Ajker Patrika

জমাদিউল আউয়ালের চতুর্থ জুমা: অন্তর জাগরণের ডাক

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ 
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

সময় এক অদৃশ্য নদীর মতো—নিঃশব্দে বয়ে যায়, কিন্তু আর কখনো ফিরে আসে না। প্রতিটি দিন, প্রতিটি জুমা সেই সময়-নদীর একেকটি ঢেউ, যা আমাদের হয়তো আল্লাহর আরও কাছে টেনে নেয়, আবার গাফিলতিতে দূরেও সরিয়ে দেয়।

আজ আমরা এসে পৌঁছেছি জমাদিউল আউয়াল মাসের চতুর্থ জুমায়। এই সময় যেন আমাদের অন্তরে ধ্বনি তোলে—‘এখনই জাগো, এখনই ফিরে এসো তোমার রবের দিকে।’

জুমা: এক সাপ্তাহিক নবজাগরণ

জুমা শুধু সপ্তাহের একটি দিন নয়; এটি আত্মার এক নতুন সূচনা। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘জুমার দিন হলো সপ্তাহের সেরা দিন। এই দিনেই আদম (আ.) সৃষ্টি হয়েছিলেন, এই দিনেই তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয় এবং এই দিনেই তাঁকে জান্নাত থেকে নামানো হয়।’ (সহিহ্ মুসলিম: ৮৫৪)। অর্থাৎ জুমার দিন আমাদের জীবনের জন্য নতুন আশার প্রতীক। প্রতিটি জুমা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—এখনো সময় আছে, আল্লাহর দিকে ফিরে আসা যায়, জীবন বদলানো যায়।

জমাদিউল আউয়ালের শিক্ষা: দৃঢ়তা ও ধৈর্য

ইসলামের ইতিহাসে জমাদিউল আউয়াল মাস নানা ত্যাগ ও সংগ্রামের সাক্ষী। এই মাসে নবীজির সাহাবারা বহু কঠিন সময় অতিক্রম করেছেন ধৈর্য ও ইমানের দৃঢ়তায়। তাঁদের জীবন শেখায়—বিপদে ধৈর্য ধরতে হয়, সংকটে দৃঢ় থাকতে হয়, আর সফলতায় কৃতজ্ঞতা জানাতে হয়।

আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা বাকারা: ১৫৩)। তাই এই মাসের চতুর্থ জুমা আমাদের জন্য হতে পারে আত্মজাগরণের এক নতুন সূচনা—অন্তর পরিশুদ্ধ করার, নিজেকে নতুনভাবে গড়ে তোলার সময়।

সময়ের আয়নায় আত্মসমালোচনা

জমাদিউল আউয়ালের শেষ ভাগে এসে আমাদের ভাবা দরকার—এই সময়টুকু কেমন গেল? আমরা কি নিয়মিত নামাজ পড়েছি? অন্যের প্রতি ন্যায্য থেকেছি? নাকি জাগতিক ব্যস্ততায় ভুলে গেছি আমাদের আসল পরিচয়—আমরা আল্লাহর বান্দা?

হজরত আলী (রা.) বলেছেন—‘যে ব্যক্তি নিজের আত্মার হিসাব নেয়, সে মুক্তি পায়; আর যে হিসাব নেয় না, সে ধ্বংস হয়।’

জুমা আমাদের শেখায় আত্মসমালোচনার গুরুত্ব। নিজের ভেতর তাকানোই ইমানের সৌন্দর্য। কারণ, পরিবর্তন শুরু হয় নিজের মধ্যেই।

জুমার আলোয় অন্তরের পরিশুদ্ধি

জুমার নামাজ শুধু শরীরের ইবাদত নয়, এটি আত্মারও পরিচ্ছন্নতা। আমরা যখন এক কাতারে দাঁড়াই, তখন ধনী-গরিব, নেতা-জনতা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী সব বিভেদ মুছে যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ভালোভাবে অজু করে, তারপর জুমার নামাজে আসে, খুতবা শোনে ও নীরব থাকে; তার এক জুমা থেকে পরের জুমা পর্যন্ত এবং অতিরিক্ত তিন দিনের গুনাহ ক্ষমা করা হয়।’ (সহিহ্ মুসলিম: ৮৫৭)।

জুমা আমাদের শেখায় ঐক্য, বিনয় ও ভালোবাসা। হয়তো আজকের জুমায় কারও চোখে অশ্রু ঝরবে, কারও অন্তর নরম হয়ে যাবে, আবার কেউ হয়তো বলবে—‘আজ থেকে আমি বদলে যাব।’ এই পরিবর্তনের শুরু হোক আজকের এই চতুর্থ জুমায়।

তওবার আহ্বান

আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর নিকট তওবা করো, যেন তোমরা সফল হও।’ (সুরা নুর: ৩১)। তওবা কোনো দুর্বলতা নয়, বরং সাহসের প্রকাশ। যে নিজের ভুল বুঝে আল্লাহর দিকে ফিরে আসে, সে প্রকৃত সাহসী। এই জুমা হোক সেই সাহস অর্জনের দিন—পুরোনো গাফিলতি ভেঙে নতুন জীবনের শুরু করার সময়।

সমাজে কল্যাণের বার্তা

জুমা শুধু ব্যক্তিগত ইবাদতের দিন নয়, এটি সামাজিক ঐক্যের প্রতীক। খুতবার মাধ্যমে মানুষ সঠিক পথের দিকনির্দেশনা পায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সচেতন হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যখন ইমাম খুতবা দেন, তখন তোমরা নীরবে শোনো।’ (সহিহ্ বুখারি: ৯৩৪)। যদি প্রতিটি জুমা আমাদের চিন্তায় ও চরিত্রে সামান্য পরিবর্তন আনতে পারে, তাহলে সমাজ বদলে যাবে।

এই চতুর্থ জুমায় আমাদের প্রার্থনা—যেন আমাদের মসজিদগুলো হয়ে ওঠে সত্য, ন্যায় ও মানবতার নবজাগরণের কেন্দ্র।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...