Ajker Patrika

আদালতে এখনো লোহার খাঁচা

এস এম নূর মোহাম্মদ, ঢাকা
আদালতে এখনো লোহার খাঁচা

সমালোচনা ও অপসারণের দাবি উঠলেও দেশে অধস্তন আদালতের বেশ কিছু এজলাসকক্ষে আসামিদের জন্য লোহার খাঁচা রয়েই গেছে। এসব এজলাসে মামলার শুনানিকালে আসামিদের ওই খাঁচায় রাখা হয়। শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস শুনানিকালে লোহার খাঁচায় থাকার ঘটনায় বিষয়টি আবার আলোচনায় আসে।

আইনজীবীরা বলছেন, লোহার খাঁচা মানবাধিকারের লঙ্ঘন ও সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এসব খাঁচা অপসারণ চেয়ে করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট রুলও দিয়েছেন। কতগুলো আদালতে লোহার খাঁচা রয়েছে, সে বিষয়ে ৬০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতেও নির্দেশ দেন। তবে প্রতিবেদন গতকাল সোমবার পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। রিটকারী আইনজীবীরা বলছেন, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ৮৪টি এজলাসকক্ষে লোহার খাঁচা রয়েছে।

পরিবেশ ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, সভ্য সমাজে আদালতে লোহার খাঁচা থাকা উচিত নয়। কেননা, সংবিধান অনুযায়ী কোনো নাগরিকের সঙ্গে অপমানজনক আচরণ করা যাবে না। তবে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী বা জঙ্গির ক্ষেত্রে বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। 

গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের ২৫ কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলায় গত ১২ জুন গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ড. ইউনূসসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার একটি আদালত। সেদিন অন্য ১৩ আসামির সঙ্গে ড. ইউনূসও এজলাসকক্ষে আসামিদের জন্য স্থাপিত লোহার খাঁচায় ছিলেন। অভিযোগ গঠন শেষে তিনি বাইরে বেরিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘সবাই জানে, যতক্ষণ একজনের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত না হয়, ততক্ষণ তিনি নিরপরাধ।

নিরপরাধ ব্যক্তিকে কেন লোহার খাঁচায় দাঁড়াতে হবে? এটার অবসান হওয়া উচিত। একজন নিরপরাধ নাগরিককে লোহার খাঁচায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, এটা আমার কাছে অত্যন্ত অপমানজনক।’ তিনি আরও বলেন, ‘যদিও আমাকে বলা হয়েছিল এজলাসে থাকতে। কিন্তু আমি নিজেই অন্যদের সঙ্গে খাঁচায় ঢুকেছি।’

এরপর এজলাসকক্ষে লোহার খাঁচার বিষয়টি আবার আলোচনায় আসে। এটি প্রথম আলোচনায় আসে গত বছরের ১৬ অক্টোবর লোহার খাঁচা অপসারণ চেয়ে ১০ আইনজীবীর দেওয়া আইনি নোটিশের কারণে। আইনসচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব ও পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বরাবর নোটিশটি পাঠানো হয়েছিল। জবাব না পেয়ে গত ২৩ জানুয়ারি হাইকোর্টে রিট করেন ওই আইনজীবীরা। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ৪ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট রুল জারি করেন। রুলে লোহার খাঁচা স্থাপন সংবিধানের ৩১, ৩২ ও ৩৫(৫) অনুচ্ছেদের সঙ্গে কেন সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। একই সঙ্গে লোহার খাঁচা অপসারণ করে পুনরায় কাঠগড়া স্থাপন করতে পদক্ষেপ নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা-ও জানতে চাওয়া হয়। সংশ্লিষ্টদের চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়। এ রকম খাঁচা থাকা আদালতের তালিকা ৬০ দিনের মধ্যে দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। 

পরে সম্পূরক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৬ জুন এ বিষয়ে আরেকটি রুল দেন হাইকোর্ট। রুলে ক্রিমিনাল রুলস অ্যান্ড অর্ডারস-এর ৮২ বিধি কেন সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়।

আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৫ সালে ঢাকায় নতুন সিএমএম আদালত ভবন উদ্বোধনের পর এজলাসকক্ষে প্রথম লোহার খাঁচা দেখা যায়।

রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, অধস্তন আদালতে অতীতে লোহার খাঁচা ছিল না। বর্তমানে ৮৪টি আদালতে এ ধরনের খাঁচা রয়েছে, এর ৭৪টিই ঢাকায়। চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহীতে ম্যাজিস্ট্রেট ও দায়রা জজ আদালতে এ রকম খাঁচা রয়েছে বলে জানা গেছে। তিনি বলেন, এ ধরনের খাঁচা স্থাপন সংবিধানের ৩১, ৩২ ও ৩৫(৫) অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এগুলো অবিলম্বে অপসারণ করা উচিত।

সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে আছে, আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে। ৩৫(৫) অনুচ্ছেদে বলা আছে, কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাবে না কিংবা কারও সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহার করা যাবে না। 

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া আজকের পত্রিকাকে বলেন, ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে লোহার খাঁচা মানবাধিকারের লঙ্ঘন ও খুবই দৃষ্টিকটু। হয়রানি করার জন্যও অনেক মামলা হয়। একটা পর্যায়ে গিয়ে আসামি খালাস পাওয়ার ঘটনাও অনেক। এমন পরিস্থিতিতে মামলা হলেই নাগরিককে খাঁচার মধ্যে রাখা অবমাননাকর। তিনি বলেন, কোনো আসামি পালানোর আশঙ্কা থাকলে বা গুরুতর অপরাধে জড়িত আসামি হলে তার ক্ষেত্রে পুলিশ প্রবিধানে কিছু বিধান উল্লেখ করা আছে। কিন্তু সব আসামিকে খাঁচার ভেতর দাঁড় করিয়ে রাখা ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। বিচারে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেককে নিরপরাধ ধরে নিতে হবে।

হাইকোর্ট লোহার খাঁচা থাকা আদালতের বিষয়ে ৬০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশনা দিলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি বলে জানান ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়। তিনি বলেন, ‘এখনো কোনো প্রতিবেদন এবং জবাব আসেনি। আমাদের সঙ্গে কেউ যোগাযোগও করেনি। আমার কাছে এলে হলফনামা করে আদালতে উপস্থাপন করব।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

মেট্রোর বিয়ারিং প্যাড পড়ে মৃত্যু: ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি, নিহতের পরিবার পাবে ৫ লাখ টাকা

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ১৬: ১২
বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে এক পথচারী মৃত্যুতে বন্ধ ফার্মগেট মেট্রোরেল স্টেশন। ছবি: আজকের পত্রিকা
বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে এক পথচারী মৃত্যুতে বন্ধ ফার্মগেট মেট্রোরেল স্টেশন। ছবি: আজকের পত্রিকা

মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড পড়ে নিহতের ঘটনায় ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সরকার। নিহত ব্যক্তির পরিবারকে ৫ লাখ টাকা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুবিষয়ক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। আজ রোববার (২৬ অক্টোবর) দুপুরে ফার্মগেট দুর্ঘটনায়স্থল পরিদর্শন এসে এসব কথা বলেন তিনি।

সড়ক উপদেষ্টা বলেন, মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড পড়ে একজন পথচারী নিহত হয়েছেন। এছাড়া আরও দুজন পথচারী আহত হয়েছেন। আহত দুজনকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। নিহতের মরদেহ ওই হাসপাতালে আছে।

উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘নিহত ব্যক্তির সব দায়-দায়িত্ব আমরা গ্রহণ করব। প্রাথমিকভাবে নিহত পরিবারকে ৫ লাখ টাকা সাহায্য দেওয়া হবে। নিহত ব্যক্তির পরিবারের কেউ কর্মক্ষম থাকলে তাঁকে মেট্রোরেলে চাকরি দেওয়া হবে।’

এই ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে উল্লেখ করে উপদেষ্টা বলেন, মেট্রোরেলের সাবেক এমডি ও সেতুসচিব মোহাম্মদ আবদুর রউফকে প্রধান করে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

এ কমিটিতে আরও আছেন বুয়েটের অধ্যাপক এবিএম তৌফিক হাসান, মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (এমআইএসটি)-র সহকারী অধ্যাপক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. জাহিদুল ইসলাম, প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আব্দুল ওহাব ও সড়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আসফিয়া সুলতানা।

এই কমিটি ২ সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেবে বলে জানান উপদেষ্টা।

সড়ক উপদেষ্টা বলেন, ‘এটা কি নির্মাণ কাজের ত্রুটির জন্য হয়েছে, নাকি নাশকতামূলক কিছু ঘটেছে সেটি খতিয়ে দেখবে এই কমিটি। যারা দায়ী তাদের চিহ্নিত করবে এবং ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের ঘটনা না ঘটে সেজন্য সুপারিশ করবে।’

আজ রোববার দুপুর ১২টা ২০ মিনিটের দিকে ফার্মগেটে মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে এক পথচারী মারা যান। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ওই ব্যক্তি ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। মেট্রোরেল চলাচলের মুহূর্তে ওপর থেকে একটি বিয়ারিং প্যাড তাঁর মাথায় পড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়।

দুর্ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে লাশ উদ্ধার করে। তেজগাঁও থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শহিদুজ্জামান বলেন, ‘আমরা ডিউটিরত অবস্থায় কাছেই ছিলাম। খবর পেয়ে দ্রুত গিয়ে দেখি, এক ব্যক্তি রাস্তায় মৃত অবস্থায় পড়ে আছেন।’

নিহত ব্যক্তির সঙ্গে থাকা একটি পাসপোর্ট পাওয়া গেছে। তাতে নাম লেখা আবুল কালাম এবং বাড়ি শরীয়তপুর। জন্মসাল ১৯৯০।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাডের কাজ কী, বারবার খুলে পড়া নিয়ে কেন উদ্বেগ

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ১৬: ১৩
মেট্রোরেলসহ বৃহৎ সব উড়াল সড়কে বিয়ারিং প্যাড ব্যবহার করা হয়। ছবি: সংগৃহীত
মেট্রোরেলসহ বৃহৎ সব উড়াল সড়কে বিয়ারিং প্যাড ব্যবহার করা হয়। ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেল স্টেশনের নিচে আজ রোববার দুপুরে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি দেশের আধুনিক এই গণপরিবহন ব্যবস্থার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়াল। দুপুর ১২টা ২০ মিনিটের দিকে উড়ালপথের পিলার ও ভায়াডাক্টের সংযোগস্থলে বসানো একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে। প্রায় ১৪০ থেকে ১৫০ কেজি ওজনের এই কাঠামোটি সরাসরি এক পথচারীর মাথায় পড়লে ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়। এই দুর্ঘটনার পরপরই জননিরাপত্তা ও কারিগরি দিক বিবেচনা করে মেট্রোরেল চলাচল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

এই দুর্ঘটনাটি সাম্প্রতিক সময়ে দ্বিতীয়বারের মতো ঘটল। এর আগে, গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেট্রোরেলের একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল, যার ফলে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত প্রায় ১১ ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। এত অল্প সময়ের ব্যবধানে একই কাঠামোগত উপাদানের পুনরাবৃত্তিমূলক ত্রুটি মেট্রোরেলের মান নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া নিয়ে মারাত্মক প্রশ্ন তুলেছে।

বিয়ারিং প্যাড: কাঠামোর মেরুদণ্ড এবং এর জটিল প্রকৌশল

মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড (Metrorail Bearing Pads) হলো উড়ালপথের স্থায়িত্ব ও সুরক্ষার জন্য একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। এটি বিশেষ ধরনের রাবার বা ইলাস্টোমেরিক পদার্থ দিয়ে তৈরি। এটি সেতুর কাঠামোগত উপাদানগুলোর মধ্যে একটি কুশন বা কোমল সংযোগস্থল হিসেবে কাজ করে।

বিয়ারিং প্যাডের মূল কাজগুলো কেবল ভার বহন করা নয়, বরং জটিল প্রকৌশলগত চাপ সামলানো। যেমন:

উল্লম্ব ভার বহন ও বণ্টন: এটি ট্রেন চলাচলের সময় সৃষ্ট বিপুল উল্লম্ব চাপ (Vertical Load) শোষণ করে এবং চাপটিকে সরাসরি কোনো একটি নির্দিষ্ট পিলারে কেন্দ্রীভূত না করে পুরো পিলারের মাধ্যমে সমানভাবে ভিত্তি বা মাটির দিকে ছড়িয়ে দেয়।

অনুভূমিক ও কৌণিক সরণ নিয়ন্ত্রণ: স্থিতিস্থাপকতার গুণে ভায়াডাক্টের অনুভূমিক সরণ (Horizontal Movement) বা চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে এটি। তাপমাত্রা পরিবর্তন, ট্রেন চলাচলের গতি বা বাঁকের কারণে ভায়াডাক্টে যে সামান্য প্রসারণ, সংকোচন বা পার্শ্বীয় নড়াচড়া হয়, প্যাড সেই নড়াচড়ার চাপ শোষণ করে।

কম্পন শোষণ (Damping) : বিয়ারিং প্যাড একটি কার্যকর ‘শক অ্যাবজর্ভার’ হিসেবে কাজ করে। এটি মেট্রোরেল চলাচলের স্বাভাবিক কম্পনের বেশিরভাগ অংশ শোষণ করে, যা শুধু কাঠামোর দীর্ঘায়ু নিশ্চিত করে না, বরং যাত্রীদের ভ্রমণও মসৃণ ও আরামদায়ক করে।

বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ: নকশা ও মান নিয়ন্ত্রণের দুর্বলতা

বুয়েটের ব্যুরো অব রিসার্চ, টেস্টিং অ্যান্ড কনসাল্ট্যান্টের (বিআরটিসি) পরিচালক ড. সামছুল হক প্রথম দুর্ঘটনার সময়ই বলেছিলেন, এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ‘অত্যন্ত বিপজ্জনক’। তাঁর মতে, একটি অত্যাধুনিক অবকাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বারবার খুলে পড়ার অর্থ হলো নকশাগত ত্রুটি অথবা ব্যবহৃত উপাদানের গুণমানে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে।

গভীরতর ঝুঁকি: বিয়ারিং প্যাড যদি স্থানচ্যুত হয়, তবে ট্রেন চলাচলের গতিশীল চাপ (Dynamic Stress) সরাসরি পিলারের সঙ্গে ভায়াডাক্টের সংযোগস্থলে গিয়ে পড়ে। এই ঘর্ষণ ও অস্বাভাবিক চাপ পিলারে সূক্ষ্ণ-ফাটল (Micro-fractures) তৈরি করতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে গোটা কাঠামোটিকেই ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। বিশেষত বাঁকযুক্ত স্থানে যেখানে চাপ স্বভাবতই বেশি তৈরি হয়, সেখানে উন্নত প্রযুক্তির অধিক চাপ সহনশীল প্যাড ব্যবহার করা অপরিহার্য।

ফার্মগেটের এই দুর্ঘটনা কেবল একটি প্রযুক্তিগত ব্যর্থতা নয়, বরং এটি নগরবাসীর মধ্যে নিরাপদ যাতায়াত নিয়ে গভীর আস্থা সংকট তৈরি করতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন।

বিয়ারিং প্যাডের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল নির্মাণকালেই

২০২৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ভায়াডাক্টে ত্রুটির কারণে দীর্ঘ সময় আংশিক বন্ধ ছিল মেট্রোরেল চলাচল। ভায়াডাক্টের বিয়ারিং প্যাড নিয়ে নির্মাণের সময়ই প্রশ্ন উঠেছিল। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে এ ব্যাপারে আপত্তিও জানানো হয়েছিল। এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়। কিন্তু তখন অদৃশ্য কারণে কেউ তাতে কর্ণপাত করেনি। শেষ পর্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ বিয়ারিং প্যাডই বসানো হয়।

বুয়েটের ল্যাবে পরীক্ষায় উত্তরা–আগারগাঁও অংশের দুটি প্যাকেজের জন্য আমদানি করা বিয়ারিং প্যাডের মান যথাযথ নয় বলে দেখা যায়। এসব বিয়ারিং প্যাড সরবরাহ করেছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইতাল–থাই। সে সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছিল, মেট্রোরেল প্রকল্পে নিম্নমানের বিয়ারিং প্যাড সরবরাহের ঘটনাটি ঘটেছিল উত্তরা–আগারগাঁও অংশের প্যাকেজ ৩ ও ৪–এর নির্মাণকাজে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজটি বাস্তবায়ন করছিল ইতালিয়ান–থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি (ইতাল–থাই)।

মেট্রোরেলের উত্তরা–আগারগাঁও অংশের দৈর্ঘ্য প্রায় ১২ কিলোমিটার। যখন অভিযোগ ওঠে তত দিনে পিয়ার–ভায়াডাক্টের সংযোগস্থলে বিয়ারিং প্যাড বসিয়ে প্রায় আট কিলোমিটার উড়ালপথ বসানো হয়ে গেছে। কিন্তু পরে সেগুলো পরিবর্তন করা হয়নি।

বিয়ারিং প্যাডের কারিগরি মান বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারার বিষয়টি উঠে আসার পর বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, মেট্রোরেলের গুরুত্বপূর্ণ এ উপকরণ মানহীন হলে তা গোটা অবকাঠামোটিকেই ঝুঁকির মুখে ফেলে দেবে। আজ মেট্রোরেলের দুর্ঘটনা সে কথাই প্রমাণ করল!

বিশেষজ্ঞরা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, বিয়ারিং প্যাড কেবল সেতুর কাঠামোর রক্ষাকবচ নয়, এটি বাংলাদেশের দ্রুত বিকাশমান গণপরিবহন ব্যবস্থার স্থায়িত্ব ও জননিরাপত্তার প্রতীক। এই দুর্ঘটনা প্রমাণ করে, কেবল অবকাঠামো নির্মাণই যথেষ্ট নয়, গুণমান নিশ্চিতকরণ ও কঠোর নজরদারিই আধুনিক ব্যবস্থার সফলতার ভিত্তি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

তিন ঘণ্টা পর আংশিক চালু মেট্রোরেল

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

রাজধানীর ফার্মগেটে মেট্রোরেলের পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে এক পথচারীর মৃত্যুর ঘটনায় বেলা ১২টার দিকে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এর প্রায় তিন ঘণ্টা পর বেলা ৩টা থেকে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত আংশিক মেট্রোরেল চলাচল শুরু হয়েছে।

আজ রোববার ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড ডিএমটিসিএল পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়।

এর আগে দুপুরে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফারুক আহমেদ বলেন, ‘মেট্রোরেল উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চালু হবে খুব দ্রুততম সময়ে। আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত আপাতত চালু হচ্ছে না। আজ চালু করা সম্ভব হবে না এই অংশ।’

ফার্মগেটে মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে আজ দুপুর ১২টা ২০ মিনিটের দিকে এক পথচারী মারা যান। এই ঘটনার পর থেকে মেট্রোরেল চলাচল পুরোপুরি বন্ধ থাকে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ওই ব্যক্তি ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। মেট্রোরেল চলাচলের মুহূর্তে ওপর থেকে একটি বিয়ারিং প্যাড তাঁর মাথায় পড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়।

নিহত ব্যক্তির সঙ্গে থাকা একটি পাসপোর্ট পাওয়া গেছে। তাতে নাম লেখা আবুল কালাম এবং বাড়ি শরীয়তপুর। জন্মসাল ১৯৯০। দুর্ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে লাশ উদ্ধার করে।

তেজগাঁও থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শহিদুজ্জামান বলেন, ‘আমরা ডিউটিরত অবস্থায় কাছেই ছিলাম। খবর পেয়ে দ্রুত গিয়ে দেখি, এক ব্যক্তি রাস্তায় মৃত অবস্থায় পড়ে আছেন।’

এর আগে গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেট্রোরেলের একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে। এর ফলে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ১১ ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। এই ঘটনায় বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টদের মধ্যে গুরুতর নিরাপত্তা উদ্বেগ তৈরি হয়। এর মধ্যে দ্বিতীয়বার বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ল।

মেট্রোরেলের লাইনের নিচে উড়ালপথের পিলারের সঙ্গে রাবারের বিয়ারিং প্যাড থাকে। এগুলোর প্রতিটির ওজন ১৪০ বা ১৫০ কেজি। এসব বিয়ারিং প্যাড ছাড়া ট্রেন চালালে উড়ালপথ দেবে যাওয়া কিংবা স্থানচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ জন্য মেট্রোরেলের চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছে ডিএমটিসিএল সূত্র।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

বইমেলা হবে কোনো সন্দেহ নেই, সময় নির্ধারণ বাংলা একাডেমির ব্যাপার: প্রেস সচিব

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘কেমন বই মেলা চাই’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। ছবি: আজকের পত্রিকা
জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘কেমন বই মেলা চাই’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। ছবি: আজকের পত্রিকা

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে এবারও বইমেলা যাতে খুব সুন্দর হয়। সময়ের ব্যাপারে আমি জানি না, বাংলা একাডেমি কি একই সময়ে করবে নাকি সময় একটু হেরফের করবে—সেটা বাংলা একাডেমির বিষয়। তবে মেলা হবে—এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।’

আজ রোববার জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী মিলনায়তনে বৈষম্যবিরোধী সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি আয়োজিত ‘কেমন বই মেলা চাই’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। সভায় ১৭টি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়।

শফিকুল আলম বলেন, ‘আমরা এমন একটা বইমেলা চাই, যে বইমেলায় আমাদের সব মানুষের বই থাকবে। আমরা যারা বই লিখি, যে যেইটাই লিখুক কেন, যে কোনো ভিন্ন মতের লেখাই থাকুক না কেন, সবার বই যেন বইমেলায় থাকে। পাঠক বেছে নেবেন—উনি যেটা পড়তে চান, যে বই তাঁকে টানে উনি ওই বইটা কিনবেন।’

তিনি যোগ করেন, ‘আমরা চাই এমন একটা মেলা, অবশ্যই সেটা বৈষম্যবিরোধী। কারও প্রতি যেন বৈষম্য না করা হয়। কেউ যেন এসে না বলেন যে না, আমার প্রতি বৈষম্য করা হচ্ছে। আমি যে বইটা প্রকাশ করতে চাচ্ছি বা বিক্রি করতে চাচ্ছি, এটা এখানে করা যাচ্ছে না। এই কথাটা যেন না শোনা হয়।’

প্রেস সচিব বলেন, ‘আমরা অবশ্যই এমন কোনো বইমেলা চাই না যেখানে ৪০ শতাংশ বই হচ্ছে একটা লোকের ওপরে। এমন একটা বইমেলার সময় গেছে, সামনে আপনি বই দেখবেন, সবই হচ্ছে শেখ পরিবারের বই। উনি টুঙ্গিপাড়ায় পুকুরের পাশে বসে আছেন, সেটা নিয়েও একটা বড় বই কেউ লিখে ফেলেছে। ওই বইগুলো ছিল—কোনোভাবে প্রতারণা করে কিছু টাকা-পয়সা কামানোর জন্য।’

সভায় জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি মোহন রায়হান বলেন, ‘বইমেলাকে দলীয় বইমেলা হিসেবে রূপান্তরিত করা হয়েছে। প্রতিটি স্টল, প্যাভেলিয়ন আওয়ামী দালালদের দেওয়া হয়েছিল। প্রকাশকেরা ছিল ফ্যাসিস্টদের দোসর। তবে এবারের বইমেলা হবে সবার।’

নির্বাচনের কারণে বইমেলা বন্ধের কোনো কারণ নেই উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘ফেব্রুয়ারিতে বইমেলা হোক। নির্বাচনের কয়েক দিন বইমেলা বন্ধ রেখে। তা আবার কয়েক দিন বর্ধিত করা যেতে পারে। তা-ও যাতে ফেব্রুয়ারিতে বইমেলা বন্ধ না থাকে। এবারের বইমেলা না হলে মনে করা হবে, ফ্যাসিস্ট শক্তির দোসররা এটা জন্য জড়িত। তারাই ষড়যন্ত্র করে বইমেলা বন্ধ করতে চাইছে। সরকারের কাছে আবেদন বইমেলা যাতে ফেব্রুয়ারির ১ তারিখেই হয়।’

আয়োজক সংগঠনের সভাপতি সাঈদ বারীর সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন কবি গাজীউল হাসান খান, ফয়েজ আলম।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত