Ajker Patrika

ট্রাম্প যুদ্ধে জড়ালে মধ্যপ্রাচ্যে দোজখ নেমে আসবে, ইরানের হুঁশিয়ারি

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৯ জুন ২০২৫, ২৩: ৩৭
বিবিসির সাক্ষাৎকারে ইরানের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাঈদ খতিবজাদ। ছবি: বিবিসি
বিবিসির সাক্ষাৎকারে ইরানের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাঈদ খতিবজাদ। ছবি: বিবিসি

ইরান-ইসরায়েল সরাসরি সংঘাতের এক অতি সংকটময় মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রকে কড়া বার্তা দিয়েছে ইরান। তেহরান হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে জড়ালে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘অপ্রত্যাশিত যুদ্ধের জনক’ হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত হবেন। এতে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে ‘দোজখ’ নেবে আসবে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে দেওয়া এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে ইরানের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী সাঈদ খতিবজাদে এই সতর্কবার্তা দেন। তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, এটি কোনোভাবেই আমেরিকার যুদ্ধ নয়। কিন্তু তারা যদি এতে ঢুকে পড়ে, তবে অপরের যুদ্ধে জড়ানোর জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে স্মরণ করা হবে। আর এ যুদ্ধ গোটা অঞ্চলের জন্য দোজখ নামিয়ে আনবে।’

গত সপ্তাহে ইসরায়েলের আকস্মিক হামলায় ইরানের একাধিক সামরিক কমান্ড পোস্ট, পরমাণু স্থাপনা এবং বেসামরিক এলাকায় ক্ষয়ক্ষতি ঘটে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ইরান ‘অপারেশন ট্রু প্রমিসের’ আওতায় ধারাবাহিক পাল্টা হামলা শুরু করে। সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী, হামলার ১৫তম ধাপে একযোগে তেল আবিব ও হাইফায় ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালানো হয়েছে।

এই যুদ্ধ পরিস্থিতির মাঝেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভূমিকা ঘিরে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ বাড়ছে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, ট্রাম্প ইতিমধ্যে ইরানে হামলার পরিকল্পনায় সম্মতি জানালেও তা বাস্তবায়নে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেননি।

‘আলোচনার পথে আমরা প্রস্তুত ছিলাম’

বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী খতিবজাদে বলেন, ‘আমরা কূটনীতির পথে এগোচ্ছিলাম। অসলোতে আমরা যখন একত্রে বসেছিলাম, তখন ওমানে ষষ্ঠ দফার পরমাণু আলোচনা নির্ধারিত ছিল। আমরা চূড়ান্ত সমঝোতার দ্বারপ্রান্তে ছিলাম, এমন মুহূর্তেই ইসরায়েল হামলা চালিয়ে পুরো প্রক্রিয়াটি বানচাল করে দেয়।’

খতিবজাদে আরও জানান, ইসরায়েলের এই আগ্রাসনের শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একাধিক মধ্যপ্রাচ্য নেতা ও দূত মারফত গোপন বার্তা পাওয়া যাচ্ছে। বার্তাগুলোতে বলা হচ্ছে, ‘আমরা (যুক্তরাষ্ট্র) এই হামলার সঙ্গে জড়িত নই এবং এতে জড়াতে চাই না।’ তবে ট্রাম্পের প্রকাশ্য বক্তব্যগুলো এসব গোপন বার্তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেই মনে করছেন তেহরান।

হোয়াইট হাউসে আলোচনার গুঞ্জন উড়িয়ে দিল তেহরান

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সম্প্রতি দাবি করেন, ইরান আলোচনার জন্য হোয়াইট হাউসে আসতে চায়। এ বিষয়ে খতিবজাদে বলেন, ‘আমরা স্পষ্ট করে বলেছি, এমন কোনো বার্তা আমরা দিইনি। বরং যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রথম ঘণ্টা থেকেই যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের দায়মুক্ত প্রমাণে ব্যস্ত। তারা চাইছে আলোচনার বার্তা ছড়িয়ে দিয়ে নিজেদের শান্তিপ্রিয় হিসেবে তুলে ধরতে।’

ট্রাম্প আরও বলেন, ‘আমরা গোপনে কোনো দরজা ঠেলে হোয়াইট হাউসে যেতে চাই না। আলোচনার ক্ষেত্র তৈরির দায় প্রথমে সেই পক্ষের, যারা আগ্রাসন করেছে।’

পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে প্রশ্নের জবাব

আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা সম্প্রতি জানায়, ইরান ৬০ শতাংশ মাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুত করেছে, যা অস্ত্র-উপযোগী (৯০ শতাংশ) ইউরেনিয়ামে পৌঁছানোর এক ধাপ আগেই থেমে আছে। এই প্রসঙ্গে খতিবজাদে বলেন, ‘৬০% সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম থাকলেই কেউ পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে, এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো ভিত্তিহীন ও বিভ্রান্তিকর। শুধু সন্দেহ ও অনুমানের ওপর ভিত্তি করে যুদ্ধ শুরু করা যায় না।’

খতিবজাদে জোর দিয়ে বলেন, ‘আমরা কখনো পারমাণবিক বোমা তৈরি করিনি এবং করবও না। আমরা পরমাণু শক্তি ব্যবহার করি শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে। যদি আমরা বোমা বানাতে চাইতাম, বহু আগেই বানিয়ে ফেলতাম।’

‘দখলদারদের অঘোষিত পরমাণু’ ও আন্তর্জাতিক নীরবতা

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ইরান বারবার বলেছে, যে রাষ্ট্র নিজেই শত শত পরমাণু অস্ত্রের গোপন ভান্ডার গড়ে তুলেছে এবং পরমাণু অস্ত্র বিস্তারের আন্তর্জাতিক চুক্তি এনএফটির সদস্য নয়, তারা কীভাবে অন্য রাষ্ট্রের বৈধ পরমাণু কার্যক্রমকে লক্ষ্যবস্তু বানায়?

খতিবজাদে বলেন, আজ ইসরায়েল যেভাবে আক্রমণ করেছে, তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। কারণ, এর মাধ্যমে একটি বিপজ্জনক নজির তৈরি হলো—এখন থেকে যে কেউ যে কারও পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালাতে পারে।

‘আমরা আত্মরক্ষায় লিপ্ত, আগ্রাসনে নয়’

ইরানের বিরুদ্ধে হাসপাতাল ও বেসামরিক স্থাপনায় হামলার অভিযোগ তুলেছে ইসরায়েল। এ প্রসঙ্গে খতিবজাদে বলেন, ‘আমরা কখনো বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাইনি। আমাদের প্রতিটি হামলা ছিল প্রতিরক্ষামূলক এবং সুনির্দিষ্ট সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ইসরায়েল আমাদের হাসপাতাল, আবাসিক ভবন, পরমাণুবিজ্ঞানী এবং সামরিক ঘাঁটিতে হামলা করেছে। এই অবস্থায় আলোচনার কথা বলা অন্যায়।’

‘যুদ্ধের আগুন নেভাতে হলে আগ্রাসন বন্ধ করতে হবে’

জেনেভায় অনুষ্ঠেয় ‘E3 +1’ বৈঠক নিয়ে ইরানের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করে খতিবজাদে বলেন, ‘আমরা সব সময় কূটনীতি ও সংলাপের পক্ষে ছিলাম, আছি। কিন্তু যুদ্ধ থামানোর দায় প্রথমে সেই পক্ষের, যারা এই সংঘাতের সূচনা করেছে। যেহেতু ইসরায়েল আগ্রাসন অব্যাহত রেখেছে, তাই আত্মরক্ষাও অব্যাহত থাকবে।’

খতিবজাদে সতর্ক করেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যদি এই যুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে পড়ে, তবে এটি শুধু ইরান-ইসরায়েল নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে একটি বিস্ফোরক ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেবে।’

খতিবজাদের ভাষায়, ‘ট্রাম্প চাইলেই এখনো আলোচনার পথে ফিরতে পারেন, যদি ইসরায়েলকে থামানোর সাহস দেখান। কিন্তু তিনি যদি যুদ্ধকে অনুমোদন দেন, তবে ইতিহাসে এই যুদ্ধ তাঁর নামেই লেখা থাকবে—এমন এক যুদ্ধ, যা মধ্যপ্রাচ্যে দোজখ নামিয়ে আনবে।’

বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে একটিমাত্র ভুল সিদ্ধান্ত গোটা অঞ্চলে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। আর সে সিদ্ধান্তের কেন্দ্রে রয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এখন দেখার বিষয়, তিনি ‘দোজখের রাস্তায়’ হাঁটবেন, নাকি ফিরে আসবেন আলোচনার পথে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত