
অভূতপূর্ব রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। তিন দিনের মাথায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। প্রায় ৫ মাস অতিবাহিত হলেও সরকার এখনো ধাতস্থ হয়নি। বিভিন্ন খাতে সংস্কার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, দ্রব্যমূল্য, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর চাপসহ নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে এই সরকার। প্রধান উপদেষ্টা মনে করেন, সংস্কার ও বছরের শেষ নাগাদ কিংবা আগামী বছরের প্রথমার্ধে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়ার কোনো ঘাটতি নেই। গত ২৯ ডিসেম্বর (২০২৪) ইংরেজি দৈনিক নিউ এজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এ মন্তব্য করেন তিনি। ঢাকায় প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় বাংলায় সাক্ষাৎকারটি নেন পত্রিকাটির সম্পাদক নূরুল কবীর। তাঁর সম্মতিক্রমে সাক্ষাৎকারটি আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

নূরুল কবীর: আপনার চার মাস হলো প্রায়। এই চার মাস আর আগের চার মাসের মধ্যে কোন পর্বটা আপনার ভালো লাগে বা কোনটা খারাপ?
মুহাম্মদ ইউনূস: খারাপ কোনোটাই না। খারাপটা বলব না, কিন্তু ভিন্ন। আগেরটা ছিল আমার নিজস্ব জগৎ। সারা জীবন ধরে যা যা করে এসেছি, সেটার মধ্যেই ছিলাম। নিজস্ব আয়োজন, নিজস্ব চিন্তা। তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। সেটা আমার মতো করে ট্যাকল করেছি। আমি আমার মতো করে চলেছি। সেটা একেবারে আমার নিজস্ব জগৎ। এটা একবারে ভিন্ন জগৎ। এটা আমার নিজস্ব জগৎ না। এই জগতে আমি কোনো দিন ছিলাম না; থাকার কোনো আগ্রহও ছিল না। এটার ডান-বাম আমার জানা নেই। অনেকটা হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে চলার মতো অবস্থা। কিন্তু এটারও একটা চ্যালেঞ্জ আছে।
আমাকে তারা আহ্বান জানিয়েছে। প্রথমে একটু সংকোচ করছিলাম যে এতে যাওয়া ঠিক হবে না, যেহেতু আমি এ জগতের মানুষ নই। কিন্তু তারা আমাকে বোঝাতে পেরেছে যে, এই পরিস্থিতিতে আপনার আসা দরকার। শেষ পর্যন্ত আমি রাজি হয়েছি যে, এইভাবে তোমরা প্রাণ দিয়েছ, তোমরা রক্ত দিয়েছ। আমার জন্য না হয় একটু চ্যালেঞ্জিং হলোই। কাজেই আমি রাজি হলাম। এটা ভিন্ন জগৎ। এই ভিন্ন জগতের মধ্যে এখন চলছি। দেখা যাক কত দূর যেতে পারি।
নূরুল কবীর: কিন্তু আগস্টের ৮ তারিখে এই জগৎটা যদি শুরু না হতো আপনার জন্য, পেছনের (আগের) যে চার মাস, আপনার মনে হয় তত দিনে জেলে থাকার কথা ছিল।
মুহাম্মদ ইউনূস: হয়তো, আমি তখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম কোন কোন দেশে যাব, যাতে বাংলাদেশে ফিরে যেতে না হয়। আমি এক উপলক্ষে আরেক দেশে ছিলাম। সেখানে বসে ভাবছি, এখন ফিরে যাওয়া ঠিক হবে কি না। কারণ, যাওয়ার সময় উত্তেজনা দেখে গেছি, কারফিউ দেখে গেছি। কারফিউর ভেতর দিয়ে আমাকে যেতে হয়েছে; উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে।
নূরুল কবীর: তার মানে, আপনি কারফিউ ভঙ্গ করেছিলেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি কারফিউ ভঙ্গ করে গেলাম, তা না হলে তো যেতে পারতাম না। ভাগ্যিস, কেউ ধরেনি পথে। অত কড়াকড়ি কারফিউ ছিল না। ওই অবস্থা তো দেখে গেছি এবং এটা ক্রমাগতভাবে দেখেছি পত্রপত্রিকায়, সোশ্যাল মিডিয়াতে ভয়ংকর রকম কাজ হচ্ছে। কাজেই ক্রমাগতভাবে ফিডব্যাকটা পাচ্ছিলাম। তার মধ্যে এই ঘটনা ঘটে গেল, একবারে অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা। কিন্তু এর মধ্যে বুঝি নাই যে এর মধ্যে আমাকে জড়িত হতে হবে। আমাদের এর মধ্যে একটা ভূমিকা পালন করতে হবে। কাজেই চার মাস এভাবেই গেছে আমার।

নূরুল কবীর: আপনি ৮ আগস্টে ক্ষমতা গ্রহণের পরে আপনার বিরুদ্ধে বিগত সরকারের যে আইনগত অভিযোগ ছিল, সেগুলো কোর্ট থেকে একের পর এক উঠে যায়। আপনার পজিশনের ভারে কিংবা প্রভাবে এ ঘটনা ঘটেছে—লোকেদের এ রকম ভাবনার সুযোগ আছে।
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি বলব, এটা আমি সরকারে থাকি বা দেশে থাকি, না থাকি—এগুলো এমনি চলে যেত। এগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। আমাদের যারা প্রতিনিধিত্ব করছেন আদালতে, আমাদের যে উকিলরা আছেন, তাঁরা এটা বোঝাতে পারতেন যে এটার কোনো ভিত্তি নেই। এটার কোনো তথ্য নাই, কিছুই নাই। এগুলো খুবই ঠুনকো জিনিস ছিল। কাজেই এটা আমার জানা-অজানার কোনো বিষয় নয়। যেহেতু এটা বিচারের বিষয়, বিচারেই চলে যেত। আমি থাকলেও যেত, না থাকলেও যেত। ঘটনার চক্রে আমি ছিলাম।
নূরুল কবীর: কিন্তু লোকেরা যে বিচারব্যবস্থার ওপর তৎকালীন এক্সিকিউটিভের, রাষ্ট্রের প্রভাবের কথা বলছিল বা বলাবলি আছে এখনো, তাহলে কি আপনি মনে করেন, উনারা ক্ষমতায় থাকলেও কোর্ট ওইভাবে ব্যবহার করত, মানে ন্যাচারাল পদ্ধতিতে?
মুহাম্মদ ইউনূস: আগের যারা ছিল তারা তো করে নাই। করে নাই বলেই তো আমি আদালতের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলাম। যারা এসেছে, তারা বিচার চাচ্ছে, বিচার প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে।
নূরুল কবীর: সেভাবেই যদি চলত, তাহলে তো আপনি জেলে যাওয়ার একটা...
মুহাম্মদ ইউনূস: অবশ্যই। আমি তো জেলে যাওয়ার পথেই ছিলাম। [আদালতে] আসা-যাওয়ার পথে প্রতিবারই মনে হচ্ছে, এবারই বোধ হয় জেলে যেতে হবে। মাঝে মাঝে প্রস্তুতি নিয়ে গেছি যে হয়তো ফেরা না-ও হতে পারে এবার। আমার সহযোগী যাঁরা আছেন, তাঁরা তাঁদের আত্মীয়স্বজনকে বলে গেছেন তাঁদের জন্য। আমি বলেছি, আমার কিছু করার নাই, যেমন আছে হবে। আমি আমার ফ্যামিলিকেও এ রকম প্রস্তুত করে যাইনি। বলি যে, রেখে দিলে রেখে দেবে, নিয়ে গেলে নিয়ে যাবে। আমি খুব সহজভাবে দেখছিলাম যে, এটা নিয়তির খেলা। এটা যেভাবে হবার হবে। এটাতে প্রস্তুতি নিয়ে আমার কোনো কাজ নাই যে জেলে থাকলে এই করতে হবে, করব। এটা যখন কপালে আছে, এটা আমাকে করে যেতে হবে।
নূরুল কবীর: আপনি এইমাত্র বললেন যে, এটা একটা ভিন্ন জগৎ এবং এইভাবে জড়িয়ে পড়তে হবে; এ রকম একটা রাজনৈতিক দায়িত্ব রাষ্ট্র পরিচালনায়, সেটা আপনি চিন্তা করেননি।
মুহাম্মদ ইউনূস: না।
নূরুল কবীর: আপনি ২০০৭ সালে যখন একটা পার্টি করতে গিয়েছিলেন, সেই সময় তো এটা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবেই চিন্তা করেছিলেন। সেখানে যদি আপনি কনটিনিউ করতেন, আপনাকে তো রাজনৈতিক দায়িত্বই গ্রহণ করতে হতো।
মুহাম্মদ ইউনূস: সেটার কারণ ছিল যে এখানে কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না তখন, সবাই আমার বন্ধুবান্ধব সহযোগী, পরিচিত। সবাই বলছে, আপনি কিছু একটা করেন; পেছনে লেগে রইল...আপনি ছাড়া পারবে না কেউ, এই যা যা বলে আরকি আশপাশের লোকজন। এতে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে শেষে বললাম যে ঠিক আছে আমি করব এইটা। পথে আসতে-যেতে সাংবাদিকেরা ধরল। তখন আমি বলেছি, হ্যাঁ, আমি করব। এই দিয়ে শুরু হলো। তখন বেশির ভাগ সময় আমি আসা-যাওয়া করছিলাম বিভিন্ন জায়গায়, উত্তরবঙ্গে যাচ্ছিলাম, চিটাগাং যাচ্ছিলাম। প্রতিবার এয়ারপোর্টে এই কথাবার্তা হচ্ছিল। আর কোথাও না। তখন একসময় ধরল যে তাহলে কী নাম দেবেন? আমি (বললাম) যে নাম ঠিক করি নাই। নাম ঠিক করলে আপনাদের জানাব। তখন বলল, নাম ঠিক না করে কীভাবে যান? তখন অবশ্য একটা নাম দিলাম, নাগরিক শক্তি। তারপর বুঝলাম যে এটা বেশ এগিয়ে যাচ্ছে জিনিসটা। তারপর সবাইরে বললাম যে এটার [ওপর] মতামত নাও। মতামত নেওয়ার ব্যাপারটি হলো, কোনো রকম এটা থেকে দূরে সরা যায় কি না, তার চেষ্টা। নাম হলো, মতামত হলো। তারপর আমি দেখলাম যে ঢুকে যাচ্ছি এর ভেতরে। যখন দশ সপ্তাহ হলো প্রায়, তখন বললাম যে না ভাই, আমি কোনো রাজনৈতিক দল করছি না, কিচ্ছু না। কাজেই আমার মাথার ভেতরে একদিন এই রাজনীতির মধ্য দিয়ে গিয়ে ক্ষমতায় যাব, এ রকম কোনো পরিকল্পনা ছিল না, এটা দীর্ঘমেয়াদি জিনিস।
নূরুল কবীর: কিন্তু রাজনৈতিক দল তো শেষ পর্যন্ত ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত...
মুহাম্মদ ইউনূস: ছিল। কিন্তু তখন আমি তো আসলে রাজনৈতিক দল করতে চাচ্ছিলাম না। ঠেকা দেবার জন্য এগুলো বলে যাচ্ছিলাম। শেষে মনে করলাম যে, এটা বেশ গভীরে চলে যাচ্ছে। তখন একদম পরিষ্কার বলে দিলাম। তখন সবাই হতবাক হয়ে গেছে। তখন আমার বন্ধুবান্ধব বিরক্ত হয়ে ছেড়ে দিলেন।
নূরুল কবীর: আপনি কি আলাপ করেছিলেন বন্ধুদের সঙ্গে?
মুহাম্মদ ইউনূস: কিচ্ছু করিনি। সে জন্য আরও হতবাক হলো। বলে যে আপনি কিছু বললেন না আমাদের! আমরা আপনার পেছনে ঘুরলাম এত দিন ধরে।
নূরুল কবীর: মনঃক্ষুণ্ন হবার কথা...
মুহাম্মদ ইউনূস: খুবই মনঃক্ষুণ্ন হয়েছে তারা।
নূরুল কবীর: তারা এখন কি আনন্দে আছে?
মুহাম্মদ ইউনূস: তারা কাছে আসে না। বলে আবার কোন দিকে নিয়ে যায় আমাদের।
নূরুল কবীর: ওই নাগরিক শক্তির সঙ্গে ছাত্রদের যে নাগরিক কমিটি, তার কোনো চিন্তা বা ভাবনার সম্পর্ক আছে?
মুহাম্মদ ইউনূস: নাগরিক শব্দটা কমন আছে এটা দেখতেছি। আমার সঙ্গে তো আর কোনো আলোচনা হয় নাই, তারা কোথা থেকে শব্দ পেল না পেল।
নূরুল কবীর: এই শব্দটা যেকোনো লোক ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু আপনার সঙ্গে কোনো পরামর্শ করে নাই তারা?
মুহাম্মদ ইউনূস: পরামর্শ করে নাই।
নূরুল কবীর: আপনি প্রায়ই বলেন, কয়েকবারই বলেছেন, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে যে ছাত্ররা আপনাকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে, তাদের ম্যান্ডেটের কারণে। ছাত্রসমাজ হিসেবে ৫ আগস্ট যে পরিমাণ তারা সমন্বিত ছিল, সংগঠিত এবং একাকার ছিল, এইটা যদি বিভক্ত হয়ে যায় তাদের উদ্দেশ্য সাধিত হয়ে যাওয়ার পর, এই অর্থে যে ইমিডিয়েট উদ্দেশ্য ছিল তৎকালীন একটা স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পতন। তার পতনের পরে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের বিভিন্ন রাজনীতি আছে। তারা যদি বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে কিংবা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থের সংঘাত ঘটে, তখন আপনার ম্যান্ডেটটা প্রশ্নবিদ্ধ হবে না?
মুহাম্মদ ইউনূস: এটা হলো অন্তর্বর্তী সরকার। আমি সেই সরকারের একটা অংশ। ওইটা হলো রাজনীতি। এই সরকারে আমি কত দিন আছি না আছি, সেটা একটা ব্যাপার। ওরা কী করছে, রাজনীতির কী ফল দাঁড়াবে, সেটা ভিন্ন জিনিস। এটা একজন নাগরিক হিসেবে ওরা চিন্তা করতে পারে যে কী হবে না হবে। কিন্তু সরকার হিসেবে আমি আমার দায়িত্ব পালন করছি; যতটুকু আমার সাধ্যে কুলায়।

নূরুল কবীর: আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ওটা সংঘবদ্ধ ছাত্রসমাজের ম্যান্ডেট ছিল। সেই সংঘবদ্ধতাটা যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে...
মুহাম্মদ ইউনূস: দুর্বল হয়ে যাবে।
নূরুল কবীর: দুর্বল হয়ে যাবে?
মুহাম্মদ ইউনূস: অবশ্যই দুর্বল হবে।
নূরুল কবীর: এ রকম সম্ভাবনা আপনি দেখেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: সব সময় সম্ভাবনা তো থাকে। একটা দুর্বল হবে আরেকটা সবল হবে। এই টুকরা এই টুকরার সঙ্গে মিলবে। নানা রকম ঘটনা তো ঘটে।
নূরুল কবীর: অন্যান্য টুকরার কথা বলছেন। ধরুন, আমরা যাঁরা বাইরে থেকে দেখি, ওই অভ্যুত্থানে বিজয়ী ছাত্রনেতৃত্ব আপনাকে আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী সেইটাকে সমর্থন করেছে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যারা পাওয়ার কনটেন্ডার, তারা আপনাকে সহযোগিতা ও সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তাহলে আপনি যখন প্রায়ই বলেন, ছাত্ররা আমাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছে, তখন আপনার কি মনে হয় যে অন্য দুইটা সেক্টর যারা সংগঠিত, নানানভাবে, তারা মনঃক্ষুণ্ন হতে পারে?
মুহাম্মদ ইউনূস: হতে পারে। কিন্তু বাস্তব তো তাই। আমাকে তো ডেকে এনেছে ছাত্ররা। কাজেই আমি সেভাবেই বলেছি, ছাত্ররা আমাকে নিয়োগ করেছে। এখন সবাই মিলে এটা সমর্থন করেছি আমরা। সেটা হলো বৃহত্তর একটা জিনিস। কিন্তু ইমিডিয়েট ছিল যে আমার সঙ্গে কথাটা হচ্ছে ছাত্রদের সঙ্গে। যাদের সঙ্গে আমার কোনো পরিচয় নাই, জীবনে দেখিনি তাদেরকে, তাদের সঙ্গে আমার পরিচয়...সেভাবে আমি কথাটা জানিয়েছি। আমার বাস্তবটা জানিয়েছি। কাউকে মনঃক্ষুণ্ন করার জন্য, কাউকে আঘাত দেওয়ার জন্য এরা দেয় নাই, ওরা দিছে, ও রকম কিছু না।
নূরুল কবীর: না মানে, পাওয়ার ব্লক থাকে তো...
মুহাম্মদ ইউনূস: অবশ্যই।
নূরুল কবীর: এই তিনটাই আপনার জন্য, দেশের মানুষের জন্য আপনার সরকারের অস্তিত্ব চলমান থাকার জন্য, জরুরি আমাদের মনে হয়।
মুহাম্মদ ইউনূস: অবশ্যই, অবশ্যই।

নূরুল কবীর: আপনার এই যে প্রধান উপদেষ্টা পদের নাম, মানে নোমেনক্লেচার অব দি পজিশন, এইটা আপনি অ্যাগ্রি করলেন কেন? আপনি কাকে উপদেশ দেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: ওগুলো আমার মাথায় আসে নাই। নামটা কি উপদেষ্টা হলো না কী হলো। দায়িত্ব নিতে বলেছে, আমি দায়িত্ব নিয়েছি।
নূরুল কবীর: উপদেষ্টা হলো একটা পজিশন। উপদেষ্টা মানেই আপনি কাউকে উপদেশ দেন।
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি এগুলোর ব্যাখ্যার মধ্যে যাই নাই। বলেছে, আপনাকে দায়িত্ব নিতে হবে এই সরকারের। আমি দায়িত্ব নিয়েছি। নামটা কী দিল না দিল, কোথা থেকে আসল...
নূরুল কবীর: একবারও মনে হয়েছে?
মুহাম্মদ ইউনূস: এগুলো বড় মনে হয়নি। কারণ, বলেছে যে এই ধরনের পরিস্থিতিতে এই ধরনের নামই হয়। কাজেই আমার চ্যালেঞ্জ করার কিছু নাই।
নূরুল কবীর: দুইটা ভিন্ন। একজন চিফ থাকে। চিফকে অন্যরা উপদেশ দেয়। তাহলে আপনি উপদেশদাতাদের মধ্যে প্রধান। কিন্তু কাকে?
মুহাম্মদ ইউনূস: এটা চিন্তা করি নাই।
নূরুল কবীর: আপনি যে মন্ত্রিপরিষদ (উপদেষ্টা পরিষদ) তৈরি করলেন ছাত্রদের আহ্বানে, অন্যদের সমর্থনে, সেইখানে কি আপনার মন্ত্রিপরিষদ গঠনে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ছিল?
মুহাম্মদ ইউনূস: পরিপূর্ণ বলব না, এটা তো তাৎক্ষণিকভাবে হয়েছে। এটা এমন কিছু না যে চিন্তাভাবনা করে করা হয়েছে। কাজেই আমাকে যতটুকু বলা হয়েছে, আমি সেটা করেছি। অন্য কারা কী করল, সেটা নিয়ে মাথা ঘামাইনি।
নূরুল কবীর: পরামর্শগুলো কি এসব সেক্টর থেকে এসেছে আপনার কাছে বা কোনো রেকমেন্ডেশন সেটা আর্মি থেকে বা রাজনৈতিক দলের মধ্য থেকে?
মুহাম্মদ ইউনূস: না না না। ওই রকমভাবে কিছু আসে নাই। বলছে যে এরা এরা আছে। আপনি কারে কারে নেবেন। শপথ গ্রহণ করতে হবে আগামীকাল বা সেদিনেই, এ রকম অবস্থা। আমি তাৎক্ষণিকভাবে আমার পরিচিত যা নাম ছিল, সেগুলো দিয়েছি।
নূরুল কবীর: আপনার কাছে এই খবর নিশ্চয়ই আছে বা আপনার এজেন্সিগুলো এই খবর কি দেয় যে আপনার সরকারের যাঁরা সদস্য, তাঁদেরকে অন্তত দুটো ক্যাটাগরিতে জেনারেলি ভাগ করা যায়। এক পক্ষের ব্যাকগ্রাউন্ড হচ্ছে এনজিওস। সেখানে আপনার ব্যাপারে একটা সমালোচনা আছে যে চিটাগংয়ের লোক বেশি। কারণ, আপনার বাড়ি চিটাগং? আরেক পক্ষ হচ্ছে, আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যে, গণতন্ত্রের জন্য লড়াই থেকে অনেকে অনেক দূরে ছিলেন। এই তাঁদের কারণে এখন ঠিক স্টেটক্রাফট পরিচালনার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে কিছু সমস্যা হচ্ছে। এই কথাগুলো কি আপনার কানে আসে?
মুহাম্মদ ইউনূস: সব সময় বলাবলি করে, সবাই বলছে। কাজেই এখানে না আসার কোনো কারণ নাই। এ জন্য বিব্রত হবারও কোনো কারণ নাই। সেভাবেই হয়েছে। নানা জায়গা থেকে আমরা এসেছি। আমারও তো কোনো অভিজ্ঞতা নাই। কাজেই ওদের দোষ দেব কী করে। আমাকে দেশ চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তার তো বিন্দুমাত্র অভিজ্ঞতা নাই। আমি তো কোনো দিন এ ধরনের কাজে ছিলাম না। আমি যদি পারি, ওরাও পারবে, এটাই আমার ভরসা ছিল।
নূরুল কবীর: তাঁদের পারফরম্যান্স নিয়ে আপনার কেমন...
মুহাম্মদ ইউনূস: নিজের পারফরম্যান্স নিয়েই আমার সন্দেহ। ওদের পারফরম্যান্স নিয়ে কী জিজ্ঞেস করব।
নূরুল কবীর: কিন্তু আপনারটা তো অন্যরা বলবে...
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি বলব; আমি দেখছি তো।
নূরুল কবীর: আপনি কি আপনার পারফরম্যান্স নিয়ে সন্তুষ্ট?
মুহাম্মদ ইউনূস: না। বলছি যে আমার তো সেই কোয়ালিটি নাই, করার জন্য যেটুকু দরকার ওটুকু নাই। যদিও সাধ্যমতো করি, যদি লেগে যায় তো ভালো। না হলে আমাদের কপাল খারাপ।

নূরুল কবীর: রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে পরিমাণ সমঝোতা এবং যোগাযোগ থাকা দরকার বলে পত্রপত্রিকা বা অন্যান্য যাদেরকে আমরা বলতে শুনি, সেই পরিমাণ সমঝোতা এবং যোগাযোগ আপনার আছে বলে মনে হয়? আমাদের কাছে মনে হয়, কিছুটা দূরত্ব আছে।
মুহাম্মদ ইউনূস: আমার কাছে মনে হয়, অবিশ্বাস্য রকম সমঝোতা-আত্মীয়তা-ঘনিষ্ঠতা আছে। এটা আমার কাছে অবাক লাগে। কাগজপত্রে দেখি তাঁরা একজনের বিরুদ্ধে একজন কটু কথা বলে। যখন সামনে আসে, সবাই কী আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বলেন! আমার কাছে অবাক লাগে এগুলো! মনে বড় সাহস লাগে। যখনই কথা বলি, ব্যক্তি হিসেবে যখন রাজনৈতিক দলের কারও সঙ্গে কথা বলি, অন্যরা কেউ নাই, একা সে। কিন্তু তার সঙ্গে যখন কথা বলি, কী রকম সমর্থন নিয়ে কথা বলে! আমি অভিভূত হয়ে যাই যে এত সমর্থন থাকা সত্ত্বেও এই দেশ চলছে না কেন! এর মধ্যে মাঝে মাঝে আবার কাগজপত্রে এ রকম কথাবার্তা [প্রকাশ] হয় কেন? এই দু রকম কেন?
নূরুল কবীর: কেন এমন হয় বলে আপনার মনে হয়?
মুহাম্মদ ইউনূস: ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় মনে হয়, এর একটা হলো রাজনৈতিক কথা। কিছু অঙ্গভঙ্গি আছে, যেগুলো রাজনীতিতে চালু হয়ে গেছে। এভাবে কথা না বললে রাজনৈতিক নেতা বলে মনে হয় না। ওভাবে, ওই শব্দে কথা বলতে হয়; ওই সুরে কথা বলতে হয়। টেলিভিশনে গেলে ওই কণ্ঠে কথা বলতে হয়। কিন্তু যেইমাত্র ব্যক্তি হিসেবে কথাবার্তা বলেন, তখন বলার ভঙ্গি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কাজেই সেটার আন্তরিকতা এবং সেটার ঘনিষ্ঠতা আমাকে অভিভূত করে। প্রতিবারই আমাকে অভিভূত করে।
নূরুল কবীর: একটা অন্য কথায় আসি। আপনার সরকার সেপ্টেম্বর মাসে সম্ভবত অক্টোবরে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যাঁরা এই গণতন্ত্রের আন্দোলন এবং অভ্যুত্থানে প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেক পরিবারকে ৩০ লাখ টাকা দেবেন। পরবর্তীকালে জুলাই ফাউন্ডেশন হলো। সেখান থেকেও কথা এসেছিল যে আহতদের এক লাখ টাকা করে এবং পাঁচ লাখ টাকা করে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তরুণ-তরুণী, ধনী-গরিব ও মধ্যবিত্তনির্বিশেষে তাঁদেরকে দেওয়া হবে। আপনি নিশ্চয়ই সচেতন আছেন যে, সেই প্রতিশ্রুতি পালিত হয় নাই এখনো। এটা কেন? ইতিমধ্যে আপনারা হাজার কোটি টাকা করে বিভিন্ন ব্যাংকে দিয়েছেন, রাষ্ট্রীয় এক্সচেকার থেকে লুটপাটের কারণে যে সমস্ত ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের। কিন্তু যারা এই ব্যবস্থাকে বদলাল, তাদেরটা প্রায়োরিটিতে আসল না কেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: প্রায়োরিটিতে ছিল বলেই এত কথা ঘোষণা হলো। প্রায়োরিটিতে ছিল। কিন্তু বাস্তবায়ন করা যায়নি। এগুলো হলো আদেশ কার্যকর করার ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা। কীভাবে টাকা কার কাছ থেকে কোথায় যাবে? কীভাবে বিতরণ হবে? এগুলো নিয়ে। দেওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নাই। যত টাকা লাগে তাদের, এই কমিটমেন্ট আছে এবং তাদের আমরা জীবৎকালে যত সমর্থন দরকার, যত পয়সাকড়ি দরকার, সবকিছুর জন্য কমিটমেন্ট আছে। এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নাই; টাকারও কোনো অভাব নাই।
নূরুল কবীর: কত দিন লাগতে পারে?
মুহাম্মদ ইউনূস: এখন আমার আগাম বলতে ভয় ভয় লাগে। যে কথা বলি, ওটায় পারি না তো শেষ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছাতে।
নূরুল কবীর: আপনার কথায় আন্তরিকতা তো মানুষ বিশ্বাস করে। আপনার অনুমান? অন্তত এটা তো খুবই একটা ইমিডিয়েট এবং প্রায়োরিটির মধ্যে থাকার কথা।
মুহাম্মদ ইউনূস: নিশ্চয়ই।
নূরুল কবীর: এটা কি আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে হচ্ছে?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে। কার হাত দিয়ে কীভাবে যাবে, কার কাছ থেকে কোথায় যাবে, এগুলো নিয়ে গোলমাল হচ্ছে। আর কিছু না।
নূরুল কবীর: তাতে আমলাতন্ত্রের কিছু হচ্ছে না। কিন্তু সরকার, আপনার সরকারের বদনাম হচ্ছে।
মুহাম্মদ ইউনূস: এটা আমাদের সবার সম্মিলিত ব্যর্থতা। আমি ব্যুরোক্রেসিকে (আমলাতন্ত্র) দোষ দেব না। তাদেরও নিয়মকানুন আছে। আমরা হয়তো সেই নিয়মকানুন বুঝি না বলে কানেকশনটা ঠিকমতো করতে পারি নাই।
নূরুল কবীর: আপনার জন্য কোনো টাইমলাইন বলা কি কঠিন?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি আবার মাস, দিন একটা দিয়ে আবার বিব্রত হতে চাচ্ছি না আরকি।
নূরুল কবীর: সাম্প্রতিককালে আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ করছেন, আমরাও লক্ষ করছি যে সরকারের যে গণতান্ত্রিক সংস্কারের কর্মসূচি এবং নির্বাচন—এই দুটিকে পরিপূরক না ভেবে একটা সাংঘর্ষিক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে আলাপ-আলোচনার মধ্যে। এটা কি আপনাকে চিন্তিত করে?
মুহাম্মদ ইউনূস: না, এখনো সাংঘর্ষিক তো যায় নাই। আমরা যেভাবে অগ্রসর হচ্ছিলাম, একটা ফর্মুলা দিয়েছিলাম, একটা প্রক্রিয়া তৈরি করেছিলাম। এটা কাজে লাগে কি না জানি না। প্রক্রিয়াটা হলো যে, কতগুলো কমিশন বসিয়ে দিয়েছি। প্রতিটা সাবজেক্টের ওপরে কমিশন বসিয়ে দিয়েছি। এ রকম ১৫টা কমিশন হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে ৬টা কমিশন প্রথম ঘোষণা করেছিলাম। ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের রিপোর্ট দেওয়ার কথা ছিল। তারা ৯০ দিনে শেষ করতে পারে নাই। বলছে যে এক সপ্তাহ দেরি হতে পারে। সেটার কারণে আমাদের আয়োজন করতেও সময় লেগেছে। ঘোষণা করেছি, তাকে বসার জায়গা দিতে পারি নাই। কোথায় কে কার সঙ্গে পরিচয়, এসব করতে সময় লেগেছে। তারা ৯০ দিন পায় নাই সেই হিসাবে। কাজেই যদি ৭ তারিখে তারা দিয়ে দেয়, তাহলে জানুয়ারি ৭ তারিখের মধ্যে আমরা সেই ৬টা কমিশনের রিপোর্ট পাব। ওইখানে যাবতীয় সংস্কারসংক্রান্ত বিষয় দেওয়া থাকবে। সবার সঙ্গে আলোচনা করে করা হয়েছে। তাহলে সংস্কারের রূপরেখাটা আমরা পেলাম। ইতিমধ্যে মতবিনিময় হয়েছে, তার মধ্যে কোনোটা টিকেছে, কোনোটা টিকে নাই। কমিশন মনে করেছে, যেটা এইগুলোই হলো আমাদের সারমর্ম। এগুলো পেয়ে গেলে তখন নিয়ে আসব বৃহত্তর সংলাপের জন্য। একটা সংলাপ সেদিন হয়েও গেল। যদিও কোনো রিপোর্ট আসেনি তবু প্রাথমিকভাবে একটা সংলাপ হলো। সবাইকে নিয়ে আলাপ করা—কোনটা পছন্দ, কোনটা অপছন্দ, কীভাবে অগ্রসর হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কাজেই বিষয়ভিত্তিক একটা বড় রকমের কনসেনসাস বিল্ডিং প্রসেস, যেটার জন্য আবার আলাদা একটা কমিশন ঘোষণা করলাম সেদিন। সেটা হলো এই ছয় কমিশনের চেয়ারম্যানদের দিয়ে একটা কমিশন। আমি নিজে এটার চেয়ারম্যান হলাম এবং প্রফেসর আলী রীয়াজকে সহসভাপতি করলাম যে আমরা মিলে এটা একটা কনসেনসাস ডেভেলপ করার চেষ্টা করব। এই কনসেনসাসের প্রক্রিয়াটা আমাদের ঠিক করতে হবে। সমাজের কোন কোন গোষ্ঠীর সঙ্গে কীভাবে আদান-প্রদান হবে, তাতে একটা সর্বমতসম্মত একটা কিছু বের করা যায় কি না। সবকিছুতে একমত না হলেও অন্তত কিছু বিষয়ে আশা করি একমত হওয়া যাবে। তখন সেটা হবে আমাদের সংস্কার। যেহেতু একমত হয়ে গেছে, তাহলে এটা বাস্তবায়ন করা সহজ হয়ে যাবে— এইভাবে আমরা চিন্তা করছি।
নূরুল কবীর: এটা আবার কি মধ্য জানুয়ারিতে শুরু হতে পারে?
মুহাম্মদ ইউনূস: আশা করছি। ডেফিনেটলি।
নূরুল কবীর: অর্থাৎ আপনার সরকারের নিজস্ব কোনো সংস্কার কর্মসূচি নাই...
মুহাম্মদ ইউনূস: এই তো এটাই আমাদের।
নূরুল কবীর: কিন্তু এটা তো বাইরে থেকে আসল...
মুহাম্মদ ইউনূস: বাইরে থেকে নিয়েই তো আমাদের হলো। এটা এভাবে একজনের মাথা থেকে তো আসবে না। ১০ জনের মাথা থেকে এসে নির্যাস হয়ে এটা আসল। তারপরও আবার সবার সঙ্গে আমি [কথা] বলছি।
নূরুল কবীর: আপনার ক্যাবিনেটে আপনাদের কি কোনো নিজস্ব চিন্তাভাবনা, কোনো সেক্টরে...?
মুহাম্মদ ইউনূস: আছে। কিন্তু সেটা কমিশনকে গিয়ে বলতে হবে। কারণ, মতামত সংগ্রহ করার দায়িত্ব হলো কমিশনের।
নূরুল কবীর: কিন্তু সরকারের নিজেদের কোনো নিজস্ব...
মুহাম্মদ ইউনূস: নিজস্ব কোনো প্রোগ্রাম নাই। আমরা তো রাজনৈতিক দল না যে আমাদের একটা নিজস্ব থাকবে। আমাদের একেকজনের একেক মত। একেকজন একেক রাজনীতিতে বিশ্বাসী। সেটা নিয়ে তো আমাদের কোনো অসুবিধা নাই।
নূরুল কবীর: এগুলো নিয়ে অনেক ভিন্নমত কি আপনার সরকারের মধ্যে...
মুহাম্মদ ইউনূস: এখনো তো দেখি নাই। সামনে আসলে দেখা যাবে, যখন তর্ক-বিতর্ক শুরু হবে—না, এটা আমরা মানি না।
নূরুল কবীর: আর আপনি এটা অনুমান করছেন...
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি অনুমান করছি। কারণ, সব সময় সবাই যে একমত হবে, সে রকম তো কথা নেই। যেমন ধরেন, সেদিন সংলাপের জন্য আমাকে একটা বক্তৃতা দিতে বলেছিল। সেখানে বললাম যে সমঝোতা কীভাবে হবে। এটা একটা প্রক্রিয়া। বলতে গিয়ে বললাম, ধরুন, আমি মনে করি, ১৭ বছর বয়সে ভোটার হওয়া উচিত এবং আপনি সেটা ভিন্নমত পোষণ করেন। তাহলে আলাপ হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, আপনার মতই টিকে গেল। আমারটা হলো না। আমি মেনে নেব সেটা। লোকে মনে করল যে, ১৭ বছর—এটা সরকার থেকে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমি তো ভাই এ রকম বলি নাই। আমি বললাম যে ধরুন, ১৭ বছর বয়স থেকে (ভোটার) হওয়া ভালো। এটা একটা মত।
নূরুল কবীর: সিদ্ধান্ত নয়...
মুহাম্মদ ইউনূস: এটা সিদ্ধান্ত নয়। উদাহরণ হিসেবে এটা। তাহলে এটার সমঝোতাটা কীভাবে হবে? আপনাদের সবার মত এক রকম, আমার মত এক রকম। শেষ পর্যন্ত সবার মত যেদিকে, আমি সেদিকে যোগ দেব। সেটি হলো কনসেনসাস, সেটি হলো ঐকমত্য। এইভাবে আমরা অগ্রসর হতে চাই। সেটা অনেকে ভুল বোঝে। মনে করে যে সরকার থেকে ১৭ বছর লাগিয়ে দিতে চাচ্ছে। আমি বললাম যে না ভাই এ রকম তো বলি নাই আমি।
নূরুল কবীর: এ বিষয়ে সরকারের সুনির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাবনা নাই...
মুহাম্মদ ইউনূস: না।
নূরুল কবীর: পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে, আমরা লক্ষ করছি, তরুণদের একটি অংশ, যাঁরা নতুন একটা রাজনৈতিক দল করতে যাচ্ছেন, তরুণেরা যাঁরা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে যে তাঁরা সময় নিতে চায় নির্বাচনের জন্য। রাজনৈতিক দলগুলো মনে করছে যে সংস্কার প্রক্রিয়ার পাশাপাশি নির্বাচনপ্রক্রিয়াটা এগিয়ে আনা দরকার। কিন্তু তাঁদের কথাবার্তার মধ্যে সাম্প্রতিককালে পাবলিক ডিবেটের মধ্যে একধরনের তিক্ততাও তৈরি হয়েছে। আপনার নজরে এসেছে?
মুহাম্মদ ইউনূস: খুব ভালো করে নজর এসেছে।
নূরুল কবীর: সেটা একটা দুশ্চিন্তার ব্যাপার নয় কি?
মুহাম্মদ ইউনূস: মোটেই না। ওই যে বললাম বাইরে এক রকম, ভেতরে আরেক রকম।
নূরুল কবীর: আচ্ছা, সে কারণে? তাঁরা শেষ পর্যন্ত একমত হয়ে যাবেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: একমত হয়ে যাবে।
নূরুল কবীর: তরুণেরা মনে করেন, যাঁদের সম্পর্কে যেটা বলা আছে বা আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা হয় যে তাঁরা দলটা করবেন, দলের পরে কনস্টিটিউয়েন্সিগুলো বিল্ডআপ করবে, লোকগুলো তৈরি করবে, এই কারণে তার সময় দরকার। আর ঠিক সংস্কারটা মাথায় আছে। নিশ্চয়ই তাঁরা সংস্কার চান। এই মুহূর্তে ক্ষমতার রাজনীতিতে তাঁরা প্রায়োরিটি দিচ্ছেন, তাঁদের নিজস্ব সংগঠন তৈরি করে নির্বাচন করা। এ কারণেই অন্যরা মনে করে যে, শুধু অন্য একটা গ্রুপকে সময় দেওয়ার জন্য নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। তা আপনি সেটার মধ্যে কোনো সমস্যা দেখছেন না।
মুহাম্মদ ইউনূস: সে জন্য ঘোষণা দিয়ে দিলাম। কতগুলো তারিখ দিয়ে দিলাম, যাতে এই সন্দেহ না থাকে। কারণ, যত কিছু টানতে চান না কেন, আমি তো ঘোষণা দিয়ে দিয়েছি। হয় এখানে হবে, না হয় ওইখানে। দুটো তারিখ দিয়ে দিয়েছি।
নূরুল কবীর: কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো তারপরও বলছে যে আরও সুনির্দিষ্ট করে দিতে হবে।
মুহাম্মদ ইউনূস: এর ভেতরে তারিখ চাচ্ছে; বাড়াতে চাচ্ছে না। এর ভেতরে তারিখ চাচ্ছে, কোন তারিখে করবেন। আমি বললাম যে, ওই প্রসেসটা অগ্রসর হতে আমরা দেখব। এটা তো আপনাকে বাদ দিয়ে দিলাম, এর বাইরে আমরা যাচ্ছি না, এইটা হলে এই পর্যন্ত, ওইটা হলে এই পর্যন্ত, এইভাবে আছে। কাজেই ওটা যে উনারা বুঝতেছে না তা (নয়), বোঝেন। তবু কথাটা বারে বারে বলছে যে, ইন কেইস আমরা এটা অতিক্রম করতে চাই।
নূরুল কবীর: তাহলে আপনাদেরকে চাপের মুখে রাখতে চান।
মুহাম্মদ ইউনূস: এটা আমাদের জন্য ভালো।
নূরুল কবীর: যাদেরকে চাপের মুখে রাখতে চায়, তারা আবার এটা ঠিকই বোঝে...
মুহাম্মদ ইউনূস: বুঝব তো বটেই।
নূরুল কবীর: দে আর প্লেয়িং টু দ্য গ্যালারিজ...
মুহাম্মদ ইউনূস: আমরাও চাই যে চাপের মধ্যে থাকি। কারণ, আমাদের ভেতরেও তো নানা মত থাকতে পারে।
নূরুল কবীর: হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
মুহাম্মদ ইউনূস: সে জন্যই একটা বাঁধ দিয়ে দেওয়া হলো। এই পর্যন্তই, এর ভেতর থেকে আমাদের যা কিছু করতে হবে। এমন না যে কেউ বলে—না, পাঁচ বছর লাগবে। এটা সংস্কার করতে ভালো লাগছে না— এমন যেন বলতে না পারে। যে যা কিছু করতে হয় এর মধ্যে হতে হবে। এই সংস্কারের জন্য যে সমস্ত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, এই দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপেই করতে হবে, আরও ছয় মাস বাড়াতে হবে, বললাম যে না এর ভেতরেই সবকিছু করতে হবে। কাজেই এই যে একটা বাঁধ দেওয়াটা, এটা খুব দরকারি জিনিস আমাদের জন্য। এর মধ্যে আমরা যেন সবকিছু সম্পন্ন করতে পারি।
নূরুল কবীর: আপনার মন্ত্রিপরিষদের তরুণ সদস্যদের কেউ কেউ এসব ব্যাপারে পাবলিক স্টেটমেন্ট করার পর অনেক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। আপনি নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন এবং সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর একটা অবিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হতে পারে—এ রকম কিছু স্টেটমেন্ট এসেছে। আপনি কি পরিষদ সদস্যদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: ক্রমাগত আলাপ হয় এবং সেটার জন্য আমাদের একটা প্রক্রিয়াও আছে, যাতে করে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমরা আলাপ করি।
নূরুল কবীর: পরিষদ সদস্যদের পাবলিক স্টেটমেন্টের জন্য যে ভুল-বোঝাবুঝি...
মুহাম্মদ ইউনূস: সেটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে একটু ভুল-বোঝাবুঝি হয়। সাংবাদিকদের সামনে গিয়ে কী বলতে কী বলে ফেলে, আমাদের তো অভ্যাস নাই। কাজেই একটু গোলমাল হয়ে যায়। পরে আবার বলে যে না আমি ওইভাবে বলি নাই, আমার বলা এভাবে ছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে ঐকমত্যের কোনো অভাব নেই। আমরা যেগুলো বলছি, সেগুলো সম্বন্ধে আমরা একমতেই আছি। এটার মধ্যে কোনো অসুবিধা নেই।
নূরুল কবীর: আপনার সর্বশেষ বক্তৃতায় দুটো পোলাইট অ্যাডমিশন ছিল, আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে ও দ্রব্যমূল্যের ব্যাপারে। সরকার যে পরিমাণ আশা করেছে, সেই পরিমাণ সাফল্য আসে নাই, সেটাও বেশ কয়েক দিন হয়ে গেল। এগুলোর জন্য বিশেষভাবে আপনারা নতুন কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন বা চিন্তা করছেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: সব সময় তো চেষ্টা করি। এটা তো আজকের সমস্যা না। এটা বরাবরেরই সমস্যা।
নূরুল কবীর: কোনো স্পেসিফিক স্টেপস, দ্রব্যমূল্যের জন্য...
মুহাম্মদ ইউনূস: একটা হলো আইনশৃঙ্খলা, আরেকটা হলো বাজারমূল্য (দ্রব্যমূল্য)। বাজারমূল্যের জন্য যত রকমের বুদ্ধি আছে, সবকিছু আমরা করেছি, আমাদের বুদ্ধিতে যত দূর কুলিয়েছে।
নূরুল কবীর: যেমন কী কী...
মুহাম্মদ ইউনূস: যেমন প্রতিদিনের খবর। কোন বাজারে কত টাকা উঠল, কত টাকা কমল, বাজারভিত্তিক। এমন না যে সারা বাংলাদেশের...অমুক বাজারে কত, অমুক বাজারে...তার মধ্যে রকমফের হয়। কেন রকমফের হচ্ছে। একসঙ্গে কেন এক বাজারে পড়ছে, আরেক বাজারে উঠতেছে, সেটা দেখা।
নূরুল কবীর: সেটা তো অ্যানালাইসিস হিসেবে ভালো। কিন্তু অ্যানালাইসিসের যে রেজাল্ট, সেইটার জন্য আপনারা অ্যাকশন কী নিয়েছেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: অ্যাকশনের জন্য হলো যে, যেগুলো মাথায় বুদ্ধি আছে, সেগুলো প্রয়োগ করা। যেমন ট্রাক দিয়ে দেওয়া যে ট্রাকে মাল আসুক। বিআরটিসির কাছে ট্রাক আছে। ট্রাক নিয়ে আসি। ট্রাক দিয়ে মাল আসতে থাকুক। কোথায় কোথায় বাজারে এগুলো উঠছে। সেখানে কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না। এই যে চাঁদাবাজির বিষয় আছে। চাঁদাবাজিটা কমানো যায় কি না ইত্যাদি ইত্যাদি। যা আপনারা দেখতেছেন, একই জিনিস আমাদের কাছে।
নূরুল কবীর: উত্তর বাংলায় যে ফুলকপির দাম দুই টাকা, ঢাকার বাজারে ৪০ টাকা। বরাবরই পুলিশ থেকে শুরু করে মিডিয়া সব সময় বলেছে যে, পথে পথে যে চাঁদাবাজি হয়, তাতে খরচটা বেড়ে যায়। এটা আপনার সরকারও জানে। কিন্তু নতুন করে একদল চলে যাওয়ার পর আরেক দল চাঁদাবাজদের দেখতে পাচ্ছি। তাদের কেউ গ্রেপ্তার হয় নাই এই অপরাধে। তার মানে কী?
মুহাম্মদ ইউনূস: গ্রেপ্তার হইছে কি না আমি জানি না। কিন্তু এটার সমাধান হয়নি।
নূরুল কবীর: কিন্তু গ্রেপ্তার হচ্ছে না। ডিটার করার [থামানোর] জন্য সরকারের পদক্ষেপ থাকলে এটা তো চলবার কোনো কারণ নাই। এগুলো সাধারণত রাজনৈতিক দলের যারা সংগঠিত শক্তি, তারাই করে। আপনারা কি রাজনৈতিক দলগুলোকে অসন্তুষ্ট করতে চান না?
মুহাম্মদ ইউনূস: আইনের ক্ষেত্রে...দল অসন্তুষ্ট হলে, সারা দেশ অসন্তুষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
নূরুল কবীর: আমরা এই বিষয়ে এই ধরনের অপরাধের জন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাউকে গ্রেপ্তার হতে দেখি নাই। এটা আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমরা হয়তো ধরতে পারছি না তাদেরকে এখনো জুতমতো।
নূরুল কবীর: এটা কি বিশ্বাসযোগ্য হবে, প্রকাশ্য রাস্তার মধ্যে বাজারের মধ্যে বাস টার্মিনালে চাঁদাবাজি। সবাই দেখতে পাচ্ছে স্যার। সরকার দেখতে পাচ্ছে না কেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: সরকারের চোখ অত পরিষ্কার না আরকি।
নূরুল কবীর: পত্রপত্রিকার রিপোর্টগুলো আরও বাড়লে কি আরেকটু পরিষ্কার হবে বলে মনে হয়?
মুহাম্মদ ইউনূস: যত বলা যায়, তত ভালো হবে, একটু সতর্ক হবে সবাই।
নূরুল কবীর: আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তোমার কোনো প্রশ্ন আছে, আমি বড় স্যারের সঙ্গে কথা বলব।...উনি বলছেন, যে সিন্ডিকেটগুলো আছে সরকারের জানার কথা। তারা কোথায় স্টক করে, সেগুলো রেইড করলেই পারে। নাগরিক হিসেবে বা আমার স্ত্রীর এই প্রশ্নের আপনার কী উত্তর?
মুহাম্মদ ইউনূস: উত্তর হলো, যে সিন্ডিকেটে এই মাল আনা-নেওয়া করে, আমরা চেষ্টা করছি যে বাইরে যারা আছে, সিন্ডিকেটের বাইরে, তাদেরকে কী কী সুবিধা দিলে তারা এই ব্যবসায় আসত। ব্যবসা যে আমরা দুজনে মিলে ঠিক করলাম যে আমরা মাল আনব, আমরা বিক্রি করব। এটাকে কোন আইনে আপনি...
নূরুল কবীর: তারা যখন আর্টিফিশিয়াল ক্রাইসিস তৈরি করে তখন...
মুহাম্মদ ইউনূস: সেটা যদি মাল গুদামে রেখে দেয়, বাজারে বিক্রি না করে, তখন গিয়ে ধরতে পারেন।
নূরুল কবীর: আপনার সরকার কি এগুলো খেয়াল করেছে, গুদামে...লক্ষ করেছে?
মুহাম্মদ ইউনূস: ওই যে বললাম, সবকিছু খেয়াল করে। ওই যে তথ্য সংগ্রহ করা দামের কথা বললাম, স্টকের কথা বললাম। কে কোথায় এলসি খুলতেছে, সেই রিপোর্ট আমাদের কাছে আসে। কোন মাল খালাস হচ্ছে, কোন দিন কোথায় স্টক হচ্ছে, সেগুলো সংগ্রহ করা এবং তদারক করা যে মাল কি ওই গুদামে রয়ে গেছে, না ছেড়ে দিচ্ছে।
নূরুল কবীর: আপনারা কোনো অসংগতি দেখতে পাচ্ছেন না?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমরা এগুলো করছি বলেই তারা তাড়াতাড়ি এগুলো ছাড়ার চেষ্টা করে, এই গুদাম থেকে আরেক গুদামে নিয়ে যায় হয়তো। বাজারে দিচ্ছে না, চালাকির কাজ।
নূরুল কবীর: এই চালাকিটার জন্য তো কোটি কোটি গরিব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
মুহাম্মদ ইউনূস: বহু বহু গরিব মানুষ, সবাই।
নূরুল কবীর: মানেটা হচ্ছে যে এই ব্যবধান থাকবার কোনো কারণ থাকতে পারে না।
মুহাম্মদ ইউনূস: ঠিক।
নূরুল কবীর: এবং সেইটা প্রধানত সরকারের দেখবার বিষয়।
মুহাম্মদ ইউনূস: ডেফিনেটলি।
নূরুল কবীর: মানুষের অভিযোগ হচ্ছে, সরকার এটা ইন ফ্যাক্ট দেখছে না। আপনি সেটা ফিল করেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি ফিল করি, ডেফিনিটলি।
নূরুল কবীর: এই সরকারের বিরুদ্ধে...রাষ্ট্র তো কিছু প্রয়োজনে, মানুষের প্রয়োজনে কঠোর হয়। আপনাদের বিরুদ্ধে সুশীলতার অভিযোগ আছে, কঠোর হচ্ছেন না।
মুহাম্মদ ইউনূস: আমরা আমাদের সাধ্যমতো কঠোর হয়ে...হয়তো যে কঠোর মানুষের মনে আছে, অত দূর হতে পারছি না। কিন্তু আমরা যে এত দিন যত কঠোর হইনি, অত কঠোর এখন হতে চাচ্ছি।
নূরুল কবীর: আমরা একটু অন্যদিকে যাই। এটা আমরা সবাই জানি, এখানে যে বাংলাদেশে এত বড় একটা রাজনৈতিক রক্তাক্ত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষের মনের মধ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কিছু আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। সেটাকে আমাদের পাশের দেশ ভারত একধরনের সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা হিসেবে চিহ্নিত করছে এবং নানান কথা বলছে। এটা আমরা ঠিক জাতীয়তাবাদী চৈতন্য থেকে নয়, দেশকে ভালোবাসি বলে নয়, তথ্য বিকৃতি হিসেবে নানান জায়গা থেকে এগুলো মিডিয়া, এটা সাধ্যমতো বলছে। কিন্তু সেটার একটা হচ্ছে মিডিয়ার লড়াই। আরেকটা হচ্ছে যে, বস্তুত ফাংশনাল ডিপ্লোমেসিতে আপনার এই কদিনের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী ভারতের সঙ্গে একটা সুষ্ঠু ওয়ার্কিং রিলেশন তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে কি আমরা এগোতে পেরেছি?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমরা বরাবর চেষ্টা করছি ভারতের বিভিন্ন পর্যায়ে সম্পর্ক [গড়ে] তোলা এবং তাদের কাছে প্রকৃত পরিস্থিতি তুলে ধরার। প্রথমবার যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ফোনে আলাপ হলো, উনিই ফোন করেছিলেন, তখন উনি অভিযোগ করলেন যে এখানে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে ইত্যাদি। আমি বললাম যে, এটা অতিরঞ্জিত কতগুলো সংবাদ আপনার কাছে যাচ্ছে। কাজেই এটা আপনি বিশ্বাস করেন না। যদি আপনি প্রকৃত তথ্য জানতে চান, আপনি আপনাদের সাংবাদিকদের পাঠান। এখানে আসুক। তাঁরা দেখুক। দেখে রিপোর্ট করুক। কাজেই আমাদের তথ্যগুলো যদি আস্থায় আনতে না চান, তাহলে এটি প্রকৃত পরিস্থিতি। পরে অনেকে এসেছিলেন। ভারতীয় সাংবাদিক এখানে এসেছেন। তাঁরা রিপোর্ট করেছেন। আমরা চেষ্টা করছি, যাতে করে অতিরঞ্জন থেকে বাঁচা যায়। কিন্তু কিছু সংবাদ আছে, এগুলো কোনো অতিরঞ্জনের বিষয় না। এটা একেবারে গাঁজাখোরি কতগুলো কথা নিয়ে যাচ্ছে। সেটা তারে সামনে দেখায়ে দিলেও হবে না। তো সে রকম তারা চলছে, নানা রকম আজগুবি সংবাদ দিচ্ছে। পরে যখন তাঁদের সঙ্গে আলাপ হয়...এবার তাঁদের পররাষ্ট্রসচিব যখন আসলেন, তখন বললাম যে এ রকম কেন হচ্ছে? তো বলল যে, ওটা আমাদের রাষ্ট্রের সরকারের বিষয় নয়। সরকার এটার মধ্যে জড়িত না। এগুলো মিডিয়ার বিষয়। এগুলো আমাদের আওতার বাইরে। কাজেই সরকার এটা থেকে দূরে চলে গেল। সেটা আমাদের জন্য একটা বড় অ্যাচিভমেন্ট। এত দিন সরকার এটার মধ্যে জড়িত ছিল বলে অনেকটা প্রকাশ করছিল। এখন সর্বপ্রথম (বলা হলো) এটা আমাদের না। আমরাও চেষ্টা করছি, আমাদের তথ্যগুলো তাদের কাছে দেওয়ার জন্য। এখন মনে হয় ইন্টারন্যাশনাল কাভারেজ ইত্যাদির কারণে অত বেশি জুত করতে পারছে না। দিচ্ছে, এখনো খবর দিচ্ছে উল্টাপাল্টা খবর দিচ্ছে। কিন্তু জুত করতে পারছে না। যেহেতু আন্তর্জাতিক সাংবাদিকেরা রিপোর্ট করছেন। আগে বলছিল যে এটা ইসলামিস্ট একটা অভ্যুত্থান হয়েছে, এটা তালেবানদের হাতে চলে গেছে ইত্যাদি। এখন পত্রপত্রিকায় ইন্টারন্যাশনাল কাগজপত্রে যখন আসছে, ওখানেও তারা সুবিধা করতে পারছে না ওরকম বলে। কিছু কাগজে দেখাল, এখানে ক্যাবিনেটের মধ্যে কারা কারা আছে? তাঁদের যে পরিচিতি দিল, কেউ বিশ্বাস করবে না যে এটা ইসলামিস্টদের গোষ্ঠীর। কাজেই ওগুলো ফেলেও দিতে পারছে না। কাজেই যতই তারা করুক না কেন, এই ধরনের যে প্রোপাগান্ডা যেগুলো ছিল, প্রচারণা যেটা ছিল, সেটা আগের থেকে অনেক কমেছে। তাতে সব রকমের প্রচারণা বন্ধ হয়ে গেছে—এটা বলব না। এ[ক]টা প্রচারণা আছেই।
নূরুল কবীর: ভারত রাষ্ট্রের দিক থেকে কোনো হোস্টাইলিটি টের পান আপনি?
মুহাম্মদ ইউনূস: না। আমাদের তো রাষ্ট্রীয় দিক থেকে কোনো হোস্টাইলিটি নাই অন্তত। এই যে বললাম তারা পরিষ্কারভাবে বলল যে এটার সঙ্গে আমাদের [ভারত সরকারের] কিছু না। আমাদের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক। আমাদের [ভারত সরকারের] বক্তব্যের মধ্যে এগুলা নাই। আমরা বলেছি যে আমাদের সম্পর্ক খুব গভীর সম্পর্ক হতে হবে এবং ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হতে হবে। এখন মেঘ জমেছে, মেঘটা কাটিয়ে উঠতে হবে। এটা বলছে, মেঘটা কাটানোর জন্য আমাদের চেষ্টা করতে হবে, উভয় পক্ষে। সেটা আমরা চেষ্টা করি।
নূরুল কবীর: মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হওয়ার জন্য আপনার সরকার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনবার একটা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। অফিশিয়ালি চিঠি দিয়েছেন আপনারা। আপনার ধারণা, একটা রিজনেবল টাইম বলে আর কত দিনের মধ্যে উত্তর আশা করেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমার কোনো ধারণা নেই, এগুলোর কত দিন সময় লাগবে।
নূরুল কবীর: আপনার ফরেন মিনিস্ট্রি নিশ্চয়ই আপনাকে...
মুহাম্মদ ইউনূস: না, এখনো জিজ্ঞেস করিনি, কত দিন লাগবে। আমরা প্রক্রিয়া শুরু করেছি। এখন দেখব, তারা কী জবাব দেয়? তারা জবাব দিচ্ছে কি না, এটা ফলোআপ করব। ডেফিনেটলি একটা গতি নেবে এটা।
নূরুল কবীর: অনুমান, কত দিন পরে আপনারা আবার চিঠি দেবেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: এটা একটা সময়ের ব্যাপার। মাসখানেক বলেন। আমরা ফলোআপ করব। দেখেন কী কী হয়।
নূরুল কবীর: আমরা আরেকটু পশ্চিমে যাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অনেক ভালো সম্পর্ক। এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্যাবিনেটে ইন্ডিয়ান বর্ন সাতজন মন্ত্রী আছেন বলে শোনা যায়। আপনার সঙ্গে পশ্চিমের সম্পর্ক ভালো বলে মানুষ মনে করে। তাঁদের এই সম্পর্ক কি আমাদের দেশে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মধ্যে কোনো ক্ষতির কারণ হবে বলে আপনি আশঙ্কা করেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: হতে পারে; কারণ, এত ঘনিষ্ঠতা থাকলে, ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তি যদি ওইখানে ক্ষমতায় থাকে, তার একটা প্রভাব তো হতেই পারে। এবং ইতিমধ্যে তার প্রভাবের কিছু নমুনাও আমরা দেখেছি। কাজেই আমরা দেখছি, এটা কোন দিকে যায়। ভারতীয় বংশোদ্ভূত হলেই যে সে ভারতের সঙ্গে যুক্ত থাকবে এমনও কোনো কথা নাই। সে হয়তো আমাদের দিকে বেশি মনোযোগ দিতে পারে। আমরা দেখছি, সেগুলো কীভাবে আমরা বার করতে পারি যে কারা কারা আমাদের দিকে সহানুভূতিশীল হবে। কীভাবে আমরা তাদের সহানুভূতিটা পেতে পারি। নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক কীভাবে গড়ে তোলা যায়। পুরোনো সরকারের সঙ্গে আমাদের একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল; ভালো সম্পর্ক ছিল। নতুন সরকারের সঙ্গে আমরা একই রকম ভালো সম্পর্ক করার জন্য চেষ্টা করব।
নূরুল কবীর: ইতিমধ্যেই কি কাজকর্ম এই ব্যাপারে শুরু হয়েছে?
মুহাম্মদ ইউনূস: এটা নিয়ম। আমাদের করতে হয়। যখন নতুন সরকার আসে, তার সঙ্গে একটা যোগাযোগ স্থাপন করা যেগুলো ডিপ্লোমেটিক পর্যায়ে হয়। গিয়ে আলাপ-সালাপ করে। ডিপ্লোমেটিক চ্যানেলের বাইরে হয় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের খাতিরে। ওইখানে যাঁরা হোয়াইট হাউসে আছেন, তাঁদের সঙ্গে যাঁদের যোগাযোগ আছে, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। কীভাবে করতে হবে? নানাভাবে হয়। বিভিন্ন চ্যানেলে যোগাযোগগুলো করতে হয়।
নূরুল কবীর: আপনি ইতিমধ্যে সার্কের একটা ইফেকটিভ রিভাইভালের কথা প্রস্তাব করেছেন বাংলাদেশের তরফ থেকে। তাতে কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে হয়?
মুহাম্মদ ইউনূস: অন্য দেশের যাঁরা আছেন, তাঁরাও চান সার্কের অন্যান্য দেশের মধ্যে...কিন্তু ভারত এটাতে খুব সাড়া দিচ্ছে না। তারা ব্যাখ্যা করে যে আমাদের [ভারত] সমস্যা হলো পাকিস্তানকে নিয়ে। তো আমি যেটা ব্যাখ্যা করি যে একটা দেশের সঙ্গে সমস্যা হলেই পুরো জিনিসটা বিকল হয়ে যাবে, এটা তো ঠিক হবে না। আমরা চেষ্টা করি, ওইটাও সমাধান হোক। অথবা ওই সমস্যাকে পৃথকভাবে দেখে বাকি সব সম্পর্ককে আমরা গড়ে তুলি। এখনো এটার কোনো...
নূরুল কবীর: রেসপন্স?
মুহাম্মদ ইউনূস: রেসপন্স...
নূরুল কবীর: দেখা যায় না?
মুহাম্মদ ইউনূস: না।
নূরুল কবীর: আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, যেটা আমার দেশের মানুষ জানতে চায়। বাংলাদেশ থেকে প্রচুর টাকা আওয়ামী লীগ আমলে পাচার হয়েছে। আপনি তার জন্য একটা কমিশনের মতো করেছেন। এই টাকাপয়সা ফিরে পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতির ইঙ্গিত কি পাচ্ছেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: একসাথে সাক্ষ্যপ্রমাণ পেয়ে গেলে আমরা নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা করতে পারব। এ রকম একটা আইন আছে। আইনের মাধ্যমে এটা করব। সব টাকা হয়তো ফেরত আসবে না। কিছু টাকা ফেরত আসবে যদি আমরা সাক্ষ্যপ্রমাণগুলো পাই। সে প্রচেষ্টাগুলো হচ্ছে।
নূরুল কবীর: সাক্ষ্যপ্রমাণের ব্যাপারে কাজকর্ম চলছে...
মুহাম্মদ ইউনূস: একদম। খুব ডেডিকেটেড একটা আলাদা ইউনিট আছে, তাদের কাজই হলো এগুলো উদ্ধার করা। এটা প্রথম থেকে শুরু হয়েছে। যেহেতু আমরা জানি, যে রকম টাকা গেছে এবং ব্যাংকিং চ্যানেলে গেছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে ধরাটা একটু সহজ হবে হয়তো। যেগুলো স্যুটকেস ভরে নিয়ে গেছে, মুশকিল আছে সেগুলো ধরা। কিন্তু এগুলো তো চ্যানেলের ব্যাপার। যারা এক্সপার্টস আছে, যারা এই কাজগুলো করে, তারাও বলতেছে, হ্যাঁ, এটা সম্ভব। কিন্তু সম্ভব বলে কত দিন আমরা বসে থাকব, এটাই হলো বিষয় আরকি। এটার আইনগত বিষয় আছে। কী সাক্ষ্যপ্রমাণ? তারা কী চায়? কীভাবে এটা আইডেনটিফাই হবে? কার কাছে গেল? আইন ভঙ্গ করে গেল? কিছু কিছু আশা মাঝে মাঝে পাই যে এটা হবে। এখনো চূড়ান্ত কিছু পাইনি।
নূরুল কবীর: মানে, আমাদের আশা করবার কারণ আছে...
মুহাম্মদ ইউনূস: আশা করার কারণ আছে। অবশ্যই কারণ আছে।
নূরুল কবীর: কী রকম সময় লাগবে বলে আপনার ধারণা?
মুহাম্মদ ইউনূস: তাদের কথা তো কিছু বুঝতে পারি না। এটার যে একটা স্ট্যান্ডলাইন আছে, এর মধ্যে গিয়ে এটা শেষ হবে, এটা এখনো বুঝি নাই যে এটা কত দিন লাগতে পারে। আমি একটা আন্দাজে বলে দিতে পারি আপনাকে। কিন্তু আমার মনে হয় না, সেটা বলা ঠিক হবে।
নূরুল কবীর: সামনের নির্বাচনের পরে এই যে এ রকম দায়িত্ব শেষ করবার পরে পরবর্তীকালে কী করার প্ল্যান আপনার?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি তো বরাবরই বলছি যে আমি যে [এখানে, এটা] সাময়িক বিষয় ছিল। আমি এই দায়িত্ব পালন করে আমার পুরোনো আনন্দের জগতে ফিরে যাব।
নূরুল কবীর: এই অভিজ্ঞতার ওপর কোনো বই লেখার পরিকল্পনা আছে আপনার?
মুহাম্মদ ইউনূস: না। এ রকম চিন্তা করিনি। আপনি বইয়ের কথা মনে করিয়ে দিলেন! আমি দিন কাটানো নিয়ে ব্যস্ত আছি।
নূরুল কবীর: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ সময় দেবার জন্য।
মুহাম্মদ ইউনূস: অসংখ্য ধন্যবাদ।
নূরুল কবীর: আপনার চার মাস হলো প্রায়। এই চার মাস আর আগের চার মাসের মধ্যে কোন পর্বটা আপনার ভালো লাগে বা কোনটা খারাপ?
মুহাম্মদ ইউনূস: খারাপ কোনোটাই না। খারাপটা বলব না, কিন্তু ভিন্ন। আগেরটা ছিল আমার নিজস্ব জগৎ। সারা জীবন ধরে যা যা করে এসেছি, সেটার মধ্যেই ছিলাম। নিজস্ব আয়োজন, নিজস্ব চিন্তা। তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। সেটা আমার মতো করে ট্যাকল করেছি। আমি আমার মতো করে চলেছি। সেটা একেবারে আমার নিজস্ব জগৎ। এটা একবারে ভিন্ন জগৎ। এটা আমার নিজস্ব জগৎ না। এই জগতে আমি কোনো দিন ছিলাম না; থাকার কোনো আগ্রহও ছিল না। এটার ডান-বাম আমার জানা নেই। অনেকটা হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে চলার মতো অবস্থা। কিন্তু এটারও একটা চ্যালেঞ্জ আছে।
আমাকে তারা আহ্বান জানিয়েছে। প্রথমে একটু সংকোচ করছিলাম যে এতে যাওয়া ঠিক হবে না, যেহেতু আমি এ জগতের মানুষ নই। কিন্তু তারা আমাকে বোঝাতে পেরেছে যে, এই পরিস্থিতিতে আপনার আসা দরকার। শেষ পর্যন্ত আমি রাজি হয়েছি যে, এইভাবে তোমরা প্রাণ দিয়েছ, তোমরা রক্ত দিয়েছ। আমার জন্য না হয় একটু চ্যালেঞ্জিং হলোই। কাজেই আমি রাজি হলাম। এটা ভিন্ন জগৎ। এই ভিন্ন জগতের মধ্যে এখন চলছি। দেখা যাক কত দূর যেতে পারি।
নূরুল কবীর: কিন্তু আগস্টের ৮ তারিখে এই জগৎটা যদি শুরু না হতো আপনার জন্য, পেছনের (আগের) যে চার মাস, আপনার মনে হয় তত দিনে জেলে থাকার কথা ছিল।
মুহাম্মদ ইউনূস: হয়তো, আমি তখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম কোন কোন দেশে যাব, যাতে বাংলাদেশে ফিরে যেতে না হয়। আমি এক উপলক্ষে আরেক দেশে ছিলাম। সেখানে বসে ভাবছি, এখন ফিরে যাওয়া ঠিক হবে কি না। কারণ, যাওয়ার সময় উত্তেজনা দেখে গেছি, কারফিউ দেখে গেছি। কারফিউর ভেতর দিয়ে আমাকে যেতে হয়েছে; উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে।
নূরুল কবীর: তার মানে, আপনি কারফিউ ভঙ্গ করেছিলেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি কারফিউ ভঙ্গ করে গেলাম, তা না হলে তো যেতে পারতাম না। ভাগ্যিস, কেউ ধরেনি পথে। অত কড়াকড়ি কারফিউ ছিল না। ওই অবস্থা তো দেখে গেছি এবং এটা ক্রমাগতভাবে দেখেছি পত্রপত্রিকায়, সোশ্যাল মিডিয়াতে ভয়ংকর রকম কাজ হচ্ছে। কাজেই ক্রমাগতভাবে ফিডব্যাকটা পাচ্ছিলাম। তার মধ্যে এই ঘটনা ঘটে গেল, একবারে অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা। কিন্তু এর মধ্যে বুঝি নাই যে এর মধ্যে আমাকে জড়িত হতে হবে। আমাদের এর মধ্যে একটা ভূমিকা পালন করতে হবে। কাজেই চার মাস এভাবেই গেছে আমার।

নূরুল কবীর: আপনি ৮ আগস্টে ক্ষমতা গ্রহণের পরে আপনার বিরুদ্ধে বিগত সরকারের যে আইনগত অভিযোগ ছিল, সেগুলো কোর্ট থেকে একের পর এক উঠে যায়। আপনার পজিশনের ভারে কিংবা প্রভাবে এ ঘটনা ঘটেছে—লোকেদের এ রকম ভাবনার সুযোগ আছে।
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি বলব, এটা আমি সরকারে থাকি বা দেশে থাকি, না থাকি—এগুলো এমনি চলে যেত। এগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। আমাদের যারা প্রতিনিধিত্ব করছেন আদালতে, আমাদের যে উকিলরা আছেন, তাঁরা এটা বোঝাতে পারতেন যে এটার কোনো ভিত্তি নেই। এটার কোনো তথ্য নাই, কিছুই নাই। এগুলো খুবই ঠুনকো জিনিস ছিল। কাজেই এটা আমার জানা-অজানার কোনো বিষয় নয়। যেহেতু এটা বিচারের বিষয়, বিচারেই চলে যেত। আমি থাকলেও যেত, না থাকলেও যেত। ঘটনার চক্রে আমি ছিলাম।
নূরুল কবীর: কিন্তু লোকেরা যে বিচারব্যবস্থার ওপর তৎকালীন এক্সিকিউটিভের, রাষ্ট্রের প্রভাবের কথা বলছিল বা বলাবলি আছে এখনো, তাহলে কি আপনি মনে করেন, উনারা ক্ষমতায় থাকলেও কোর্ট ওইভাবে ব্যবহার করত, মানে ন্যাচারাল পদ্ধতিতে?
মুহাম্মদ ইউনূস: আগের যারা ছিল তারা তো করে নাই। করে নাই বলেই তো আমি আদালতের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলাম। যারা এসেছে, তারা বিচার চাচ্ছে, বিচার প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে।
নূরুল কবীর: সেভাবেই যদি চলত, তাহলে তো আপনি জেলে যাওয়ার একটা...
মুহাম্মদ ইউনূস: অবশ্যই। আমি তো জেলে যাওয়ার পথেই ছিলাম। [আদালতে] আসা-যাওয়ার পথে প্রতিবারই মনে হচ্ছে, এবারই বোধ হয় জেলে যেতে হবে। মাঝে মাঝে প্রস্তুতি নিয়ে গেছি যে হয়তো ফেরা না-ও হতে পারে এবার। আমার সহযোগী যাঁরা আছেন, তাঁরা তাঁদের আত্মীয়স্বজনকে বলে গেছেন তাঁদের জন্য। আমি বলেছি, আমার কিছু করার নাই, যেমন আছে হবে। আমি আমার ফ্যামিলিকেও এ রকম প্রস্তুত করে যাইনি। বলি যে, রেখে দিলে রেখে দেবে, নিয়ে গেলে নিয়ে যাবে। আমি খুব সহজভাবে দেখছিলাম যে, এটা নিয়তির খেলা। এটা যেভাবে হবার হবে। এটাতে প্রস্তুতি নিয়ে আমার কোনো কাজ নাই যে জেলে থাকলে এই করতে হবে, করব। এটা যখন কপালে আছে, এটা আমাকে করে যেতে হবে।
নূরুল কবীর: আপনি এইমাত্র বললেন যে, এটা একটা ভিন্ন জগৎ এবং এইভাবে জড়িয়ে পড়তে হবে; এ রকম একটা রাজনৈতিক দায়িত্ব রাষ্ট্র পরিচালনায়, সেটা আপনি চিন্তা করেননি।
মুহাম্মদ ইউনূস: না।
নূরুল কবীর: আপনি ২০০৭ সালে যখন একটা পার্টি করতে গিয়েছিলেন, সেই সময় তো এটা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবেই চিন্তা করেছিলেন। সেখানে যদি আপনি কনটিনিউ করতেন, আপনাকে তো রাজনৈতিক দায়িত্বই গ্রহণ করতে হতো।
মুহাম্মদ ইউনূস: সেটার কারণ ছিল যে এখানে কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না তখন, সবাই আমার বন্ধুবান্ধব সহযোগী, পরিচিত। সবাই বলছে, আপনি কিছু একটা করেন; পেছনে লেগে রইল...আপনি ছাড়া পারবে না কেউ, এই যা যা বলে আরকি আশপাশের লোকজন। এতে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে শেষে বললাম যে ঠিক আছে আমি করব এইটা। পথে আসতে-যেতে সাংবাদিকেরা ধরল। তখন আমি বলেছি, হ্যাঁ, আমি করব। এই দিয়ে শুরু হলো। তখন বেশির ভাগ সময় আমি আসা-যাওয়া করছিলাম বিভিন্ন জায়গায়, উত্তরবঙ্গে যাচ্ছিলাম, চিটাগাং যাচ্ছিলাম। প্রতিবার এয়ারপোর্টে এই কথাবার্তা হচ্ছিল। আর কোথাও না। তখন একসময় ধরল যে তাহলে কী নাম দেবেন? আমি (বললাম) যে নাম ঠিক করি নাই। নাম ঠিক করলে আপনাদের জানাব। তখন বলল, নাম ঠিক না করে কীভাবে যান? তখন অবশ্য একটা নাম দিলাম, নাগরিক শক্তি। তারপর বুঝলাম যে এটা বেশ এগিয়ে যাচ্ছে জিনিসটা। তারপর সবাইরে বললাম যে এটার [ওপর] মতামত নাও। মতামত নেওয়ার ব্যাপারটি হলো, কোনো রকম এটা থেকে দূরে সরা যায় কি না, তার চেষ্টা। নাম হলো, মতামত হলো। তারপর আমি দেখলাম যে ঢুকে যাচ্ছি এর ভেতরে। যখন দশ সপ্তাহ হলো প্রায়, তখন বললাম যে না ভাই, আমি কোনো রাজনৈতিক দল করছি না, কিচ্ছু না। কাজেই আমার মাথার ভেতরে একদিন এই রাজনীতির মধ্য দিয়ে গিয়ে ক্ষমতায় যাব, এ রকম কোনো পরিকল্পনা ছিল না, এটা দীর্ঘমেয়াদি জিনিস।
নূরুল কবীর: কিন্তু রাজনৈতিক দল তো শেষ পর্যন্ত ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত...
মুহাম্মদ ইউনূস: ছিল। কিন্তু তখন আমি তো আসলে রাজনৈতিক দল করতে চাচ্ছিলাম না। ঠেকা দেবার জন্য এগুলো বলে যাচ্ছিলাম। শেষে মনে করলাম যে, এটা বেশ গভীরে চলে যাচ্ছে। তখন একদম পরিষ্কার বলে দিলাম। তখন সবাই হতবাক হয়ে গেছে। তখন আমার বন্ধুবান্ধব বিরক্ত হয়ে ছেড়ে দিলেন।
নূরুল কবীর: আপনি কি আলাপ করেছিলেন বন্ধুদের সঙ্গে?
মুহাম্মদ ইউনূস: কিচ্ছু করিনি। সে জন্য আরও হতবাক হলো। বলে যে আপনি কিছু বললেন না আমাদের! আমরা আপনার পেছনে ঘুরলাম এত দিন ধরে।
নূরুল কবীর: মনঃক্ষুণ্ন হবার কথা...
মুহাম্মদ ইউনূস: খুবই মনঃক্ষুণ্ন হয়েছে তারা।
নূরুল কবীর: তারা এখন কি আনন্দে আছে?
মুহাম্মদ ইউনূস: তারা কাছে আসে না। বলে আবার কোন দিকে নিয়ে যায় আমাদের।
নূরুল কবীর: ওই নাগরিক শক্তির সঙ্গে ছাত্রদের যে নাগরিক কমিটি, তার কোনো চিন্তা বা ভাবনার সম্পর্ক আছে?
মুহাম্মদ ইউনূস: নাগরিক শব্দটা কমন আছে এটা দেখতেছি। আমার সঙ্গে তো আর কোনো আলোচনা হয় নাই, তারা কোথা থেকে শব্দ পেল না পেল।
নূরুল কবীর: এই শব্দটা যেকোনো লোক ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু আপনার সঙ্গে কোনো পরামর্শ করে নাই তারা?
মুহাম্মদ ইউনূস: পরামর্শ করে নাই।
নূরুল কবীর: আপনি প্রায়ই বলেন, কয়েকবারই বলেছেন, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে যে ছাত্ররা আপনাকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে, তাদের ম্যান্ডেটের কারণে। ছাত্রসমাজ হিসেবে ৫ আগস্ট যে পরিমাণ তারা সমন্বিত ছিল, সংগঠিত এবং একাকার ছিল, এইটা যদি বিভক্ত হয়ে যায় তাদের উদ্দেশ্য সাধিত হয়ে যাওয়ার পর, এই অর্থে যে ইমিডিয়েট উদ্দেশ্য ছিল তৎকালীন একটা স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পতন। তার পতনের পরে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের বিভিন্ন রাজনীতি আছে। তারা যদি বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে কিংবা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থের সংঘাত ঘটে, তখন আপনার ম্যান্ডেটটা প্রশ্নবিদ্ধ হবে না?
মুহাম্মদ ইউনূস: এটা হলো অন্তর্বর্তী সরকার। আমি সেই সরকারের একটা অংশ। ওইটা হলো রাজনীতি। এই সরকারে আমি কত দিন আছি না আছি, সেটা একটা ব্যাপার। ওরা কী করছে, রাজনীতির কী ফল দাঁড়াবে, সেটা ভিন্ন জিনিস। এটা একজন নাগরিক হিসেবে ওরা চিন্তা করতে পারে যে কী হবে না হবে। কিন্তু সরকার হিসেবে আমি আমার দায়িত্ব পালন করছি; যতটুকু আমার সাধ্যে কুলায়।

নূরুল কবীর: আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ওটা সংঘবদ্ধ ছাত্রসমাজের ম্যান্ডেট ছিল। সেই সংঘবদ্ধতাটা যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে...
মুহাম্মদ ইউনূস: দুর্বল হয়ে যাবে।
নূরুল কবীর: দুর্বল হয়ে যাবে?
মুহাম্মদ ইউনূস: অবশ্যই দুর্বল হবে।
নূরুল কবীর: এ রকম সম্ভাবনা আপনি দেখেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: সব সময় সম্ভাবনা তো থাকে। একটা দুর্বল হবে আরেকটা সবল হবে। এই টুকরা এই টুকরার সঙ্গে মিলবে। নানা রকম ঘটনা তো ঘটে।
নূরুল কবীর: অন্যান্য টুকরার কথা বলছেন। ধরুন, আমরা যাঁরা বাইরে থেকে দেখি, ওই অভ্যুত্থানে বিজয়ী ছাত্রনেতৃত্ব আপনাকে আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী সেইটাকে সমর্থন করেছে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যারা পাওয়ার কনটেন্ডার, তারা আপনাকে সহযোগিতা ও সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তাহলে আপনি যখন প্রায়ই বলেন, ছাত্ররা আমাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছে, তখন আপনার কি মনে হয় যে অন্য দুইটা সেক্টর যারা সংগঠিত, নানানভাবে, তারা মনঃক্ষুণ্ন হতে পারে?
মুহাম্মদ ইউনূস: হতে পারে। কিন্তু বাস্তব তো তাই। আমাকে তো ডেকে এনেছে ছাত্ররা। কাজেই আমি সেভাবেই বলেছি, ছাত্ররা আমাকে নিয়োগ করেছে। এখন সবাই মিলে এটা সমর্থন করেছি আমরা। সেটা হলো বৃহত্তর একটা জিনিস। কিন্তু ইমিডিয়েট ছিল যে আমার সঙ্গে কথাটা হচ্ছে ছাত্রদের সঙ্গে। যাদের সঙ্গে আমার কোনো পরিচয় নাই, জীবনে দেখিনি তাদেরকে, তাদের সঙ্গে আমার পরিচয়...সেভাবে আমি কথাটা জানিয়েছি। আমার বাস্তবটা জানিয়েছি। কাউকে মনঃক্ষুণ্ন করার জন্য, কাউকে আঘাত দেওয়ার জন্য এরা দেয় নাই, ওরা দিছে, ও রকম কিছু না।
নূরুল কবীর: না মানে, পাওয়ার ব্লক থাকে তো...
মুহাম্মদ ইউনূস: অবশ্যই।
নূরুল কবীর: এই তিনটাই আপনার জন্য, দেশের মানুষের জন্য আপনার সরকারের অস্তিত্ব চলমান থাকার জন্য, জরুরি আমাদের মনে হয়।
মুহাম্মদ ইউনূস: অবশ্যই, অবশ্যই।

নূরুল কবীর: আপনার এই যে প্রধান উপদেষ্টা পদের নাম, মানে নোমেনক্লেচার অব দি পজিশন, এইটা আপনি অ্যাগ্রি করলেন কেন? আপনি কাকে উপদেশ দেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: ওগুলো আমার মাথায় আসে নাই। নামটা কি উপদেষ্টা হলো না কী হলো। দায়িত্ব নিতে বলেছে, আমি দায়িত্ব নিয়েছি।
নূরুল কবীর: উপদেষ্টা হলো একটা পজিশন। উপদেষ্টা মানেই আপনি কাউকে উপদেশ দেন।
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি এগুলোর ব্যাখ্যার মধ্যে যাই নাই। বলেছে, আপনাকে দায়িত্ব নিতে হবে এই সরকারের। আমি দায়িত্ব নিয়েছি। নামটা কী দিল না দিল, কোথা থেকে আসল...
নূরুল কবীর: একবারও মনে হয়েছে?
মুহাম্মদ ইউনূস: এগুলো বড় মনে হয়নি। কারণ, বলেছে যে এই ধরনের পরিস্থিতিতে এই ধরনের নামই হয়। কাজেই আমার চ্যালেঞ্জ করার কিছু নাই।
নূরুল কবীর: দুইটা ভিন্ন। একজন চিফ থাকে। চিফকে অন্যরা উপদেশ দেয়। তাহলে আপনি উপদেশদাতাদের মধ্যে প্রধান। কিন্তু কাকে?
মুহাম্মদ ইউনূস: এটা চিন্তা করি নাই।
নূরুল কবীর: আপনি যে মন্ত্রিপরিষদ (উপদেষ্টা পরিষদ) তৈরি করলেন ছাত্রদের আহ্বানে, অন্যদের সমর্থনে, সেইখানে কি আপনার মন্ত্রিপরিষদ গঠনে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ছিল?
মুহাম্মদ ইউনূস: পরিপূর্ণ বলব না, এটা তো তাৎক্ষণিকভাবে হয়েছে। এটা এমন কিছু না যে চিন্তাভাবনা করে করা হয়েছে। কাজেই আমাকে যতটুকু বলা হয়েছে, আমি সেটা করেছি। অন্য কারা কী করল, সেটা নিয়ে মাথা ঘামাইনি।
নূরুল কবীর: পরামর্শগুলো কি এসব সেক্টর থেকে এসেছে আপনার কাছে বা কোনো রেকমেন্ডেশন সেটা আর্মি থেকে বা রাজনৈতিক দলের মধ্য থেকে?
মুহাম্মদ ইউনূস: না না না। ওই রকমভাবে কিছু আসে নাই। বলছে যে এরা এরা আছে। আপনি কারে কারে নেবেন। শপথ গ্রহণ করতে হবে আগামীকাল বা সেদিনেই, এ রকম অবস্থা। আমি তাৎক্ষণিকভাবে আমার পরিচিত যা নাম ছিল, সেগুলো দিয়েছি।
নূরুল কবীর: আপনার কাছে এই খবর নিশ্চয়ই আছে বা আপনার এজেন্সিগুলো এই খবর কি দেয় যে আপনার সরকারের যাঁরা সদস্য, তাঁদেরকে অন্তত দুটো ক্যাটাগরিতে জেনারেলি ভাগ করা যায়। এক পক্ষের ব্যাকগ্রাউন্ড হচ্ছে এনজিওস। সেখানে আপনার ব্যাপারে একটা সমালোচনা আছে যে চিটাগংয়ের লোক বেশি। কারণ, আপনার বাড়ি চিটাগং? আরেক পক্ষ হচ্ছে, আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যে, গণতন্ত্রের জন্য লড়াই থেকে অনেকে অনেক দূরে ছিলেন। এই তাঁদের কারণে এখন ঠিক স্টেটক্রাফট পরিচালনার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে কিছু সমস্যা হচ্ছে। এই কথাগুলো কি আপনার কানে আসে?
মুহাম্মদ ইউনূস: সব সময় বলাবলি করে, সবাই বলছে। কাজেই এখানে না আসার কোনো কারণ নাই। এ জন্য বিব্রত হবারও কোনো কারণ নাই। সেভাবেই হয়েছে। নানা জায়গা থেকে আমরা এসেছি। আমারও তো কোনো অভিজ্ঞতা নাই। কাজেই ওদের দোষ দেব কী করে। আমাকে দেশ চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তার তো বিন্দুমাত্র অভিজ্ঞতা নাই। আমি তো কোনো দিন এ ধরনের কাজে ছিলাম না। আমি যদি পারি, ওরাও পারবে, এটাই আমার ভরসা ছিল।
নূরুল কবীর: তাঁদের পারফরম্যান্স নিয়ে আপনার কেমন...
মুহাম্মদ ইউনূস: নিজের পারফরম্যান্স নিয়েই আমার সন্দেহ। ওদের পারফরম্যান্স নিয়ে কী জিজ্ঞেস করব।
নূরুল কবীর: কিন্তু আপনারটা তো অন্যরা বলবে...
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি বলব; আমি দেখছি তো।
নূরুল কবীর: আপনি কি আপনার পারফরম্যান্স নিয়ে সন্তুষ্ট?
মুহাম্মদ ইউনূস: না। বলছি যে আমার তো সেই কোয়ালিটি নাই, করার জন্য যেটুকু দরকার ওটুকু নাই। যদিও সাধ্যমতো করি, যদি লেগে যায় তো ভালো। না হলে আমাদের কপাল খারাপ।

নূরুল কবীর: রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে পরিমাণ সমঝোতা এবং যোগাযোগ থাকা দরকার বলে পত্রপত্রিকা বা অন্যান্য যাদেরকে আমরা বলতে শুনি, সেই পরিমাণ সমঝোতা এবং যোগাযোগ আপনার আছে বলে মনে হয়? আমাদের কাছে মনে হয়, কিছুটা দূরত্ব আছে।
মুহাম্মদ ইউনূস: আমার কাছে মনে হয়, অবিশ্বাস্য রকম সমঝোতা-আত্মীয়তা-ঘনিষ্ঠতা আছে। এটা আমার কাছে অবাক লাগে। কাগজপত্রে দেখি তাঁরা একজনের বিরুদ্ধে একজন কটু কথা বলে। যখন সামনে আসে, সবাই কী আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বলেন! আমার কাছে অবাক লাগে এগুলো! মনে বড় সাহস লাগে। যখনই কথা বলি, ব্যক্তি হিসেবে যখন রাজনৈতিক দলের কারও সঙ্গে কথা বলি, অন্যরা কেউ নাই, একা সে। কিন্তু তার সঙ্গে যখন কথা বলি, কী রকম সমর্থন নিয়ে কথা বলে! আমি অভিভূত হয়ে যাই যে এত সমর্থন থাকা সত্ত্বেও এই দেশ চলছে না কেন! এর মধ্যে মাঝে মাঝে আবার কাগজপত্রে এ রকম কথাবার্তা [প্রকাশ] হয় কেন? এই দু রকম কেন?
নূরুল কবীর: কেন এমন হয় বলে আপনার মনে হয়?
মুহাম্মদ ইউনূস: ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় মনে হয়, এর একটা হলো রাজনৈতিক কথা। কিছু অঙ্গভঙ্গি আছে, যেগুলো রাজনীতিতে চালু হয়ে গেছে। এভাবে কথা না বললে রাজনৈতিক নেতা বলে মনে হয় না। ওভাবে, ওই শব্দে কথা বলতে হয়; ওই সুরে কথা বলতে হয়। টেলিভিশনে গেলে ওই কণ্ঠে কথা বলতে হয়। কিন্তু যেইমাত্র ব্যক্তি হিসেবে কথাবার্তা বলেন, তখন বলার ভঙ্গি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কাজেই সেটার আন্তরিকতা এবং সেটার ঘনিষ্ঠতা আমাকে অভিভূত করে। প্রতিবারই আমাকে অভিভূত করে।
নূরুল কবীর: একটা অন্য কথায় আসি। আপনার সরকার সেপ্টেম্বর মাসে সম্ভবত অক্টোবরে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যাঁরা এই গণতন্ত্রের আন্দোলন এবং অভ্যুত্থানে প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেক পরিবারকে ৩০ লাখ টাকা দেবেন। পরবর্তীকালে জুলাই ফাউন্ডেশন হলো। সেখান থেকেও কথা এসেছিল যে আহতদের এক লাখ টাকা করে এবং পাঁচ লাখ টাকা করে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তরুণ-তরুণী, ধনী-গরিব ও মধ্যবিত্তনির্বিশেষে তাঁদেরকে দেওয়া হবে। আপনি নিশ্চয়ই সচেতন আছেন যে, সেই প্রতিশ্রুতি পালিত হয় নাই এখনো। এটা কেন? ইতিমধ্যে আপনারা হাজার কোটি টাকা করে বিভিন্ন ব্যাংকে দিয়েছেন, রাষ্ট্রীয় এক্সচেকার থেকে লুটপাটের কারণে যে সমস্ত ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের। কিন্তু যারা এই ব্যবস্থাকে বদলাল, তাদেরটা প্রায়োরিটিতে আসল না কেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: প্রায়োরিটিতে ছিল বলেই এত কথা ঘোষণা হলো। প্রায়োরিটিতে ছিল। কিন্তু বাস্তবায়ন করা যায়নি। এগুলো হলো আদেশ কার্যকর করার ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা। কীভাবে টাকা কার কাছ থেকে কোথায় যাবে? কীভাবে বিতরণ হবে? এগুলো নিয়ে। দেওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নাই। যত টাকা লাগে তাদের, এই কমিটমেন্ট আছে এবং তাদের আমরা জীবৎকালে যত সমর্থন দরকার, যত পয়সাকড়ি দরকার, সবকিছুর জন্য কমিটমেন্ট আছে। এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নাই; টাকারও কোনো অভাব নাই।
নূরুল কবীর: কত দিন লাগতে পারে?
মুহাম্মদ ইউনূস: এখন আমার আগাম বলতে ভয় ভয় লাগে। যে কথা বলি, ওটায় পারি না তো শেষ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছাতে।
নূরুল কবীর: আপনার কথায় আন্তরিকতা তো মানুষ বিশ্বাস করে। আপনার অনুমান? অন্তত এটা তো খুবই একটা ইমিডিয়েট এবং প্রায়োরিটির মধ্যে থাকার কথা।
মুহাম্মদ ইউনূস: নিশ্চয়ই।
নূরুল কবীর: এটা কি আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে হচ্ছে?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে। কার হাত দিয়ে কীভাবে যাবে, কার কাছ থেকে কোথায় যাবে, এগুলো নিয়ে গোলমাল হচ্ছে। আর কিছু না।
নূরুল কবীর: তাতে আমলাতন্ত্রের কিছু হচ্ছে না। কিন্তু সরকার, আপনার সরকারের বদনাম হচ্ছে।
মুহাম্মদ ইউনূস: এটা আমাদের সবার সম্মিলিত ব্যর্থতা। আমি ব্যুরোক্রেসিকে (আমলাতন্ত্র) দোষ দেব না। তাদেরও নিয়মকানুন আছে। আমরা হয়তো সেই নিয়মকানুন বুঝি না বলে কানেকশনটা ঠিকমতো করতে পারি নাই।
নূরুল কবীর: আপনার জন্য কোনো টাইমলাইন বলা কি কঠিন?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি আবার মাস, দিন একটা দিয়ে আবার বিব্রত হতে চাচ্ছি না আরকি।
নূরুল কবীর: সাম্প্রতিককালে আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ করছেন, আমরাও লক্ষ করছি যে সরকারের যে গণতান্ত্রিক সংস্কারের কর্মসূচি এবং নির্বাচন—এই দুটিকে পরিপূরক না ভেবে একটা সাংঘর্ষিক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে আলাপ-আলোচনার মধ্যে। এটা কি আপনাকে চিন্তিত করে?
মুহাম্মদ ইউনূস: না, এখনো সাংঘর্ষিক তো যায় নাই। আমরা যেভাবে অগ্রসর হচ্ছিলাম, একটা ফর্মুলা দিয়েছিলাম, একটা প্রক্রিয়া তৈরি করেছিলাম। এটা কাজে লাগে কি না জানি না। প্রক্রিয়াটা হলো যে, কতগুলো কমিশন বসিয়ে দিয়েছি। প্রতিটা সাবজেক্টের ওপরে কমিশন বসিয়ে দিয়েছি। এ রকম ১৫টা কমিশন হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে ৬টা কমিশন প্রথম ঘোষণা করেছিলাম। ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের রিপোর্ট দেওয়ার কথা ছিল। তারা ৯০ দিনে শেষ করতে পারে নাই। বলছে যে এক সপ্তাহ দেরি হতে পারে। সেটার কারণে আমাদের আয়োজন করতেও সময় লেগেছে। ঘোষণা করেছি, তাকে বসার জায়গা দিতে পারি নাই। কোথায় কে কার সঙ্গে পরিচয়, এসব করতে সময় লেগেছে। তারা ৯০ দিন পায় নাই সেই হিসাবে। কাজেই যদি ৭ তারিখে তারা দিয়ে দেয়, তাহলে জানুয়ারি ৭ তারিখের মধ্যে আমরা সেই ৬টা কমিশনের রিপোর্ট পাব। ওইখানে যাবতীয় সংস্কারসংক্রান্ত বিষয় দেওয়া থাকবে। সবার সঙ্গে আলোচনা করে করা হয়েছে। তাহলে সংস্কারের রূপরেখাটা আমরা পেলাম। ইতিমধ্যে মতবিনিময় হয়েছে, তার মধ্যে কোনোটা টিকেছে, কোনোটা টিকে নাই। কমিশন মনে করেছে, যেটা এইগুলোই হলো আমাদের সারমর্ম। এগুলো পেয়ে গেলে তখন নিয়ে আসব বৃহত্তর সংলাপের জন্য। একটা সংলাপ সেদিন হয়েও গেল। যদিও কোনো রিপোর্ট আসেনি তবু প্রাথমিকভাবে একটা সংলাপ হলো। সবাইকে নিয়ে আলাপ করা—কোনটা পছন্দ, কোনটা অপছন্দ, কীভাবে অগ্রসর হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কাজেই বিষয়ভিত্তিক একটা বড় রকমের কনসেনসাস বিল্ডিং প্রসেস, যেটার জন্য আবার আলাদা একটা কমিশন ঘোষণা করলাম সেদিন। সেটা হলো এই ছয় কমিশনের চেয়ারম্যানদের দিয়ে একটা কমিশন। আমি নিজে এটার চেয়ারম্যান হলাম এবং প্রফেসর আলী রীয়াজকে সহসভাপতি করলাম যে আমরা মিলে এটা একটা কনসেনসাস ডেভেলপ করার চেষ্টা করব। এই কনসেনসাসের প্রক্রিয়াটা আমাদের ঠিক করতে হবে। সমাজের কোন কোন গোষ্ঠীর সঙ্গে কীভাবে আদান-প্রদান হবে, তাতে একটা সর্বমতসম্মত একটা কিছু বের করা যায় কি না। সবকিছুতে একমত না হলেও অন্তত কিছু বিষয়ে আশা করি একমত হওয়া যাবে। তখন সেটা হবে আমাদের সংস্কার। যেহেতু একমত হয়ে গেছে, তাহলে এটা বাস্তবায়ন করা সহজ হয়ে যাবে— এইভাবে আমরা চিন্তা করছি।
নূরুল কবীর: এটা আবার কি মধ্য জানুয়ারিতে শুরু হতে পারে?
মুহাম্মদ ইউনূস: আশা করছি। ডেফিনেটলি।
নূরুল কবীর: অর্থাৎ আপনার সরকারের নিজস্ব কোনো সংস্কার কর্মসূচি নাই...
মুহাম্মদ ইউনূস: এই তো এটাই আমাদের।
নূরুল কবীর: কিন্তু এটা তো বাইরে থেকে আসল...
মুহাম্মদ ইউনূস: বাইরে থেকে নিয়েই তো আমাদের হলো। এটা এভাবে একজনের মাথা থেকে তো আসবে না। ১০ জনের মাথা থেকে এসে নির্যাস হয়ে এটা আসল। তারপরও আবার সবার সঙ্গে আমি [কথা] বলছি।
নূরুল কবীর: আপনার ক্যাবিনেটে আপনাদের কি কোনো নিজস্ব চিন্তাভাবনা, কোনো সেক্টরে...?
মুহাম্মদ ইউনূস: আছে। কিন্তু সেটা কমিশনকে গিয়ে বলতে হবে। কারণ, মতামত সংগ্রহ করার দায়িত্ব হলো কমিশনের।
নূরুল কবীর: কিন্তু সরকারের নিজেদের কোনো নিজস্ব...
মুহাম্মদ ইউনূস: নিজস্ব কোনো প্রোগ্রাম নাই। আমরা তো রাজনৈতিক দল না যে আমাদের একটা নিজস্ব থাকবে। আমাদের একেকজনের একেক মত। একেকজন একেক রাজনীতিতে বিশ্বাসী। সেটা নিয়ে তো আমাদের কোনো অসুবিধা নাই।
নূরুল কবীর: এগুলো নিয়ে অনেক ভিন্নমত কি আপনার সরকারের মধ্যে...
মুহাম্মদ ইউনূস: এখনো তো দেখি নাই। সামনে আসলে দেখা যাবে, যখন তর্ক-বিতর্ক শুরু হবে—না, এটা আমরা মানি না।
নূরুল কবীর: আর আপনি এটা অনুমান করছেন...
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি অনুমান করছি। কারণ, সব সময় সবাই যে একমত হবে, সে রকম তো কথা নেই। যেমন ধরেন, সেদিন সংলাপের জন্য আমাকে একটা বক্তৃতা দিতে বলেছিল। সেখানে বললাম যে সমঝোতা কীভাবে হবে। এটা একটা প্রক্রিয়া। বলতে গিয়ে বললাম, ধরুন, আমি মনে করি, ১৭ বছর বয়সে ভোটার হওয়া উচিত এবং আপনি সেটা ভিন্নমত পোষণ করেন। তাহলে আলাপ হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, আপনার মতই টিকে গেল। আমারটা হলো না। আমি মেনে নেব সেটা। লোকে মনে করল যে, ১৭ বছর—এটা সরকার থেকে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমি তো ভাই এ রকম বলি নাই। আমি বললাম যে ধরুন, ১৭ বছর বয়স থেকে (ভোটার) হওয়া ভালো। এটা একটা মত।
নূরুল কবীর: সিদ্ধান্ত নয়...
মুহাম্মদ ইউনূস: এটা সিদ্ধান্ত নয়। উদাহরণ হিসেবে এটা। তাহলে এটার সমঝোতাটা কীভাবে হবে? আপনাদের সবার মত এক রকম, আমার মত এক রকম। শেষ পর্যন্ত সবার মত যেদিকে, আমি সেদিকে যোগ দেব। সেটি হলো কনসেনসাস, সেটি হলো ঐকমত্য। এইভাবে আমরা অগ্রসর হতে চাই। সেটা অনেকে ভুল বোঝে। মনে করে যে সরকার থেকে ১৭ বছর লাগিয়ে দিতে চাচ্ছে। আমি বললাম যে না ভাই এ রকম তো বলি নাই আমি।
নূরুল কবীর: এ বিষয়ে সরকারের সুনির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাবনা নাই...
মুহাম্মদ ইউনূস: না।
নূরুল কবীর: পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে, আমরা লক্ষ করছি, তরুণদের একটি অংশ, যাঁরা নতুন একটা রাজনৈতিক দল করতে যাচ্ছেন, তরুণেরা যাঁরা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে যে তাঁরা সময় নিতে চায় নির্বাচনের জন্য। রাজনৈতিক দলগুলো মনে করছে যে সংস্কার প্রক্রিয়ার পাশাপাশি নির্বাচনপ্রক্রিয়াটা এগিয়ে আনা দরকার। কিন্তু তাঁদের কথাবার্তার মধ্যে সাম্প্রতিককালে পাবলিক ডিবেটের মধ্যে একধরনের তিক্ততাও তৈরি হয়েছে। আপনার নজরে এসেছে?
মুহাম্মদ ইউনূস: খুব ভালো করে নজর এসেছে।
নূরুল কবীর: সেটা একটা দুশ্চিন্তার ব্যাপার নয় কি?
মুহাম্মদ ইউনূস: মোটেই না। ওই যে বললাম বাইরে এক রকম, ভেতরে আরেক রকম।
নূরুল কবীর: আচ্ছা, সে কারণে? তাঁরা শেষ পর্যন্ত একমত হয়ে যাবেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: একমত হয়ে যাবে।
নূরুল কবীর: তরুণেরা মনে করেন, যাঁদের সম্পর্কে যেটা বলা আছে বা আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা হয় যে তাঁরা দলটা করবেন, দলের পরে কনস্টিটিউয়েন্সিগুলো বিল্ডআপ করবে, লোকগুলো তৈরি করবে, এই কারণে তার সময় দরকার। আর ঠিক সংস্কারটা মাথায় আছে। নিশ্চয়ই তাঁরা সংস্কার চান। এই মুহূর্তে ক্ষমতার রাজনীতিতে তাঁরা প্রায়োরিটি দিচ্ছেন, তাঁদের নিজস্ব সংগঠন তৈরি করে নির্বাচন করা। এ কারণেই অন্যরা মনে করে যে, শুধু অন্য একটা গ্রুপকে সময় দেওয়ার জন্য নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। তা আপনি সেটার মধ্যে কোনো সমস্যা দেখছেন না।
মুহাম্মদ ইউনূস: সে জন্য ঘোষণা দিয়ে দিলাম। কতগুলো তারিখ দিয়ে দিলাম, যাতে এই সন্দেহ না থাকে। কারণ, যত কিছু টানতে চান না কেন, আমি তো ঘোষণা দিয়ে দিয়েছি। হয় এখানে হবে, না হয় ওইখানে। দুটো তারিখ দিয়ে দিয়েছি।
নূরুল কবীর: কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো তারপরও বলছে যে আরও সুনির্দিষ্ট করে দিতে হবে।
মুহাম্মদ ইউনূস: এর ভেতরে তারিখ চাচ্ছে; বাড়াতে চাচ্ছে না। এর ভেতরে তারিখ চাচ্ছে, কোন তারিখে করবেন। আমি বললাম যে, ওই প্রসেসটা অগ্রসর হতে আমরা দেখব। এটা তো আপনাকে বাদ দিয়ে দিলাম, এর বাইরে আমরা যাচ্ছি না, এইটা হলে এই পর্যন্ত, ওইটা হলে এই পর্যন্ত, এইভাবে আছে। কাজেই ওটা যে উনারা বুঝতেছে না তা (নয়), বোঝেন। তবু কথাটা বারে বারে বলছে যে, ইন কেইস আমরা এটা অতিক্রম করতে চাই।
নূরুল কবীর: তাহলে আপনাদেরকে চাপের মুখে রাখতে চান।
মুহাম্মদ ইউনূস: এটা আমাদের জন্য ভালো।
নূরুল কবীর: যাদেরকে চাপের মুখে রাখতে চায়, তারা আবার এটা ঠিকই বোঝে...
মুহাম্মদ ইউনূস: বুঝব তো বটেই।
নূরুল কবীর: দে আর প্লেয়িং টু দ্য গ্যালারিজ...
মুহাম্মদ ইউনূস: আমরাও চাই যে চাপের মধ্যে থাকি। কারণ, আমাদের ভেতরেও তো নানা মত থাকতে পারে।
নূরুল কবীর: হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
মুহাম্মদ ইউনূস: সে জন্যই একটা বাঁধ দিয়ে দেওয়া হলো। এই পর্যন্তই, এর ভেতর থেকে আমাদের যা কিছু করতে হবে। এমন না যে কেউ বলে—না, পাঁচ বছর লাগবে। এটা সংস্কার করতে ভালো লাগছে না— এমন যেন বলতে না পারে। যে যা কিছু করতে হয় এর মধ্যে হতে হবে। এই সংস্কারের জন্য যে সমস্ত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, এই দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপেই করতে হবে, আরও ছয় মাস বাড়াতে হবে, বললাম যে না এর ভেতরেই সবকিছু করতে হবে। কাজেই এই যে একটা বাঁধ দেওয়াটা, এটা খুব দরকারি জিনিস আমাদের জন্য। এর মধ্যে আমরা যেন সবকিছু সম্পন্ন করতে পারি।
নূরুল কবীর: আপনার মন্ত্রিপরিষদের তরুণ সদস্যদের কেউ কেউ এসব ব্যাপারে পাবলিক স্টেটমেন্ট করার পর অনেক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। আপনি নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন এবং সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর একটা অবিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হতে পারে—এ রকম কিছু স্টেটমেন্ট এসেছে। আপনি কি পরিষদ সদস্যদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: ক্রমাগত আলাপ হয় এবং সেটার জন্য আমাদের একটা প্রক্রিয়াও আছে, যাতে করে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমরা আলাপ করি।
নূরুল কবীর: পরিষদ সদস্যদের পাবলিক স্টেটমেন্টের জন্য যে ভুল-বোঝাবুঝি...
মুহাম্মদ ইউনূস: সেটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে একটু ভুল-বোঝাবুঝি হয়। সাংবাদিকদের সামনে গিয়ে কী বলতে কী বলে ফেলে, আমাদের তো অভ্যাস নাই। কাজেই একটু গোলমাল হয়ে যায়। পরে আবার বলে যে না আমি ওইভাবে বলি নাই, আমার বলা এভাবে ছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে ঐকমত্যের কোনো অভাব নেই। আমরা যেগুলো বলছি, সেগুলো সম্বন্ধে আমরা একমতেই আছি। এটার মধ্যে কোনো অসুবিধা নেই।
নূরুল কবীর: আপনার সর্বশেষ বক্তৃতায় দুটো পোলাইট অ্যাডমিশন ছিল, আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে ও দ্রব্যমূল্যের ব্যাপারে। সরকার যে পরিমাণ আশা করেছে, সেই পরিমাণ সাফল্য আসে নাই, সেটাও বেশ কয়েক দিন হয়ে গেল। এগুলোর জন্য বিশেষভাবে আপনারা নতুন কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন বা চিন্তা করছেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: সব সময় তো চেষ্টা করি। এটা তো আজকের সমস্যা না। এটা বরাবরেরই সমস্যা।
নূরুল কবীর: কোনো স্পেসিফিক স্টেপস, দ্রব্যমূল্যের জন্য...
মুহাম্মদ ইউনূস: একটা হলো আইনশৃঙ্খলা, আরেকটা হলো বাজারমূল্য (দ্রব্যমূল্য)। বাজারমূল্যের জন্য যত রকমের বুদ্ধি আছে, সবকিছু আমরা করেছি, আমাদের বুদ্ধিতে যত দূর কুলিয়েছে।
নূরুল কবীর: যেমন কী কী...
মুহাম্মদ ইউনূস: যেমন প্রতিদিনের খবর। কোন বাজারে কত টাকা উঠল, কত টাকা কমল, বাজারভিত্তিক। এমন না যে সারা বাংলাদেশের...অমুক বাজারে কত, অমুক বাজারে...তার মধ্যে রকমফের হয়। কেন রকমফের হচ্ছে। একসঙ্গে কেন এক বাজারে পড়ছে, আরেক বাজারে উঠতেছে, সেটা দেখা।
নূরুল কবীর: সেটা তো অ্যানালাইসিস হিসেবে ভালো। কিন্তু অ্যানালাইসিসের যে রেজাল্ট, সেইটার জন্য আপনারা অ্যাকশন কী নিয়েছেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: অ্যাকশনের জন্য হলো যে, যেগুলো মাথায় বুদ্ধি আছে, সেগুলো প্রয়োগ করা। যেমন ট্রাক দিয়ে দেওয়া যে ট্রাকে মাল আসুক। বিআরটিসির কাছে ট্রাক আছে। ট্রাক নিয়ে আসি। ট্রাক দিয়ে মাল আসতে থাকুক। কোথায় কোথায় বাজারে এগুলো উঠছে। সেখানে কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না। এই যে চাঁদাবাজির বিষয় আছে। চাঁদাবাজিটা কমানো যায় কি না ইত্যাদি ইত্যাদি। যা আপনারা দেখতেছেন, একই জিনিস আমাদের কাছে।
নূরুল কবীর: উত্তর বাংলায় যে ফুলকপির দাম দুই টাকা, ঢাকার বাজারে ৪০ টাকা। বরাবরই পুলিশ থেকে শুরু করে মিডিয়া সব সময় বলেছে যে, পথে পথে যে চাঁদাবাজি হয়, তাতে খরচটা বেড়ে যায়। এটা আপনার সরকারও জানে। কিন্তু নতুন করে একদল চলে যাওয়ার পর আরেক দল চাঁদাবাজদের দেখতে পাচ্ছি। তাদের কেউ গ্রেপ্তার হয় নাই এই অপরাধে। তার মানে কী?
মুহাম্মদ ইউনূস: গ্রেপ্তার হইছে কি না আমি জানি না। কিন্তু এটার সমাধান হয়নি।
নূরুল কবীর: কিন্তু গ্রেপ্তার হচ্ছে না। ডিটার করার [থামানোর] জন্য সরকারের পদক্ষেপ থাকলে এটা তো চলবার কোনো কারণ নাই। এগুলো সাধারণত রাজনৈতিক দলের যারা সংগঠিত শক্তি, তারাই করে। আপনারা কি রাজনৈতিক দলগুলোকে অসন্তুষ্ট করতে চান না?
মুহাম্মদ ইউনূস: আইনের ক্ষেত্রে...দল অসন্তুষ্ট হলে, সারা দেশ অসন্তুষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
নূরুল কবীর: আমরা এই বিষয়ে এই ধরনের অপরাধের জন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাউকে গ্রেপ্তার হতে দেখি নাই। এটা আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমরা হয়তো ধরতে পারছি না তাদেরকে এখনো জুতমতো।
নূরুল কবীর: এটা কি বিশ্বাসযোগ্য হবে, প্রকাশ্য রাস্তার মধ্যে বাজারের মধ্যে বাস টার্মিনালে চাঁদাবাজি। সবাই দেখতে পাচ্ছে স্যার। সরকার দেখতে পাচ্ছে না কেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: সরকারের চোখ অত পরিষ্কার না আরকি।
নূরুল কবীর: পত্রপত্রিকার রিপোর্টগুলো আরও বাড়লে কি আরেকটু পরিষ্কার হবে বলে মনে হয়?
মুহাম্মদ ইউনূস: যত বলা যায়, তত ভালো হবে, একটু সতর্ক হবে সবাই।
নূরুল কবীর: আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তোমার কোনো প্রশ্ন আছে, আমি বড় স্যারের সঙ্গে কথা বলব।...উনি বলছেন, যে সিন্ডিকেটগুলো আছে সরকারের জানার কথা। তারা কোথায় স্টক করে, সেগুলো রেইড করলেই পারে। নাগরিক হিসেবে বা আমার স্ত্রীর এই প্রশ্নের আপনার কী উত্তর?
মুহাম্মদ ইউনূস: উত্তর হলো, যে সিন্ডিকেটে এই মাল আনা-নেওয়া করে, আমরা চেষ্টা করছি যে বাইরে যারা আছে, সিন্ডিকেটের বাইরে, তাদেরকে কী কী সুবিধা দিলে তারা এই ব্যবসায় আসত। ব্যবসা যে আমরা দুজনে মিলে ঠিক করলাম যে আমরা মাল আনব, আমরা বিক্রি করব। এটাকে কোন আইনে আপনি...
নূরুল কবীর: তারা যখন আর্টিফিশিয়াল ক্রাইসিস তৈরি করে তখন...
মুহাম্মদ ইউনূস: সেটা যদি মাল গুদামে রেখে দেয়, বাজারে বিক্রি না করে, তখন গিয়ে ধরতে পারেন।
নূরুল কবীর: আপনার সরকার কি এগুলো খেয়াল করেছে, গুদামে...লক্ষ করেছে?
মুহাম্মদ ইউনূস: ওই যে বললাম, সবকিছু খেয়াল করে। ওই যে তথ্য সংগ্রহ করা দামের কথা বললাম, স্টকের কথা বললাম। কে কোথায় এলসি খুলতেছে, সেই রিপোর্ট আমাদের কাছে আসে। কোন মাল খালাস হচ্ছে, কোন দিন কোথায় স্টক হচ্ছে, সেগুলো সংগ্রহ করা এবং তদারক করা যে মাল কি ওই গুদামে রয়ে গেছে, না ছেড়ে দিচ্ছে।
নূরুল কবীর: আপনারা কোনো অসংগতি দেখতে পাচ্ছেন না?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমরা এগুলো করছি বলেই তারা তাড়াতাড়ি এগুলো ছাড়ার চেষ্টা করে, এই গুদাম থেকে আরেক গুদামে নিয়ে যায় হয়তো। বাজারে দিচ্ছে না, চালাকির কাজ।
নূরুল কবীর: এই চালাকিটার জন্য তো কোটি কোটি গরিব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
মুহাম্মদ ইউনূস: বহু বহু গরিব মানুষ, সবাই।
নূরুল কবীর: মানেটা হচ্ছে যে এই ব্যবধান থাকবার কোনো কারণ থাকতে পারে না।
মুহাম্মদ ইউনূস: ঠিক।
নূরুল কবীর: এবং সেইটা প্রধানত সরকারের দেখবার বিষয়।
মুহাম্মদ ইউনূস: ডেফিনেটলি।
নূরুল কবীর: মানুষের অভিযোগ হচ্ছে, সরকার এটা ইন ফ্যাক্ট দেখছে না। আপনি সেটা ফিল করেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি ফিল করি, ডেফিনিটলি।
নূরুল কবীর: এই সরকারের বিরুদ্ধে...রাষ্ট্র তো কিছু প্রয়োজনে, মানুষের প্রয়োজনে কঠোর হয়। আপনাদের বিরুদ্ধে সুশীলতার অভিযোগ আছে, কঠোর হচ্ছেন না।
মুহাম্মদ ইউনূস: আমরা আমাদের সাধ্যমতো কঠোর হয়ে...হয়তো যে কঠোর মানুষের মনে আছে, অত দূর হতে পারছি না। কিন্তু আমরা যে এত দিন যত কঠোর হইনি, অত কঠোর এখন হতে চাচ্ছি।
নূরুল কবীর: আমরা একটু অন্যদিকে যাই। এটা আমরা সবাই জানি, এখানে যে বাংলাদেশে এত বড় একটা রাজনৈতিক রক্তাক্ত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষের মনের মধ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কিছু আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। সেটাকে আমাদের পাশের দেশ ভারত একধরনের সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা হিসেবে চিহ্নিত করছে এবং নানান কথা বলছে। এটা আমরা ঠিক জাতীয়তাবাদী চৈতন্য থেকে নয়, দেশকে ভালোবাসি বলে নয়, তথ্য বিকৃতি হিসেবে নানান জায়গা থেকে এগুলো মিডিয়া, এটা সাধ্যমতো বলছে। কিন্তু সেটার একটা হচ্ছে মিডিয়ার লড়াই। আরেকটা হচ্ছে যে, বস্তুত ফাংশনাল ডিপ্লোমেসিতে আপনার এই কদিনের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী ভারতের সঙ্গে একটা সুষ্ঠু ওয়ার্কিং রিলেশন তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে কি আমরা এগোতে পেরেছি?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমরা বরাবর চেষ্টা করছি ভারতের বিভিন্ন পর্যায়ে সম্পর্ক [গড়ে] তোলা এবং তাদের কাছে প্রকৃত পরিস্থিতি তুলে ধরার। প্রথমবার যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ফোনে আলাপ হলো, উনিই ফোন করেছিলেন, তখন উনি অভিযোগ করলেন যে এখানে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে ইত্যাদি। আমি বললাম যে, এটা অতিরঞ্জিত কতগুলো সংবাদ আপনার কাছে যাচ্ছে। কাজেই এটা আপনি বিশ্বাস করেন না। যদি আপনি প্রকৃত তথ্য জানতে চান, আপনি আপনাদের সাংবাদিকদের পাঠান। এখানে আসুক। তাঁরা দেখুক। দেখে রিপোর্ট করুক। কাজেই আমাদের তথ্যগুলো যদি আস্থায় আনতে না চান, তাহলে এটি প্রকৃত পরিস্থিতি। পরে অনেকে এসেছিলেন। ভারতীয় সাংবাদিক এখানে এসেছেন। তাঁরা রিপোর্ট করেছেন। আমরা চেষ্টা করছি, যাতে করে অতিরঞ্জন থেকে বাঁচা যায়। কিন্তু কিছু সংবাদ আছে, এগুলো কোনো অতিরঞ্জনের বিষয় না। এটা একেবারে গাঁজাখোরি কতগুলো কথা নিয়ে যাচ্ছে। সেটা তারে সামনে দেখায়ে দিলেও হবে না। তো সে রকম তারা চলছে, নানা রকম আজগুবি সংবাদ দিচ্ছে। পরে যখন তাঁদের সঙ্গে আলাপ হয়...এবার তাঁদের পররাষ্ট্রসচিব যখন আসলেন, তখন বললাম যে এ রকম কেন হচ্ছে? তো বলল যে, ওটা আমাদের রাষ্ট্রের সরকারের বিষয় নয়। সরকার এটার মধ্যে জড়িত না। এগুলো মিডিয়ার বিষয়। এগুলো আমাদের আওতার বাইরে। কাজেই সরকার এটা থেকে দূরে চলে গেল। সেটা আমাদের জন্য একটা বড় অ্যাচিভমেন্ট। এত দিন সরকার এটার মধ্যে জড়িত ছিল বলে অনেকটা প্রকাশ করছিল। এখন সর্বপ্রথম (বলা হলো) এটা আমাদের না। আমরাও চেষ্টা করছি, আমাদের তথ্যগুলো তাদের কাছে দেওয়ার জন্য। এখন মনে হয় ইন্টারন্যাশনাল কাভারেজ ইত্যাদির কারণে অত বেশি জুত করতে পারছে না। দিচ্ছে, এখনো খবর দিচ্ছে উল্টাপাল্টা খবর দিচ্ছে। কিন্তু জুত করতে পারছে না। যেহেতু আন্তর্জাতিক সাংবাদিকেরা রিপোর্ট করছেন। আগে বলছিল যে এটা ইসলামিস্ট একটা অভ্যুত্থান হয়েছে, এটা তালেবানদের হাতে চলে গেছে ইত্যাদি। এখন পত্রপত্রিকায় ইন্টারন্যাশনাল কাগজপত্রে যখন আসছে, ওখানেও তারা সুবিধা করতে পারছে না ওরকম বলে। কিছু কাগজে দেখাল, এখানে ক্যাবিনেটের মধ্যে কারা কারা আছে? তাঁদের যে পরিচিতি দিল, কেউ বিশ্বাস করবে না যে এটা ইসলামিস্টদের গোষ্ঠীর। কাজেই ওগুলো ফেলেও দিতে পারছে না। কাজেই যতই তারা করুক না কেন, এই ধরনের যে প্রোপাগান্ডা যেগুলো ছিল, প্রচারণা যেটা ছিল, সেটা আগের থেকে অনেক কমেছে। তাতে সব রকমের প্রচারণা বন্ধ হয়ে গেছে—এটা বলব না। এ[ক]টা প্রচারণা আছেই।
নূরুল কবীর: ভারত রাষ্ট্রের দিক থেকে কোনো হোস্টাইলিটি টের পান আপনি?
মুহাম্মদ ইউনূস: না। আমাদের তো রাষ্ট্রীয় দিক থেকে কোনো হোস্টাইলিটি নাই অন্তত। এই যে বললাম তারা পরিষ্কারভাবে বলল যে এটার সঙ্গে আমাদের [ভারত সরকারের] কিছু না। আমাদের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক। আমাদের [ভারত সরকারের] বক্তব্যের মধ্যে এগুলা নাই। আমরা বলেছি যে আমাদের সম্পর্ক খুব গভীর সম্পর্ক হতে হবে এবং ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হতে হবে। এখন মেঘ জমেছে, মেঘটা কাটিয়ে উঠতে হবে। এটা বলছে, মেঘটা কাটানোর জন্য আমাদের চেষ্টা করতে হবে, উভয় পক্ষে। সেটা আমরা চেষ্টা করি।
নূরুল কবীর: মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হওয়ার জন্য আপনার সরকার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনবার একটা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। অফিশিয়ালি চিঠি দিয়েছেন আপনারা। আপনার ধারণা, একটা রিজনেবল টাইম বলে আর কত দিনের মধ্যে উত্তর আশা করেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমার কোনো ধারণা নেই, এগুলোর কত দিন সময় লাগবে।
নূরুল কবীর: আপনার ফরেন মিনিস্ট্রি নিশ্চয়ই আপনাকে...
মুহাম্মদ ইউনূস: না, এখনো জিজ্ঞেস করিনি, কত দিন লাগবে। আমরা প্রক্রিয়া শুরু করেছি। এখন দেখব, তারা কী জবাব দেয়? তারা জবাব দিচ্ছে কি না, এটা ফলোআপ করব। ডেফিনেটলি একটা গতি নেবে এটা।
নূরুল কবীর: অনুমান, কত দিন পরে আপনারা আবার চিঠি দেবেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: এটা একটা সময়ের ব্যাপার। মাসখানেক বলেন। আমরা ফলোআপ করব। দেখেন কী কী হয়।
নূরুল কবীর: আমরা আরেকটু পশ্চিমে যাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অনেক ভালো সম্পর্ক। এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্যাবিনেটে ইন্ডিয়ান বর্ন সাতজন মন্ত্রী আছেন বলে শোনা যায়। আপনার সঙ্গে পশ্চিমের সম্পর্ক ভালো বলে মানুষ মনে করে। তাঁদের এই সম্পর্ক কি আমাদের দেশে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মধ্যে কোনো ক্ষতির কারণ হবে বলে আপনি আশঙ্কা করেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: হতে পারে; কারণ, এত ঘনিষ্ঠতা থাকলে, ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তি যদি ওইখানে ক্ষমতায় থাকে, তার একটা প্রভাব তো হতেই পারে। এবং ইতিমধ্যে তার প্রভাবের কিছু নমুনাও আমরা দেখেছি। কাজেই আমরা দেখছি, এটা কোন দিকে যায়। ভারতীয় বংশোদ্ভূত হলেই যে সে ভারতের সঙ্গে যুক্ত থাকবে এমনও কোনো কথা নাই। সে হয়তো আমাদের দিকে বেশি মনোযোগ দিতে পারে। আমরা দেখছি, সেগুলো কীভাবে আমরা বার করতে পারি যে কারা কারা আমাদের দিকে সহানুভূতিশীল হবে। কীভাবে আমরা তাদের সহানুভূতিটা পেতে পারি। নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক কীভাবে গড়ে তোলা যায়। পুরোনো সরকারের সঙ্গে আমাদের একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল; ভালো সম্পর্ক ছিল। নতুন সরকারের সঙ্গে আমরা একই রকম ভালো সম্পর্ক করার জন্য চেষ্টা করব।
নূরুল কবীর: ইতিমধ্যেই কি কাজকর্ম এই ব্যাপারে শুরু হয়েছে?
মুহাম্মদ ইউনূস: এটা নিয়ম। আমাদের করতে হয়। যখন নতুন সরকার আসে, তার সঙ্গে একটা যোগাযোগ স্থাপন করা যেগুলো ডিপ্লোমেটিক পর্যায়ে হয়। গিয়ে আলাপ-সালাপ করে। ডিপ্লোমেটিক চ্যানেলের বাইরে হয় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের খাতিরে। ওইখানে যাঁরা হোয়াইট হাউসে আছেন, তাঁদের সঙ্গে যাঁদের যোগাযোগ আছে, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। কীভাবে করতে হবে? নানাভাবে হয়। বিভিন্ন চ্যানেলে যোগাযোগগুলো করতে হয়।
নূরুল কবীর: আপনি ইতিমধ্যে সার্কের একটা ইফেকটিভ রিভাইভালের কথা প্রস্তাব করেছেন বাংলাদেশের তরফ থেকে। তাতে কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে হয়?
মুহাম্মদ ইউনূস: অন্য দেশের যাঁরা আছেন, তাঁরাও চান সার্কের অন্যান্য দেশের মধ্যে...কিন্তু ভারত এটাতে খুব সাড়া দিচ্ছে না। তারা ব্যাখ্যা করে যে আমাদের [ভারত] সমস্যা হলো পাকিস্তানকে নিয়ে। তো আমি যেটা ব্যাখ্যা করি যে একটা দেশের সঙ্গে সমস্যা হলেই পুরো জিনিসটা বিকল হয়ে যাবে, এটা তো ঠিক হবে না। আমরা চেষ্টা করি, ওইটাও সমাধান হোক। অথবা ওই সমস্যাকে পৃথকভাবে দেখে বাকি সব সম্পর্ককে আমরা গড়ে তুলি। এখনো এটার কোনো...
নূরুল কবীর: রেসপন্স?
মুহাম্মদ ইউনূস: রেসপন্স...
নূরুল কবীর: দেখা যায় না?
মুহাম্মদ ইউনূস: না।
নূরুল কবীর: আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, যেটা আমার দেশের মানুষ জানতে চায়। বাংলাদেশ থেকে প্রচুর টাকা আওয়ামী লীগ আমলে পাচার হয়েছে। আপনি তার জন্য একটা কমিশনের মতো করেছেন। এই টাকাপয়সা ফিরে পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতির ইঙ্গিত কি পাচ্ছেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: একসাথে সাক্ষ্যপ্রমাণ পেয়ে গেলে আমরা নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা করতে পারব। এ রকম একটা আইন আছে। আইনের মাধ্যমে এটা করব। সব টাকা হয়তো ফেরত আসবে না। কিছু টাকা ফেরত আসবে যদি আমরা সাক্ষ্যপ্রমাণগুলো পাই। সে প্রচেষ্টাগুলো হচ্ছে।
নূরুল কবীর: সাক্ষ্যপ্রমাণের ব্যাপারে কাজকর্ম চলছে...
মুহাম্মদ ইউনূস: একদম। খুব ডেডিকেটেড একটা আলাদা ইউনিট আছে, তাদের কাজই হলো এগুলো উদ্ধার করা। এটা প্রথম থেকে শুরু হয়েছে। যেহেতু আমরা জানি, যে রকম টাকা গেছে এবং ব্যাংকিং চ্যানেলে গেছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে ধরাটা একটু সহজ হবে হয়তো। যেগুলো স্যুটকেস ভরে নিয়ে গেছে, মুশকিল আছে সেগুলো ধরা। কিন্তু এগুলো তো চ্যানেলের ব্যাপার। যারা এক্সপার্টস আছে, যারা এই কাজগুলো করে, তারাও বলতেছে, হ্যাঁ, এটা সম্ভব। কিন্তু সম্ভব বলে কত দিন আমরা বসে থাকব, এটাই হলো বিষয় আরকি। এটার আইনগত বিষয় আছে। কী সাক্ষ্যপ্রমাণ? তারা কী চায়? কীভাবে এটা আইডেনটিফাই হবে? কার কাছে গেল? আইন ভঙ্গ করে গেল? কিছু কিছু আশা মাঝে মাঝে পাই যে এটা হবে। এখনো চূড়ান্ত কিছু পাইনি।
নূরুল কবীর: মানে, আমাদের আশা করবার কারণ আছে...
মুহাম্মদ ইউনূস: আশা করার কারণ আছে। অবশ্যই কারণ আছে।
নূরুল কবীর: কী রকম সময় লাগবে বলে আপনার ধারণা?
মুহাম্মদ ইউনূস: তাদের কথা তো কিছু বুঝতে পারি না। এটার যে একটা স্ট্যান্ডলাইন আছে, এর মধ্যে গিয়ে এটা শেষ হবে, এটা এখনো বুঝি নাই যে এটা কত দিন লাগতে পারে। আমি একটা আন্দাজে বলে দিতে পারি আপনাকে। কিন্তু আমার মনে হয় না, সেটা বলা ঠিক হবে।
নূরুল কবীর: সামনের নির্বাচনের পরে এই যে এ রকম দায়িত্ব শেষ করবার পরে পরবর্তীকালে কী করার প্ল্যান আপনার?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি তো বরাবরই বলছি যে আমি যে [এখানে, এটা] সাময়িক বিষয় ছিল। আমি এই দায়িত্ব পালন করে আমার পুরোনো আনন্দের জগতে ফিরে যাব।
নূরুল কবীর: এই অভিজ্ঞতার ওপর কোনো বই লেখার পরিকল্পনা আছে আপনার?
মুহাম্মদ ইউনূস: না। এ রকম চিন্তা করিনি। আপনি বইয়ের কথা মনে করিয়ে দিলেন! আমি দিন কাটানো নিয়ে ব্যস্ত আছি।
নূরুল কবীর: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ সময় দেবার জন্য।
মুহাম্মদ ইউনূস: অসংখ্য ধন্যবাদ।

অভূতপূর্ব রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। তিন দিনের মাথায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। প্রায় ৫ মাস অতিবাহিত হলেও সরকার এখনো ধাতস্থ হয়নি। বিভিন্ন খাতে সংস্কার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, দ্রব্যমূল্য, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর চাপসহ নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে এই সরকার। প্রধান উপদেষ্টা মনে করেন, সংস্কার ও বছরের শেষ নাগাদ কিংবা আগামী বছরের প্রথমার্ধে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়ার কোনো ঘাটতি নেই। গত ২৯ ডিসেম্বর (২০২৪) ইংরেজি দৈনিক নিউ এজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এ মন্তব্য করেন তিনি। ঢাকায় প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় বাংলায় সাক্ষাৎকারটি নেন পত্রিকাটির সম্পাদক নূরুল কবীর। তাঁর সম্মতিক্রমে সাক্ষাৎকারটি আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

নূরুল কবীর: আপনার চার মাস হলো প্রায়। এই চার মাস আর আগের চার মাসের মধ্যে কোন পর্বটা আপনার ভালো লাগে বা কোনটা খারাপ?
মুহাম্মদ ইউনূস: খারাপ কোনোটাই না। খারাপটা বলব না, কিন্তু ভিন্ন। আগেরটা ছিল আমার নিজস্ব জগৎ। সারা জীবন ধরে যা যা করে এসেছি, সেটার মধ্যেই ছিলাম। নিজস্ব আয়োজন, নিজস্ব চিন্তা। তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। সেটা আমার মতো করে ট্যাকল করেছি। আমি আমার মতো করে চলেছি। সেটা একেবারে আমার নিজস্ব জগৎ। এটা একবারে ভিন্ন জগৎ। এটা আমার নিজস্ব জগৎ না। এই জগতে আমি কোনো দিন ছিলাম না; থাকার কোনো আগ্রহও ছিল না। এটার ডান-বাম আমার জানা নেই। অনেকটা হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে চলার মতো অবস্থা। কিন্তু এটারও একটা চ্যালেঞ্জ আছে।
আমাকে তারা আহ্বান জানিয়েছে। প্রথমে একটু সংকোচ করছিলাম যে এতে যাওয়া ঠিক হবে না, যেহেতু আমি এ জগতের মানুষ নই। কিন্তু তারা আমাকে বোঝাতে পেরেছে যে, এই পরিস্থিতিতে আপনার আসা দরকার। শেষ পর্যন্ত আমি রাজি হয়েছি যে, এইভাবে তোমরা প্রাণ দিয়েছ, তোমরা রক্ত দিয়েছ। আমার জন্য না হয় একটু চ্যালেঞ্জিং হলোই। কাজেই আমি রাজি হলাম। এটা ভিন্ন জগৎ। এই ভিন্ন জগতের মধ্যে এখন চলছি। দেখা যাক কত দূর যেতে পারি।
নূরুল কবীর: কিন্তু আগস্টের ৮ তারিখে এই জগৎটা যদি শুরু না হতো আপনার জন্য, পেছনের (আগের) যে চার মাস, আপনার মনে হয় তত দিনে জেলে থাকার কথা ছিল।
মুহাম্মদ ইউনূস: হয়তো, আমি তখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম কোন কোন দেশে যাব, যাতে বাংলাদেশে ফিরে যেতে না হয়। আমি এক উপলক্ষে আরেক দেশে ছিলাম। সেখানে বসে ভাবছি, এখন ফিরে যাওয়া ঠিক হবে কি না। কারণ, যাওয়ার সময় উত্তেজনা দেখে গেছি, কারফিউ দেখে গেছি। কারফিউর ভেতর দিয়ে আমাকে যেতে হয়েছে; উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে।
নূরুল কবীর: তার মানে, আপনি কারফিউ ভঙ্গ করেছিলেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি কারফিউ ভঙ্গ করে গেলাম, তা না হলে তো যেতে পারতাম না। ভাগ্যিস, কেউ ধরেনি পথে। অত কড়াকড়ি কারফিউ ছিল না। ওই অবস্থা তো দেখে গেছি এবং এটা ক্রমাগতভাবে দেখেছি পত্রপত্রিকায়, সোশ্যাল মিডিয়াতে ভয়ংকর রকম কাজ হচ্ছে। কাজেই ক্রমাগতভাবে ফিডব্যাকটা পাচ্ছিলাম। তার মধ্যে এই ঘটনা ঘটে গেল, একবারে অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা। কিন্তু এর মধ্যে বুঝি নাই যে এর মধ্যে আমাকে জড়িত হতে হবে। আমাদের এর মধ্যে একটা ভূমিকা পালন করতে হবে। কাজেই চার মাস এভাবেই গেছে আমার।

নূরুল কবীর: আপনি ৮ আগস্টে ক্ষমতা গ্রহণের পরে আপনার বিরুদ্ধে বিগত সরকারের যে আইনগত অভিযোগ ছিল, সেগুলো কোর্ট থেকে একের পর এক উঠে যায়। আপনার পজিশনের ভারে কিংবা প্রভাবে এ ঘটনা ঘটেছে—লোকেদের এ রকম ভাবনার সুযোগ আছে।
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি বলব, এটা আমি সরকারে থাকি বা দেশে থাকি, না থাকি—এগুলো এমনি চলে যেত। এগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। আমাদের যারা প্রতিনিধিত্ব করছেন আদালতে, আমাদের যে উকিলরা আছেন, তাঁরা এটা বোঝাতে পারতেন যে এটার কোনো ভিত্তি নেই। এটার কোনো তথ্য নাই, কিছুই নাই। এগুলো খুবই ঠুনকো জিনিস ছিল। কাজেই এটা আমার জানা-অজানার কোনো বিষয় নয়। যেহেতু এটা বিচারের বিষয়, বিচারেই চলে যেত। আমি থাকলেও যেত, না থাকলেও যেত। ঘটনার চক্রে আমি ছিলাম।
নূরুল কবীর: কিন্তু লোকেরা যে বিচারব্যবস্থার ওপর তৎকালীন এক্সিকিউটিভের, রাষ্ট্রের প্রভাবের কথা বলছিল বা বলাবলি আছে এখনো, তাহলে কি আপনি মনে করেন, উনারা ক্ষমতায় থাকলেও কোর্ট ওইভাবে ব্যবহার করত, মানে ন্যাচারাল পদ্ধতিতে?
মুহাম্মদ ইউনূস: আগের যারা ছিল তারা তো করে নাই। করে নাই বলেই তো আমি আদালতের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলাম। যারা এসেছে, তারা বিচার চাচ্ছে, বিচার প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে।
নূরুল কবীর: সেভাবেই যদি চলত, তাহলে তো আপনি জেলে যাওয়ার একটা...
মুহাম্মদ ইউনূস: অবশ্যই। আমি তো জেলে যাওয়ার পথেই ছিলাম। [আদালতে] আসা-যাওয়ার পথে প্রতিবারই মনে হচ্ছে, এবারই বোধ হয় জেলে যেতে হবে। মাঝে মাঝে প্রস্তুতি নিয়ে গেছি যে হয়তো ফেরা না-ও হতে পারে এবার। আমার সহযোগী যাঁরা আছেন, তাঁরা তাঁদের আত্মীয়স্বজনকে বলে গেছেন তাঁদের জন্য। আমি বলেছি, আমার কিছু করার নাই, যেমন আছে হবে। আমি আমার ফ্যামিলিকেও এ রকম প্রস্তুত করে যাইনি। বলি যে, রেখে দিলে রেখে দেবে, নিয়ে গেলে নিয়ে যাবে। আমি খুব সহজভাবে দেখছিলাম যে, এটা নিয়তির খেলা। এটা যেভাবে হবার হবে। এটাতে প্রস্তুতি নিয়ে আমার কোনো কাজ নাই যে জেলে থাকলে এই করতে হবে, করব। এটা যখন কপালে আছে, এটা আমাকে করে যেতে হবে।
নূরুল কবীর: আপনি এইমাত্র বললেন যে, এটা একটা ভিন্ন জগৎ এবং এইভাবে জড়িয়ে পড়তে হবে; এ রকম একটা রাজনৈতিক দায়িত্ব রাষ্ট্র পরিচালনায়, সেটা আপনি চিন্তা করেননি।
মুহাম্মদ ইউনূস: না।
নূরুল কবীর: আপনি ২০০৭ সালে যখন একটা পার্টি করতে গিয়েছিলেন, সেই সময় তো এটা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবেই চিন্তা করেছিলেন। সেখানে যদি আপনি কনটিনিউ করতেন, আপনাকে তো রাজনৈতিক দায়িত্বই গ্রহণ করতে হতো।
মুহাম্মদ ইউনূস: সেটার কারণ ছিল যে এখানে কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না তখন, সবাই আমার বন্ধুবান্ধব সহযোগী, পরিচিত। সবাই বলছে, আপনি কিছু একটা করেন; পেছনে লেগে রইল...আপনি ছাড়া পারবে না কেউ, এই যা যা বলে আরকি আশপাশের লোকজন। এতে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে শেষে বললাম যে ঠিক আছে আমি করব এইটা। পথে আসতে-যেতে সাংবাদিকেরা ধরল। তখন আমি বলেছি, হ্যাঁ, আমি করব। এই দিয়ে শুরু হলো। তখন বেশির ভাগ সময় আমি আসা-যাওয়া করছিলাম বিভিন্ন জায়গায়, উত্তরবঙ্গে যাচ্ছিলাম, চিটাগাং যাচ্ছিলাম। প্রতিবার এয়ারপোর্টে এই কথাবার্তা হচ্ছিল। আর কোথাও না। তখন একসময় ধরল যে তাহলে কী নাম দেবেন? আমি (বললাম) যে নাম ঠিক করি নাই। নাম ঠিক করলে আপনাদের জানাব। তখন বলল, নাম ঠিক না করে কীভাবে যান? তখন অবশ্য একটা নাম দিলাম, নাগরিক শক্তি। তারপর বুঝলাম যে এটা বেশ এগিয়ে যাচ্ছে জিনিসটা। তারপর সবাইরে বললাম যে এটার [ওপর] মতামত নাও। মতামত নেওয়ার ব্যাপারটি হলো, কোনো রকম এটা থেকে দূরে সরা যায় কি না, তার চেষ্টা। নাম হলো, মতামত হলো। তারপর আমি দেখলাম যে ঢুকে যাচ্ছি এর ভেতরে। যখন দশ সপ্তাহ হলো প্রায়, তখন বললাম যে না ভাই, আমি কোনো রাজনৈতিক দল করছি না, কিচ্ছু না। কাজেই আমার মাথার ভেতরে একদিন এই রাজনীতির মধ্য দিয়ে গিয়ে ক্ষমতায় যাব, এ রকম কোনো পরিকল্পনা ছিল না, এটা দীর্ঘমেয়াদি জিনিস।
নূরুল কবীর: কিন্তু রাজনৈতিক দল তো শেষ পর্যন্ত ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত...
মুহাম্মদ ইউনূস: ছিল। কিন্তু তখন আমি তো আসলে রাজনৈতিক দল করতে চাচ্ছিলাম না। ঠেকা দেবার জন্য এগুলো বলে যাচ্ছিলাম। শেষে মনে করলাম যে, এটা বেশ গভীরে চলে যাচ্ছে। তখন একদম পরিষ্কার বলে দিলাম। তখন সবাই হতবাক হয়ে গেছে। তখন আমার বন্ধুবান্ধব বিরক্ত হয়ে ছেড়ে দিলেন।
নূরুল কবীর: আপনি কি আলাপ করেছিলেন বন্ধুদের সঙ্গে?
মুহাম্মদ ইউনূস: কিচ্ছু করিনি। সে জন্য আরও হতবাক হলো। বলে যে আপনি কিছু বললেন না আমাদের! আমরা আপনার পেছনে ঘুরলাম এত দিন ধরে।
নূরুল কবীর: মনঃক্ষুণ্ন হবার কথা...
মুহাম্মদ ইউনূস: খুবই মনঃক্ষুণ্ন হয়েছে তারা।
নূরুল কবীর: তারা এখন কি আনন্দে আছে?
মুহাম্মদ ইউনূস: তারা কাছে আসে না। বলে আবার কোন দিকে নিয়ে যায় আমাদের।
নূরুল কবীর: ওই নাগরিক শক্তির সঙ্গে ছাত্রদের যে নাগরিক কমিটি, তার কোনো চিন্তা বা ভাবনার সম্পর্ক আছে?
মুহাম্মদ ইউনূস: নাগরিক শব্দটা কমন আছে এটা দেখতেছি। আমার সঙ্গে তো আর কোনো আলোচনা হয় নাই, তারা কোথা থেকে শব্দ পেল না পেল।
নূরুল কবীর: এই শব্দটা যেকোনো লোক ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু আপনার সঙ্গে কোনো পরামর্শ করে নাই তারা?
মুহাম্মদ ইউনূস: পরামর্শ করে নাই।
নূরুল কবীর: আপনি প্রায়ই বলেন, কয়েকবারই বলেছেন, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে যে ছাত্ররা আপনাকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে, তাদের ম্যান্ডেটের কারণে। ছাত্রসমাজ হিসেবে ৫ আগস্ট যে পরিমাণ তারা সমন্বিত ছিল, সংগঠিত এবং একাকার ছিল, এইটা যদি বিভক্ত হয়ে যায় তাদের উদ্দেশ্য সাধিত হয়ে যাওয়ার পর, এই অর্থে যে ইমিডিয়েট উদ্দেশ্য ছিল তৎকালীন একটা স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পতন। তার পতনের পরে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের বিভিন্ন রাজনীতি আছে। তারা যদি বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে কিংবা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থের সংঘাত ঘটে, তখন আপনার ম্যান্ডেটটা প্রশ্নবিদ্ধ হবে না?
মুহাম্মদ ইউনূস: এটা হলো অন্তর্বর্তী সরকার। আমি সেই সরকারের একটা অংশ। ওইটা হলো রাজনীতি। এই সরকারে আমি কত দিন আছি না আছি, সেটা একটা ব্যাপার। ওরা কী করছে, রাজনীতির কী ফল দাঁড়াবে, সেটা ভিন্ন জিনিস। এটা একজন নাগরিক হিসেবে ওরা চিন্তা করতে পারে যে কী হবে না হবে। কিন্তু সরকার হিসেবে আমি আমার দায়িত্ব পালন করছি; যতটুকু আমার সাধ্যে কুলায়।

নূরুল কবীর: আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ওটা সংঘবদ্ধ ছাত্রসমাজের ম্যান্ডেট ছিল। সেই সংঘবদ্ধতাটা যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে...
মুহাম্মদ ইউনূস: দুর্বল হয়ে যাবে।
নূরুল কবীর: দুর্বল হয়ে যাবে?
মুহাম্মদ ইউনূস: অবশ্যই দুর্বল হবে।
নূরুল কবীর: এ রকম সম্ভাবনা আপনি দেখেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: সব সময় সম্ভাবনা তো থাকে। একটা দুর্বল হবে আরেকটা সবল হবে। এই টুকরা এই টুকরার সঙ্গে মিলবে। নানা রকম ঘটনা তো ঘটে।
নূরুল কবীর: অন্যান্য টুকরার কথা বলছেন। ধরুন, আমরা যাঁরা বাইরে থেকে দেখি, ওই অভ্যুত্থানে বিজয়ী ছাত্রনেতৃত্ব আপনাকে আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী সেইটাকে সমর্থন করেছে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যারা পাওয়ার কনটেন্ডার, তারা আপনাকে সহযোগিতা ও সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তাহলে আপনি যখন প্রায়ই বলেন, ছাত্ররা আমাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছে, তখন আপনার কি মনে হয় যে অন্য দুইটা সেক্টর যারা সংগঠিত, নানানভাবে, তারা মনঃক্ষুণ্ন হতে পারে?
মুহাম্মদ ইউনূস: হতে পারে। কিন্তু বাস্তব তো তাই। আমাকে তো ডেকে এনেছে ছাত্ররা। কাজেই আমি সেভাবেই বলেছি, ছাত্ররা আমাকে নিয়োগ করেছে। এখন সবাই মিলে এটা সমর্থন করেছি আমরা। সেটা হলো বৃহত্তর একটা জিনিস। কিন্তু ইমিডিয়েট ছিল যে আমার সঙ্গে কথাটা হচ্ছে ছাত্রদের সঙ্গে। যাদের সঙ্গে আমার কোনো পরিচয় নাই, জীবনে দেখিনি তাদেরকে, তাদের সঙ্গে আমার পরিচয়...সেভাবে আমি কথাটা জানিয়েছি। আমার বাস্তবটা জানিয়েছি। কাউকে মনঃক্ষুণ্ন করার জন্য, কাউকে আঘাত দেওয়ার জন্য এরা দেয় নাই, ওরা দিছে, ও রকম কিছু না।
নূরুল কবীর: না মানে, পাওয়ার ব্লক থাকে তো...
মুহাম্মদ ইউনূস: অবশ্যই।
নূরুল কবীর: এই তিনটাই আপনার জন্য, দেশের মানুষের জন্য আপনার সরকারের অস্তিত্ব চলমান থাকার জন্য, জরুরি আমাদের মনে হয়।
মুহাম্মদ ইউনূস: অবশ্যই, অবশ্যই।

নূরুল কবীর: আপনার এই যে প্রধান উপদেষ্টা পদের নাম, মানে নোমেনক্লেচার অব দি পজিশন, এইটা আপনি অ্যাগ্রি করলেন কেন? আপনি কাকে উপদেশ দেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: ওগুলো আমার মাথায় আসে নাই। নামটা কি উপদেষ্টা হলো না কী হলো। দায়িত্ব নিতে বলেছে, আমি দায়িত্ব নিয়েছি।
নূরুল কবীর: উপদেষ্টা হলো একটা পজিশন। উপদেষ্টা মানেই আপনি কাউকে উপদেশ দেন।
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি এগুলোর ব্যাখ্যার মধ্যে যাই নাই। বলেছে, আপনাকে দায়িত্ব নিতে হবে এই সরকারের। আমি দায়িত্ব নিয়েছি। নামটা কী দিল না দিল, কোথা থেকে আসল...
নূরুল কবীর: একবারও মনে হয়েছে?
মুহাম্মদ ইউনূস: এগুলো বড় মনে হয়নি। কারণ, বলেছে যে এই ধরনের পরিস্থিতিতে এই ধরনের নামই হয়। কাজেই আমার চ্যালেঞ্জ করার কিছু নাই।
নূরুল কবীর: দুইটা ভিন্ন। একজন চিফ থাকে। চিফকে অন্যরা উপদেশ দেয়। তাহলে আপনি উপদেশদাতাদের মধ্যে প্রধান। কিন্তু কাকে?
মুহাম্মদ ইউনূস: এটা চিন্তা করি নাই।
নূরুল কবীর: আপনি যে মন্ত্রিপরিষদ (উপদেষ্টা পরিষদ) তৈরি করলেন ছাত্রদের আহ্বানে, অন্যদের সমর্থনে, সেইখানে কি আপনার মন্ত্রিপরিষদ গঠনে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ছিল?
মুহাম্মদ ইউনূস: পরিপূর্ণ বলব না, এটা তো তাৎক্ষণিকভাবে হয়েছে। এটা এমন কিছু না যে চিন্তাভাবনা করে করা হয়েছে। কাজেই আমাকে যতটুকু বলা হয়েছে, আমি সেটা করেছি। অন্য কারা কী করল, সেটা নিয়ে মাথা ঘামাইনি।
নূরুল কবীর: পরামর্শগুলো কি এসব সেক্টর থেকে এসেছে আপনার কাছে বা কোনো রেকমেন্ডেশন সেটা আর্মি থেকে বা রাজনৈতিক দলের মধ্য থেকে?
মুহাম্মদ ইউনূস: না না না। ওই রকমভাবে কিছু আসে নাই। বলছে যে এরা এরা আছে। আপনি কারে কারে নেবেন। শপথ গ্রহণ করতে হবে আগামীকাল বা সেদিনেই, এ রকম অবস্থা। আমি তাৎক্ষণিকভাবে আমার পরিচিত যা নাম ছিল, সেগুলো দিয়েছি।
নূরুল কবীর: আপনার কাছে এই খবর নিশ্চয়ই আছে বা আপনার এজেন্সিগুলো এই খবর কি দেয় যে আপনার সরকারের যাঁরা সদস্য, তাঁদেরকে অন্তত দুটো ক্যাটাগরিতে জেনারেলি ভাগ করা যায়। এক পক্ষের ব্যাকগ্রাউন্ড হচ্ছে এনজিওস। সেখানে আপনার ব্যাপারে একটা সমালোচনা আছে যে চিটাগংয়ের লোক বেশি। কারণ, আপনার বাড়ি চিটাগং? আরেক পক্ষ হচ্ছে, আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যে, গণতন্ত্রের জন্য লড়াই থেকে অনেকে অনেক দূরে ছিলেন। এই তাঁদের কারণে এখন ঠিক স্টেটক্রাফট পরিচালনার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে কিছু সমস্যা হচ্ছে। এই কথাগুলো কি আপনার কানে আসে?
মুহাম্মদ ইউনূস: সব সময় বলাবলি করে, সবাই বলছে। কাজেই এখানে না আসার কোনো কারণ নাই। এ জন্য বিব্রত হবারও কোনো কারণ নাই। সেভাবেই হয়েছে। নানা জায়গা থেকে আমরা এসেছি। আমারও তো কোনো অভিজ্ঞতা নাই। কাজেই ওদের দোষ দেব কী করে। আমাকে দেশ চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তার তো বিন্দুমাত্র অভিজ্ঞতা নাই। আমি তো কোনো দিন এ ধরনের কাজে ছিলাম না। আমি যদি পারি, ওরাও পারবে, এটাই আমার ভরসা ছিল।
নূরুল কবীর: তাঁদের পারফরম্যান্স নিয়ে আপনার কেমন...
মুহাম্মদ ইউনূস: নিজের পারফরম্যান্স নিয়েই আমার সন্দেহ। ওদের পারফরম্যান্স নিয়ে কী জিজ্ঞেস করব।
নূরুল কবীর: কিন্তু আপনারটা তো অন্যরা বলবে...
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি বলব; আমি দেখছি তো।
নূরুল কবীর: আপনি কি আপনার পারফরম্যান্স নিয়ে সন্তুষ্ট?
মুহাম্মদ ইউনূস: না। বলছি যে আমার তো সেই কোয়ালিটি নাই, করার জন্য যেটুকু দরকার ওটুকু নাই। যদিও সাধ্যমতো করি, যদি লেগে যায় তো ভালো। না হলে আমাদের কপাল খারাপ।

নূরুল কবীর: রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে পরিমাণ সমঝোতা এবং যোগাযোগ থাকা দরকার বলে পত্রপত্রিকা বা অন্যান্য যাদেরকে আমরা বলতে শুনি, সেই পরিমাণ সমঝোতা এবং যোগাযোগ আপনার আছে বলে মনে হয়? আমাদের কাছে মনে হয়, কিছুটা দূরত্ব আছে।
মুহাম্মদ ইউনূস: আমার কাছে মনে হয়, অবিশ্বাস্য রকম সমঝোতা-আত্মীয়তা-ঘনিষ্ঠতা আছে। এটা আমার কাছে অবাক লাগে। কাগজপত্রে দেখি তাঁরা একজনের বিরুদ্ধে একজন কটু কথা বলে। যখন সামনে আসে, সবাই কী আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বলেন! আমার কাছে অবাক লাগে এগুলো! মনে বড় সাহস লাগে। যখনই কথা বলি, ব্যক্তি হিসেবে যখন রাজনৈতিক দলের কারও সঙ্গে কথা বলি, অন্যরা কেউ নাই, একা সে। কিন্তু তার সঙ্গে যখন কথা বলি, কী রকম সমর্থন নিয়ে কথা বলে! আমি অভিভূত হয়ে যাই যে এত সমর্থন থাকা সত্ত্বেও এই দেশ চলছে না কেন! এর মধ্যে মাঝে মাঝে আবার কাগজপত্রে এ রকম কথাবার্তা [প্রকাশ] হয় কেন? এই দু রকম কেন?
নূরুল কবীর: কেন এমন হয় বলে আপনার মনে হয়?
মুহাম্মদ ইউনূস: ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় মনে হয়, এর একটা হলো রাজনৈতিক কথা। কিছু অঙ্গভঙ্গি আছে, যেগুলো রাজনীতিতে চালু হয়ে গেছে। এভাবে কথা না বললে রাজনৈতিক নেতা বলে মনে হয় না। ওভাবে, ওই শব্দে কথা বলতে হয়; ওই সুরে কথা বলতে হয়। টেলিভিশনে গেলে ওই কণ্ঠে কথা বলতে হয়। কিন্তু যেইমাত্র ব্যক্তি হিসেবে কথাবার্তা বলেন, তখন বলার ভঙ্গি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কাজেই সেটার আন্তরিকতা এবং সেটার ঘনিষ্ঠতা আমাকে অভিভূত করে। প্রতিবারই আমাকে অভিভূত করে।
নূরুল কবীর: একটা অন্য কথায় আসি। আপনার সরকার সেপ্টেম্বর মাসে সম্ভবত অক্টোবরে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যাঁরা এই গণতন্ত্রের আন্দোলন এবং অভ্যুত্থানে প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেক পরিবারকে ৩০ লাখ টাকা দেবেন। পরবর্তীকালে জুলাই ফাউন্ডেশন হলো। সেখান থেকেও কথা এসেছিল যে আহতদের এক লাখ টাকা করে এবং পাঁচ লাখ টাকা করে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তরুণ-তরুণী, ধনী-গরিব ও মধ্যবিত্তনির্বিশেষে তাঁদেরকে দেওয়া হবে। আপনি নিশ্চয়ই সচেতন আছেন যে, সেই প্রতিশ্রুতি পালিত হয় নাই এখনো। এটা কেন? ইতিমধ্যে আপনারা হাজার কোটি টাকা করে বিভিন্ন ব্যাংকে দিয়েছেন, রাষ্ট্রীয় এক্সচেকার থেকে লুটপাটের কারণে যে সমস্ত ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের। কিন্তু যারা এই ব্যবস্থাকে বদলাল, তাদেরটা প্রায়োরিটিতে আসল না কেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: প্রায়োরিটিতে ছিল বলেই এত কথা ঘোষণা হলো। প্রায়োরিটিতে ছিল। কিন্তু বাস্তবায়ন করা যায়নি। এগুলো হলো আদেশ কার্যকর করার ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা। কীভাবে টাকা কার কাছ থেকে কোথায় যাবে? কীভাবে বিতরণ হবে? এগুলো নিয়ে। দেওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নাই। যত টাকা লাগে তাদের, এই কমিটমেন্ট আছে এবং তাদের আমরা জীবৎকালে যত সমর্থন দরকার, যত পয়সাকড়ি দরকার, সবকিছুর জন্য কমিটমেন্ট আছে। এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নাই; টাকারও কোনো অভাব নাই।
নূরুল কবীর: কত দিন লাগতে পারে?
মুহাম্মদ ইউনূস: এখন আমার আগাম বলতে ভয় ভয় লাগে। যে কথা বলি, ওটায় পারি না তো শেষ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছাতে।
নূরুল কবীর: আপনার কথায় আন্তরিকতা তো মানুষ বিশ্বাস করে। আপনার অনুমান? অন্তত এটা তো খুবই একটা ইমিডিয়েট এবং প্রায়োরিটির মধ্যে থাকার কথা।
মুহাম্মদ ইউনূস: নিশ্চয়ই।
নূরুল কবীর: এটা কি আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে হচ্ছে?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে। কার হাত দিয়ে কীভাবে যাবে, কার কাছ থেকে কোথায় যাবে, এগুলো নিয়ে গোলমাল হচ্ছে। আর কিছু না।
নূরুল কবীর: তাতে আমলাতন্ত্রের কিছু হচ্ছে না। কিন্তু সরকার, আপনার সরকারের বদনাম হচ্ছে।
মুহাম্মদ ইউনূস: এটা আমাদের সবার সম্মিলিত ব্যর্থতা। আমি ব্যুরোক্রেসিকে (আমলাতন্ত্র) দোষ দেব না। তাদেরও নিয়মকানুন আছে। আমরা হয়তো সেই নিয়মকানুন বুঝি না বলে কানেকশনটা ঠিকমতো করতে পারি নাই।
নূরুল কবীর: আপনার জন্য কোনো টাইমলাইন বলা কি কঠিন?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি আবার মাস, দিন একটা দিয়ে আবার বিব্রত হতে চাচ্ছি না আরকি।
নূরুল কবীর: সাম্প্রতিককালে আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ করছেন, আমরাও লক্ষ করছি যে সরকারের যে গণতান্ত্রিক সংস্কারের কর্মসূচি এবং নির্বাচন—এই দুটিকে পরিপূরক না ভেবে একটা সাংঘর্ষিক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে আলাপ-আলোচনার মধ্যে। এটা কি আপনাকে চিন্তিত করে?
মুহাম্মদ ইউনূস: না, এখনো সাংঘর্ষিক তো যায় নাই। আমরা যেভাবে অগ্রসর হচ্ছিলাম, একটা ফর্মুলা দিয়েছিলাম, একটা প্রক্রিয়া তৈরি করেছিলাম। এটা কাজে লাগে কি না জানি না। প্রক্রিয়াটা হলো যে, কতগুলো কমিশন বসিয়ে দিয়েছি। প্রতিটা সাবজেক্টের ওপরে কমিশন বসিয়ে দিয়েছি। এ রকম ১৫টা কমিশন হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে ৬টা কমিশন প্রথম ঘোষণা করেছিলাম। ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের রিপোর্ট দেওয়ার কথা ছিল। তারা ৯০ দিনে শেষ করতে পারে নাই। বলছে যে এক সপ্তাহ দেরি হতে পারে। সেটার কারণে আমাদের আয়োজন করতেও সময় লেগেছে। ঘোষণা করেছি, তাকে বসার জায়গা দিতে পারি নাই। কোথায় কে কার সঙ্গে পরিচয়, এসব করতে সময় লেগেছে। তারা ৯০ দিন পায় নাই সেই হিসাবে। কাজেই যদি ৭ তারিখে তারা দিয়ে দেয়, তাহলে জানুয়ারি ৭ তারিখের মধ্যে আমরা সেই ৬টা কমিশনের রিপোর্ট পাব। ওইখানে যাবতীয় সংস্কারসংক্রান্ত বিষয় দেওয়া থাকবে। সবার সঙ্গে আলোচনা করে করা হয়েছে। তাহলে সংস্কারের রূপরেখাটা আমরা পেলাম। ইতিমধ্যে মতবিনিময় হয়েছে, তার মধ্যে কোনোটা টিকেছে, কোনোটা টিকে নাই। কমিশন মনে করেছে, যেটা এইগুলোই হলো আমাদের সারমর্ম। এগুলো পেয়ে গেলে তখন নিয়ে আসব বৃহত্তর সংলাপের জন্য। একটা সংলাপ সেদিন হয়েও গেল। যদিও কোনো রিপোর্ট আসেনি তবু প্রাথমিকভাবে একটা সংলাপ হলো। সবাইকে নিয়ে আলাপ করা—কোনটা পছন্দ, কোনটা অপছন্দ, কীভাবে অগ্রসর হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কাজেই বিষয়ভিত্তিক একটা বড় রকমের কনসেনসাস বিল্ডিং প্রসেস, যেটার জন্য আবার আলাদা একটা কমিশন ঘোষণা করলাম সেদিন। সেটা হলো এই ছয় কমিশনের চেয়ারম্যানদের দিয়ে একটা কমিশন। আমি নিজে এটার চেয়ারম্যান হলাম এবং প্রফেসর আলী রীয়াজকে সহসভাপতি করলাম যে আমরা মিলে এটা একটা কনসেনসাস ডেভেলপ করার চেষ্টা করব। এই কনসেনসাসের প্রক্রিয়াটা আমাদের ঠিক করতে হবে। সমাজের কোন কোন গোষ্ঠীর সঙ্গে কীভাবে আদান-প্রদান হবে, তাতে একটা সর্বমতসম্মত একটা কিছু বের করা যায় কি না। সবকিছুতে একমত না হলেও অন্তত কিছু বিষয়ে আশা করি একমত হওয়া যাবে। তখন সেটা হবে আমাদের সংস্কার। যেহেতু একমত হয়ে গেছে, তাহলে এটা বাস্তবায়ন করা সহজ হয়ে যাবে— এইভাবে আমরা চিন্তা করছি।
নূরুল কবীর: এটা আবার কি মধ্য জানুয়ারিতে শুরু হতে পারে?
মুহাম্মদ ইউনূস: আশা করছি। ডেফিনেটলি।
নূরুল কবীর: অর্থাৎ আপনার সরকারের নিজস্ব কোনো সংস্কার কর্মসূচি নাই...
মুহাম্মদ ইউনূস: এই তো এটাই আমাদের।
নূরুল কবীর: কিন্তু এটা তো বাইরে থেকে আসল...
মুহাম্মদ ইউনূস: বাইরে থেকে নিয়েই তো আমাদের হলো। এটা এভাবে একজনের মাথা থেকে তো আসবে না। ১০ জনের মাথা থেকে এসে নির্যাস হয়ে এটা আসল। তারপরও আবার সবার সঙ্গে আমি [কথা] বলছি।
নূরুল কবীর: আপনার ক্যাবিনেটে আপনাদের কি কোনো নিজস্ব চিন্তাভাবনা, কোনো সেক্টরে...?
মুহাম্মদ ইউনূস: আছে। কিন্তু সেটা কমিশনকে গিয়ে বলতে হবে। কারণ, মতামত সংগ্রহ করার দায়িত্ব হলো কমিশনের।
নূরুল কবীর: কিন্তু সরকারের নিজেদের কোনো নিজস্ব...
মুহাম্মদ ইউনূস: নিজস্ব কোনো প্রোগ্রাম নাই। আমরা তো রাজনৈতিক দল না যে আমাদের একটা নিজস্ব থাকবে। আমাদের একেকজনের একেক মত। একেকজন একেক রাজনীতিতে বিশ্বাসী। সেটা নিয়ে তো আমাদের কোনো অসুবিধা নাই।
নূরুল কবীর: এগুলো নিয়ে অনেক ভিন্নমত কি আপনার সরকারের মধ্যে...
মুহাম্মদ ইউনূস: এখনো তো দেখি নাই। সামনে আসলে দেখা যাবে, যখন তর্ক-বিতর্ক শুরু হবে—না, এটা আমরা মানি না।
নূরুল কবীর: আর আপনি এটা অনুমান করছেন...
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি অনুমান করছি। কারণ, সব সময় সবাই যে একমত হবে, সে রকম তো কথা নেই। যেমন ধরেন, সেদিন সংলাপের জন্য আমাকে একটা বক্তৃতা দিতে বলেছিল। সেখানে বললাম যে সমঝোতা কীভাবে হবে। এটা একটা প্রক্রিয়া। বলতে গিয়ে বললাম, ধরুন, আমি মনে করি, ১৭ বছর বয়সে ভোটার হওয়া উচিত এবং আপনি সেটা ভিন্নমত পোষণ করেন। তাহলে আলাপ হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, আপনার মতই টিকে গেল। আমারটা হলো না। আমি মেনে নেব সেটা। লোকে মনে করল যে, ১৭ বছর—এটা সরকার থেকে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমি তো ভাই এ রকম বলি নাই। আমি বললাম যে ধরুন, ১৭ বছর বয়স থেকে (ভোটার) হওয়া ভালো। এটা একটা মত।
নূরুল কবীর: সিদ্ধান্ত নয়...
মুহাম্মদ ইউনূস: এটা সিদ্ধান্ত নয়। উদাহরণ হিসেবে এটা। তাহলে এটার সমঝোতাটা কীভাবে হবে? আপনাদের সবার মত এক রকম, আমার মত এক রকম। শেষ পর্যন্ত সবার মত যেদিকে, আমি সেদিকে যোগ দেব। সেটি হলো কনসেনসাস, সেটি হলো ঐকমত্য। এইভাবে আমরা অগ্রসর হতে চাই। সেটা অনেকে ভুল বোঝে। মনে করে যে সরকার থেকে ১৭ বছর লাগিয়ে দিতে চাচ্ছে। আমি বললাম যে না ভাই এ রকম তো বলি নাই আমি।
নূরুল কবীর: এ বিষয়ে সরকারের সুনির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাবনা নাই...
মুহাম্মদ ইউনূস: না।
নূরুল কবীর: পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে, আমরা লক্ষ করছি, তরুণদের একটি অংশ, যাঁরা নতুন একটা রাজনৈতিক দল করতে যাচ্ছেন, তরুণেরা যাঁরা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে যে তাঁরা সময় নিতে চায় নির্বাচনের জন্য। রাজনৈতিক দলগুলো মনে করছে যে সংস্কার প্রক্রিয়ার পাশাপাশি নির্বাচনপ্রক্রিয়াটা এগিয়ে আনা দরকার। কিন্তু তাঁদের কথাবার্তার মধ্যে সাম্প্রতিককালে পাবলিক ডিবেটের মধ্যে একধরনের তিক্ততাও তৈরি হয়েছে। আপনার নজরে এসেছে?
মুহাম্মদ ইউনূস: খুব ভালো করে নজর এসেছে।
নূরুল কবীর: সেটা একটা দুশ্চিন্তার ব্যাপার নয় কি?
মুহাম্মদ ইউনূস: মোটেই না। ওই যে বললাম বাইরে এক রকম, ভেতরে আরেক রকম।
নূরুল কবীর: আচ্ছা, সে কারণে? তাঁরা শেষ পর্যন্ত একমত হয়ে যাবেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: একমত হয়ে যাবে।
নূরুল কবীর: তরুণেরা মনে করেন, যাঁদের সম্পর্কে যেটা বলা আছে বা আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা হয় যে তাঁরা দলটা করবেন, দলের পরে কনস্টিটিউয়েন্সিগুলো বিল্ডআপ করবে, লোকগুলো তৈরি করবে, এই কারণে তার সময় দরকার। আর ঠিক সংস্কারটা মাথায় আছে। নিশ্চয়ই তাঁরা সংস্কার চান। এই মুহূর্তে ক্ষমতার রাজনীতিতে তাঁরা প্রায়োরিটি দিচ্ছেন, তাঁদের নিজস্ব সংগঠন তৈরি করে নির্বাচন করা। এ কারণেই অন্যরা মনে করে যে, শুধু অন্য একটা গ্রুপকে সময় দেওয়ার জন্য নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। তা আপনি সেটার মধ্যে কোনো সমস্যা দেখছেন না।
মুহাম্মদ ইউনূস: সে জন্য ঘোষণা দিয়ে দিলাম। কতগুলো তারিখ দিয়ে দিলাম, যাতে এই সন্দেহ না থাকে। কারণ, যত কিছু টানতে চান না কেন, আমি তো ঘোষণা দিয়ে দিয়েছি। হয় এখানে হবে, না হয় ওইখানে। দুটো তারিখ দিয়ে দিয়েছি।
নূরুল কবীর: কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো তারপরও বলছে যে আরও সুনির্দিষ্ট করে দিতে হবে।
মুহাম্মদ ইউনূস: এর ভেতরে তারিখ চাচ্ছে; বাড়াতে চাচ্ছে না। এর ভেতরে তারিখ চাচ্ছে, কোন তারিখে করবেন। আমি বললাম যে, ওই প্রসেসটা অগ্রসর হতে আমরা দেখব। এটা তো আপনাকে বাদ দিয়ে দিলাম, এর বাইরে আমরা যাচ্ছি না, এইটা হলে এই পর্যন্ত, ওইটা হলে এই পর্যন্ত, এইভাবে আছে। কাজেই ওটা যে উনারা বুঝতেছে না তা (নয়), বোঝেন। তবু কথাটা বারে বারে বলছে যে, ইন কেইস আমরা এটা অতিক্রম করতে চাই।
নূরুল কবীর: তাহলে আপনাদেরকে চাপের মুখে রাখতে চান।
মুহাম্মদ ইউনূস: এটা আমাদের জন্য ভালো।
নূরুল কবীর: যাদেরকে চাপের মুখে রাখতে চায়, তারা আবার এটা ঠিকই বোঝে...
মুহাম্মদ ইউনূস: বুঝব তো বটেই।
নূরুল কবীর: দে আর প্লেয়িং টু দ্য গ্যালারিজ...
মুহাম্মদ ইউনূস: আমরাও চাই যে চাপের মধ্যে থাকি। কারণ, আমাদের ভেতরেও তো নানা মত থাকতে পারে।
নূরুল কবীর: হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
মুহাম্মদ ইউনূস: সে জন্যই একটা বাঁধ দিয়ে দেওয়া হলো। এই পর্যন্তই, এর ভেতর থেকে আমাদের যা কিছু করতে হবে। এমন না যে কেউ বলে—না, পাঁচ বছর লাগবে। এটা সংস্কার করতে ভালো লাগছে না— এমন যেন বলতে না পারে। যে যা কিছু করতে হয় এর মধ্যে হতে হবে। এই সংস্কারের জন্য যে সমস্ত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, এই দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপেই করতে হবে, আরও ছয় মাস বাড়াতে হবে, বললাম যে না এর ভেতরেই সবকিছু করতে হবে। কাজেই এই যে একটা বাঁধ দেওয়াটা, এটা খুব দরকারি জিনিস আমাদের জন্য। এর মধ্যে আমরা যেন সবকিছু সম্পন্ন করতে পারি।
নূরুল কবীর: আপনার মন্ত্রিপরিষদের তরুণ সদস্যদের কেউ কেউ এসব ব্যাপারে পাবলিক স্টেটমেন্ট করার পর অনেক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। আপনি নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন এবং সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর একটা অবিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হতে পারে—এ রকম কিছু স্টেটমেন্ট এসেছে। আপনি কি পরিষদ সদস্যদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: ক্রমাগত আলাপ হয় এবং সেটার জন্য আমাদের একটা প্রক্রিয়াও আছে, যাতে করে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমরা আলাপ করি।
নূরুল কবীর: পরিষদ সদস্যদের পাবলিক স্টেটমেন্টের জন্য যে ভুল-বোঝাবুঝি...
মুহাম্মদ ইউনূস: সেটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে একটু ভুল-বোঝাবুঝি হয়। সাংবাদিকদের সামনে গিয়ে কী বলতে কী বলে ফেলে, আমাদের তো অভ্যাস নাই। কাজেই একটু গোলমাল হয়ে যায়। পরে আবার বলে যে না আমি ওইভাবে বলি নাই, আমার বলা এভাবে ছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে ঐকমত্যের কোনো অভাব নেই। আমরা যেগুলো বলছি, সেগুলো সম্বন্ধে আমরা একমতেই আছি। এটার মধ্যে কোনো অসুবিধা নেই।
নূরুল কবীর: আপনার সর্বশেষ বক্তৃতায় দুটো পোলাইট অ্যাডমিশন ছিল, আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে ও দ্রব্যমূল্যের ব্যাপারে। সরকার যে পরিমাণ আশা করেছে, সেই পরিমাণ সাফল্য আসে নাই, সেটাও বেশ কয়েক দিন হয়ে গেল। এগুলোর জন্য বিশেষভাবে আপনারা নতুন কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন বা চিন্তা করছেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: সব সময় তো চেষ্টা করি। এটা তো আজকের সমস্যা না। এটা বরাবরেরই সমস্যা।
নূরুল কবীর: কোনো স্পেসিফিক স্টেপস, দ্রব্যমূল্যের জন্য...
মুহাম্মদ ইউনূস: একটা হলো আইনশৃঙ্খলা, আরেকটা হলো বাজারমূল্য (দ্রব্যমূল্য)। বাজারমূল্যের জন্য যত রকমের বুদ্ধি আছে, সবকিছু আমরা করেছি, আমাদের বুদ্ধিতে যত দূর কুলিয়েছে।
নূরুল কবীর: যেমন কী কী...
মুহাম্মদ ইউনূস: যেমন প্রতিদিনের খবর। কোন বাজারে কত টাকা উঠল, কত টাকা কমল, বাজারভিত্তিক। এমন না যে সারা বাংলাদেশের...অমুক বাজারে কত, অমুক বাজারে...তার মধ্যে রকমফের হয়। কেন রকমফের হচ্ছে। একসঙ্গে কেন এক বাজারে পড়ছে, আরেক বাজারে উঠতেছে, সেটা দেখা।
নূরুল কবীর: সেটা তো অ্যানালাইসিস হিসেবে ভালো। কিন্তু অ্যানালাইসিসের যে রেজাল্ট, সেইটার জন্য আপনারা অ্যাকশন কী নিয়েছেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: অ্যাকশনের জন্য হলো যে, যেগুলো মাথায় বুদ্ধি আছে, সেগুলো প্রয়োগ করা। যেমন ট্রাক দিয়ে দেওয়া যে ট্রাকে মাল আসুক। বিআরটিসির কাছে ট্রাক আছে। ট্রাক নিয়ে আসি। ট্রাক দিয়ে মাল আসতে থাকুক। কোথায় কোথায় বাজারে এগুলো উঠছে। সেখানে কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না। এই যে চাঁদাবাজির বিষয় আছে। চাঁদাবাজিটা কমানো যায় কি না ইত্যাদি ইত্যাদি। যা আপনারা দেখতেছেন, একই জিনিস আমাদের কাছে।
নূরুল কবীর: উত্তর বাংলায় যে ফুলকপির দাম দুই টাকা, ঢাকার বাজারে ৪০ টাকা। বরাবরই পুলিশ থেকে শুরু করে মিডিয়া সব সময় বলেছে যে, পথে পথে যে চাঁদাবাজি হয়, তাতে খরচটা বেড়ে যায়। এটা আপনার সরকারও জানে। কিন্তু নতুন করে একদল চলে যাওয়ার পর আরেক দল চাঁদাবাজদের দেখতে পাচ্ছি। তাদের কেউ গ্রেপ্তার হয় নাই এই অপরাধে। তার মানে কী?
মুহাম্মদ ইউনূস: গ্রেপ্তার হইছে কি না আমি জানি না। কিন্তু এটার সমাধান হয়নি।
নূরুল কবীর: কিন্তু গ্রেপ্তার হচ্ছে না। ডিটার করার [থামানোর] জন্য সরকারের পদক্ষেপ থাকলে এটা তো চলবার কোনো কারণ নাই। এগুলো সাধারণত রাজনৈতিক দলের যারা সংগঠিত শক্তি, তারাই করে। আপনারা কি রাজনৈতিক দলগুলোকে অসন্তুষ্ট করতে চান না?
মুহাম্মদ ইউনূস: আইনের ক্ষেত্রে...দল অসন্তুষ্ট হলে, সারা দেশ অসন্তুষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
নূরুল কবীর: আমরা এই বিষয়ে এই ধরনের অপরাধের জন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাউকে গ্রেপ্তার হতে দেখি নাই। এটা আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমরা হয়তো ধরতে পারছি না তাদেরকে এখনো জুতমতো।
নূরুল কবীর: এটা কি বিশ্বাসযোগ্য হবে, প্রকাশ্য রাস্তার মধ্যে বাজারের মধ্যে বাস টার্মিনালে চাঁদাবাজি। সবাই দেখতে পাচ্ছে স্যার। সরকার দেখতে পাচ্ছে না কেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: সরকারের চোখ অত পরিষ্কার না আরকি।
নূরুল কবীর: পত্রপত্রিকার রিপোর্টগুলো আরও বাড়লে কি আরেকটু পরিষ্কার হবে বলে মনে হয়?
মুহাম্মদ ইউনূস: যত বলা যায়, তত ভালো হবে, একটু সতর্ক হবে সবাই।
নূরুল কবীর: আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তোমার কোনো প্রশ্ন আছে, আমি বড় স্যারের সঙ্গে কথা বলব।...উনি বলছেন, যে সিন্ডিকেটগুলো আছে সরকারের জানার কথা। তারা কোথায় স্টক করে, সেগুলো রেইড করলেই পারে। নাগরিক হিসেবে বা আমার স্ত্রীর এই প্রশ্নের আপনার কী উত্তর?
মুহাম্মদ ইউনূস: উত্তর হলো, যে সিন্ডিকেটে এই মাল আনা-নেওয়া করে, আমরা চেষ্টা করছি যে বাইরে যারা আছে, সিন্ডিকেটের বাইরে, তাদেরকে কী কী সুবিধা দিলে তারা এই ব্যবসায় আসত। ব্যবসা যে আমরা দুজনে মিলে ঠিক করলাম যে আমরা মাল আনব, আমরা বিক্রি করব। এটাকে কোন আইনে আপনি...
নূরুল কবীর: তারা যখন আর্টিফিশিয়াল ক্রাইসিস তৈরি করে তখন...
মুহাম্মদ ইউনূস: সেটা যদি মাল গুদামে রেখে দেয়, বাজারে বিক্রি না করে, তখন গিয়ে ধরতে পারেন।
নূরুল কবীর: আপনার সরকার কি এগুলো খেয়াল করেছে, গুদামে...লক্ষ করেছে?
মুহাম্মদ ইউনূস: ওই যে বললাম, সবকিছু খেয়াল করে। ওই যে তথ্য সংগ্রহ করা দামের কথা বললাম, স্টকের কথা বললাম। কে কোথায় এলসি খুলতেছে, সেই রিপোর্ট আমাদের কাছে আসে। কোন মাল খালাস হচ্ছে, কোন দিন কোথায় স্টক হচ্ছে, সেগুলো সংগ্রহ করা এবং তদারক করা যে মাল কি ওই গুদামে রয়ে গেছে, না ছেড়ে দিচ্ছে।
নূরুল কবীর: আপনারা কোনো অসংগতি দেখতে পাচ্ছেন না?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমরা এগুলো করছি বলেই তারা তাড়াতাড়ি এগুলো ছাড়ার চেষ্টা করে, এই গুদাম থেকে আরেক গুদামে নিয়ে যায় হয়তো। বাজারে দিচ্ছে না, চালাকির কাজ।
নূরুল কবীর: এই চালাকিটার জন্য তো কোটি কোটি গরিব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
মুহাম্মদ ইউনূস: বহু বহু গরিব মানুষ, সবাই।
নূরুল কবীর: মানেটা হচ্ছে যে এই ব্যবধান থাকবার কোনো কারণ থাকতে পারে না।
মুহাম্মদ ইউনূস: ঠিক।
নূরুল কবীর: এবং সেইটা প্রধানত সরকারের দেখবার বিষয়।
মুহাম্মদ ইউনূস: ডেফিনেটলি।
নূরুল কবীর: মানুষের অভিযোগ হচ্ছে, সরকার এটা ইন ফ্যাক্ট দেখছে না। আপনি সেটা ফিল করেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি ফিল করি, ডেফিনিটলি।
নূরুল কবীর: এই সরকারের বিরুদ্ধে...রাষ্ট্র তো কিছু প্রয়োজনে, মানুষের প্রয়োজনে কঠোর হয়। আপনাদের বিরুদ্ধে সুশীলতার অভিযোগ আছে, কঠোর হচ্ছেন না।
মুহাম্মদ ইউনূস: আমরা আমাদের সাধ্যমতো কঠোর হয়ে...হয়তো যে কঠোর মানুষের মনে আছে, অত দূর হতে পারছি না। কিন্তু আমরা যে এত দিন যত কঠোর হইনি, অত কঠোর এখন হতে চাচ্ছি।
নূরুল কবীর: আমরা একটু অন্যদিকে যাই। এটা আমরা সবাই জানি, এখানে যে বাংলাদেশে এত বড় একটা রাজনৈতিক রক্তাক্ত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষের মনের মধ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কিছু আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। সেটাকে আমাদের পাশের দেশ ভারত একধরনের সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা হিসেবে চিহ্নিত করছে এবং নানান কথা বলছে। এটা আমরা ঠিক জাতীয়তাবাদী চৈতন্য থেকে নয়, দেশকে ভালোবাসি বলে নয়, তথ্য বিকৃতি হিসেবে নানান জায়গা থেকে এগুলো মিডিয়া, এটা সাধ্যমতো বলছে। কিন্তু সেটার একটা হচ্ছে মিডিয়ার লড়াই। আরেকটা হচ্ছে যে, বস্তুত ফাংশনাল ডিপ্লোমেসিতে আপনার এই কদিনের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী ভারতের সঙ্গে একটা সুষ্ঠু ওয়ার্কিং রিলেশন তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে কি আমরা এগোতে পেরেছি?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমরা বরাবর চেষ্টা করছি ভারতের বিভিন্ন পর্যায়ে সম্পর্ক [গড়ে] তোলা এবং তাদের কাছে প্রকৃত পরিস্থিতি তুলে ধরার। প্রথমবার যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ফোনে আলাপ হলো, উনিই ফোন করেছিলেন, তখন উনি অভিযোগ করলেন যে এখানে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে ইত্যাদি। আমি বললাম যে, এটা অতিরঞ্জিত কতগুলো সংবাদ আপনার কাছে যাচ্ছে। কাজেই এটা আপনি বিশ্বাস করেন না। যদি আপনি প্রকৃত তথ্য জানতে চান, আপনি আপনাদের সাংবাদিকদের পাঠান। এখানে আসুক। তাঁরা দেখুক। দেখে রিপোর্ট করুক। কাজেই আমাদের তথ্যগুলো যদি আস্থায় আনতে না চান, তাহলে এটি প্রকৃত পরিস্থিতি। পরে অনেকে এসেছিলেন। ভারতীয় সাংবাদিক এখানে এসেছেন। তাঁরা রিপোর্ট করেছেন। আমরা চেষ্টা করছি, যাতে করে অতিরঞ্জন থেকে বাঁচা যায়। কিন্তু কিছু সংবাদ আছে, এগুলো কোনো অতিরঞ্জনের বিষয় না। এটা একেবারে গাঁজাখোরি কতগুলো কথা নিয়ে যাচ্ছে। সেটা তারে সামনে দেখায়ে দিলেও হবে না। তো সে রকম তারা চলছে, নানা রকম আজগুবি সংবাদ দিচ্ছে। পরে যখন তাঁদের সঙ্গে আলাপ হয়...এবার তাঁদের পররাষ্ট্রসচিব যখন আসলেন, তখন বললাম যে এ রকম কেন হচ্ছে? তো বলল যে, ওটা আমাদের রাষ্ট্রের সরকারের বিষয় নয়। সরকার এটার মধ্যে জড়িত না। এগুলো মিডিয়ার বিষয়। এগুলো আমাদের আওতার বাইরে। কাজেই সরকার এটা থেকে দূরে চলে গেল। সেটা আমাদের জন্য একটা বড় অ্যাচিভমেন্ট। এত দিন সরকার এটার মধ্যে জড়িত ছিল বলে অনেকটা প্রকাশ করছিল। এখন সর্বপ্রথম (বলা হলো) এটা আমাদের না। আমরাও চেষ্টা করছি, আমাদের তথ্যগুলো তাদের কাছে দেওয়ার জন্য। এখন মনে হয় ইন্টারন্যাশনাল কাভারেজ ইত্যাদির কারণে অত বেশি জুত করতে পারছে না। দিচ্ছে, এখনো খবর দিচ্ছে উল্টাপাল্টা খবর দিচ্ছে। কিন্তু জুত করতে পারছে না। যেহেতু আন্তর্জাতিক সাংবাদিকেরা রিপোর্ট করছেন। আগে বলছিল যে এটা ইসলামিস্ট একটা অভ্যুত্থান হয়েছে, এটা তালেবানদের হাতে চলে গেছে ইত্যাদি। এখন পত্রপত্রিকায় ইন্টারন্যাশনাল কাগজপত্রে যখন আসছে, ওখানেও তারা সুবিধা করতে পারছে না ওরকম বলে। কিছু কাগজে দেখাল, এখানে ক্যাবিনেটের মধ্যে কারা কারা আছে? তাঁদের যে পরিচিতি দিল, কেউ বিশ্বাস করবে না যে এটা ইসলামিস্টদের গোষ্ঠীর। কাজেই ওগুলো ফেলেও দিতে পারছে না। কাজেই যতই তারা করুক না কেন, এই ধরনের যে প্রোপাগান্ডা যেগুলো ছিল, প্রচারণা যেটা ছিল, সেটা আগের থেকে অনেক কমেছে। তাতে সব রকমের প্রচারণা বন্ধ হয়ে গেছে—এটা বলব না। এ[ক]টা প্রচারণা আছেই।
নূরুল কবীর: ভারত রাষ্ট্রের দিক থেকে কোনো হোস্টাইলিটি টের পান আপনি?
মুহাম্মদ ইউনূস: না। আমাদের তো রাষ্ট্রীয় দিক থেকে কোনো হোস্টাইলিটি নাই অন্তত। এই যে বললাম তারা পরিষ্কারভাবে বলল যে এটার সঙ্গে আমাদের [ভারত সরকারের] কিছু না। আমাদের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক। আমাদের [ভারত সরকারের] বক্তব্যের মধ্যে এগুলা নাই। আমরা বলেছি যে আমাদের সম্পর্ক খুব গভীর সম্পর্ক হতে হবে এবং ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হতে হবে। এখন মেঘ জমেছে, মেঘটা কাটিয়ে উঠতে হবে। এটা বলছে, মেঘটা কাটানোর জন্য আমাদের চেষ্টা করতে হবে, উভয় পক্ষে। সেটা আমরা চেষ্টা করি।
নূরুল কবীর: মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হওয়ার জন্য আপনার সরকার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনবার একটা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। অফিশিয়ালি চিঠি দিয়েছেন আপনারা। আপনার ধারণা, একটা রিজনেবল টাইম বলে আর কত দিনের মধ্যে উত্তর আশা করেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমার কোনো ধারণা নেই, এগুলোর কত দিন সময় লাগবে।
নূরুল কবীর: আপনার ফরেন মিনিস্ট্রি নিশ্চয়ই আপনাকে...
মুহাম্মদ ইউনূস: না, এখনো জিজ্ঞেস করিনি, কত দিন লাগবে। আমরা প্রক্রিয়া শুরু করেছি। এখন দেখব, তারা কী জবাব দেয়? তারা জবাব দিচ্ছে কি না, এটা ফলোআপ করব। ডেফিনেটলি একটা গতি নেবে এটা।
নূরুল কবীর: অনুমান, কত দিন পরে আপনারা আবার চিঠি দেবেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: এটা একটা সময়ের ব্যাপার। মাসখানেক বলেন। আমরা ফলোআপ করব। দেখেন কী কী হয়।
নূরুল কবীর: আমরা আরেকটু পশ্চিমে যাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অনেক ভালো সম্পর্ক। এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্যাবিনেটে ইন্ডিয়ান বর্ন সাতজন মন্ত্রী আছেন বলে শোনা যায়। আপনার সঙ্গে পশ্চিমের সম্পর্ক ভালো বলে মানুষ মনে করে। তাঁদের এই সম্পর্ক কি আমাদের দেশে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মধ্যে কোনো ক্ষতির কারণ হবে বলে আপনি আশঙ্কা করেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: হতে পারে; কারণ, এত ঘনিষ্ঠতা থাকলে, ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তি যদি ওইখানে ক্ষমতায় থাকে, তার একটা প্রভাব তো হতেই পারে। এবং ইতিমধ্যে তার প্রভাবের কিছু নমুনাও আমরা দেখেছি। কাজেই আমরা দেখছি, এটা কোন দিকে যায়। ভারতীয় বংশোদ্ভূত হলেই যে সে ভারতের সঙ্গে যুক্ত থাকবে এমনও কোনো কথা নাই। সে হয়তো আমাদের দিকে বেশি মনোযোগ দিতে পারে। আমরা দেখছি, সেগুলো কীভাবে আমরা বার করতে পারি যে কারা কারা আমাদের দিকে সহানুভূতিশীল হবে। কীভাবে আমরা তাদের সহানুভূতিটা পেতে পারি। নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক কীভাবে গড়ে তোলা যায়। পুরোনো সরকারের সঙ্গে আমাদের একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল; ভালো সম্পর্ক ছিল। নতুন সরকারের সঙ্গে আমরা একই রকম ভালো সম্পর্ক করার জন্য চেষ্টা করব।
নূরুল কবীর: ইতিমধ্যেই কি কাজকর্ম এই ব্যাপারে শুরু হয়েছে?
মুহাম্মদ ইউনূস: এটা নিয়ম। আমাদের করতে হয়। যখন নতুন সরকার আসে, তার সঙ্গে একটা যোগাযোগ স্থাপন করা যেগুলো ডিপ্লোমেটিক পর্যায়ে হয়। গিয়ে আলাপ-সালাপ করে। ডিপ্লোমেটিক চ্যানেলের বাইরে হয় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের খাতিরে। ওইখানে যাঁরা হোয়াইট হাউসে আছেন, তাঁদের সঙ্গে যাঁদের যোগাযোগ আছে, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। কীভাবে করতে হবে? নানাভাবে হয়। বিভিন্ন চ্যানেলে যোগাযোগগুলো করতে হয়।
নূরুল কবীর: আপনি ইতিমধ্যে সার্কের একটা ইফেকটিভ রিভাইভালের কথা প্রস্তাব করেছেন বাংলাদেশের তরফ থেকে। তাতে কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে হয়?
মুহাম্মদ ইউনূস: অন্য দেশের যাঁরা আছেন, তাঁরাও চান সার্কের অন্যান্য দেশের মধ্যে...কিন্তু ভারত এটাতে খুব সাড়া দিচ্ছে না। তারা ব্যাখ্যা করে যে আমাদের [ভারত] সমস্যা হলো পাকিস্তানকে নিয়ে। তো আমি যেটা ব্যাখ্যা করি যে একটা দেশের সঙ্গে সমস্যা হলেই পুরো জিনিসটা বিকল হয়ে যাবে, এটা তো ঠিক হবে না। আমরা চেষ্টা করি, ওইটাও সমাধান হোক। অথবা ওই সমস্যাকে পৃথকভাবে দেখে বাকি সব সম্পর্ককে আমরা গড়ে তুলি। এখনো এটার কোনো...
নূরুল কবীর: রেসপন্স?
মুহাম্মদ ইউনূস: রেসপন্স...
নূরুল কবীর: দেখা যায় না?
মুহাম্মদ ইউনূস: না।
নূরুল কবীর: আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, যেটা আমার দেশের মানুষ জানতে চায়। বাংলাদেশ থেকে প্রচুর টাকা আওয়ামী লীগ আমলে পাচার হয়েছে। আপনি তার জন্য একটা কমিশনের মতো করেছেন। এই টাকাপয়সা ফিরে পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতির ইঙ্গিত কি পাচ্ছেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: একসাথে সাক্ষ্যপ্রমাণ পেয়ে গেলে আমরা নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা করতে পারব। এ রকম একটা আইন আছে। আইনের মাধ্যমে এটা করব। সব টাকা হয়তো ফেরত আসবে না। কিছু টাকা ফেরত আসবে যদি আমরা সাক্ষ্যপ্রমাণগুলো পাই। সে প্রচেষ্টাগুলো হচ্ছে।
নূরুল কবীর: সাক্ষ্যপ্রমাণের ব্যাপারে কাজকর্ম চলছে...
মুহাম্মদ ইউনূস: একদম। খুব ডেডিকেটেড একটা আলাদা ইউনিট আছে, তাদের কাজই হলো এগুলো উদ্ধার করা। এটা প্রথম থেকে শুরু হয়েছে। যেহেতু আমরা জানি, যে রকম টাকা গেছে এবং ব্যাংকিং চ্যানেলে গেছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে ধরাটা একটু সহজ হবে হয়তো। যেগুলো স্যুটকেস ভরে নিয়ে গেছে, মুশকিল আছে সেগুলো ধরা। কিন্তু এগুলো তো চ্যানেলের ব্যাপার। যারা এক্সপার্টস আছে, যারা এই কাজগুলো করে, তারাও বলতেছে, হ্যাঁ, এটা সম্ভব। কিন্তু সম্ভব বলে কত দিন আমরা বসে থাকব, এটাই হলো বিষয় আরকি। এটার আইনগত বিষয় আছে। কী সাক্ষ্যপ্রমাণ? তারা কী চায়? কীভাবে এটা আইডেনটিফাই হবে? কার কাছে গেল? আইন ভঙ্গ করে গেল? কিছু কিছু আশা মাঝে মাঝে পাই যে এটা হবে। এখনো চূড়ান্ত কিছু পাইনি।
নূরুল কবীর: মানে, আমাদের আশা করবার কারণ আছে...
মুহাম্মদ ইউনূস: আশা করার কারণ আছে। অবশ্যই কারণ আছে।
নূরুল কবীর: কী রকম সময় লাগবে বলে আপনার ধারণা?
মুহাম্মদ ইউনূস: তাদের কথা তো কিছু বুঝতে পারি না। এটার যে একটা স্ট্যান্ডলাইন আছে, এর মধ্যে গিয়ে এটা শেষ হবে, এটা এখনো বুঝি নাই যে এটা কত দিন লাগতে পারে। আমি একটা আন্দাজে বলে দিতে পারি আপনাকে। কিন্তু আমার মনে হয় না, সেটা বলা ঠিক হবে।
নূরুল কবীর: সামনের নির্বাচনের পরে এই যে এ রকম দায়িত্ব শেষ করবার পরে পরবর্তীকালে কী করার প্ল্যান আপনার?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি তো বরাবরই বলছি যে আমি যে [এখানে, এটা] সাময়িক বিষয় ছিল। আমি এই দায়িত্ব পালন করে আমার পুরোনো আনন্দের জগতে ফিরে যাব।
নূরুল কবীর: এই অভিজ্ঞতার ওপর কোনো বই লেখার পরিকল্পনা আছে আপনার?
মুহাম্মদ ইউনূস: না। এ রকম চিন্তা করিনি। আপনি বইয়ের কথা মনে করিয়ে দিলেন! আমি দিন কাটানো নিয়ে ব্যস্ত আছি।
নূরুল কবীর: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ সময় দেবার জন্য।
মুহাম্মদ ইউনূস: অসংখ্য ধন্যবাদ।
নূরুল কবীর: আপনার চার মাস হলো প্রায়। এই চার মাস আর আগের চার মাসের মধ্যে কোন পর্বটা আপনার ভালো লাগে বা কোনটা খারাপ?
মুহাম্মদ ইউনূস: খারাপ কোনোটাই না। খারাপটা বলব না, কিন্তু ভিন্ন। আগেরটা ছিল আমার নিজস্ব জগৎ। সারা জীবন ধরে যা যা করে এসেছি, সেটার মধ্যেই ছিলাম। নিজস্ব আয়োজন, নিজস্ব চিন্তা। তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। সেটা আমার মতো করে ট্যাকল করেছি। আমি আমার মতো করে চলেছি। সেটা একেবারে আমার নিজস্ব জগৎ। এটা একবারে ভিন্ন জগৎ। এটা আমার নিজস্ব জগৎ না। এই জগতে আমি কোনো দিন ছিলাম না; থাকার কোনো আগ্রহও ছিল না। এটার ডান-বাম আমার জানা নেই। অনেকটা হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে চলার মতো অবস্থা। কিন্তু এটারও একটা চ্যালেঞ্জ আছে।
আমাকে তারা আহ্বান জানিয়েছে। প্রথমে একটু সংকোচ করছিলাম যে এতে যাওয়া ঠিক হবে না, যেহেতু আমি এ জগতের মানুষ নই। কিন্তু তারা আমাকে বোঝাতে পেরেছে যে, এই পরিস্থিতিতে আপনার আসা দরকার। শেষ পর্যন্ত আমি রাজি হয়েছি যে, এইভাবে তোমরা প্রাণ দিয়েছ, তোমরা রক্ত দিয়েছ। আমার জন্য না হয় একটু চ্যালেঞ্জিং হলোই। কাজেই আমি রাজি হলাম। এটা ভিন্ন জগৎ। এই ভিন্ন জগতের মধ্যে এখন চলছি। দেখা যাক কত দূর যেতে পারি।
নূরুল কবীর: কিন্তু আগস্টের ৮ তারিখে এই জগৎটা যদি শুরু না হতো আপনার জন্য, পেছনের (আগের) যে চার মাস, আপনার মনে হয় তত দিনে জেলে থাকার কথা ছিল।
মুহাম্মদ ইউনূস: হয়তো, আমি তখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম কোন কোন দেশে যাব, যাতে বাংলাদেশে ফিরে যেতে না হয়। আমি এক উপলক্ষে আরেক দেশে ছিলাম। সেখানে বসে ভাবছি, এখন ফিরে যাওয়া ঠিক হবে কি না। কারণ, যাওয়ার সময় উত্তেজনা দেখে গেছি, কারফিউ দেখে গেছি। কারফিউর ভেতর দিয়ে আমাকে যেতে হয়েছে; উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে।
নূরুল কবীর: তার মানে, আপনি কারফিউ ভঙ্গ করেছিলেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি কারফিউ ভঙ্গ করে গেলাম, তা না হলে তো যেতে পারতাম না। ভাগ্যিস, কেউ ধরেনি পথে। অত কড়াকড়ি কারফিউ ছিল না। ওই অবস্থা তো দেখে গেছি এবং এটা ক্রমাগতভাবে দেখেছি পত্রপত্রিকায়, সোশ্যাল মিডিয়াতে ভয়ংকর রকম কাজ হচ্ছে। কাজেই ক্রমাগতভাবে ফিডব্যাকটা পাচ্ছিলাম। তার মধ্যে এই ঘটনা ঘটে গেল, একবারে অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা। কিন্তু এর মধ্যে বুঝি নাই যে এর মধ্যে আমাকে জড়িত হতে হবে। আমাদের এর মধ্যে একটা ভূমিকা পালন করতে হবে। কাজেই চার মাস এভাবেই গেছে আমার।

নূরুল কবীর: আপনি ৮ আগস্টে ক্ষমতা গ্রহণের পরে আপনার বিরুদ্ধে বিগত সরকারের যে আইনগত অভিযোগ ছিল, সেগুলো কোর্ট থেকে একের পর এক উঠে যায়। আপনার পজিশনের ভারে কিংবা প্রভাবে এ ঘটনা ঘটেছে—লোকেদের এ রকম ভাবনার সুযোগ আছে।
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি বলব, এটা আমি সরকারে থাকি বা দেশে থাকি, না থাকি—এগুলো এমনি চলে যেত। এগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। আমাদের যারা প্রতিনিধিত্ব করছেন আদালতে, আমাদের যে উকিলরা আছেন, তাঁরা এটা বোঝাতে পারতেন যে এটার কোনো ভিত্তি নেই। এটার কোনো তথ্য নাই, কিছুই নাই। এগুলো খুবই ঠুনকো জিনিস ছিল। কাজেই এটা আমার জানা-অজানার কোনো বিষয় নয়। যেহেতু এটা বিচারের বিষয়, বিচারেই চলে যেত। আমি থাকলেও যেত, না থাকলেও যেত। ঘটনার চক্রে আমি ছিলাম।
নূরুল কবীর: কিন্তু লোকেরা যে বিচারব্যবস্থার ওপর তৎকালীন এক্সিকিউটিভের, রাষ্ট্রের প্রভাবের কথা বলছিল বা বলাবলি আছে এখনো, তাহলে কি আপনি মনে করেন, উনারা ক্ষমতায় থাকলেও কোর্ট ওইভাবে ব্যবহার করত, মানে ন্যাচারাল পদ্ধতিতে?
মুহাম্মদ ইউনূস: আগের যারা ছিল তারা তো করে নাই। করে নাই বলেই তো আমি আদালতের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলাম। যারা এসেছে, তারা বিচার চাচ্ছে, বিচার প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে।
নূরুল কবীর: সেভাবেই যদি চলত, তাহলে তো আপনি জেলে যাওয়ার একটা...
মুহাম্মদ ইউনূস: অবশ্যই। আমি তো জেলে যাওয়ার পথেই ছিলাম। [আদালতে] আসা-যাওয়ার পথে প্রতিবারই মনে হচ্ছে, এবারই বোধ হয় জেলে যেতে হবে। মাঝে মাঝে প্রস্তুতি নিয়ে গেছি যে হয়তো ফেরা না-ও হতে পারে এবার। আমার সহযোগী যাঁরা আছেন, তাঁরা তাঁদের আত্মীয়স্বজনকে বলে গেছেন তাঁদের জন্য। আমি বলেছি, আমার কিছু করার নাই, যেমন আছে হবে। আমি আমার ফ্যামিলিকেও এ রকম প্রস্তুত করে যাইনি। বলি যে, রেখে দিলে রেখে দেবে, নিয়ে গেলে নিয়ে যাবে। আমি খুব সহজভাবে দেখছিলাম যে, এটা নিয়তির খেলা। এটা যেভাবে হবার হবে। এটাতে প্রস্তুতি নিয়ে আমার কোনো কাজ নাই যে জেলে থাকলে এই করতে হবে, করব। এটা যখন কপালে আছে, এটা আমাকে করে যেতে হবে।
নূরুল কবীর: আপনি এইমাত্র বললেন যে, এটা একটা ভিন্ন জগৎ এবং এইভাবে জড়িয়ে পড়তে হবে; এ রকম একটা রাজনৈতিক দায়িত্ব রাষ্ট্র পরিচালনায়, সেটা আপনি চিন্তা করেননি।
মুহাম্মদ ইউনূস: না।
নূরুল কবীর: আপনি ২০০৭ সালে যখন একটা পার্টি করতে গিয়েছিলেন, সেই সময় তো এটা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবেই চিন্তা করেছিলেন। সেখানে যদি আপনি কনটিনিউ করতেন, আপনাকে তো রাজনৈতিক দায়িত্বই গ্রহণ করতে হতো।
মুহাম্মদ ইউনূস: সেটার কারণ ছিল যে এখানে কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না তখন, সবাই আমার বন্ধুবান্ধব সহযোগী, পরিচিত। সবাই বলছে, আপনি কিছু একটা করেন; পেছনে লেগে রইল...আপনি ছাড়া পারবে না কেউ, এই যা যা বলে আরকি আশপাশের লোকজন। এতে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে শেষে বললাম যে ঠিক আছে আমি করব এইটা। পথে আসতে-যেতে সাংবাদিকেরা ধরল। তখন আমি বলেছি, হ্যাঁ, আমি করব। এই দিয়ে শুরু হলো। তখন বেশির ভাগ সময় আমি আসা-যাওয়া করছিলাম বিভিন্ন জায়গায়, উত্তরবঙ্গে যাচ্ছিলাম, চিটাগাং যাচ্ছিলাম। প্রতিবার এয়ারপোর্টে এই কথাবার্তা হচ্ছিল। আর কোথাও না। তখন একসময় ধরল যে তাহলে কী নাম দেবেন? আমি (বললাম) যে নাম ঠিক করি নাই। নাম ঠিক করলে আপনাদের জানাব। তখন বলল, নাম ঠিক না করে কীভাবে যান? তখন অবশ্য একটা নাম দিলাম, নাগরিক শক্তি। তারপর বুঝলাম যে এটা বেশ এগিয়ে যাচ্ছে জিনিসটা। তারপর সবাইরে বললাম যে এটার [ওপর] মতামত নাও। মতামত নেওয়ার ব্যাপারটি হলো, কোনো রকম এটা থেকে দূরে সরা যায় কি না, তার চেষ্টা। নাম হলো, মতামত হলো। তারপর আমি দেখলাম যে ঢুকে যাচ্ছি এর ভেতরে। যখন দশ সপ্তাহ হলো প্রায়, তখন বললাম যে না ভাই, আমি কোনো রাজনৈতিক দল করছি না, কিচ্ছু না। কাজেই আমার মাথার ভেতরে একদিন এই রাজনীতির মধ্য দিয়ে গিয়ে ক্ষমতায় যাব, এ রকম কোনো পরিকল্পনা ছিল না, এটা দীর্ঘমেয়াদি জিনিস।
নূরুল কবীর: কিন্তু রাজনৈতিক দল তো শেষ পর্যন্ত ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত...
মুহাম্মদ ইউনূস: ছিল। কিন্তু তখন আমি তো আসলে রাজনৈতিক দল করতে চাচ্ছিলাম না। ঠেকা দেবার জন্য এগুলো বলে যাচ্ছিলাম। শেষে মনে করলাম যে, এটা বেশ গভীরে চলে যাচ্ছে। তখন একদম পরিষ্কার বলে দিলাম। তখন সবাই হতবাক হয়ে গেছে। তখন আমার বন্ধুবান্ধব বিরক্ত হয়ে ছেড়ে দিলেন।
নূরুল কবীর: আপনি কি আলাপ করেছিলেন বন্ধুদের সঙ্গে?
মুহাম্মদ ইউনূস: কিচ্ছু করিনি। সে জন্য আরও হতবাক হলো। বলে যে আপনি কিছু বললেন না আমাদের! আমরা আপনার পেছনে ঘুরলাম এত দিন ধরে।
নূরুল কবীর: মনঃক্ষুণ্ন হবার কথা...
মুহাম্মদ ইউনূস: খুবই মনঃক্ষুণ্ন হয়েছে তারা।
নূরুল কবীর: তারা এখন কি আনন্দে আছে?
মুহাম্মদ ইউনূস: তারা কাছে আসে না। বলে আবার কোন দিকে নিয়ে যায় আমাদের।
নূরুল কবীর: ওই নাগরিক শক্তির সঙ্গে ছাত্রদের যে নাগরিক কমিটি, তার কোনো চিন্তা বা ভাবনার সম্পর্ক আছে?
মুহাম্মদ ইউনূস: নাগরিক শব্দটা কমন আছে এটা দেখতেছি। আমার সঙ্গে তো আর কোনো আলোচনা হয় নাই, তারা কোথা থেকে শব্দ পেল না পেল।
নূরুল কবীর: এই শব্দটা যেকোনো লোক ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু আপনার সঙ্গে কোনো পরামর্শ করে নাই তারা?
মুহাম্মদ ইউনূস: পরামর্শ করে নাই।
নূরুল কবীর: আপনি প্রায়ই বলেন, কয়েকবারই বলেছেন, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে যে ছাত্ররা আপনাকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে, তাদের ম্যান্ডেটের কারণে। ছাত্রসমাজ হিসেবে ৫ আগস্ট যে পরিমাণ তারা সমন্বিত ছিল, সংগঠিত এবং একাকার ছিল, এইটা যদি বিভক্ত হয়ে যায় তাদের উদ্দেশ্য সাধিত হয়ে যাওয়ার পর, এই অর্থে যে ইমিডিয়েট উদ্দেশ্য ছিল তৎকালীন একটা স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পতন। তার পতনের পরে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের বিভিন্ন রাজনীতি আছে। তারা যদি বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে কিংবা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থের সংঘাত ঘটে, তখন আপনার ম্যান্ডেটটা প্রশ্নবিদ্ধ হবে না?
মুহাম্মদ ইউনূস: এটা হলো অন্তর্বর্তী সরকার। আমি সেই সরকারের একটা অংশ। ওইটা হলো রাজনীতি। এই সরকারে আমি কত দিন আছি না আছি, সেটা একটা ব্যাপার। ওরা কী করছে, রাজনীতির কী ফল দাঁড়াবে, সেটা ভিন্ন জিনিস। এটা একজন নাগরিক হিসেবে ওরা চিন্তা করতে পারে যে কী হবে না হবে। কিন্তু সরকার হিসেবে আমি আমার দায়িত্ব পালন করছি; যতটুকু আমার সাধ্যে কুলায়।

নূরুল কবীর: আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ওটা সংঘবদ্ধ ছাত্রসমাজের ম্যান্ডেট ছিল। সেই সংঘবদ্ধতাটা যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে...
মুহাম্মদ ইউনূস: দুর্বল হয়ে যাবে।
নূরুল কবীর: দুর্বল হয়ে যাবে?
মুহাম্মদ ইউনূস: অবশ্যই দুর্বল হবে।
নূরুল কবীর: এ রকম সম্ভাবনা আপনি দেখেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: সব সময় সম্ভাবনা তো থাকে। একটা দুর্বল হবে আরেকটা সবল হবে। এই টুকরা এই টুকরার সঙ্গে মিলবে। নানা রকম ঘটনা তো ঘটে।
নূরুল কবীর: অন্যান্য টুকরার কথা বলছেন। ধরুন, আমরা যাঁরা বাইরে থেকে দেখি, ওই অভ্যুত্থানে বিজয়ী ছাত্রনেতৃত্ব আপনাকে আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী সেইটাকে সমর্থন করেছে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যারা পাওয়ার কনটেন্ডার, তারা আপনাকে সহযোগিতা ও সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তাহলে আপনি যখন প্রায়ই বলেন, ছাত্ররা আমাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছে, তখন আপনার কি মনে হয় যে অন্য দুইটা সেক্টর যারা সংগঠিত, নানানভাবে, তারা মনঃক্ষুণ্ন হতে পারে?
মুহাম্মদ ইউনূস: হতে পারে। কিন্তু বাস্তব তো তাই। আমাকে তো ডেকে এনেছে ছাত্ররা। কাজেই আমি সেভাবেই বলেছি, ছাত্ররা আমাকে নিয়োগ করেছে। এখন সবাই মিলে এটা সমর্থন করেছি আমরা। সেটা হলো বৃহত্তর একটা জিনিস। কিন্তু ইমিডিয়েট ছিল যে আমার সঙ্গে কথাটা হচ্ছে ছাত্রদের সঙ্গে। যাদের সঙ্গে আমার কোনো পরিচয় নাই, জীবনে দেখিনি তাদেরকে, তাদের সঙ্গে আমার পরিচয়...সেভাবে আমি কথাটা জানিয়েছি। আমার বাস্তবটা জানিয়েছি। কাউকে মনঃক্ষুণ্ন করার জন্য, কাউকে আঘাত দেওয়ার জন্য এরা দেয় নাই, ওরা দিছে, ও রকম কিছু না।
নূরুল কবীর: না মানে, পাওয়ার ব্লক থাকে তো...
মুহাম্মদ ইউনূস: অবশ্যই।
নূরুল কবীর: এই তিনটাই আপনার জন্য, দেশের মানুষের জন্য আপনার সরকারের অস্তিত্ব চলমান থাকার জন্য, জরুরি আমাদের মনে হয়।
মুহাম্মদ ইউনূস: অবশ্যই, অবশ্যই।

নূরুল কবীর: আপনার এই যে প্রধান উপদেষ্টা পদের নাম, মানে নোমেনক্লেচার অব দি পজিশন, এইটা আপনি অ্যাগ্রি করলেন কেন? আপনি কাকে উপদেশ দেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: ওগুলো আমার মাথায় আসে নাই। নামটা কি উপদেষ্টা হলো না কী হলো। দায়িত্ব নিতে বলেছে, আমি দায়িত্ব নিয়েছি।
নূরুল কবীর: উপদেষ্টা হলো একটা পজিশন। উপদেষ্টা মানেই আপনি কাউকে উপদেশ দেন।
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি এগুলোর ব্যাখ্যার মধ্যে যাই নাই। বলেছে, আপনাকে দায়িত্ব নিতে হবে এই সরকারের। আমি দায়িত্ব নিয়েছি। নামটা কী দিল না দিল, কোথা থেকে আসল...
নূরুল কবীর: একবারও মনে হয়েছে?
মুহাম্মদ ইউনূস: এগুলো বড় মনে হয়নি। কারণ, বলেছে যে এই ধরনের পরিস্থিতিতে এই ধরনের নামই হয়। কাজেই আমার চ্যালেঞ্জ করার কিছু নাই।
নূরুল কবীর: দুইটা ভিন্ন। একজন চিফ থাকে। চিফকে অন্যরা উপদেশ দেয়। তাহলে আপনি উপদেশদাতাদের মধ্যে প্রধান। কিন্তু কাকে?
মুহাম্মদ ইউনূস: এটা চিন্তা করি নাই।
নূরুল কবীর: আপনি যে মন্ত্রিপরিষদ (উপদেষ্টা পরিষদ) তৈরি করলেন ছাত্রদের আহ্বানে, অন্যদের সমর্থনে, সেইখানে কি আপনার মন্ত্রিপরিষদ গঠনে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ছিল?
মুহাম্মদ ইউনূস: পরিপূর্ণ বলব না, এটা তো তাৎক্ষণিকভাবে হয়েছে। এটা এমন কিছু না যে চিন্তাভাবনা করে করা হয়েছে। কাজেই আমাকে যতটুকু বলা হয়েছে, আমি সেটা করেছি। অন্য কারা কী করল, সেটা নিয়ে মাথা ঘামাইনি।
নূরুল কবীর: পরামর্শগুলো কি এসব সেক্টর থেকে এসেছে আপনার কাছে বা কোনো রেকমেন্ডেশন সেটা আর্মি থেকে বা রাজনৈতিক দলের মধ্য থেকে?
মুহাম্মদ ইউনূস: না না না। ওই রকমভাবে কিছু আসে নাই। বলছে যে এরা এরা আছে। আপনি কারে কারে নেবেন। শপথ গ্রহণ করতে হবে আগামীকাল বা সেদিনেই, এ রকম অবস্থা। আমি তাৎক্ষণিকভাবে আমার পরিচিত যা নাম ছিল, সেগুলো দিয়েছি।
নূরুল কবীর: আপনার কাছে এই খবর নিশ্চয়ই আছে বা আপনার এজেন্সিগুলো এই খবর কি দেয় যে আপনার সরকারের যাঁরা সদস্য, তাঁদেরকে অন্তত দুটো ক্যাটাগরিতে জেনারেলি ভাগ করা যায়। এক পক্ষের ব্যাকগ্রাউন্ড হচ্ছে এনজিওস। সেখানে আপনার ব্যাপারে একটা সমালোচনা আছে যে চিটাগংয়ের লোক বেশি। কারণ, আপনার বাড়ি চিটাগং? আরেক পক্ষ হচ্ছে, আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যে, গণতন্ত্রের জন্য লড়াই থেকে অনেকে অনেক দূরে ছিলেন। এই তাঁদের কারণে এখন ঠিক স্টেটক্রাফট পরিচালনার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে কিছু সমস্যা হচ্ছে। এই কথাগুলো কি আপনার কানে আসে?
মুহাম্মদ ইউনূস: সব সময় বলাবলি করে, সবাই বলছে। কাজেই এখানে না আসার কোনো কারণ নাই। এ জন্য বিব্রত হবারও কোনো কারণ নাই। সেভাবেই হয়েছে। নানা জায়গা থেকে আমরা এসেছি। আমারও তো কোনো অভিজ্ঞতা নাই। কাজেই ওদের দোষ দেব কী করে। আমাকে দেশ চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তার তো বিন্দুমাত্র অভিজ্ঞতা নাই। আমি তো কোনো দিন এ ধরনের কাজে ছিলাম না। আমি যদি পারি, ওরাও পারবে, এটাই আমার ভরসা ছিল।
নূরুল কবীর: তাঁদের পারফরম্যান্স নিয়ে আপনার কেমন...
মুহাম্মদ ইউনূস: নিজের পারফরম্যান্স নিয়েই আমার সন্দেহ। ওদের পারফরম্যান্স নিয়ে কী জিজ্ঞেস করব।
নূরুল কবীর: কিন্তু আপনারটা তো অন্যরা বলবে...
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি বলব; আমি দেখছি তো।
নূরুল কবীর: আপনি কি আপনার পারফরম্যান্স নিয়ে সন্তুষ্ট?
মুহাম্মদ ইউনূস: না। বলছি যে আমার তো সেই কোয়ালিটি নাই, করার জন্য যেটুকু দরকার ওটুকু নাই। যদিও সাধ্যমতো করি, যদি লেগে যায় তো ভালো। না হলে আমাদের কপাল খারাপ।

নূরুল কবীর: রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে পরিমাণ সমঝোতা এবং যোগাযোগ থাকা দরকার বলে পত্রপত্রিকা বা অন্যান্য যাদেরকে আমরা বলতে শুনি, সেই পরিমাণ সমঝোতা এবং যোগাযোগ আপনার আছে বলে মনে হয়? আমাদের কাছে মনে হয়, কিছুটা দূরত্ব আছে।
মুহাম্মদ ইউনূস: আমার কাছে মনে হয়, অবিশ্বাস্য রকম সমঝোতা-আত্মীয়তা-ঘনিষ্ঠতা আছে। এটা আমার কাছে অবাক লাগে। কাগজপত্রে দেখি তাঁরা একজনের বিরুদ্ধে একজন কটু কথা বলে। যখন সামনে আসে, সবাই কী আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বলেন! আমার কাছে অবাক লাগে এগুলো! মনে বড় সাহস লাগে। যখনই কথা বলি, ব্যক্তি হিসেবে যখন রাজনৈতিক দলের কারও সঙ্গে কথা বলি, অন্যরা কেউ নাই, একা সে। কিন্তু তার সঙ্গে যখন কথা বলি, কী রকম সমর্থন নিয়ে কথা বলে! আমি অভিভূত হয়ে যাই যে এত সমর্থন থাকা সত্ত্বেও এই দেশ চলছে না কেন! এর মধ্যে মাঝে মাঝে আবার কাগজপত্রে এ রকম কথাবার্তা [প্রকাশ] হয় কেন? এই দু রকম কেন?
নূরুল কবীর: কেন এমন হয় বলে আপনার মনে হয়?
মুহাম্মদ ইউনূস: ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় মনে হয়, এর একটা হলো রাজনৈতিক কথা। কিছু অঙ্গভঙ্গি আছে, যেগুলো রাজনীতিতে চালু হয়ে গেছে। এভাবে কথা না বললে রাজনৈতিক নেতা বলে মনে হয় না। ওভাবে, ওই শব্দে কথা বলতে হয়; ওই সুরে কথা বলতে হয়। টেলিভিশনে গেলে ওই কণ্ঠে কথা বলতে হয়। কিন্তু যেইমাত্র ব্যক্তি হিসেবে কথাবার্তা বলেন, তখন বলার ভঙ্গি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কাজেই সেটার আন্তরিকতা এবং সেটার ঘনিষ্ঠতা আমাকে অভিভূত করে। প্রতিবারই আমাকে অভিভূত করে।
নূরুল কবীর: একটা অন্য কথায় আসি। আপনার সরকার সেপ্টেম্বর মাসে সম্ভবত অক্টোবরে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যাঁরা এই গণতন্ত্রের আন্দোলন এবং অভ্যুত্থানে প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেক পরিবারকে ৩০ লাখ টাকা দেবেন। পরবর্তীকালে জুলাই ফাউন্ডেশন হলো। সেখান থেকেও কথা এসেছিল যে আহতদের এক লাখ টাকা করে এবং পাঁচ লাখ টাকা করে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তরুণ-তরুণী, ধনী-গরিব ও মধ্যবিত্তনির্বিশেষে তাঁদেরকে দেওয়া হবে। আপনি নিশ্চয়ই সচেতন আছেন যে, সেই প্রতিশ্রুতি পালিত হয় নাই এখনো। এটা কেন? ইতিমধ্যে আপনারা হাজার কোটি টাকা করে বিভিন্ন ব্যাংকে দিয়েছেন, রাষ্ট্রীয় এক্সচেকার থেকে লুটপাটের কারণে যে সমস্ত ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের। কিন্তু যারা এই ব্যবস্থাকে বদলাল, তাদেরটা প্রায়োরিটিতে আসল না কেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: প্রায়োরিটিতে ছিল বলেই এত কথা ঘোষণা হলো। প্রায়োরিটিতে ছিল। কিন্তু বাস্তবায়ন করা যায়নি। এগুলো হলো আদেশ কার্যকর করার ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা। কীভাবে টাকা কার কাছ থেকে কোথায় যাবে? কীভাবে বিতরণ হবে? এগুলো নিয়ে। দেওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নাই। যত টাকা লাগে তাদের, এই কমিটমেন্ট আছে এবং তাদের আমরা জীবৎকালে যত সমর্থন দরকার, যত পয়সাকড়ি দরকার, সবকিছুর জন্য কমিটমেন্ট আছে। এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নাই; টাকারও কোনো অভাব নাই।
নূরুল কবীর: কত দিন লাগতে পারে?
মুহাম্মদ ইউনূস: এখন আমার আগাম বলতে ভয় ভয় লাগে। যে কথা বলি, ওটায় পারি না তো শেষ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছাতে।
নূরুল কবীর: আপনার কথায় আন্তরিকতা তো মানুষ বিশ্বাস করে। আপনার অনুমান? অন্তত এটা তো খুবই একটা ইমিডিয়েট এবং প্রায়োরিটির মধ্যে থাকার কথা।
মুহাম্মদ ইউনূস: নিশ্চয়ই।
নূরুল কবীর: এটা কি আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে হচ্ছে?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে। কার হাত দিয়ে কীভাবে যাবে, কার কাছ থেকে কোথায় যাবে, এগুলো নিয়ে গোলমাল হচ্ছে। আর কিছু না।
নূরুল কবীর: তাতে আমলাতন্ত্রের কিছু হচ্ছে না। কিন্তু সরকার, আপনার সরকারের বদনাম হচ্ছে।
মুহাম্মদ ইউনূস: এটা আমাদের সবার সম্মিলিত ব্যর্থতা। আমি ব্যুরোক্রেসিকে (আমলাতন্ত্র) দোষ দেব না। তাদেরও নিয়মকানুন আছে। আমরা হয়তো সেই নিয়মকানুন বুঝি না বলে কানেকশনটা ঠিকমতো করতে পারি নাই।
নূরুল কবীর: আপনার জন্য কোনো টাইমলাইন বলা কি কঠিন?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি আবার মাস, দিন একটা দিয়ে আবার বিব্রত হতে চাচ্ছি না আরকি।
নূরুল কবীর: সাম্প্রতিককালে আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ করছেন, আমরাও লক্ষ করছি যে সরকারের যে গণতান্ত্রিক সংস্কারের কর্মসূচি এবং নির্বাচন—এই দুটিকে পরিপূরক না ভেবে একটা সাংঘর্ষিক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে আলাপ-আলোচনার মধ্যে। এটা কি আপনাকে চিন্তিত করে?
মুহাম্মদ ইউনূস: না, এখনো সাংঘর্ষিক তো যায় নাই। আমরা যেভাবে অগ্রসর হচ্ছিলাম, একটা ফর্মুলা দিয়েছিলাম, একটা প্রক্রিয়া তৈরি করেছিলাম। এটা কাজে লাগে কি না জানি না। প্রক্রিয়াটা হলো যে, কতগুলো কমিশন বসিয়ে দিয়েছি। প্রতিটা সাবজেক্টের ওপরে কমিশন বসিয়ে দিয়েছি। এ রকম ১৫টা কমিশন হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে ৬টা কমিশন প্রথম ঘোষণা করেছিলাম। ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের রিপোর্ট দেওয়ার কথা ছিল। তারা ৯০ দিনে শেষ করতে পারে নাই। বলছে যে এক সপ্তাহ দেরি হতে পারে। সেটার কারণে আমাদের আয়োজন করতেও সময় লেগেছে। ঘোষণা করেছি, তাকে বসার জায়গা দিতে পারি নাই। কোথায় কে কার সঙ্গে পরিচয়, এসব করতে সময় লেগেছে। তারা ৯০ দিন পায় নাই সেই হিসাবে। কাজেই যদি ৭ তারিখে তারা দিয়ে দেয়, তাহলে জানুয়ারি ৭ তারিখের মধ্যে আমরা সেই ৬টা কমিশনের রিপোর্ট পাব। ওইখানে যাবতীয় সংস্কারসংক্রান্ত বিষয় দেওয়া থাকবে। সবার সঙ্গে আলোচনা করে করা হয়েছে। তাহলে সংস্কারের রূপরেখাটা আমরা পেলাম। ইতিমধ্যে মতবিনিময় হয়েছে, তার মধ্যে কোনোটা টিকেছে, কোনোটা টিকে নাই। কমিশন মনে করেছে, যেটা এইগুলোই হলো আমাদের সারমর্ম। এগুলো পেয়ে গেলে তখন নিয়ে আসব বৃহত্তর সংলাপের জন্য। একটা সংলাপ সেদিন হয়েও গেল। যদিও কোনো রিপোর্ট আসেনি তবু প্রাথমিকভাবে একটা সংলাপ হলো। সবাইকে নিয়ে আলাপ করা—কোনটা পছন্দ, কোনটা অপছন্দ, কীভাবে অগ্রসর হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কাজেই বিষয়ভিত্তিক একটা বড় রকমের কনসেনসাস বিল্ডিং প্রসেস, যেটার জন্য আবার আলাদা একটা কমিশন ঘোষণা করলাম সেদিন। সেটা হলো এই ছয় কমিশনের চেয়ারম্যানদের দিয়ে একটা কমিশন। আমি নিজে এটার চেয়ারম্যান হলাম এবং প্রফেসর আলী রীয়াজকে সহসভাপতি করলাম যে আমরা মিলে এটা একটা কনসেনসাস ডেভেলপ করার চেষ্টা করব। এই কনসেনসাসের প্রক্রিয়াটা আমাদের ঠিক করতে হবে। সমাজের কোন কোন গোষ্ঠীর সঙ্গে কীভাবে আদান-প্রদান হবে, তাতে একটা সর্বমতসম্মত একটা কিছু বের করা যায় কি না। সবকিছুতে একমত না হলেও অন্তত কিছু বিষয়ে আশা করি একমত হওয়া যাবে। তখন সেটা হবে আমাদের সংস্কার। যেহেতু একমত হয়ে গেছে, তাহলে এটা বাস্তবায়ন করা সহজ হয়ে যাবে— এইভাবে আমরা চিন্তা করছি।
নূরুল কবীর: এটা আবার কি মধ্য জানুয়ারিতে শুরু হতে পারে?
মুহাম্মদ ইউনূস: আশা করছি। ডেফিনেটলি।
নূরুল কবীর: অর্থাৎ আপনার সরকারের নিজস্ব কোনো সংস্কার কর্মসূচি নাই...
মুহাম্মদ ইউনূস: এই তো এটাই আমাদের।
নূরুল কবীর: কিন্তু এটা তো বাইরে থেকে আসল...
মুহাম্মদ ইউনূস: বাইরে থেকে নিয়েই তো আমাদের হলো। এটা এভাবে একজনের মাথা থেকে তো আসবে না। ১০ জনের মাথা থেকে এসে নির্যাস হয়ে এটা আসল। তারপরও আবার সবার সঙ্গে আমি [কথা] বলছি।
নূরুল কবীর: আপনার ক্যাবিনেটে আপনাদের কি কোনো নিজস্ব চিন্তাভাবনা, কোনো সেক্টরে...?
মুহাম্মদ ইউনূস: আছে। কিন্তু সেটা কমিশনকে গিয়ে বলতে হবে। কারণ, মতামত সংগ্রহ করার দায়িত্ব হলো কমিশনের।
নূরুল কবীর: কিন্তু সরকারের নিজেদের কোনো নিজস্ব...
মুহাম্মদ ইউনূস: নিজস্ব কোনো প্রোগ্রাম নাই। আমরা তো রাজনৈতিক দল না যে আমাদের একটা নিজস্ব থাকবে। আমাদের একেকজনের একেক মত। একেকজন একেক রাজনীতিতে বিশ্বাসী। সেটা নিয়ে তো আমাদের কোনো অসুবিধা নাই।
নূরুল কবীর: এগুলো নিয়ে অনেক ভিন্নমত কি আপনার সরকারের মধ্যে...
মুহাম্মদ ইউনূস: এখনো তো দেখি নাই। সামনে আসলে দেখা যাবে, যখন তর্ক-বিতর্ক শুরু হবে—না, এটা আমরা মানি না।
নূরুল কবীর: আর আপনি এটা অনুমান করছেন...
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি অনুমান করছি। কারণ, সব সময় সবাই যে একমত হবে, সে রকম তো কথা নেই। যেমন ধরেন, সেদিন সংলাপের জন্য আমাকে একটা বক্তৃতা দিতে বলেছিল। সেখানে বললাম যে সমঝোতা কীভাবে হবে। এটা একটা প্রক্রিয়া। বলতে গিয়ে বললাম, ধরুন, আমি মনে করি, ১৭ বছর বয়সে ভোটার হওয়া উচিত এবং আপনি সেটা ভিন্নমত পোষণ করেন। তাহলে আলাপ হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, আপনার মতই টিকে গেল। আমারটা হলো না। আমি মেনে নেব সেটা। লোকে মনে করল যে, ১৭ বছর—এটা সরকার থেকে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমি তো ভাই এ রকম বলি নাই। আমি বললাম যে ধরুন, ১৭ বছর বয়স থেকে (ভোটার) হওয়া ভালো। এটা একটা মত।
নূরুল কবীর: সিদ্ধান্ত নয়...
মুহাম্মদ ইউনূস: এটা সিদ্ধান্ত নয়। উদাহরণ হিসেবে এটা। তাহলে এটার সমঝোতাটা কীভাবে হবে? আপনাদের সবার মত এক রকম, আমার মত এক রকম। শেষ পর্যন্ত সবার মত যেদিকে, আমি সেদিকে যোগ দেব। সেটি হলো কনসেনসাস, সেটি হলো ঐকমত্য। এইভাবে আমরা অগ্রসর হতে চাই। সেটা অনেকে ভুল বোঝে। মনে করে যে সরকার থেকে ১৭ বছর লাগিয়ে দিতে চাচ্ছে। আমি বললাম যে না ভাই এ রকম তো বলি নাই আমি।
নূরুল কবীর: এ বিষয়ে সরকারের সুনির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাবনা নাই...
মুহাম্মদ ইউনূস: না।
নূরুল কবীর: পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে, আমরা লক্ষ করছি, তরুণদের একটি অংশ, যাঁরা নতুন একটা রাজনৈতিক দল করতে যাচ্ছেন, তরুণেরা যাঁরা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে যে তাঁরা সময় নিতে চায় নির্বাচনের জন্য। রাজনৈতিক দলগুলো মনে করছে যে সংস্কার প্রক্রিয়ার পাশাপাশি নির্বাচনপ্রক্রিয়াটা এগিয়ে আনা দরকার। কিন্তু তাঁদের কথাবার্তার মধ্যে সাম্প্রতিককালে পাবলিক ডিবেটের মধ্যে একধরনের তিক্ততাও তৈরি হয়েছে। আপনার নজরে এসেছে?
মুহাম্মদ ইউনূস: খুব ভালো করে নজর এসেছে।
নূরুল কবীর: সেটা একটা দুশ্চিন্তার ব্যাপার নয় কি?
মুহাম্মদ ইউনূস: মোটেই না। ওই যে বললাম বাইরে এক রকম, ভেতরে আরেক রকম।
নূরুল কবীর: আচ্ছা, সে কারণে? তাঁরা শেষ পর্যন্ত একমত হয়ে যাবেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: একমত হয়ে যাবে।
নূরুল কবীর: তরুণেরা মনে করেন, যাঁদের সম্পর্কে যেটা বলা আছে বা আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা হয় যে তাঁরা দলটা করবেন, দলের পরে কনস্টিটিউয়েন্সিগুলো বিল্ডআপ করবে, লোকগুলো তৈরি করবে, এই কারণে তার সময় দরকার। আর ঠিক সংস্কারটা মাথায় আছে। নিশ্চয়ই তাঁরা সংস্কার চান। এই মুহূর্তে ক্ষমতার রাজনীতিতে তাঁরা প্রায়োরিটি দিচ্ছেন, তাঁদের নিজস্ব সংগঠন তৈরি করে নির্বাচন করা। এ কারণেই অন্যরা মনে করে যে, শুধু অন্য একটা গ্রুপকে সময় দেওয়ার জন্য নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। তা আপনি সেটার মধ্যে কোনো সমস্যা দেখছেন না।
মুহাম্মদ ইউনূস: সে জন্য ঘোষণা দিয়ে দিলাম। কতগুলো তারিখ দিয়ে দিলাম, যাতে এই সন্দেহ না থাকে। কারণ, যত কিছু টানতে চান না কেন, আমি তো ঘোষণা দিয়ে দিয়েছি। হয় এখানে হবে, না হয় ওইখানে। দুটো তারিখ দিয়ে দিয়েছি।
নূরুল কবীর: কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো তারপরও বলছে যে আরও সুনির্দিষ্ট করে দিতে হবে।
মুহাম্মদ ইউনূস: এর ভেতরে তারিখ চাচ্ছে; বাড়াতে চাচ্ছে না। এর ভেতরে তারিখ চাচ্ছে, কোন তারিখে করবেন। আমি বললাম যে, ওই প্রসেসটা অগ্রসর হতে আমরা দেখব। এটা তো আপনাকে বাদ দিয়ে দিলাম, এর বাইরে আমরা যাচ্ছি না, এইটা হলে এই পর্যন্ত, ওইটা হলে এই পর্যন্ত, এইভাবে আছে। কাজেই ওটা যে উনারা বুঝতেছে না তা (নয়), বোঝেন। তবু কথাটা বারে বারে বলছে যে, ইন কেইস আমরা এটা অতিক্রম করতে চাই।
নূরুল কবীর: তাহলে আপনাদেরকে চাপের মুখে রাখতে চান।
মুহাম্মদ ইউনূস: এটা আমাদের জন্য ভালো।
নূরুল কবীর: যাদেরকে চাপের মুখে রাখতে চায়, তারা আবার এটা ঠিকই বোঝে...
মুহাম্মদ ইউনূস: বুঝব তো বটেই।
নূরুল কবীর: দে আর প্লেয়িং টু দ্য গ্যালারিজ...
মুহাম্মদ ইউনূস: আমরাও চাই যে চাপের মধ্যে থাকি। কারণ, আমাদের ভেতরেও তো নানা মত থাকতে পারে।
নূরুল কবীর: হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
মুহাম্মদ ইউনূস: সে জন্যই একটা বাঁধ দিয়ে দেওয়া হলো। এই পর্যন্তই, এর ভেতর থেকে আমাদের যা কিছু করতে হবে। এমন না যে কেউ বলে—না, পাঁচ বছর লাগবে। এটা সংস্কার করতে ভালো লাগছে না— এমন যেন বলতে না পারে। যে যা কিছু করতে হয় এর মধ্যে হতে হবে। এই সংস্কারের জন্য যে সমস্ত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, এই দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপেই করতে হবে, আরও ছয় মাস বাড়াতে হবে, বললাম যে না এর ভেতরেই সবকিছু করতে হবে। কাজেই এই যে একটা বাঁধ দেওয়াটা, এটা খুব দরকারি জিনিস আমাদের জন্য। এর মধ্যে আমরা যেন সবকিছু সম্পন্ন করতে পারি।
নূরুল কবীর: আপনার মন্ত্রিপরিষদের তরুণ সদস্যদের কেউ কেউ এসব ব্যাপারে পাবলিক স্টেটমেন্ট করার পর অনেক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। আপনি নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন এবং সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর একটা অবিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হতে পারে—এ রকম কিছু স্টেটমেন্ট এসেছে। আপনি কি পরিষদ সদস্যদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: ক্রমাগত আলাপ হয় এবং সেটার জন্য আমাদের একটা প্রক্রিয়াও আছে, যাতে করে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমরা আলাপ করি।
নূরুল কবীর: পরিষদ সদস্যদের পাবলিক স্টেটমেন্টের জন্য যে ভুল-বোঝাবুঝি...
মুহাম্মদ ইউনূস: সেটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে একটু ভুল-বোঝাবুঝি হয়। সাংবাদিকদের সামনে গিয়ে কী বলতে কী বলে ফেলে, আমাদের তো অভ্যাস নাই। কাজেই একটু গোলমাল হয়ে যায়। পরে আবার বলে যে না আমি ওইভাবে বলি নাই, আমার বলা এভাবে ছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে ঐকমত্যের কোনো অভাব নেই। আমরা যেগুলো বলছি, সেগুলো সম্বন্ধে আমরা একমতেই আছি। এটার মধ্যে কোনো অসুবিধা নেই।
নূরুল কবীর: আপনার সর্বশেষ বক্তৃতায় দুটো পোলাইট অ্যাডমিশন ছিল, আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে ও দ্রব্যমূল্যের ব্যাপারে। সরকার যে পরিমাণ আশা করেছে, সেই পরিমাণ সাফল্য আসে নাই, সেটাও বেশ কয়েক দিন হয়ে গেল। এগুলোর জন্য বিশেষভাবে আপনারা নতুন কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন বা চিন্তা করছেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: সব সময় তো চেষ্টা করি। এটা তো আজকের সমস্যা না। এটা বরাবরেরই সমস্যা।
নূরুল কবীর: কোনো স্পেসিফিক স্টেপস, দ্রব্যমূল্যের জন্য...
মুহাম্মদ ইউনূস: একটা হলো আইনশৃঙ্খলা, আরেকটা হলো বাজারমূল্য (দ্রব্যমূল্য)। বাজারমূল্যের জন্য যত রকমের বুদ্ধি আছে, সবকিছু আমরা করেছি, আমাদের বুদ্ধিতে যত দূর কুলিয়েছে।
নূরুল কবীর: যেমন কী কী...
মুহাম্মদ ইউনূস: যেমন প্রতিদিনের খবর। কোন বাজারে কত টাকা উঠল, কত টাকা কমল, বাজারভিত্তিক। এমন না যে সারা বাংলাদেশের...অমুক বাজারে কত, অমুক বাজারে...তার মধ্যে রকমফের হয়। কেন রকমফের হচ্ছে। একসঙ্গে কেন এক বাজারে পড়ছে, আরেক বাজারে উঠতেছে, সেটা দেখা।
নূরুল কবীর: সেটা তো অ্যানালাইসিস হিসেবে ভালো। কিন্তু অ্যানালাইসিসের যে রেজাল্ট, সেইটার জন্য আপনারা অ্যাকশন কী নিয়েছেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: অ্যাকশনের জন্য হলো যে, যেগুলো মাথায় বুদ্ধি আছে, সেগুলো প্রয়োগ করা। যেমন ট্রাক দিয়ে দেওয়া যে ট্রাকে মাল আসুক। বিআরটিসির কাছে ট্রাক আছে। ট্রাক নিয়ে আসি। ট্রাক দিয়ে মাল আসতে থাকুক। কোথায় কোথায় বাজারে এগুলো উঠছে। সেখানে কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না। এই যে চাঁদাবাজির বিষয় আছে। চাঁদাবাজিটা কমানো যায় কি না ইত্যাদি ইত্যাদি। যা আপনারা দেখতেছেন, একই জিনিস আমাদের কাছে।
নূরুল কবীর: উত্তর বাংলায় যে ফুলকপির দাম দুই টাকা, ঢাকার বাজারে ৪০ টাকা। বরাবরই পুলিশ থেকে শুরু করে মিডিয়া সব সময় বলেছে যে, পথে পথে যে চাঁদাবাজি হয়, তাতে খরচটা বেড়ে যায়। এটা আপনার সরকারও জানে। কিন্তু নতুন করে একদল চলে যাওয়ার পর আরেক দল চাঁদাবাজদের দেখতে পাচ্ছি। তাদের কেউ গ্রেপ্তার হয় নাই এই অপরাধে। তার মানে কী?
মুহাম্মদ ইউনূস: গ্রেপ্তার হইছে কি না আমি জানি না। কিন্তু এটার সমাধান হয়নি।
নূরুল কবীর: কিন্তু গ্রেপ্তার হচ্ছে না। ডিটার করার [থামানোর] জন্য সরকারের পদক্ষেপ থাকলে এটা তো চলবার কোনো কারণ নাই। এগুলো সাধারণত রাজনৈতিক দলের যারা সংগঠিত শক্তি, তারাই করে। আপনারা কি রাজনৈতিক দলগুলোকে অসন্তুষ্ট করতে চান না?
মুহাম্মদ ইউনূস: আইনের ক্ষেত্রে...দল অসন্তুষ্ট হলে, সারা দেশ অসন্তুষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
নূরুল কবীর: আমরা এই বিষয়ে এই ধরনের অপরাধের জন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাউকে গ্রেপ্তার হতে দেখি নাই। এটা আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমরা হয়তো ধরতে পারছি না তাদেরকে এখনো জুতমতো।
নূরুল কবীর: এটা কি বিশ্বাসযোগ্য হবে, প্রকাশ্য রাস্তার মধ্যে বাজারের মধ্যে বাস টার্মিনালে চাঁদাবাজি। সবাই দেখতে পাচ্ছে স্যার। সরকার দেখতে পাচ্ছে না কেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: সরকারের চোখ অত পরিষ্কার না আরকি।
নূরুল কবীর: পত্রপত্রিকার রিপোর্টগুলো আরও বাড়লে কি আরেকটু পরিষ্কার হবে বলে মনে হয়?
মুহাম্মদ ইউনূস: যত বলা যায়, তত ভালো হবে, একটু সতর্ক হবে সবাই।
নূরুল কবীর: আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তোমার কোনো প্রশ্ন আছে, আমি বড় স্যারের সঙ্গে কথা বলব।...উনি বলছেন, যে সিন্ডিকেটগুলো আছে সরকারের জানার কথা। তারা কোথায় স্টক করে, সেগুলো রেইড করলেই পারে। নাগরিক হিসেবে বা আমার স্ত্রীর এই প্রশ্নের আপনার কী উত্তর?
মুহাম্মদ ইউনূস: উত্তর হলো, যে সিন্ডিকেটে এই মাল আনা-নেওয়া করে, আমরা চেষ্টা করছি যে বাইরে যারা আছে, সিন্ডিকেটের বাইরে, তাদেরকে কী কী সুবিধা দিলে তারা এই ব্যবসায় আসত। ব্যবসা যে আমরা দুজনে মিলে ঠিক করলাম যে আমরা মাল আনব, আমরা বিক্রি করব। এটাকে কোন আইনে আপনি...
নূরুল কবীর: তারা যখন আর্টিফিশিয়াল ক্রাইসিস তৈরি করে তখন...
মুহাম্মদ ইউনূস: সেটা যদি মাল গুদামে রেখে দেয়, বাজারে বিক্রি না করে, তখন গিয়ে ধরতে পারেন।
নূরুল কবীর: আপনার সরকার কি এগুলো খেয়াল করেছে, গুদামে...লক্ষ করেছে?
মুহাম্মদ ইউনূস: ওই যে বললাম, সবকিছু খেয়াল করে। ওই যে তথ্য সংগ্রহ করা দামের কথা বললাম, স্টকের কথা বললাম। কে কোথায় এলসি খুলতেছে, সেই রিপোর্ট আমাদের কাছে আসে। কোন মাল খালাস হচ্ছে, কোন দিন কোথায় স্টক হচ্ছে, সেগুলো সংগ্রহ করা এবং তদারক করা যে মাল কি ওই গুদামে রয়ে গেছে, না ছেড়ে দিচ্ছে।
নূরুল কবীর: আপনারা কোনো অসংগতি দেখতে পাচ্ছেন না?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমরা এগুলো করছি বলেই তারা তাড়াতাড়ি এগুলো ছাড়ার চেষ্টা করে, এই গুদাম থেকে আরেক গুদামে নিয়ে যায় হয়তো। বাজারে দিচ্ছে না, চালাকির কাজ।
নূরুল কবীর: এই চালাকিটার জন্য তো কোটি কোটি গরিব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
মুহাম্মদ ইউনূস: বহু বহু গরিব মানুষ, সবাই।
নূরুল কবীর: মানেটা হচ্ছে যে এই ব্যবধান থাকবার কোনো কারণ থাকতে পারে না।
মুহাম্মদ ইউনূস: ঠিক।
নূরুল কবীর: এবং সেইটা প্রধানত সরকারের দেখবার বিষয়।
মুহাম্মদ ইউনূস: ডেফিনেটলি।
নূরুল কবীর: মানুষের অভিযোগ হচ্ছে, সরকার এটা ইন ফ্যাক্ট দেখছে না। আপনি সেটা ফিল করেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি ফিল করি, ডেফিনিটলি।
নূরুল কবীর: এই সরকারের বিরুদ্ধে...রাষ্ট্র তো কিছু প্রয়োজনে, মানুষের প্রয়োজনে কঠোর হয়। আপনাদের বিরুদ্ধে সুশীলতার অভিযোগ আছে, কঠোর হচ্ছেন না।
মুহাম্মদ ইউনূস: আমরা আমাদের সাধ্যমতো কঠোর হয়ে...হয়তো যে কঠোর মানুষের মনে আছে, অত দূর হতে পারছি না। কিন্তু আমরা যে এত দিন যত কঠোর হইনি, অত কঠোর এখন হতে চাচ্ছি।
নূরুল কবীর: আমরা একটু অন্যদিকে যাই। এটা আমরা সবাই জানি, এখানে যে বাংলাদেশে এত বড় একটা রাজনৈতিক রক্তাক্ত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষের মনের মধ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কিছু আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। সেটাকে আমাদের পাশের দেশ ভারত একধরনের সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা হিসেবে চিহ্নিত করছে এবং নানান কথা বলছে। এটা আমরা ঠিক জাতীয়তাবাদী চৈতন্য থেকে নয়, দেশকে ভালোবাসি বলে নয়, তথ্য বিকৃতি হিসেবে নানান জায়গা থেকে এগুলো মিডিয়া, এটা সাধ্যমতো বলছে। কিন্তু সেটার একটা হচ্ছে মিডিয়ার লড়াই। আরেকটা হচ্ছে যে, বস্তুত ফাংশনাল ডিপ্লোমেসিতে আপনার এই কদিনের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী ভারতের সঙ্গে একটা সুষ্ঠু ওয়ার্কিং রিলেশন তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে কি আমরা এগোতে পেরেছি?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমরা বরাবর চেষ্টা করছি ভারতের বিভিন্ন পর্যায়ে সম্পর্ক [গড়ে] তোলা এবং তাদের কাছে প্রকৃত পরিস্থিতি তুলে ধরার। প্রথমবার যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ফোনে আলাপ হলো, উনিই ফোন করেছিলেন, তখন উনি অভিযোগ করলেন যে এখানে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে ইত্যাদি। আমি বললাম যে, এটা অতিরঞ্জিত কতগুলো সংবাদ আপনার কাছে যাচ্ছে। কাজেই এটা আপনি বিশ্বাস করেন না। যদি আপনি প্রকৃত তথ্য জানতে চান, আপনি আপনাদের সাংবাদিকদের পাঠান। এখানে আসুক। তাঁরা দেখুক। দেখে রিপোর্ট করুক। কাজেই আমাদের তথ্যগুলো যদি আস্থায় আনতে না চান, তাহলে এটি প্রকৃত পরিস্থিতি। পরে অনেকে এসেছিলেন। ভারতীয় সাংবাদিক এখানে এসেছেন। তাঁরা রিপোর্ট করেছেন। আমরা চেষ্টা করছি, যাতে করে অতিরঞ্জন থেকে বাঁচা যায়। কিন্তু কিছু সংবাদ আছে, এগুলো কোনো অতিরঞ্জনের বিষয় না। এটা একেবারে গাঁজাখোরি কতগুলো কথা নিয়ে যাচ্ছে। সেটা তারে সামনে দেখায়ে দিলেও হবে না। তো সে রকম তারা চলছে, নানা রকম আজগুবি সংবাদ দিচ্ছে। পরে যখন তাঁদের সঙ্গে আলাপ হয়...এবার তাঁদের পররাষ্ট্রসচিব যখন আসলেন, তখন বললাম যে এ রকম কেন হচ্ছে? তো বলল যে, ওটা আমাদের রাষ্ট্রের সরকারের বিষয় নয়। সরকার এটার মধ্যে জড়িত না। এগুলো মিডিয়ার বিষয়। এগুলো আমাদের আওতার বাইরে। কাজেই সরকার এটা থেকে দূরে চলে গেল। সেটা আমাদের জন্য একটা বড় অ্যাচিভমেন্ট। এত দিন সরকার এটার মধ্যে জড়িত ছিল বলে অনেকটা প্রকাশ করছিল। এখন সর্বপ্রথম (বলা হলো) এটা আমাদের না। আমরাও চেষ্টা করছি, আমাদের তথ্যগুলো তাদের কাছে দেওয়ার জন্য। এখন মনে হয় ইন্টারন্যাশনাল কাভারেজ ইত্যাদির কারণে অত বেশি জুত করতে পারছে না। দিচ্ছে, এখনো খবর দিচ্ছে উল্টাপাল্টা খবর দিচ্ছে। কিন্তু জুত করতে পারছে না। যেহেতু আন্তর্জাতিক সাংবাদিকেরা রিপোর্ট করছেন। আগে বলছিল যে এটা ইসলামিস্ট একটা অভ্যুত্থান হয়েছে, এটা তালেবানদের হাতে চলে গেছে ইত্যাদি। এখন পত্রপত্রিকায় ইন্টারন্যাশনাল কাগজপত্রে যখন আসছে, ওখানেও তারা সুবিধা করতে পারছে না ওরকম বলে। কিছু কাগজে দেখাল, এখানে ক্যাবিনেটের মধ্যে কারা কারা আছে? তাঁদের যে পরিচিতি দিল, কেউ বিশ্বাস করবে না যে এটা ইসলামিস্টদের গোষ্ঠীর। কাজেই ওগুলো ফেলেও দিতে পারছে না। কাজেই যতই তারা করুক না কেন, এই ধরনের যে প্রোপাগান্ডা যেগুলো ছিল, প্রচারণা যেটা ছিল, সেটা আগের থেকে অনেক কমেছে। তাতে সব রকমের প্রচারণা বন্ধ হয়ে গেছে—এটা বলব না। এ[ক]টা প্রচারণা আছেই।
নূরুল কবীর: ভারত রাষ্ট্রের দিক থেকে কোনো হোস্টাইলিটি টের পান আপনি?
মুহাম্মদ ইউনূস: না। আমাদের তো রাষ্ট্রীয় দিক থেকে কোনো হোস্টাইলিটি নাই অন্তত। এই যে বললাম তারা পরিষ্কারভাবে বলল যে এটার সঙ্গে আমাদের [ভারত সরকারের] কিছু না। আমাদের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক। আমাদের [ভারত সরকারের] বক্তব্যের মধ্যে এগুলা নাই। আমরা বলেছি যে আমাদের সম্পর্ক খুব গভীর সম্পর্ক হতে হবে এবং ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হতে হবে। এখন মেঘ জমেছে, মেঘটা কাটিয়ে উঠতে হবে। এটা বলছে, মেঘটা কাটানোর জন্য আমাদের চেষ্টা করতে হবে, উভয় পক্ষে। সেটা আমরা চেষ্টা করি।
নূরুল কবীর: মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হওয়ার জন্য আপনার সরকার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনবার একটা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। অফিশিয়ালি চিঠি দিয়েছেন আপনারা। আপনার ধারণা, একটা রিজনেবল টাইম বলে আর কত দিনের মধ্যে উত্তর আশা করেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমার কোনো ধারণা নেই, এগুলোর কত দিন সময় লাগবে।
নূরুল কবীর: আপনার ফরেন মিনিস্ট্রি নিশ্চয়ই আপনাকে...
মুহাম্মদ ইউনূস: না, এখনো জিজ্ঞেস করিনি, কত দিন লাগবে। আমরা প্রক্রিয়া শুরু করেছি। এখন দেখব, তারা কী জবাব দেয়? তারা জবাব দিচ্ছে কি না, এটা ফলোআপ করব। ডেফিনেটলি একটা গতি নেবে এটা।
নূরুল কবীর: অনুমান, কত দিন পরে আপনারা আবার চিঠি দেবেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: এটা একটা সময়ের ব্যাপার। মাসখানেক বলেন। আমরা ফলোআপ করব। দেখেন কী কী হয়।
নূরুল কবীর: আমরা আরেকটু পশ্চিমে যাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অনেক ভালো সম্পর্ক। এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্যাবিনেটে ইন্ডিয়ান বর্ন সাতজন মন্ত্রী আছেন বলে শোনা যায়। আপনার সঙ্গে পশ্চিমের সম্পর্ক ভালো বলে মানুষ মনে করে। তাঁদের এই সম্পর্ক কি আমাদের দেশে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মধ্যে কোনো ক্ষতির কারণ হবে বলে আপনি আশঙ্কা করেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: হতে পারে; কারণ, এত ঘনিষ্ঠতা থাকলে, ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তি যদি ওইখানে ক্ষমতায় থাকে, তার একটা প্রভাব তো হতেই পারে। এবং ইতিমধ্যে তার প্রভাবের কিছু নমুনাও আমরা দেখেছি। কাজেই আমরা দেখছি, এটা কোন দিকে যায়। ভারতীয় বংশোদ্ভূত হলেই যে সে ভারতের সঙ্গে যুক্ত থাকবে এমনও কোনো কথা নাই। সে হয়তো আমাদের দিকে বেশি মনোযোগ দিতে পারে। আমরা দেখছি, সেগুলো কীভাবে আমরা বার করতে পারি যে কারা কারা আমাদের দিকে সহানুভূতিশীল হবে। কীভাবে আমরা তাদের সহানুভূতিটা পেতে পারি। নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক কীভাবে গড়ে তোলা যায়। পুরোনো সরকারের সঙ্গে আমাদের একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল; ভালো সম্পর্ক ছিল। নতুন সরকারের সঙ্গে আমরা একই রকম ভালো সম্পর্ক করার জন্য চেষ্টা করব।
নূরুল কবীর: ইতিমধ্যেই কি কাজকর্ম এই ব্যাপারে শুরু হয়েছে?
মুহাম্মদ ইউনূস: এটা নিয়ম। আমাদের করতে হয়। যখন নতুন সরকার আসে, তার সঙ্গে একটা যোগাযোগ স্থাপন করা যেগুলো ডিপ্লোমেটিক পর্যায়ে হয়। গিয়ে আলাপ-সালাপ করে। ডিপ্লোমেটিক চ্যানেলের বাইরে হয় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের খাতিরে। ওইখানে যাঁরা হোয়াইট হাউসে আছেন, তাঁদের সঙ্গে যাঁদের যোগাযোগ আছে, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। কীভাবে করতে হবে? নানাভাবে হয়। বিভিন্ন চ্যানেলে যোগাযোগগুলো করতে হয়।
নূরুল কবীর: আপনি ইতিমধ্যে সার্কের একটা ইফেকটিভ রিভাইভালের কথা প্রস্তাব করেছেন বাংলাদেশের তরফ থেকে। তাতে কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে হয়?
মুহাম্মদ ইউনূস: অন্য দেশের যাঁরা আছেন, তাঁরাও চান সার্কের অন্যান্য দেশের মধ্যে...কিন্তু ভারত এটাতে খুব সাড়া দিচ্ছে না। তারা ব্যাখ্যা করে যে আমাদের [ভারত] সমস্যা হলো পাকিস্তানকে নিয়ে। তো আমি যেটা ব্যাখ্যা করি যে একটা দেশের সঙ্গে সমস্যা হলেই পুরো জিনিসটা বিকল হয়ে যাবে, এটা তো ঠিক হবে না। আমরা চেষ্টা করি, ওইটাও সমাধান হোক। অথবা ওই সমস্যাকে পৃথকভাবে দেখে বাকি সব সম্পর্ককে আমরা গড়ে তুলি। এখনো এটার কোনো...
নূরুল কবীর: রেসপন্স?
মুহাম্মদ ইউনূস: রেসপন্স...
নূরুল কবীর: দেখা যায় না?
মুহাম্মদ ইউনূস: না।
নূরুল কবীর: আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, যেটা আমার দেশের মানুষ জানতে চায়। বাংলাদেশ থেকে প্রচুর টাকা আওয়ামী লীগ আমলে পাচার হয়েছে। আপনি তার জন্য একটা কমিশনের মতো করেছেন। এই টাকাপয়সা ফিরে পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতির ইঙ্গিত কি পাচ্ছেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: একসাথে সাক্ষ্যপ্রমাণ পেয়ে গেলে আমরা নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা করতে পারব। এ রকম একটা আইন আছে। আইনের মাধ্যমে এটা করব। সব টাকা হয়তো ফেরত আসবে না। কিছু টাকা ফেরত আসবে যদি আমরা সাক্ষ্যপ্রমাণগুলো পাই। সে প্রচেষ্টাগুলো হচ্ছে।
নূরুল কবীর: সাক্ষ্যপ্রমাণের ব্যাপারে কাজকর্ম চলছে...
মুহাম্মদ ইউনূস: একদম। খুব ডেডিকেটেড একটা আলাদা ইউনিট আছে, তাদের কাজই হলো এগুলো উদ্ধার করা। এটা প্রথম থেকে শুরু হয়েছে। যেহেতু আমরা জানি, যে রকম টাকা গেছে এবং ব্যাংকিং চ্যানেলে গেছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে ধরাটা একটু সহজ হবে হয়তো। যেগুলো স্যুটকেস ভরে নিয়ে গেছে, মুশকিল আছে সেগুলো ধরা। কিন্তু এগুলো তো চ্যানেলের ব্যাপার। যারা এক্সপার্টস আছে, যারা এই কাজগুলো করে, তারাও বলতেছে, হ্যাঁ, এটা সম্ভব। কিন্তু সম্ভব বলে কত দিন আমরা বসে থাকব, এটাই হলো বিষয় আরকি। এটার আইনগত বিষয় আছে। কী সাক্ষ্যপ্রমাণ? তারা কী চায়? কীভাবে এটা আইডেনটিফাই হবে? কার কাছে গেল? আইন ভঙ্গ করে গেল? কিছু কিছু আশা মাঝে মাঝে পাই যে এটা হবে। এখনো চূড়ান্ত কিছু পাইনি।
নূরুল কবীর: মানে, আমাদের আশা করবার কারণ আছে...
মুহাম্মদ ইউনূস: আশা করার কারণ আছে। অবশ্যই কারণ আছে।
নূরুল কবীর: কী রকম সময় লাগবে বলে আপনার ধারণা?
মুহাম্মদ ইউনূস: তাদের কথা তো কিছু বুঝতে পারি না। এটার যে একটা স্ট্যান্ডলাইন আছে, এর মধ্যে গিয়ে এটা শেষ হবে, এটা এখনো বুঝি নাই যে এটা কত দিন লাগতে পারে। আমি একটা আন্দাজে বলে দিতে পারি আপনাকে। কিন্তু আমার মনে হয় না, সেটা বলা ঠিক হবে।
নূরুল কবীর: সামনের নির্বাচনের পরে এই যে এ রকম দায়িত্ব শেষ করবার পরে পরবর্তীকালে কী করার প্ল্যান আপনার?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি তো বরাবরই বলছি যে আমি যে [এখানে, এটা] সাময়িক বিষয় ছিল। আমি এই দায়িত্ব পালন করে আমার পুরোনো আনন্দের জগতে ফিরে যাব।
নূরুল কবীর: এই অভিজ্ঞতার ওপর কোনো বই লেখার পরিকল্পনা আছে আপনার?
মুহাম্মদ ইউনূস: না। এ রকম চিন্তা করিনি। আপনি বইয়ের কথা মনে করিয়ে দিলেন! আমি দিন কাটানো নিয়ে ব্যস্ত আছি।
নূরুল কবীর: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ সময় দেবার জন্য।
মুহাম্মদ ইউনূস: অসংখ্য ধন্যবাদ।

ইসলামী ব্যাংক শুরু থেকে এই কার্যক্রমে যুক্ত। আমরা ১৮ বছরের কম বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্য ‘মুদারাবা স্কুল স্টুডেন্ট সেভিংস অ্যাকাউন্ট’ চালু করেছি, যেখানে অভিভাবকেরা সন্তানদের পক্ষ থেকে হিসাব পরিচালনা করেন। মূল লক্ষ্য হলো শিশু-কিশোরদের সুদমুক্ত অর্থনীতিতে যুক্ত করা এবং ভবিষ্যতে দায়িত্বশীল...
৮ দিন আগে
ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসি (ইবিএল) নিয়মিতভাবে স্কুলে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন, সেমিনার, ওয়ার্কশপ এবং বিশেষ অফারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সচেতন করছে এবং তাদের হিসাব খোলায় উৎসাহ দিচ্ছে। আমরা শিক্ষার্থীদের ব্যাংকিং জ্ঞান ও সঞ্চয়ের গুরুত্ব বোঝাতে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করি।
৮ দিন আগে
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিবিসি বাংলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে সংস্কার, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এবং রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন। প্রায় দুই দশক পর প্রথম কোনো গণমাধ্যম হিসেবে বিবিসি বাংলার মুখোমুখি হয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তিনি।
২৩ দিন আগে
দীর্ঘ প্রায় দুই দশক পর কোনো গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকারে আগামী নির্বাচনে দলের কৌশল, আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও তাদের নেতা-কর্মীদের বিচার...
২৪ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

আজকের পত্রিকা: কবে থেকে স্কুল ব্যাংকিংয়ে যুক্ত ইসলামী ব্যাংক?
ওমর ফারুক খাঁন: ইসলামী ব্যাংক শুরু থেকে এই কার্যক্রমে যুক্ত। আমরা ১৮ বছরের কম বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্য ‘মুদারাবা স্কুল স্টুডেন্ট সেভিংস অ্যাকাউন্ট’ চালু করেছি, যেখানে অভিভাবকেরা সন্তানদের পক্ষ থেকে হিসাব পরিচালনা করেন। মূল লক্ষ্য হলো শিশু-কিশোরদের সুদমুক্ত অর্থনীতিতে যুক্ত করা এবং ভবিষ্যতে দায়িত্বশীল ব্যাংক গ্রাহক হিসেবে গড়ে তোলা।
আজকের পত্রিকা: তাহলে এ খাতে ইসলামী ব্যাংকের অবস্থান কীভাবে দেখছেন?
ওমর ফারুক খাঁন: বর্তমানে আমাদের ৬ লাখ ৬১ হাজার শিক্ষার্থী হিসাব রয়েছে, যা দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে বিস্তৃত শাখা নেটওয়ার্ক, গ্রামীণ পর্যায়ে সেবা সম্প্রসারণ এবং ধারাবাহিক প্রচেষ্টা। মাত্র ১০০ টাকায় হিসাব খোলা যায়, কোনো বার্ষিক চার্জ নেই, শিক্ষার্থীরা বিনা মূল্যে ডেবিট কার্ডও পায়। ফলে আর্থিকভাবে দুর্বল পরিবারের সন্তানেরাও সহজে এই সুযোগ নিতে পারছে।
আজকের পত্রিকা: স্কুল ব্যাংকিং বিস্তারে ব্যাংকগুলোর ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
ওমর ফারুক খাঁন: এখন ৬১ ব্যাংকের মধ্যে ৫৯টি এই কার্যক্রমে যুক্ত; যা বলে দেয় ব্যাংকগুলো কতটা সক্রিয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি শাখা অন্তত একটি স্কুলে স্কুল ব্যাংকিং পরিচালনা করছে; পাশাপাশি ব্যাংকগুলো সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান, প্রদর্শনী ও প্রশিক্ষণ আয়োজন করছে, যাতে শিক্ষার্থীরা সঞ্চয়ের গুরুত্ব এবং ব্যাংক ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা পায়। আশাব্যঞ্জক দিক হলো, এই হিসাবগুলোর ৫৪ শতাংশই গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের নামে।
আজকের পত্রিকা: শিক্ষার্থীরা সাধারণত কোথা থেকে সঞ্চয়ের অর্থ পায়?
ওমর ফারুক খাঁন: বেশির ভাগ টিফিনের টাকা, হাতখরচ, উপহার অথবা বৃত্তির অর্থ থেকে সঞ্চয় করে। কেউ কেউ টিউশন বা ছোটখাটো অনলাইন কাজ থেকে আয় করে জমা রাখে। অভিভাবকেরাও সন্তানদের সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তুলতে নিয়মিত কিছু টাকা জমা দেন। এই ছোট ছোট জমা মিলিয়েই তৈরি হচ্ছে একটি বড় আর্থিক ভিত্তি।
আজকের পত্রিকা: তবে সাম্প্রতিক সময়ে জমার প্রবাহ কিছুটা কমে এসেছে। কেন?
ওমর ফারুক খাঁন: এর পেছনে প্রধান কারণ অর্থনৈতিক চাপ ও সচেতনতার অভাব। অনেক পরিবার আগের মতো সঞ্চয়ের জন্য আলাদা অর্থ রাখতে পারছে না। অন্যদিকে কিছু ব্যাংক করপোরেট খাতে বেশি মনোযোগ দেওয়ায় এই খাতের উদ্যোগও কিছুটা কমেছে। তবে নীতিগত সহায়তা, ডিজিটাল সুবিধা এবং প্রচার বাড়ানো গেলে দ্রুতই তা ঘুরে দাঁড়াবে।
আজকের পত্রিকা: জাতীয় অর্থনীতিতে খুদে শিক্ষার্থীদের সঞ্চয় কতটা শক্তি জোগাচ্ছে?
ওমর ফারুক খাঁন: এই ক্ষুদ্র সঞ্চয়গুলো একত্রে ব্যাংকের আমানত বাড়াচ্ছে, যা পরে বিনিয়োগ ও উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। এতে কর্মসংস্থান বাড়ে, অর্থনীতি সচল হয়। একই সঙ্গে শিশুরা ছোটবেলা থেকে অর্থের মূল্য, সঞ্চয় ও আর্থিক শৃঙ্খলা শেখে। আমার বিশ্বাস, এটি শুধু ব্যাংক উদ্যোগ নয়; এক সামাজিক পরিবর্তনের আন্দোলন, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অর্থনৈতিকভাবে সচেতন এবং আত্মনির্ভর করে গড়ে তুলবে।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি
আজকের পত্রিকা: কবে থেকে স্কুল ব্যাংকিংয়ে যুক্ত ইসলামী ব্যাংক?
ওমর ফারুক খাঁন: ইসলামী ব্যাংক শুরু থেকে এই কার্যক্রমে যুক্ত। আমরা ১৮ বছরের কম বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্য ‘মুদারাবা স্কুল স্টুডেন্ট সেভিংস অ্যাকাউন্ট’ চালু করেছি, যেখানে অভিভাবকেরা সন্তানদের পক্ষ থেকে হিসাব পরিচালনা করেন। মূল লক্ষ্য হলো শিশু-কিশোরদের সুদমুক্ত অর্থনীতিতে যুক্ত করা এবং ভবিষ্যতে দায়িত্বশীল ব্যাংক গ্রাহক হিসেবে গড়ে তোলা।
আজকের পত্রিকা: তাহলে এ খাতে ইসলামী ব্যাংকের অবস্থান কীভাবে দেখছেন?
ওমর ফারুক খাঁন: বর্তমানে আমাদের ৬ লাখ ৬১ হাজার শিক্ষার্থী হিসাব রয়েছে, যা দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে বিস্তৃত শাখা নেটওয়ার্ক, গ্রামীণ পর্যায়ে সেবা সম্প্রসারণ এবং ধারাবাহিক প্রচেষ্টা। মাত্র ১০০ টাকায় হিসাব খোলা যায়, কোনো বার্ষিক চার্জ নেই, শিক্ষার্থীরা বিনা মূল্যে ডেবিট কার্ডও পায়। ফলে আর্থিকভাবে দুর্বল পরিবারের সন্তানেরাও সহজে এই সুযোগ নিতে পারছে।
আজকের পত্রিকা: স্কুল ব্যাংকিং বিস্তারে ব্যাংকগুলোর ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
ওমর ফারুক খাঁন: এখন ৬১ ব্যাংকের মধ্যে ৫৯টি এই কার্যক্রমে যুক্ত; যা বলে দেয় ব্যাংকগুলো কতটা সক্রিয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি শাখা অন্তত একটি স্কুলে স্কুল ব্যাংকিং পরিচালনা করছে; পাশাপাশি ব্যাংকগুলো সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান, প্রদর্শনী ও প্রশিক্ষণ আয়োজন করছে, যাতে শিক্ষার্থীরা সঞ্চয়ের গুরুত্ব এবং ব্যাংক ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা পায়। আশাব্যঞ্জক দিক হলো, এই হিসাবগুলোর ৫৪ শতাংশই গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের নামে।
আজকের পত্রিকা: শিক্ষার্থীরা সাধারণত কোথা থেকে সঞ্চয়ের অর্থ পায়?
ওমর ফারুক খাঁন: বেশির ভাগ টিফিনের টাকা, হাতখরচ, উপহার অথবা বৃত্তির অর্থ থেকে সঞ্চয় করে। কেউ কেউ টিউশন বা ছোটখাটো অনলাইন কাজ থেকে আয় করে জমা রাখে। অভিভাবকেরাও সন্তানদের সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তুলতে নিয়মিত কিছু টাকা জমা দেন। এই ছোট ছোট জমা মিলিয়েই তৈরি হচ্ছে একটি বড় আর্থিক ভিত্তি।
আজকের পত্রিকা: তবে সাম্প্রতিক সময়ে জমার প্রবাহ কিছুটা কমে এসেছে। কেন?
ওমর ফারুক খাঁন: এর পেছনে প্রধান কারণ অর্থনৈতিক চাপ ও সচেতনতার অভাব। অনেক পরিবার আগের মতো সঞ্চয়ের জন্য আলাদা অর্থ রাখতে পারছে না। অন্যদিকে কিছু ব্যাংক করপোরেট খাতে বেশি মনোযোগ দেওয়ায় এই খাতের উদ্যোগও কিছুটা কমেছে। তবে নীতিগত সহায়তা, ডিজিটাল সুবিধা এবং প্রচার বাড়ানো গেলে দ্রুতই তা ঘুরে দাঁড়াবে।
আজকের পত্রিকা: জাতীয় অর্থনীতিতে খুদে শিক্ষার্থীদের সঞ্চয় কতটা শক্তি জোগাচ্ছে?
ওমর ফারুক খাঁন: এই ক্ষুদ্র সঞ্চয়গুলো একত্রে ব্যাংকের আমানত বাড়াচ্ছে, যা পরে বিনিয়োগ ও উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। এতে কর্মসংস্থান বাড়ে, অর্থনীতি সচল হয়। একই সঙ্গে শিশুরা ছোটবেলা থেকে অর্থের মূল্য, সঞ্চয় ও আর্থিক শৃঙ্খলা শেখে। আমার বিশ্বাস, এটি শুধু ব্যাংক উদ্যোগ নয়; এক সামাজিক পরিবর্তনের আন্দোলন, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অর্থনৈতিকভাবে সচেতন এবং আত্মনির্ভর করে গড়ে তুলবে।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি

প্রধান উপদেষ্টা মনে করেন, সংস্কার ও বছরের শেষ নাগাদ বা আগামী বছরের প্রথমার্ধে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়ার কোনো ঘাটতি নেই। গত ২৯ ডিসেম্বর (২০২৪) ইংরেজি দৈনিক নিউ এজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এ মন্তব্য করেন তিনি। ঢাকায় প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় বাং
০৭ জানুয়ারি ২০২৫
ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসি (ইবিএল) নিয়মিতভাবে স্কুলে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন, সেমিনার, ওয়ার্কশপ এবং বিশেষ অফারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সচেতন করছে এবং তাদের হিসাব খোলায় উৎসাহ দিচ্ছে। আমরা শিক্ষার্থীদের ব্যাংকিং জ্ঞান ও সঞ্চয়ের গুরুত্ব বোঝাতে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করি।
৮ দিন আগে
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিবিসি বাংলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে সংস্কার, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এবং রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন। প্রায় দুই দশক পর প্রথম কোনো গণমাধ্যম হিসেবে বিবিসি বাংলার মুখোমুখি হয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তিনি।
২৩ দিন আগে
দীর্ঘ প্রায় দুই দশক পর কোনো গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকারে আগামী নির্বাচনে দলের কৌশল, আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও তাদের নেতা-কর্মীদের বিচার...
২৪ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

আজকের পত্রিকা: স্কুল ব্যাংকিংয়ের প্রসারে ব্যাংকগুলোর ভূমিকা কী?
এম. খোরশেদ আনোয়ার: ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসি (ইবিএল) নিয়মিতভাবে স্কুলে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন, সেমিনার, ওয়ার্কশপ এবং বিশেষ অফারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সচেতন করছে এবং তাদের হিসাব খোলায় উৎসাহ দিচ্ছে। আমরা শিক্ষার্থীদের ব্যাংকিং জ্ঞান ও সঞ্চয়ের গুরুত্ব বোঝাতে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করি।
আজকের পত্রিকা: শিক্ষার্থীদের হিসাব খুলতে কী কী বিশেষ উদ্যোগ রয়েছে?
এম. খোরশেদ আনোয়ার: ইবিএল শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ সুবিধাসহ স্কুল ব্যাংকিং হিসাব খোলার সুযোগ দিচ্ছে। ন্যূনতম জমা দিয়ে হিসাব খোলা যায়, পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা পায় বিনা মূল্যে ডেবিট কার্ডসহ আকর্ষণীয় উপহার।
আজকের পত্রিকা: স্কুল ব্যাংকিংয়ে ইবিএলের শেয়ার কত?
এম. খোরশেদ আনোয়ার: ইবিএল বর্তমানে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্কুল ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। আমরা ধারাবাহিকভাবে নতুন নতুন স্কুলে অংশগ্রহণ বাড়াচ্ছি, যাতে আরও বেশি শিক্ষার্থী এই উদ্যোগের আওতায় আসে। বর্তমানে দেশের স্কুল ব্যাংকিং খাতে ইবিএলের উল্লেখযোগ্য শেয়ার রয়েছে, যা আমাদের ধারাবাহিক প্রচেষ্টা এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাংকিং সংস্কৃতি গড়ে তোলার প্রতিফলন।
আজকের পত্রিকা: স্কুল ব্যাংকিংয়ের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যদি কিছু বলেন।
এম. খোরশেদ আনোয়ার: ইবিএল বিশ্বাস করে, স্কুল ব্যাংকিংয়ের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময়। আমরা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আরও আধুনিক ব্যাংকিং সুবিধা দিতে কাজ করছি, যাতে তারা ছোটবেলা থেকেই স্মার্ট ব্যাংকিংয়ে অভ্যস্ত হয়।
আজকের পত্রিকা: শিক্ষার্থীদের হিসাবে বাড়তি কী সুবিধা রয়েছে?
এম. খোরশেদ আনোয়ার: ইবিএল শিক্ষার্থীদের সঞ্চয়ের পাশাপাশি আর্থিক সচেতনতা বৃদ্ধি, স্কলারশিপ, বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ও পুরস্কারের মাধ্যমে উৎসাহিত করে। এ ছাড়া ভবিষ্যতে বিশেষ ডিজিটাল সুবিধা যুক্ত করার পরিকল্পনাও রয়েছে।
আজকের পত্রিকা: নতুন কোনো অফার দেবেন কি?
এম. খোরশেদ আনোয়ার: হ্যাঁ, ইবিএল নিয়মিতভাবে শিক্ষার্থীদের জন্য আকর্ষণীয় অফার ও পুরস্কার কার্যক্রম আয়োজন করে। যেমন সেরা সঞ্চয়কারী শিক্ষার্থীদের জন্য উপহার, আর্থিক সচেতনতা কর্মশালা ইত্যাদি।
উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, হেড অব রিটেইল অ্যান্ড এসএমই ব্যাংকিং ডিপার্টমেন্ট, ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসি
আজকের পত্রিকা: স্কুল ব্যাংকিংয়ের প্রসারে ব্যাংকগুলোর ভূমিকা কী?
এম. খোরশেদ আনোয়ার: ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসি (ইবিএল) নিয়মিতভাবে স্কুলে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন, সেমিনার, ওয়ার্কশপ এবং বিশেষ অফারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সচেতন করছে এবং তাদের হিসাব খোলায় উৎসাহ দিচ্ছে। আমরা শিক্ষার্থীদের ব্যাংকিং জ্ঞান ও সঞ্চয়ের গুরুত্ব বোঝাতে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করি।
আজকের পত্রিকা: শিক্ষার্থীদের হিসাব খুলতে কী কী বিশেষ উদ্যোগ রয়েছে?
এম. খোরশেদ আনোয়ার: ইবিএল শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ সুবিধাসহ স্কুল ব্যাংকিং হিসাব খোলার সুযোগ দিচ্ছে। ন্যূনতম জমা দিয়ে হিসাব খোলা যায়, পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা পায় বিনা মূল্যে ডেবিট কার্ডসহ আকর্ষণীয় উপহার।
আজকের পত্রিকা: স্কুল ব্যাংকিংয়ে ইবিএলের শেয়ার কত?
এম. খোরশেদ আনোয়ার: ইবিএল বর্তমানে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্কুল ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। আমরা ধারাবাহিকভাবে নতুন নতুন স্কুলে অংশগ্রহণ বাড়াচ্ছি, যাতে আরও বেশি শিক্ষার্থী এই উদ্যোগের আওতায় আসে। বর্তমানে দেশের স্কুল ব্যাংকিং খাতে ইবিএলের উল্লেখযোগ্য শেয়ার রয়েছে, যা আমাদের ধারাবাহিক প্রচেষ্টা এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাংকিং সংস্কৃতি গড়ে তোলার প্রতিফলন।
আজকের পত্রিকা: স্কুল ব্যাংকিংয়ের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যদি কিছু বলেন।
এম. খোরশেদ আনোয়ার: ইবিএল বিশ্বাস করে, স্কুল ব্যাংকিংয়ের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময়। আমরা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আরও আধুনিক ব্যাংকিং সুবিধা দিতে কাজ করছি, যাতে তারা ছোটবেলা থেকেই স্মার্ট ব্যাংকিংয়ে অভ্যস্ত হয়।
আজকের পত্রিকা: শিক্ষার্থীদের হিসাবে বাড়তি কী সুবিধা রয়েছে?
এম. খোরশেদ আনোয়ার: ইবিএল শিক্ষার্থীদের সঞ্চয়ের পাশাপাশি আর্থিক সচেতনতা বৃদ্ধি, স্কলারশিপ, বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ও পুরস্কারের মাধ্যমে উৎসাহিত করে। এ ছাড়া ভবিষ্যতে বিশেষ ডিজিটাল সুবিধা যুক্ত করার পরিকল্পনাও রয়েছে।
আজকের পত্রিকা: নতুন কোনো অফার দেবেন কি?
এম. খোরশেদ আনোয়ার: হ্যাঁ, ইবিএল নিয়মিতভাবে শিক্ষার্থীদের জন্য আকর্ষণীয় অফার ও পুরস্কার কার্যক্রম আয়োজন করে। যেমন সেরা সঞ্চয়কারী শিক্ষার্থীদের জন্য উপহার, আর্থিক সচেতনতা কর্মশালা ইত্যাদি।
উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, হেড অব রিটেইল অ্যান্ড এসএমই ব্যাংকিং ডিপার্টমেন্ট, ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসি

প্রধান উপদেষ্টা মনে করেন, সংস্কার ও বছরের শেষ নাগাদ বা আগামী বছরের প্রথমার্ধে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়ার কোনো ঘাটতি নেই। গত ২৯ ডিসেম্বর (২০২৪) ইংরেজি দৈনিক নিউ এজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এ মন্তব্য করেন তিনি। ঢাকায় প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় বাং
০৭ জানুয়ারি ২০২৫
ইসলামী ব্যাংক শুরু থেকে এই কার্যক্রমে যুক্ত। আমরা ১৮ বছরের কম বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্য ‘মুদারাবা স্কুল স্টুডেন্ট সেভিংস অ্যাকাউন্ট’ চালু করেছি, যেখানে অভিভাবকেরা সন্তানদের পক্ষ থেকে হিসাব পরিচালনা করেন। মূল লক্ষ্য হলো শিশু-কিশোরদের সুদমুক্ত অর্থনীতিতে যুক্ত করা এবং ভবিষ্যতে দায়িত্বশীল...
৮ দিন আগে
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিবিসি বাংলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে সংস্কার, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এবং রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন। প্রায় দুই দশক পর প্রথম কোনো গণমাধ্যম হিসেবে বিবিসি বাংলার মুখোমুখি হয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তিনি।
২৩ দিন আগে
দীর্ঘ প্রায় দুই দশক পর কোনো গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকারে আগামী নির্বাচনে দলের কৌশল, আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও তাদের নেতা-কর্মীদের বিচার...
২৪ দিন আগে
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিবিসি বাংলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে সংস্কার, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এবং রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন। প্রায় দুই দশক পর প্রথম কোনো গণমাধ্যম হিসেবে বিবিসি বাংলার মুখোমুখি হয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তিনি। তারেক রহমান লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে এই সাক্ষাৎকার দেন। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব আজ।
আজকের পত্রিকা ডেস্ক

বিবিসি বাংলা: এখন বাংলাদেশের সরকার পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার, তাদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?
তারেক রহমান: বিষয়টি তো রাজনৈতিক। এটি তো কোনো ব্যক্তির বিষয় নয়। আমরা প্রথম থেকে যে কথাটি বলছি, আমরা চাই এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সফল হোক। অর্থাৎ, অনেক কিছুর মতো বিভিন্ন বিষয় আছে। যেমন—আমরা যদি মূল দুটো বিষয় বলি যে, কিছু সংস্কারের বিষয় আছে, একই সাথে প্রত্যাশিত সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, স্বাধীন নির্বাচনের একটি বিষয় আছে।
মূলত কিছু সংস্কারসহ যে সংস্কারগুলো না করলেই নয়, এরকম সংস্কারসহ একটি স্বাভাবিক সুষ্ঠু, স্বাধীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত করাই হচ্ছে বর্তমান সরকারের মূল লক্ষ্য। আমরা প্রত্যাশা করি, ওনারা উনাদের ওপরে যেটা মূল দায়িত্ব, সেটি ওনারা সঠিকভাবে সম্পাদন করবেন। এটাই তো তাঁদের কাছে আমাদের চাওয়া রাজনৈতিক দল হিসেবে।
আমরা আশা রাখি, প্রত্যাশা করি যে, ওনারা কাজটি সুন্দরভাবে করবেন। স্বাভাবিকভাবে এই কাজের সৌন্দর্য বা কতটুকু ভালো, কতটুকু ভালো বা মন্দভাবে করতে পারছেন, তার ওপরেই মনে হয় সম্পর্কের উষ্ণতা বা শীতলতা যেটাই বলেন, সেটা নির্ভর করবে।
বিবিসি বাংলা: আপনি কয়েক মাস আগে একটি মন্তব্য করেছিলেন যে, অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। আপনার এই মন্তব্য নিয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, এ বিষয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া কী? তিনি তখন বলেছিলেন, সন্দেহটা ওনার মনে। অর্থাৎ, আপনার মনে সন্দেহ আছে কি না, সেটা তিনি জানতে চান। আপনার মনে কি সেই সন্দেহ আছে?
তারেক রহমান: দেখুন, আমি যখন কথাটি বলেছিলাম, এই মুহূর্তে আমার যতটুকু মনে পড়ে, সেই সময় পর্যন্ত ওনারা কিন্তু নির্বাচনের ব্যাপারে সঠিক কোনো টাইম ফ্রেম বা কোনো কিছু বলেননি।
রোডম্যাপ বলতে যা বোঝায়, আমরা নরমালি যা বুঝে থাকি, এরকম কিছু বলেননি। এবং সে কারণেই শুধু আমার মনের মধ্যেই নয়, আমরা যদি সেই সময় বিভিন্ন মিডিয়া দেখি, বিভিন্ন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব দেখি, যাঁরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় আলোচনা করেন রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে, প্রায় সবার মনের মধ্যেই সন্দেহ ছিল।
আমরা যখন দেখলাম যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান ডক্টর ইউনূস, উনি মোটামুটিভাবে একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করলেন। এবং পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকবার উনি ওনার যে সিদ্ধান্ত, সেটির ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তারপর থেকেই খুব স্বাভাবিকভাবেই এই সন্দেহ বহু মানুষের মন থেকে ধীরে ধীরে চলে যেতে ধরেছে।
আমি মনে করি, ওনারা যা বলেছেন, ওনারা যতক্ষণ পর্যন্ত দৃঢ় থাকবেন, ওনাদের বক্তব্যে, ওনাদের কাজে যত বেশি দৃঢ় থাকবেন, ততই সন্দেহ চলে যাবে আস্তে আস্তে।
বিবিসি বাংলা: সেই সন্দেহ মনে কিছুটা দূরীভূত হয়েছিল লন্ডনে যখন তিনি আপনার সঙ্গে বৈঠক করলেন। তার পরেই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কথা এসেছিল। তো সেই বৈঠকে নির্বাচনের কথা তো হয়েছিল, যেহেতু সেটি পরে এসেছে। এর বাইরে কি আপনাদের মধ্যে আর কোনো কথা হয়েছে? আর কোনো বিষয়ে কোনো চিন্তাভাবনা বা সমঝোতা কিছু হয়েছে?
তারেক রহমান: এর বাইরে স্বাভাবিকভাবেই উনি একজন অত্যন্ত স্বনামধন্য মানুষ। অত্যন্ত বিজ্ঞ মানুষ উনি। এর বাইরে তো অবশ্যই স্বাভাবিকভাবে সৌজন্যমূলক কথাবার্তা হয়েছে। এর বাইরেও উনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন যে, জনগণ যদি আপনাদের সুযোগ দেয়, তাহলে আপনারা কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য—এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
আমার কিছু চিন্তাভাবনা দেশের মানুষকে নিয়ে, দেশের জনগণকে নিয়ে, দেশকে নিয়ে আমরা যদি সুযোগ পাই, জনগণ আমাদের যদি সেই সুযোগ দেন, তাহলে আমরা কী কী বিষয়ে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করব, সে বিষয়গুলো নিয়ে কিছু কিছু আলোচনা হয়েছে।
বিবিসি বাংলা: নির্বাচনের বিষয়টি তো আপনি বললেন, এর বাইরে সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে, দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে গত এক বছরে যে ভূমিকা রেখেছে অন্তর্বর্তী সরকার, সেটাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
তারেক রহমান: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মানে ইন্টেরিম, মানে এটা তো ক্ষণস্থায়ী বিষয়। তো খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি দেশ পরিচালনা তো একটি বিশাল বিষয়। আমরা হয়তো ভূখণ্ডের ভিত্তিতে যদি বিবেচনা করি, হয়তো বাংলাদেশকে অনেকে বলবে ছোট দেশ। কিন্তু আমরা যদি জনসংখ্যার ভিত্তিতে বিবেচনা করি, বাংলাদেশ পৃথিবীর অনেক ভূখণ্ডের চেয়ে বড় দেশ।
ইউকের (যুক্তরাজ্য) জনসংখ্যা ৭ কোটির মতো, বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্লাস-মাইনাস ২০ কোটির মতো এখন। কাজেই ইউকের তিন গুণ বড়। এরকম একটি দেশ পরিচালনা করতে হলে স্বাভাবিকভাবেই জনগণের ম্যান্ডেটসহ একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক সরকার প্রয়োজন। বিভিন্ন বিষয় থাকে, ইস্যুজ থাকে, বিভিন্ন বিষয় আছে।
তো এখন নির্বাচনের বাইরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পারফরমেন্স আপনি যেটা বললেন, আমরা সবকিছু বিবেচনা করলে আমার কাছে মনে হয়েছে যে, হয়তো ওনারা চেষ্টা করেছেন অনেক বিষয়ে। সব ক্ষেত্রে সবাই তো আর সফল হতে পারে না, স্বাভাবিকভাবে ওনাদের লিমিটেশনস কিছু আছে। সেই লিমিটেশনসের মধ্যে ওনারা হয়তো চেষ্টা করেছেন, যতটুকু পেরেছেন হয়তো চেষ্টা করছেন।
এক এগারোর সরকার নিয়ে মূল্যায়ন কী?
বিবিসি বাংলা: আমি একটু পিছনে তাকাতে চাই।
তারেক রহমান: ভাই, আমরা তো সামনে যেতে চাই। আপনি পেছনে কেন যাচ্ছেন? দেশকে সামনে নিতে হবে।
বিবিসি বাংলা: মানে, পেছন থেকেই তো শিক্ষা নিয়ে সামনে এগোতে হয়। তো পেছনের একটা বিষয়, সেটা হচ্ছে, এক-এগারোর সরকার বা সেনাসমর্থিত সরকারের সেই সময়টা নিয়ে রাজনীতিতে অনেক আলোচনা আছে। সে সময়টাকে ঘিরে আপনার মূল্যায়ন কী?
তারেক রহমান: এক বাক্যে বা সংক্ষেপে যদি বলতে হয়, এক-এগারোর সরকার তো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটি সরকার ছিল।
আমরা দেখেছি, সেই সরকার আসলে কীভাবে দেশের যতটুকু যেমনই হোক বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে যতটুকুই রাজনীতি গড়ে উঠেছিল, গণতান্ত্রিক ভিত্তি ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিল ভুল-ত্রুটি সবকিছুর ভিতর দিয়েই। কিন্তু আমরা দেখেছি যে, কীভাবে তারা সবকিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিল, বিরাজনীতিকরণ করতে চেয়েছিল। দেশকে একটি অন্ধকার দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। পরবর্তী সময়ে দেখেছি যে, খুব সম্ভবত তাদেরই ভিন্ন আরেকটি রূপ; অন্যভাবে দেখেছি আমরা ’ইন দ্য নেম অব ডেমোক্রেসি’।
বিএনপির রাজনীতিতে পরিবর্তন হয়েছে কতটা
বিবিসি বাংলা: ২০০৪ সালে আমি আপনার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম ঢাকায়। সে সময় আপনি বলেছিলেন যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি পরিবর্তন আনার চেষ্টা করবেন। তো বিএনপির রাজনীতিতে আসলে কতটা পরিবর্তন হয়েছে; ভবিষ্যৎ বিএনপিই বা কেমন হবে?
তারেক রহমান: আমাদের রাজনীতির মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণ, দেশ এবং দেশের সার্বভৌমত্ব। আমরা দুটো বিষয় নিয়ে বাংলাদেশে খুবই গর্ব করি, অহংকার করি। একটি হচ্ছে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প, আরেকটি হচ্ছে প্রবাসীরা দিন-রাত পরিশ্রম করে যে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পাঠান—এ দুটোই কিন্তু বিএনপি শুরু করেছিল।
আমরা দেখেছি, বিএনপির সময়ে শুরু হয়েছিল প্রবাসীদের বিদেশ যাওয়া, একই সাথে গার্মেন্ট শিল্পের প্রসার। এর বাইরেও যদি আমরা দেখি, ১৯৭৪ সালে যে দুর্ভিক্ষটা হয়েছিল, পরবর্তীতে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেলেন, আমরা দেখেছি কীভাবে ধীরে ধীরে দুর্ভিক্ষপীড়িত একটি দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসপূর্ণ করে শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণ না, অল্প পরিমাণ করে হলেও আমরা কিন্তু সেই সময় বিদেশে খাদ্য রপ্তানি, চাল রপ্তানি করেছিলাম।
আর রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে যদি আমরা দেখি, যেখানে একসময় সকল দলকে নিষিদ্ধ করে একটি দল বাকশাল করা হয়েছিল। আমরা দেখেছি যে, বিএনপির কাঁধে যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পড়ে, তখন কীভাবে বহুদলীয় গণতন্ত্রের চালু আবার করা হয়েছিল।
কাজেই আপনি বললেন, অতীত থেকে শিক্ষা নিতে হবে। ইয়েস, আমরা অতীতে এই ভালো কাজগুলো করেছি। ভবিষ্যতে ইনশাআল্লাহ এ বিষয়গুলো কনসিডারেশন (বিবেচনায়) রেখেই সামনে এগিয়ে যাব। আমাদের অন্যতম মূল লক্ষ্য হবে ভবিষ্যৎ বিএনপির গণতন্ত্রের যে বুনিয়াদ, একটি শক্তিশালী বুনিয়াদ তৈরি করা। জবাবদিহি তৈরি করা।
বিবিসি বাংলা: কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা অভিযোগ সব সময় থাকে। যখন যারা চেয়ারে বসে, জবাবদিহিতার প্রশ্নটা তখন থাকে না। মানে, এড়িয়ে যায়—এ ধরনের একটা অভিযোগ সব সময় ছিল। সব রাজনৈতিক দল বা যারাই সরকারে এসেছে।
তারেক রহমান: দেখুন, অভিযোগ থাকতেই পারে। আমি আগেই তো বলেছি, একটি বিষয়ে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন রকম অভিযোগ থাকতে পারে। এখন অভিযোগ নিয়ে তো আর বলা যাবে না। কিন্তু অভিযোগটা কনসিডারেশনে (বিবেচনায়) অবশ্যই রাখব। আপনি যেহেতু আমার কাছে জানতে চেয়েছেন, আমি আপনাকে এটাই বলেছি। আপনি জানতে চেয়েছেন ভবিষ্যৎ কেমন হবে।
আমি আমার অভিজ্ঞতা দিয়ে যা দেখেছি, বুঝেছি, জেনেছি, আমি আপনার সামনে সেটিই তুলে ধরলাম। অভিযোগ এ দেশেও আছে, কিন্তু আপনি যা জানতে চাইছেন, এটি তো আমি একমাত্র সুযোগ যদি পাই, আমি ইনশআল্লাহ সুযোগ পেলে পরে তখন আস্তে আস্তে জিনিসটি প্রমাণ করা সম্ভব হবে।
হ্যাঁ, এটাও বাস্তবতা। প্রাগমেটিক কথা যেটা, বাস্তব কথা যেটা, আমি সুযোগ পেলে যে সাথে সাথেই বিষয়টি হবে তা না। কারণ, আমি সুযোগ পেলে আপনাকেও বুঝতে হবে। আপনিও কিন্তু দেশ গঠনের একটা পার্ট। কাজেই আপনার মতো এরকম লক্ষকোটি মানুষকে বিষয়টি বুঝতে হবে। এতটুকু বলতে পারি যে, ইয়েস, উই আর কমিটেড। উই উইল ট্রাই আওয়ার বেস্ট টু ডু পারফরম বেস্ট ডু দ্যাট।
বিবিসি বাংলা: জবাবদিহির কথা বলছিলেন। এ প্রসঙ্গে বলি, গত ১৫ বছর আপনি নির্বাসনে থেকে দলকে নেতৃত্ব দেওয়ায়, এটা একটা ভিন্ন পরিস্থিতি। নেতৃত্ব নিয়ে আপনার চিন্তাধারায় কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে? আপনি কী অনুভব করেন, অনুধাবন করেন?
তারেক রহমান: গত ১৭ বছর প্রবাসজীবনে আছি এবং অনেকগুলো বছর আমি বাংলাদেশের সাথে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা টাইম ডিফারেন্স, ডিস্টেন্স ডিফারেন্স তো আছেই। রিচিং ডিফারেন্স তো একটা ডিফিকাল্টিস তো আছেই। এটি একটি বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই আমি আমার পরিবার অর্থাৎ, আমার স্ত্রী এবং আমার সন্তানকে এখানে ধন্যবাদ দিতে চাই। কারণ তাদের সহযোগিতা না থাকলে হয়তো এই ডিফিকাল্ট কাজটি করা আমার জন্য আরও ডিফিকাল্ট হতো। ওনাদের সহযোগিতা ছিল, সে জন্য আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছে।
একই সাথে আমি আবারও ধন্যবাদ দিতে চাই আমার হাজারো-লক্ষ নেতাকর্মীকে। যাঁরা এই ডিফিকাল্টিজের মধ্যে থেকেও আমাকে সহযোগিতা করেছেন দলকে সুসংগঠিত রাখতে, দলকে রাজপথে নিয়ে যেতে শত অত্যাচার, বাধাবিঘ্নের মাঝেও জনগণের কথা তুলে ধরতে, জনগণের দাবির ব্যাপারে সোচ্চার থাকতে। আপনি জিজ্ঞেস করেছেন মনে হয় যে, এখানে (যুক্তরাজ্যে) থেকে কী কী দেখেছি, শিখেছি বা জেনেছি। আমি মনে করি, এই দেশ থেকে ভালো যা কিছু দেখেছি বা শিখেছি। দেশের নাগরিক হিসেবে এবং যেহেতু আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী, হয়তো আমার একটি সুযোগ আছে দেশের জন্য ভালো কিছু করার।
যদি আমি ইনশাআল্লাহ সেই সুযোগ পাই, তাহলে যতটুকু সম্ভব দেশের মানুষের জন্য বা দেশের জন্য কিছু করার, এভাবে বিষয়টিকে আমি বিবেচনা করি।
কূটনীতির ক্ষেত্রে বিএনপির মূলনীতি কী হবে?
বিবিসি বাংলা: কূটনীতির প্রসঙ্গে আসি। বিএনপি যদি সরকার গঠন করে, তাহলে কূটনীতির ক্ষেত্রে বিএনপির মূলনীতি কী হবে?
তারেক রহমান: গুড কোশ্চেন। বিএনপির মূলনীতি একটাই—সবার আগে বাংলাদেশ। কূটনীতির ক্ষেত্রে বিএনপির নীতি সবার আগে বাংলাদেশ। আমার জনগণ, আমার দেশ, আমার সার্বভৌমত্ব। এটিকে অক্ষুণ্ন রেখে, এর স্বার্থ বিবেচনা করে, এই স্বার্থকে অটুট রেখে বাকি সবকিছু।
বিবিসি বাংলা: এটাকে বৈশ্বিক রাজনীতির একটা প্রভাব বলা যায়? কারণ আপনি যদি বিভিন্ন দেশে দেখেন, এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্পও আমেরিকা ফার্স্ট একটা স্লোগান দিয়ে এসেছিলেন।
তারেক রহমান: না, ওদেরটা ওরা বলেছে, আমি ভাই বাংলাদেশি। আমার কাছে বাংলাদেশের স্বার্থ বড়, আমার কাছে বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থ বড়। কাজেই কে কী বলল...সবার আগে বাংলাদেশ, সিম্পল, কমপ্লিকেট (জটিল) করার কিছু নাই, এটা সিম্পল ব্যাপার।
ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে অবস্থান কী?
বিবিসি বাংলা: বিগত সরকারের সময় বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে যে সম্পর্ক ছিল, সেটা নিয়ে অনেক সমালোচনা রয়েছে। তো ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে আপনাদের নীতি কী হবে?
তারেক রহমান: আমার মনে হয়, আপনি একটু আগে যে প্রশ্নগুলো করেছেন, সেখানে বোধহয় আমি ক্লিয়ার করেছি পুরো ব্যাপারটা। সবার আগে বাংলাদেশ। এখানে তো আপনি পার্টিকুলার (সুনির্দিষ্ট) একটি দেশের কথা বলেছেন।
এখানে ওই দেশ বা অন্য দেশ তো বিষয় না। বিষয় তো হচ্ছে, ভাই, বাংলাদেশ আমার কাছে আমার স্বার্থ, আমি আগে আমার দেশের মানুষের স্বার্থ দেখব, আমার দেশের স্বার্থ দেখব। ওটাকে আমি রেখে আপহোল্ড করে আমি যা যা করতে পারব, আমি তা-ই করব।
বিবিসি বাংলা: বাংলাদেশের স্বার্থ আপনারা সবার আগে নেবেন, সেটা আপনি পরিষ্কার করেছেন। ভারতের কথা বিশেষভাবে আসছে, যেহেতু সেটি বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ এবং বাংলাদেশের তিন পাশেই এই দেশের সীমান্ত রয়েছে। এবং এটি নিয়ে আপনিও জানেন যে, বিভিন্ন সময়ে কথা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও কথা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সময় তো সম্পর্ক নিয়ে বললামই, সেটা নিয়ে কথা হয়েছে। তাদের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত বা কেমন থাকা প্রয়োজন—এ নিয়ে আপনার চিন্তা কী?
তারেক রহমান: অবশ্যই আমি আমার পানির হিস্যা চাই। অবশ্যই আমি দেখতে চাই না যে, আরেক ফেলানী ঝুলে আছে। অবশ্যই আমরা এটা মেনে নিব না।
বিবিসি বাংলা: বাংলাদেশের স্বার্থের প্রসঙ্গে আপনি বলছেন যে, পানির হিস্যা চাওয়া এবং সীমান্ত হত্যার বিষয়টি নিয়ে আপনারা সোচ্চার থাকবেন।
তারেক রহমান: না না, আমি উদাহরণ দিয়ে বললাম। দুটো উদাহরণ দিয়ে বোঝালাম আপনাকে যে আমাদের স্ট্যান্ডটা কী হবে। আমরা আমাদের পানির হিস্যা চাই। অর্থাৎ আমার দেশের হিস্যা, মানুষের হিস্যা আমি চাই, হিসাব আমি চাই।
আমার যেটা ন্যায্য, সেটা আমি চাই। অবশ্যই ফেলানী হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে আমি বোঝাতে চেয়েছি যে, আমার মানুষের ওপরে আঘাত আসলে অবশ্যই সেই আঘাতকে এভাবে আমি মেনে নেব না।
বিবিসি বাংলা: একটা বিষয় যদি বলি, ৫ অগাস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এবং আপনিও জানেন যে, শেখ হাসিনা দিল্লিতে গেছেন এবং সেখানে আছেন। ভারতের সাথে একটা সম্পর্কের শীতলতা দেখা গেছে গত এক বছর ধরে। যেমন ধরুন, সেটি যাওয়া-আসার ক্ষেত্রে, ব্যবসার ক্ষেত্রে নানা রকম, সেই ক্ষেত্রে কি কোনো পরিবর্তন আপনারা সরকারে এলে হবে বা পরিবর্তনের ব্যাপারে উদ্যোগ নেবেন—এমন কোনো চিন্তা কি আপনাদের আছে?
তারেক রহমান: এখন তারা যদি স্বৈরাচারকে সেখানে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের বিরাগভাজন হয়, সেখানে তো আমাদের কিছু করার নেই। এটা বাংলাদেশের মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তাদের সাথে শীতল থাকবে। সো, আমাকে আমার দেশের মানুষের সাথে থাকতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর সংসদ ও দলীয় নেতৃত্বের প্রশ্নে যা বললেন
বিবিসি বাংলা: সংস্কারের প্রশ্নে আসি। এখন খুব আলোচিত ইস্যু। সংস্কারের কিছু বিষয়ে দেখা যাচ্ছে যে, বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দলের কিছুটা মতপার্থক্য বা মতবিরোধ হচ্ছে। যেমন—এক ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা বা দলের প্রধান থাকতে পারবেন না, এরকম একটা প্রস্তাব এসেছে, যেখানে বিএনপি নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। যদি এক ব্যক্তি তিন পদে একই সাথে থাকেন, সেটা স্বৈরতান্ত্রিক একটা ব্যবস্থা তৈরির সুযোগ দেয় কি না?
তারেক রহমান: সকলের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, এই যে বাংলাদেশে রাষ্ট্র মেরামতের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার প্রয়োজন। একজন ব্যক্তি দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না, থাকবেন না—এরকম আরও যে বিষয়গুলো আছে, এগুলো বাংলাদেশে যখন স্বৈরাচার ছিল তাদের মুখের ওপরে, তাদের চোখের দিকে চোখ রেখে আমরা বিএনপিই বলেছিলাম।
এখন হয়তো অনেকে সংস্কারের কথা বলছেন। সেদিন কিন্তু সংস্কারের ’স’-ও তারা বলেননি। তার পরেও সকলের প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে আমি বলতে চাই যে, বিএনপি ’নোট অব ডিসেন্ট’ দিলে সেটি সমস্যা, অর্থাৎ বিএনপিকে অ্যাগ্রি (সম্মত) করতে হবে সবার সাথে, তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু বিএনপি যদি কোনোটার সাথে একমত না হয়, তাহলে বেঠিক। এটি তো গণতন্ত্র হলো না।
মানে, আমাকে অন্যের সাথে একমত হতে হবে, তাহলে গণতন্ত্র। আমি যদি অন্যের সাথে দ্বিমত করি, তাহলে গণতন্ত্র না। এটি কেমন গণতন্ত্র? কারণ গণতন্ত্রের মানেই তো হচ্ছে, বিভিন্ন মতামত থাকবে। আমরা অনেক ব্যাপারেই একমত হব হয়তো। সকল ব্যাপারে একমত হবো না, কিছু ব্যাপারে হয়তো দ্বিমত থাকতেই পারে। এটাই তো গণতন্ত্র, এটাই তো এসেন্স অব গণতন্ত্র।
আমরা তো কোনো হাইড অ্যান্ড সিক করছি না। আমি যেটা মনে করছি যে ভাই, আমি মনে করছি যেটা আমার দৃষ্টিতে ঠিক না, আমি বলছি ঠিক না।
বিবিসি বাংলা: কিন্তু দুই বছর আগে ২০২৩ সালে আপনারা ৩১ দফা দিয়েছেন। সেই ৩১ দফাতেই আপনারা সংস্কারের যেসব বিষয় এনেছেন, সেখানে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনার কথা বলেছেন। তাহলে এ বিষয়গুলোতে আপত্তি কেন?
তারেক রহমান: না, আমরা যেটাতে বলেছিলাম, আমরা সেখানে এখনো আছি। যতটুকু ভারসাম্য হওয়া উচিত, যে যে বিষয়ে যতটুকু বিবেচনা করা উচিত, আমরা সে বিষয়ের মধ্যে এখনো কমবেশি আছি। আমাদের অবস্থান থেকে তো আমরা অবস্থান পরিবর্তন করিনি।
বিবিসি বাংলা: কিন্তু মূল যে বিষয়গুলো, যেমন যেটা বড় বিরোধ হিসেবে আসছে, বড় মতপার্থক্য হিসেবে আসছে যে, এক ব্যক্তির তিন পদে একসাথে থাকা, সেখানেই তো আপত্তিটা থাকছে বিএনপির।
তারেক রহমান: না, আমরা তো তখনো বলিনি যে এক ব্যক্তি তিন পদে থাকতে পারবে না। এটা অন্যরা কেউ বলেছে যে, এক ব্যক্তি তিন পদে থাকতে পারবে না। আমরা মনে করি না যে, এটাতে স্বৈরাচারী হওয়ার কোনো কারণ আছে।
আমরা তো দেখেছি, স্বৈরাচারের সময়ও এবং তার আগে তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু তাদের টু থার্ড মেজরিটি ছিল। টু থার্ড মেজরিটি ২০০৮ সালে তারা নিয়েছিল। তারা ওটাকে চেঞ্জ করে ফেলেছে। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা রাখেনি।
২০০১ সালে তো বিএনপিরও টু থার্ড মেজরিটি ছিল, বিএনপি তো চেঞ্জ করেনি। যেহেতু জনগণ মনে করে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকলে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে; বিএনপি টু থার্ড মেজরিটি থাকার পরেও তো চেঞ্জ করেনি।
কাজেই এক ব্যক্তির হাতে থাকলেই যে স্বৈরাচর হবে তা নয়। এটি নির্ভর করে ব্যক্তি টু ব্যক্তি, শুধু আইন চেঞ্জ করলেই সবকিছু সঠিক হয়ে যাবে না।
৩১ দফা, নাকি জুলাই সনদ, অগ্রাধিকার কী হবে
বিবিসি বাংলা: এই সংস্কারের বিষয়গুলোতে যেখানে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো নিয়ে একটা জুলাই সনদ প্রণয়নের কথা। সেটাও বাস্তবায়নের উপায়গুলো নিয়ে বা বাস্তবায়নের পথ নিয়ে দলগুলোর মধ্যে একটা বিতর্ক আছে। অনেক দল বলছে যে, নির্বাচনের আগেই আইনি ভিত্তি দেওয়া বা বাস্তবায়ন করা। আর বিএনপি বলছে, নির্বাচিত সংসদ সেটা করবে। এই জায়গাটা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী, বিএনপির চিন্তাটা এখন কী?
তারেক রহমান: দেখুন, এখানে আবার আমাকে বলতে হচ্ছে, আমরা কিন্তু কোনো হাইড এন্ড সিক করছি না। যদি আমাদের সেরকম অসৎ উদ্দেশ্য থাকত মনের ভিতরে, বলতাম আরেকটা যে ঠিক আছে, ওকে, অসুবিধা নাই। তার পরে ইনশআল্লাহ আমরা সরকার গঠনে সক্ষম হলে আমরা হয়তো করতাম না। তো আমরা যেটা মনে করছি, সেটাই বলছি।
এখন বিষয় হচ্ছে দেখুন, এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ইম্পর্টেন্ট একটি বিষয়। দেখুন, আমরা যদি ইভেন রিসেন্ট যে ঘটনা, নেপালেও যদি দেখি, আপনি দেখেন, ওরা কিন্তু এত কিছুর মধ্যে যাচ্ছে না। ওরা বলছে যে, গুরুত্বপূর্ণ যা বিষয় আছে, সংস্কার বলেন বা বিভিন্ন বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যা বিষয় আছে—নির্বাচিত প্রতিনিধি যাঁরা আসবেন, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি যাঁরা আসবেন, তাঁরা সেগুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।
তার পরেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবকিছু বিবেচনা করে রাজনৈতিক দলগুলো বসেছে, অন্তর্বর্তী সরকার আহ্বান করেছে। এখানে যতটুকু হয়েছে, আমরা বলেছি, এখন যতটুকু হয়েছে, যেগুলো শুধু আইন দিয়ে করলে হয়ে যায়, সেগুলো হয়ে যাক। যেগুলোর সাংবিধানিক এনডোর্সমেন্ট লাগবে, সেগুলো আমরা মনে করি যে, নির্বাচিত সংসদ হওয়ার পরে সেখানে গ্রহণ করাটাই ভালো হবে।
কারণ, আপনি যদি নির্বাচিত সংসদের কথা বলেন, অথচ তাকে বাদ দিয়ে যদি আপনি আউট অব দ্য বক্স কিছু করেন এবং এটা যদি রেওয়াজ হয়ে যায়, তাহলে এটা আমরা মনে করি যে, এটা সাংবিধানিকভাবে হোক, আইনগতভাবে হোক বা যে দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিবেচনা করেন না কেন, ভবিষ্যতের জন্য এটা একটি খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
সে জন্য আমরা মনে করি, যেটা দেশের জন্য সামগ্রিকভাবে ক্ষতির একটি কারণ হবে। সে জন্যই আমরা এটার সাথে একমত না।
বিবিসি বাংলা: এখন বিএনপির যেহেতু ৩১ দফা আছে, যদিও যেসব বিষয় আলোচনায় এসেছে, অনেক বিষয়ে মিল আছে। তো বিএনপি যদি ক্ষমতায় আসে বা সরকার গঠন করে, তখন ৩১ দফা নাকি জুলাই সনদ—কোনটা অগ্রাধিকার পাবে?
তারেক রহমান: আমরা যেগুলোতে একমত হয়েছি, প্রথমে আমরা সেগুলোর ওপরেই জোর দিব। সেটা আপনি যে নামেই বলেন না কেন, স্বাভাবিকভাবে আমরা ঐকমত্য কমিশনে যেগুলোতে সকলে মিলে একমত হয়েছি, আমরা প্রথমে সেগুলোতে ইনশাআল্লাহ সরকার গঠনের সুযোগ পেলে প্রথমে সেগুলোতেই অবশ্যই জোর দিব।
আর, তারপরে আপনি যেটা ৩১ দফার কথা বললেন, অবশ্যই ৩১ দফা আমাদের রাজনৈতিক কমিটমেন্ট জনগণের প্রতি। আমরা তো আমাদের ৩১ দফার মধ্যে যেগুলোর এটার সাথে মিলে গিয়েছে, সেগুলো তো আমরা করবই। এর বাইরে যেগুলো থাকবে ৩১ দফায় আছে, সেগুলোও বাস্তবায়ন করব।
কারণ ওটা তো আমাদের রাজনৈতিক কমিটমেন্ট। এটাও যেমন পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট, ওটাও আমাদের পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট। এটা আমরা রাজনৈতিক দলগুলো মিলে একত্রিত হয়ে বলেছি। ওটাও আমরা অনেকগুলো রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়েই কিন্তু ৩১ দফা দিয়েছি।
‘বিড়ালটি আমার মেয়ের’
বিবিসি বাংলা: রাজনীতি থেকে একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই। আপনাকে সম্প্রতি প্রাণী অধিকার রক্ষা নিয়ে বেশ সোচ্চার দেখা গেছে। এ-সংক্রান্ত অনুষ্ঠানে আপনি যোগ দিয়েছেন। রাজনৈতিক অনুষ্ঠানের বাইরে আপনার পোষা বিড়ালের সঙ্গে আপনার নিয়মিত ছবি দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তো এটা আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল কীভাবে?
তারেক রহমান: প্রথমত এখানে একটু ক্লিয়ার করে নেই, বিড়ালটি আমার মেয়ের। ও এখন অবশ্য সবারই হয়ে গিয়েছে। আমরা সবাই ওকে আদর করি।
বিষয়টি হচ্ছে, এরকম শুধু বিড়াল নয়, আমি এবং আমার ভাই যখন ছোট ছিলাম, আমাদের একটি ছোট কুকুরও ছিল। ইভেন, তখন আমাদের বাসায় আম্মা হাঁস-মুরগি পালতেন, ছাগলও ছিল আমাদের বাসায়। উনি ছাগলও কয়েকটি পালতেন।
তো স্বাভাবিকভাবেই আপনি যেই দৃষ্টিকোণ থেকেই বলেন, পোষা কুকুর-বিড়ালই বলেন, বাই দ্য ওয়ে কবুতরও ছিল আমাদের বাসায়। শুধু কবুতর না, আমাদের বাসায় একটি বিরাট বড় খাঁচা ছিল। সেই খাঁচার মধ্যে কিন্তু পাখি ছিল, বিভিন্ন রকমের এবং আবার আরেকটি খাঁচা ছিল, যেটার মধ্যে একটা ময়না ছিল।
ময়নাটা আমরা বরিশাল থেকে এনেছিলাম। ও আবার বরিশালি ভাষায় কথাও বলত। টুকটুক করে মাঝে মাঝে কিছু কিছু কথাও বলত। কাজেই বিষয়টি হঠাৎ করেই না। এই পশুপাখির প্রতি যে বিষয়টি, এটির সাথে আমি কমবেশি ছোটবেলা থেকে জড়িত আছি। হয়তো এটি এখন প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্নভাবে। বাট, এটির সাথে আমি বা আমার পরিবার, আমরা অনেক আগে থেকেই আছি।
কুকুর-বিড়াল ছিল, গরু-ছাগল ছিল, হাঁস-মুরগি ছিল, পাখি ছিল, ময়না ছিল, কবুতর ছিল। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যদি আমরা চিন্তা করি, আমাদের আল্লাহ সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে তৈরি করেছেন। আমাদের দায়িত্ব কিন্তু আল্লাহর সৃষ্টি যা কিছু আছে প্রকৃতির, তার প্রতি কিন্তু যত্ন নেওয়া আমাদের দায়িত্ব। এটি একটি বিষয়।
আর আমরা যদি মানবিক দৃষ্টিকোণ অথবা আমরা যদি নেচার থেকেও বিষয়টি দেখি, দেখুন, ওরা না থাকলে কিন্তু আমাদের জন্য বেঁচে থাকা কষ্টকর। প্রকৃতি যদি না থাকে, প্রকৃতির ব্যালেন্স যদি না থাকে।
এই আলোচনা শুরু হওয়ার আগে কিন্তু আপনি আমরা তিনজন কিন্তু ওয়েদার নিয়ে কথা বলছিলাম, এই ইংল্যান্ডের বা ইউকের ওয়েদার নিয়ে আমরা আলাপ করছিলাম এবং আমি বলছিলাম যে, আমার এই ১৭ বছর অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ওয়েদার মনে হয় একটু একটু এখানেও চেঞ্জ হয়েছে। আমরা দেখেছি, বাংলাদেশে পত্রপত্রিকায় দেখেছি পলিউশন ঢাকা শহরে। নরমালি আমরা জানি যে, একটি দেশের টোটাল অংশের মধ্যে এটলিস্ট ২৫ শতাংশ গ্রীন দরকার, বনায়ন দরকার। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে আমি যতটুকু জেনেছি, এটি ১২ পার্সেন্টের মতো। হুইচ ইস ভেরি ডেঞ্জারাস।
তো এগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি—কীভাবে আমরা বাড়াব। তো যেমন এগুলো আছে, ঠিক একই সাথে এই যে আপনি পশুপাখির কথা বললেন, এ বিষয়গুলো আছে নেচার। নেচারকে যদি আমরা মিনিমাম ঠিক রাখতে না পারি, সেখানে মানুষ হিসেবে কিন্তু আমাদের বসবাস করা খুব কঠিন হয়ে যাবে। কাজেই আমাদের নিজেদের স্বার্থেই এ বিষয়গুলো বোধহয় করা প্রয়োজন।
সামাজিক মাধ্যমে মিম, কার্টুন কীভাবে দেখেন
বিবিসি বাংলা: রাজনীতিতে যেমন আপনাকে নিয়ে অনেক আলোচনা আছে, স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক মাধ্যমেও আপনাকে নিয়ে অনেক আলোচনা আছে এবং আপনি যে পোস্টগুলো করেন, সেটা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। আপনাকে নিয়ে অনেক মিমও তৈরি হয়, অনেক কার্টুন হয়। যেমন—একটা মিমের কথা যদি আমি বলি, অনেকে শেয়ার করেছিল যে, আপনি আপনার সাথে আমরা জুমে কথা বলছি, আপনি জুমে বক্তব্য দেন। এটা নিয়ে একটা মিম তৈরি হয়েছে যে, ওয়ার্ক ফ্রম হোম, তো এ ধরনের মিমগুলো আপনি কীভাবে দেখেন?
তারেক রহমান: আমি এনজয় করি বেশ, বেশ আমি এনজয় করি।
বিবিসি বাংলা: আপনি দেখেন এগুলো? আপনার চোখে পড়ে?
তারেক রহমান: হ্যাঁ, চোখে পড়বে না কেন, অবশ্যই চোখে পড়ে। তবে এখানে একটি কথা আছে, যেহেতু সোশ্যাল মিডিয়ার বিষয়টি এল, আমার মনে হয় এ বিষয়ে একটু এড করা উচিত।
দেখুন, সোশ্যাল মিডিয়া এমন একটি বিষয়, আমি নিজেও আছি সোশ্যাল মিডিয়ায় কমবেশি। বহু বহু মানুষ আছেন, লক্ষকোটি মানুষ আছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। এটি দিয়ে যেমন খুব দ্রুত একজনের সাথে আরেকজনের যোগাযোগ করা যায়।
আমরা মাঝে মাঝে বলি যে, দেখেন, অনেক সময় অনেক আলোচনায় আসে, সেমিনার-বক্তব্যে আসে যে, ডিনামাইটটা যখন আবিষ্কৃত হয়, ডিনামাইটটা আবিষ্কৃত হয়েছিল আপনার পাহাড় ভেঙে কীভাবে মানুষের চলাচলের জন্য রাস্তাঘাট তৈরি করা যায়; হয়তো কীভাবে চাষের জমি করা যায়। এরকম লক্ষ্য সামনে রেখেই, উদ্দেশ্য সামনে রেখেই কমবেশি ডিনামাইটের ব্যবহারটা শুরু হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা দেখেছি, এটি মানুষ হত্যার মতো জঘন্য কাজেও ব্যবহার করা হয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে আমি বলতে চাই যে, অবশ্যই প্রত্যেক মানুষের অধিকার আছে। যেহেতু আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। মানুষের বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতায় আমরা বিশ্বাস করি। প্রত্যেক মানুষের অধিকার আছে তার মতামত প্রকাশ করার।
তবে আমরা যদি সকলে এতটুকু সচেতন হই যে, আমি আমার মত প্রকাশ করলাম, কিন্তু এই মত প্রকাশের ফলে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলো কি না—এ বিষয়টিকে যদি আমরা বিবেচনায় রাখি, একটি মানুষ ক্ষতির সম্মুখীন হলো কি না, ক্ষতিগ্রস্ত হলো কি না—এসব বিষয় বোধহয় আমাদের বিবেচনায় রাখা উচিত; এটি এক নম্বর।
দ্বিতীয়ত হচ্ছে, সোশ্যাল মিডিয়ার বহুল ব্যবহারের ফলে ডিসইনফরমেশন বা মিসইনফরমেশন বিষয়টিও চলে এসেছে সামনে। এ কথাও চলে এসেছে। একটি জিনিস আমি দেখলাম বা শুনলাম, সাথে সাথেই আমি সেটিতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। তা না করে আমার মনে হয়, ফ্যাক্ট চেক বলে যেই কথাটি আছে সোশ্যাল মিডিয়ায়, এটা সব জায়গায় আছে—এ ব্যাপারেও যদি আমরা একটু অ্যালার্ট থাকি সবাই, এ ব্যাপারে যদি একটু সচেতন থাকি যে ঠিক আছে, এটি একটু যাচাইবাছাই করে নিই।
যদি সত্য হয়, অবশ্যই আমার সেখানে মতামত থাকবে। কিন্তু যদি মিথ্যা হয় বিষয়টি, কেন আমি এখানে মতামত দিব? একটি মিথ্যার সাথে আমি কেন নিজেকে সংশ্লিষ্ট করব? একটি খারাপ কিছুর সাথে কেন আমি নিজেকে সংশ্লিষ্ট করব? এটি আমি আমার মতামতটা প্রকাশ করলাম।
মানুষের আস্থার প্রশ্নে যা বললেন
বিবিসি বাংলা: আমরা প্রায় শেষ দিকে চলে এসেছি। আমি একটা প্রশ্ন করতে চাই যে, রাজনৈতিক পট পরিবর্তন যেটা হয়েছে গত বছরের ৫ আগস্ট। তারপর থেকে বিএনপির পক্ষ থেকে যেসব বক্তব্য বা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো বাস্তবায়ন হবে—এই প্রশ্নে মানুষকে কীভাবে আস্থায় নেবেন?
তারেক রহমান: এই প্রশ্নের উত্তরে যদি একটু এভাবে বলি, স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক দল হিসেবে তো আমাদের একটি পরিকল্পনা আছে। আপনাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে আমি কিছু কিছু বলেছি।
ব্যাপারটা হচ্ছে এরকম যে, দেখুন এই মুহূর্তে মাঠে আমরা যেই রাজনৈতিক দলগুলো আছি, আমরা ধরে নিতে পারি, সেই রাজনৈতিক দলগুলো ইনশআল্লাহ আগামীতে দেশ পরিচালনা করতে পারে। তার মধ্যে বিএনপিরই কিন্তু দেশ পরিচালনার অভিজ্ঞতা আছে।
আপনাকে যদি বলি, ধরেন এখন লন্ডন আসবেন। তো আপনি একটা প্লেনে উঠলেন। যে প্লেন চালাবে, সে যদি আপনাকে বলে যে ভাই কিছু মনে করেন না, আমার ঠিক লাইসেন্সটা হয়নি এখনো, তবে আমার মনে হয় আমি চেষ্টা করলে আপনাকে নিয়ে যেতে পারব লন্ডন পর্যন্ত উড়িয়ে। আপনি কি তার সাথে উঠবেন প্লেনে? নিশ্চয়ই আপনি উঠবেন না।
আপনি একজন অভিজ্ঞ ড্রাইভারের সাথে উঠতে পারেন। কিন্তু অভিজ্ঞ ড্রাইভারও গাড়ি হয়তো ঠিকই চালাচ্ছে সেফলি, কিন্তু রাস্তায় তো গর্ত খানাখন্দ থাকবেই, একটু জার্কিং হতেই পারে। জোরে অনেক সময় ব্রেক হতেই পারে, ঝাঁকুনি লাগতেই পারে, কিন্তু অভিজ্ঞ ড্রাইভার আপনাকে মোটামুটি ঠিকভাবে নিয়ে যাবে। নিয়ে যাওয়ার সর্বোচ্চ সে চেষ্টা করবে। কারণ তার সেই অভিজ্ঞতা আছে।
কাজেই আমরা যদি দেখি যে, ভালো কাজ বা কমিটমেন্ট আপনি যেটা বলেন, বিএনপি করবে কি না। আমরা তো করেছি। হতে পারে আমাদের দ্বারা কিছু ভুল-ত্রুটি হয়েছে।
আপনি একটু আগে একটা কথা বলেছিলেন, মানুষ তো অতীত থেকেই শিখে। ইয়েস, আমরাও দেখেছি, আমরাও অতীত থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি যে ঠিক আছে এই কাজটি এভাবে করলে হয়তো ভুল হয়, এটি আমরা ভবিষ্যতে ইনশাআল্লাহ করব না। বাট আমাদের অভিজ্ঞতা আছে, অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা ভালো-মন্দ যাচাই করতে পারব।
একই সাথে আমাদের কমিটমেন্ট আছে, যে কমিটমেন্ট দিয়ে আমরা ডেলিভারি করতে পারব এবং আমরা ডেলিভারি করতে চাই।
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে বিএনপির অবস্থান
বিবিসি বাংলা: শেষ প্রশ্নটি করি তাহলে আপনাকে এবং ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়েই। বিগত সরকারের আমলে তাদের একটা বিষয় বড় সমালোচনা ছিল যে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ। আপনারা যদি ক্ষমতায় আসেন, সে ক্ষেত্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদ বা সংবাদমাধ্যমের ওপর দমন-পীড়নের বিষয়গুলো যে আর হবে না, সেই নিশ্চয়তা কি আপনি দিতে পারেন?
তারেক রহমান: জ্ব, ইয়েস পারি। একদম দিতে পারি। আপনি ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত পত্রপত্রিকা খুলুন। আমি কারও নাম উল্লেখ করব না, কোনো পত্রিকার কথা উল্লেখ করব না। শুধু খুলে দেখুন কীভাবে অনেক খবর ছাপা হয়েছিল, যার সত্যতা কিন্তু ছিল না, অপপ্রচার ছিল। কিন্তু অপপ্রচারটা সংবাদ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
আপনি কি শুনেছেন, আপনি কি আমাকে প্রমাণ দিতে পারবেন, বলতে পারবেন যে বিএনপির সময়, আমি কিন্তু বলতে পারব অনেক অনেক সাংবাদিকের নাম, যাঁরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন স্বৈরাচারের সময় এবং পরবর্তীতে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। ইভেন, এখনো অনেকে প্রবাসজীবনে আছেন, এরকম বহু সাংবাদিক।
আমি বলতে পারব, স্বৈরাচারের সময় বহু সাংবাদিককে বিভিন্ন জায়গা থেকে ফোন করে বিভিন্ন রকম ভয়ভীতি প্রদর্শন ও ধমক দেওয়া হতো। বিএনপির সময় এগুলো করা হয়নি, কারণ তখন সংবাদপত্রে যে খবরগুলো প্রকাশিত হয়েছে তৎকালীন বিএনপি সরকার সম্পর্কে, আমার সম্পর্কে যে খবরগুলো প্রকাশিত হয়েছে, যদি ওই রকম হতো, তাহলে কিন্তু ওরকম খবর প্রকাশিত হতো না।
অর্থাৎ, বিএনপির সময় যদি অত্যাচার-নির্যাতন থাকত, তাহলে খবরগুলো প্রকাশিত হতো না স্বাভাবিকভাবে, যা হয়নি বিগত সরকারের সময় স্বৈরাচার সরকারের সময়। কাজেই আপনাকে আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, বিএনপির অতীত সরকারের সময় যেরকম সাংবাদিকদের গুম করা হয়নি। সাংবাদিকদের নির্যাতন করা হয়নি। সাংবাদিকদের দেশ ছেড়ে যেতে হয়নি, বাধ্য হতে হয়নি। ইনশআল্লাহ ভবিষ্যতেও হবে না।
বিবিসি বাংলা: তাহলে কি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ করে—এ ধরনের যে আইনগুলো রয়েছে, সেগুলো আপনারা বাতিল করবেন, এটা কি ধরে নেওয়া যায়?
তারেক রহমান: অবশ্যই, আমরা সকলে মিলে বসব, আলোচনা করব। আপনাদের মতো সাংবাদিকসহ যাঁরা আছেন, তাঁদের সাথে আলোচনা করব। আলোচনা করে সেগুলো এরকম কালো আইন যা যা আছে, আমরা আস্তে আস্তে ঠিক করব।
তবে এখানে বোধহয় একটি বিষয় আবার আমাকে উল্লেখ করতে হয়, যেটি আমি সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে বলেছি। দেখুন, এটি তো সবাইকে মিলে করতে হবে। অপপ্রচারকে তো অবশ্যই সংবাদ হিসেবে তো প্রচার করা ঠিক নয়, তাই না?
আমাদের কাছে আপনাদের যেরকম চাওয়া থাকবে, ভবিষ্যৎ সরকারের কাছে, যারাই আসুক সরকারে, রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমাদেরও অনুরোধ থাকবে আপনাদের প্রতি যে অপপ্রচার সংবাদ হিসেবে যেন প্রচারিত না হয়—এ বিষয়টি একটু সকলকে সচেতন বা খেয়াল রাখতে হবে।
বিবিসি বাংলা: তারেক রহমান, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ বিবিসি বাংলার সাথে কথা বলার জন্য।
তারেক রহমান: আপনাদেরও অনেক ধন্যবাদ। আপনাদের প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আমার কথাগুলো দেশের মানুষের সামনে আমি তুলে ধরতে পেরেছি। সেই সুযোগটুকু আপনারা করে দিয়েছেন, তার জন্য আপনাদের আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ।
বিবিসি বাংলা: এখন বাংলাদেশের সরকার পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার, তাদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?
তারেক রহমান: বিষয়টি তো রাজনৈতিক। এটি তো কোনো ব্যক্তির বিষয় নয়। আমরা প্রথম থেকে যে কথাটি বলছি, আমরা চাই এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সফল হোক। অর্থাৎ, অনেক কিছুর মতো বিভিন্ন বিষয় আছে। যেমন—আমরা যদি মূল দুটো বিষয় বলি যে, কিছু সংস্কারের বিষয় আছে, একই সাথে প্রত্যাশিত সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, স্বাধীন নির্বাচনের একটি বিষয় আছে।
মূলত কিছু সংস্কারসহ যে সংস্কারগুলো না করলেই নয়, এরকম সংস্কারসহ একটি স্বাভাবিক সুষ্ঠু, স্বাধীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত করাই হচ্ছে বর্তমান সরকারের মূল লক্ষ্য। আমরা প্রত্যাশা করি, ওনারা উনাদের ওপরে যেটা মূল দায়িত্ব, সেটি ওনারা সঠিকভাবে সম্পাদন করবেন। এটাই তো তাঁদের কাছে আমাদের চাওয়া রাজনৈতিক দল হিসেবে।
আমরা আশা রাখি, প্রত্যাশা করি যে, ওনারা কাজটি সুন্দরভাবে করবেন। স্বাভাবিকভাবে এই কাজের সৌন্দর্য বা কতটুকু ভালো, কতটুকু ভালো বা মন্দভাবে করতে পারছেন, তার ওপরেই মনে হয় সম্পর্কের উষ্ণতা বা শীতলতা যেটাই বলেন, সেটা নির্ভর করবে।
বিবিসি বাংলা: আপনি কয়েক মাস আগে একটি মন্তব্য করেছিলেন যে, অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। আপনার এই মন্তব্য নিয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, এ বিষয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া কী? তিনি তখন বলেছিলেন, সন্দেহটা ওনার মনে। অর্থাৎ, আপনার মনে সন্দেহ আছে কি না, সেটা তিনি জানতে চান। আপনার মনে কি সেই সন্দেহ আছে?
তারেক রহমান: দেখুন, আমি যখন কথাটি বলেছিলাম, এই মুহূর্তে আমার যতটুকু মনে পড়ে, সেই সময় পর্যন্ত ওনারা কিন্তু নির্বাচনের ব্যাপারে সঠিক কোনো টাইম ফ্রেম বা কোনো কিছু বলেননি।
রোডম্যাপ বলতে যা বোঝায়, আমরা নরমালি যা বুঝে থাকি, এরকম কিছু বলেননি। এবং সে কারণেই শুধু আমার মনের মধ্যেই নয়, আমরা যদি সেই সময় বিভিন্ন মিডিয়া দেখি, বিভিন্ন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব দেখি, যাঁরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় আলোচনা করেন রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে, প্রায় সবার মনের মধ্যেই সন্দেহ ছিল।
আমরা যখন দেখলাম যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান ডক্টর ইউনূস, উনি মোটামুটিভাবে একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করলেন। এবং পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকবার উনি ওনার যে সিদ্ধান্ত, সেটির ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তারপর থেকেই খুব স্বাভাবিকভাবেই এই সন্দেহ বহু মানুষের মন থেকে ধীরে ধীরে চলে যেতে ধরেছে।
আমি মনে করি, ওনারা যা বলেছেন, ওনারা যতক্ষণ পর্যন্ত দৃঢ় থাকবেন, ওনাদের বক্তব্যে, ওনাদের কাজে যত বেশি দৃঢ় থাকবেন, ততই সন্দেহ চলে যাবে আস্তে আস্তে।
বিবিসি বাংলা: সেই সন্দেহ মনে কিছুটা দূরীভূত হয়েছিল লন্ডনে যখন তিনি আপনার সঙ্গে বৈঠক করলেন। তার পরেই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কথা এসেছিল। তো সেই বৈঠকে নির্বাচনের কথা তো হয়েছিল, যেহেতু সেটি পরে এসেছে। এর বাইরে কি আপনাদের মধ্যে আর কোনো কথা হয়েছে? আর কোনো বিষয়ে কোনো চিন্তাভাবনা বা সমঝোতা কিছু হয়েছে?
তারেক রহমান: এর বাইরে স্বাভাবিকভাবেই উনি একজন অত্যন্ত স্বনামধন্য মানুষ। অত্যন্ত বিজ্ঞ মানুষ উনি। এর বাইরে তো অবশ্যই স্বাভাবিকভাবে সৌজন্যমূলক কথাবার্তা হয়েছে। এর বাইরেও উনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন যে, জনগণ যদি আপনাদের সুযোগ দেয়, তাহলে আপনারা কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য—এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
আমার কিছু চিন্তাভাবনা দেশের মানুষকে নিয়ে, দেশের জনগণকে নিয়ে, দেশকে নিয়ে আমরা যদি সুযোগ পাই, জনগণ আমাদের যদি সেই সুযোগ দেন, তাহলে আমরা কী কী বিষয়ে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করব, সে বিষয়গুলো নিয়ে কিছু কিছু আলোচনা হয়েছে।
বিবিসি বাংলা: নির্বাচনের বিষয়টি তো আপনি বললেন, এর বাইরে সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে, দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে গত এক বছরে যে ভূমিকা রেখেছে অন্তর্বর্তী সরকার, সেটাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
তারেক রহমান: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মানে ইন্টেরিম, মানে এটা তো ক্ষণস্থায়ী বিষয়। তো খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি দেশ পরিচালনা তো একটি বিশাল বিষয়। আমরা হয়তো ভূখণ্ডের ভিত্তিতে যদি বিবেচনা করি, হয়তো বাংলাদেশকে অনেকে বলবে ছোট দেশ। কিন্তু আমরা যদি জনসংখ্যার ভিত্তিতে বিবেচনা করি, বাংলাদেশ পৃথিবীর অনেক ভূখণ্ডের চেয়ে বড় দেশ।
ইউকের (যুক্তরাজ্য) জনসংখ্যা ৭ কোটির মতো, বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্লাস-মাইনাস ২০ কোটির মতো এখন। কাজেই ইউকের তিন গুণ বড়। এরকম একটি দেশ পরিচালনা করতে হলে স্বাভাবিকভাবেই জনগণের ম্যান্ডেটসহ একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক সরকার প্রয়োজন। বিভিন্ন বিষয় থাকে, ইস্যুজ থাকে, বিভিন্ন বিষয় আছে।
তো এখন নির্বাচনের বাইরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পারফরমেন্স আপনি যেটা বললেন, আমরা সবকিছু বিবেচনা করলে আমার কাছে মনে হয়েছে যে, হয়তো ওনারা চেষ্টা করেছেন অনেক বিষয়ে। সব ক্ষেত্রে সবাই তো আর সফল হতে পারে না, স্বাভাবিকভাবে ওনাদের লিমিটেশনস কিছু আছে। সেই লিমিটেশনসের মধ্যে ওনারা হয়তো চেষ্টা করেছেন, যতটুকু পেরেছেন হয়তো চেষ্টা করছেন।
এক এগারোর সরকার নিয়ে মূল্যায়ন কী?
বিবিসি বাংলা: আমি একটু পিছনে তাকাতে চাই।
তারেক রহমান: ভাই, আমরা তো সামনে যেতে চাই। আপনি পেছনে কেন যাচ্ছেন? দেশকে সামনে নিতে হবে।
বিবিসি বাংলা: মানে, পেছন থেকেই তো শিক্ষা নিয়ে সামনে এগোতে হয়। তো পেছনের একটা বিষয়, সেটা হচ্ছে, এক-এগারোর সরকার বা সেনাসমর্থিত সরকারের সেই সময়টা নিয়ে রাজনীতিতে অনেক আলোচনা আছে। সে সময়টাকে ঘিরে আপনার মূল্যায়ন কী?
তারেক রহমান: এক বাক্যে বা সংক্ষেপে যদি বলতে হয়, এক-এগারোর সরকার তো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটি সরকার ছিল।
আমরা দেখেছি, সেই সরকার আসলে কীভাবে দেশের যতটুকু যেমনই হোক বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে যতটুকুই রাজনীতি গড়ে উঠেছিল, গণতান্ত্রিক ভিত্তি ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিল ভুল-ত্রুটি সবকিছুর ভিতর দিয়েই। কিন্তু আমরা দেখেছি যে, কীভাবে তারা সবকিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিল, বিরাজনীতিকরণ করতে চেয়েছিল। দেশকে একটি অন্ধকার দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। পরবর্তী সময়ে দেখেছি যে, খুব সম্ভবত তাদেরই ভিন্ন আরেকটি রূপ; অন্যভাবে দেখেছি আমরা ’ইন দ্য নেম অব ডেমোক্রেসি’।
বিএনপির রাজনীতিতে পরিবর্তন হয়েছে কতটা
বিবিসি বাংলা: ২০০৪ সালে আমি আপনার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম ঢাকায়। সে সময় আপনি বলেছিলেন যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি পরিবর্তন আনার চেষ্টা করবেন। তো বিএনপির রাজনীতিতে আসলে কতটা পরিবর্তন হয়েছে; ভবিষ্যৎ বিএনপিই বা কেমন হবে?
তারেক রহমান: আমাদের রাজনীতির মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণ, দেশ এবং দেশের সার্বভৌমত্ব। আমরা দুটো বিষয় নিয়ে বাংলাদেশে খুবই গর্ব করি, অহংকার করি। একটি হচ্ছে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প, আরেকটি হচ্ছে প্রবাসীরা দিন-রাত পরিশ্রম করে যে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পাঠান—এ দুটোই কিন্তু বিএনপি শুরু করেছিল।
আমরা দেখেছি, বিএনপির সময়ে শুরু হয়েছিল প্রবাসীদের বিদেশ যাওয়া, একই সাথে গার্মেন্ট শিল্পের প্রসার। এর বাইরেও যদি আমরা দেখি, ১৯৭৪ সালে যে দুর্ভিক্ষটা হয়েছিল, পরবর্তীতে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেলেন, আমরা দেখেছি কীভাবে ধীরে ধীরে দুর্ভিক্ষপীড়িত একটি দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসপূর্ণ করে শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণ না, অল্প পরিমাণ করে হলেও আমরা কিন্তু সেই সময় বিদেশে খাদ্য রপ্তানি, চাল রপ্তানি করেছিলাম।
আর রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে যদি আমরা দেখি, যেখানে একসময় সকল দলকে নিষিদ্ধ করে একটি দল বাকশাল করা হয়েছিল। আমরা দেখেছি যে, বিএনপির কাঁধে যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পড়ে, তখন কীভাবে বহুদলীয় গণতন্ত্রের চালু আবার করা হয়েছিল।
কাজেই আপনি বললেন, অতীত থেকে শিক্ষা নিতে হবে। ইয়েস, আমরা অতীতে এই ভালো কাজগুলো করেছি। ভবিষ্যতে ইনশাআল্লাহ এ বিষয়গুলো কনসিডারেশন (বিবেচনায়) রেখেই সামনে এগিয়ে যাব। আমাদের অন্যতম মূল লক্ষ্য হবে ভবিষ্যৎ বিএনপির গণতন্ত্রের যে বুনিয়াদ, একটি শক্তিশালী বুনিয়াদ তৈরি করা। জবাবদিহি তৈরি করা।
বিবিসি বাংলা: কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা অভিযোগ সব সময় থাকে। যখন যারা চেয়ারে বসে, জবাবদিহিতার প্রশ্নটা তখন থাকে না। মানে, এড়িয়ে যায়—এ ধরনের একটা অভিযোগ সব সময় ছিল। সব রাজনৈতিক দল বা যারাই সরকারে এসেছে।
তারেক রহমান: দেখুন, অভিযোগ থাকতেই পারে। আমি আগেই তো বলেছি, একটি বিষয়ে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন রকম অভিযোগ থাকতে পারে। এখন অভিযোগ নিয়ে তো আর বলা যাবে না। কিন্তু অভিযোগটা কনসিডারেশনে (বিবেচনায়) অবশ্যই রাখব। আপনি যেহেতু আমার কাছে জানতে চেয়েছেন, আমি আপনাকে এটাই বলেছি। আপনি জানতে চেয়েছেন ভবিষ্যৎ কেমন হবে।
আমি আমার অভিজ্ঞতা দিয়ে যা দেখেছি, বুঝেছি, জেনেছি, আমি আপনার সামনে সেটিই তুলে ধরলাম। অভিযোগ এ দেশেও আছে, কিন্তু আপনি যা জানতে চাইছেন, এটি তো আমি একমাত্র সুযোগ যদি পাই, আমি ইনশআল্লাহ সুযোগ পেলে পরে তখন আস্তে আস্তে জিনিসটি প্রমাণ করা সম্ভব হবে।
হ্যাঁ, এটাও বাস্তবতা। প্রাগমেটিক কথা যেটা, বাস্তব কথা যেটা, আমি সুযোগ পেলে যে সাথে সাথেই বিষয়টি হবে তা না। কারণ, আমি সুযোগ পেলে আপনাকেও বুঝতে হবে। আপনিও কিন্তু দেশ গঠনের একটা পার্ট। কাজেই আপনার মতো এরকম লক্ষকোটি মানুষকে বিষয়টি বুঝতে হবে। এতটুকু বলতে পারি যে, ইয়েস, উই আর কমিটেড। উই উইল ট্রাই আওয়ার বেস্ট টু ডু পারফরম বেস্ট ডু দ্যাট।
বিবিসি বাংলা: জবাবদিহির কথা বলছিলেন। এ প্রসঙ্গে বলি, গত ১৫ বছর আপনি নির্বাসনে থেকে দলকে নেতৃত্ব দেওয়ায়, এটা একটা ভিন্ন পরিস্থিতি। নেতৃত্ব নিয়ে আপনার চিন্তাধারায় কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে? আপনি কী অনুভব করেন, অনুধাবন করেন?
তারেক রহমান: গত ১৭ বছর প্রবাসজীবনে আছি এবং অনেকগুলো বছর আমি বাংলাদেশের সাথে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা টাইম ডিফারেন্স, ডিস্টেন্স ডিফারেন্স তো আছেই। রিচিং ডিফারেন্স তো একটা ডিফিকাল্টিস তো আছেই। এটি একটি বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই আমি আমার পরিবার অর্থাৎ, আমার স্ত্রী এবং আমার সন্তানকে এখানে ধন্যবাদ দিতে চাই। কারণ তাদের সহযোগিতা না থাকলে হয়তো এই ডিফিকাল্ট কাজটি করা আমার জন্য আরও ডিফিকাল্ট হতো। ওনাদের সহযোগিতা ছিল, সে জন্য আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছে।
একই সাথে আমি আবারও ধন্যবাদ দিতে চাই আমার হাজারো-লক্ষ নেতাকর্মীকে। যাঁরা এই ডিফিকাল্টিজের মধ্যে থেকেও আমাকে সহযোগিতা করেছেন দলকে সুসংগঠিত রাখতে, দলকে রাজপথে নিয়ে যেতে শত অত্যাচার, বাধাবিঘ্নের মাঝেও জনগণের কথা তুলে ধরতে, জনগণের দাবির ব্যাপারে সোচ্চার থাকতে। আপনি জিজ্ঞেস করেছেন মনে হয় যে, এখানে (যুক্তরাজ্যে) থেকে কী কী দেখেছি, শিখেছি বা জেনেছি। আমি মনে করি, এই দেশ থেকে ভালো যা কিছু দেখেছি বা শিখেছি। দেশের নাগরিক হিসেবে এবং যেহেতু আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী, হয়তো আমার একটি সুযোগ আছে দেশের জন্য ভালো কিছু করার।
যদি আমি ইনশাআল্লাহ সেই সুযোগ পাই, তাহলে যতটুকু সম্ভব দেশের মানুষের জন্য বা দেশের জন্য কিছু করার, এভাবে বিষয়টিকে আমি বিবেচনা করি।
কূটনীতির ক্ষেত্রে বিএনপির মূলনীতি কী হবে?
বিবিসি বাংলা: কূটনীতির প্রসঙ্গে আসি। বিএনপি যদি সরকার গঠন করে, তাহলে কূটনীতির ক্ষেত্রে বিএনপির মূলনীতি কী হবে?
তারেক রহমান: গুড কোশ্চেন। বিএনপির মূলনীতি একটাই—সবার আগে বাংলাদেশ। কূটনীতির ক্ষেত্রে বিএনপির নীতি সবার আগে বাংলাদেশ। আমার জনগণ, আমার দেশ, আমার সার্বভৌমত্ব। এটিকে অক্ষুণ্ন রেখে, এর স্বার্থ বিবেচনা করে, এই স্বার্থকে অটুট রেখে বাকি সবকিছু।
বিবিসি বাংলা: এটাকে বৈশ্বিক রাজনীতির একটা প্রভাব বলা যায়? কারণ আপনি যদি বিভিন্ন দেশে দেখেন, এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্পও আমেরিকা ফার্স্ট একটা স্লোগান দিয়ে এসেছিলেন।
তারেক রহমান: না, ওদেরটা ওরা বলেছে, আমি ভাই বাংলাদেশি। আমার কাছে বাংলাদেশের স্বার্থ বড়, আমার কাছে বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থ বড়। কাজেই কে কী বলল...সবার আগে বাংলাদেশ, সিম্পল, কমপ্লিকেট (জটিল) করার কিছু নাই, এটা সিম্পল ব্যাপার।
ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে অবস্থান কী?
বিবিসি বাংলা: বিগত সরকারের সময় বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে যে সম্পর্ক ছিল, সেটা নিয়ে অনেক সমালোচনা রয়েছে। তো ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে আপনাদের নীতি কী হবে?
তারেক রহমান: আমার মনে হয়, আপনি একটু আগে যে প্রশ্নগুলো করেছেন, সেখানে বোধহয় আমি ক্লিয়ার করেছি পুরো ব্যাপারটা। সবার আগে বাংলাদেশ। এখানে তো আপনি পার্টিকুলার (সুনির্দিষ্ট) একটি দেশের কথা বলেছেন।
এখানে ওই দেশ বা অন্য দেশ তো বিষয় না। বিষয় তো হচ্ছে, ভাই, বাংলাদেশ আমার কাছে আমার স্বার্থ, আমি আগে আমার দেশের মানুষের স্বার্থ দেখব, আমার দেশের স্বার্থ দেখব। ওটাকে আমি রেখে আপহোল্ড করে আমি যা যা করতে পারব, আমি তা-ই করব।
বিবিসি বাংলা: বাংলাদেশের স্বার্থ আপনারা সবার আগে নেবেন, সেটা আপনি পরিষ্কার করেছেন। ভারতের কথা বিশেষভাবে আসছে, যেহেতু সেটি বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ এবং বাংলাদেশের তিন পাশেই এই দেশের সীমান্ত রয়েছে। এবং এটি নিয়ে আপনিও জানেন যে, বিভিন্ন সময়ে কথা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও কথা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সময় তো সম্পর্ক নিয়ে বললামই, সেটা নিয়ে কথা হয়েছে। তাদের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত বা কেমন থাকা প্রয়োজন—এ নিয়ে আপনার চিন্তা কী?
তারেক রহমান: অবশ্যই আমি আমার পানির হিস্যা চাই। অবশ্যই আমি দেখতে চাই না যে, আরেক ফেলানী ঝুলে আছে। অবশ্যই আমরা এটা মেনে নিব না।
বিবিসি বাংলা: বাংলাদেশের স্বার্থের প্রসঙ্গে আপনি বলছেন যে, পানির হিস্যা চাওয়া এবং সীমান্ত হত্যার বিষয়টি নিয়ে আপনারা সোচ্চার থাকবেন।
তারেক রহমান: না না, আমি উদাহরণ দিয়ে বললাম। দুটো উদাহরণ দিয়ে বোঝালাম আপনাকে যে আমাদের স্ট্যান্ডটা কী হবে। আমরা আমাদের পানির হিস্যা চাই। অর্থাৎ আমার দেশের হিস্যা, মানুষের হিস্যা আমি চাই, হিসাব আমি চাই।
আমার যেটা ন্যায্য, সেটা আমি চাই। অবশ্যই ফেলানী হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে আমি বোঝাতে চেয়েছি যে, আমার মানুষের ওপরে আঘাত আসলে অবশ্যই সেই আঘাতকে এভাবে আমি মেনে নেব না।
বিবিসি বাংলা: একটা বিষয় যদি বলি, ৫ অগাস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এবং আপনিও জানেন যে, শেখ হাসিনা দিল্লিতে গেছেন এবং সেখানে আছেন। ভারতের সাথে একটা সম্পর্কের শীতলতা দেখা গেছে গত এক বছর ধরে। যেমন ধরুন, সেটি যাওয়া-আসার ক্ষেত্রে, ব্যবসার ক্ষেত্রে নানা রকম, সেই ক্ষেত্রে কি কোনো পরিবর্তন আপনারা সরকারে এলে হবে বা পরিবর্তনের ব্যাপারে উদ্যোগ নেবেন—এমন কোনো চিন্তা কি আপনাদের আছে?
তারেক রহমান: এখন তারা যদি স্বৈরাচারকে সেখানে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের বিরাগভাজন হয়, সেখানে তো আমাদের কিছু করার নেই। এটা বাংলাদেশের মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তাদের সাথে শীতল থাকবে। সো, আমাকে আমার দেশের মানুষের সাথে থাকতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর সংসদ ও দলীয় নেতৃত্বের প্রশ্নে যা বললেন
বিবিসি বাংলা: সংস্কারের প্রশ্নে আসি। এখন খুব আলোচিত ইস্যু। সংস্কারের কিছু বিষয়ে দেখা যাচ্ছে যে, বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দলের কিছুটা মতপার্থক্য বা মতবিরোধ হচ্ছে। যেমন—এক ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা বা দলের প্রধান থাকতে পারবেন না, এরকম একটা প্রস্তাব এসেছে, যেখানে বিএনপি নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। যদি এক ব্যক্তি তিন পদে একই সাথে থাকেন, সেটা স্বৈরতান্ত্রিক একটা ব্যবস্থা তৈরির সুযোগ দেয় কি না?
তারেক রহমান: সকলের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, এই যে বাংলাদেশে রাষ্ট্র মেরামতের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার প্রয়োজন। একজন ব্যক্তি দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না, থাকবেন না—এরকম আরও যে বিষয়গুলো আছে, এগুলো বাংলাদেশে যখন স্বৈরাচার ছিল তাদের মুখের ওপরে, তাদের চোখের দিকে চোখ রেখে আমরা বিএনপিই বলেছিলাম।
এখন হয়তো অনেকে সংস্কারের কথা বলছেন। সেদিন কিন্তু সংস্কারের ’স’-ও তারা বলেননি। তার পরেও সকলের প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে আমি বলতে চাই যে, বিএনপি ’নোট অব ডিসেন্ট’ দিলে সেটি সমস্যা, অর্থাৎ বিএনপিকে অ্যাগ্রি (সম্মত) করতে হবে সবার সাথে, তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু বিএনপি যদি কোনোটার সাথে একমত না হয়, তাহলে বেঠিক। এটি তো গণতন্ত্র হলো না।
মানে, আমাকে অন্যের সাথে একমত হতে হবে, তাহলে গণতন্ত্র। আমি যদি অন্যের সাথে দ্বিমত করি, তাহলে গণতন্ত্র না। এটি কেমন গণতন্ত্র? কারণ গণতন্ত্রের মানেই তো হচ্ছে, বিভিন্ন মতামত থাকবে। আমরা অনেক ব্যাপারেই একমত হব হয়তো। সকল ব্যাপারে একমত হবো না, কিছু ব্যাপারে হয়তো দ্বিমত থাকতেই পারে। এটাই তো গণতন্ত্র, এটাই তো এসেন্স অব গণতন্ত্র।
আমরা তো কোনো হাইড অ্যান্ড সিক করছি না। আমি যেটা মনে করছি যে ভাই, আমি মনে করছি যেটা আমার দৃষ্টিতে ঠিক না, আমি বলছি ঠিক না।
বিবিসি বাংলা: কিন্তু দুই বছর আগে ২০২৩ সালে আপনারা ৩১ দফা দিয়েছেন। সেই ৩১ দফাতেই আপনারা সংস্কারের যেসব বিষয় এনেছেন, সেখানে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনার কথা বলেছেন। তাহলে এ বিষয়গুলোতে আপত্তি কেন?
তারেক রহমান: না, আমরা যেটাতে বলেছিলাম, আমরা সেখানে এখনো আছি। যতটুকু ভারসাম্য হওয়া উচিত, যে যে বিষয়ে যতটুকু বিবেচনা করা উচিত, আমরা সে বিষয়ের মধ্যে এখনো কমবেশি আছি। আমাদের অবস্থান থেকে তো আমরা অবস্থান পরিবর্তন করিনি।
বিবিসি বাংলা: কিন্তু মূল যে বিষয়গুলো, যেমন যেটা বড় বিরোধ হিসেবে আসছে, বড় মতপার্থক্য হিসেবে আসছে যে, এক ব্যক্তির তিন পদে একসাথে থাকা, সেখানেই তো আপত্তিটা থাকছে বিএনপির।
তারেক রহমান: না, আমরা তো তখনো বলিনি যে এক ব্যক্তি তিন পদে থাকতে পারবে না। এটা অন্যরা কেউ বলেছে যে, এক ব্যক্তি তিন পদে থাকতে পারবে না। আমরা মনে করি না যে, এটাতে স্বৈরাচারী হওয়ার কোনো কারণ আছে।
আমরা তো দেখেছি, স্বৈরাচারের সময়ও এবং তার আগে তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু তাদের টু থার্ড মেজরিটি ছিল। টু থার্ড মেজরিটি ২০০৮ সালে তারা নিয়েছিল। তারা ওটাকে চেঞ্জ করে ফেলেছে। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা রাখেনি।
২০০১ সালে তো বিএনপিরও টু থার্ড মেজরিটি ছিল, বিএনপি তো চেঞ্জ করেনি। যেহেতু জনগণ মনে করে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকলে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে; বিএনপি টু থার্ড মেজরিটি থাকার পরেও তো চেঞ্জ করেনি।
কাজেই এক ব্যক্তির হাতে থাকলেই যে স্বৈরাচর হবে তা নয়। এটি নির্ভর করে ব্যক্তি টু ব্যক্তি, শুধু আইন চেঞ্জ করলেই সবকিছু সঠিক হয়ে যাবে না।
৩১ দফা, নাকি জুলাই সনদ, অগ্রাধিকার কী হবে
বিবিসি বাংলা: এই সংস্কারের বিষয়গুলোতে যেখানে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো নিয়ে একটা জুলাই সনদ প্রণয়নের কথা। সেটাও বাস্তবায়নের উপায়গুলো নিয়ে বা বাস্তবায়নের পথ নিয়ে দলগুলোর মধ্যে একটা বিতর্ক আছে। অনেক দল বলছে যে, নির্বাচনের আগেই আইনি ভিত্তি দেওয়া বা বাস্তবায়ন করা। আর বিএনপি বলছে, নির্বাচিত সংসদ সেটা করবে। এই জায়গাটা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী, বিএনপির চিন্তাটা এখন কী?
তারেক রহমান: দেখুন, এখানে আবার আমাকে বলতে হচ্ছে, আমরা কিন্তু কোনো হাইড এন্ড সিক করছি না। যদি আমাদের সেরকম অসৎ উদ্দেশ্য থাকত মনের ভিতরে, বলতাম আরেকটা যে ঠিক আছে, ওকে, অসুবিধা নাই। তার পরে ইনশআল্লাহ আমরা সরকার গঠনে সক্ষম হলে আমরা হয়তো করতাম না। তো আমরা যেটা মনে করছি, সেটাই বলছি।
এখন বিষয় হচ্ছে দেখুন, এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ইম্পর্টেন্ট একটি বিষয়। দেখুন, আমরা যদি ইভেন রিসেন্ট যে ঘটনা, নেপালেও যদি দেখি, আপনি দেখেন, ওরা কিন্তু এত কিছুর মধ্যে যাচ্ছে না। ওরা বলছে যে, গুরুত্বপূর্ণ যা বিষয় আছে, সংস্কার বলেন বা বিভিন্ন বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যা বিষয় আছে—নির্বাচিত প্রতিনিধি যাঁরা আসবেন, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি যাঁরা আসবেন, তাঁরা সেগুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।
তার পরেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবকিছু বিবেচনা করে রাজনৈতিক দলগুলো বসেছে, অন্তর্বর্তী সরকার আহ্বান করেছে। এখানে যতটুকু হয়েছে, আমরা বলেছি, এখন যতটুকু হয়েছে, যেগুলো শুধু আইন দিয়ে করলে হয়ে যায়, সেগুলো হয়ে যাক। যেগুলোর সাংবিধানিক এনডোর্সমেন্ট লাগবে, সেগুলো আমরা মনে করি যে, নির্বাচিত সংসদ হওয়ার পরে সেখানে গ্রহণ করাটাই ভালো হবে।
কারণ, আপনি যদি নির্বাচিত সংসদের কথা বলেন, অথচ তাকে বাদ দিয়ে যদি আপনি আউট অব দ্য বক্স কিছু করেন এবং এটা যদি রেওয়াজ হয়ে যায়, তাহলে এটা আমরা মনে করি যে, এটা সাংবিধানিকভাবে হোক, আইনগতভাবে হোক বা যে দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিবেচনা করেন না কেন, ভবিষ্যতের জন্য এটা একটি খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
সে জন্য আমরা মনে করি, যেটা দেশের জন্য সামগ্রিকভাবে ক্ষতির একটি কারণ হবে। সে জন্যই আমরা এটার সাথে একমত না।
বিবিসি বাংলা: এখন বিএনপির যেহেতু ৩১ দফা আছে, যদিও যেসব বিষয় আলোচনায় এসেছে, অনেক বিষয়ে মিল আছে। তো বিএনপি যদি ক্ষমতায় আসে বা সরকার গঠন করে, তখন ৩১ দফা নাকি জুলাই সনদ—কোনটা অগ্রাধিকার পাবে?
তারেক রহমান: আমরা যেগুলোতে একমত হয়েছি, প্রথমে আমরা সেগুলোর ওপরেই জোর দিব। সেটা আপনি যে নামেই বলেন না কেন, স্বাভাবিকভাবে আমরা ঐকমত্য কমিশনে যেগুলোতে সকলে মিলে একমত হয়েছি, আমরা প্রথমে সেগুলোতে ইনশাআল্লাহ সরকার গঠনের সুযোগ পেলে প্রথমে সেগুলোতেই অবশ্যই জোর দিব।
আর, তারপরে আপনি যেটা ৩১ দফার কথা বললেন, অবশ্যই ৩১ দফা আমাদের রাজনৈতিক কমিটমেন্ট জনগণের প্রতি। আমরা তো আমাদের ৩১ দফার মধ্যে যেগুলোর এটার সাথে মিলে গিয়েছে, সেগুলো তো আমরা করবই। এর বাইরে যেগুলো থাকবে ৩১ দফায় আছে, সেগুলোও বাস্তবায়ন করব।
কারণ ওটা তো আমাদের রাজনৈতিক কমিটমেন্ট। এটাও যেমন পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট, ওটাও আমাদের পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট। এটা আমরা রাজনৈতিক দলগুলো মিলে একত্রিত হয়ে বলেছি। ওটাও আমরা অনেকগুলো রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়েই কিন্তু ৩১ দফা দিয়েছি।
‘বিড়ালটি আমার মেয়ের’
বিবিসি বাংলা: রাজনীতি থেকে একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই। আপনাকে সম্প্রতি প্রাণী অধিকার রক্ষা নিয়ে বেশ সোচ্চার দেখা গেছে। এ-সংক্রান্ত অনুষ্ঠানে আপনি যোগ দিয়েছেন। রাজনৈতিক অনুষ্ঠানের বাইরে আপনার পোষা বিড়ালের সঙ্গে আপনার নিয়মিত ছবি দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তো এটা আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল কীভাবে?
তারেক রহমান: প্রথমত এখানে একটু ক্লিয়ার করে নেই, বিড়ালটি আমার মেয়ের। ও এখন অবশ্য সবারই হয়ে গিয়েছে। আমরা সবাই ওকে আদর করি।
বিষয়টি হচ্ছে, এরকম শুধু বিড়াল নয়, আমি এবং আমার ভাই যখন ছোট ছিলাম, আমাদের একটি ছোট কুকুরও ছিল। ইভেন, তখন আমাদের বাসায় আম্মা হাঁস-মুরগি পালতেন, ছাগলও ছিল আমাদের বাসায়। উনি ছাগলও কয়েকটি পালতেন।
তো স্বাভাবিকভাবেই আপনি যেই দৃষ্টিকোণ থেকেই বলেন, পোষা কুকুর-বিড়ালই বলেন, বাই দ্য ওয়ে কবুতরও ছিল আমাদের বাসায়। শুধু কবুতর না, আমাদের বাসায় একটি বিরাট বড় খাঁচা ছিল। সেই খাঁচার মধ্যে কিন্তু পাখি ছিল, বিভিন্ন রকমের এবং আবার আরেকটি খাঁচা ছিল, যেটার মধ্যে একটা ময়না ছিল।
ময়নাটা আমরা বরিশাল থেকে এনেছিলাম। ও আবার বরিশালি ভাষায় কথাও বলত। টুকটুক করে মাঝে মাঝে কিছু কিছু কথাও বলত। কাজেই বিষয়টি হঠাৎ করেই না। এই পশুপাখির প্রতি যে বিষয়টি, এটির সাথে আমি কমবেশি ছোটবেলা থেকে জড়িত আছি। হয়তো এটি এখন প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্নভাবে। বাট, এটির সাথে আমি বা আমার পরিবার, আমরা অনেক আগে থেকেই আছি।
কুকুর-বিড়াল ছিল, গরু-ছাগল ছিল, হাঁস-মুরগি ছিল, পাখি ছিল, ময়না ছিল, কবুতর ছিল। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যদি আমরা চিন্তা করি, আমাদের আল্লাহ সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে তৈরি করেছেন। আমাদের দায়িত্ব কিন্তু আল্লাহর সৃষ্টি যা কিছু আছে প্রকৃতির, তার প্রতি কিন্তু যত্ন নেওয়া আমাদের দায়িত্ব। এটি একটি বিষয়।
আর আমরা যদি মানবিক দৃষ্টিকোণ অথবা আমরা যদি নেচার থেকেও বিষয়টি দেখি, দেখুন, ওরা না থাকলে কিন্তু আমাদের জন্য বেঁচে থাকা কষ্টকর। প্রকৃতি যদি না থাকে, প্রকৃতির ব্যালেন্স যদি না থাকে।
এই আলোচনা শুরু হওয়ার আগে কিন্তু আপনি আমরা তিনজন কিন্তু ওয়েদার নিয়ে কথা বলছিলাম, এই ইংল্যান্ডের বা ইউকের ওয়েদার নিয়ে আমরা আলাপ করছিলাম এবং আমি বলছিলাম যে, আমার এই ১৭ বছর অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ওয়েদার মনে হয় একটু একটু এখানেও চেঞ্জ হয়েছে। আমরা দেখেছি, বাংলাদেশে পত্রপত্রিকায় দেখেছি পলিউশন ঢাকা শহরে। নরমালি আমরা জানি যে, একটি দেশের টোটাল অংশের মধ্যে এটলিস্ট ২৫ শতাংশ গ্রীন দরকার, বনায়ন দরকার। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে আমি যতটুকু জেনেছি, এটি ১২ পার্সেন্টের মতো। হুইচ ইস ভেরি ডেঞ্জারাস।
তো এগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি—কীভাবে আমরা বাড়াব। তো যেমন এগুলো আছে, ঠিক একই সাথে এই যে আপনি পশুপাখির কথা বললেন, এ বিষয়গুলো আছে নেচার। নেচারকে যদি আমরা মিনিমাম ঠিক রাখতে না পারি, সেখানে মানুষ হিসেবে কিন্তু আমাদের বসবাস করা খুব কঠিন হয়ে যাবে। কাজেই আমাদের নিজেদের স্বার্থেই এ বিষয়গুলো বোধহয় করা প্রয়োজন।
সামাজিক মাধ্যমে মিম, কার্টুন কীভাবে দেখেন
বিবিসি বাংলা: রাজনীতিতে যেমন আপনাকে নিয়ে অনেক আলোচনা আছে, স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক মাধ্যমেও আপনাকে নিয়ে অনেক আলোচনা আছে এবং আপনি যে পোস্টগুলো করেন, সেটা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। আপনাকে নিয়ে অনেক মিমও তৈরি হয়, অনেক কার্টুন হয়। যেমন—একটা মিমের কথা যদি আমি বলি, অনেকে শেয়ার করেছিল যে, আপনি আপনার সাথে আমরা জুমে কথা বলছি, আপনি জুমে বক্তব্য দেন। এটা নিয়ে একটা মিম তৈরি হয়েছে যে, ওয়ার্ক ফ্রম হোম, তো এ ধরনের মিমগুলো আপনি কীভাবে দেখেন?
তারেক রহমান: আমি এনজয় করি বেশ, বেশ আমি এনজয় করি।
বিবিসি বাংলা: আপনি দেখেন এগুলো? আপনার চোখে পড়ে?
তারেক রহমান: হ্যাঁ, চোখে পড়বে না কেন, অবশ্যই চোখে পড়ে। তবে এখানে একটি কথা আছে, যেহেতু সোশ্যাল মিডিয়ার বিষয়টি এল, আমার মনে হয় এ বিষয়ে একটু এড করা উচিত।
দেখুন, সোশ্যাল মিডিয়া এমন একটি বিষয়, আমি নিজেও আছি সোশ্যাল মিডিয়ায় কমবেশি। বহু বহু মানুষ আছেন, লক্ষকোটি মানুষ আছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। এটি দিয়ে যেমন খুব দ্রুত একজনের সাথে আরেকজনের যোগাযোগ করা যায়।
আমরা মাঝে মাঝে বলি যে, দেখেন, অনেক সময় অনেক আলোচনায় আসে, সেমিনার-বক্তব্যে আসে যে, ডিনামাইটটা যখন আবিষ্কৃত হয়, ডিনামাইটটা আবিষ্কৃত হয়েছিল আপনার পাহাড় ভেঙে কীভাবে মানুষের চলাচলের জন্য রাস্তাঘাট তৈরি করা যায়; হয়তো কীভাবে চাষের জমি করা যায়। এরকম লক্ষ্য সামনে রেখেই, উদ্দেশ্য সামনে রেখেই কমবেশি ডিনামাইটের ব্যবহারটা শুরু হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা দেখেছি, এটি মানুষ হত্যার মতো জঘন্য কাজেও ব্যবহার করা হয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে আমি বলতে চাই যে, অবশ্যই প্রত্যেক মানুষের অধিকার আছে। যেহেতু আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। মানুষের বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতায় আমরা বিশ্বাস করি। প্রত্যেক মানুষের অধিকার আছে তার মতামত প্রকাশ করার।
তবে আমরা যদি সকলে এতটুকু সচেতন হই যে, আমি আমার মত প্রকাশ করলাম, কিন্তু এই মত প্রকাশের ফলে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলো কি না—এ বিষয়টিকে যদি আমরা বিবেচনায় রাখি, একটি মানুষ ক্ষতির সম্মুখীন হলো কি না, ক্ষতিগ্রস্ত হলো কি না—এসব বিষয় বোধহয় আমাদের বিবেচনায় রাখা উচিত; এটি এক নম্বর।
দ্বিতীয়ত হচ্ছে, সোশ্যাল মিডিয়ার বহুল ব্যবহারের ফলে ডিসইনফরমেশন বা মিসইনফরমেশন বিষয়টিও চলে এসেছে সামনে। এ কথাও চলে এসেছে। একটি জিনিস আমি দেখলাম বা শুনলাম, সাথে সাথেই আমি সেটিতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। তা না করে আমার মনে হয়, ফ্যাক্ট চেক বলে যেই কথাটি আছে সোশ্যাল মিডিয়ায়, এটা সব জায়গায় আছে—এ ব্যাপারেও যদি আমরা একটু অ্যালার্ট থাকি সবাই, এ ব্যাপারে যদি একটু সচেতন থাকি যে ঠিক আছে, এটি একটু যাচাইবাছাই করে নিই।
যদি সত্য হয়, অবশ্যই আমার সেখানে মতামত থাকবে। কিন্তু যদি মিথ্যা হয় বিষয়টি, কেন আমি এখানে মতামত দিব? একটি মিথ্যার সাথে আমি কেন নিজেকে সংশ্লিষ্ট করব? একটি খারাপ কিছুর সাথে কেন আমি নিজেকে সংশ্লিষ্ট করব? এটি আমি আমার মতামতটা প্রকাশ করলাম।
মানুষের আস্থার প্রশ্নে যা বললেন
বিবিসি বাংলা: আমরা প্রায় শেষ দিকে চলে এসেছি। আমি একটা প্রশ্ন করতে চাই যে, রাজনৈতিক পট পরিবর্তন যেটা হয়েছে গত বছরের ৫ আগস্ট। তারপর থেকে বিএনপির পক্ষ থেকে যেসব বক্তব্য বা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো বাস্তবায়ন হবে—এই প্রশ্নে মানুষকে কীভাবে আস্থায় নেবেন?
তারেক রহমান: এই প্রশ্নের উত্তরে যদি একটু এভাবে বলি, স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক দল হিসেবে তো আমাদের একটি পরিকল্পনা আছে। আপনাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে আমি কিছু কিছু বলেছি।
ব্যাপারটা হচ্ছে এরকম যে, দেখুন এই মুহূর্তে মাঠে আমরা যেই রাজনৈতিক দলগুলো আছি, আমরা ধরে নিতে পারি, সেই রাজনৈতিক দলগুলো ইনশআল্লাহ আগামীতে দেশ পরিচালনা করতে পারে। তার মধ্যে বিএনপিরই কিন্তু দেশ পরিচালনার অভিজ্ঞতা আছে।
আপনাকে যদি বলি, ধরেন এখন লন্ডন আসবেন। তো আপনি একটা প্লেনে উঠলেন। যে প্লেন চালাবে, সে যদি আপনাকে বলে যে ভাই কিছু মনে করেন না, আমার ঠিক লাইসেন্সটা হয়নি এখনো, তবে আমার মনে হয় আমি চেষ্টা করলে আপনাকে নিয়ে যেতে পারব লন্ডন পর্যন্ত উড়িয়ে। আপনি কি তার সাথে উঠবেন প্লেনে? নিশ্চয়ই আপনি উঠবেন না।
আপনি একজন অভিজ্ঞ ড্রাইভারের সাথে উঠতে পারেন। কিন্তু অভিজ্ঞ ড্রাইভারও গাড়ি হয়তো ঠিকই চালাচ্ছে সেফলি, কিন্তু রাস্তায় তো গর্ত খানাখন্দ থাকবেই, একটু জার্কিং হতেই পারে। জোরে অনেক সময় ব্রেক হতেই পারে, ঝাঁকুনি লাগতেই পারে, কিন্তু অভিজ্ঞ ড্রাইভার আপনাকে মোটামুটি ঠিকভাবে নিয়ে যাবে। নিয়ে যাওয়ার সর্বোচ্চ সে চেষ্টা করবে। কারণ তার সেই অভিজ্ঞতা আছে।
কাজেই আমরা যদি দেখি যে, ভালো কাজ বা কমিটমেন্ট আপনি যেটা বলেন, বিএনপি করবে কি না। আমরা তো করেছি। হতে পারে আমাদের দ্বারা কিছু ভুল-ত্রুটি হয়েছে।
আপনি একটু আগে একটা কথা বলেছিলেন, মানুষ তো অতীত থেকেই শিখে। ইয়েস, আমরাও দেখেছি, আমরাও অতীত থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি যে ঠিক আছে এই কাজটি এভাবে করলে হয়তো ভুল হয়, এটি আমরা ভবিষ্যতে ইনশাআল্লাহ করব না। বাট আমাদের অভিজ্ঞতা আছে, অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা ভালো-মন্দ যাচাই করতে পারব।
একই সাথে আমাদের কমিটমেন্ট আছে, যে কমিটমেন্ট দিয়ে আমরা ডেলিভারি করতে পারব এবং আমরা ডেলিভারি করতে চাই।
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে বিএনপির অবস্থান
বিবিসি বাংলা: শেষ প্রশ্নটি করি তাহলে আপনাকে এবং ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়েই। বিগত সরকারের আমলে তাদের একটা বিষয় বড় সমালোচনা ছিল যে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ। আপনারা যদি ক্ষমতায় আসেন, সে ক্ষেত্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদ বা সংবাদমাধ্যমের ওপর দমন-পীড়নের বিষয়গুলো যে আর হবে না, সেই নিশ্চয়তা কি আপনি দিতে পারেন?
তারেক রহমান: জ্ব, ইয়েস পারি। একদম দিতে পারি। আপনি ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত পত্রপত্রিকা খুলুন। আমি কারও নাম উল্লেখ করব না, কোনো পত্রিকার কথা উল্লেখ করব না। শুধু খুলে দেখুন কীভাবে অনেক খবর ছাপা হয়েছিল, যার সত্যতা কিন্তু ছিল না, অপপ্রচার ছিল। কিন্তু অপপ্রচারটা সংবাদ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
আপনি কি শুনেছেন, আপনি কি আমাকে প্রমাণ দিতে পারবেন, বলতে পারবেন যে বিএনপির সময়, আমি কিন্তু বলতে পারব অনেক অনেক সাংবাদিকের নাম, যাঁরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন স্বৈরাচারের সময় এবং পরবর্তীতে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। ইভেন, এখনো অনেকে প্রবাসজীবনে আছেন, এরকম বহু সাংবাদিক।
আমি বলতে পারব, স্বৈরাচারের সময় বহু সাংবাদিককে বিভিন্ন জায়গা থেকে ফোন করে বিভিন্ন রকম ভয়ভীতি প্রদর্শন ও ধমক দেওয়া হতো। বিএনপির সময় এগুলো করা হয়নি, কারণ তখন সংবাদপত্রে যে খবরগুলো প্রকাশিত হয়েছে তৎকালীন বিএনপি সরকার সম্পর্কে, আমার সম্পর্কে যে খবরগুলো প্রকাশিত হয়েছে, যদি ওই রকম হতো, তাহলে কিন্তু ওরকম খবর প্রকাশিত হতো না।
অর্থাৎ, বিএনপির সময় যদি অত্যাচার-নির্যাতন থাকত, তাহলে খবরগুলো প্রকাশিত হতো না স্বাভাবিকভাবে, যা হয়নি বিগত সরকারের সময় স্বৈরাচার সরকারের সময়। কাজেই আপনাকে আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, বিএনপির অতীত সরকারের সময় যেরকম সাংবাদিকদের গুম করা হয়নি। সাংবাদিকদের নির্যাতন করা হয়নি। সাংবাদিকদের দেশ ছেড়ে যেতে হয়নি, বাধ্য হতে হয়নি। ইনশআল্লাহ ভবিষ্যতেও হবে না।
বিবিসি বাংলা: তাহলে কি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ করে—এ ধরনের যে আইনগুলো রয়েছে, সেগুলো আপনারা বাতিল করবেন, এটা কি ধরে নেওয়া যায়?
তারেক রহমান: অবশ্যই, আমরা সকলে মিলে বসব, আলোচনা করব। আপনাদের মতো সাংবাদিকসহ যাঁরা আছেন, তাঁদের সাথে আলোচনা করব। আলোচনা করে সেগুলো এরকম কালো আইন যা যা আছে, আমরা আস্তে আস্তে ঠিক করব।
তবে এখানে বোধহয় একটি বিষয় আবার আমাকে উল্লেখ করতে হয়, যেটি আমি সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে বলেছি। দেখুন, এটি তো সবাইকে মিলে করতে হবে। অপপ্রচারকে তো অবশ্যই সংবাদ হিসেবে তো প্রচার করা ঠিক নয়, তাই না?
আমাদের কাছে আপনাদের যেরকম চাওয়া থাকবে, ভবিষ্যৎ সরকারের কাছে, যারাই আসুক সরকারে, রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমাদেরও অনুরোধ থাকবে আপনাদের প্রতি যে অপপ্রচার সংবাদ হিসেবে যেন প্রচারিত না হয়—এ বিষয়টি একটু সকলকে সচেতন বা খেয়াল রাখতে হবে।
বিবিসি বাংলা: তারেক রহমান, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ বিবিসি বাংলার সাথে কথা বলার জন্য।
তারেক রহমান: আপনাদেরও অনেক ধন্যবাদ। আপনাদের প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আমার কথাগুলো দেশের মানুষের সামনে আমি তুলে ধরতে পেরেছি। সেই সুযোগটুকু আপনারা করে দিয়েছেন, তার জন্য আপনাদের আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ।

প্রধান উপদেষ্টা মনে করেন, সংস্কার ও বছরের শেষ নাগাদ বা আগামী বছরের প্রথমার্ধে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়ার কোনো ঘাটতি নেই। গত ২৯ ডিসেম্বর (২০২৪) ইংরেজি দৈনিক নিউ এজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এ মন্তব্য করেন তিনি। ঢাকায় প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় বাং
০৭ জানুয়ারি ২০২৫
ইসলামী ব্যাংক শুরু থেকে এই কার্যক্রমে যুক্ত। আমরা ১৮ বছরের কম বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্য ‘মুদারাবা স্কুল স্টুডেন্ট সেভিংস অ্যাকাউন্ট’ চালু করেছি, যেখানে অভিভাবকেরা সন্তানদের পক্ষ থেকে হিসাব পরিচালনা করেন। মূল লক্ষ্য হলো শিশু-কিশোরদের সুদমুক্ত অর্থনীতিতে যুক্ত করা এবং ভবিষ্যতে দায়িত্বশীল...
৮ দিন আগে
ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসি (ইবিএল) নিয়মিতভাবে স্কুলে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন, সেমিনার, ওয়ার্কশপ এবং বিশেষ অফারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সচেতন করছে এবং তাদের হিসাব খোলায় উৎসাহ দিচ্ছে। আমরা শিক্ষার্থীদের ব্যাংকিং জ্ঞান ও সঞ্চয়ের গুরুত্ব বোঝাতে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করি।
৮ দিন আগে
দীর্ঘ প্রায় দুই দশক পর কোনো গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকারে আগামী নির্বাচনে দলের কৌশল, আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও তাদের নেতা-কর্মীদের বিচার...
২৪ দিন আগে
দীর্ঘ প্রায় দুই দশক পর কোনো গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বিবিসি বাংলাকে দেওয়া দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকারে আগামী নির্বাচনে দলের কৌশল, আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও তাদের নেতা-কর্মীদের বিচার, বাংলাদেশের নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতিসহ সমসাময়িক নানা বিষয়ে বিএনপির অবস্থান তুলে ধরেছেন তারেক রহমান।
আজকের পত্রিকা ডেস্ক

বিবিসি বাংলা: তারেক রহমান আপনাকে অনেক ধন্যবাদ বিবিসি বাংলার সাথে যোগ দেবার জন্য।
তারেক রহমান: আপনাদেরকেও অনেক ধন্যবাদ, আমাকে কথা বলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।
বিবিসি বাংলা: আপনি কেমন আছেন? আপনার সময় কেমন যাচ্ছে?
তারেক রহমান: আলহামদুলিল্লাহ, আমি শারীরিকভাবে ভালো আছি। সময় তো স্বাভাবিকভাবে ব্যস্তই যাচ্ছে। ফিজিক্যালি হয়তো আমি এই দেশে আছি, বাট মন-মানসিকতা সবকিছু মিলিয়ে তো আমি গত ১৭ বছর ধরে বাংলাদেশেই রয়ে গিয়েছি।
বিবিসি বাংলা: আমরা এমন একটা সময় আপনার সাথে কথা বলছি, যখন বাংলাদেশ ইতিহাসে একটা গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে বললে ভুল বলা হবে না। ২০২৪ সালে একটি ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের শাসনের অবসান হয়েছে। আর কয়েক মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ একটি নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে আপনি আপনার অনেক দলীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন, কথা বলেছেন, নিয়মিতই কথা বলে যাচ্ছেন। কিন্তু গণমাধ্যমের সাথে আপনি এই দীর্ঘ সময় কথা বলেননি। এত দিন ধরে আপনি কথা বলেননি কেন?
তারেক রহমান: ব্যাপারটা বোধ হয় এ রকম না, ব্যাপারটা বোধয় একটু ভিন্ন। আসলে আমি কথা ঠিকই বলেছি। আমি দীর্ঘ ১৭ বছর এখানে আছি এই দেশে, প্রবাস জীবনে, তবে আমার ওপরে যখন দলের দায়িত্ব এসে পড়েছে; তারপর থেকে আমি গ্রামেগঞ্জে আমার নেতা-কর্মীসহ তাদের সাথে বিভিন্ন পর্যায়ে সাধারণ মানুষ যখন যেভাবে অংশগ্রহণ করেছে, আমি সকলের সাথে কথা বলেছি।
আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, বিগত স্বৈরাচার সরকারের সময় কোর্ট থেকে রীতিমতন একটা আদেশ দিয়ে আমার কথা বলার অধিকারকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আমি যদি গণমাধ্যমে কিছু বলতে চাইতাম, হয়তো গণমাধ্যমের ইচ্ছা ছিল ছাপানোর, গণমাধ্যম সেটি ছাপাতে পারত না।
আমি একবার প্রেসক্লাবে কথা বলেছিলাম। তখন পরের দিন দেখলাম যে প্রেসক্লাবে একটি তখনকার যেই প্রেসক্লাবের যারা সদস্য ছিলেন বা কমিটি ছিল, তারা একটি মিটিং ডেকে একটি সভা করে সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা তখন আমাকে আইনের দৃষ্টিতে ফেরারি বলা হয়েছিল যে, সে রকম কোনো ব্যক্তিকে তারা প্রেসক্লাবে কথা বলতে দিবে না। এভাবে তারা চেষ্টা করেছিল আমার কথা বন্ধ করে রাখতে।
আমি কথা বলেছি, সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন পন্থায় আমি পৌঁছানোর চেষ্টা করেছি, আমি ইনশা আল্লাহ পৌঁছেছি মানুষের কাছে। কাজেই গণমাধ্যমে যে কথা বলিনি তা না। আমি কথা বলেছি হয়তো আপনারা তখন কথা নিতে পারেননি অথবা শুনতে পারেননি। ইচ্ছা থাকলেও ছাপাতে পারেননি হয়তো প্রচার করতে পারেননি। কিন্তু আমি বলেছি আমি থেমে থাকিনি।
দেশে ফেরার প্রশ্নে যা বললেন?
বিবিসি বাংলা: আমি অবশ্য সাক্ষাৎকারের কথা বলছিলাম যে প্রশ্নোত্তরের বিষয়টি মানে বিশেষ করে গত এক বছরে। বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পেরিয়ে গেছে এবং অনেকের ধারণা ছিল, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আপনি দেশে এসে সশরীরে দলের নেতৃত্ব দেবেন। গত এক বছরে যে প্রশ্নটা বারবার ঘুরেফিরে এসেছে এবং এখনো আসছে যে আপনি এখনো দেশে ফেরেননি কেন। কেন আপনি এখনো দেশে ফেরেননি?
তারেক রহমান: কিছু সংগত কারণে হয়তো ফেরাটা হয়ে ওঠেনি এখনো। তবে সময় তো চলে এসেছে মনে হয়। ইনশা আল্লাহ দ্রুতই ফিরে আসব।
বিবিসি বাংলা: সেটা কবে, আমরা কি জানতে পারি?
তারেক রহমান: দ্রুতই মনে হয়। দ্রুতই ইনশা আল্লাহ।
বিবিসি বাংলা: নির্বাচনের আগে কি তাহলে আপনি দেশে আসবেন, এমন সম্ভাবনা বলা যায়?
তারেক রহমান: রাজনীতি যখন করি, আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে স্বাভাবিক, নির্বাচনের সাথে রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক কর্মীর একটি ওতপ্রত সম্পর্ক। কাজেই যেখানে একটি প্রত্যাশিত, জনগণের প্রত্যাশিত নির্বাচন হবে, সেই নির্বাচনের সময় কেমন করে দূরে থাকব? আমি তো আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে, ইচ্ছা থাকবে, আগ্রহ থাকবে সেই প্রত্যাশিত যে প্রত্যাশিত নির্বাচন জনগণ চাইছে। সেই প্রত্যাশিত নির্বাচন যখন অনুষ্ঠিত হবে, জনগণের সাথে জনগণের মাঝেই থাকব ইনশা আল্লাহ।
বিবিসি বাংলা: একটা বিষয়, যেটা আপনার দল থেকে, মাঝে দলের নেতাদের কেউ কেউ কখনো কখনো বলেছেন যে একটা নিরাপত্তার শঙ্কার কথা বলেছেন। আপনি না আসার পেছনে, আপনি কি কোনো ধরনের শঙ্কা বোধ করেছেন এর মধ্যে?
তারেক রহমান: বিভিন্ন রকম শঙ্কার কথা তো আমরা অনেক সময় বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে তো শুনেছি। সরকারেরও বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকেও তো অনেক সময় অনেক শঙ্কার কথা বিভিন্ন মাধ্যমে, বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রকাশিত হয়েছে।
’কোনো ব্যক্তি নয়, মাস্টারমাইন্ড গণতন্ত্রকামী জনগণ’
বিবিসি বাংলা: জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রসঙ্গে আসি। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আপনার ভূমিকা নিয়ে অনেক আলোচনা আছে। এটি মোটামুটি সব পক্ষই স্বীকার করেও যে সেই সময়ে আপনার একটা সক্রিয় ভূমিকা ছিল। আবার আপনার দলের কোনো কোনো নেতা বা সমর্থক তারা এই অভ্যুত্থানে আপনাকে ’একমাত্র মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। আপনি কি নিজেকে এই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে দেখেন?
তারেক রহমান: না। আমি অবশ্যই এই জুলাই আন্দোলনে আমাকে আমি কখনোই মাস্টারমাইন্ড হিসেবে দেখি না। এই যে ৫ই অগাস্ট যেই আন্দোলন, জুলাই আন্দোলন বলে যেটি বিখ্যাত বা যেটি সকলের কাছে গৃহীত, এই আন্দোলনটি সফল হয়েছে জুলাই মাসে। কিন্তু এই আন্দোলনটি প্রেক্ষাপট শুরু হয়েছে কিন্তু বহু বছর আগে থেকে।
এই আন্দোলনে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীরা, সেটি বিএনপি হোক বা অন্য রাজনৈতিক দলগুলো হোক, যারা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছে। বিভিন্নভাবে তাদের নেতা-কর্মীরা নির্যাতিত হয়েছে।
আমি মনে করি, জুলাই-আগস্ট মাসে এসে জনগণ সকল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের সাথে অংশগ্রহণ করেছে। শুধু কী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাই সেদিন ছিল মাঠে? অবশ্যই নয়।
আমরা দেখেছি, সেদিন মাদ্রাসার ছাত্ররা তাঁরা ছিলেন এই আন্দোলনের মাঠে। আমরা দেখেছি গৃহিণীরা পর্যন্ত রাস্তায় নেমে এসেছেন সন্তানের পেছনে। আমরা দেখেছি, কৃষক, শ্রমিক, সিএনজিচালক, ছোট দোকান কর্মচারী বা দোকানমালিক থেকে আরম্ভ করে গার্মেন্টস কর্মী—তাঁরা নেমে এসেছিলেন। আমরা দেখেছিলাম, সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নেমে এসেছিলেন এই আন্দোলনে।
এমন অনেক সাংবাদিক, যাঁরা স্বৈরাচারের অত্যাচারে নির্যাতিত হয়ে দেশ থেকে বাইরে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁরা সম্পৃক্ত হয়েছিলেন এই আন্দোলনে। কাজেই কারও ভূমিকাকে আমরা ছোট করে দেখতে চাই, না খাটো করে দেখতে চাই না।
আমি বিশ্বাস করি, দৃঢ়ভাবে সমাজের দলমত-নির্বিশেষে শ্রেণিবিন্যাস নির্বিশেষে প্রত্যেকটি মানুষের অবদান আছে।
এই আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের জনগণের আন্দোলন, যাঁরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তাঁরাই এই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড। কোনো দল, কোনো ব্যক্তি নয়, এই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ।
বিবিসি বাংলা: যখন আন্দোলনটা চলছিল, তখন আন্দোলনে যে ছাত্রনেতৃত্ব ছিল, তাদের সাথে আপনার কতটা যোগাযোগ ছিল? আপনার দলের সাথে তো নিশ্চয়ই যোগাযোগ ছিল, অন্যদের সাথে আপনাদের আপনার কতটা যোগাযোগ ছিল?
তারেক রহমান: স্বাভাবিকভাবে আমি যেহেতু বাইরে থেকে কাজ করছি, আমাকে যোগাযোগটা অনলাইনের মাধ্যমে রাখতে হয়েছে এবং সেই দিনগুলোতে আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে টেলিফোন সিস্টেম বা অনলাইন সিস্টেমের কী অবস্থা করেছিল স্বৈরাচার।
আপনি যোগাযোগের যেটি কথা বলেছেন, এই যোগাযোগটি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বিভিন্নভাবে আমাদেরকে করতে হয়েছে। বিভিন্ন মাধ্যমে করতে হয়েছে। যোগাযোগটা যে খুব স্মুথ সব সময় থেকেছে, তা নয়। প্রত্যেকে সহযোগিতা করেছি আমরা।
বিবিসি বাংলা: ছাত্র-জনতার যে অভ্যুত্থান, সেটির পরে এটার কৃতিত্ব কার সেটা নিয়ে বিভিন্ন পক্ষ দাবি করেছে, তাতে কি আপনার মনে হয় যে এর ফলে বিভিন্ন পক্ষের যে সংকীর্ণ স্বার্থ পূরণের চেষ্টা, সেটাই একটু বেশি প্রকট হয়েছে এবং এখানে বিএনপির আসলে কোনো দায় আছে কি না?
তারেক রহমান: দেখুন ব্যাপারটা আমরা যদি একটু অন্যভাবে দেখি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত এটি একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা।
এই আন্দোলন, মানুষের এই আত্মত্যাগ সাধারণত কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনে বা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শিশু হত্যা হয় না, শিশু শহীদ হয় না, শিশু মৃত্যুবরণ করে না। বাট আমরা দেখেছি এই আন্দোলনে স্বৈরাচারের এই আন্দোলনে যতটুকু আমার মনে আছে, প্রায় ৬৩ জন শিশু শহীদ হয়েছে, মারা গিয়েছে।
আমি আগেই বলেছি, আপনার আগের প্রশ্নের উত্তরে বলেছি যে এই আন্দোলনের ক্রেডিট দলমত-নির্বিশেষে বাংলাদেশের জনগণের, কোনো একটি রাজনৈতিক দলের নয়।
অনেকে হয়তো অনেক কিছু বলে থাকতে পারেন, ডিমান্ড করতে পারেন, সেটি তাঁদের অবস্থান।
আমি বা আমার দলের অবস্থান হচ্ছে, আন্দোলন হয়ে গিয়েছে, আন্দোলনের জনগণ সফলতা লাভ করেছেন। আন্দোলনে স্বাভাবিকভাবেই দুটো পক্ষ আছে। একটি পক্ষ হচ্ছে মানুষ শহীদ হয়েছে। ২০০০-এর মতো মানুষকে হত্যা করা হয়েছে আন্দোলনে। আবার আরেকটি পক্ষ হচ্ছে প্রায় ৩০ হাজারের মতন মানুষ বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন অন্ধ হয়ে গিয়েছেন।
আমার মনে হয়, আমাদের উচিত হবে, এখন আমাদের সকলের উচিত হবে রাষ্ট্রসহ সরকারসহ রাজনৈতিক দলগুলোর যার যতটুকু সম্ভব, সেই পরিবারগুলোর পাশে গিয়ে দাঁড়ানো। যতটুকু সহযোগিতা তাদেরকে করা যায়, যতটুকু সম্ভব তাদের পাশে দাঁড়ানো। তাদের এই আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানানো।
নির্বাচন এককভাবে নাকি দলগতভাবে
বিবিসি বাংলা: অন্তর্বর্তী সরকারের শুরু থেকেই দেখা গেছে যে বিএনপির পক্ষ থেকে দ্রুত নির্বাচন দাবি করা হয়েছে। সরকার গড়িমসি করছে এ ধরনের অভিযোগও বিএনপির নেতারা করে আসছেন। তো এখন দেখা যাচ্ছে যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং নির্বাচন কমিশন তারা ফেব্রুয়ারিতে একটা নির্বাচনের সময় দিয়েছেন। তো ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হবে—আপনাদের আস্থা কতটা আছে তাতে?
তারেক রহমান: বিএনপি প্রথম থেকেই বলে আসছিল যে যত দ্রুত নির্বাচনটি হবে, তত দ্রুত দেশের মধ্যে একটি স্থিতিশীলতা আসবে। দেখুন বাংলাদেশের মানুষ গত ১৭ বছর যাবৎ তাদের রাজনৈতিক অধিকার যেমন তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, তাদেরকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছিল।
যার ফলশ্রুতিতে আমরা সমাজে অনেকগুলো পর্যায়ক্রমিকভাবে স্পিলওভার ইফেক্ট বলতে যা বোঝায় অনেকগুলো খারাপ লক্ষণ দেখেছি। বেকার সমস্যা বেড়েছে, দরিদ্রতা বেড়েছে। শিক্ষাব্যবস্থা ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। চিকিৎসাব্যবস্থা ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। কৃষিব্যবস্থা ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়েছে।
আমরা সে জন্যই বলেছিলাম যে যত দ্রুত নির্বাচন হবে, যত দ্রুত দেশের মালিক যারা অর্থাৎ জনগণ তাদের কাছে যখন সেই অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হবে, তারা যখন সিদ্ধান্ত নেবে, অর্থাৎ দেশের মালিক যখন সিদ্ধান্ত নিবে দেশ কারা কীভাবে পরিচালিত করবে, তত দ্রুত দেশে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।
কারণ, প্রকৃতভাবে নির্বাচিত একটি সরকার অবশ্যই জনগণের যে চাওয়া অর্থাৎ, জনগণ যেভাবে চায় সেই বিষয়গুলোকে তারা অ্যাড্রেস করবে। ইয়েস, একটি নির্বাচন হলেই যে সব রাতারাতি সব ঠিক হয়ে যাবে তা না। সমস্যাগুলোকে যখন আপনি অ্যাড্রেস করবেন খুব স্বাভাবিকভাবেই ধীরে ধীরে সমস্যা কমতে শুরু করবে।
আমরা আনন্দিত যে দেরিতে হলেও সরকার জিনিসটি উপলব্ধি করতে পেরেছেন। আমরা ডিসেম্বরের ভিতরে চেয়েছিলাম। উনারা ফেব্রুয়ারির ভিতরে এখন নির্বাচনটি করতে চাইছেন। আমরা আস্থা রাখতে চাই যে সরকার সে ব্যাপারে সব রকম উদ্যোগ পর্যায়ক্রমিকভাবে গ্রহণ করবেন।
বিবিসি বাংলা: এখন যেহেতু আপনারা বলছেন যে আপনারা আস্থা রাখতে চান, সেখানে নির্বাচন নিয়ে আপনার পরিকল্পনাটা কি? এককভাবে বিএনপি নির্বাচন করবে মানে দলগতভাবে নাকি জোটবদ্ধভাবে আসন ভাগাভাগির মাধ্যমে নির্বাচন করবে?
তারেক রহমান: খুব ট্রিকি কোশ্চেন একটু। দেখুন আমরা প্রায় ৬৪টি রাজনৈতিক দল বিগত স্বৈরাচারের সময় যার যার অবস্থান থেকে রাজপথে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে।
আমরা চেষ্টা করেছিলাম কমবেশি একসাথে কাজ করার জন্য। এমনকি আমরা যে ৩১ দফা দিয়েছি রাষ্ট্র পুনর্গঠনের, এটি প্রথমে ২০১৬ সালে আমরা দিয়েছিলাম শুধু বিএনপির পক্ষ থেকে। পরবর্তীতে ভিশন টুয়েন্টি ছিল। যেটা পরবর্তীতে কিছুটা আরেকটু ডেভেলপ করে আমরা ২৭ দফা দিয়েছিলাম।
পরবর্তীতে আমরা আমাদের সাথে যে রাজনৈতিক দলগুলো আছে তাদের সাথে পরামর্শ করে সকলের মতামত নিয়ে আমরা ৩১ দফা দিয়েছি। কারণটি হচ্ছে যে দলগুলোকে আমরা পেয়েছি, আমাদের সাথে রাজপথের আন্দোলনে, আমরা চাই সকলকে সাথে নিয়ে রাষ্ট্র পুনর্গঠন করতে। সকলের মতামতকে সাথে নিয়ে আমরা রাষ্ট্র পুনর্গঠন করতে চাই।
বিবিসি বাংলা: সেখানে তাহলে মানে যারা আন্দোলন করেছে তারাই নাকি? মানে মিত্র কারা হবে আসলে কারা সাথে থাকবে আপনাদের নির্বাচনকে সামনে রেখে?
তারেক রহমান: ওই যে বললাম, কমবেশি সকলকে নিয়ে আমরা রাষ্ট্র গঠন করতে চাই।
বিএনপির মনোনয়নে এবার ভিন্ন কী হবে
বিবিসি বাংলা: কিন্তু দেখা গেছে, জামায়াতে ইসলামী তারা কিছু দলকে নিয়ে বিএনপিবিরোধী একটি জোট করার ইঙ্গিত দিচ্ছে। সেটিকে আপনারা কি উদ্বেগ হিসেবে দেখেন? মানে আপনারা কীভাবে দেখেন সেটা?
তারেক রহমান: দেখুন, কোনো দল বা সমষ্টিগতভাবে কোনো দল যদি বাংলাদেশের যে আইন আছে, বৈধ আইন আছে। বাংলাদেশের যে সংবিধান এখনো যেটি আছে, এই সবকিছুর ভেতরে থেকে অর্থাৎ মানুষের সমর্থন-গ্রহণযোগ্যতা সবকিছুর ভেতরে থেকে যারা রাজনীতি করবে, তারা করতেই পারে। এটাতে তো কোনো সমস্যা বা উদ্বেগের কোনো কারণ আমি দেখি না।
বিবিসি বাংলা: সেখানে যদি তারা একটি আলাদা জোট করে, সেটি কি আপনাদের জন্য কোনো চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে?
তারেক রহমান: না, কেন? ইলেকশন হলে তো ইলেকশনে প্রতিযোগিতা থাকতেই পারে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকতেই পারে। এতে উদ্বেগের কী আছে? বিএনপি তো আগেও নির্বাচন করেছে। বিভিন্ন সময় বিএনপি নির্বাচন করেছে। কম্পিটিশন করেই বিএনপি নির্বাচন করেছে। প্রতিযোগিতা করেছে। উদ্বেগের কিছু নেই।
বিবিসি বাংলা: মনোনয়নের প্রশ্নে যদি আসি, সেখানে আপনাদের কৌশলটা কী হবে? এর আগে বিভিন্ন সময় নির্বাচনগুলোতে পেশিশক্তির প্রভাব, টাকার প্রভাব, পারিবারিক বিষয় বিবেচনা এই বিষয়গুলো বিভিন্ন সময় অভিযোগ আছে। এবার ভিন্ন কি হবে আসলে?
তারেক রহমান: আপনি যেই বিষয়গুলো বললেন, আমরা কখনোই এইসব বিবেচনায় নিয়ে কখনোই আমার দল নমিনেশনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়নি।
আমাদের নমিনেশনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত সব সময় কমবেশি, যা ছিল বা ভবিষ্যতে আমরা যেটিকে মূল্যায়ন করব—সেটি হচ্ছে অবশ্যই কোনো একটি পার্টিকুলার এলাকা থেকে আমরা আমাদের দলের এমন একজন ব্যক্তিকেই নমিনেশন দিতে চাইব, যে ওই এলাকার সমস্যা সম্পর্কে সচেতন আছে, যার সাথে ওই এলাকার মানুষের সম্পৃক্ততা আছে, উঠাবসা আছে, যে ওই এলাকার মানুষের সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম।
যে ওই এলাকার বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ, তরুণ, নারী, মুরব্বিসহ ছাত্রছাত্রী সবার সাথে যার একটা কমিউনিকেশন আছে। এই ধরনের মানুষকেই আমরা প্রায়োরিটি দিব, খুবই স্বাভাবিক। অর্থাৎ যার প্রতি জনসমর্থন আছে। যে জনসমর্থনকে তার সাথে রাখতে পারে। জনগণের যার প্রতি সমর্থন আছে সে রকম মানুষকে দেখেই আমরা নমিনেশন দেব।
বিবিসি বাংলা: সেখানে তৃণমূলের মতামত কতটা প্রাধান্য পাবে? অভিযোগ আছে যে তৃণমূলের মতামত প্রাধান্য কম পায়?
তারেক রহমান: না, ব্যাপারটা এ রকম না। দেখুন গণতন্ত্রে স্বাভাবিক যেখানেই গণতন্ত্র আছে, সেখানে মতামত থাকতেই পারে। বিভিন্ন রকম মতামত অভিযোগ। হয়তো এক জায়গায় ৫০ জন আছে। ৫০ জনের মধ্যে ৩০ জন একটি কথা বলছে, ১৫ জন একটি কথা বলছে। বাকিরা আরেকটি কথা বলছে। তাহলে আপনি কি বলবেন যে মতামত নে্য়ও হচ্ছে না? না।
স্বাভাবিকভাবেই যেখানে আমরা মেজরিটির যেটা মতামত পাবো, এলাকার মানুষের কম বেশি। আমরা তো আমাদের মতন করে খোঁজ করছি। সেটি তৃণমূলই হোক বা সেটি সাধারণ মানুষের হোক।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য—আমরা কিন্তু দলের নেতৃত্ব নির্বাচন করছি না। আমরা নির্বাচন করছি এমন একজন ব্যক্তিকে, যেই শুধু দলেরই সমর্থন নয় বরং দলমত-নির্বিশেষে ওই এলাকার অধিকাংশ মানুষের সমর্থন যার প্রতি আছে।
আমরা এ রকম একজন মানুষকে বের করে আনতে চাইছি। এ রকম একজন মানুষকে আমাদের দলের মনোনয়ন দিতে চাইছি। শুধু দল দিয়ে তো নির্বাচন হবে না। নির্বাচনে তো সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ থাকে। বিভিন্ন মানুষের অংশগ্রহণ থাকে।
কাজেই যার সমর্থন আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করব, চেষ্টা করছি যার প্রতি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সমর্থন আছে। শুধুমাত্র দলীয় সমর্থন নয়, এরকম মানুষ।
প্রধানমন্ত্রী পদের প্রত্যাশী কি না?
বিবিসি বাংলা: নির্বাচন প্রসঙ্গে আপনার কাছে জানতে চাই যে আগামী নির্বাচনে আপনার ভূমিকা কী হবে, আপনি কি সরাসরি নির্বাচন করছেন? আপনাকে কি আমরা প্রধানমন্ত্রী পদের প্রত্যাশী হিসেবে দেখতে পাব নির্বাচনে?
তারেক রহমান: আমার মনে হয়, আপনি প্রথম দিকে বোধহয় একটা প্রশ্ন করেছেন, আমি ওখানে বলেছিলাম স্বাভাবিক আমি একজন রাজনৈতিক দলের সদস্য। একজন রাজনৈতিক কর্মী আমি। নির্বাচনের সাথে তো রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক কর্মীর ওতপ্রোত সম্পর্ক।
কাজেই নির্বাচন যেখানে একটি মানে জনগণের সম্পৃক্ত, এ রকম একটি নির্বাচন হবে, সেখানে তো অবশ্যই আমি নিজেকে দূরে থাকতে পারব না। আমাকে আসতেই হবে। স্বাভাবিকভাবেই মাঠেই ইনশা আল্লাহ থাকব আমি। আপনি আপনার প্রশ্নের পরের যে অংশটি ছিল, দেখুন আমি মনে করি এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জনগণের। এটি তো আমার সিদ্ধান্ত না। এটি সিদ্ধান্ত নিবে বাংলাদেশের জনগণ।
বিবিসি বাংলা: কিন্তু আপনি নির্বাচনে অংশ নেবেন কিনা সেই সিদ্ধান্ত তো আপনাকে নিতে হবে।
তারেক রহমান: না না সেটি তো নিব, কেন নিব না? অবশ্যই নিব।
বিবিসি বাংলা: আপনি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন তাহলে?
তারেক রহমান: জ্বি, ইনশা আল্লাহ।
বিবিসি বাংলা: অর্থাৎ বিএনপি যদি ক্ষমতায় আসে বা নির্বাচনে অংশ নেয় সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী পদের প্রত্যাশী হিসেবে আমরা তারেক রহমানকে দেখতে পাব সেটা আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি?
তারেক রহমান: এটির সিদ্ধান্ত তো বাংলাদেশের জনগণের।
বিবিসি বাংলা: বিএনপির পক্ষ থেকে?
তারেক রহমান: সে ক্ষেত্রে তো এটি দল সিদ্ধান্ত নেবে। দল কিভাবে করবে এটি তো দলের সিদ্ধান্ত।
নির্বাচনে খালেদা জিয়ার ভূমিকা কি হবে?
বিবিসি বাংলা: সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং আপনাদের দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া তিনি কি এ নির্বাচনে কোনো ভূমিকায় থাকবেন? তাকে কি আমরা নির্বাচনে কোনো ভূমিকায় দেখতে পাবো?
তারেক রহমান: আপনি এমন একজন মানুষের কথা বলেছেন, যেই মানুষটি বাংলাদেশের গণতন্ত্র, যতবার গণতান্ত্রিক অধিকারকে হরণ করা হয়েছে, প্রতিবার উনি অবদান রেখেছেন। সেই গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত বা পুনরুদ্ধার করার জন্য।
এবারও আপনাদের সকলের চোখের সামনেই ঘটেছে যে কীভাবে স্বৈরাচারের সময় তার উপরে অত্যাচারের খড়গহস্ত নেমে আসে। কিন্তু উনি আপোষ করেননি। এরকম একজন ব্যক্তি আজ অসুস্থ। কেন কীভাবে উনি শারীরিকভাবে অসুস্থ হলেন, মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে তাকে জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হলো।
আমরা দেখেছিলাম একজন সুস্থ মানুষ গিয়েছেন। কিন্তু যখন বেরিয়ে এসেছেন একজন অসুস্থ মানুষ বেরিয়ে এসেছেন। তাকে চিকিৎসার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে। এ সবগুলোই ঘটনা দেশবাসী জানেন। তারপরেও যে মানুষটির এত বড় অবদান রয়েছে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করার।
আমি সেই দলের একজন কর্মী হিসেবে বিশ্বাস করি বা বিশ্বাস করতে চাই গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে যেই প্রত্যাশিত, জনপ্রত্যাশিত যে নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, উনার শারীরিক সক্ষমতা যদি এলাও করে উনাকে নিশ্চয়ই উনি কিছু না কিছু ভূমিকা রাখবেন।
বিবিসি বাংলা: সেটা কি নির্বাচনে অংশগ্রহণ হতে পারে?
তারেক রহমান: এটি আমি এখনো বলতে পারছি না। আমি মাত্রই বললাম যে উনার শারীরিক বা ফিজিক্যাল এবিলিটির উপরে বিষয়টি কিছুটা হলেও নির্ভর করছে।
বিবিসি বাংলা: এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন চলে আসে বিএনপির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়ে। আপনার বাবা সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আপনার মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তিনি চার দশক বিএনপির নেতৃত্ব দিয়েছেন। এখন আপনি কার্যত দলের নেতৃত্বে রয়েছেন আপনি। বিএনপির ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে পরিবারের প্রভাব কতটা থাকবে?
তারেক রহমান: দেখুন বিষয়টিকে আমি একটু তাহলে অন্যভাবে উপস্থাপন করি। সব রকম সকলের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই আমি বলতে চাইছি। দেখুন, একজন চিকিৎসকের সন্তান যখন চিকিৎসক হয় তখন সে ভালোও করে সে খারাপও করে। একজন লয়ারের সন্তানও দেখা যায় যে অনেক সময় বাবা-মায়ের মতন ভালো লয়ার (আইনজীবি) হয় অথবা হয় না।
রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে অনেকের সন্তান পলিটিক্সে এসেছে। সবাই কি ভালো করেছে? সবাই ভালো করেনি। কেউ কেউ করেছে কেউ কেউ করতে পারেনি ভালো।
আপনি যদি আমাকে ইঙ্গিত করে থাকেন, তাহলে এভাবে আমি বলব যে, দেখুন আমরা দেখেছি বাংলাদেশের মতন দেশে রাজনীতি যারা করেন বিগত ১৭ বছরে দেখেছি। তার আগেও আমরা দেখেছি রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করতে গিয়ে বিভিন্নভাবে হ্যারাসমেন্টের শিকার হন। মিথ্যে মামলার শিকার হন। আমাদের বহু নেতা-কর্মী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। জেল জুলুম খেটেছে। ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। যেই কয়টা উদাহরণ দিলাম আমি মাত্র।
আপনি কি বলতে পারবেন, এর কোনোটার মধ্যে দিয়ে আমি যাইনি? এর প্রতিটার ভেতর দিয়ে আমি গিয়েছি। প্রত্যেকটা স্তর পার করে এসেছি আমি। আমি শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েছি। যেই নির্যাতনের চিহ্ন এখনো কখনো কখনো আমাকে সহ্য করতে হয়। জেল জুলুম খেটেছি আমি। বিভিন্নভাবে মিথ্যা অপপ্রচারের শিকার হয়েছি আমি। সবকিছুর ভিতর দিয়েই আমি পেরিয়ে এসেছি।
কাজেই এইজন্য এই কথাগুলো আমি বললাম যে রাজনীতি পরিবারকরণ হয় না। এটি সমর্থনের ভিত্তিতে হয়। কাজেই যে অর্গানাইজ করে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে দলকে ঐক্যবদ্ধ করে সামনে এগিয়ে যেতে পারবে সে এগিয়ে যেতে পারবে। কেউ যদি এগিয়ে যেতে না পারে, তাহলে সে এগিয়ে যেতে পারবে না। সময় পরিস্থিতি সবকিছু প্রমাণ করে দিবে।
বিবিসি বাংলা: আপনার স্ত্রী বা কন্যা বা আপনার পরিবারে যারা আছেন তারা রাজনীতিতে আসবেন কিনা এটা নিয়ে কিন্তু ব্যাপক আলোচনা আছে। আলোচনা হয় কিন্তু রাজনীতিতে। তো এ ধরনের কি কোনো সম্ভাবনা আছে বা তারা আগ্রহী কি না রাজনীতিতে আসার ব্যাপারে?
তারেক রহমান: আমি ওই যে বললাম সময় পরিস্থিতি বলে দিবে ওটা।
বিএনপির অগ্রাধিকার
বিবিসি বাংলা: একটু আবার নির্বাচনের দিকে যাই। বিএনপি সর্বশেষ সরকারে ছিল ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত। এরপর প্রায় ১৯ বছর পরে বিএনপির সামনে আবার একটা সরকার গঠনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। সেই তখনকার যে বিএনপি আর এখনকার যে বিএনপি এই দুটোর পার্থক্যটা আপনি কোথায় কী বলবেন?
তারেক রহমান: এই ১৯ বছরে আমরা বাংলাদেশ বলি বা পুরো বিশ্ব বলি অনেক কিছু পরিবর্তিত হয়েছে সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়েছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়েছে। দুটো বড় বড় জিনিসের বোধহয় পরিবর্তন হয়েছে।
একটি হচ্ছে কোভিডের ভিতর দিয়ে পুরা বিশ্ব গিয়েছে। এই কোভিড বিভিন্নভাবে আমাদের অনেক কিছু চিন্তা ভাবনা মনোজগত চেঞ্জ করেছে। ঠিক একইভাবে যদি আরেকটি বিষয় আমরা দেখি এই যে আপনার সাথে আমি কথা বলছি অনলাইনে, এই যে আইটি বা সোশ্যাল মিডিয়া এই পুরো বিষয়টা কিন্তু মানুষের মনোজগতকে ভিন্নভাবে ভিন্ন রকম করেছে।
অনেক্ষক্ষেত্রে মনোজগতে একটা প্রভাব বিস্তার করেছে। খুব স্বাভাবিকভাবে আপনি যেই সময়ের কথা বলেছেন সেই সময় এই বিষয়গুলো হয়তো সেভাবে ছিল না। তো স্বাভাবিকভাবেই এই সবকিছু বিবেচনা করে সামনের দিনগুলোতে আমাদেরকে এই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব রেখে বিভিন্ন বিষয়ে চিন্তাভাবনা করতে হচ্ছে।
আমরা সেভাবে চিন্তাভাবনা করে আমাদের প্ল্যান প্রোগ্রাম বিষয়গুলোকে আমরা সাজাচ্ছি। সেই সময় থেকে ১৯ বছর আগে আমাদের যেসব প্ল্যান প্রোগ্রাম ছিল, তার থেকে কিছুটা পরিবর্তন হবে।
কিন্তু ওই যে বেসিক যে জিনিসটা সেটা হচ্ছে মানুষের বেটারমেন্ট। মানুষের ভালো কিছু করার জন্য মানুষ যাতে আজকে যেমন আছে আগামীকাল যাতে একটু বেটার থাকতে পারে কি, কীভাবে সেটা করা যেতে পারে, কে কোনো শ্রেণি কীভাবে একটু বেটার থাকতে পারে, সেটিই থাকবে আমাদের সবচেয়ে প্রায়োরিটি ইস্যু।
দুর্নীতি প্রশ্নে বিএনপি ভোটারদের আশ্বস্ত করবে কীভাবে
বিবিসি বাংলা: বিগত যখন বিএনপি সরকারে ছিল তখন অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা ছিল, তার মধ্যে একটা বড় বিষয় ছিল দুর্নীতির অভিযোগ। সরকারে যারা ছিলেন তাদের অনেকের বিরুদ্ধে বা সেই সময় যেভাবে দুর্নীতি হচ্ছিল বিভিন্ন জায়গায়। আপনার নিশ্চয় মনে আছে যে দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে তখন অনেক সমালোচনা হয়েছিল। এ ধরনের পরিস্থিতি যে আর হবে না এ বিষয়ে আপনি ভোটারদেরকে কিভাবে আশ্বস্ত করবেন?
তারেক রহমান: দেখুন আপনি যে কথাটি বললেন দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন। ৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার ছিল সেই সময়। আমরা ২০০১ সালের পহেলা অক্টোবরে সরকার নির্বাচনের পর ১০ই অক্টোবর সরকার গঠন করি, সম্ভবত।
এর বোধহয় কিছুদিন পরে একটি সূচক বের হলো টিআইবির। মানে দুই তিন মাস পরে বোধহয় একটি সূচক বের হলো।
নিশ্চয়ই মাত্র নির্বাচিত একটি সরকারের পক্ষে তো ভালোমন্দ কোনো কিছুই তিন মাসে করা সম্ভব নয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই যে সূচকটি হয়েছিল সেটি তার আগে আমাদের আগে যে সরকারটি ছিল তারা যে পাঁচ বছর যা করেছে তার উপর ভিত্তি করেই সেই সূচকটি তারা তৈরি করেছে।
আপনি যদি ২০০১ থেকে ২০০৬ অর্থাৎ বিএনপি সরকার গঠন করার পরে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে যখন ক্ষমতা হ্যান্ডওভার করে দিল, আপনি যদি সেই সংস্থা টিএইবি নামক সেই সংস্থাটার রিপোর্টই যদি আপনি দেখেন তাহলে দেখবেন পর্যায়ক্রমিকভাবে, এটি কিন্তু আমার কথা না, এটি তাদের পরিসংখ্যানের কথা-পর্যায়ক্রমিকভাবে কিন্তু নেমে এসেছে।
হ্যাঁ আমি এডমিট করছি পুরাপুরি হয়তো আমরা করতে পারিনি। বাস্তবতা তো বুঝতে হবে। এটি একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। কাজেই এটি মানুষকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে বুঝিয়ে আস্তে আস্তে করতে হবে। জিনিসটি সময় লাগবে।
আমি এখন যত কথাই বলি না কেন বাস্তবতা হচ্ছে এই বিষয়টি যেহেতু সময় লাগবে আমাদেরকে কাজ দিয়ে প্রমাণ করতে হবে।
সেজন্যই আমি ভোটারদেরকে এতটুকু বলতে পারব, আমরা যদি সুযোগ পাই, জনগণ যদি আমাদেরকে সেই সুযোগ দেন, তাহলে আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে আমরা যাতে একটি এমন অবস্থা তৈরি করতে পারি যেখানে কিছুটা হলেও আমরা বহিঃবিশ্বে বিশ্বের অন্য দেশের সামনে কিছুটা হলেও যাতে সম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে কথা বলতে পারি।
চাঁদাবাজি, দখলের মত নানা অভিযোগ নিয়ে যা বললেন
বিবিসি বাংলা: পাঁচই আগস্টের পরে বিএনপির অনেক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে এরই মধ্যে চাঁদাবাজি বা দখলের মত নানা অভিযোগ এসেছে। আপনাদের দল থেকে অনেককে বহিষ্কার করা হয়েছে এটা ঠিক, আবার একই সাথে এটাও ঠিক যে এই অভিযোগগুলো কিন্তু বারবার আসছে। তো এটা থামানো যাচ্ছে না কেন?
তারেক রহমান: আপনার প্রতি সম্মান রেখে আপনার সাথে এগ্রিও যেমন করবো, আবার এখানে অন্য একটি বিষয় আমি তুলে ধরতে চাইবো।
এর মধ্যে নিশ্চয়ই আপনারা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে দেখেছেন যে প্রায় ৭০০০ এর মতন আমাদের নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে আমরা কিছু সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। কিন্তু এই ৭০০০ এ সবাই কিন্তু আপনি যে অভিযোগ করলেন এই অভিযোগের সাথে জড়িত নয়। এর মধ্যে এমন অনেক বিষয় আছে যারা অন্য সাংগঠনিক বিষয়ের সাথে জড়িত। এটি গেল একটি বিষয়।
দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে আমাদের কাছে এরকম যখন অনেক অভিযোগ এসেছে। আমরা অভিযোগগুলো তদন্ত করেছি। তদন্ত করার পরে আমরা বেশ কিছু বিষয় পেয়েছি।
যেমন আমি দুই-একটি উদাহরণ দিয়ে আপনাকে বলি। যেমন-ধরেন দুই ভাই। কোনো একটি এলাকায় দুই ভাই আছে। দুই ভাইয়ের মধ্যে পারিবারিক সম্পত্তি সহায় সম্পত্তি নিয়ে একটি সমস্যা আছে। এক ভাই বিগত যে স্বৈরাচার পলাতক স্বৈরাচার তাদের কারো সাথে এক ভাইয়ের খুব ভালো সম্পর্ক।
তার ফলে সে সেই স্বৈরাচারের যে দোসর যার সাথে এই এক ভাইয়ের সম্পর্ক, সে তার ইনফ্লুয়েন্সটি ব্যবহার করে অন্য ভাইয়ের সম্পত্তিও জোর করে দখল করে রেখেছে। এখন পাঁচ তারিখের পরে যে ভাই স্বৈরাচারের দোসরকে ব্যবহার করেছিল সেই দোসরও তো পালিয়ে গিয়েছে। তো স্বাভাবিকভাবেই সেই ভাই এখন আর শেল্টার পাচ্ছে না।
তো অন্য যার সম্পত্তি জোর করে রেখে দিয়েছিল অন্য ভাইটি। সেই অন্য ভাইটি স্বাভাবিকভাবে তার হক আদায় করতে গিয়েছে বা হক বুঝে নিতে গিয়েছে। এখন এক্সিডেন্টলি বা ইনসিডেন্টলি যে ভাই এতদিনভাবে বঞ্চিত ছিল সম্পত্তি থেকে সেই ভাই বিএনপি করে। বিএনপির কোনো একজন কর্মী বা স্ট্রং সমর্থক বা নেতা যেটাই হোক। চাপিয়ে দিল অভিযোগ তুলে দিল অন্যজন যে বিএনপি দখল করতে গিয়েছে। এ রকম ঘটনা আমরা প্রচুর পেয়েছি।
আবার আরেকটি আমি উদাহরণ দেই যা সত্য, যা বাস্তব। স্বৈরাচারের সময় সারা বাংলাদেশে আমাদের প্রায় ৫০ লাখের বেশি নেতা-কর্মীর নামে বিভিন্ন রকম গায়েবি মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছিল।
আমাদের বহু নেতা-কর্মী তাদের ঘর বাড়িতে থাকতে পারতো না। তাদেরকে বিভিন্নভাবে পালিয়ে থাকতে হতো। বিভিন্নভাবে সরে থাকতে হতো। এই সুযোগে স্বৈরাচার তাদের ব্যবসা বাণিজ্য দোকান-পাট ঘর বাড়ি জমি জমা পুকুর দখল করে নিয়েছিল। পাঁচ তারিখে যখন স্বৈরাচার পলাতক হয়ে গিয়েছে, পালিয়ে গিয়েছে-তখন স্বৈরাচারের যারা দখল করেছে তারাও সাথে সাথে পালিয়ে গিয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই আমাদের নেতা-কর্মীরা তাদের নিজেদের যেগুলি বৈধ সম্পত্তি, পৈতৃক সম্পত্তি সেগুলো আবার ফিরে পেতে গিয়েছে। তখন আবার কিছু সংখ্যক লোক প্রচার করেছে যে বিএনপির লোকজন দখল করতে গিয়েছে এরকম ঘটনা প্রচুর ঘটেছে।
আপনি যেই কথাটি বললেন সেরকমও কিছু ঘটেছে। সে কারণেই আমরা আমাদের অবস্থান থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। তবে এখানে আমার একটি প্রশ্ন আছে, যে প্রশ্নটি আমরা পাবলিকলিও করেছি। দেখুন আমরা একটি রাজনৈতিক দল। কিছু ঘটনা ঘটেছে। আমরা অস্বীকার করছি না। ঘটেছে যেমন, আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি তাদের বিরুদ্ধে।
যতটুকু আমরা জেনেছি, যতটুকু আমরা তদন্তের পরে পেয়েছি, যখন সত্যতা পেয়েছি, আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। কিন্তু পুলিশিং করা তো আমাদের কাজ না। রাজনৈতিক দলের কাজ অবশ্যই পুলিশিং করা না।
আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কখনো বলিনি সরকারকে-যে অমুককে ধরতে পারবে না, তমুককে ধরতে পারবে না, এই করতে পারবে না ওই কথা। আমরা কিন্তু কখনো বলিনি। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে যাদের কাজ পুলিশিং করা তারা কেন তাদের কাজটি করছে না। তারা কেন তাদের কাজে ব্যর্থ এটি আমাদের প্রশ্ন।
বিবিসি বাংলা: তার মানে এখানে সরকারের একটা ব্যর্থতা আছে?
তারেক রহমান: অবশ্যই। আমি তো আগেই বলছি পুলিশিং তো রাজনৈতিক দলের কাজ না পুলিশিং করার দায়িত্ব সরকারের।
বিবিসি বাংলা: অর্থাৎ আমরা ধরে নিতে পারি যে, আপনারা যদি সরকার গঠন করেন সে ক্ষেত্রে আপনার দলের নেতা-কর্মী বা আপনার দলের নামে কোনো চাঁদাবাজি বা দখল এ ধরনের কিছু কেউ সেটা করতে পারবে না, কারণ তখন যেহেতু আপনারা সরকারে থাকবেন?
তারেক রহমান: ইয়েস, পুলিশ পুলিশের কাজ করবে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী আইনশৃঙ্খলার কাজ করবে। বিএনপি ইনশা আল্লাহ সরকার গঠন করলে আমার দলের কোন নেতা-কর্মী তখনো যদি এ রকম কোনো অনৈতিক কাজে সম্পৃক্ত হয় আমরা দলের অবস্থান থেকে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিব।
দল তার পক্ষে থাকবে না, দলের অবস্থান এবং দেশের আইন অনুযায়ী। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার দায়িত্ব যাদের, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তারা তাদের কাজ করবে, সিম্পল। এখানে দুইয়ে দুইয়ে চারের মতন ব্যাপার।
’ডাকসুর প্রভাব পড়বে না জাতীয় রাজনীতিতে’
বিবিসি বাংলা: একটু ডাকসু নির্বাচন প্রশ্নে আসি। সাম্প্রতিক সময়ে ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল ব্যাপক আলোচনা চলছে রাজনীতিতে এখনো। এর ফলাফলে দেখা গেছে যে বিএনপি সমর্থক ছাত্রদলের চেয়ে বেশ বড় ব্যবধানে ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল জয়ী হয়েছে। আপনি কীভাবে দেখেন এই ফলাফলটাকে আসলে?
তারেক রহমান: আমি মনে করি গণতান্ত্রিক যাত্রার একটি ভালো উদ্যোগ এটি। ভালো সূচনা। এটি গেল এক নম্বর।
দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে যারা জয়ী হয়েছেন বা এরকম আরো ভবিষ্যতে যারা জয়ী হবেন, তাদের প্রতি শুভেচ্ছা এবং যারা ভবিষ্যতে জয়ী হবেন তাদের প্রতি অগ্রিম শুভেচ্ছা রইলো।
তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে দেখুন একটা অগ্রযাত্রা শুরু হলো, কিন্তু আমরা চাইছিলাম না যে কোনো বিতর্কের মধ্যে এগুলা পড়ুক। আমরা আশা করব যে পরবর্তীতে যেগুলো হবে সেগুলো বিতর্কবিহীন হবে নির্বাচনগুলো।
বিবিসি বাংলা: এই নির্বাচনের ফলাফল, মানে ডাকসুর নির্বাচনের ফলাফল এটা কি জাতীয় রাজনীতিতে কোনো প্রভাব ফেলতে পারে? আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে আপনার কি মনে হয়? আপনি কি মনে করেন সেটা?
তারেক রহমান: আমি যেটা দেখলাম বিভিন্ন মিডিয়াতে কিছু ব্যক্তি, যেমন-মান্না ভাই, ওনাকে উনি তো বোধহয় দুবার ভিপি ছিলেন। আমার থেকে অনেক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন রাজনীতিবিদ।
আমরা যদি উনার বক্তব্য শুনে থাকি বা ধরে থাকি তাহলে তো আমি মনে করি না কোনো কারণ আছে। ছাত্র রাজনীতি ছাত্র রাজনীতির জায়গায়, জাতীয় রাজনীতি জাতীয় রাজনীতির জায়গায়।
জামায়াতের সম্ভাব্য জোট নিয়ে উদ্বেগ নেই
বিবিসি বাংলা: এখন যে সক্রিয় দলগুলো আছে তাদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর প্রশ্নে যদি একটু আসি, যে জামায়াতে ইসলামীকে ঘিরে বিএনপির নেতাদের অনেক সমালোচনা করতে দেখা যাচ্ছে। গত সাম্প্রতিক সময়ে, তো জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে আপনার মনোভাবটা কি আসলে?
তারেক রহমান: বিষয়টা হচ্ছে যে দেখুন বাংলাদেশের স্বীকৃত যে নিয়ম, আইন-কানুন আছে, এগুলোর ভিতরে থেকে যদি কেউ রাজনীতি করে অবশ্যই করতে পারে।
বিএনপি সবসময় বহুদলীয় রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। কাজেই বিষয়টি আমরা এভাবেই দেখতে চাই।
দেশের যে আইন কানুন আছে তার ভিতরে থেকে যারা রাজনীতি করবে, অবশ্যই সবার রাজনীতি করার অধিকার আছে। এবং আমরা তো চাই সবাই রাজনীতি করুক। বহুদলীয় রাজনীতিতে আমরা বিশ্বাস করি।
বিবিসি বাংলা: জামায়াতে ইসলামী তো বিএনপির সাথে একসময় মিত্র ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের বিরোধী ভূমিকা নিয়ে কিন্তু বিএনপি নেতারা এখন অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, সামনে আনছেন। কিন্তু বিএনপি আবার তাদের সাথে সরকারও গঠন করেছিল একটা সময়?
তারেক রহমান: ২০২৪ সালে স্বৈরাচার যেই হত্যাগুলো করেছে দেশ স্বাধীনের পরে যখন তারা সরকার গঠন করেছিল ক্ষমতায় ছিল তখনও যে সকল লুট তারা করেছে, খুন-গুম তারা করেছে।
বিগত ১৭ বছর গুম খুন যারা করেছে, এর জবাব যে রকম তাদেরকেই দিতে হবে, ঠিক একইভাবে ’৭১ সালে কোনো রাজনৈতিক দল যদি তাদের কোনো বিতর্কিত ভূমিকা থেকে থাকে, তাহলে তাদের জবাব তারাই দিবেন। ওটা তো আর আমি দিতে পারবো না। আমারটা আমি দিতে পারবো। অন্যেরটা তো আমি দিতে পারবো না।
যা বললেন আওয়ামী লীগের রাজনীতি প্রসঙ্গে
বিবিসি বাংলা: আপনি জুলাইয়ের সময়ের কথা বলছিলেন। সে সময়ের হত্যাকাণ্ডের কথা বলছিলেন। সেই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের ব্যাপারে আপনার আপনাদের বা বিএনপির অবস্থানটা কী আসলে?
তারেক রহমান: দেখুন, আমি ১৭ বছর যাবত প্রবাস জীবনে আছি। ওয়ান ইলেভেন, তথাকথিত ওয়ান ইলেভেন সরকারের সময় যেই শারীরিক নির্যাতন আমার উপরে হয়েছিল তারপরে চিকিৎসার জন্য আমি এই দেশে আসি।
আমি যখন এখানে আসি, আমার ভাইকে আমি রেখে এসেছিলাম ছোট ভাইকে। আমি যখন এই দেশে আসি আমার সুস্থ মাকে আমি রেখে এসেছিলাম। একটি ঘর রেখে এসেছিলাম। যেই ঘরে আমি এবং আমার ছোট ভাই বড় হয়েছি। যেই ঘরে আমার বাবার স্মৃতি ছিল। যেই ঘরে আমাদের দুই ভাইয়ের সন্তানরা জন্মগ্রহণ করেছিল। যেই ঘরে আমার মায়ের বহু স্মৃতি ছিল।
সেই স্মৃতিগুলোকে ভেঙে চুড়ে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে ভাইকে আমি রেখে এসেছিলাম সেই ভাই এখন আর নেই। যেই সুস্থ মাকে রেখে এসেছিলাম সেই সুস্থ মা এখন সুস্থ নেই। শুধু অসুস্থই নন, উনার উপরে মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতনও করা হয়েছে।
আমি আমার পরিবারের যেই কাহিনী আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম। এটিকে আপনারা কাহিনী বলুন, বা সংগ্রাম বলুন যেটাই বলুন না কেন, এটি শুধু আমার কাহিনী না, বা আমার পরিবারের কাহিনী না। এরকম কাহিনী বাংলাদেশের শত না, হাজার হাজার পরিবারের।
যে পরিবারের বাবা, যে পরিবারের ভাই, যে পরিবারের স্বামী তার ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে, হ্যান্ডকাফ পারা অবস্থায় হাসপাতালের বারান্দায় মারা গিয়েছে, তা না হলে হ্যান্ডকাফ পারা অবস্থায় জেলের ভিতরে মারা গিয়েছে, সহায় সম্পত্তি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে-এই সকল অন্যায়, এই সকল হত্যা, এই সকল নির্যাতনের জন্য যারা দায়ী, যারা এসবের হুকুম দিয়েছে, তাদের প্রত্যেকের বিচার হতে হবে।
এটি প্রতিশোধের কোনো বিষয় নয়। এটি ন্যায়ের কথা। এটি আইনের কথা। অন্যায় হলে তার বিচার হতে হয়। কার সম্পর্কে কী মনোভাব সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়।
বিবিসি বাংলা: এখানে একটা বিষয় আলোচনায় এসেছে যে যারা অপরাধী তাদের বিচার হবে। কিন্তু দল হিসেবে আওয়ামী লীগ তাদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারা-না পারার প্রশ্নে বিএনপিরও অনেক নেতা অনেক সময় বলেছেন যেকোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে তারা নন। তো এখন নির্বাচনও সামনে আসছে। ফলে আওয়ামী লীগ রাজনীতি করতে পারবে কি পারবে না সে ধরনের একটা প্রশ্নও আসছে। তো সেটা সেই জায়গাটাতে বিএনপির অবস্থানটা কী হতে পারে?
তারেক রহমান: দল হিসেবে তারা যদি অন্যায় করে থাকে তাহলে দেশের আইন অনুযায়ী তার বিচার হবে। দেশের আইন সিদ্ধান্ত নেবে।
বিবিসি বাংলা: তার মানে এটা আদালতের বিষয় বলে মনে করছেন?
তারেক রহমান: দল হিসেবে যদি অন্যায় হয়ে থাকে তাহলে তাই হবে। সোজা কথায় অন্যায়কারীর বিচার হতে হবে। তো সেটি ব্যক্তি হোক, সেটি দলই হোক। যারা জুলুম করেছে তাদের তো বিচার হতে হবে। সেটি ব্যক্তিও হতে পারে। সেটি দলও হতে পারে।
বিবিসি বাংলা: আপনি ব্যক্তিগতভাবে কী মনে করেন? আওয়ামী লীগের কি বাংলাদেশের রাজনীতিতে থাকা উচিত নাকি, না?
তারেক রহমান: আমার মনে হয় আপনার কোনো কোনো প্রশ্নের উত্তরে আমি মনে হয় বলেছিলাম যে আমরা রাজনীতি করি জনগণের জন্য।
আমরা বিশ্বাস করি এবং বিভিন্ন সময় বলিও আমরা বিএনপি যারা করি আমাদের রাজনৈতিক সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এবং বিশ্বাস করতে চাই-যে দলের ব্যক্তিরা বা যে দল মানুষ হত্যা করে, মানুষ গুম করে, মানুষ খুন করে, দেশের মানুষের অর্থসম্পদ লুটপাট করে বিদেশে পাচার করে-জনগণ তাদেরকে সমর্থন করতে পারে বলে আমি মনে করি না।
জনগণ যদি সমর্থন না করে কোনো রাজনৈতিক দল বা রাজনৈতিক সংগঠনকে তাদের টিকে থাকার তো কোনো কারণ আমি দেখি না। যেহেতু জনগণের শক্তিতে আমরা বিশ্বাস করি, জনগণের সিদ্ধান্তে আমরা বিশ্বাস করি। জনগণের সিদ্ধান্তের উপরে আমরা আস্থা রাখতে চাই। এ বিষয়ে সবচেয়ে বড় বিচারক আমি মনে করি জনগণ।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাথে বিবিসি বাংলার সাক্ষাৎকারের এটি প্রথম পর্ব। দ্বিতীয় পর্বটি প্রকাশ হবে মঙ্গলবার ৭ই অক্টোবর বিবিসি বাংলার ওয়েবসাইট, ফেসবুক পাতা ও ইউটিউব চ্যানেলে।
বিবিসি বাংলা: তারেক রহমান আপনাকে অনেক ধন্যবাদ বিবিসি বাংলার সাথে যোগ দেবার জন্য।
তারেক রহমান: আপনাদেরকেও অনেক ধন্যবাদ, আমাকে কথা বলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।
বিবিসি বাংলা: আপনি কেমন আছেন? আপনার সময় কেমন যাচ্ছে?
তারেক রহমান: আলহামদুলিল্লাহ, আমি শারীরিকভাবে ভালো আছি। সময় তো স্বাভাবিকভাবে ব্যস্তই যাচ্ছে। ফিজিক্যালি হয়তো আমি এই দেশে আছি, বাট মন-মানসিকতা সবকিছু মিলিয়ে তো আমি গত ১৭ বছর ধরে বাংলাদেশেই রয়ে গিয়েছি।
বিবিসি বাংলা: আমরা এমন একটা সময় আপনার সাথে কথা বলছি, যখন বাংলাদেশ ইতিহাসে একটা গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে বললে ভুল বলা হবে না। ২০২৪ সালে একটি ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের শাসনের অবসান হয়েছে। আর কয়েক মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ একটি নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে আপনি আপনার অনেক দলীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন, কথা বলেছেন, নিয়মিতই কথা বলে যাচ্ছেন। কিন্তু গণমাধ্যমের সাথে আপনি এই দীর্ঘ সময় কথা বলেননি। এত দিন ধরে আপনি কথা বলেননি কেন?
তারেক রহমান: ব্যাপারটা বোধ হয় এ রকম না, ব্যাপারটা বোধয় একটু ভিন্ন। আসলে আমি কথা ঠিকই বলেছি। আমি দীর্ঘ ১৭ বছর এখানে আছি এই দেশে, প্রবাস জীবনে, তবে আমার ওপরে যখন দলের দায়িত্ব এসে পড়েছে; তারপর থেকে আমি গ্রামেগঞ্জে আমার নেতা-কর্মীসহ তাদের সাথে বিভিন্ন পর্যায়ে সাধারণ মানুষ যখন যেভাবে অংশগ্রহণ করেছে, আমি সকলের সাথে কথা বলেছি।
আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, বিগত স্বৈরাচার সরকারের সময় কোর্ট থেকে রীতিমতন একটা আদেশ দিয়ে আমার কথা বলার অধিকারকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আমি যদি গণমাধ্যমে কিছু বলতে চাইতাম, হয়তো গণমাধ্যমের ইচ্ছা ছিল ছাপানোর, গণমাধ্যম সেটি ছাপাতে পারত না।
আমি একবার প্রেসক্লাবে কথা বলেছিলাম। তখন পরের দিন দেখলাম যে প্রেসক্লাবে একটি তখনকার যেই প্রেসক্লাবের যারা সদস্য ছিলেন বা কমিটি ছিল, তারা একটি মিটিং ডেকে একটি সভা করে সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা তখন আমাকে আইনের দৃষ্টিতে ফেরারি বলা হয়েছিল যে, সে রকম কোনো ব্যক্তিকে তারা প্রেসক্লাবে কথা বলতে দিবে না। এভাবে তারা চেষ্টা করেছিল আমার কথা বন্ধ করে রাখতে।
আমি কথা বলেছি, সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন পন্থায় আমি পৌঁছানোর চেষ্টা করেছি, আমি ইনশা আল্লাহ পৌঁছেছি মানুষের কাছে। কাজেই গণমাধ্যমে যে কথা বলিনি তা না। আমি কথা বলেছি হয়তো আপনারা তখন কথা নিতে পারেননি অথবা শুনতে পারেননি। ইচ্ছা থাকলেও ছাপাতে পারেননি হয়তো প্রচার করতে পারেননি। কিন্তু আমি বলেছি আমি থেমে থাকিনি।
দেশে ফেরার প্রশ্নে যা বললেন?
বিবিসি বাংলা: আমি অবশ্য সাক্ষাৎকারের কথা বলছিলাম যে প্রশ্নোত্তরের বিষয়টি মানে বিশেষ করে গত এক বছরে। বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পেরিয়ে গেছে এবং অনেকের ধারণা ছিল, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আপনি দেশে এসে সশরীরে দলের নেতৃত্ব দেবেন। গত এক বছরে যে প্রশ্নটা বারবার ঘুরেফিরে এসেছে এবং এখনো আসছে যে আপনি এখনো দেশে ফেরেননি কেন। কেন আপনি এখনো দেশে ফেরেননি?
তারেক রহমান: কিছু সংগত কারণে হয়তো ফেরাটা হয়ে ওঠেনি এখনো। তবে সময় তো চলে এসেছে মনে হয়। ইনশা আল্লাহ দ্রুতই ফিরে আসব।
বিবিসি বাংলা: সেটা কবে, আমরা কি জানতে পারি?
তারেক রহমান: দ্রুতই মনে হয়। দ্রুতই ইনশা আল্লাহ।
বিবিসি বাংলা: নির্বাচনের আগে কি তাহলে আপনি দেশে আসবেন, এমন সম্ভাবনা বলা যায়?
তারেক রহমান: রাজনীতি যখন করি, আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে স্বাভাবিক, নির্বাচনের সাথে রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক কর্মীর একটি ওতপ্রত সম্পর্ক। কাজেই যেখানে একটি প্রত্যাশিত, জনগণের প্রত্যাশিত নির্বাচন হবে, সেই নির্বাচনের সময় কেমন করে দূরে থাকব? আমি তো আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে, ইচ্ছা থাকবে, আগ্রহ থাকবে সেই প্রত্যাশিত যে প্রত্যাশিত নির্বাচন জনগণ চাইছে। সেই প্রত্যাশিত নির্বাচন যখন অনুষ্ঠিত হবে, জনগণের সাথে জনগণের মাঝেই থাকব ইনশা আল্লাহ।
বিবিসি বাংলা: একটা বিষয়, যেটা আপনার দল থেকে, মাঝে দলের নেতাদের কেউ কেউ কখনো কখনো বলেছেন যে একটা নিরাপত্তার শঙ্কার কথা বলেছেন। আপনি না আসার পেছনে, আপনি কি কোনো ধরনের শঙ্কা বোধ করেছেন এর মধ্যে?
তারেক রহমান: বিভিন্ন রকম শঙ্কার কথা তো আমরা অনেক সময় বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে তো শুনেছি। সরকারেরও বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকেও তো অনেক সময় অনেক শঙ্কার কথা বিভিন্ন মাধ্যমে, বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রকাশিত হয়েছে।
’কোনো ব্যক্তি নয়, মাস্টারমাইন্ড গণতন্ত্রকামী জনগণ’
বিবিসি বাংলা: জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রসঙ্গে আসি। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আপনার ভূমিকা নিয়ে অনেক আলোচনা আছে। এটি মোটামুটি সব পক্ষই স্বীকার করেও যে সেই সময়ে আপনার একটা সক্রিয় ভূমিকা ছিল। আবার আপনার দলের কোনো কোনো নেতা বা সমর্থক তারা এই অভ্যুত্থানে আপনাকে ’একমাত্র মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। আপনি কি নিজেকে এই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে দেখেন?
তারেক রহমান: না। আমি অবশ্যই এই জুলাই আন্দোলনে আমাকে আমি কখনোই মাস্টারমাইন্ড হিসেবে দেখি না। এই যে ৫ই অগাস্ট যেই আন্দোলন, জুলাই আন্দোলন বলে যেটি বিখ্যাত বা যেটি সকলের কাছে গৃহীত, এই আন্দোলনটি সফল হয়েছে জুলাই মাসে। কিন্তু এই আন্দোলনটি প্রেক্ষাপট শুরু হয়েছে কিন্তু বহু বছর আগে থেকে।
এই আন্দোলনে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীরা, সেটি বিএনপি হোক বা অন্য রাজনৈতিক দলগুলো হোক, যারা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছে। বিভিন্নভাবে তাদের নেতা-কর্মীরা নির্যাতিত হয়েছে।
আমি মনে করি, জুলাই-আগস্ট মাসে এসে জনগণ সকল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের সাথে অংশগ্রহণ করেছে। শুধু কী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাই সেদিন ছিল মাঠে? অবশ্যই নয়।
আমরা দেখেছি, সেদিন মাদ্রাসার ছাত্ররা তাঁরা ছিলেন এই আন্দোলনের মাঠে। আমরা দেখেছি গৃহিণীরা পর্যন্ত রাস্তায় নেমে এসেছেন সন্তানের পেছনে। আমরা দেখেছি, কৃষক, শ্রমিক, সিএনজিচালক, ছোট দোকান কর্মচারী বা দোকানমালিক থেকে আরম্ভ করে গার্মেন্টস কর্মী—তাঁরা নেমে এসেছিলেন। আমরা দেখেছিলাম, সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নেমে এসেছিলেন এই আন্দোলনে।
এমন অনেক সাংবাদিক, যাঁরা স্বৈরাচারের অত্যাচারে নির্যাতিত হয়ে দেশ থেকে বাইরে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁরা সম্পৃক্ত হয়েছিলেন এই আন্দোলনে। কাজেই কারও ভূমিকাকে আমরা ছোট করে দেখতে চাই, না খাটো করে দেখতে চাই না।
আমি বিশ্বাস করি, দৃঢ়ভাবে সমাজের দলমত-নির্বিশেষে শ্রেণিবিন্যাস নির্বিশেষে প্রত্যেকটি মানুষের অবদান আছে।
এই আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের জনগণের আন্দোলন, যাঁরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তাঁরাই এই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড। কোনো দল, কোনো ব্যক্তি নয়, এই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ।
বিবিসি বাংলা: যখন আন্দোলনটা চলছিল, তখন আন্দোলনে যে ছাত্রনেতৃত্ব ছিল, তাদের সাথে আপনার কতটা যোগাযোগ ছিল? আপনার দলের সাথে তো নিশ্চয়ই যোগাযোগ ছিল, অন্যদের সাথে আপনাদের আপনার কতটা যোগাযোগ ছিল?
তারেক রহমান: স্বাভাবিকভাবে আমি যেহেতু বাইরে থেকে কাজ করছি, আমাকে যোগাযোগটা অনলাইনের মাধ্যমে রাখতে হয়েছে এবং সেই দিনগুলোতে আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে টেলিফোন সিস্টেম বা অনলাইন সিস্টেমের কী অবস্থা করেছিল স্বৈরাচার।
আপনি যোগাযোগের যেটি কথা বলেছেন, এই যোগাযোগটি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বিভিন্নভাবে আমাদেরকে করতে হয়েছে। বিভিন্ন মাধ্যমে করতে হয়েছে। যোগাযোগটা যে খুব স্মুথ সব সময় থেকেছে, তা নয়। প্রত্যেকে সহযোগিতা করেছি আমরা।
বিবিসি বাংলা: ছাত্র-জনতার যে অভ্যুত্থান, সেটির পরে এটার কৃতিত্ব কার সেটা নিয়ে বিভিন্ন পক্ষ দাবি করেছে, তাতে কি আপনার মনে হয় যে এর ফলে বিভিন্ন পক্ষের যে সংকীর্ণ স্বার্থ পূরণের চেষ্টা, সেটাই একটু বেশি প্রকট হয়েছে এবং এখানে বিএনপির আসলে কোনো দায় আছে কি না?
তারেক রহমান: দেখুন ব্যাপারটা আমরা যদি একটু অন্যভাবে দেখি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত এটি একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা।
এই আন্দোলন, মানুষের এই আত্মত্যাগ সাধারণত কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনে বা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শিশু হত্যা হয় না, শিশু শহীদ হয় না, শিশু মৃত্যুবরণ করে না। বাট আমরা দেখেছি এই আন্দোলনে স্বৈরাচারের এই আন্দোলনে যতটুকু আমার মনে আছে, প্রায় ৬৩ জন শিশু শহীদ হয়েছে, মারা গিয়েছে।
আমি আগেই বলেছি, আপনার আগের প্রশ্নের উত্তরে বলেছি যে এই আন্দোলনের ক্রেডিট দলমত-নির্বিশেষে বাংলাদেশের জনগণের, কোনো একটি রাজনৈতিক দলের নয়।
অনেকে হয়তো অনেক কিছু বলে থাকতে পারেন, ডিমান্ড করতে পারেন, সেটি তাঁদের অবস্থান।
আমি বা আমার দলের অবস্থান হচ্ছে, আন্দোলন হয়ে গিয়েছে, আন্দোলনের জনগণ সফলতা লাভ করেছেন। আন্দোলনে স্বাভাবিকভাবেই দুটো পক্ষ আছে। একটি পক্ষ হচ্ছে মানুষ শহীদ হয়েছে। ২০০০-এর মতো মানুষকে হত্যা করা হয়েছে আন্দোলনে। আবার আরেকটি পক্ষ হচ্ছে প্রায় ৩০ হাজারের মতন মানুষ বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন অন্ধ হয়ে গিয়েছেন।
আমার মনে হয়, আমাদের উচিত হবে, এখন আমাদের সকলের উচিত হবে রাষ্ট্রসহ সরকারসহ রাজনৈতিক দলগুলোর যার যতটুকু সম্ভব, সেই পরিবারগুলোর পাশে গিয়ে দাঁড়ানো। যতটুকু সহযোগিতা তাদেরকে করা যায়, যতটুকু সম্ভব তাদের পাশে দাঁড়ানো। তাদের এই আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানানো।
নির্বাচন এককভাবে নাকি দলগতভাবে
বিবিসি বাংলা: অন্তর্বর্তী সরকারের শুরু থেকেই দেখা গেছে যে বিএনপির পক্ষ থেকে দ্রুত নির্বাচন দাবি করা হয়েছে। সরকার গড়িমসি করছে এ ধরনের অভিযোগও বিএনপির নেতারা করে আসছেন। তো এখন দেখা যাচ্ছে যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং নির্বাচন কমিশন তারা ফেব্রুয়ারিতে একটা নির্বাচনের সময় দিয়েছেন। তো ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হবে—আপনাদের আস্থা কতটা আছে তাতে?
তারেক রহমান: বিএনপি প্রথম থেকেই বলে আসছিল যে যত দ্রুত নির্বাচনটি হবে, তত দ্রুত দেশের মধ্যে একটি স্থিতিশীলতা আসবে। দেখুন বাংলাদেশের মানুষ গত ১৭ বছর যাবৎ তাদের রাজনৈতিক অধিকার যেমন তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, তাদেরকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছিল।
যার ফলশ্রুতিতে আমরা সমাজে অনেকগুলো পর্যায়ক্রমিকভাবে স্পিলওভার ইফেক্ট বলতে যা বোঝায় অনেকগুলো খারাপ লক্ষণ দেখেছি। বেকার সমস্যা বেড়েছে, দরিদ্রতা বেড়েছে। শিক্ষাব্যবস্থা ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। চিকিৎসাব্যবস্থা ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। কৃষিব্যবস্থা ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়েছে।
আমরা সে জন্যই বলেছিলাম যে যত দ্রুত নির্বাচন হবে, যত দ্রুত দেশের মালিক যারা অর্থাৎ জনগণ তাদের কাছে যখন সেই অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হবে, তারা যখন সিদ্ধান্ত নেবে, অর্থাৎ দেশের মালিক যখন সিদ্ধান্ত নিবে দেশ কারা কীভাবে পরিচালিত করবে, তত দ্রুত দেশে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।
কারণ, প্রকৃতভাবে নির্বাচিত একটি সরকার অবশ্যই জনগণের যে চাওয়া অর্থাৎ, জনগণ যেভাবে চায় সেই বিষয়গুলোকে তারা অ্যাড্রেস করবে। ইয়েস, একটি নির্বাচন হলেই যে সব রাতারাতি সব ঠিক হয়ে যাবে তা না। সমস্যাগুলোকে যখন আপনি অ্যাড্রেস করবেন খুব স্বাভাবিকভাবেই ধীরে ধীরে সমস্যা কমতে শুরু করবে।
আমরা আনন্দিত যে দেরিতে হলেও সরকার জিনিসটি উপলব্ধি করতে পেরেছেন। আমরা ডিসেম্বরের ভিতরে চেয়েছিলাম। উনারা ফেব্রুয়ারির ভিতরে এখন নির্বাচনটি করতে চাইছেন। আমরা আস্থা রাখতে চাই যে সরকার সে ব্যাপারে সব রকম উদ্যোগ পর্যায়ক্রমিকভাবে গ্রহণ করবেন।
বিবিসি বাংলা: এখন যেহেতু আপনারা বলছেন যে আপনারা আস্থা রাখতে চান, সেখানে নির্বাচন নিয়ে আপনার পরিকল্পনাটা কি? এককভাবে বিএনপি নির্বাচন করবে মানে দলগতভাবে নাকি জোটবদ্ধভাবে আসন ভাগাভাগির মাধ্যমে নির্বাচন করবে?
তারেক রহমান: খুব ট্রিকি কোশ্চেন একটু। দেখুন আমরা প্রায় ৬৪টি রাজনৈতিক দল বিগত স্বৈরাচারের সময় যার যার অবস্থান থেকে রাজপথে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে।
আমরা চেষ্টা করেছিলাম কমবেশি একসাথে কাজ করার জন্য। এমনকি আমরা যে ৩১ দফা দিয়েছি রাষ্ট্র পুনর্গঠনের, এটি প্রথমে ২০১৬ সালে আমরা দিয়েছিলাম শুধু বিএনপির পক্ষ থেকে। পরবর্তীতে ভিশন টুয়েন্টি ছিল। যেটা পরবর্তীতে কিছুটা আরেকটু ডেভেলপ করে আমরা ২৭ দফা দিয়েছিলাম।
পরবর্তীতে আমরা আমাদের সাথে যে রাজনৈতিক দলগুলো আছে তাদের সাথে পরামর্শ করে সকলের মতামত নিয়ে আমরা ৩১ দফা দিয়েছি। কারণটি হচ্ছে যে দলগুলোকে আমরা পেয়েছি, আমাদের সাথে রাজপথের আন্দোলনে, আমরা চাই সকলকে সাথে নিয়ে রাষ্ট্র পুনর্গঠন করতে। সকলের মতামতকে সাথে নিয়ে আমরা রাষ্ট্র পুনর্গঠন করতে চাই।
বিবিসি বাংলা: সেখানে তাহলে মানে যারা আন্দোলন করেছে তারাই নাকি? মানে মিত্র কারা হবে আসলে কারা সাথে থাকবে আপনাদের নির্বাচনকে সামনে রেখে?
তারেক রহমান: ওই যে বললাম, কমবেশি সকলকে নিয়ে আমরা রাষ্ট্র গঠন করতে চাই।
বিএনপির মনোনয়নে এবার ভিন্ন কী হবে
বিবিসি বাংলা: কিন্তু দেখা গেছে, জামায়াতে ইসলামী তারা কিছু দলকে নিয়ে বিএনপিবিরোধী একটি জোট করার ইঙ্গিত দিচ্ছে। সেটিকে আপনারা কি উদ্বেগ হিসেবে দেখেন? মানে আপনারা কীভাবে দেখেন সেটা?
তারেক রহমান: দেখুন, কোনো দল বা সমষ্টিগতভাবে কোনো দল যদি বাংলাদেশের যে আইন আছে, বৈধ আইন আছে। বাংলাদেশের যে সংবিধান এখনো যেটি আছে, এই সবকিছুর ভেতরে থেকে অর্থাৎ মানুষের সমর্থন-গ্রহণযোগ্যতা সবকিছুর ভেতরে থেকে যারা রাজনীতি করবে, তারা করতেই পারে। এটাতে তো কোনো সমস্যা বা উদ্বেগের কোনো কারণ আমি দেখি না।
বিবিসি বাংলা: সেখানে যদি তারা একটি আলাদা জোট করে, সেটি কি আপনাদের জন্য কোনো চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে?
তারেক রহমান: না, কেন? ইলেকশন হলে তো ইলেকশনে প্রতিযোগিতা থাকতেই পারে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকতেই পারে। এতে উদ্বেগের কী আছে? বিএনপি তো আগেও নির্বাচন করেছে। বিভিন্ন সময় বিএনপি নির্বাচন করেছে। কম্পিটিশন করেই বিএনপি নির্বাচন করেছে। প্রতিযোগিতা করেছে। উদ্বেগের কিছু নেই।
বিবিসি বাংলা: মনোনয়নের প্রশ্নে যদি আসি, সেখানে আপনাদের কৌশলটা কী হবে? এর আগে বিভিন্ন সময় নির্বাচনগুলোতে পেশিশক্তির প্রভাব, টাকার প্রভাব, পারিবারিক বিষয় বিবেচনা এই বিষয়গুলো বিভিন্ন সময় অভিযোগ আছে। এবার ভিন্ন কি হবে আসলে?
তারেক রহমান: আপনি যেই বিষয়গুলো বললেন, আমরা কখনোই এইসব বিবেচনায় নিয়ে কখনোই আমার দল নমিনেশনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়নি।
আমাদের নমিনেশনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত সব সময় কমবেশি, যা ছিল বা ভবিষ্যতে আমরা যেটিকে মূল্যায়ন করব—সেটি হচ্ছে অবশ্যই কোনো একটি পার্টিকুলার এলাকা থেকে আমরা আমাদের দলের এমন একজন ব্যক্তিকেই নমিনেশন দিতে চাইব, যে ওই এলাকার সমস্যা সম্পর্কে সচেতন আছে, যার সাথে ওই এলাকার মানুষের সম্পৃক্ততা আছে, উঠাবসা আছে, যে ওই এলাকার মানুষের সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম।
যে ওই এলাকার বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ, তরুণ, নারী, মুরব্বিসহ ছাত্রছাত্রী সবার সাথে যার একটা কমিউনিকেশন আছে। এই ধরনের মানুষকেই আমরা প্রায়োরিটি দিব, খুবই স্বাভাবিক। অর্থাৎ যার প্রতি জনসমর্থন আছে। যে জনসমর্থনকে তার সাথে রাখতে পারে। জনগণের যার প্রতি সমর্থন আছে সে রকম মানুষকে দেখেই আমরা নমিনেশন দেব।
বিবিসি বাংলা: সেখানে তৃণমূলের মতামত কতটা প্রাধান্য পাবে? অভিযোগ আছে যে তৃণমূলের মতামত প্রাধান্য কম পায়?
তারেক রহমান: না, ব্যাপারটা এ রকম না। দেখুন গণতন্ত্রে স্বাভাবিক যেখানেই গণতন্ত্র আছে, সেখানে মতামত থাকতেই পারে। বিভিন্ন রকম মতামত অভিযোগ। হয়তো এক জায়গায় ৫০ জন আছে। ৫০ জনের মধ্যে ৩০ জন একটি কথা বলছে, ১৫ জন একটি কথা বলছে। বাকিরা আরেকটি কথা বলছে। তাহলে আপনি কি বলবেন যে মতামত নে্য়ও হচ্ছে না? না।
স্বাভাবিকভাবেই যেখানে আমরা মেজরিটির যেটা মতামত পাবো, এলাকার মানুষের কম বেশি। আমরা তো আমাদের মতন করে খোঁজ করছি। সেটি তৃণমূলই হোক বা সেটি সাধারণ মানুষের হোক।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য—আমরা কিন্তু দলের নেতৃত্ব নির্বাচন করছি না। আমরা নির্বাচন করছি এমন একজন ব্যক্তিকে, যেই শুধু দলেরই সমর্থন নয় বরং দলমত-নির্বিশেষে ওই এলাকার অধিকাংশ মানুষের সমর্থন যার প্রতি আছে।
আমরা এ রকম একজন মানুষকে বের করে আনতে চাইছি। এ রকম একজন মানুষকে আমাদের দলের মনোনয়ন দিতে চাইছি। শুধু দল দিয়ে তো নির্বাচন হবে না। নির্বাচনে তো সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ থাকে। বিভিন্ন মানুষের অংশগ্রহণ থাকে।
কাজেই যার সমর্থন আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করব, চেষ্টা করছি যার প্রতি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সমর্থন আছে। শুধুমাত্র দলীয় সমর্থন নয়, এরকম মানুষ।
প্রধানমন্ত্রী পদের প্রত্যাশী কি না?
বিবিসি বাংলা: নির্বাচন প্রসঙ্গে আপনার কাছে জানতে চাই যে আগামী নির্বাচনে আপনার ভূমিকা কী হবে, আপনি কি সরাসরি নির্বাচন করছেন? আপনাকে কি আমরা প্রধানমন্ত্রী পদের প্রত্যাশী হিসেবে দেখতে পাব নির্বাচনে?
তারেক রহমান: আমার মনে হয়, আপনি প্রথম দিকে বোধহয় একটা প্রশ্ন করেছেন, আমি ওখানে বলেছিলাম স্বাভাবিক আমি একজন রাজনৈতিক দলের সদস্য। একজন রাজনৈতিক কর্মী আমি। নির্বাচনের সাথে তো রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক কর্মীর ওতপ্রোত সম্পর্ক।
কাজেই নির্বাচন যেখানে একটি মানে জনগণের সম্পৃক্ত, এ রকম একটি নির্বাচন হবে, সেখানে তো অবশ্যই আমি নিজেকে দূরে থাকতে পারব না। আমাকে আসতেই হবে। স্বাভাবিকভাবেই মাঠেই ইনশা আল্লাহ থাকব আমি। আপনি আপনার প্রশ্নের পরের যে অংশটি ছিল, দেখুন আমি মনে করি এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জনগণের। এটি তো আমার সিদ্ধান্ত না। এটি সিদ্ধান্ত নিবে বাংলাদেশের জনগণ।
বিবিসি বাংলা: কিন্তু আপনি নির্বাচনে অংশ নেবেন কিনা সেই সিদ্ধান্ত তো আপনাকে নিতে হবে।
তারেক রহমান: না না সেটি তো নিব, কেন নিব না? অবশ্যই নিব।
বিবিসি বাংলা: আপনি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন তাহলে?
তারেক রহমান: জ্বি, ইনশা আল্লাহ।
বিবিসি বাংলা: অর্থাৎ বিএনপি যদি ক্ষমতায় আসে বা নির্বাচনে অংশ নেয় সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী পদের প্রত্যাশী হিসেবে আমরা তারেক রহমানকে দেখতে পাব সেটা আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি?
তারেক রহমান: এটির সিদ্ধান্ত তো বাংলাদেশের জনগণের।
বিবিসি বাংলা: বিএনপির পক্ষ থেকে?
তারেক রহমান: সে ক্ষেত্রে তো এটি দল সিদ্ধান্ত নেবে। দল কিভাবে করবে এটি তো দলের সিদ্ধান্ত।
নির্বাচনে খালেদা জিয়ার ভূমিকা কি হবে?
বিবিসি বাংলা: সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং আপনাদের দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া তিনি কি এ নির্বাচনে কোনো ভূমিকায় থাকবেন? তাকে কি আমরা নির্বাচনে কোনো ভূমিকায় দেখতে পাবো?
তারেক রহমান: আপনি এমন একজন মানুষের কথা বলেছেন, যেই মানুষটি বাংলাদেশের গণতন্ত্র, যতবার গণতান্ত্রিক অধিকারকে হরণ করা হয়েছে, প্রতিবার উনি অবদান রেখেছেন। সেই গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত বা পুনরুদ্ধার করার জন্য।
এবারও আপনাদের সকলের চোখের সামনেই ঘটেছে যে কীভাবে স্বৈরাচারের সময় তার উপরে অত্যাচারের খড়গহস্ত নেমে আসে। কিন্তু উনি আপোষ করেননি। এরকম একজন ব্যক্তি আজ অসুস্থ। কেন কীভাবে উনি শারীরিকভাবে অসুস্থ হলেন, মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে তাকে জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হলো।
আমরা দেখেছিলাম একজন সুস্থ মানুষ গিয়েছেন। কিন্তু যখন বেরিয়ে এসেছেন একজন অসুস্থ মানুষ বেরিয়ে এসেছেন। তাকে চিকিৎসার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে। এ সবগুলোই ঘটনা দেশবাসী জানেন। তারপরেও যে মানুষটির এত বড় অবদান রয়েছে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করার।
আমি সেই দলের একজন কর্মী হিসেবে বিশ্বাস করি বা বিশ্বাস করতে চাই গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে যেই প্রত্যাশিত, জনপ্রত্যাশিত যে নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, উনার শারীরিক সক্ষমতা যদি এলাও করে উনাকে নিশ্চয়ই উনি কিছু না কিছু ভূমিকা রাখবেন।
বিবিসি বাংলা: সেটা কি নির্বাচনে অংশগ্রহণ হতে পারে?
তারেক রহমান: এটি আমি এখনো বলতে পারছি না। আমি মাত্রই বললাম যে উনার শারীরিক বা ফিজিক্যাল এবিলিটির উপরে বিষয়টি কিছুটা হলেও নির্ভর করছে।
বিবিসি বাংলা: এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন চলে আসে বিএনপির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়ে। আপনার বাবা সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আপনার মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তিনি চার দশক বিএনপির নেতৃত্ব দিয়েছেন। এখন আপনি কার্যত দলের নেতৃত্বে রয়েছেন আপনি। বিএনপির ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে পরিবারের প্রভাব কতটা থাকবে?
তারেক রহমান: দেখুন বিষয়টিকে আমি একটু তাহলে অন্যভাবে উপস্থাপন করি। সব রকম সকলের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই আমি বলতে চাইছি। দেখুন, একজন চিকিৎসকের সন্তান যখন চিকিৎসক হয় তখন সে ভালোও করে সে খারাপও করে। একজন লয়ারের সন্তানও দেখা যায় যে অনেক সময় বাবা-মায়ের মতন ভালো লয়ার (আইনজীবি) হয় অথবা হয় না।
রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে অনেকের সন্তান পলিটিক্সে এসেছে। সবাই কি ভালো করেছে? সবাই ভালো করেনি। কেউ কেউ করেছে কেউ কেউ করতে পারেনি ভালো।
আপনি যদি আমাকে ইঙ্গিত করে থাকেন, তাহলে এভাবে আমি বলব যে, দেখুন আমরা দেখেছি বাংলাদেশের মতন দেশে রাজনীতি যারা করেন বিগত ১৭ বছরে দেখেছি। তার আগেও আমরা দেখেছি রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করতে গিয়ে বিভিন্নভাবে হ্যারাসমেন্টের শিকার হন। মিথ্যে মামলার শিকার হন। আমাদের বহু নেতা-কর্মী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। জেল জুলুম খেটেছে। ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। যেই কয়টা উদাহরণ দিলাম আমি মাত্র।
আপনি কি বলতে পারবেন, এর কোনোটার মধ্যে দিয়ে আমি যাইনি? এর প্রতিটার ভেতর দিয়ে আমি গিয়েছি। প্রত্যেকটা স্তর পার করে এসেছি আমি। আমি শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েছি। যেই নির্যাতনের চিহ্ন এখনো কখনো কখনো আমাকে সহ্য করতে হয়। জেল জুলুম খেটেছি আমি। বিভিন্নভাবে মিথ্যা অপপ্রচারের শিকার হয়েছি আমি। সবকিছুর ভিতর দিয়েই আমি পেরিয়ে এসেছি।
কাজেই এইজন্য এই কথাগুলো আমি বললাম যে রাজনীতি পরিবারকরণ হয় না। এটি সমর্থনের ভিত্তিতে হয়। কাজেই যে অর্গানাইজ করে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে দলকে ঐক্যবদ্ধ করে সামনে এগিয়ে যেতে পারবে সে এগিয়ে যেতে পারবে। কেউ যদি এগিয়ে যেতে না পারে, তাহলে সে এগিয়ে যেতে পারবে না। সময় পরিস্থিতি সবকিছু প্রমাণ করে দিবে।
বিবিসি বাংলা: আপনার স্ত্রী বা কন্যা বা আপনার পরিবারে যারা আছেন তারা রাজনীতিতে আসবেন কিনা এটা নিয়ে কিন্তু ব্যাপক আলোচনা আছে। আলোচনা হয় কিন্তু রাজনীতিতে। তো এ ধরনের কি কোনো সম্ভাবনা আছে বা তারা আগ্রহী কি না রাজনীতিতে আসার ব্যাপারে?
তারেক রহমান: আমি ওই যে বললাম সময় পরিস্থিতি বলে দিবে ওটা।
বিএনপির অগ্রাধিকার
বিবিসি বাংলা: একটু আবার নির্বাচনের দিকে যাই। বিএনপি সর্বশেষ সরকারে ছিল ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত। এরপর প্রায় ১৯ বছর পরে বিএনপির সামনে আবার একটা সরকার গঠনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। সেই তখনকার যে বিএনপি আর এখনকার যে বিএনপি এই দুটোর পার্থক্যটা আপনি কোথায় কী বলবেন?
তারেক রহমান: এই ১৯ বছরে আমরা বাংলাদেশ বলি বা পুরো বিশ্ব বলি অনেক কিছু পরিবর্তিত হয়েছে সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়েছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়েছে। দুটো বড় বড় জিনিসের বোধহয় পরিবর্তন হয়েছে।
একটি হচ্ছে কোভিডের ভিতর দিয়ে পুরা বিশ্ব গিয়েছে। এই কোভিড বিভিন্নভাবে আমাদের অনেক কিছু চিন্তা ভাবনা মনোজগত চেঞ্জ করেছে। ঠিক একইভাবে যদি আরেকটি বিষয় আমরা দেখি এই যে আপনার সাথে আমি কথা বলছি অনলাইনে, এই যে আইটি বা সোশ্যাল মিডিয়া এই পুরো বিষয়টা কিন্তু মানুষের মনোজগতকে ভিন্নভাবে ভিন্ন রকম করেছে।
অনেক্ষক্ষেত্রে মনোজগতে একটা প্রভাব বিস্তার করেছে। খুব স্বাভাবিকভাবে আপনি যেই সময়ের কথা বলেছেন সেই সময় এই বিষয়গুলো হয়তো সেভাবে ছিল না। তো স্বাভাবিকভাবেই এই সবকিছু বিবেচনা করে সামনের দিনগুলোতে আমাদেরকে এই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব রেখে বিভিন্ন বিষয়ে চিন্তাভাবনা করতে হচ্ছে।
আমরা সেভাবে চিন্তাভাবনা করে আমাদের প্ল্যান প্রোগ্রাম বিষয়গুলোকে আমরা সাজাচ্ছি। সেই সময় থেকে ১৯ বছর আগে আমাদের যেসব প্ল্যান প্রোগ্রাম ছিল, তার থেকে কিছুটা পরিবর্তন হবে।
কিন্তু ওই যে বেসিক যে জিনিসটা সেটা হচ্ছে মানুষের বেটারমেন্ট। মানুষের ভালো কিছু করার জন্য মানুষ যাতে আজকে যেমন আছে আগামীকাল যাতে একটু বেটার থাকতে পারে কি, কীভাবে সেটা করা যেতে পারে, কে কোনো শ্রেণি কীভাবে একটু বেটার থাকতে পারে, সেটিই থাকবে আমাদের সবচেয়ে প্রায়োরিটি ইস্যু।
দুর্নীতি প্রশ্নে বিএনপি ভোটারদের আশ্বস্ত করবে কীভাবে
বিবিসি বাংলা: বিগত যখন বিএনপি সরকারে ছিল তখন অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা ছিল, তার মধ্যে একটা বড় বিষয় ছিল দুর্নীতির অভিযোগ। সরকারে যারা ছিলেন তাদের অনেকের বিরুদ্ধে বা সেই সময় যেভাবে দুর্নীতি হচ্ছিল বিভিন্ন জায়গায়। আপনার নিশ্চয় মনে আছে যে দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে তখন অনেক সমালোচনা হয়েছিল। এ ধরনের পরিস্থিতি যে আর হবে না এ বিষয়ে আপনি ভোটারদেরকে কিভাবে আশ্বস্ত করবেন?
তারেক রহমান: দেখুন আপনি যে কথাটি বললেন দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন। ৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার ছিল সেই সময়। আমরা ২০০১ সালের পহেলা অক্টোবরে সরকার নির্বাচনের পর ১০ই অক্টোবর সরকার গঠন করি, সম্ভবত।
এর বোধহয় কিছুদিন পরে একটি সূচক বের হলো টিআইবির। মানে দুই তিন মাস পরে বোধহয় একটি সূচক বের হলো।
নিশ্চয়ই মাত্র নির্বাচিত একটি সরকারের পক্ষে তো ভালোমন্দ কোনো কিছুই তিন মাসে করা সম্ভব নয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই যে সূচকটি হয়েছিল সেটি তার আগে আমাদের আগে যে সরকারটি ছিল তারা যে পাঁচ বছর যা করেছে তার উপর ভিত্তি করেই সেই সূচকটি তারা তৈরি করেছে।
আপনি যদি ২০০১ থেকে ২০০৬ অর্থাৎ বিএনপি সরকার গঠন করার পরে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে যখন ক্ষমতা হ্যান্ডওভার করে দিল, আপনি যদি সেই সংস্থা টিএইবি নামক সেই সংস্থাটার রিপোর্টই যদি আপনি দেখেন তাহলে দেখবেন পর্যায়ক্রমিকভাবে, এটি কিন্তু আমার কথা না, এটি তাদের পরিসংখ্যানের কথা-পর্যায়ক্রমিকভাবে কিন্তু নেমে এসেছে।
হ্যাঁ আমি এডমিট করছি পুরাপুরি হয়তো আমরা করতে পারিনি। বাস্তবতা তো বুঝতে হবে। এটি একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। কাজেই এটি মানুষকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে বুঝিয়ে আস্তে আস্তে করতে হবে। জিনিসটি সময় লাগবে।
আমি এখন যত কথাই বলি না কেন বাস্তবতা হচ্ছে এই বিষয়টি যেহেতু সময় লাগবে আমাদেরকে কাজ দিয়ে প্রমাণ করতে হবে।
সেজন্যই আমি ভোটারদেরকে এতটুকু বলতে পারব, আমরা যদি সুযোগ পাই, জনগণ যদি আমাদেরকে সেই সুযোগ দেন, তাহলে আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে আমরা যাতে একটি এমন অবস্থা তৈরি করতে পারি যেখানে কিছুটা হলেও আমরা বহিঃবিশ্বে বিশ্বের অন্য দেশের সামনে কিছুটা হলেও যাতে সম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে কথা বলতে পারি।
চাঁদাবাজি, দখলের মত নানা অভিযোগ নিয়ে যা বললেন
বিবিসি বাংলা: পাঁচই আগস্টের পরে বিএনপির অনেক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে এরই মধ্যে চাঁদাবাজি বা দখলের মত নানা অভিযোগ এসেছে। আপনাদের দল থেকে অনেককে বহিষ্কার করা হয়েছে এটা ঠিক, আবার একই সাথে এটাও ঠিক যে এই অভিযোগগুলো কিন্তু বারবার আসছে। তো এটা থামানো যাচ্ছে না কেন?
তারেক রহমান: আপনার প্রতি সম্মান রেখে আপনার সাথে এগ্রিও যেমন করবো, আবার এখানে অন্য একটি বিষয় আমি তুলে ধরতে চাইবো।
এর মধ্যে নিশ্চয়ই আপনারা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে দেখেছেন যে প্রায় ৭০০০ এর মতন আমাদের নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে আমরা কিছু সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। কিন্তু এই ৭০০০ এ সবাই কিন্তু আপনি যে অভিযোগ করলেন এই অভিযোগের সাথে জড়িত নয়। এর মধ্যে এমন অনেক বিষয় আছে যারা অন্য সাংগঠনিক বিষয়ের সাথে জড়িত। এটি গেল একটি বিষয়।
দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে আমাদের কাছে এরকম যখন অনেক অভিযোগ এসেছে। আমরা অভিযোগগুলো তদন্ত করেছি। তদন্ত করার পরে আমরা বেশ কিছু বিষয় পেয়েছি।
যেমন আমি দুই-একটি উদাহরণ দিয়ে আপনাকে বলি। যেমন-ধরেন দুই ভাই। কোনো একটি এলাকায় দুই ভাই আছে। দুই ভাইয়ের মধ্যে পারিবারিক সম্পত্তি সহায় সম্পত্তি নিয়ে একটি সমস্যা আছে। এক ভাই বিগত যে স্বৈরাচার পলাতক স্বৈরাচার তাদের কারো সাথে এক ভাইয়ের খুব ভালো সম্পর্ক।
তার ফলে সে সেই স্বৈরাচারের যে দোসর যার সাথে এই এক ভাইয়ের সম্পর্ক, সে তার ইনফ্লুয়েন্সটি ব্যবহার করে অন্য ভাইয়ের সম্পত্তিও জোর করে দখল করে রেখেছে। এখন পাঁচ তারিখের পরে যে ভাই স্বৈরাচারের দোসরকে ব্যবহার করেছিল সেই দোসরও তো পালিয়ে গিয়েছে। তো স্বাভাবিকভাবেই সেই ভাই এখন আর শেল্টার পাচ্ছে না।
তো অন্য যার সম্পত্তি জোর করে রেখে দিয়েছিল অন্য ভাইটি। সেই অন্য ভাইটি স্বাভাবিকভাবে তার হক আদায় করতে গিয়েছে বা হক বুঝে নিতে গিয়েছে। এখন এক্সিডেন্টলি বা ইনসিডেন্টলি যে ভাই এতদিনভাবে বঞ্চিত ছিল সম্পত্তি থেকে সেই ভাই বিএনপি করে। বিএনপির কোনো একজন কর্মী বা স্ট্রং সমর্থক বা নেতা যেটাই হোক। চাপিয়ে দিল অভিযোগ তুলে দিল অন্যজন যে বিএনপি দখল করতে গিয়েছে। এ রকম ঘটনা আমরা প্রচুর পেয়েছি।
আবার আরেকটি আমি উদাহরণ দেই যা সত্য, যা বাস্তব। স্বৈরাচারের সময় সারা বাংলাদেশে আমাদের প্রায় ৫০ লাখের বেশি নেতা-কর্মীর নামে বিভিন্ন রকম গায়েবি মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছিল।
আমাদের বহু নেতা-কর্মী তাদের ঘর বাড়িতে থাকতে পারতো না। তাদেরকে বিভিন্নভাবে পালিয়ে থাকতে হতো। বিভিন্নভাবে সরে থাকতে হতো। এই সুযোগে স্বৈরাচার তাদের ব্যবসা বাণিজ্য দোকান-পাট ঘর বাড়ি জমি জমা পুকুর দখল করে নিয়েছিল। পাঁচ তারিখে যখন স্বৈরাচার পলাতক হয়ে গিয়েছে, পালিয়ে গিয়েছে-তখন স্বৈরাচারের যারা দখল করেছে তারাও সাথে সাথে পালিয়ে গিয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই আমাদের নেতা-কর্মীরা তাদের নিজেদের যেগুলি বৈধ সম্পত্তি, পৈতৃক সম্পত্তি সেগুলো আবার ফিরে পেতে গিয়েছে। তখন আবার কিছু সংখ্যক লোক প্রচার করেছে যে বিএনপির লোকজন দখল করতে গিয়েছে এরকম ঘটনা প্রচুর ঘটেছে।
আপনি যেই কথাটি বললেন সেরকমও কিছু ঘটেছে। সে কারণেই আমরা আমাদের অবস্থান থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। তবে এখানে আমার একটি প্রশ্ন আছে, যে প্রশ্নটি আমরা পাবলিকলিও করেছি। দেখুন আমরা একটি রাজনৈতিক দল। কিছু ঘটনা ঘটেছে। আমরা অস্বীকার করছি না। ঘটেছে যেমন, আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি তাদের বিরুদ্ধে।
যতটুকু আমরা জেনেছি, যতটুকু আমরা তদন্তের পরে পেয়েছি, যখন সত্যতা পেয়েছি, আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। কিন্তু পুলিশিং করা তো আমাদের কাজ না। রাজনৈতিক দলের কাজ অবশ্যই পুলিশিং করা না।
আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কখনো বলিনি সরকারকে-যে অমুককে ধরতে পারবে না, তমুককে ধরতে পারবে না, এই করতে পারবে না ওই কথা। আমরা কিন্তু কখনো বলিনি। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে যাদের কাজ পুলিশিং করা তারা কেন তাদের কাজটি করছে না। তারা কেন তাদের কাজে ব্যর্থ এটি আমাদের প্রশ্ন।
বিবিসি বাংলা: তার মানে এখানে সরকারের একটা ব্যর্থতা আছে?
তারেক রহমান: অবশ্যই। আমি তো আগেই বলছি পুলিশিং তো রাজনৈতিক দলের কাজ না পুলিশিং করার দায়িত্ব সরকারের।
বিবিসি বাংলা: অর্থাৎ আমরা ধরে নিতে পারি যে, আপনারা যদি সরকার গঠন করেন সে ক্ষেত্রে আপনার দলের নেতা-কর্মী বা আপনার দলের নামে কোনো চাঁদাবাজি বা দখল এ ধরনের কিছু কেউ সেটা করতে পারবে না, কারণ তখন যেহেতু আপনারা সরকারে থাকবেন?
তারেক রহমান: ইয়েস, পুলিশ পুলিশের কাজ করবে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী আইনশৃঙ্খলার কাজ করবে। বিএনপি ইনশা আল্লাহ সরকার গঠন করলে আমার দলের কোন নেতা-কর্মী তখনো যদি এ রকম কোনো অনৈতিক কাজে সম্পৃক্ত হয় আমরা দলের অবস্থান থেকে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিব।
দল তার পক্ষে থাকবে না, দলের অবস্থান এবং দেশের আইন অনুযায়ী। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার দায়িত্ব যাদের, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তারা তাদের কাজ করবে, সিম্পল। এখানে দুইয়ে দুইয়ে চারের মতন ব্যাপার।
’ডাকসুর প্রভাব পড়বে না জাতীয় রাজনীতিতে’
বিবিসি বাংলা: একটু ডাকসু নির্বাচন প্রশ্নে আসি। সাম্প্রতিক সময়ে ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল ব্যাপক আলোচনা চলছে রাজনীতিতে এখনো। এর ফলাফলে দেখা গেছে যে বিএনপি সমর্থক ছাত্রদলের চেয়ে বেশ বড় ব্যবধানে ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল জয়ী হয়েছে। আপনি কীভাবে দেখেন এই ফলাফলটাকে আসলে?
তারেক রহমান: আমি মনে করি গণতান্ত্রিক যাত্রার একটি ভালো উদ্যোগ এটি। ভালো সূচনা। এটি গেল এক নম্বর।
দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে যারা জয়ী হয়েছেন বা এরকম আরো ভবিষ্যতে যারা জয়ী হবেন, তাদের প্রতি শুভেচ্ছা এবং যারা ভবিষ্যতে জয়ী হবেন তাদের প্রতি অগ্রিম শুভেচ্ছা রইলো।
তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে দেখুন একটা অগ্রযাত্রা শুরু হলো, কিন্তু আমরা চাইছিলাম না যে কোনো বিতর্কের মধ্যে এগুলা পড়ুক। আমরা আশা করব যে পরবর্তীতে যেগুলো হবে সেগুলো বিতর্কবিহীন হবে নির্বাচনগুলো।
বিবিসি বাংলা: এই নির্বাচনের ফলাফল, মানে ডাকসুর নির্বাচনের ফলাফল এটা কি জাতীয় রাজনীতিতে কোনো প্রভাব ফেলতে পারে? আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে আপনার কি মনে হয়? আপনি কি মনে করেন সেটা?
তারেক রহমান: আমি যেটা দেখলাম বিভিন্ন মিডিয়াতে কিছু ব্যক্তি, যেমন-মান্না ভাই, ওনাকে উনি তো বোধহয় দুবার ভিপি ছিলেন। আমার থেকে অনেক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন রাজনীতিবিদ।
আমরা যদি উনার বক্তব্য শুনে থাকি বা ধরে থাকি তাহলে তো আমি মনে করি না কোনো কারণ আছে। ছাত্র রাজনীতি ছাত্র রাজনীতির জায়গায়, জাতীয় রাজনীতি জাতীয় রাজনীতির জায়গায়।
জামায়াতের সম্ভাব্য জোট নিয়ে উদ্বেগ নেই
বিবিসি বাংলা: এখন যে সক্রিয় দলগুলো আছে তাদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর প্রশ্নে যদি একটু আসি, যে জামায়াতে ইসলামীকে ঘিরে বিএনপির নেতাদের অনেক সমালোচনা করতে দেখা যাচ্ছে। গত সাম্প্রতিক সময়ে, তো জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে আপনার মনোভাবটা কি আসলে?
তারেক রহমান: বিষয়টা হচ্ছে যে দেখুন বাংলাদেশের স্বীকৃত যে নিয়ম, আইন-কানুন আছে, এগুলোর ভিতরে থেকে যদি কেউ রাজনীতি করে অবশ্যই করতে পারে।
বিএনপি সবসময় বহুদলীয় রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। কাজেই বিষয়টি আমরা এভাবেই দেখতে চাই।
দেশের যে আইন কানুন আছে তার ভিতরে থেকে যারা রাজনীতি করবে, অবশ্যই সবার রাজনীতি করার অধিকার আছে। এবং আমরা তো চাই সবাই রাজনীতি করুক। বহুদলীয় রাজনীতিতে আমরা বিশ্বাস করি।
বিবিসি বাংলা: জামায়াতে ইসলামী তো বিএনপির সাথে একসময় মিত্র ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের বিরোধী ভূমিকা নিয়ে কিন্তু বিএনপি নেতারা এখন অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, সামনে আনছেন। কিন্তু বিএনপি আবার তাদের সাথে সরকারও গঠন করেছিল একটা সময়?
তারেক রহমান: ২০২৪ সালে স্বৈরাচার যেই হত্যাগুলো করেছে দেশ স্বাধীনের পরে যখন তারা সরকার গঠন করেছিল ক্ষমতায় ছিল তখনও যে সকল লুট তারা করেছে, খুন-গুম তারা করেছে।
বিগত ১৭ বছর গুম খুন যারা করেছে, এর জবাব যে রকম তাদেরকেই দিতে হবে, ঠিক একইভাবে ’৭১ সালে কোনো রাজনৈতিক দল যদি তাদের কোনো বিতর্কিত ভূমিকা থেকে থাকে, তাহলে তাদের জবাব তারাই দিবেন। ওটা তো আর আমি দিতে পারবো না। আমারটা আমি দিতে পারবো। অন্যেরটা তো আমি দিতে পারবো না।
যা বললেন আওয়ামী লীগের রাজনীতি প্রসঙ্গে
বিবিসি বাংলা: আপনি জুলাইয়ের সময়ের কথা বলছিলেন। সে সময়ের হত্যাকাণ্ডের কথা বলছিলেন। সেই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের ব্যাপারে আপনার আপনাদের বা বিএনপির অবস্থানটা কী আসলে?
তারেক রহমান: দেখুন, আমি ১৭ বছর যাবত প্রবাস জীবনে আছি। ওয়ান ইলেভেন, তথাকথিত ওয়ান ইলেভেন সরকারের সময় যেই শারীরিক নির্যাতন আমার উপরে হয়েছিল তারপরে চিকিৎসার জন্য আমি এই দেশে আসি।
আমি যখন এখানে আসি, আমার ভাইকে আমি রেখে এসেছিলাম ছোট ভাইকে। আমি যখন এই দেশে আসি আমার সুস্থ মাকে আমি রেখে এসেছিলাম। একটি ঘর রেখে এসেছিলাম। যেই ঘরে আমি এবং আমার ছোট ভাই বড় হয়েছি। যেই ঘরে আমার বাবার স্মৃতি ছিল। যেই ঘরে আমাদের দুই ভাইয়ের সন্তানরা জন্মগ্রহণ করেছিল। যেই ঘরে আমার মায়ের বহু স্মৃতি ছিল।
সেই স্মৃতিগুলোকে ভেঙে চুড়ে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে ভাইকে আমি রেখে এসেছিলাম সেই ভাই এখন আর নেই। যেই সুস্থ মাকে রেখে এসেছিলাম সেই সুস্থ মা এখন সুস্থ নেই। শুধু অসুস্থই নন, উনার উপরে মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতনও করা হয়েছে।
আমি আমার পরিবারের যেই কাহিনী আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম। এটিকে আপনারা কাহিনী বলুন, বা সংগ্রাম বলুন যেটাই বলুন না কেন, এটি শুধু আমার কাহিনী না, বা আমার পরিবারের কাহিনী না। এরকম কাহিনী বাংলাদেশের শত না, হাজার হাজার পরিবারের।
যে পরিবারের বাবা, যে পরিবারের ভাই, যে পরিবারের স্বামী তার ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে, হ্যান্ডকাফ পারা অবস্থায় হাসপাতালের বারান্দায় মারা গিয়েছে, তা না হলে হ্যান্ডকাফ পারা অবস্থায় জেলের ভিতরে মারা গিয়েছে, সহায় সম্পত্তি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে-এই সকল অন্যায়, এই সকল হত্যা, এই সকল নির্যাতনের জন্য যারা দায়ী, যারা এসবের হুকুম দিয়েছে, তাদের প্রত্যেকের বিচার হতে হবে।
এটি প্রতিশোধের কোনো বিষয় নয়। এটি ন্যায়ের কথা। এটি আইনের কথা। অন্যায় হলে তার বিচার হতে হয়। কার সম্পর্কে কী মনোভাব সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়।
বিবিসি বাংলা: এখানে একটা বিষয় আলোচনায় এসেছে যে যারা অপরাধী তাদের বিচার হবে। কিন্তু দল হিসেবে আওয়ামী লীগ তাদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারা-না পারার প্রশ্নে বিএনপিরও অনেক নেতা অনেক সময় বলেছেন যেকোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে তারা নন। তো এখন নির্বাচনও সামনে আসছে। ফলে আওয়ামী লীগ রাজনীতি করতে পারবে কি পারবে না সে ধরনের একটা প্রশ্নও আসছে। তো সেটা সেই জায়গাটাতে বিএনপির অবস্থানটা কী হতে পারে?
তারেক রহমান: দল হিসেবে তারা যদি অন্যায় করে থাকে তাহলে দেশের আইন অনুযায়ী তার বিচার হবে। দেশের আইন সিদ্ধান্ত নেবে।
বিবিসি বাংলা: তার মানে এটা আদালতের বিষয় বলে মনে করছেন?
তারেক রহমান: দল হিসেবে যদি অন্যায় হয়ে থাকে তাহলে তাই হবে। সোজা কথায় অন্যায়কারীর বিচার হতে হবে। তো সেটি ব্যক্তি হোক, সেটি দলই হোক। যারা জুলুম করেছে তাদের তো বিচার হতে হবে। সেটি ব্যক্তিও হতে পারে। সেটি দলও হতে পারে।
বিবিসি বাংলা: আপনি ব্যক্তিগতভাবে কী মনে করেন? আওয়ামী লীগের কি বাংলাদেশের রাজনীতিতে থাকা উচিত নাকি, না?
তারেক রহমান: আমার মনে হয় আপনার কোনো কোনো প্রশ্নের উত্তরে আমি মনে হয় বলেছিলাম যে আমরা রাজনীতি করি জনগণের জন্য।
আমরা বিশ্বাস করি এবং বিভিন্ন সময় বলিও আমরা বিএনপি যারা করি আমাদের রাজনৈতিক সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এবং বিশ্বাস করতে চাই-যে দলের ব্যক্তিরা বা যে দল মানুষ হত্যা করে, মানুষ গুম করে, মানুষ খুন করে, দেশের মানুষের অর্থসম্পদ লুটপাট করে বিদেশে পাচার করে-জনগণ তাদেরকে সমর্থন করতে পারে বলে আমি মনে করি না।
জনগণ যদি সমর্থন না করে কোনো রাজনৈতিক দল বা রাজনৈতিক সংগঠনকে তাদের টিকে থাকার তো কোনো কারণ আমি দেখি না। যেহেতু জনগণের শক্তিতে আমরা বিশ্বাস করি, জনগণের সিদ্ধান্তে আমরা বিশ্বাস করি। জনগণের সিদ্ধান্তের উপরে আমরা আস্থা রাখতে চাই। এ বিষয়ে সবচেয়ে বড় বিচারক আমি মনে করি জনগণ।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাথে বিবিসি বাংলার সাক্ষাৎকারের এটি প্রথম পর্ব। দ্বিতীয় পর্বটি প্রকাশ হবে মঙ্গলবার ৭ই অক্টোবর বিবিসি বাংলার ওয়েবসাইট, ফেসবুক পাতা ও ইউটিউব চ্যানেলে।

প্রধান উপদেষ্টা মনে করেন, সংস্কার ও বছরের শেষ নাগাদ বা আগামী বছরের প্রথমার্ধে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়ার কোনো ঘাটতি নেই। গত ২৯ ডিসেম্বর (২০২৪) ইংরেজি দৈনিক নিউ এজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এ মন্তব্য করেন তিনি। ঢাকায় প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় বাং
০৭ জানুয়ারি ২০২৫
ইসলামী ব্যাংক শুরু থেকে এই কার্যক্রমে যুক্ত। আমরা ১৮ বছরের কম বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্য ‘মুদারাবা স্কুল স্টুডেন্ট সেভিংস অ্যাকাউন্ট’ চালু করেছি, যেখানে অভিভাবকেরা সন্তানদের পক্ষ থেকে হিসাব পরিচালনা করেন। মূল লক্ষ্য হলো শিশু-কিশোরদের সুদমুক্ত অর্থনীতিতে যুক্ত করা এবং ভবিষ্যতে দায়িত্বশীল...
৮ দিন আগে
ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসি (ইবিএল) নিয়মিতভাবে স্কুলে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন, সেমিনার, ওয়ার্কশপ এবং বিশেষ অফারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সচেতন করছে এবং তাদের হিসাব খোলায় উৎসাহ দিচ্ছে। আমরা শিক্ষার্থীদের ব্যাংকিং জ্ঞান ও সঞ্চয়ের গুরুত্ব বোঝাতে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করি।
৮ দিন আগে
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিবিসি বাংলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে সংস্কার, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এবং রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন। প্রায় দুই দশক পর প্রথম কোনো গণমাধ্যম হিসেবে বিবিসি বাংলার মুখোমুখি হয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তিনি।
২৩ দিন আগে