Ajker Patrika

১৯৫৩ সালের অভ্যুত্থান থেকে ট্রাম্পের হামলা: যুক্তরাষ্ট্র-ইরান উত্তেজনার সাত দশক

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
সাত দশক পুরোনো এ সংঘাতের শেষ কোথায়। ছবি: সংগৃহীত
সাত দশক পুরোনো এ সংঘাতের শেষ কোথায়। ছবি: সংগৃহীত

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত নতুন মোড় নিল যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি অংশগ্রহণের পর। গতকাল রোববার ইরানের তিন পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার পর এখন ইরান-ইসরায়েল সংঘাত যেন পরিণত হয়েছে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সংঘাতে। যুক্তরাষ্ট্রের এই সরাসরি আক্রমণের বিপরীতে ইরান কী জবাব দেবে সেটা দেখার অপেক্ষায় বিশ্ব। তবে এই বৈরিতা নতুন নয়। ১৯৫০-এর দশক থেকে বিশ্ব দেখে এসেছে এই দুই দেশের দ্বন্দ্ব। ইরানে মার্কিন হস্তক্ষেপ, মধ্যপ্রাচ্যে ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর কার্যকলাপ ও পারমাণবিক কর্মসূচি—ধাপে ধাপে দুই দেশের মধ্যে বিবাদের উৎস যেন বেড়েই চলেছে। আর এখন তা পৌঁছেছে সর্বোচ্চ পর্যায়ে।

ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব-প্রতিপত্তি গুঁড়িয়ে দিয়েছিল ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লব। এ বিপ্লবের পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিপক্ষে পরিণত হয়েছিল ইরান। এই বিপ্লবের মাধ্যমে পতন হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির সরকারের। বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি। তবে এই বিপ্লবের আছে এক লম্বা ইতিহাস। একদিনের পশ্চিমা প্রভাবে ইরান উত্তাল হয়ে ওঠেনি। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গর্জন উঠেছিল দীর্ঘ এক সময়ের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে।

যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সাত দশকের দ্বৈরথ—

১৯৫৩: মার্কিন-সমর্থিত অভ্যুত্থান ও শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির ক্ষমতায় ফেরা

১৯০০-এর দশকের প্রথম দিকে ইরানে তেল আবিষ্কার হয়। এরপর থেকে ব্রিটিশ-নিয়ন্ত্রিত অ্যাংলো-ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানি (বর্তমানে বিপি) নামে যৌথ উদ্যোগের কোম্পানির মাধ্যমে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি তেল উত্তোলনে সিংহভাগ অংশের নিয়ন্ত্রণ করত। ১৯৫১ সালের নির্বাচনের পর দেশটিতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেক কোম্পানিটি জাতীয়করণের উদ্যোগ নেন। এই উদ্যোগ ক্ষুব্ধ হয় ব্রিটিশেরা। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর সাহায্য নিয়ে ইরানে অভ্যুত্থান ঘটানো হয় আর ক্ষমতায় ফেরেন পূর্বে ক্ষমতাচ্যুত শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি। যিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিয়ভাজন। আর এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের সম্পর্কের টানাপোড়েন।

১৯৫৭: পারমাণবিক কর্মসূচি ‘অ্যাটমস ফর পিস’

পারমাণবিক শক্তিধর ইরান গড়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা দেখেছিলেন শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি। তাঁর এই স্বপ্নে সমর্থন দেয় যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা মিত্ররা। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট ডি. আইজেনহাওয়ারের ‘অ্যাটমস ফর পিস’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি বেসামরিক পারমাণবিক চুক্তি হয়। এর এক দশক পর যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে একটি পারমাণবিক চুল্লি ও জ্বালানি হিসেবে ইউরেনিয়াম সরবরাহ করে। এই পারমাণবিক সহযোগিতাই পরবর্তী সময়ে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ঘিরে বর্তমান উত্তেজনার ভিত্তি গড়ে দেয়।

১৯৭৯: ইসলামি বিপ্লব

তেহরান-ওয়াশিংটনের সুসম্পর্কের বাতাস বইলেও ইরানের জনগণের মনে বাসা বাঁধছিল পাহলভির স্বৈরশাসন ও পশ্চিমা প্রভাবের জাঁতাকলে পিষ্ট হওয়ার ক্ষোভ। এই ক্ষোভ ১৯৭৮ সালের শেষ দিকে এসে পরিণত হলো বিপ্লবী আন্দোলনে। এই আন্দোলনে সমাপ্তি হলো ১৯৭৯ সালের জানুয়ারিতে, পাহলভিকে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য করার মাধ্যমে। বিপ্লবে সফর ইরানে ফিরলেন নির্বাসিত ইসলামি নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি। দেশে ফিরে এসে কাঁধে তুলে নিলেন নতুন ইসলামি প্রজাতন্ত্রের শাসনভার। নতুন রূপ নিল যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্কের বৈরিতা।

১৯৮০: যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন

দেশ ছেড়ে পালানো শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভিকে ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় দেওয়া হলে ক্ষোভে ফেটে পড়ে ইরান। ইরানি ছাত্ররা তেহরানের মার্কিন দূতাবাসে ঢুকে ৫২ জন মার্কিন নাগরিককে টানা ৪৪৪ দিন জিম্মি করে রাখে। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ওয়াশিংটন ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। দেশটির ওপর আরোপ করে নিষেধাজ্ঞা। অন্যদিকে নির্বাসিত অবস্থায়ই মৃত্যু হয় পাহলভির।

১৯৮০–৮৮: ইরাক-ইরান যুদ্ধ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক প্রীতি

সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বে ইরাক আক্রমণ চালায় ইরানে। খোমেনির ইসলামি মতাদর্শ প্রতিহত করতে আগ্রহী সাদ্দাম এ সময় পেয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন। আর এই সমর্থন ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটায়। আট বছরব্যাপী এই যুদ্ধে প্রাণ হারায় ইরান-ইরাকের হাজার হাজার মানুষ।

১৯৮৪: ইরানকে ‘সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষক’ ঘোষণা

মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান ইরানকে ‘রাষ্ট্রীয়ভাবে সন্ত্রাসবাদে পৃষ্ঠপোষক’ ঘোষণা করেন। লেবাননে ইসরায়েলের হামলা এবং এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে পড়ার পরিণতিতে এই আখ্যা পায় ইরান। বৈরুতের একটি সামরিক ঘাঁটিতে এক হামলায় ২৪১ জন মার্কিন সেনা নিহত হন। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, হিজবুল্লাহ এই হামলা চালিয়েছিল, আর তাদের সমর্থন দিয়েছিল ইরান।

তবে পরবর্তীতে রিগ্যান প্রশাসন হিজবুল্লাহর হাতে আটক মার্কিন জিম্মিদের মুক্ত করতে গোপনে ইরানের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এই গোপন যোগাযোগ প্রকাশ হয়ে গেলে এই ‘ইরান-কন্ট্রা অ্যাফেয়ার’-এর কারণে ব্যাপক বিতর্কের মুখে পড়েন প্রেসিডেন্ট রিগ্যান।

১৯৮৮: ইরান এয়ার ফ্লাইট ভূপাতিত করে যুক্তরাষ্ট্র

ইরাকের সঙ্গে তখন তুমুল যুদ্ধ চলছিল ইরানের। এমন উত্তেজনার মধ্যেই পারস্য উপসাগরে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজগুলোর মধ্যে একাধিক সরাসরি সংঘর্ষ ঘটে। ১৯৮৮ সালের ৮ জুলাই একটি মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজ ইরানের জলসীমায় প্রবেশ করে দুবাইগামী বেসামরিক ইরান এয়ারের ফ্লাইট (আইআর ৬৫৫) লক্ষ্য করে গুলি চালায়। বিমানে থাকা ২৯০ জন যাত্রীর সবাই মারা যান।

এ ঘটনাকে ‘দুর্ভাগ্যজনক ভুল’ বলে দাবি করে নিহতদের পরিবারকে ৬১.৮ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিলেও আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখপ্রকাশ বা দায় স্বীকার করেনি যুক্তরাষ্ট্র।

১৯৯৫: কঠোর নিষেধাজ্ঞার খড়্গ

১৯৯৫ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর একাধিক নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে মার্কিন কোম্পানিগুলোর ইরানের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য নিষিদ্ধ করেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। একই সময় মার্কিন কংগ্রেস একটি আইন পাস করে, যাতে বলা হয় কোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠান যদি ইরানের জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ করে বা দেশটিকে উন্নত অস্ত্র বিক্রি করে, তাহলে তাদের শাস্তির মুখে পড়তে হবে। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এবং হিজবুল্লাহ, হামাস ও ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদের মতো গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থনের অভিযোগ তুলে এসব নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।

২০০২: ৯/১১-পরবর্তী উত্তেজনা

২০০১ সালে ৯/১১ হামলার পর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ তাঁর স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন ভাষণে ইরাক ও উত্তর কোরিয়ার পাশাপাশি ইরানকেও ‘অশুভ অক্ষ’ (Axis of Evil)-এর অংশ বলে উল্লেখ করেন। অথচ সেই সময় আফগানিস্তানে তালেবান ও আল-কায়েদার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গোপনে আলোচনা চালাচ্ছিল ইরান। বুশের এ মন্তব্যের পর এই আলোচনা ভেস্তে যায়। ২০০২ সালের শেষে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকেরা ইরানে উচ্চ মাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম খুঁজে পান, যার ফলে ইরানের ওপর আরও বেশি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।

২০১৩: পারমাণবিক চুক্তি জেসিপিওএ

২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইরানের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের আলোচনা শুরু করেন। যার পরিণতিতে ২০১৫ সালে ইরান জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ) নামে পরিচিত একটি ঐতিহাসিক চুক্তিতে সই করে। এই চুক্তির আওতায় নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার বিনিময়ে পারমাণবিক কার্যক্রম সীমিত করতে রাজি হয় ইরান। চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও চীন, রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন অংশ নেয়।

২০১৮: পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসা

প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম মেয়াদে ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রকে একতরফাভাবে জেসিপিওএ চুক্তি থেকে প্রত্যাহার করে নেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আবারও ইরানের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। ট্রাম্প সরে যাওয়ার পর ইরানও চুক্তির প্রতিশ্রুতি থেকে দূরে সরে আসে। চুক্তিতে আরোপিত সীমা অতিক্রম করে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ শুরু করে দেশটি।

২০২০: কাসেম সোলাইমানির মৃত্যু

ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে বাগদাদে মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হন ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) এলিট কুদস ফোর্সের প্রধান জেনারেল কাসেম সোলাইমানি। এর এক বছর আগে ট্রাম্প প্রশাসন কুদস ফোর্সকে একটি ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেছিল। এর প্রতিক্রিয়ায় ইরাকে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান।

২০২৫: ট্রাম্পের চিঠি ও আলোচনার প্রস্তাব

পাঁচ বছর পর চলতি বছরের মার্চ মাসে এই সম্পর্কের পালে লাগে নতুন হাওয়া। দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়া প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে চিঠি পাঠান। চিঠিতে নতুন একটি পারমাণবিক চুক্তির প্রস্তাব দেন ট্রাম্প। আর এ নিয়ে আলোচনার জন্য ৬০ দিনের সময়সীমা বেঁধে দেন। তবে খামেনির কাছে প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যাত হয়। খামেনি বলেন, আলোচনার নামে ইরানের ওপর শর্ত চাপিয়ে দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এরপরও ওমানের মধ্যস্থতায় ওমান ও ইতালিতে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়।

কয়েক দফা বৈঠকের পর ট্রাম্প দাবি করেন, চুক্তির খুব কাছাকাছি আছেন তাঁরা। ইরানও আশাবাদ প্রকাশ করে তবে তারা এটাও জানায়, ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ হওয়ার অধিকার থেকে একচুলও পিছিয়ে না আসার ইচ্ছে নেই তাদের। যা নিয়ে আলোচনা চলতে থাকলেও ষষ্ঠ দফা বৈঠকের আগের দিন ইরানজুড়ে হামলা চালায় ইসরায়েল।

২০২৫: ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলা

ইসরায়েলের এই হামলার জবাবে ইরানও ইসরায়েলে হামলা চালায়। এরপর গত রোববার ‘নিরাপত্তা হুমকি’ ও ‘ইসরায়েলের রক্ষা’র যুক্তি দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্রও ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা চালায়। আবারও সরাসরি ইরানের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের আগুনে ইরান পুড়বে না কি ইরান থেকে যুক্তরাষ্ট্র পিছু হটবে—সেটি দেখার অপেক্ষায় বিশ্ব।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

হোয়াইট হাউসে আল–শারার ঐতিহাসিক সফর, সিরিয়াকে সফল করার প্রতিশ্রুতি ট্রাম্পের

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১১ নভেম্বর ২০২৫, ১৩: ৪১
হোয়াইট হাউসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে আহমেদ আল–শারা। ছবি: এএফপি
হোয়াইট হাউসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে আহমেদ আল–শারা। ছবি: এএফপি

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সোমবার জানিয়েছেন, সিরিয়াকে সফল রাষ্ট্রে পরিণত করতে তিনি সব ধরনের পদক্ষেপ নেবেন। স্থানীয় সময় গতকাল সোমবার হোয়াইট হাউসে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার সঙ্গে ঐতিহাসিক বৈঠকের পর এ কথা বলেন ট্রাম্প।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, শারার ওয়াশিংটন সফর তাঁর জন্য অসাধারণ এক সফল বছর শেষের প্রতীক। বিদ্রোহী থেকে রাষ্ট্রনায়ক হয়ে ওঠা শারা গত বছর দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদকে উৎখাত করে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এরপর থেকেই তিনি বিশ্ব সফরে গিয়ে নিজেকে মধ্যপন্থী নেতা হিসেবে পরিচয় করানোর চেষ্টা করছেন। তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে ঐক্যবদ্ধ করতে চান এবং আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা দূর করতে চান।

ওয়াশিংটনে শারার প্রধান লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কঠোরতম নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া। বৈঠকের সময়ে মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয় ঘোষণা করেছে, সিজার অ্যাক্ট-এর আওতায় থাকা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার স্থগিতাদেশ আরও ১৮০ দিনের জন্য বাড়ানো হয়েছে। তবে এই নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত কংগ্রেসের।

শারার ওয়াশিংটন সফর ছিল কোনো সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের প্রথম সফর। ছয় মাস আগে সৌদি আরবে ট্রাম্প ও শারার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। সেখানেই ট্রাম্প সিরিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তোলার ইঙ্গিত দেন। কয়েক দিন আগেই যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দিয়েছে, শারা আর ‘বিশ্বব্যাপী বিশেষভাবে চিহ্নিত সন্ত্রাসী’ নন।

হোয়াইট হাউসে শারাকে স্বাগত জানানোর পরিবেশ ছিল অস্বাভাবিকভাবে নীরব। একসময় যার মাথার দাম ছিল যুক্তরাষ্ট্রে ১ কোটি ডলার, তিনি প্রবেশ করেন পাশের দরজা দিয়ে। অর্থাৎ, হোয়াইট হাউসের মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করেননি তিনি।

সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় ট্রাম্প বলেন, শারা একজন ‘শক্তিশালী নেতা’। তিনি শারার প্রতি আস্থা রাখেন। তিনি বলেন, ‘আমরা যা কিছু পারি, তা করব, যাতে সিরিয়া সফল হয়।’ তবে শারার অতীত প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন, ‘আমাদের সবারই কঠিন অতীত আছে।’

শারা গত বছর ক্ষমতায় আসেন। এরপর সিরিয়া দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। আসাদের পুরোনো মিত্র ইরান ও রাশিয়ার দিক থেকে দেশটি সরে এসেছে। নতুনভাবে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে তুরস্ক, উপসাগরীয় দেশগুলো ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে।

নিরাপত্তা আলোচনাও বৈঠকের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার নাজুক রাজনৈতিক পরিবর্তনে সহায়তা করতে চায়। দেশটি ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ‘গ্লোবাল কোয়ালিশন টু ডিফিট আইএস’-এর সঙ্গে একটি রাজনৈতিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র দামেস্কের এক বিমানঘাঁটিতে সামরিক উপস্থিতি স্থাপনের পরিকল্পনা করছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

মার্কিন সরকারের শাটডাউন অবসানের বিল সিনেটে পাস, নিম্নকক্ষে অনুমোদনের অপেক্ষা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট ভবন ক্যাপিটল হিল। ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট ভবন ক্যাপিটল হিল। ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে দেশটির সরকারের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের শাটডাউন বা অচলাবস্থার অবসান ঘটাতে গতকাল সোমবার এক সমঝোতা চুক্তি অনুমোদন করেছে দেশটির পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সিনেট। কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা এই অচলাবস্থায় লাখো মানুষ খাদ্য সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়েছে, কয়েক লাখ সরকারি কর্মচারী বেতন পাননি, আর বিমান চলাচল ব্যবস্থাও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।

৬০–৪০ ভোটে পাস হওয়া এই প্রস্তাবে প্রায় সব রিপাবলিকান সিনেটর ও আট ডেমোক্র্যাট সিনেটর সমর্থন দেন। যদিও ডেমোক্র্যাটরা সরকারে অর্থায়নের সঙ্গে বছরের শেষে মেয়াদোত্তীর্ণ হতে যাওয়া স্বাস্থ্য ভর্তুকি যুক্ত করতে চেয়েছিলেন, সেটি গৃহীত হয়নি। সমঝোতা অনুযায়ী ডিসেম্বর মাসে এই ভর্তুকি নিয়ে ভোট হবে, তবে তা বহাল থাকবে কি না, তার নিশ্চয়তা নেই।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, নতুন চুক্তির মাধ্যমে ১ অক্টোবর মেয়াদোত্তীর্ণ ফেডারেল সংস্থাগুলোর অর্থায়ন পুনরায় চালু হবে। একই সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ফেডারেল কর্মীসংখ্যা কমানোর পরিকল্পনাও অন্তত ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত স্থগিত থাকবে। বিলটি এখন রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নকক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভস বা প্রতিনিধি পরিষদে যাবে। স্পিকার মাইক জনসন জানিয়েছেন, তিনি বুধবারের মধ্যেই এটি পাস করিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে পাঠাতে চান। ট্রাম্প চুক্তিটিকে ‘খুব ভালো’ বলে প্রশংসা করেছেন।

এই সমঝোতায় সরকারের অর্থায়ন ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হবে। ফলে আপাতত যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকার বছরে প্রায় ১ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলার নতুন ঋণ যোগ করে ৩৮ ট্রিলিয়ন ডলারের মোট ঋণের পথে এগিয়ে যাবে।

চুক্তিটি এমন এক সময় হলো, যখন ডেমোক্র্যাটরা নিউ জার্সি, ভার্জিনিয়া এবং নিউ ইয়র্ক সিটিতে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে জয় পেয়েছে। তবে এই সমঝোতায় ডেমোক্র্যাটদের একাংশের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। তাদের অভিযোগ, এতে স্বাস্থ্য ভর্তুকি চালু রাখার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সিনেটের ডেমোক্র্যাট নেতা ডিক ডারবিন বলেন, ‘আমরা আরও কিছু করতে চেয়েছিলাম। সরকার বন্ধ হওয়াকে আমরা ভালো নীতির পথে নেওয়ার সুযোগ ভেবেছিলাম। কিন্তু সেটা হয়নি।’

রয়টার্স–ইপসসের অক্টোবরের শেষ দিকের এক জরিপে দেখা যায়, ৫০ শতাংশ মার্কিন নাগরিক শাটডাউনের জন্য রিপাবলিকানদের দায়ী করেন, আর ৪৩ শতাংশ দায় দেন ডেমোক্র্যাটদের।

এর আগে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একতরফাভাবে কয়েক বিলিয়ন ডলার ব্যয় বাতিল করেছেন এবং লক্ষাধিক ফেডারেল কর্মী ছাঁটাই করেছেন, যা কংগ্রেসের আর্থিক ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ হিসেবে সমালোচিত হয়েছে। এতে পূর্বে কংগ্রেস অনুমোদিত ব্যয় আইনও ভঙ্গ হয়েছে। তাই অনেক ডেমোক্র্যাট এখন প্রশ্ন তুলছেন, ভবিষ্যতে এমন কোনো ব্যয় চুক্তিতে তারা কেন ভোট দেবেন।

চুক্তিতে ট্রাম্পের ভবিষ্যৎ ব্যয় কমানোর পদক্ষেপ ঠেকানোর কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। তবে এতে স্ন্যাপ (SNAP) খাদ্য সহায়তা কর্মসূচির অর্থায়ন আগামী বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিশ্চিত করা হয়েছে, যাতে সরকার আবার বন্ধ হলেও এই সহায়তা ব্যাহত না হয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

বিহার বিধানসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় দফার ভোটগ্রহণ চলছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
বিহারে বিধানসভা নির্বাচনে দ্বিতীয় দফার ভোটগ্রহণের দিনে একটি কেন্দ্রের দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত
বিহারে বিধানসভা নির্বাচনে দ্বিতীয় দফার ভোটগ্রহণের দিনে একটি কেন্দ্রের দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত

বিহারে বিধানসভার নির্বাচনের দ্বিতীয় দফার ভোটগ্রহণ আজ মঙ্গলবার সকালে শুরু হয়েছে। রাজ্যের বিভিন্ন জেলার ১২২টি আসনে ভোটগ্রহণ চলছে। এ দফায় মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমারের মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য নির্বাচনী লড়াইয়ে রয়েছেন। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

বিরোধী দলগুলোর জোট মহাগাঠবন্ধন বা মহাজোটে ভাঙনের খবর ছড়ালেও বিকাশশীল ইনসান পার্টির প্রধান ও উপমুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী মুকেশ সাহানি সে খবর পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন। এই পর্বকে বিজেপি নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স বা এনডিএ–এর ছোট অংশীদারদের জন্য শক্তি পরীক্ষার লড়াই হিসেবে দেখা হচ্ছে। জিতন রাম মাঞ্জির নেতৃত্বাধীন হিন্দুস্তানি আওয়াম মোর্চা ও রাজ্যসভার সদস্য উপেন্দ্র কুশওয়াহার নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় লোক মোর্চা—দুটি দলই ছয়টি করে আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।

মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমারের মন্ত্রিসভার নয় মন্ত্রী এই পর্বে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাঁরা হলেন—বিজেন্দ্র প্রসাদ যাদব (সুপৌল), সুমিত কুমার সিং (চাকাই), মোহাম্মদ জামা খান (চেইনপুর), লেশি সিং (ধামদহা), কৃষ্ণ নন্দন পাসওয়ান (হরসিধি), রেণু দেবী (বেতিয়া), নীরজ কুমার বাবলু (ছাটাপুর), নিতীশ মিশ্র (ঝনঝারপুর), প্রেম কুমার (গয়া), শীলা মণ্ডল (ফুলপরাস), বিজয় মণ্ডল (সিকতি) এবং জয়ন্ত রাজ কুশওয়াহা (আমরপুর)।

আজ যেসব জেলায় ভোট হচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে পশ্চিম চম্পারণ, পূর্ব চম্পারণ, সীতামারহি, মধুবনী, সুপৌল, আরারিয়া ও কিষাণগঞ্জ। এসব জেলার সীমানা নেপালের সঙ্গে যুক্ত। এই ভোটপর্বে সীমাঞ্চল অঞ্চলের বহু জেলা অন্তর্ভুক্ত। এখানে মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি বেশি, ফলে এ পর্বটি সরকার ও বিরোধী—দুই জোটের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সবচেয়ে নজরকাড়া আসনের মধ্যে একটি হলো ভাগলপুর জেলার কাহালগাঁও। এখানে চারদলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। মহাগঠবন্ধনের শরিক আরজেডি ও কংগ্রেসের মধ্যে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াই’ দেখা যাবে। লড়াইয়ে রয়েছে শাসক দল জনতা দল ইউনাইটেডও। অন্যদিকে, বিজেপির বর্তমান বিধায়ক পবন কুমার যাদব দল থেকে বিদ্রোহ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।

অন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন রাজ্য কংগ্রেস সভাপতি রাজেশ কুমার, যিনি সংরক্ষিত কুটুম্বা আসন দ্বিতীয়বারের মতো ধরে রাখতে চান। এ ছাড়া প্রার্থী হয়েছেন প্রাক্তন বিধানসভার স্পিকার উদয় নারায়ণ চৌধুরী (আরজেডি), কংগ্রেস বিধায়ক দলনেতা শাকিল আহমেদ খান এবং সিপিআই-এমএল বিধায়ক দলনেতা মেহবুব আলম।

দ্বিতীয় দফার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। প্রায় ৪ লাখ নিরাপত্তা সদস্য দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন। গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত প্রথম দফার ভোটে ৬৫ শতাংশের বেশি ভোটার অংশ নিয়েছিলেন, যা রেকর্ড পরিমাণ ভোটার উপস্থিতি। ভোট গণনা হবে আগামী ১৪ নভেম্বর।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

গণমাধ্যমেই কেবল গাজার ‘গণহত্যা বন্ধ হয়েছে’, বাস্তবে এখনো চলছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১১ নভেম্বর ২০২৫, ০৯: ৩০
গাজায় পানি সংগ্রহ করতে যাওয়া এক শিশু। যার কাঁধে এখনই জীবনের বোঝা উঠে গেছে। ছবি: এএফপি
গাজায় পানি সংগ্রহ করতে যাওয়া এক শিশু। যার কাঁধে এখনই জীবনের বোঝা উঠে গেছে। ছবি: এএফপি

গাজায় যুদ্ধবিরতির এক মাস পেরিয়ে গেলেও ফিলিস্তিনিদের জীবনে কোনো পরিবর্তন আসেনি। গাজা সিটির শুজাইয়া এলাকার বাসিন্দা মানার জেন্দিয়া এখনো বাস্তুচ্যুত। পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন দেইর আল-বালাহ এলাকায়।

জেন্দিয়া বলেন, যুদ্ধবিরতি শুরু হয়েছে ১১ অক্টোবর, কিন্তু তাঁর এলাকার বেশির ভাগ অংশ এখনো ইসরায়েলি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। তিনি বলেন, ‘চুক্তির দুই সপ্তাহ পরই আমাদের আশ্রয় নেওয়া জায়গায় ভয়াবহ বোমাবর্ষণ হয়। আমার বোন তখন সেখানেই মারা যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘ওর স্বামী যুদ্ধের শুরুতেই মারা গিয়েছিল। সন্তানদের একাই লালনপালন করছিল। গাজা শহরে যখন হামলা বেড়ে গেল, তখন সন্তানদের নিয়ে মাঝ গাজায় একটি তাঁবুতে আশ্রয় নেয়। কিন্তু সেখানেই ও মারা গেল। এখন ওর সন্তানদের মা-বাবা কেউ বেঁচে নেই।’

জেন্দিয়ার মতো অনেক ফিলিস্তিনি মনে করে, যুদ্ধবিরতির পরও গণহত্যা থামেনি। তিনি বলেন, ‘গণহত্যা শুধু গণমাধ্যমে থেমেছে। তারা (গণমাধ্যম) কথা বলা বন্ধ করেছে, কিন্তু আমাদের জন্য এটা এখনো চলছে।’

গাজায় এখনো ইসরায়েলি বাহিনীর হামলা চলছে। প্রায় প্রতিদিন গাজা উপত্যকার বিভিন্ন স্থানে বাড়িঘর ধ্বংস হচ্ছে। গোলাগুলি ও গুলিবর্ষণে সাধারণ মানুষ নিহত হচ্ছে। আকাশে ড্রোন ঘুরছে, বাজছে আতঙ্ক ছড়ানো শব্দ। ইসরায়েলি অবরোধের কারণে খাদ্য ও ওষুধের সংকটও আগের মতোই রয়েছে। দিনে গড়ে মাত্র ১৫০টি ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশ করতে দেওয়া হয়, যেখানে চুক্তিতে ছিল ৬০০টি। তার বেশির ভাগেই অপ্রয়োজনীয় খাদ্য ও ওষুধ, জরুরি জিনিসপত্র এখনো মজুত ঘাটতিতে।

যুদ্ধবিরতির পরও ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় অন্তত ২৪২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, তাদের মধ্যে বহু শিশু রয়েছে। এ ছাড়া রাফাহ সীমান্ত এখনো বন্ধ। ফলে গুরুতর আহত ব্যক্তিদের মিসরে নেওয়া যাচ্ছে না।

জেন্দিয়া জানান, তিনি তাঁর স্বামীকে হারিয়েছেন প্রথম বছরের ‘আটা হত্যাকাণ্ডে’। সেদিন ত্রাণের জন্য অপেক্ষারত সাধারণ মানুষের ওপর ইসরায়েলি সেনারা গুলি চালিয়েছিল। এখন তিনি তিন সন্তান ও শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের নিয়ে গাজা শহরের এক স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘দেইর আল-বালাহের পূর্ব দিকে ছিলাম। যুদ্ধবিরতি শুরু হলে ভাবলাম, গাজা শহর বা এখানে—যেখানেই থাকি, তাঁবুতেই থাকতে হবে। তাই থাকা ঠিক করেছিলাম। কিন্তু প্রতিদিন সকালে বোমা পড়ত। নিরাপত্তা পাইনি। তাই শহরের কেন্দ্রে চলে এসেছি।’

তবু শান্তি ফেরেনি বলে জানান এই ফিলিস্তিনি নারী। তিনি আরও জানেন, ‘আমি খাবার মজুত করে রাখি। ভয় হয়, আবার অবরোধ কড়াকড়ি হবে, ক্ষুধা ফিরে আসবে। প্রতিদিন সকালে পূর্ব দিক থেকে বিস্ফোরণের শব্দ আসে। প্রতিদিন নতুন হামলা, নতুন লাশ।

যুদ্ধবিরতির মধ্যেও গাজায় এখন নতুন আতঙ্ক—ইসরায়েলি ড্রোন। ৩০ বছর বয়সী আনাস মুঈন বলেন, ‘তিন দিন আগে ড্রোনটা আমার বাড়ির ওপর ঘুরছিল। ওরা যে রেকর্ডিং বাজায়, তাতে ইচ্ছে করেই বিকৃতি আনা হয়। শব্দগুলো স্পষ্ট না, বিকট। মনে হয় ভয় ধরানোর জন্যই এমন করছে।’

আনাস মুঈন বলেন, ‘যুদ্ধবিরতির সময় এসব ড্রোন আমাদের মনে করিয়ে দেয়—সেনারা কাছেই আছে, নজর রাখছে। ওরা বলছে, বন্দীদের দেহ হস্তান্তর করো, ‘যুদ্ধবিরতি মানো। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ, এসব আমাদের দায়িত্ব নয়।’

বাসিন্দারা জানান, এখন দেখা ড্রোনগুলো আগের ছোট কোয়াডকপ্টার নয়। এগুলোর আকার বড়, দেখতে ইসরায়েলের আরএ-০১ মডেলের মতো, কিছুটা পরিবর্তিত নকশায়। মুঈন বলেন, ‘এগুলো অনেক উঁচুতে ওড়ে, আকারে ত্রিভুজাকার। আগে এমন ড্রোন আত্মঘাতী হামলায় ব্যবহার হতে দেখেছি। এবার এটা ভয় ছড়ানো বার্তা দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, যেকোনো মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।’

ইসরায়েলি ড্রোন এখনো লিফলেট ফেলছে গাজার বিভিন্ন স্থানে। গত রোববারের লিফলেটে হামাসের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো হয়। মুঈন বলেন, ‘মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের পাশাপাশি স্থল হামলাও বেড়েছে।’

১৯ অক্টোবর ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি ভেঙে রাফাহতে বিমান হামলা চালায়। ওই দিন দুই ইসরায়েলি সেনা নিহত হওয়ার পর তারা পাল্টা হামলায় ১০০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে, আহত হয় আরও ১৫০ জন। মুঈন বলেন, ‘ইসরায়েলি সেনারা এখনো গাজার অনেক ভেতরে অবস্থান করছে। সামরিক যান আমার বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটারের মধ্যেই, অথচ আমি শহরের কেন্দ্রেই থাকি।’

মুঈন যোগ করেন, ‘এগুলো কেবল মাঝেমধ্যে হামলা নয়, প্রতিদিনের রুটিন। বিমান হামলা, গোলাবর্ষণ আর এত গুলিবর্ষণ হয় যে একে প্রায় উন্মত্ত বলা যায়। কখনো দেখা যায়, এক সৈন্য টানা ১৫ মিনিট গুলি চালিয়ে যাচ্ছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত