Ajker Patrika

যুক্তরাষ্ট্রই যেভাবে ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙক্ষার বীজ বপন করেছিল

অনলাইন ডেস্ক
স্যাটেলাইট থেকে ইরানের নাতানজ পরমাণু কেন্দ্র। ছবি: সংগৃহীত
স্যাটেলাইট থেকে ইরানের নাতানজ পরমাণু কেন্দ্র। ছবি: সংগৃহীত

ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আজ যে আলোচনা ও সংঘাত, সেটার সূত্রপাতই হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাত ধরে। আবার সেই যুক্তরাষ্ট্রই এখন ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ঘোরতর বিরোধী। ইরানের পরমাণু কর্মসূচির সূত্রপাত ১৯৬০ এর দশকে। সে সময় মার্কিন বিজ্ঞানীরা তেহরানে পারমাণবিক চুল্লি (রিয়্যাক্টর) বসাতে সহায়তা করেছিলেন।

সে সময় ইরানে পরমাণু চুল্লি স্থাপন করা হয়েছিল ‘শান্তির জন্য পারমাণবিক শক্তি’—এই স্লোগানের অধীনে। কিন্তু কয়েক দশক পর, ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প এখন যুক্তরাষ্ট্রের চোখে হুমকি হয়ে উঠেছে। আর সেই হুমকি ঠেকাতে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে বোমা বর্ষণ করেছে মার্কিন যুদ্ধবিমান।

এই পুরো কাহিনির শুরু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দশক পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডুইট ডি আইজেনহাওয়ারের ‘অ্যাটমস ফর পিস’ বা ‘শান্তির জন্য পারমাণবিক শক্তি’ কর্মসূচির মাধ্যমে। ওই কর্মসূচির আওতায় যুক্তরাষ্ট্র মিত্রদের সঙ্গে বেসামরিক পারমাণবিক প্রযুক্তি শেয়ার করত। সে সময় ইরান ছিল পশ্চিমাপন্থী, ‘ধর্মনিরপেক্ষ ও আধুনিকায়নের প্রতি আগ্রহী’ এক আদর্শ মিত্র। ইরানের শাসক শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। সে সময় ইরান ছিল মার্কিন শিবিরের কমিউনিস্ট বিরোধী এক পক্ষ।

যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক আরও মজবুত করতে তেহরান রিসার্চ রিয়্যাক্টর বসাতে সাহায্য করে। ইরানিরা মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ করে এমআইটিতে প্রশিক্ষণ নেয়। ইউরোপীয় মিত্রদের সঙ্গে পারমাণবিক প্রযুক্তি বিনিময়ের পথও খুলে দেয় যুক্তরাষ্ট্র।

ওয়াশিংটনের দৃষ্টিতে, এটি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব ঠেকানো, নিজের প্রভাব বিস্তার এবং পারমাণবিক শক্তির ‘উদার’ ব্যবহার দেখানোর কৌশল। কিন্তু বাস্তবে, এটি ইরানের ভেতরে একটি পূর্ণাঙ্গ পারমাণবিক অবকাঠামোর ভিত গড়ে দেয়, যা শাহের পতনের বহু বছর পরও টিকে যায়।

এই বিষয়ে সাবেক মার্কিন অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা এবং বর্তমানে ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের গবেষক রবার্ট আইনহর্ন বলেন, ‘আমরাই ইরানকে পারমাণবিক প্রযুক্তির হাতেখড়ি দিয়েছিলাম। তখন পারমাণবিক (অস্ত্র) বিস্তারের বিষয়ে আমরা অতটা উদ্বিগ্ন ছিলাম না। তাই যথেষ্ট উদারভাবে আমরা প্রযুক্তি সরবরাহ করেছিলাম।’

আসলে, তখন দুশ্চিন্তা ছিল না যে, ইরান ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি নিয়ে কী করবে, বরং ভয় ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের। শাহের আমলে ইরানের উচ্চাকাঙ্ক্ষা আরও বাড়ে। প্রচুর তেল থাকা সত্ত্বেও ইরান নিজেকে পারমাণবিক শক্তিতে পরিণত করতে চেয়েছিল—সেটা ছিল প্রতীকী মর্যাদা ও বাস্তব ক্ষমতার ইঙ্গিত। ফ্রান্স ও জার্মানি কয়েক বিলিয়ন ডলারের পারমাণবিক রিয়্যাক্টর চুক্তি করে ইরানের সঙ্গে।

সে সময় মার্কিন গণমাধ্যমেও বিজ্ঞাপন চলত, যেখানে শাহের ‘দায়িত্বশীল’ পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের প্রশংসা করা হতো। কিন্তু এর আড়ালে ওয়াশিংটনের গোয়েন্দাদের উদ্বেগ বাড়তে থাকে। বিশেষ করে, ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার ইচ্ছা, যা পারমাণবিক অস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ উভয় কাজে লাগতে পারে, সেটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয় যুক্তরাষ্ট্র। যদিও সেটা ছিল এনপিটি বা পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির অধীনে আইনসিদ্ধ।

১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর কিছু বিধিনিষেধ চাপানোর চেষ্টা করে। পারমাণবিক চুক্তিতে পরিবর্তন আনা হয়, জ্বালানির সরবরাহে শর্ত দেওয়া হয়। কিন্তু তত দিনে ইরানের ভেতরে পারমাণবিক অবকাঠামো অনেকটাই গড়ে উঠেছে।

এরপর আসে ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লব। শাহের পতন ঘটে, ক্ষমতায় আসে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী ধর্মীয় সরকার। এক রাতেই ধ্বংস হয় যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্ক। প্রথমদিকে নতুন সরকার পারমাণবিক প্রকল্প নিয়ে আগ্রহী ছিল না। কারণ, এটা ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল, পশ্চিমা প্রযুক্তিনির্ভর এবং শাহ সরকারের প্রতীক। আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি এ প্রকল্পে খুব একটা মূল্য দেখেননি।

কিন্তু ১৯৮০-এর দশকের ইরান-ইরাক যুদ্ধ চিত্রটাই বদলে দেয়। সেই যুদ্ধের সময় রাসায়নিক অস্ত্র ও ব্যাপক প্রাণহানি ইরানের নেতাদের জাতীয় নিরাপত্তা ভাবনায় বড়সড় ধাক্কা দেয়। পারমাণবিক প্রযুক্তি তখন আর বিলাসিতা নয়, বরং একটি শক্ত প্রতিরোধের উপায় হয়ে ওঠে। তবে এবার প্রযুক্তির জোগানদাতা ছিল না যুক্তরাষ্ট্র।

ইরান এবার মুখ ঘুরিয়ে নেয় পাকিস্তানের দিকে। সেখানে পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচির জনক আব্দুল কাদের খান ইরানকে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার যন্ত্রপাতি ও নকশা সরবরাহ করেন। এই প্রযুক্তি আসলে ইউরোপ থেকে চুরি করা ডিজাইনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। এভাবেই ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে প্রথম বাস্তব পদক্ষেপ নেয়।

কিন্তু এই যে ইরান এত সহজে প্রযুক্তি শিখে নিতে পারল, তার ভিত্তিটা তৈরি করে গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রই, বহু বছর আগে। ২০০০-এর দশকের শুরুতে গোটা বিশ্ব জানতে পারে ইরানের গোপন ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের কথা। তেহরান দাবি করে, এটা এনপিটির অধীনে তাদের আইনসিদ্ধ অধিকার। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা সে যুক্তি মানেনি।

এরপরই শুরু হয় তীব্র সংকট—সংঘর্ষ, নিষেধাজ্ঞা, গুপ্ত হামলা আর ছায়াযুদ্ধ। ২০১৫ সালে যখন পারমাণবিক চুক্তি বা জেসিপিওএ স্বাক্ষরিত হয়, তখন মনে হয়েছিল, সংকট কিছুটা কমছে। কিন্তু ২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসন চুক্তি থেকে বেরিয়ে এলে আবার উত্তেজনা বাড়ে। তারই পরিণতিতে যুক্তরাষ্ট্র এমন আক্রমণে নামে, যা মূলত ধ্বংস করতে চায় সেই পারমাণবিক সক্ষমতা, যেটি একসময় তারাই তৈরি করে দিয়েছিল।

তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা ও এনডিটিভি

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত