Ajker Patrika

প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতা চিকিৎসায় ভালো হয়

ডা. ফারজানা রহমান
আপডেট : ০৯ আগস্ট ২০২৩, ১৩: ১৪
প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতা চিকিৎসায় ভালো হয়

প্রশ্ন: আমার চাচাতো বোনের বয়স ১৯ বছর। তার এক বছর বয়সী একটি সন্তান আছে। গ্রামে তার শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে বসবাস করে। সন্তান জন্মের পর থেকে তার মধ্যে কিছু মানসিক অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ে। নিজের সন্তানকে কোলে নিতে চায় না। দিন দিন অস্বাভাবিক আচরণ বাড়ছে। সন্তানকে কোলে দিতে গেলে চিৎকার করে, ভয় পায় এবং আঘাত করার চেষ্টা করে। নিজেকেও আঘাত করে। গ্রামের মানুষজনের ধারণা, তাকে জিনে ধরেছে। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা কবিরাজ দিয়ে চিকিৎসা করানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না; বরং অবস্থার আরও অবনতি হচ্ছে। আমরা তাকে ডাক্তার দেখাতে চাইছি। কিন্তু কীভাবে কী করব বুঝতে পারছি না। পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করলে উপকৃত হব।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, খুলনা

আপনার চাচাতো বোনের যে সমস্যার কথা বলেছেন, রোগের উপসর্গ পড়ে ধারণা করছি, তিনি পোস্ট পার্টাম সাইকোসিস বা প্রসব-পরবর্তী গুরুতর মানসিক রোগে ভুগছেন। এই রোগ হলে রোগীর বদ্ধমূল বিশ্বাস হয়—

  • তাঁর সন্তান ত্রুটিপূর্ণ, বিকলাঙ্গ এবং সন্তানটি তাঁর জন্য ক্ষতিকর।
  • রোগীরা কখনো কখনো সন্তানকে অশুভ কিংবা সবার জন্য ভয়াবহ মনে করেন।
  • রোগীরা বিশ্বাস করেন, সন্তানটি তাঁর ও পরিবারের অন্য সদস্যদের মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
  • এই বিশ্বাসের কারণেই মা একপর্যায়ে তাঁর সন্তানের কোনো যত্ন নেন না, কোলে নেন না, এমনকি নিজের সন্তানকে হত্যাও করে ফেলেন!

 এই মানসিক রোগ এতই গুরুতর যে মা তাঁর শিশুকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেন বা মেরে ফেলেন। এ জন্যই অনেকে মনে করে থাকেন, রোগীকে হয়তো জিন-ভূতে ধরেছে। এই রোগের বিষয়ে সঠিক ধারণা না থাকায় আপনার বোনের চিকিৎসার জন্য তাঁর পরিবারের মানুষেরা কবিরাজের সাহায্য নিচ্ছেন। শুধু গ্রামে নয়, শহরেও এই মানসিক রোগের ব্যাপারে অনেকের হয়তো ধারণা নেই।

প্রথমেই বলব, এটি যে গুরুতর মানসিক রোগ, সেটি পরিবারের সবাইকে জানাতে হবে। রোগীর সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। আপনার বোনের কাছ থেকে তাঁর সন্তানটিকে দূরে, অন্য কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তির কাছে রাখতে হবে।
আপনার বোন সঠিক চিকিৎসা পেলে আশা করা যায় সুস্থ হবেন।

প্রশ্ন: আমার বয়স ২৪ বছর। একজন গৃহিণী। সাত মাস বয়সী একটি ছেলেসন্তান আছে।
বাড়ির কাজে সাহায্য করার মতো কেউ নেই। কিন্তু এতে আমার তেমন কোনো সমস্যা কখনোই হয়নি। তবে কয়েক মাস ধরে কোনো কাজ করতে ইচ্ছা করে না। ঘরের স্বাভাবিক কাজকর্ম করতেও বিরক্ত লাগে। অকারণেই কান্না পায়। এসব কারণে সন্তানের যত্নেও অবহেলা হয়ে যায়। খুব অপরাধবোধে ভুগছি। কেন এমন হচ্ছে বা এই সমস্যার সমাধান কী?

নাসিমা খানম, ময়মনসিংহ

সন্তান জন্ম দেওয়ার পর মায়ের যে মানসিক সমস্যাগুলো হয়, উপসর্গ বা লক্ষণভেদে তাকে বলে পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন এবং পোস্ট পার্টাম সাইকোসিস।

ম্যাটারনিটি ব্লু বলে আরেকটি বিষয় আছে, যা সন্তান জন্মদানের এক সপ্তাহের মধ্যে দেখা দেয়। এ ক্ষেত্রেও মা খুব কান্নাকাটি করেন, মন খারাপ করেন, নিজেদের যত্ন নেন না। এটা কিন্তু পরিবারের সবার অংশগ্রহণ এবং কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে ঠিক হয়ে যায়। কোনো ওষুধের প্রয়োজন পড়ে না।

আপনার এই সমস্যার নাম সহজ ভাষায় প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতা। এটা গুরুতর মানসিক রোগ। এই রোগে আক্রান্ত মায়ের মন খুব খারাপ থাকে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। তিনি মনে করেন, তিনি কিছুই করতে পারবেন না। শিশুর যত্ন নিতে পারবেন না। নিজেকে অনেক তুচ্ছ মনে করেন। কখনো কখনো এমনও হয় যে তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন তিনি দোষী, পাপী। সন্তান জন্মদানের যোগ্য তিনি নন। এর ধারাবাহিকতায় তিনি আত্মহত্যা করেন এবং তার আগে অনেকে নিজের সন্তানকেও হত্যা করেন। বিভিন্ন কারণে এই রোগ হতে পারে। 

কারণ

  • সাধারণত সন্তান জন্মদানের পর সংক্রমণ।
  • হরমোনের ভারসাম্যহীনতা।
  • অতিরিক্ত পরিশ্রম।
  • বিশ্রামের অভাব।
  • পরিবারে মানসিক রোগের ইতিহাস।
  • পরিবারের সহযোগিতার অভাব।
  • অতীতে মানসিক রোগ থাকা।
  • আগের সন্তান জন্মদানের পর এ রকম লক্ষণ থাকা।

যা করতে হবে

  • রোগটি সম্পর্কে পরিবারের অন্য সদস্যদের জানাতে হবে।
  • মায়ের কাছ থেকে শিশুকে আলাদা রাখতে হবে।
  •  বিষণ্নতায় আক্রান্ত মাকে অবশ্যই মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
  • ওষুধ ও কাউন্সেলিংয়ের মধ্যে রাখতে হবে।

এই রোগের চিকিৎসার খরচ বেশি নয়। তবে সময়সাপেক্ষ। হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করালে বেশি ভালো হয়। চিকিৎসা করার ক্ষেত্রে একটুও দেরি করা উচিত নয়। যত দ্রুত চিকিৎসা শুরু হবে, তত তাড়াতাড়ি রোগী সুস্থ হয়ে উঠবেন। একবার এই রোগ হলে পরবর্তী সন্তান জন্মদানের পরও এটি দেখা দিতে পারে। এ ধরনের সমস্যা হলে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে, চিকিৎসাধীন থাকতে হবে, হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটসহ দেশের সব মেডিকেল কলেজ ও সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের সাইকিয়াট্রি ডিপার্টমেন্টে পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশনের চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিভাগে পোস্ট পার্টাম সাইকোসিসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত