Ajker Patrika

ফজরের নামাজ জীবনে যে সফলতা বয়ে আনে

হাবিবুর রহমান
জামাতে নামাজ পড়ছেন মুসল্লিরা। ছবি: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি
জামাতে নামাজ পড়ছেন মুসল্লিরা। ছবি: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি

আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দার কল্যাণের জন্য অসংখ্য নেয়ামত দান করেছেন। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ হলো নামাজ, যার মধ্যে রয়েছে বান্দার মুক্তি ও কল্যাণ। আল্লাহ তাআলা মুমিনদের জন্য প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেছেন, যার মাধ্যমে মুমিন ব্যক্তি তাঁর রবের নৈকট্য অর্জন করতে পারে। ফজরের নামাজ দিয়েই মুমিনদের জন্য নতুন দিনের শুভ সূচনা হয়।

ফজরের নামাজ: শয়তানের বিরুদ্ধে প্রথম বিজয়

ফজরের নামাজ আদায়ের মাধ্যমে মুমিন ব্যক্তি শয়তানের বিরুদ্ধে তার প্রথম বিজয় লাভ করে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যখন তোমাদের কেউ ঘুমিয়ে পড়ে, তখন শয়তান তার ঘাড়ে তিনটি গিঁট বেঁধে দেয়; প্রত্যেক গিঁটে সে এই বলে মন্ত্র পড়ে যে—তোমার সামনে রয়েছে দীর্ঘ রাত, অতএব তুমি ঘুমাও। এরপর যদি সে জেগে উঠে আল্লাহর জিকির করে, তাহলে একটি গিঁট খুলে যায়। তারপর যদি অজু করে, তবে তার আর একটি গিঁট খুলে যায়। তারপর যদি নামাজ পড়ে, তাহলে সমস্ত গিঁট খুলে যায়। আর তার সকাল হয় স্ফূর্তি ও ভালো মনে। নতুবা সে সকালে ওঠে কলুষিত মনে ও অলসতা নিয়ে।’ (সহিহ্ বুখারি: ১১৪২, সহিহ্ মুসলিম: ১৮৫৫)

ফজরের আজান বা অ্যালার্ম বেজে উঠলেই আল্লাহু আকবার বলে উঠে পড়তে হবে। আরামের বিছানা ছেড়ে ওঠা সত্যিই এক যুদ্ধের মতো, বিশেষ করে শীতকালে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই আরামের ঘুম ত্যাগ করার মাধ্যমেই আমরা শয়তানের বেঁধে দেওয়া গিঁট থেকে মুক্ত হতে পারি।

অলসতা কেন? মুনাফিক ও মুমিনের পার্থক্য

আমাদের ফজর নামাজ ছুটে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো অলসতা। মহানবী (সা.) বলেন, ‘মুনাফিকদের জন্য ফজর এবং ইশার নামাজের চেয়ে কষ্টকর আর কিছু নেই।’ (সুনানে আবু দাউদ ৫৪৪)। একমাত্র দুর্বল ইমানের ব্যক্তিই ফজরের সময় অলসতার কাছে হার মানে। আল্লাহর খাঁটি ও দৃঢ় ইমানের অধিকারী বান্দারা আল্লাহর আদেশ পালনে সর্বদা তৎপর থাকে, তা যত কষ্টই হোক না কেন।

শাইখ বদর বিন নাদের আল-মিশারি বলেন, ‘আপনি যদি ফজরের নামাজের জন্য ঘুম থেকে জাগতে না পারেন, তাহলে নিজের জীবনের দিকে তাকান এবং দ্রুত নিজেকে সংশোধন করুন। কেননা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ফজরের নামাজের জন্য কেবল তাঁর প্রিয় বান্দাদেরকেই জাগ্রত করান। ঠিক এ জন্যই মুনাফিকদের জন্য ফজরের নামাজ এত কঠিন।’

ফজরের নামাজে অর্জিত সৌভাগ্য ও পুরস্কার

ফজরের নামাজের নেয়ামত, গুরুত্ব ও উপকারিতার কথা বলে শেষ করা যাবে না। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে আল্লাহ তাআলা ও নবী মুহাম্মদ (সা.) তা বর্ণনা করেছেন। ফজরের নামাজ আদায়কারী ব্যক্তি যেসব সৌভাগ্য লাভ করেন—

  • ১. আল্লাহর জিম্মায় থাকা: নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ আদায় করল সে আল্লাহর জিম্মায় চলে গেল। অতএব আল্লাহ যেন তাঁর জিম্মার ব্যাপারে তোমাদের কোনো অভিযুক্ত না করেন।’ (জামে তিরমিজি ২১৮৪)
  • ২. কিয়ামতের দিন পরিপূর্ণ নূরের সুসংবাদ: মহানবী (সা.) বলেন, ‘যারা আধারে (ফজরের সালাতের জন্য) মসজিদের দিকে হেঁটে যায়, তাদের কিয়ামতের দিন পরিপূর্ণ নূর প্রাপ্তির সুসংবাদ দাও।’ (সুনানে আবু দাউদ ৪৯৪)
  • ৩. জাহান্নাম থেকে মুক্তি: হজরত আবু জুহাইর উমারা ইবনে রুয়াইবা (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের পূর্বে (ফজর ও আসরের ওয়াক্ত) নামাজ আদায় করবে সে কখনো জাহান্নামে প্রবেশ করবে না।’ (সহিহ্ মুসলিম ৬৩৪)
  • ৪. সারা রাত নামাজ আদায়ের সওয়াব: হজরত উসমান ইবনে আফফান (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জামায়াতের সঙ্গে ইশার নামাজ আদায় করল সে যেন অর্ধেক রাত জেগে নামাজ পড়ল। আর যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ জামায়াতের সঙ্গে আদায় করল সে যেন পুরো রাত জেগে নামাজ পড়ল।’ (সহিহ্ মুসলিম: ১৩৭৭)
  • ৫. ফেরেশতাদের সাক্ষ্য: আল্লাহ তাআলা রোজ আমাদের খোঁজ খবর রাখেন। আমরা যখন ফজরের সালাতে দাঁড়াই, তখন একদল ফেরেশতা পৃথিবীতে হতে আসমানের দিকে যাত্রা করে আল্লাহর কাছে পৌঁছায়। তখন আল্লাহ ফেরেশতাদের কাছে জানতে চান, ‘তোমরা আমার অমুক অমুক বান্দাদের কোন অবস্থায় দেখে এলে?’ তখন ফেরেশতারা বলবে, ‘হে আমাদের রব, আমরা আপনার অমুক অমুক বান্দাকে নামাজরত অবস্থায় দেখে এসেছি।’ (সহিহ্ বুখারি: ৫৫৫)

ফজরের বরকতময় সময় ও আমাদের অবহেলা

ফজরের সময়টি এতটাই বরকতময় যে, আল্লাহ তাআলা ফজর নামেই পবিত্র কোরআনে একটি পূর্ণাঙ্গ সুরা নাজিল করেছেন। তিনি সেখানে শপথ করে বলেন, ‘শপথ সুবহে সাদিকের!’ (সুরা ফজর: ১)। এই সময়ে আমরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে থাকি, অথচ রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, প্রতি রাত্রের শেষ তৃতীয়াংশে আমাদের মর্যাদাবান ও বরকতপূর্ণ রব দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন এবং বলেন, ‘যে আমাকে ডাকবে আমি তার ডাকে সাড়া দেব। যে আমার নিকট কিছু প্রার্থনা করবে আমি তাকে তা দান করব। যে আমার নিকট মাফ চাইবে আমি তাকে মাফ করে দেব।’ (সহিহ্ বুখারি: ১১৪৫, সহিহ্ মুসলিম: ৭৫৮)

অনেকেই অতিরিক্ত রাত জেগে মোবাইল ফোন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা অন্যান্য অকাজে সময় নষ্ট করে ফজরের নামাজ কাজা করে থাকেন। দিনের শুরুতেই শয়তানের কাছে এ ধরনের পরাজয় মেনে নিলে বাকি দিনটি কোন অবস্থায় কাটবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ফজরের নামাজ দিয়ে দিন শুরু করলে ব্যক্তিগত জীবনে শৃঙ্খলা ও সময়ানুবর্তিতা আসে। ছাত্র তার পড়াশোনার জন্য অধিক সময় পায়, কর্মব্যস্ত মানুষ নির্দিষ্ট সময়ে তার কর্মস্থলে যেতে পারে, আর কৃষক তাঁর আবাদি জমিতে সকালের মিষ্টি হাসি দেখতে পায়। এত নেয়ামত ও সুযোগ সুবিধাপূর্ণ ফজরের নামাজ কাজা করে নিজেদের জীবনকে ঝামেলায় ফেলা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আসুন, আমরা অলসতাকে দূরে ঠেলে ফজরের নামাজ দিয়ে আমাদের দিনের শুভ সূচনা করি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত