Ajker Patrika

পারস্য থেকে ঢাবির টিএসসি, সমুচার হাজার বছরের ইতিহাস

জিন্নাত আরা ঋতু, ঢাকা
আপডেট : ১০ জুন ২০২৫, ১৭: ৪০
সমুচা। ছবি: ফ্রিপিক
সমুচা। ছবি: ফ্রিপিক

মনে পড়ে ২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপাচার্যের সেই বক্তব্য? ঢাবির টিএসসিতে মাত্র ১০ টাকায় এক কাপ চা, একটি শিঙাড়া, একটি সমুচা ও একটি চপ পাওয়া যায়—এমন বক্তব্যে তোপের মুখে পড়েন উপাচার্য। তৈরি হয় নানান আলোচনা-সমালোচনা। ঘটনার পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও বক্তব্যের এই রেশ কাটেনি। প্লেটভর্তি সমুচা দেখলে কিংবা গরম সমুচা ভাজতে দেখলে সেই বক্তব্যও যেন আড্ডায় গরম-গরম জমে ওঠে।

তবে আমাদের আলোচনার বিষয় সেই বক্তব্য নয়। কম খরচে তৈরি এই স্ন্যাকসের গোড়ার গল্প নিয়েই আজকের এই লেখা। কীভাবে খাবারটি তৈরি হলো, যুগে যুগে ছড়িয়ে পড়ল, তা জানাব আপনাদের। যদিও দক্ষিণ এশিয়ানরা তাঁদের নিজস্ব খাবার বলে মনে করলেও সমুচার উৎপত্তি আসলে আরবভূমি ও মধ্যপ্রাচ্যে। দশম থেকে ১৩ শতাব্দীর আরব রন্ধন পুস্তকগুলোতে এই খাবারকে ‘সানবুসাক’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে, যা পারসি শব্দ ‘সানবোসাগ’ থেকে এসেছে। মিসর থেকে লিবিয়া, মধ্য এশিয়া থেকে ভারত—ত্রিভুজাকৃতির এই পুরভরা পেস্ট্রি অঞ্চলভেদে নানা নামে পরিচিত হয়ে পড়েছে।

মূলত ‘সামসা’ নামে পরিচিত এই খাবারের নামকরণ মধ্য এশিয়ার পিরামিডসদৃশ আকৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে করা হয়। ইতিহাসে এর অন্যান্য নামের মধ্যে রয়েছে ‘সানবুসাক’, এমনকি ‘সানবুসাজ’—যা সবই পারসি শব্দ ‘সানবোসাগ’-এর ভিন্ন রূপ। আট শতাব্দী ধরে সমুচা দক্ষিণ এশিয়ার রান্নাঘরে অত্যন্ত জনপ্রিয় খাবার। সুলতান ও সম্রাটদের রাজসভায় যেমন এটি পরিবেশিত হয়েছে, তেমনি ভারতের ও পাকিস্তানের অলিগলির পথঘাটেও সাধারণ মানুষের হয়ে ওঠে জনপ্রিয় নাশতা।

ইতিহাসবিদদের মতে, মধ্য এশিয়ার জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভ্রমণের সময় দ্রুত ও সহজে খাওয়া যায় এমন খাবার হিসেবে সমুচার কদর ছিল। এ কারণেই লোকজন এটি প্রস্তুত করতেন এবং পথে চলতে চলতে উপভোগ করতেন।

বেক করা সমুচা। ছবি: বাইত আল ফান
বেক করা সমুচা। ছবি: বাইত আল ফান

সমুচার প্রথম দিকের উল্লেখ পাওয়া যায় ইরানের ইতিহাসবিদ আবুল ফজল বেইহাকির ১১ শতকের বিখ্যাত রচনায় তারিখ-ই বেইহাকি-তে, যেখানে তিনি ‘সামবোসা’ নামে এর উল্লেখ করেন। সে সময়ের সমুচা ছিল আকারে খুব ছোট, যাতে ভ্রমণকারীরা তাঁদের স্যাডল ব্যাগে সহজে বহন করতে পারতেন এবং চলার পথে খেতে পারতেন।

দিল্লির মুসলিম সুলতানদের শাসনামলে মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়া থেকে আগত দক্ষ রন্ধনশিল্পীরা রাজকীয় রান্নাঘরে কাজ করতেন, সেই সময়েই সমুচা দক্ষিণ এশিয়ার রান্নাঘরে জায়গা করে নেয়। প্রায় ১৩০০ খ্রিষ্টাব্দে কবি ও দরবারি পণ্ডিত আমির খসরু লিখেছিলেন, রাজপুত্র ও অভিজাতেরা মাংস, ঘি, পেঁয়াজসহ নানা উপাদানে তৈরি সমুচা খেতেন।

ফারসি পাণ্ডুলিপি নিমাতনামা-ই-নাসিরুদ্দিন-শাহিতে সমুচা কীভাবে রান্না করা হয়, তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ছবি: বাইত আল ফান
ফারসি পাণ্ডুলিপি নিমাতনামা-ই-নাসিরুদ্দিন-শাহিতে সমুচা কীভাবে রান্না করা হয়, তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ছবি: বাইত আল ফান

১৪ শতকে মরোক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতা দিল্লির সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলকের রাজসভায় ক্ষুদ্র পাতলা পেস্ট্রিতে কিমা ও মটর দিয়ে তৈরি একটি খাবারের কথা উল্লেখ করেন, যা পরে হায়দরাবাদে ‘লুখমি’ নামে পরিচিতি পায়।

ভূমধ্যসাগর-সংলগ্ন আরব দেশগুলোতে আধা-চাঁদাকৃতি ‘সানবুসাক’ তৈরি করা হয়, যার ভেতরে মুরগির কিমা বা মাংস, পেঁয়াজ, ফেটা চিজ ও পালংশাক থাকে। মালদ্বীপে সমুচার স্থানীয় রূপ হলো ‘বাজিয়া’। এগুলোতে মাছ বা টুনা, পেঁয়াজসহ নানা উপাদান দিয়ে পুর তৈরি করে।

ইন্দোনেশিয়ায় সমুচা একই নামেই পরিচিত, তবে সেখানে এটি আলু, চিজ, কারি, রো-সঙ (শুকনো মাংস) বা নুডলস দিয়ে স্থানীয় রুচির সঙ্গে মিলিয়ে পুর তৈরি করা হয়। সাধারণত এটি ‘সাম্বাল’ (একধরনের ঝাল সস) দিয়ে পরিবেশন করা হয়। ইন্দোনেশীয় ‘পাস্তেল’, ‘পানাডা’ বা ‘এপোক-এপোক’-এর সঙ্গে এর বেশ মিল রয়েছে।

মধ্য এশিয়ার তুর্কিভাষী দেশগুলোতে এই খাবার ‘সমসা’ নামে পরিচিত এবং তা ভাজা নয়, বরং ওভেনে বেক করা হয়। এখানকার সবচেয়ে জনপ্রিয় পুর হলো ভেড়ার কিমা ও পেঁয়াজ, যদিও চিজ, গরুর মাংস ও কুমড়ার পুরও বহুল ব্যবহৃত হয়।

১৬ শতকের ফারসি পাণ্ডুলিপিভিত্তিক মধ্যযুগীয় ভারতীয় রন্ধন পুস্তক নিমতনামা-ই-নাসিরউদ্দিন-শাহিতে চিত্রিত সমুচা পরিবেশনের দৃশ্য। ছবি: বাইত আল ফান
১৬ শতকের ফারসি পাণ্ডুলিপিভিত্তিক মধ্যযুগীয় ভারতীয় রন্ধন পুস্তক নিমতনামা-ই-নাসিরউদ্দিন-শাহিতে চিত্রিত সমুচা পরিবেশনের দৃশ্য। ছবি: বাইত আল ফান

আফ্রিকার ‘হর্ন অব আফ্রিকা’ অঞ্চলে—বিশেষ করে ইথিওপিয়া, সোমালিয়া ও ইরিত্রিয়ায় ‘সামবুসা’ একটি প্রচলিত খাদ্য। রমজান, বড়দিন ও অন্যান্য উৎসবের সময় এটি বিশেষভাবে তৈরি ও পরিবেশিত হয়।

বর্তমানে সমুচা একটি বিশ্বজনীন জনপ্রিয় নাশতা। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে টিকে রয়েছে খাবারটি। এর পেছনের অন্যতম কারণ হলো, বিভিন্ন স্বাদের ও উপাদানের সমন্বয়ে তৈরি এর অসংখ্য রূপ, যা বিশ্বজুড়ে ভিন্ন ভিন্ন রুচির মানুষের মন জয় করেছে।

সূত্র: বাইত আল ফান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পাচারের অর্থে দুবাইয়ে মেয়ের ৪৫ কোটি টাকার ফ্ল্যাট—অভিযোগ নিয়ে যা বললেন গভর্নর

সুধা সদন এখন কিশোর গ্যাং ও মাদকসেবীর আখড়া

যুক্তরাজ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের শতকোটি টাকার সম্পত্তি জব্দ

দোকান দখলে যুবদল-কৃষক দল নেতা, আ.লীগের দোসর আখ্যা দিয়ে ১৬ মামলা

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে এখন বৈঠকে রাজি নন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত