Ajker Patrika

জীবনের অগ্রগতিতে বাধা তৈরি করে ‘পারফেকশন প্যারালাইসিস’

মুসাররাত আবির
জীবনের অগ্রগতিতে বাধা তৈরি করে ‘পারফেকশন প্যারালাইসিস’

আপনি যখন কোনো কাজ হাতে নেন, তখন কি সেটা একেবারে মনমতো না হওয়া পর্যন্ত করেই যান? নাকি একটা পর্যায়ে গিয়ে মনে হয়, ‘নাহ্, এতটুকুই যথেষ্ট?’ আসলে কোনো কিছু করতে গিয়ে আমরা সব সময় চেষ্টা করি, কাজটা যেন একেবারে নির্ভুল ও নিখুঁত হয়। কিন্তু আমরা এটাও জানি, একেবারে নিখুঁতভাবে কোনো কাজ করা সব সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না।

তবে কেউ কেউ সবকিছু নিখুঁতভাবে করার বিষয়টিকে এত বেশি গুরুত্ব দেন যে, যতক্ষণ না তাঁরা যেমন চান, কাজটি ঠিক তেমন না হওয়ার আগপর্যন্ত তার পেছনে লেগেই থাকেন। ফলে সৃষ্টি হয় পারফেকশন প্যারালাইসিস। 

পারফেকশন প্যারালাইসিস কী
এ প্রতিযোগিতামূলক পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা নিখুঁত হওয়ার চেষ্টা করি—সেটা কাজ হোক বা পড়াশোনা, সবকিছুতেই যেন পরিপূর্ণতা চাই। কিন্তু এ পরিপূর্ণতার পেছনে ছুটে চলা কখনো কখনো আমাদের অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আর তখনই সৃষ্টি হয় ‘পারফেকশন প্যারালাইসিস’।

এ পরিস্থিতিতে আমরা চিন্তা করি, কাজটি পুরোপুরি নিখুঁত না হলে সেটা করা উচিত নয়। কিন্তু এর ফলে আমরা কাজ শুরু করতে দেরি করি, কখনো শেষ করতে পারি না, অথবা কাজের প্রতি আস্থাহীনতায় ভুগি। এটা শুধু আমাদের মানসিক চাপই বাড়ায় না, বরং ব্যক্তিগত ও পেশাগত উন্নতির পথেও অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। 

পারফেকশন প্যারালাইসিসের কারণ

  • ব্যর্থতার ভয়: অনেকেই মনে করেন, কোনো কাজ পুরোপুরি নিখুঁতভাবে না করতে পারলে তাঁরা সে কাজে ব্যর্থ। এ মানসিকতা এমন দোটানার সৃষ্টি করে, যা কাজ অসম্পূর্ণ রাখা বা দেরি করে কাজ করার প্রবণতার দিকে নিয়ে যায়। 
  • অতিরিক্ত চাপ: পারফেকশনিস্টরা প্রায়ই কাজের চাপে দিশেহারা থাকেন। ছোট ছোট বিষয়ে এত বেশি মনোযোগ দেন যে, মূল কাজটাই চোখের আড়ালে থেকে যায়। ফলে তাঁরা কাজ শেষ করার বদলে বারবার সংশোধন করতে থাকেন। 
  • উচ্চ প্রত্যাশা: পারফেকশন প্যারালাইসিসে ভোগা মানুষ নিজেদের জন্য খুবই উচ্চ মানদণ্ড নির্ধারণ করেন। এ প্রত্যাশা এতটাই বেশি হতে পারে, যা তাঁদের জন্য একধরনের বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাঁরা শুধু পরিকল্পনাই করতে থাকেন, কিন্তু কখনো বাস্তবায়নে যেতে পারেন না। 
  • অন্যের সঙ্গে তুলনা: আজকের সোশ্যাল মিডিয়ানির্ভর বিশ্বে মানুষ প্রায়ই নিজেদের কাজ ও জীবন অন্যদের সঙ্গে তুলনা করেন। অন্যদের উপস্থাপিত অর্জন দেখে নিজের কাজ প্রকাশ করতে তাঁদের দ্বিধা হয়। তাঁরা মনে করেন, সোশ্যাল মিডিয়ার মানুষগুলোর জীবনই আসলে বেশি নিখুঁত।

পারফেকশন প্যারালাইসিসের উদাহরণ
এ সমস্যায় ভুগতে থাকা শিক্ষার্থীরা সব সময় নিজেদের অ্যাসাইনমেন্ট কীভাবে নিখুঁত ও নির্ভুল করা যায়, সে চিন্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ব্যয় করে ফেলছেন। ফলে দেখা যায়, শেষ মুহূর্তে তাড়াহুড়ো করে কাজ জমা দিতে হয়; কিংবা সময়সীমা পার হয়ে যাওয়ার পরও কাজ শেষ হয় না।

একই সমস্যা অফিসের কাজের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। কর্মীরা প্রেজেন্টেশন, রিপোর্ট তৈরি কিংবা ছোটখাটো কোনো প্রজেক্টের পেছনে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করেন। ফলে কাজ শেষ করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে তাঁরা আগের কাজই বারবার সংশোধন করতে থাকেন।

আবার যাঁরা উদ্যোক্তা আছেন, তাঁরা তাঁদের পণ্য বা সেবা যতক্ষণ না নিখুঁত হয়, ততক্ষণ তা বাজারজাত করেন না; কিংবা সবার সামনে আনেন না। তখন দেখা যায়, অন্য কেউ তাঁর উদ্যোগটা কাজে লাগিয়ে নতুন কিছু তৈরি করে ফেলছেন। 

পারফেকশন প্যারালাইসিস যেভাবে ক্ষতিকর
সবকিছু নিখুঁত করার অপেক্ষায় থাকলে আপনার হাত থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সুযোগই হারিয়ে যেতে পারে। যখন আপনি পারফেকশনিজমে আটকে থাকেন, তখন কার্যকরভাবে কাজ সম্পন্ন করার সম্ভাবনা কমে যায়। ক্রমাগত সংশোধন ও পরিবর্তন সময়ের অপচয় ঘটায় এবং কাজের উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দেয়। একই সঙ্গে সব সময় নিখুঁত হওয়ার চিন্তা আপনার দুশ্চিন্তার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। একই কাজ বারবার সংশোধন করতে থাকলে কাজের সৃজনশীলতা কমে যায়। তা ছাড়া কাজে ঝুঁকি নেওয়ার মাত্রা কমে যাওয়ার কারণে নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসও আর থাকে না। 

পারফেকশন প্যারালাইসিস কাটিয়ে ওঠার উপায়
কাজ নিখুঁতভাবেই করতে হবে, এমন মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসুন। মোটামুটি চলনসই কাজ করলেও কিন্তু কাজটা ঠিকই থাকে। একটা কাজের পেছনে অনেক সময় না দিয়ে, কম সময়ে সঠিকভাবে কাজ করাকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। উচ্চাশা থাকা ভালো, তবে বাস্তবসম্মত লক্ষ্য ঠিক করা শ্রেয়। সেটা না হলে অহেতুক নিজের ওপর চাপ বেড়ে যায়। কোনো কাজ যদি অনেক বড় বা দীর্ঘমেয়াদি হয়, তাহলে তা ছোট ছোট কয়েকটি অংশে ভাগ করে নিন। এতে কাজ করা সহজ হয়ে যায়।

কাজের অগ্রগতির দিকে মনোযোগ দিন, নিপুণতার দিকে নয়। এটি আপনার উদ্বেগ ও চাপ কমাতে সাহায্য করবে। ‘নিখুঁত’ ফলাফলের জন্য অপেক্ষা না করে, ছোট ছোট সাফল্য এবং মাইলফলক উদ্‌যাপন করুন। কাজ সংশোধনের জন্য একটি সময়সীমা নির্ধারণ করুন। একবার সময় শেষ হলে সে সময়ে আপনার কাজের সবচেয়ে ভালো সংস্করণ নিয়ে পরের ধাপে যান। ভুলগুলোকে শেখার সুযোগ হিসেবে নিন। 

সূত্র: ইট ইওর ক্যারিয়ার

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত