Ajker Patrika

পরণে ঢাকাই শাড়ি

রজত কান্তি রায়, ঢাকা
আপডেট : ১৩ এপ্রিল ২০২২, ০৯: ৫৪
পরণে  ঢাকাই শাড়ি

বাঙালিমাত্রই সেই চিত্রকল্পে আটকে যাওয়া ফিতে। রিওয়াইন্ড বা ফরোয়ার্ড যা-ই করি না কেন, মনে তারই নিত্য যাওয়া-আসা। কে যায়? যার পরনে ঢাকাই শাড়ি।

অথচ কত বর্ণের, কত নকশার কত শত যে শাড়ি আছে এই বঙ্গের তাঁতিদের ভাঁড়ারে! এই বাংলার তাঁতিরা তৈরি করতেন লক্ষ্মীবিলাস শাড়ি। ‘গোপীচন্দ্রের গানে’র কবি এ শাড়ির যে বর্ণনায় বলেছেন, দরিয়ার যত মাছ আর পৃথিবীর যত পাখি, সবই ছিল সেই শাড়ির নকশায়। রাজহাঁস, বালিহাঁস, সরালি, চকোর, বুলবুলের নকশা তোলা সে শাড়ির গায়ে আঁকা ছিল। ছিল বিখ্যাত অগ্নি পাটের শাড়ি। ছিল যুবতী স্ত্রীর মন গলানো এক টাকা দামের ‘মটরি’ নামের পাবনার বিখ্যাত শাড়ি। এর বাইরেও আমাদের পালাগানের নায়িকারা পরতেন গঙ্গার জল, গুয়ার ফুল, উনী, হিয়া, ধ্যাতি ইত্যাদি নামের বিবিধ বৈশিষ্ট্যের দারুণ সব শাড়ি। গুয়ার ফুল শাড়ি এতই সূক্ষ্ম ছিল যে সে শাড়ি হাতের মুঠিতে ভরে ফেলা যেত। ধ্যাতি নামের শাড়ির পাড়ে ছিল হরেক পাখির নকশা। কিন্তু তারপরেও ঢাকাই শাড়ি কেন?  

ঢাকাই শাড়ি 
‘ঢাকাই’ শব্দটি একটু বোঝা দরকার। ঢাকা অঞ্চলে যা তৈরি হয়, তা-ই ঢাকাই। এখন বস্ত্র তৈরি না হলেও ঢাকা অঞ্চলের বিখ্যাত বস্ত্র বয়ন এলাকা ছিল সাভার। সাভার থেকে সোনারগাঁ—এ পুরো অঞ্চল ছিল মূলত ঢাকার অন্তর্ভুক্ত। এ অঞ্চলেই তৈরি হতো ঢাকাই শাড়ি। কোনো একটি মাত্র শাড়ি ‘ঢাকাই শাড়ি’ হিসেবে পরিচিত ছিল না। ঢাকা অঞ্চলে তৈরি হওয়া যেকোনো শাড়িই আসলে ঢাকাই শাড়ি হিসেবে সাধারণভাবে পরিচিত ছিল।
মূলত আমাদের প্রাচীন বঙ্গ সূক্ষ্ম বস্ত্র তৈরির জন্য বিখ্যাত ছিল পৃথিবীতে। তার প্রামাণ্য ইতিহাস রয়েছে। বস্ত্র বয়নের ক্ষেত্রে ঢাকা ছিল বিখ্যাত জায়গা, সেই প্রাচীনকাল থেকে। এখানে তৈরি হতো বিখ্যাত মসলিন। ঐতিহাসিক সেই সূত্রগুলো থেকে জানা যায়, আমাদের ঢাকার তাঁতিরা এতই সূক্ষ্ম বস্ত্র তৈরি করতে পারতেন যে ভোরের শিশির পড়লে তাকে দেখাই যেত না। সে জন্য তার নাম হয়েছিল শবনম। এই শবনম আমাদের বিখ্যাত মসলিনের একটি ধরন। আরও ধরন আছে মসলিনের, যেমন মলবুল খাস, সরকার-ই-আলা, ঝুনা, আব-ই-রওয়ান, খাসসা আর ছিল জামদানি। এর বাইরে সেই প্রাচীনকাল থেকে ঢাকায় তৈরি হতো বিভিন্ন ধরনের বস্ত্র তথা শাড়ি। এখনো তৈরি হয়ে চলেছে সেগুলো।

বিখ্যাত কেন
মূলত ঘন বুনটের জন্য ঢাকার কাপড় বিখ্যাত ছিল। তারপর ছিল নকশার কারুকাজ। এই দুটি মূল ঘটনা ঢাকাই শাড়ির খ্যাতির পেছনে। মসলিন যেমন ছিল সূক্ষ্ম, জামদানি তেমনি ছিল একটু মোটা কাপড়ে নকশায় অভিজাত। অন্যান্য শাড়ি ছিল ঘন বুনটের মধ্যে নকশাদার। ফলে এ শাড়িগুলো ব্যবহারকারীদের নজর কেড়েছিল। 

ঢাকাই জামদানি
মসলিনের যুগ গত হয়েছে অনেক আগে। ধারণা করা হয়, পুরো উনিশ শতক আর বিশ শতকের মাঝামাঝি, এই প্রায় দেড় শ বছর মসলিন ধ্বংসের কাল। ধীরে ধীরে বিভিন্নভাবে মসলিন ধ্বংস করে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা। কিন্তু থেকে যায় মসলিনেরই একটি ধরন, জামদানি। এখনো পর্যন্ত ঢাকাই শাড়ির অহংকার ধরে রেখেছে জামদানি। এখনো ‘ঢাকাই শাড়ি’ বললে চোখে ভাসে হাতে চালানো তাঁতযন্ত্রে বোনা রঙিন জামদানি।

ঢাকার অদূরে শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব তীরের নোয়াপাড়া, রূপসী, মৈকুলী, খাদুন, পবনকুল, মুরগাকুল, বরাব—এসব গ্রামের তাঁতিদের হাতে তৈরি হয় জামদানি। এ গ্রামগুলো এখন প্রশাসনিকভাবে নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁ ও রূপগঞ্জ উপজেলার অধীনে। এই গ্রামগুলোতে এখনো তৈরি হয় ময়ূর পেখম পাড়, কলকা পাড়, মালঞ্চ পাড়, মদন পাড়র, পুঁই ডগা পাড়, কুশি পাড় ইত্যাদি নামের হরেক রকম জামদানি। বলে রাখা ভালো, এখন রঙিন হলেও এক সময় জামদানি ছিল সাদার ওপরে সাদা রঙের খেলা। অর্থাৎ টানা ও পোড়েনে সাদা সুতায় জামদানি বোনা হতো একসময়। হাকিম হাবিবুর রহমানের জানাচ্ছেন, সাদা থেকে রঙিন জামদানির যাত্রায় যুক্ত ছিলেন ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ (১৮৭১-১৯১৫)। উনিশ শতকের শেষ দশকে কিংবা বিশ শতকের শুরুর দিকে নবাব স্যার সলিমুল্লাহর পৃষ্ঠপোষকতায় রঙিন জামদানি তৈরি হতে শুরু করে। ক্রমে তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। জীবনসায়াহ্নে এসে নবাবের নিজে নকশাকার হয়ে যাওয়ার তথ্য আমাদের কাছে চিত্তাকর্ষকই বটে!

রবীন্দ্রনাথ কি জামদানিকেই ‘ঢাকাই শাড়ি’ বলেছিলেন? হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে। হতে পারে, কারণ জামদানি ছিল অভিজাত নারীদের পরিধেয় শাড়ি। এখনো তাই আছে।

সেই সূত্রে রবীন্দ্রনাথ জামদানিকেই হয়তো চিনতেন ঢাকাই শাড়ি বলে। আবার নাও হতে পারে। কারণ জামদানিকেই যে তিনি ঢাকাই শাড়ি বলেছিলেন, তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না কোথাও। তবে প্রচলিত ভাবে মনে করা হয়, ঢাকাই শাড়ি মানে জামদানি। 

পাবেন কোথায়
ঢাকার বিভিন্ন অভিজাত পোশাকের দোকানে পাওয়া যায় হরেক রঙের জামদানি। পাবেন বেশ কিছু অনলাইন শপে। নইলে যেতে পারেন ডেমরা হাটে, প্রতি বৃহস্পতিবার ভোর থেকে শুরু হয় এ হাট। সাধারণত চার হাজার টাকা থেকে এর দাম শুরু হয়। দোকানে চল্লিশ বা পঞ্চাশ হাজার টাকা দামের জামদানি শাড়িও পাবেন। বিশেষভাবে তৈরি করে নিতে চাইলে তার দাম লাখ ছাড়িয়েও যেতে পারে। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত