Ajker Patrika

নির্বাচনের নিরাপত্তা

ভোটে মব ঠেকানোর কৌশল শিখছেন পুলিশ সদস্যরা

  • চার ধাপে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। প্রথম ধাপে ১৫০ জন মাস্টার ট্রেইনার তৈরি করা হয়।
  • প্রশিক্ষণে নির্বাচনী আইন জানানো, ‘মব’ নিয়ন্ত্রণ, অস্ত্র প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি অন্তর্ভুক্ত।
  • ৪ নভেম্বর পর্যন্ত ৪৮ হাজার ১৩৪ জন পুলিশ সদস্য প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
রাসেল মাহমুদ, ঢাকা
ভোটে মব ঠেকানোর কৌশল শিখছেন পুলিশ সদস্যরা

আগামী ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে এক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে। এই ভোটে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ যেমন আগের থেকে ভিন্ন, তেমনি ভোটের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জেও রয়েছে ভিন্নমাত্রা। এই নির্বাচন সুষ্ঠু করা তাই পুলিশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সেসব মাথায় রেখেই নিজেদের মতো করে প্রস্তুতি নিচ্ছে পুলিশ। বাহিনীর বিরাট একটি অংশকে দেওয়া হচ্ছে প্রশিক্ষণ। এর মধ্যে বিশেষ করে ‘মব’ ঠেকানোর কৌশলও শিখছেন তাঁরা।

গত সেপ্টেম্বরে পুলিশ সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) বাহারুল আলম বলেছিলেন, ‘নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এবারই প্রথম বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। নির্বাচনে সহিংসতাও আমরা মোকাবিলা করতে পারব।’ এ সময় প্রশিক্ষণের বিষয়ে অতিরিক্ত আইজিপি (এইচআরএম) আবু নাসের মোহাম্মদ খালেদ বলেন, প্রশিক্ষণটি অত্যন্ত যুগোপযোগী, আধুনিক। অডিও-ভিডিও ধারণ, ‘মব’ নিয়ন্ত্রণের অনুশীলন, নির্বাচনী বিধিবিধান —সবকিছুই প্রশিক্ষণে থাকছে।’

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ১ লাখ ৪৩ হাজার পুলিশ সদস্য মোতায়েন ছিলেন। আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে ১ লাখ ৫০ হাজার পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হবে। নির্বাচনে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে পুলিশ সদস্যদের পেশাদারি ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের জন্য গত জুনে মডিউল তৈরি করে বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি নেয় পুলিশ। মডিউলে নির্বাচনের চার ধাপ—তফসিল ঘোষণার আগের সময়, তফসিল ঘোষণার পরের সময়, নির্বাচনের দিন এবং নির্বাচন-পরবর্তী সময়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণে নির্বাচনী আইনবিধি অবহিতকরণ, জনতার ভিড় বা ‘মব’ নিয়ন্ত্রণ, প্রথমবারের মতো বডি ওর্ন ক্যামেরা ব্যবহার, অস্ত্র প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে আরও জানা যায়, চার ধাপে পুলিশ সদস্যদের নির্বাচনী প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। প্রথম ধাপে ১৫০ জন মাস্টার ট্রেইনার তৈরি করা হয়। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার থেকে ডিআইজি পদমর্যাদার কর্মকর্তারা এ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং তাঁরা বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে গিয়ে মাঠপর্যায়ের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। তিনটি ধাপের প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছে। গত ৫ অক্টোবর থেকে চতুর্থ ধাপে সারা দেশে ১৩০টি প্রশিক্ষণকেন্দ্রে একযোগে এ প্রশিক্ষণ চলছে। পুলিশ সদস্যদের মনোবল ও মানসিক প্রস্তুতি বাড়াতে প্রশিক্ষণে রাখা হয়েছে প্রামাণ্যচিত্র, অডিও ভিজ্যুয়াল কনটেন্ট, ছোট ফিল্ম ও তথ্যবহুল বুকলেট। আগামী ১৫ জানুয়ারির মধ্যে এ প্রশিক্ষণ শেষ হবে। এই ধাপে মাঠপর্যায়ের সবচেয়ে বেশি পুলিশ সদস্য প্রশিক্ষণ পাবেন। চার ধাপে প্রায় দেড় লাখ পুলিশ নির্বাচনী প্রশিক্ষণ নেবে। ৪ নভেম্বর পর্যন্ত ৪৮ হাজার ১৩৪ জন পুলিশ সদস্য প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

প্রশিক্ষণ নেওয়া একাধিক পুলিশ সদস্য আজকের পত্রিকাকে বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া, জনতার বিক্ষোভ বা ‘মব’ সামাল দেওয়ার জন্য উপস্থিত বুদ্ধি বা কৌশল গ্রহণের ওপর প্রশিক্ষণে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া আইন অনুযায়ী পুলিশের দায়িত্ব ও ক্ষমতা কতটুকু, তা প্রশিক্ষণে শেখানো হচ্ছে।

প্রশিক্ষণে ‘মব’ ও সহিংসতা ঠেকাতে বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে। এতে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখতে। ফলে উত্তেজনা শুরু হওয়ার আগেই তা প্রশমিত করা সম্ভব হবে বলে মনে করা হচ্ছে। পাশাপাশি সম্ভাব্য সহিংস এলাকা চিহ্নিত করে সেখানে আগেই স্ট্রাইকিং ফোর্স মোতায়েনের প্রস্তুতিও নেওয়া হচ্ছে।

নির্বাচনের মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে প্রশিক্ষণ নেওয়া পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পুলিশ সুপার আব্দুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, নির্বাচনে পুলিশের দায়িত্ব কী, আইন অনুযায়ী কী করতে পারবে—এসব বিষয় প্রশিক্ষণে শেখানো হচ্ছে। তাঁরা যেন আইনের সীমার মধ্যে থেকে শান্তভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন এবং ‘মব’ সৃষ্টি হলে আইন অনুযায়ী যে প্রক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রণের বিধান আছে, সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন। প্রয়োজনে স্ট্রাইকিং ফোর্সের সহযোগিতা নেবেন।

নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৪২ হাজার ৭৬১টি ভোটকেন্দ্র থাকবে। এসব কেন্দ্রে পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি ও আনসার সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকবেন।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ পুলিশে ২ লাখ ৩ হাজার সদস্য রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে দেড় লাখ সদস্য আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে দায়িত্ব পালন করবেন। তাঁদের ধাপে ধাপে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটেও তাঁদের প্রশিক্ষণ চলছে। মাঠপর্যায়ে উপপরিদর্শক (এসআই), সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) ও কনস্টেবলরা দায়িত্ব পালন করবেন। প্রতিটি কেন্দ্রে দুই থেকে চারজন পুলিশ সদস্য থাকবেন।

আওয়ামী লীগের আমলে নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ সদস্যরাও প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তাঁদের অধিকাংশই মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্য।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এক উপপরিদর্শক (এসআই) বলেন, ‘গত নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করেছি। প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া ৮০ শতাংশই গত নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রশিক্ষণে তাঁরা অভিজ্ঞতা শেয়ার করছেন। কিছু নতুন সদস্য রয়েছেন। প্রশিক্ষণে কোন পরিস্থিতিতে কী করণীয়, সে বিষয়ে ক্লাসের মাধ্যমে শেখানো হচ্ছে।’

পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) শাহাদাত হোসাইন বলেন, এবারের নির্বাচনের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। তাই আগে থেকে পুলিশ সদস্যদের প্রস্তুতির জন্য প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। প্রাথমিকভাবে পুলিশ সদর দপ্তরের প্রশিক্ষণ শাখা থেকে অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে, নির্বাচন কমিশনের বাজেটের পর তা সমন্বয় করা হতে পারে। পুলিশ সদস্যরা যেন আইনের সীমার মধ্যে থেকে শান্তভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, প্রশিক্ষণে সে বিষয়ে জোর দেওয়া হচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...