Ajker Patrika

তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী থেকে ডাক ক্যাডারে প্রথম নবীনুর রহমান

জেলি খাতুন
নবীনুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত
নবীনুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

চার বোনের পর একমাত্র ভাই নবীনুর রহমান। টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর উপজেলার কোনাবাড়ী গ্রামের এক সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া সেই ছেলেটিই এ বছর ৪৪তম বিসিএসে পোস্টাল ক্যাডারে প্রথম হয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যাচেলর অব ফিজিওথেরাপি সম্পন্ন করেছেন তিনি। বিসিএসের এই অভাবনীয় সাফল্যের পেছনে রয়েছে বছরের পর বছর সংগ্রাম, অধ্যবসায় আর হার না মানা মানসিকতা। নবীনুর রহমানের বিসিএস জয়ের গল্প নিয়ে থাকছে আজকের আয়োজন।

পিছিয়ে পড়েও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন

ছোটবেলায় নবীনুরের পড়াশোনায় তেমন মনোযোগ ছিল না। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত তিনি প্রায়ই ফেল করতেন। গোপালপুর দারুল উলুম কামিল মাদ্রাসা থেকে ইবতেদায়ি শুরু করে দাখিল পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠে তাঁর মধ্যে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। অষ্টম শ্রেণিতে মাদ্রাসা বোর্ডে দেশজুড়ে তৃতীয় স্থান অর্জন করে সবাইকে চমকে দেন। এরপর ২০০৮ সালে দাখিলে জিপিএ ৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। কলেজে ভর্তির সময় মাদ্রাসা থেকে আসায় হীনম্মন্যতা কাজ করত। কিন্তু গোপালপুর সরকারি কলেজে নিজের চেষ্টা আর শিক্ষকদের অনুপ্রেরণায় নবীনুর উচ্চমাধ্যমিকেও জিপিএ ৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে

প্রথমে স্বপ্ন ছিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। বুয়েটের কোচিংও করেছিলেন, কিন্তু সুযোগ পাননি। সুযোগ পেয়ে ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগে। পরে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইসিটি বিভাগে ভর্তির সুযোগ পেলে আগের ভর্তি বাতিল করে টাঙ্গাইলে ভর্তি হন, কিন্তু মন পড়ে ছিল মেডিকেলে। দ্বিতীয় দফায় চেষ্টা করে সফল না হলেও হাল ছাড়েননি। শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন ফ্যাকাল্টির অধীনে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ট্রমাটোলজি থেকে ফিজিওথেরাপিতে গ্র্যাজুয়েশন করেন ২০১৭ সালে।

সাফল্যের পেছনের গল্প

২০১৭ সাল থেকে বিসিএস প্রস্তুতি নিলেও ৩৮তম বিসিএসে অংশ নেন কেবল অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য। ৪০তম বিসিএসে প্রস্তুতি নিয়েও সফল হতে পারেননি। এ সময় বেসরকারি একটি ক্লিনিকে অনুশীলন করেন। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ডাক বিভাগে একজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। তবে ছোট পদকে কখনো ছোট করে দেখেননি, বরং এটাকেই বানিয়ে নিয়েছিলেন নিজের বড় স্বপ্নের সিঁড়ি।

ডাক বিভাগে চাকরি করার ফাঁকে ৪১, ৪৩ এবং ৪৪তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেন। ৪১ ও ৪৩তম ভাইভা উত্তীর্ণ হলেও নন-ক্যাডারেই থেকে যান। এর মাঝে ২০২৩ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে যোগ দেন। পরে জনতা ব্যাংক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নন-ক্যাডার পদে চাকরির সুযোগ পান, তবে মন পড়ে ছিল বিসিএসে। অবশেষে ৪৪তম বিসিএসে পোস্টাল ক্যাডারে প্রথম হয়ে স্বপ্ন পূরণ করেন।

বিসিএসের পেছনের প্রেরণা

নবীনুরের অনুপ্রেরণার বড় উৎস ছিলেন তাঁর বাবা মো. দানেশ আলী, যিনি পোলট্রি খামার পরিচালনা করতেন এবং উপজেলা পরিষদে প্রশিক্ষণে যেতেন। বাবার মুখে কর্মকর্তাদের গল্প শুনেই তাঁর মনে জাগে সরকারি চাকরির স্বপ্ন। নবীনুর মনে করেন, ‘বিসিএস কোনো ব্যক্তিগত অর্জন নয়, এটি একটি দায়িত্ব। এটি তখনই সফল হবে, যখন মানুষের জন্য কাজ করা যাবে।’

বাবার মুখে কর্মকর্তাদের গল্প শুনেই তাঁর মনে জাগে সরকারি চাকরির স্বপ্ন। নবীনুর মনে করেন, ‘বিসিএস কোনো ব্যক্তিগত অর্জন নয়, এটি একটি দায়িত্ব। এটি তখনই সফল হবে, যখন মানুষের জন্য কাজ করা যাবে।’ নবীনুর রহমান, ৪৪তম বিসিএস পোস্টাল, ক্যাডারে প্রথম।

পড়াশোনার কৌশল ও প্রস্তুতির টিপস

» বিষয় বুঝে পড়া, মুখস্থ না করে।

» বারবার মডেল টেস্ট দিয়ে নিজেকে যাচাই করা।

» কঠিন টপিক ব্লকে ভাগ করে পড়ে ছোট ছোট নোট বানানো।

» গাণিতিক প্রশ্ন না দেখে সমাধান করার অভ্যাস।

» সপ্তাহে এক দিন পুরোনো পড়া রিভিশন।

» নিজস্ব শর্টনোট বা নিমোনিক তৈরি করে মনে রাখা।

» লিখিত পরীক্ষার জন্য ইংরেজি সম্পাদকীয় ও ট্রান্সলেশন চর্চা।

» অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ম্যাপ, আলোচিত ইস্যু ও ফ্রি-হ্যান্ড রাইটিং।

নতুনদের জন্য পরামর্শ

বিসিএস দিতে হলে আগে নিশ্চিত হোন যে আপনি আদৌ এই পথের জন্য তৈরি কি না। পরিবারের সমর্থন নিয়ে, সময় আর শ্রম দিতে হবে। প্রিলি প্রস্তুতিতে সহায়ক হবে নবম শ্রেণির বাংলা ব্যাকরণ, ভূগোল, বিজ্ঞান, গণিত এবং মাধ্যমিক স্তরের সাহিত্য বইয়ের লেখক পরিচিতি। লিখিত পরীক্ষায় প্রতিদিন কিছু না কিছু লিখতে হবে, সেটা যে বিষয়েই হোক।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

বর্তমানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত নবীনুর রহমান চান, ডাক বিভাগকে লাভজনক ও আধুনিক করে তুলতে। তিনি বলেন, ‘ডাক বিভাগ একটা সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। এখানেই আমি কাজ করতে চাই।’

অনুলিখন: জেলি খাতুন

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত