই সঙ্গে একাধিক পদে থাকা সংক্রান্ত প্রস্তাবে। যেখানে বলা হয়েছিল, কোনো ব্যক্তি একই সময়ে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের পদে থাকতে পারবেন না, সেখানেও বিএনপিসহ কয়েকটি দল আপত্তি জানিয়েছে। বিএনপি মতে, সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধানমন্ত্রী মনোনয়নের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা থাকতে হবে, এর সঙ্গে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কোনো বিরোধ তাঁরা দেখছেন না। এই ভিন্নমতের কারণে, দলটি ক্ষমতায় এলে এই সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এ ছাড়া, সংসদের উচ্চকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতির মাধ্যমে সদস্য নির্বাচনের প্রস্তাবেও বিএনপির ভিন্নমত রয়েছে। তারা নিম্নকক্ষের প্রাপ্ত আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষে আসন বণ্টনের পক্ষে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির মতো দলগুলো সংসদ নির্বাচনে মোট প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে (পিআর) উচ্চকক্ষে তাদের প্রতিনিধি পাঠাতে চায়।
আবার সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন বা বাতিলেও আশানুরূপ সিদ্ধান্ত আসেনি। ‘ব্যক্তিগত স্বার্থে’ সংসদ সদস্যরা বিক্রি হয়ে যেতে পারেন, যেটিকে বলে ফ্লোর ক্রসিং—এই আশঙ্কা এবং ‘গণতন্ত্রের সঙ্গে স্থিতিশীল সরকার দরকার’—এমন অজুহাতে এই অনুচ্ছেদ বহাল রাখা পক্ষে অনেকে।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, একজন সংসদ সদস্য যদি সংসদে দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দেন, নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেন অথবা দল থেকে পদত্যাগ করেন, তাহলে তাঁর সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়ে যাবে।
এর মাধ্যমে দলের ভোটে জিতে আসা একটি রাজনৈতিক দলকে কার্যত আনচ্যালেঞ্জড থাকার গ্যারান্টি দেওয়া হয়। অবশ্য আস্থা ভোট ও অর্থ বিল বাদে সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবেন— এ বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। এটি বিএনপিরই প্রস্তাব ছিল।
সংবিধানের ৮১ অনুচ্ছেদের আলোচ্য বিষয় অর্থবিল। সরকার যদি উন্নয়নের জন্য কোনো ঋণ গ্রহণ করে এবং এই সম্পর্কিত কোনো বিল সংসদে উত্থাপন করে তাহলে সেই বিলকে অর্থবিল বলে। বাজেটের মধ্যে যে ঋণ থাকে সেটি অর্থবিল। বাজেট নিজেও অর্থবিল। শুল্ক ও কর এবং সাংবিধানিক পদধারীদের বেতন সম্পর্কিত বিলগুলোকেও অর্থবিল বলা হয়।
সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির প্রধান ভূমিকা
বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রপতি হলেন রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক প্রধান। সংসদীয় গণতন্ত্রে তিনি প্রতীকী প্রধান হিসেবে কাজ করেন, অর্থাৎ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদটি তাঁর হলেও বেশির ভাগ নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত থাকে। সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও ভূমিকা স্পষ্ট করে।
সংবিধানে নির্দিষ্ট ক্ষমতা
রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক প্রধান (অনুচ্ছেদ ৪৮): রাষ্ট্রপতি হলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান এবং রাষ্ট্রের অন্য সব ব্যক্তির ঊর্ধ্বে তাঁর স্থান। তিনি সংবিধান ও আইন অনুযায়ী তাঁকে দেওয়া সব ক্ষমতা প্রয়োগ করেন এবং দায়িত্ব পালন করেন।
সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক (অনুচ্ছেদ ৬১): রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। যদিও তাঁর এই ক্ষমতা আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং বাস্তবে এটি প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকে।
ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতা (অনুচ্ছেদ ৪৯): এটি রাষ্ট্রপতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা। তিনি যেকোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষের দেওয়া দণ্ডাদেশের মার্জনা, স্থগিত, হ্রাস বা মওকুফ করতে পারেন।
যেসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সীমিত
বাংলাদেশের সংবিধান সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা অনুসরণ করে। এ কারণে রাষ্ট্রপতিকে তাঁর বেশির ভাগ দায়িত্ব পালনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মেনে চলতে হয়। সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি শুধুমাত্র দুটি ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন:
১. প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ: সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দলের নেতাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির আছে।
২. প্রধান বিচারপতি নিয়োগ: প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রপতি এককভাবে সিদ্ধান্ত নেন।
এ ছাড়া অন্য সব নির্বাহী ও প্রশাসনিক কাজের জন্য রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতে হয়। অর্থাৎ, মন্ত্রিপরিষদ, নির্বাচন কমিশন, অ্যাটর্নি জেনারেলসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়ার সময়ও রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে কাজ করেন।
সব মিলিয়ে, বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রপতির পদটি প্রধানত আনুষ্ঠানিক এবং প্রতীকী। এর বিপরীতে, প্রধানমন্ত্রীর পদটি নির্বাহী ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করে।
রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি: কতটা কার্যকরী?
ক্ষমতার ভারসাম্যের লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতিকে অধিক ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব ছিল। ১২টি গুরুত্বপূর্ণ পদে রাষ্ট্রপতিকে সরাসরি নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। এর মধ্যে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধান, ডিজিএফআই এবং এনএসআই প্রধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই প্রস্তাব থেকে সরে এসে মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন, প্রেস কাউন্সিল ও আইন কমিশনের মতো কয়েকটি পদে নিয়োগের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কিছুটা বাড়লেও, প্রধানমন্ত্রীর সামগ্রিক ক্ষমতা কাঠামোতে তা বড় ধরনের পরিবর্তন আনবে না বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
সংস্কারের ভবিষ্যৎ
যতটুকু ঐকমত্য হয়েছে, তা দিয়ে রাষ্ট্রের ক্ষমতার ভারসাম্য কতটা ফিরবে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। এই সামান্য পরিবর্তনগুলো হয়তো একটি প্রতীকী পদক্ষেপ, যা ভবিষ্যতে আরও বড় সংস্কারের পথ তৈরি করতে পারে। কিন্তু মূল লক্ষ্য ছিল প্রধানমন্ত্রীর এককেন্দ্রিক ক্ষমতা ভেঙে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা, যা এখনো পুরোপুরি অর্জিত হয়নি।
গণতন্ত্রকে টেকসই করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আরও বড় পরিসরে বোঝাপড়া প্রয়োজন। কারণ, ঐকমত্য না থাকলে, শুধু কাগজে-কলমে থাকা সিদ্ধান্তগুলো কার্যকর করা সম্ভব নয়। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি, জুলাই সনদে যে যে বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ থাকছে সেগুলো আদৌ বাস্তবায়ন হবে কিনা তা নিয়ে বিশ্লেষকেরা শঙ্কা প্রকাশ করছেন। এখন দেখার বিষয়, আগামীতে এই সংস্কার প্রস্তাবগুলো কীভাবে বাস্তবায়িত হয় এবং তা দেশের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় কতটা পরিবর্তন আনতে পারে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা নতুন করে আলোচনায় এসেছে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের ভিত্তিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে ঐকমত্য ও ভিন্নমত তৈরি হয়েছে, তা ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রব্যবস্থার গতিপথ নিয়ে নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। মূল প্রস্তাব ছিল প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা কমানো। কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানো। কিন্তু যে পরিমাণ ঐকমত্য হয়েছে, তাতে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কতটা কমবে এবং সংস্কারের মূল উদ্দেশ্য কতটা সফল হবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
বাংলাদেশের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর পদটি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং দেশের শাসনব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর হাতেই নির্বাহী ক্ষমতার প্রায় সবটুকু কেন্দ্রীভূত থাকে। সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ পর্যালোচনা করলে এই একচ্ছত্র ক্ষমতার চিত্রটি স্পষ্ট হয়।
সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা
বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চম অধ্যায়ে সরকারের নির্বাহী বিভাগ সম্পর্কে বিস্তারিত বলা আছে। এখানে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও দায়িত্বের মূল ভিত্তিগুলো আলোচনা করা হলো:
নির্বাহী ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু (অনুচ্ছেদ ৫৮): সংবিধান অনুযায়ী, প্রজাতন্ত্রের সব নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত। রাষ্ট্রপতি এই ক্ষমতা প্রয়োগ করেন প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে। এর ফলে, যদিও রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের প্রধান, কিন্তু কার্যত তিনি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া কোনো কাজ করতে পারেন না। একমাত্র প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মেনে চলতে হয়।
মন্ত্রিসভার প্রধান (অনুচ্ছেদ ৫৮(২)): প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার প্রধান। তিনি মন্ত্রীদের নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দেন। মূলত, প্রধানমন্ত্রী যাকে চান, তিনিই মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। মন্ত্রিসভার সব বৈঠক ও সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে নেওয়া হয়।
আইন প্রণয়নে প্রভাব (অনুচ্ছেদ ৬৫): প্রধানমন্ত্রী যেহেতু সংসদ নেতা এবং তাঁর দল সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল, তাই সংসদীয় আইন প্রণয়নে তাঁর প্রভাব অপরিসীম। সরকারি বিলগুলো প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বেই উত্থাপিত ও পাস হয়।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ (অনুচ্ছেদ ৪৮(৩)): অ্যাটর্নি জেনারেল, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার, সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান এবং সদস্যসহ গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদগুলোতে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেন, কিন্তু এই নিয়োগের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক। ফলে, এসব পদে কারা আসবেন, তা কার্যত প্রধানমন্ত্রীই নির্ধারণ করেন।
প্রতিরক্ষা বাহিনীর ওপর কর্তৃত্ব (অনুচ্ছেদ ৬১): বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হলেন রাষ্ট্রপতি। তবে, সংবিধান অনুযায়ী, এই ক্ষমতা আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। বাস্তবে, প্রধানমন্ত্রীই প্রতিরক্ষা বাহিনীর ওপর চূড়ান্ত কর্তৃত্ব বজায় রাখেন।
সংবিধান সংশোধনে ভূমিকা: সংবিধান সংশোধনের জন্য সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতাসীন দলের প্রধান, তাই তার নেতৃত্বেই সংবিধান সংশোধন সম্ভব হয়।
অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞ মনে করেন, বাংলাদেশের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর হাতে এত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। এর ফলে সংসদ, বিচার বিভাগ এবং অন্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই ভারসাম্যহীনতার কারণে প্রায়ই সরকার এবং প্রধানমন্ত্রীর একক সিদ্ধান্তই রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়।
এই একচ্ছত্র ক্ষমতা থেকে বেরিয়ে এসে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে সংবিধান সংস্কারের দাবি উঠেছে। তবে সংবিধানে এখন পর্যন্ত যে বিধানগুলো আছে, তাতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের সরকারপ্রধানদের তুলনায় অনেক বেশি ক্ষমতা উপভোগ করেন।
প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতার লাগাম টানার চেষ্টা: যতটুকু ঐকমত্য
ঐকমত্য কমিশন এবং বিভিন্ন দলের মধ্যে আলোচনার পর কিছু বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকার মেয়াদ নির্দিষ্ট করে দেওয়া। সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, একজন ব্যক্তি জীবনে সর্বোচ্চ দুই মেয়াদে বা মোট দশ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন। এটি ভবিষ্যতে কোনো একক ব্যক্তির দীর্ঘস্থায়ী ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রবণতা রোধে সহায়ক হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
এ ছাড়া, নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের ক্ষেত্রে একটি নতুন পদ্ধতির প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকারি দল, বিরোধী দল এবং বিচার বিভাগের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত একটি বাছাই কমিটি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এবং অন্য কমিশনারদের নাম সুপারিশ করবে। তবে এই বাছাই কমিটি সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হলে পরবর্তী প্রক্রিয়া কী হবে তা নিয়ে ঐকমত্য হয়নি। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব হলো, এরপর দুজন বিচারপতি এই বাছাই কমিটিতে যুক্ত হবেন। এরপর সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের ভিত্তিতে বাছাই চূড়ান্ত করা হবে। তাঁরাও সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হলে র্যাঙ্কড চয়েস ভোটিং পদ্ধতি অনুসরণের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিএনপি এর বিরোধিতা করে এই পরিস্থিতিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সংসদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে।
রাষ্ট্রপতির হাতে সরাসরি কিছু সাংবিধানিক পদে নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন, প্রেস কাউন্সিল এবং আইন কমিশন অন্তর্ভুক্ত। জরুরি অবস্থা জারির ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রীর একক সিদ্ধান্তের বদলে মন্ত্রিসভার অনুমোদন বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এই পদক্ষেপগুলো আপাতদৃষ্টিতে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সামান্য হলেও হ্রাস করবে।
ভিন্নমতের দেয়াল: যেসব প্রস্তাব আটকে আছে
তবে, মূল প্রস্তাবগুলোর অনেকগুলোতেই বিএনপিসহ কয়েকটি দলের ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা ভিন্নমত রয়েছে, যা সংস্কারের সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা কমাতে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের প্রস্তাব করেছিল, যা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগের দায়িত্ব পালন করবে। কিন্তু বিএনপি এবং অন্যান্য দলের আপত্তির কারণে সেই প্রস্তাব বাদ দিয়ে কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়, যেখানেও তাদের আপত্তি ছিল। বিএনপি মনে করে, এ ধরনের কমিটি নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা দুর্বল করে দেবে।
সবচেয়ে বড় ভিন্নমত দেখা গেছে প্রধানমন্ত্রীর একই সঙ্গে একাধিক পদে থাকা সংক্রান্ত প্রস্তাবে। যেখানে বলা হয়েছিল, কোনো ব্যক্তি একই সময়ে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের পদে থাকতে পারবেন না, সেখানেও বিএনপিসহ কয়েকটি দল আপত্তি জানিয়েছে। বিএনপি মতে, সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধানমন্ত্রী মনোনয়নের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা থাকতে হবে, এর সঙ্গে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কোনো বিরোধ তাঁরা দেখছেন না। এই ভিন্নমতের কারণে, দলটি ক্ষমতায় এলে এই সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এ ছাড়া, সংসদের উচ্চকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতির মাধ্যমে সদস্য নির্বাচনের প্রস্তাবেও বিএনপির ভিন্নমত রয়েছে। তারা নিম্নকক্ষের প্রাপ্ত আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষে আসন বণ্টনের পক্ষে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির মতো দলগুলো সংসদ নির্বাচনে মোট প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে (পিআর) উচ্চকক্ষে তাদের প্রতিনিধি পাঠাতে চায়।
আবার সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন বা বাতিলেও আশানুরূপ সিদ্ধান্ত আসেনি। ‘ব্যক্তিগত স্বার্থে’ সংসদ সদস্যরা বিক্রি হয়ে যেতে পারেন, যেটিকে বলে ফ্লোর ক্রসিং—এই আশঙ্কা এবং ‘গণতন্ত্রের সঙ্গে স্থিতিশীল সরকার দরকার’—এমন অজুহাতে এই অনুচ্ছেদ বহাল রাখা পক্ষে অনেকে।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, একজন সংসদ সদস্য যদি সংসদে দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দেন, নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেন অথবা দল থেকে পদত্যাগ করেন, তাহলে তাঁর সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়ে যাবে।
এর মাধ্যমে দলের ভোটে জিতে আসা একটি রাজনৈতিক দলকে কার্যত আনচ্যালেঞ্জড থাকার গ্যারান্টি দেওয়া হয়। অবশ্য আস্থা ভোট ও অর্থ বিল বাদে সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবেন— এ বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। এটি বিএনপিরই প্রস্তাব ছিল।
সংবিধানের ৮১ অনুচ্ছেদের আলোচ্য বিষয় অর্থবিল। সরকার যদি উন্নয়নের জন্য কোনো ঋণ গ্রহণ করে এবং এই সম্পর্কিত কোনো বিল সংসদে উত্থাপন করে তাহলে সেই বিলকে অর্থবিল বলে। বাজেটের মধ্যে যে ঋণ থাকে সেটি অর্থবিল। বাজেট নিজেও অর্থবিল। শুল্ক ও কর এবং সাংবিধানিক পদধারীদের বেতন সম্পর্কিত বিলগুলোকেও অর্থবিল বলা হয়।
সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির প্রধান ভূমিকা
বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রপতি হলেন রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক প্রধান। সংসদীয় গণতন্ত্রে তিনি প্রতীকী প্রধান হিসেবে কাজ করেন, অর্থাৎ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদটি তাঁর হলেও বেশির ভাগ নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত থাকে। সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও ভূমিকা স্পষ্ট করে।
সংবিধানে নির্দিষ্ট ক্ষমতা
রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক প্রধান (অনুচ্ছেদ ৪৮): রাষ্ট্রপতি হলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান এবং রাষ্ট্রের অন্য সব ব্যক্তির ঊর্ধ্বে তাঁর স্থান। তিনি সংবিধান ও আইন অনুযায়ী তাঁকে দেওয়া সব ক্ষমতা প্রয়োগ করেন এবং দায়িত্ব পালন করেন।
সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক (অনুচ্ছেদ ৬১): রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। যদিও তাঁর এই ক্ষমতা আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং বাস্তবে এটি প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকে।
ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতা (অনুচ্ছেদ ৪৯): এটি রাষ্ট্রপতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা। তিনি যেকোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষের দেওয়া দণ্ডাদেশের মার্জনা, স্থগিত, হ্রাস বা মওকুফ করতে পারেন।
যেসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সীমিত
বাংলাদেশের সংবিধান সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা অনুসরণ করে। এ কারণে রাষ্ট্রপতিকে তাঁর বেশির ভাগ দায়িত্ব পালনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মেনে চলতে হয়। সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি শুধুমাত্র দুটি ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন:
১. প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ: সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দলের নেতাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির আছে।
২. প্রধান বিচারপতি নিয়োগ: প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রপতি এককভাবে সিদ্ধান্ত নেন।
এ ছাড়া অন্য সব নির্বাহী ও প্রশাসনিক কাজের জন্য রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতে হয়। অর্থাৎ, মন্ত্রিপরিষদ, নির্বাচন কমিশন, অ্যাটর্নি জেনারেলসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়ার সময়ও রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে কাজ করেন।
সব মিলিয়ে, বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রপতির পদটি প্রধানত আনুষ্ঠানিক এবং প্রতীকী। এর বিপরীতে, প্রধানমন্ত্রীর পদটি নির্বাহী ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করে।
রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি: কতটা কার্যকরী?
ক্ষমতার ভারসাম্যের লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতিকে অধিক ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব ছিল। ১২টি গুরুত্বপূর্ণ পদে রাষ্ট্রপতিকে সরাসরি নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। এর মধ্যে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধান, ডিজিএফআই এবং এনএসআই প্রধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই প্রস্তাব থেকে সরে এসে মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন, প্রেস কাউন্সিল ও আইন কমিশনের মতো কয়েকটি পদে নিয়োগের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কিছুটা বাড়লেও, প্রধানমন্ত্রীর সামগ্রিক ক্ষমতা কাঠামোতে তা বড় ধরনের পরিবর্তন আনবে না বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
সংস্কারের ভবিষ্যৎ
যতটুকু ঐকমত্য হয়েছে, তা দিয়ে রাষ্ট্রের ক্ষমতার ভারসাম্য কতটা ফিরবে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। এই সামান্য পরিবর্তনগুলো হয়তো একটি প্রতীকী পদক্ষেপ, যা ভবিষ্যতে আরও বড় সংস্কারের পথ তৈরি করতে পারে। কিন্তু মূল লক্ষ্য ছিল প্রধানমন্ত্রীর এককেন্দ্রিক ক্ষমতা ভেঙে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা, যা এখনো পুরোপুরি অর্জিত হয়নি।
গণতন্ত্রকে টেকসই করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আরও বড় পরিসরে বোঝাপড়া প্রয়োজন। কারণ, ঐকমত্য না থাকলে, শুধু কাগজে-কলমে থাকা সিদ্ধান্তগুলো কার্যকর করা সম্ভব নয়। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি, জুলাই সনদে যে যে বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ থাকছে সেগুলো আদৌ বাস্তবায়ন হবে কিনা তা নিয়ে বিশ্লেষকেরা শঙ্কা প্রকাশ করছেন। এখন দেখার বিষয়, আগামীতে এই সংস্কার প্রস্তাবগুলো কীভাবে বাস্তবায়িত হয় এবং তা দেশের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় কতটা পরিবর্তন আনতে পারে।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করতে আজ সোমবার বিকেলে আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব)-এর সভাপতিত্বে এ বৈঠক হবে।
৬ মিনিট আগেত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণে সংক্ষুব্ধদের শুনানি আগামী ২৪ আগস্ট থেকে শুরু করবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। শুনানি চলবে ২৭ আগস্ট পর্যন্ত। নির্বাচন কমিশন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
১ ঘণ্টা আগেপ্রকৃতি ও পরিবেশের সুরক্ষায় গুরুত্বারোপ করে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ ২০২৫-এর উদ্বোধন করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আজ সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে প্রধান উপদেষ্টা এই সপ্তাহের উদ্বোধন করেন।
১ ঘণ্টা আগেশারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় ভাষাসৈনিক আহমদ রফিককে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গতকাল রোববার রাত পৌনে ১২টার দিকে তাঁকে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে নেওয়া হয়।
১ ঘণ্টা আগে